খোঁজ
ভোরবেলা কেবিন থেকে বেরিয়ে পিয়া দেখল ঘন কুয়াশা যেন মুড়ে রেখেছে মেঘাকে। কেবিনের সামনে থেকে বোটের দুই প্রান্ত দেখা যাচ্ছে না। ডেকের সামনের দিকে এগোতে গিয়ে আরেকটু হলেই কানাইয়ের গায়ের ওপর হুড়মুড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিল ও। একটা চেয়ার নিয়ে বসেছিল কানাই, হাঁটুর ওপরে নোটবই, আর পাশে একটা লণ্ঠন।
“উঠে পড়েছেন এর মধ্যেই?”
“হ্যাঁ।” ক্লান্তভাবে হাসল কানাই। “ঘণ্টা কয়েক আগেই উঠে পড়েছি।”
“সে কী? কেন?”
“আসলে একটা কাজ করছিলাম,” বলল কানাই।
“এত ভোরবেলা?” বিস্ময় গোপন করতে পারল না পিয়া। “এই ভোর রাত্তিরে বিছানা ছেড়ে এসে কাজ করছেন–নিশ্চয়ই খুব ইম্পর্ট্যান্ট কিছু?”
“ইম্পর্ট্যান্ট,” জবাব দিল কানাই। “কাজটা আসলে আপনারই জন্যে। একটা উপহার। চলে যাওয়ার আগে এটা শেষ করে আপনাকে দিয়ে যেতে চাইছিলাম।”
“আমার জন্যে? কী উপহার?” জিজ্ঞেস করল পিয়া।
মাথা নেড়ে হাসল কানাই। মুখটা একটু বাঁকিয়ে বলল, “শেষ হলেই দেখতে পাবেন।”
“শেষ হয়নি এখনও?”
“না। তবে আমি যাওয়ার আগে শেষ হয়ে যাবে,” বলল কানাই।
“ঠিক আছে। পরে কথা হবে তা হলে।” জামাকাপড় ছাড়ার জন্যে কেবিনের দিকে এগোল পিয়া। তারপর দাঁত-টাত মেজে কলা আর ওভালটিন দিয়ে হালকা ব্রেকফাস্ট সেরে যখন আবার বেরিয়ে এল, ততক্ষণে হরেন উঠে পড়ে সারেং-এর ঘরে গিয়ে বসেছে। ফকিরও চলে গেছে ওর ডিঙিতে, নোঙর তোলার তোড়জোড় করছে। হাত বাড়িয়ে ফকিরকে পিঠব্যাগটা দিয়ে দিল পিয়া। ব্যাগের মধ্যে রয়েছে ওর যন্ত্রপাতি, দুটো জলের বোতল আর কয়েকটা নিউট্রিশন বার। তারপর একবার গেল সামনের ডেকে। কানাই তখনও বসে রয়েছে সেই চেয়ারে।
“হয়েছে শেষ?” জিজ্ঞেস করল পিয়া।
“হ্যাঁ।” উঠে দাঁড়িয়ে মোটা ব্রাউনপেপারের একটা বড় এনভেলপ পিয়ার হাতে দিল কানাই। “এই নিন।”
খামটা কানাইয়ের হাত থেকে নিয়ে উলটে পালটে দেখল পিয়া। “এখনও বলবেন না এটার মধ্যে কী আছে?”
“সেটা একটা সারপ্রাইজ,” চোখ নামিয়ে ডেকের দিকে তাকাল কানাই। পা ঘষল তক্তায়। “আর এটার ব্যাপারে আপনার মতামত যদি আমাকে জানাতে চান–খামের। পেছনে আমার ঠিকানা লেখা আছে। আশাকরি লিখবেন।”
“নিশ্চয়ই লিখব কানাই,” বলল পিয়া। “আমরা তো বন্ধু, তাই না?”
