মধ্যস্থ

নোটপত্র গোছানো, জামাকাপড় কাঁচা আর যন্ত্রপাতি পরিষ্কারের কাজ শেষ হতে হতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নেমে গেল। পিয়া ঠিক করল এখনই শুয়ে পড়বে। রাতের খাওয়ার জন্য আর অপেক্ষা করবে না। এরপরে কবে আবার কপালে একটা বিছানা জুটবে তার তো কোনও ঠিক নেই। তাই আজকে রাতে এই বিছানাটার সদ্ব্যবহার করাই ভাল। যতটা পারা যায় ঘুমিয়ে নেবে ও। কানাই ছাদের স্টাডিতে পড়াশোনা করছে, ওকে আর খামখা ডিস্টার্ব করার দরকার নেই। এক গ্লাস ওভালটিন গুলে নিয়ে নীচে ফাঁকায় নেমে এল পিয়া।

চাঁদ উঠে গেছে অনেকক্ষণ। রুপোলি আলোয় পিয়া দেখতে পেল নীলিমা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মনে হল কী যেন একটা গভীর চিন্তায় ডুবে আছে। পিয়ার পায়ের শব্দ পেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল।

এক হাতে ওভালটিনের গ্লাস, অন্য হাতটা দিয়ে বাতাসে ঢেউয়ের মতো একটা আঁক কাটল পিয়া : “হ্যালো।”

জবাবে একটু হাসল নীলিমা। কী যেন বলল বাংলায়। খানিকটা আপশোসের সুরে পিয়া বলল, “সরি। বুঝতে পারলাম না।”

“আরে, তাই তো,”নীলিমা বলল। “আমারই তো সরি বলা উচিত। বার বার খালি ভুলে যাই আমি। আসলে তোমার চেহারাটার জন্যই একটুও খেয়াল থাকে না আমার। খালি নিজেকে মনে করাতে থাকি যাতে বাংলা না বলি তোমার সঙ্গে, তাও ঠিক বেরিয়ে যায় মুখ ফসকে।”

হাসল পিয়া। “আমার মা বলত বাংলা ভাষাটা না-জানার জন্য একদিন দুঃখ করব আমি। মনে হয় ঠিকই বলত মা।”

“কিন্তু একটা কথা বলো তো বাছা,” নীলিমা বলল, “জানতে ইচ্ছে করছে বলেই জিজ্ঞেস করছি–তোমার বাবা-মা কেন তোমাকে কখনও বাংলা শেখাতে চেষ্টা করেননি?”

“মা একটু চেষ্টা করেছিল,” বলল পিয়া। “আমারই বিশেষ আগ্রহ ছিল না। আর বাবার কথা যদি বলেন, তা হলে মনে হয় বিষয়টা নিয়ে বাবার নিজের মনেই একটু সন্দেহ ছিল।

“সন্দেহ? তোমাকে বাংলা শেখানোর ব্যাপারে?”

“হ্যাঁ,” পিয়া বলল। “পুরো গল্পটা একটু কমপ্লিকেটেড। আসলে আমার ঠাকুরদা-ঠাকুরমাও ছিলেন প্রবাসী বাঙালি–বার্মায় থাকতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেখানকার ঘরবাড়ি ছেড়ে ওদের দেশে ফিরে আসতে হয়েছিল। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে বড় হবার ফলে প্রবাসী বা উদ্বাস্তুদের বিষয়ে নিজের মতো করে কয়েকটা থিয়োরি তৈরি করে নিয়েছিল বাবা। বাবার ধারণা হল ভারতীয়রা বিশেষ করে বাঙালিরা কখনওই ভাল পর্যটক হতে পারে না। কারণ তাদের চোখ সব সময় ফেরানো থাকে পেছন দিকে ঘরের দিকে। তাই যখন আমরা আমেরিকায় গেলাম, বাবা ঠিক করল যে এই ভুল করবে না। সে দেশের মতো করেই খাপ খাইয়ে নেবে নিজেকে।”

“তাই উনি তোমার সঙ্গে সব সময় ইংরেজিতে কথা বলতেন?”

“হ্যাঁ,” পিয়া বলল। “আর এর জন্যে অনেকটাই ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল বাবাকে, সেটা ভুললে চলবে না। কারণ ইংরেজি ভাষাটা খুব ভাল বলতে পারত না বাবা। এখনও, এই এতদিন বিদেশে থাকার পরেও পারে না। বাবা পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, ফলে কথা যখন বলে ইংরেজিটা খানিকটা যেন কন্সট্রাকশন ম্যানুয়েলের মতো শোনায়।”

“তোমার মায়ের সঙ্গে কী ভাষায় কথা বলতেন উনি?”

“নিজেদের মধ্যে বাবা-মা বাংলাই বলত,” হেসে বলল পিয়া। অবশ্য যখন ওরা কথা বলত। আর দু’জনের মধ্যে কথা যখন বন্ধ থাকত তখন আমিই ছিলাম ওদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। তবে এই বার্তাবাহকের কাজ করার সময় বাবা-মাকে ইংরেজিতে কথা বলতে বাধ্য করতাম আমি–তা না হলে কিছুতেই খবর পৌঁছে দিতাম না।”

কোনও জবাব দিল না নীলিমা। একটু অস্বস্তি হল পিয়ার। ভুল করে কোনও বেফঁস কথা বলা হয়ে গেল নাকি? কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই নিজের আঁচলের কোনাটা ধরে মুখের কাছে নিয়ে গেল নীলিমা। দু’চোখে টলটল করছে জল।

“আই অ্যাম সরি,” তাড়াতাড়ি বলল পিয়া। “আমি কি অন্যায় কিছু বলে ফেলেছি?”

