বইটা সরিয়ে রেখে কুসুমকে জিজ্ঞেস করলাম, “ঠিক কোন জায়গাটায় যাচ্ছি আমরা বল তো? দ্বীপটার নাম গর্জনতলা কেন?”
“গর্জনগাছের জন্য ওই রকম নাম হয়েছে সার। ওখানে অনেক গর্জনগাছ আছে তো।”
“তাই বুঝি?” এই ব্যাপারটা এতক্ষণ আমার মনে আসনি। গর্জন শব্দের অন্য মানেটাই মাথার মধ্যে ঘুরছিল। “তা হলে বাঘের ডাকের জন্য নামটা হয়নি?”
হাসল ওরা। “তাও হতে পারে।”
“কিন্তু গর্জনতলাতে কেন যাচ্ছি আমরা? মানে ওই জায়গাটাতেই কেন যাচ্ছি, অন্য কোথাও কেন নয়?”
“সে আমার বাবার জন্য সার,” বলল কুসুম।
“তোর বাবার জন্য?”
“হ্যাঁ। অনেক বছর আগে ওই দ্বীপটায় এসে বাবা একবার প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল।”
“তাই নাকি? কী হয়েছিল?”
“জিজ্ঞেস করলেন বলে বলছি স্যার। কিন্তু আমি জানি আপনি বিশ্বাস করবেন না, হয়তো হাসবেন।
“সে অনেক কাল হল, আমার জন্মের বহু বহু দিন আগে; বাবা একদিন জেলে ডিঙি নিয়ে একা পড়েছিল ঝড়ে–ভীষণ তুফানে। সেই তুফানের তোড় ফুঁসে ফুঁসে আসে, তার ঝাঁপটের ঘায়ে, নৌকো ভেঙে ভেসে গেল কুটোর মতন। হাবুডুবু খেতে খেতে গাছের এক গুঁড়ি ধরে কোনওমতে বাবা বেঁচে গেল প্রাণে। ঢেউয়ের ধাক্কায় আর জলের টানেতে, গিয়ে পৌঁছল সেই গর্জনতলা। গাছে চড়ে উঠে বসে গামছার পাকে বাঁধল ডালের সাথে নিজের শরীর। হু হু শব্দে ধেয়ে আসে ঝড়ের ঝাঁপট, দু’হাতে আঁকড়ে ধরে বাবা সেই ডাল। আচমকাই থেমে গেল সব তাণ্ডব, নিশ্চুপ হয়ে গেল গোটা জঙ্গল। তুফানের ধাক্কায় নুয়ে পড়া গাছ সব ফের খাড়া হল, শান্ত হল নদী। চাঁদ নেই আকাশেতে, কালিমাখা রাত, নিঝুম আঁধারে চোখ অন্ধ মনে হয়।
“হঠাৎ প্রচণ্ড এক বাজ পড়ে যেন। থরথর কেঁপে ওঠে সব গাছপালা ভীষণ এক গর্জনে। আর তার সাথে নাকে আসে বদগন্ধ, বাবা শিউরে ওঠে। নাম নেওয়া মানা যার সেই জানোয়ার ওত পেতে আছে কোথা শিকারের খোঁজে। আতঙ্কে অজ্ঞান বাবা গাছের ওপরে কোনওমতে ঝুলে থাকে গামছার বাঁধনে। সেই অচেতন স্বপ্নে আসে বনবিবি, বলে, ‘ওরে মুখ, তোর কেন এত ভয়? আমাকে বিশ্বাস কর, এ দ্বীপ আমার। যে মানুষ মনে সাচ্চা, এই জঙ্গলে তার কোনও ভয় নেই, আমি আছি পাশে।
“ভোরের আলো ফুটলেই দেখিস তখন ভাটার সময় হবে। দ্বীপ পার হয়ে উত্তর দিক পানে হেঁটে চলে যাস। নজর রাখিস জলে, অধৈর্য হস নে দেখবি এ জঙ্গলে তুই একা নোস। আমি আছি কাছাকাছি। দূতেরা আমার তোর পাশে পাশে আছে। তারাই আমার চোখ আর কান সেটা মনে রেখে দিস। যতক্ষণ ভাটা চলে সঙ্গ দেবে তারা। তারপর আসবে তোর মুক্তির সময়। জেলে ডিঙি ভেসে যাবে ওই পথ দিয়ে। তোকে নিয়ে গিয়ে তারা পৌঁছে দেবে ঘরে।”
এত সুন্দরভাবে বলা এরকম একটা গল্প শুনে মুগ্ধ না হয়ে উপায় কী? হেসে জিজ্ঞেস করলাম, “এরপর তুই নিশ্চয়ই বলবি যে পরদিন সকালে হুবহু ওই রকমই সব ঘটেছিল?”