“আশা করি।”
পেছন থেকে হরেনের চোখ ওর পিঠটা প্রায় ফুটো করে দিচ্ছে, বুঝতে পারছিল পিয়া। তা না হলে কানাইয়ের গালে আলতো করে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করছিল ওর। বলল, “ভাল থাকুন।”
“আপনিও ভাল থাকুন পিয়া। গুড লাক।”
ঘন কুয়াশার ভারী চাদর ঝুলে আছে জলের ওপর। স্রোতের গতি যেন ধীর হয়ে গেছে তার ওজনে। ফকির জলে বৈঠা ডোবাতেই তরতর করে এগিয়ে গেল ডিঙি, গলুইয়ের সামনে কুয়াশা যেন ফেনিয়ে উঠল উথলানো দুধের মতো। পঁাড়ের কয়েকটা টানেই দৃষ্টির আড়ালে • চলে গেল মেঘা, কয়েক মিনিটের মধ্যেই মিলিয়ে গেল কুয়াশার ভেতর।
ডিঙি এগোতে লাগল ভাটির দিকে। কানাইয়ের দেওয়া খামটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখল পিয়া। মাপ দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেশ কয়েক পাতা কাগজ রয়েছে ভেতরে। পিয়া ঠিক করল এক্ষুনি খুলবে না খামটা। পিঠব্যাগটা নিয়ে ওটাকে তার মধ্যে রেখে পজিশনিং মনিটরটা বের করল। ডিঙিটা ঠিক কোন জায়গায় রয়েছে সেটা বুঝে নিয়ে তারপর কুয়াশাজড়ানো স্বপ্নিল শান্তির মধ্যে গা ভাসিয়ে দিল।
গত কয়েকদিন ধরেই ভটভটির কাপুনি আর ডিজেল ইঞ্জিনের ধকধক শব্দে কেমন অভ্যস্ত হয়ে গেছে শরীর–সে তুলনায় এই শব্দহীন নৌকোযাত্রা অনেক আরামের। নিজের জায়গায় বসে ভাল করে ডিঙিটার দিকে চেয়ে দেখল পিয়া। খসখসে কাঠ আর ছাই-রঙা ছইয়ের দিকে তাকিয়ে মনে হল যেন এই প্রথম ও মন দিয়ে দেখছে ওগুলোকে। খোলের ওপরে পাতা প্লাইউডের তক্তায় আঙুল বোলাল। কাঠের ওপর ছাপা ঝাপসা হয়ে আসা লেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করল; মার্কিনি ডাকবিভাগের থলি কেটে তৈরি বুটিওয়ালা প্লাস্টিক শিটটার দিকে তাকিয়ে দেখল–মনে পড়ল প্লাস্টিকটা দেখে প্রথম যখন চিনতে পেরেছিল, কী ভীষণ অবাক লেগেছিল তখন। জলে ডুবতে ডুবতে বেঁচে যাওয়ার পর যখন এই ডিঙির তক্তার ওপর শুয়েছিল পিয়া, এই সাধারণ ছোটখাটো জিনিসগুলিকে কেমন অদ্ভুত মায়াময় বলে মনে হয়েছিল, কোনও জাদুকরের ভোজবাজির মতো। বাতিলের দল থেকে তুলে আনা এইসব টুকিটাকিগুলোকে সেদিনকার চোখে দেখতে দেখতে পিয়ার মনে হল, এই নৌকোটা নয়, আসলে ওর নিজের চোখই সেদিন জাদুকরি মায়ার সোনার কাঠি ছুঁইয়ে দিয়েছিল এদের গায়ে। এখন কিন্তু জিনিসগুলোকে ওরকম মায়াময় লাগছে না আর, মনে হচ্ছে খুবই সাধারণ সব টুকিটাকি, বহু পরিচিত ঘরোয়া আসবাবের মতো, স্বস্তিকর।
