ছাদের ঘরের নিশ্চিন্ত আরামে বসে রাতের খাওয়ার কথা ভুলেই গিয়েছিল কানাই। কম্পাউন্ডের জেনারেটর থেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের আলোটা যখন নিভে গেল তখনও ও একমনে লেখাটা পড়ছে। আলো নিভতে মনে পড়ল ঘরের কোথাও একটা কেরোসিনের লক্ষ রয়েছে। অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে সেটা খুঁজছে কানাই, এমন সময় কার যেন পায়ের শব্দ পাওয়া গেল দরজার কাছে।
“কানাইবাবু?”
হাতে একটা মোমবাতি নিয়ে ময়না দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। “দেশলাই লাগবে?” জিজ্ঞেস করল কানাইকে। “আমি তো টিফিন ক্যারিয়ারটা নিয়ে যেতে এসেছিলাম। দেখলাম আপনি এখনও খাননি।”
“নীচেই যাচ্ছিলাম আমি,” বলল কানাই। “এ ঘরে কোথায় একটা হারিকেন ছিল না? খুঁজে পাচ্ছি না।”
“ওই তো ওখানে।”
মোমবাতি হাতে হারিকেনের কাছে গিয়ে কাঁচটা খুলে ফেলল ময়না। পলতেটা জ্বালাতে যেতেই হাত পিছলে গেল। মোমবাতি হারিকেন দুটোই ছিটকে পড়ল মাটিতে। চুরমার হয়ে গেল কাঁচটা আর কেরোসিনের কটু গন্ধে ভরে গেল সারা ঘর। মোমবাতিটা গড়াতে গড়াতে চলে গেল ঘরের এক কোণে। শিখা নিভে গেলেও সলতের ডগায় একটু লাল আভা তখনও দেখা যাচ্ছে। “জলদি!” মেঝের উপর উবু হয়ে বসে পড়ে মোমটার দিকে হাত বাড়াল কানাই। “পলতেটা টিপে নিভিয়ে দাও। নইলে কেরোসিনে আগুন ধরে সারা বাড়ি জ্বলে যাবে এক্ষুনি।”ময়নার হাত থেকে মোমবাতিটা নিয়ে বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর মধ্যে টিপে নিজেই পলতেটা নিভিয়ে ফেলল কানাই। “যাক, নিভে গেছে। এবার কাঁচের টুকরোগুলো পরিষ্কার করতে হবে।”
“সে আমি করছি কানাইবাবু।”
“দু’জনে মিলে করলে তাড়াতাড়ি হবে।” ময়নার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে হাত দিয়ে সাবধানে মেঝেটা মুছতে লাগল কানাই।
“খাবারটা তো ঠান্ডা হয়ে গেল কানাইবাবু,” বলল ময়না। “খেয়ে নেননি কেন?”
“কালকের জন্যে তৈরি হচ্ছিলাম,” কানাই বলল। “ভোরবেলাতেই বেরিয়ে পড়তে হবে তো। আমিও যাচ্ছি, জানো কি?”
“জানি। মাসিমা বলেছেন। আপনি যাবেন শুনে আমি একটু খুশি হয়েছি।”
“কেন? আমার জন্যে খাবার আনতে আর ভাল লাগছে না?”
“না না,” বলল ময়না। “সে জন্যে নয়।”
“তা হলে?”
“আপনিও ওদের সঙ্গে যাবেন সেটা জেনেই অনেকটা শান্তি পেয়েছি। ওরা একা থাকবে না।”
“কারা?”
“ওরা দু’জন,” হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল ময়নার গলা।
“মানে ফকির আর পিয়া?”
“আর কে? যখন শুনলাম আপনি ওদের সঙ্গে যাবেন, এত নিশ্চিন্ত লাগল যে কী বলব। সত্যি কথা বলতে কী, আমি ভাবছিলাম যদি আপনি ওর সঙ্গে একটু কথা বলেন…”
“ফকিরের সঙ্গে? কী ব্যাপারে কথা বলব?”
