অপরাধ

বেশ কয়েকদিন ধরে চলল পুলিশি অবরোধ। পুরো ব্যাপারটাই আমাদের হাতের বাইরে, কিছুই করতে পারছি না, শুধু শুনতে পাচ্ছি নানারকম গুজব–কানে আসছে খুব সাবধানে খরচ করা সত্ত্বেও খাবার-দাবার সব শেষ হয়ে গেছে, খিদের জ্বালায় অনেকে নাকি ঘাস পর্যন্ত খাচ্ছে। সব টিউবওয়েলগুলো ভেঙে দিয়েছে পুলিশ, দ্বীপে কোনও খাওয়ার জল পাওয়া যাচ্ছে না। তেষ্টায় লোকে পুকুর-ডোবার জল খাচ্ছে, ফলে নাকি মারাত্মক কলেরা ছড়িয়ে পড়েছে মরিচঝাঁপিতে।

একদিন অবশেষে উদ্বাস্তুদের একজন পুলিশের চোখ এড়িয়ে পালিয়ে এল। সাঁতরে পার হয়ে গেল গারল নদী–নিঃসন্দেহে খুবই বীরত্বব্যঞ্জক কাজ। কিন্তু তাতেই সে থেমে থাকল না। বহু কষ্ট করে শেষে গিয়ে পৌঁছল কলকাতায়। সেখানকার সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করে তাদের সমস্ত বৃত্তান্ত জানাল। পুরো ব্যাপারটা ফলাও করে ছাপা হল খবরের কাগজে। হুলুস্থুল পড়ে গেল চারদিকে। নাগরিক মঞ্চগুলি নানা জায়গায় আপিল করল, তুমুল হইচই হল বিধানসভায়, শেষে হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়াল ব্যাপারটা। আদালত রায় দিল এভাবে দ্বীপবাসীদের ঘেরাও করে রাখা বেআইনি, অবিলম্বে অবরোধ ওঠাতে হবে সরকারকে।

মনে হল একটা বড় জিত হল উদ্বাস্তুদের। খবরটা যেদিন আমাদের কাছে পৌঁছল, তার পরদিন দেখি বাঁধের কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে হরেন। মুখ ফুটে কিছু বলতে হল না–ঝোলা গুছিয়ে নিয়ে গুটিগুটি গিয়ে চেপে বসলাম ওর নৌকোয়। তারপর রওয়ানা দিলাম।

মনের মধ্যে তখন বেশ একটা ফুরফুরে ভাব। ভাবছি মরিচঝাঁপি গিয়ে নিশ্চয়ই দেখব মোচ্ছব চলছে, সকলে জয়ের আনন্দে মাতোয়ারা। কিন্তু পৌঁছে দেখি চিত্রটা একেবারেই অন্যরকম। এ কয়দিনের ঝড়ের আঘাতটা মারাত্মকভাবে লেগেছে মরিচঝাঁপিতে। তা ছাড়া অবরোধ উঠলেও পুলিশরা কিন্তু চলে যায়নি। এখনও তারা দ্বীপে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে, সকলকে বলছে দ্বীপ ছেড়ে চলে যেতে।

কুসুমকে দেখে তো বুক ফেটে গেল আমার। শুকিয়ে কাঠির মতো হয়ে গেছে শরীর, চামড়া কুঁড়ে বেরিয়ে আসা হাড়গুলো যেন গোনা যায়। এত দুর্বল যে মাদুর ছেড়ে ওঠার ক্ষমতাটুকুও নেই। বরং ফকিরের ওপর দেখা গেল ততটা লাগেনি অবরোধের ধাক্কা–বাচ্চা বলেই হয়তো। ওই দেখাশোনা করছে মায়ের।

দেখেশুনে আমার মনে হল ফকির যাতে খেতে পায় সেইজন্য এই কয়দিন নিজে কিছু খায়নি কুসুম। কিন্তু দেখা গেল ব্যাপারটা অতটা সরল নয়। বেশিরভাগ সময়টাতেই কুসুম ফকিরকে ঘরে আটকে রাখার চেষ্টা করেছে, চারিদিকে থিকথিকে পুলিশের মধ্যে বাইরে যেতে দিতে চায়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও কঁক-ফোকর খুঁজে ফকির মাঝে মাঝেই বেরিয়ে গেছে, কখনও কয়েকটা কাঁকড়া, কখনও বা কিছু মাছ ধরে নিয়ে এসেছে। তার অধিকাংশটা কুসুম ওকেই খাইয়ে দিয়েছে। আর নিজে খেয়েছে একরকমের বুনো শাক–এখানকার লোকেরা তাকে বলে জাদু পালং। প্রথম প্রথম খেতে মন্দ লাগেনি। কিন্তু তারপর বোঝা গেল কী মারাত্মক ছিল সেই শাক। ভয়ানক পেটের গণ্ডগোল হল কুসুমের ওটা খেয়ে। একেই তো কয়েকদিন কোনও পুষ্টিকর খাবার পেটে পড়েনি, তার ওপর এই পেট খারাপ। সেইজন্যই এইরকম দশা দাঁড়িয়েছে কুসুমের।