মন থেকে দিবাস্বপ্নের ভাবটা দূর করার জন্য মাথাটাকে একবার ঝাঁকিয়ে নিল পিয়া। উবু হয়ে উঠে বসে ইশারায় একজোড়া বৈঠা চেয়ে নিল ফকিরের কাছ থেকে। ডিঙিটাকে ফকির কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছিল না, তবে আন্দাজ করল ডলফিনরা যেদিক দিয়ে খাবারের খোঁজে যায় সেইরকমই একটা পথের দিকে ওরা চলেছে এখন। জোয়ার পুরো হয়েছে প্রায় ঘণ্টাখানেক হল, ডলফিনগুলো গর্জনতলার দহে এখনও আসেনি। ঠিক কোন জায়গায় ওদের দেখা যাবে ফকির মনে হল সেটা জানে।
নৌকো এখন স্রোতের অনুকুলে চলেছে। দু’জোড়া বৈঠায় জল কেটে তরতর করে এগোচ্ছে সামনে। খানিকক্ষণ পরেই ফকির ইশারায় পিয়াকে জানাল যে গন্তব্যে পৌঁছে গেছে ওরা। দাঁড় তুলে নিয়ে মিনিট কয়েক ডিঙিটাকে বয়ে যেতে দিল ফকির, তারপর একপাশে ঝুঁকে নোঙরটা ছুঁড়ে ফেলল নদীতে। দড়িটাকে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে ছেড়ে দিল জলের মধ্যে।
কুয়াশা পাতলা হয়ে এসেছে। পিয়া লক্ষ করল ডিঙিটাকে ফকির এমন একটা জায়গায় এনে পঁড় করিয়েছে যেখান থেকে একটা বড় খাড়ির পুরো মুখটা চোখে পড়ে। বেশ কয়েকবার সেদিকে ইশারা করল ফকির, যেন বোঝাতে চাইল শিগগিরই ওই পথ দিয়ে ঢুকে আসবে ডলফিনগুলো। দূরবিন চোখে লাগানোর আগে জিপিএস-এ আরেকবার জায়গাটার অবস্থান দেখে নিল পিয়া। দেখল গর্জনতলার কাছে দাঁড় করানো মেঘার থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে চলে এসেছে ওরা।
শুরুতে ফকির যেন খানিকটা গা-ছাড়া ভাবে তাকিয়েছিল খাড়িটার দিকে, প্রায় হেলাফেলার ভাব নিয়ে যেন ও নিশ্চিত জানে ওইদিক থেকেই আসবে ডলফিনগুলো। কিন্তু প্রায় দু’ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন একটা পাখনাও চোখে পড়ল না, একটু যেন দ্বিধায় পড়ে গেল ও। আস্তে আস্তে পালটাতে শুরু করল ওর হাবভাব, আত্মবিশ্বাস যেন চিড় খেয়ে গেল একটু, মুখেচোখে কেমন একটা ভ্যাবাচ্যাকা ভাব।
আরও ঘণ্টা দুয়েক ওই একই জায়গায় অপেক্ষা করল ওরা। দিন পরিষ্কার, বহুদূর পর্যন্ত চোখে পড়ছে, কিন্তু ডলফিনের কোনও চিহ্নই দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে ভাটাও পড়ে গেছে, সূর্য উঠতে শুরু করেছে মাঝ আকাশের দিকে, চড়চড় করে বেড়ে উঠছে রোদ। পিয়ার জামাটা ঘামে একেবারে চুপচুপে হয়ে গেছে। পিয়া খেয়াল করে দেখল ও এখানে আসার পর একদিনও এত সকাল সকাল এতটা গরম পড়েনি।
দুপুরের একটু পরে, জল তখন অনেকটা নেমে গেছে, ফকির নোঙর তুলে ফেলল। যেন বোঝাতে চাইছে এবার এ জায়গা থেকে যেতে হবে। প্রথমটায় পিয়ার মনে হল হাল ছেড়ে দিয়ে আবার গর্জনতলার দিকেই ফিরে যেতে চাইছে ও। কিন্তু পিয়া যখন বৈঠার জন্য হাত বাড়াল, মাথা নাড়ল ফকির। খাঁড়ির যে মুখটার দিকে ওরা সারা সকাল ধরে নজর রেখেছে, সেইদিকে ইঙ্গিত করে দেখাল। দূরবিন নিয়ে পিয়াকে সজাগ থাকতে বলল ইশারায়। ডিঙি ঘুরিয়ে নিয়ে এবার খাড়িটার ভেতর ঢুকে পড়ল ফকির। কয়েকশো মিটার যাওয়ার পর আবার নৌকোর মুখ ঘুরিয়ে ঢুকল একটা সুতিখালের মধ্যে।