“ঘটেছিল তো সার। যেমন যেমন স্বপ্নে দেখেছিল বাবা, ঠিক সেই রকম। পরে একবার ওই দ্বীপে ফিরে গিয়ে বনবিবির একটা থান তৈরি করে এসেছিল বাবা। যতদিন বাবা বেঁচেছিল, প্রতি বছর বনবিবির পুজোর সময়ে সবাই মিলে আমরা গর্জনতলায় আসতাম।”
আমার হাসি পেয়ে গেল। বললাম, “আর ওই দেবীর দূতদেরও নিশ্চয়ই দেখতে পেয়েছিল তোর বাবা?”
“দেখেছিল তো। একটু পরেই আপনি নিজেও দেখতে পাবেন সার,” বলল কুসুম।
এবার হো হো করে হেসে ফেললাম আমি। “আমিও দেখতে পাব? আমার মতো অবিশ্বাসী নাস্তিক? আমার ওপরে কি এত দয়া হবে দেবীর?”
“হ্যাঁ সার,” আমার ব্যঙ্গ উপেক্ষা করে কুসুম বলল। “কোথায় খুঁজতে হবে জানা থাকলে যে কেউই দেখতে পায় বনবিবির দূতদের।”
ছাতার আড়ালে বসে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। তন্দ্রা ভাঙল কুসুমের ডাকে। পৌঁছে গেছি আমরা গর্জনতলায়।
ধড়মড় করে উঠে বসলাম। এতক্ষণ ধরে এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করছি আমি–কখন কুসুমের বিশ্বাসী মনের ভুল ভেঙে দেওয়ার সুযোগ পাব। ভাটা পড়ে গেছে। বাঁকের মুখে খানিকটা জায়গায় স্থির হয়ে আছে জল–ঠিক সেইখানটাতেই এসে থেমেছে আমাদের নৌকো। ডাঙা এখনও খানিকটা দূরে। দূত-টুত বা অন্য কোনও দৈব দৃশ্য কিছুই দেখা যাচ্ছে না কোথাও। নিজের ওপর একটু খুশি না হয়ে পারলাম না। জয়ের আনন্দ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে করতে কুসুমকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী রে, কোথায় গেল তোর দেবীর দূতেরা?”
“দেখতে পাবেন সার, একটু সবুর করুন।”
হঠাৎ একটা অদ্ভুত আওয়াজ কানে এল–আমার মনে হল যেন সশব্দে নাক ঝাড়ছে কেউ। সবিস্ময়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম কিছু একটা অদৃশ্য হয়ে গেল জলের তলায়। শেষ মুহূর্তে কালো চামড়ার একটু আভাস শুধু চোখে পড়ল।
“কী ওটা?” আশ্চর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। “কোথা থেকে এল? কোথায় চলে গেল?”
“ওই যে,” অন্য আরেক দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল ছোট্ট ফকির। “ওইখানে।”
ঘুরে দাঁড়িয়ে আরেকটা ওরকম জীব দেখতে পেলাম আমি। জলের মধ্যে ডিগবাজি খাচ্ছে। একটা তিনকোনা পাখনাও দেখতে পেলাম এক ঝলক। আগে কখনও দেখিনি, কিন্তু বুঝতে পারলাম ওগুলো কোনও এক জাতের ডলফিন হবে। তবে এখানকার নদীতে যে শুশুক দেখেছি আমি, তার সঙ্গে এদের তফাত আছে। শুশুকের পিঠে এরকম কোনও পাখনা হয় না।
“ওগুলো কী? জিজ্ঞেস করলাম আমি। “কোনও এক ধরনের শুশুক নিশ্চয়ই।”
এবার কুসুমের হাসার পালা। “আমি আমার নিজের মতো নাম দিয়েছি ওদের। আমি ওদের বনবিবির দূত বলি।” ওরই জিত। অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই।
যতক্ষণ নৌকোটা ওখানে দাঁড়িয়ে রইল, জন্তুগুলো খেলা করে বেড়াতে লাগল আমাদের চারপাশে। কেন এখানে এসেছে ওরা? এতক্ষণ ধরে একই জায়গায় রয়েছেই বা কেন? জবাব খুঁজে পেলাম না। তারপর হঠাৎ এক সময় দেখলাম একটা ডলফিন জল থেকে মাথা তুলে সোজা আমার দিকে তাকাল। এতক্ষণে বুঝতে পারলাম কী করে কুসুম এত সহজে জন্তুগুলোকে অন্য কিছু বলে বিশ্বাস করতে পেরেছে। ওর চোখে যা বনবিবির চিহ্ন বলে মনে হয়েছে, আমার কাছে তাই মনে হল কবির চোখের দৃষ্টি। মনে হল সে চোখ যেন আমাকে বলছে :
“বোবা পশু শান্ত ঘাড় উঁচু করে
আমাদের চুলচেরা দেখে নিতে চায়।
এবং তারই আরেক নাম বুঝি নিয়তি…”