“না বাছা। অন্যায় কিছু বলনি। আমি খালি তোমার ছোটবেলার কথা ভাবছিলাম–কেমন করে বাবা-মার কথাগুলো পৌঁছে দিতে পরস্পরের কাছে। স্বামী-স্ত্রী যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলতে পারে না সেটা যে কত দুঃখের কথা সে তোমাকে কী বলব বাছা। তাও তো তুমি ছিলে তোমার বাবা-মার মাঝখানে। যদি কেউ না থাকত তা হলে–”

কথাটা শেষ করল না নীলিমা। থেমে গেল আবার। পিয়া বুঝতে পারছিল ব্যক্তিগত কোনও ব্যথার জায়গায় ছুঁয়ে ফেলেছে না বুঝে। নীলিমার ধাতস্থ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল চুপ করে।

“আমাদের বাড়িতে তো ছেলেপুলে বলতে ওই কানাই-ই একবার এসে ছিল কিছুদিনের জন্য,” অবশেষে বলল নীলিমা। “আমার স্বামীর কাছে সেইটুকুই যে কতখানি ছিল সেটা আগে আমি কল্পনাও করতে পারিনি। শুধু নিজের কথাগুলো কাউকে বলে যাওয়ার জন্যেই যে কী আকুলতা ছিল মানুষটার, কী বলব। তারপরেও কত বছর ধরে যে আমাকে বলেছে, কানাইটা যদি আবার এসে কিছুদিন থাকত। আমি মনে করিয়ে দিতাম, কানাই তো আর ছোটটি নেই, বড় হয়ে গেছে। তারও নিজের কাজকর্ম আছে। কিন্তু তাতে কিছু এসে যেত না আমার স্বামীর। কতবার যে চিঠি লিখেছে কানাইকে, এখানে আসার জন্য।”

“কানাই আসেনি?”

“নাঃ,” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল নীলিমা। “ও তখন খুবই ব্যস্ত। ব্যবসায় উন্নতি করছে। তার দামটাও তো দিতে হবে। নিজের জন্যে ছাড়া আর কারও জন্যেই সময় ছিল না ওর। নিজের মা-বাবার জন্যেও না। আমাদের কথা তো ছেড়েই দাও।”

“ও কি সব সময়ই এই রকম?” পিয়া জিজ্ঞেস করল। “এই রকম উদ্যমী?”

“কেউ কেউ বলে স্বার্থপর,” জবাব দিল নীলিমা। “আসলে কানাইয়ের মুশকিলটা কী জানো তো? ও সব সময়ই একটু বেশি চালাক। সব কিছু খুব সহজেই হাতে এসে গেছে তো, তাই বেশির ভাগ মানুষের কাছে দুনিয়াটা যে কী রকম সে বোধটাই ওর কখনও হয়নি।”

পিয়া বুঝতে পারল তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী নীলিমা ঠিকই চিনেছে তার ভাগ্নেকে। কিন্তু সে ধারণাটা প্রকাশ না করাই ভাল মনে হল। ভদ্রতা রাখতে বলল, “আমি তো ওকে সামান্যই দেখেছি, আমি আর কী বলব?”

“ঠিকই,” বলল নীলিমা। “তবে তোমাকে একটু সাবধান করে দিই বাছা। আমার ভাগ্নেকে আমি ভালবাসি ঠিকই, কিন্তু একটা কথা আমার বলে দেওয়া উচিত যে কানাই হল সেই ধরনের মানুষ যারা মনে করে যে মেয়েরা তাদের কাছাকাছি এলেই প্রেমে একেবারে হাবুডুবু খাবে। দুঃখের বিষয় হল পৃথিবীতে বোকা মেয়ের তো অভাব নেই। অনেকেই আছে যারা এই রকম লোকেদের ধারণাকে সত্যি বলে প্রমাণ করে। কানাই মনে হয় সব সময় সেই রকম মেয়েদেরই খুঁজে বেড়ায়। তোমরা কী বল জানি না, আমাদের সময় তো এ ধরনের লোকেদের আমরা বলতাম লম্পট’।” নীলিমা কথা শেষ করল। ভুরু উপরে তুলে জিজ্ঞেস করল, “আমার কথাটা বুঝতে পেরেছ তো?”

“বুঝেছি।”

মাথা নেড়ে শাড়ির আঁচলে নাক মুছল নীলিমা। “যাকগে, আর ভ্যাজর ভ্যাজর করব না। কাল তো তোমার অনেক কাজ, তাই না?”

“হ্যাঁ,” বলল পিয়া। “আমরা সকাল সকালই বেরিয়ে পড়ব। সত্যি, ভাবতেই ভাল লাগছে।”

পিয়ার কাঁধের ওপর একটা হাত দিয়ে ওকে বুকের কাছে টেনে নিল নীলিমা। “শোনো বাছা, খুব সাবধানে থাকবে। জঙ্গল ভয়ংকর জায়গা, মনে রাখবে। আর সব সময় জন্তু জানোয়াররাই যে শুধু ভয়ের কারণ তা কিন্তু নয়।”