প্রায় ঘন্টাখানেক এভাবে এই খাল ওই খাল ধরে চলার পর একটা জায়গায় এসে ডিঙি থামাল ফকির। সামনে জলের ওপর চোখ বুলিয়ে নিল একবার–ডলফিনের কোনও চিহ্নই নেই। অধৈর্য হয়ে টাকরায় একটা শব্দ তুলে আবার বৈঠা হাতে নিল ফকির, অন্য আরেকদিকে ঘুরিয়ে নিল নৌকোটাকে।
ডিঙি চলতে চলতে পিয়া আর একবার ওর জিপিএস মনিটরটা বের করে রিডিং নিল, দেখল গর্জনতলা থেকে ক্রমশ আরও দূরে সরে যাচ্ছে ওরা। সকাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত পনেরো কিলোমিটারেরও বেশি চলে এসেছে, যদিও সোজা রাস্তায় আদৌ নয়: যে পথ বরাবর ওরা এসেছে, সেটাকে পুরনো মাফলার থেকে খুলে নেওয়া উলের সুতোর মতো দেখাচ্ছে মনিটরের পর্দায়।
বাতাস একেবারে স্থির, যেন ভারী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে; নদীর জল কাঁচের মতো মসৃণ, হাওয়ার এতটুকু দাগ নেই তার ওপর। ঘামে একেবারে নেয়ে গেছে ফকির। সেই ভ্যাবাচ্যাকা-খাওয়া ভাবটার জায়গায় এখন একটা উদ্বেগের ছাপ ওর মুখে। সাত ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ঘোরাঘুরির পরও কিছুই চোখে পড়েনি এখনও। পিয়া ইশারা করে ফকিরকে বলল একটু থেমে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে নিতে, কিন্তু কথাটাকে ও কোনও পাত্তাই দিল না। প্রাণপণে যেন নদী-খাঁড়ির গোলকধাঁধার আরও গভীরে ঢুকে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করে যেতে লাগল।
* * *
লুসিবাড়িতে ফেরার সময় প্রথমটায় বেশ খানিকক্ষণ যে পথ দিয়ে ওদের যেতে হল সেদিকটায় মানুষের যাতায়াত বিশেষ নেই। গর্জনতলা ছাড়ার পর কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত তাই ছোট বড় কোনও নৌকোই চোখে পড়েনি। কিন্তু তারপরে ভটভটিটা একটা সাগরমুখো নদীর কাছাকাছি এসে পড়তেই দৃশ্যটা একেবারে পালটে গেল। নদীর নাম জাহাজফোড়ন। তার ওপর থিকথিক করছে নানা মাপের নৌকো, ভটভটি আর লঞ্চ। নদীর প্রস্থটা মেঘার মুখের সঙ্গে সমকোণে থাকায় বেশ অনেকটা দূর থেকেও অগুন্তি নৌকো চোখে পড়ছিল জলের ওপর। দৃশ্যটার মধ্যে এমনিতে অস্বাভাবিক কিছু নেই, শুধু একটা ব্যাপার ছাড়া–সবগুলি নৌকোই চলেছে একই পথে–সাগর থেকে দূরে, মূল স্থলভূমির দিকে।
রাত্তিরটা পুরোটাই প্রায় জেগে কেটেছে, তাই গর্জনতলা ছেড়ে আসার খানিকক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিল কানাই। ঘুমটা ভেঙে গেল হরেনের গলার আওয়াজে। নীচের ডেক থেকে চেঁচিয়ে নাতিকে ডাকছে হরেন।