ভাগ্যিস বুদ্ধি করে কিছু রসদ সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম আমরা খানিকটা চাল ডাল আর তেল। কুসুমের ঝুপড়ির মধ্যে এখন সেগুলি ঠিকমতো গুছিয়ে রাখতে লাগলাম। কিন্তু কুসুম সেসব কিছুই খাবে না। কোনওরকমে মাদুর থেকে উঠে একটা ব্যাগ টেনে তুলল নিজের কাঁধে, হরেন আর ফকিরকে বলল বাকিগুলো তুলে নিতে।

“আরে দাঁড়া দাঁড়া, কী করছিস তুই?” ভীষণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি। “কোথায় যাচ্ছিস এগুলো নিয়ে? এ তো আমরা তোর জন্যে নিয়ে এসেছি।”

“আমি তো এগুলো রাখতে পারব না সার। এখন সব খাবার-দাবার খুব হিসেব করে খরচ করছি আমরা এখানে। এগুলো নিয়ে গিয়ে আমাদের পাড়ার নেতার কাছে জমা করতে হবে এক্ষুনি।”

যুক্তিটা আমি বুঝতে পারলাম। কিন্তু তাও অনেক করে বোঝালাম কুসুমকে–সবকিছু ভাগ করে খাওয়া হচ্ছে বলে যে সমস্তটাই উজাড় করে দিয়ে দিতে হবে তার কোনও মানে নেই। এর থেকে দু’-এক মুঠো চাল ডাল আলাদা করে রেখে দেওয়াটা কিছু অনৈতিক হবে না। বিশেষ করে ও যখন একটা বাচ্চার মা। তার দেখাশোনাও তো ওকে করতে হবে।

আমরা কাপে করে মেপে খানিকটা চাল ডাল তুলে রাখছি দেখে কাঁদতে শুরু করে দিল কুসুম। ওর সেই চোখের জল দেখে যেন একটা ঝাঁকুনি লাগল আমার আর হরেনের। এত ঝড়ঝঞ্জার মধ্যেও যে কুসুম সাহস আর মনোবল হারায়নি, তাকে এমন করে ভেঙে পড়তে দেখাটা বুকে শেল বেঁধার মতো যন্ত্রণাদায়ক। মায়ের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দু’হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরল ফকির, আর পাশে বসে কুসুমের কাঁধে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল হরেন। আমি বসে রইলাম স্থাণু হয়ে। আমার তো কিছু দেওয়ার নেই এখানে, শুধু মুখের কথা ছাড়া।

“কী হল কুসুম?” জিজ্ঞেস করলাম আমি। “কী ভাবছিস রে?”

“কী জানেন সার,” আঁচলে চোখ মুছে বলল কুসুম, “খিদে-তেষ্টাটা তবু সহ্য হয়, কিন্তু তার চেয়েও বেশি কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে এই ক’দিনে। এই ঝুপড়ির মধ্যে অসহায়ভাবে বসে বসে শোনা–বাইরে পুলিশের দল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, বারবার মাইকে বলছে আমাদের প্রাণের দাম এক কানাকড়িও নয়–সে যে কী ভয়ংকর সে আপনাকে কী বলব। বসে বসে খালি শুনেছি, এই দ্বীপকে রক্ষা করতে হবে গাছেদের জন্য, বন্য পশুদের জন্য। এই দ্বীপ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের সম্পত্তি, ব্যাঘ্র প্রকল্পের অংশ। সারা পৃথিবীর মানুষের পয়সায় এই প্রকল্প চলছে। প্রতিদিন খালি পেটে এখানে বসে বসে কতবার যে এই কথাগুলো শুনতে হয়েছে তার কোনও হিসেব নেই। মনে মনে ভেবেছি কারা এইসব লোক, যারা এত ভালবাসে বনের পশুদের যে তাদের জন্যে আমাদের মেরে ফেলতেও কোনও আপত্তি নেই? তারা কি জানে তাদের নাম করে কী করা হচ্ছে এখানে? কোথায় থাকে এই মানুষেরা? তাদের ঘরে কি ছেলেমেয়ে আছে? মা আছে? বাবা আছে? যত ভেবেছি তত মনে হয়েছে এই গোটা পৃথিবীটাই জন্তু জানোয়ারদের জায়গা হয়ে গেছে; আর আমাদের দোষ, আমাদের অপরাধ যে আমরা মানুষ হয়ে জন্মেছি, যেভাবে সবসময় মানুষ বাঁচার চেষ্টা করেছে, সেভাবে এই জল মাটির ওপর নির্ভর করে বাঁচতে চেয়েছি। সেই বাঁচার চেষ্টাকে যদি কেউ অপরাধ বলে মনে করে তা হলে সে ভুলে গেছে এভাবেই মানুষ বেঁচে এসেছে এতটা কাল মাছ ধরে, জঙ্গল সাফ করে আর সেই জমিতে চাষ করে।”

কথাগুলো শুনে আর ওর ভাঙাচোরা মুখটা দেখে এত খারাপ লাগল আমার–এই অকর্মণ্য সাধারণ ইস্কুল মাস্টারের–যে মাথাটা ঘুরতে শুরু করল হঠাৎ। মাদুরের ওপর চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়তে হল আমাকে।