বাঙ্কের ওপর উঠে বসল কানাই। জামাকাপড় বিছানার চাদর সব একেবারে ভিজে গেছে। ঘামে। ভোরবেলা যখন শিরশিরে একটা বাতাস বইছিল তখন কেবিনের দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল ও। দুপুর হতে এখনও কয়েক ঘণ্টা দেরি আছে, কিন্তু এর মধ্যেই কেবিনের দেয়াল-টেয়াল সব তেতে উঠেছে। বেরিয়ে এসে কানাই দেখল বোটের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে সামনের চওড়া নদীর দিকে চেয়ে আছে হরেন, আর ওপরে সারেং-এর ঘরে চাকা ধরে বসে আছে নগেন।
“কী ব্যাপার হরেনদা?” ডেকের সামনেটায় এগিয়ে গেল কানাই। “কী দেখছেন?”
“দেখুন ওই দিকে,” হাত দিয়ে সামনে ইশারা করে বলল হরেন।
চোখের ওপর হাত আড়াল করে সামনে তাকাল কানাই। জলের দেশের রাহান-সাহানে অনভ্যস্ত ওর চোখেও নৌকোগুলোর চলনটা যেন কেমন বেখাপ্পা মনে হল। কিন্তু খটকাটা কোথায় লাগছে সেটা ও ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। “ওদিকে তো অনেকগুলো নৌকো দেখতে পাচ্ছি শুধু।”
“সবগুলো একইদিকে যাচ্ছে সেটা দেখতে পাচ্ছেন না?” একটু রুক্ষ শোনাল হরেনের গলা। “যে যার গাঁয়ে ফিরে যাচ্ছে সবাই।”
ঘড়ির দিকে একপলক তাকিয়ে কানাই দেখল সবেমাত্র দশটা বেজেছে। হঠাৎ ওর খেয়াল হল এত সকাল সকাল তো জেলেদের মাছ নিয়ে ঘরে ফেরার কথা নয়। “এত তাড়াতাড়ি কেন ফিরে আসছে ওরা?” জিজ্ঞেস করল কানাই। “এখনও কি ফেরার সময় হয়েছে?”
“না,” হরেন বলল। “সন্ধে নামার আগে জেলেরা এভাবে ফেরে না।”
“তা হলে?”
“তা হলে একটাই কারণ হতে পারে বছরের এই সময়টায়।”
“কী কারণ?”
ঠোঁট বাঁকাল হরেন। ওর বয়স্ক মুখের জটিল ভাজের আড়ালে যেন হারিয়ে গেল চোখদুটো। “দেখতে পাবেন শিগগিরই।” মুখ ঘুরিয়ে সারেং-এর ঘরের দিকে স্টিয়ারিং ধরতে চলে গেল হরেন।
নদীটা পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছতে আরও মিনিট দশেক লাগল। খানিকটা যাওয়ার পর একটা বাঁক ঘুরে রায়মঙ্গলে এসে ইঞ্জিনটা প্রায় বন্ধ করে দিল হরেন। আস্তে আস্তে নিশ্চল হয়ে এল মেঘা। তারপর নগেনের হাতে স্টিয়ারিং দিয়ে হরেন চলে গেল বোটের পেছন দিকটায়। একটা মাছ-ধরা নৌকো কাছাকাছি আসার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।
খানিক বাদেই একঝক ডিঙি এসে জড়ো হল বোটটার পাশে। কানে এল চিৎকার করে মাঝিদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে হরেন। তারপর দ্রুতপায়ে ও ফিরে গেল সারেং-এর ঘরে। মুখটা গম্ভীর, ভুরু দুটো কুঁচকে রয়েছে। বিড়বিড় করে নগেনকে কী যেন বলতেই একদৌড়ে নীচে নেমে গিয়ে ইঞ্জিন চালু করে দিল নগেন। হরেন স্টিয়ারিং ধরে বসল।
হরেনের মুখে ছায়া নেমে আসতে দেখে কানাইয়ের মনের মধ্যে কেমন একটা অজানা আশঙ্কার কাটা খচখচ করতে লাগল। জিজ্ঞেস করল, “ব্যাপারটা কী হরেনা? কিছু জানা গেল?”
“যা ভেবেছিলাম তাই। তা ছাড়া আর হবেটাই বা কী এই সময়ে?” একটু রূঢ় শোনাল হরেনের গলাটা।
ঝড় আসছে, জানাল হরেন। দিল্লির হাওয়া অফিস থেকে নাকি আগেরদিনই সতর্কবার্তা দিয়েছে। এমনকী সাইক্লোন পর্যন্ত হতে পারে। ভোর থেকে কোস্টগার্ডের বোট সাগরে ঘুরে ঘুরে সমস্ত মাছ-ধরা নৌকোগুলোকে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে। সেইজন্যেই সব ফিরে আসছে একসঙ্গে।
“কিন্তু তাহলে–” কানাইয়ের মাথায় প্রথমেই যে চিন্তাটা এল সেটা হল ফকির আর পিয়ার এখন কী হবে? ওরা তো গর্জনতলায় রয়ে গেছে।
প্রশ্নটার মাঝখানেই ওকে থামিয়ে দিল হরেন। “চিন্তার কিছু নেই। ঝড় কাল দুপুরের আগে আসছে না। মাঝে অনেকটা সময় আছে। আমরা গর্জনতলায় গিয়ে ওদের জন্যে অপেক্ষা করব। এমনকী ওরা যদি সন্ধে পর্যন্তও না ফেরে তাতেও ভয়ের কিছু নেই। কাল খুব ভোরবেলা যদি ওখান থেকে রওয়ানা হয়ে যেতে পারি তা হলেও ঝড় আসার আগে আমরা লুসিবাড়িতে পৌঁছে যাব।”
ধকধক আওয়াজ উঠল ইঞ্জিনে। দু’ কাঁধের পেশি ফুলিয়ে স্টিয়ারিং ঘোরাল হরেন। চুলের কাটার মতো একটা বাঁক নিল মেঘা। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওরা ফের গর্জনতলার দিকে এগোতে লাগল। সকালে যে পথ ধরে এসেছিল সেই পথ দিয়েই ফিরতে লাগল আবার।
গর্জনতলায় গিয়ে যখন ওরা পৌঁছল তখন দুপুর প্রায় একটা বাজে। সেখানে কাউকেই দেখা গেল না। তাতে অবশ্য হরেন বা কানাই কেউই বিশেষ চিন্তিত হল না, কারণ সকালে ফকিরের ডিঙি ছাড়ার পর এতক্ষণে মাত্র সাতঘণ্টা মতো পেরিয়েছে। ওরা জানে যে লুসিবাড়ি ঘুরে মেঘার ফেরার সময়টা হিসেব করে নিশ্চয়ই আরও বেশ খানিকটা পরেই ফেরার প্ল্যান করেছে পিয়া আর ফকির। ফলে ওদের আসতে আসতে প্রায় সন্ধে হয়ে যাবে।
তবে একটা জিনিস কানাইয়ের বেশ অদ্ভুত লাগল। ভটভটিটা যেখানে নোঙর করেছে হরেন, সেখান থেকে গর্জনতলার দহটা পরিষ্কার দেখা যায়, তবুও, ভাটা পড়ে যাওয়া সত্ত্বেও সেখানে একটা ডলফিনেরও চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। কানাইয়ের মনে পড়ল ভাটার সময় ডলফিনের দলটা এখানে এসে জড়ো হয়, আর ভাটা যে পড়ে গেছে অনভ্যস্ত চোখেও সেটা দিব্যি বুঝতে পারছিল ও। নিঃসন্দিগ্ধ হওয়ার জন্য তবুও একবার হরেনকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল কানাই। হরেন বলল, “হ্যাঁ ভাটাই চলছে এখন। জোয়ার আসতে আরও দু-তিন ঘণ্টা অন্তত লাগবে।”
“কিন্তু হরেনদা, একটা জিনিস দেখুন,” গর্জনতলার দিকে হাত দিয়ে ইশারা করল কানাই। “এতক্ষণ হল ভাটা পড়ে গেছে, কিন্তু জল তো তবুও খালি। কেন বলুন তো?”
প্রশ্নটা শুনতে শুনতে ভুরু কোঁচকাল হরেন। অবশেষে জবাব দিল, “কী করে বলব বলুন? দুনিয়া তো আর ঘড়ির কাটা ধরে চলে না। সবকিছুই একেবারে ঠিক ঠিক সময় মেনে হবে এরকম তাই সবসময় হয় না।”
এই যুক্তির জবাবে আর বলার কিছু থাকে না। তবুও কানাইয়ের পেটের ভেতরে কী যেন গুড়গুঁড়িয়ে উঠল, মনে হল কোথাও যেন কিছু একটা গড়বড় হয়েছে। হরেনকে বলল, “আচ্ছা হরেনদা, এখানে বসে না থেকে আমরা একটু এগিয়ে গিয়ে খুঁজে দেখি না, ফকিরের নৌকোটাকে দেখা যায় কিনা?”
হরেন যেন মজা পেল কথাটা শুনে। গলা দিয়ে ঘোঁত করে একটা আওয়াজ করে বলল, “এখানে একটা ডিঙি খুঁজে বের করা আর খড়ের গাদা থেকে একটা উঁচ খুঁজে বের করা একই ব্যাপার, বুঝলেন কানাইবাবু?”
“কিন্তু ক্ষতি তো কিছু নেই,” কানাই নাছোড়বান্দা। “যদি আমরা সন্ধের মধ্যেই এখানে ফিরে আসি তবে আর অসুবিধা কী আছে? সব যদি ঠিকঠাক থাকে তা হলে তো এমনিতেই ওরা সন্ধেবেলা ফিরে চলে আসবেই এখানে।”
“কোনও লাভ নেই,” গম্ভীর গলায় বলল হরেন। “শত শত খাল থাকে এইসব দ্বীপের মধ্যে। বেশিরভাগই এত অগভীর যে এ ভটভটি নিয়ে ঢোকাই যাবে না সেগুলোর মধ্যে।”
কানাই বুঝতে পারছিল আস্তে আস্তে নরম হয়ে আসছে হরেন। হালকা গলায় বলল, “আমরা তো এমনিতে কিছুই করছি না–একটু ঘুরে দেখেই এলাম না হয়।”
“ঠিক আছে তা হলে।” রেলিংয়ের পাশ দিয়ে ঝুঁকে পড়ে চেঁচিয়ে নগেনকে ইঞ্জিন স্টার্ট করতে বলল হুরেন। তারপর নোঙর তুলল।
সারেং-এর ঘরটার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল কানাই। গর্জনতলা ছাড়িয়ে ভটভটি আস্তে আস্তে এগোতে শুরু করল ভাটির দিকে। আকাশে কোথাও একটুকরো মেঘের চিহ্ন নেই। দুপুরের ঝিম-ধরানো রোদে কেমন চুপচাপ, শান্ত দেখাচ্ছে চারদিক। আবহাওয়া যে শিগগিরই খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা আছে সেটা কল্পনা করাটাও এখন কঠিন।