“ওই যে, ওই মেমসাহেব মেয়েটার ব্যাপারে। আপনি যদি ওকে একটু বুঝিয়ে বলেন, মেয়েটা এখানে শুধু ক’দিনের জন্যে এসেছে, আবার ফিরে চলে যাবে…”
“কিন্তু সে কথা তো ফকির জানে। জানে না?”
অন্ধকারের মধ্যে শাড়ির খসখস শব্দ শোনা গেল। কাপড়টা ভাল করে গায়ে জড়িয়ে নিল ময়না। “তাও, আপনার কাছ থেকে একবার শুনলে ভাল হবে, কানাইবাবু। কে জানে মনে মনে কী সব ভেবে বসে আছে ও। এত এত টাকা দিচ্ছে তো। ওই মেয়েটার সঙ্গেও যদি একটু কথা বলতে পারেন ভাল হয়। যদি একটু বুঝিয়ে বলেন, এরকমভাবে মাথা ঘুরিয়ে দিলে ফকিরের তাতে ভাল হবে না।”
“কিন্তু আমাকে কেন বলছ ময়না?” আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল কানাই। “আমি কী বলব বল?”
“কানাইবাবু, এখানে তো আপনিই শুধু ওদের দুজনের সঙ্গে কথা বলতে পারেন ফকিরের সঙ্গেও পারেন, আর ওই মেয়েটার সঙ্গেও পারেন। আপনিই তো ওদের দু’জনের মাঝখানে আছেন। আপনিই তো ওদের একজনের কথা শুনে আরেকজনকে বলবেন। আপনাকে ছাড়া ওদের কেউ তো জানতেই পারবে না অন্যজনের মনে কী আছে। এখন সবই আপনার হাতে কানাইবাবু। আপনি যা ইচ্ছে করবেন তাই বলাতে পারবেন ওদের মুখ দিয়ে।”
“আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না ময়না,” ভুরু কুঁচকে বলল কানাই। “কী বলতে চাইছ তুমি বলো তো? কীসের ভয় পাচ্ছ তুমি?”
“ও একটা মেয়ে, কানাইবাবু,” প্রায় ফিসফিস করে বলল ময়না। “আর ফকির একটা পুরুষ মানুষ৷”
অন্ধকারের মধ্যে ময়নার দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইল কানাই। “আমিও তো একটা পুরুষ মানুষ, ময়না। তোমার কি মনে হয়, আমার কিংবা ফকিরের মধ্যে একজনকে যদি বেছে নিতে হয়, ও কাকে পছন্দ করবে?”
হ্যাঁ না কিছুই জবাব দিল না ময়না। ধীরে ধীরে বলল, “আমি কী করে বলব কানাইবাবু, কী আছে ওর মনে?”
ময়নার কথায় দ্বিধার সুরে একটু উত্তেজিত হয়ে উঠল কানাই। “আর তুমি? যদি সম্ভব হত তুমি কাকে বেছে নিতে আমাদের দু’জনের মধ্যে, ময়না?”
“কী বলছেন আপনি কানাইবাবু? ফকির আমার স্বামী,” শান্ত গলায় জবাব দিল ময়না। কিন্তু কানাই হাল ছাড়ার পাত্র নয়। “তুমি তো এত বুদ্ধিমতী মেয়ে ময়না, কত কী করতে পারো, ফকিরের কথা তুমি ভুলে যাও। তুমি বুঝতে পারছ না, ওর সঙ্গে থাকলে তুমি জীবনে কিছুই করে উঠতে পারবে না?”
“ও আমার ছেলের বাবা কানাইবাবু,” বলল ময়না। “আমি ওকে ছেড়ে যেতে পারি না। আমি যদি চলে যাই তা হলে ওর কী হবে?”
হাসল কানাই। “ঠিক আছে, ও তোমার স্বামী কিন্তু তা হলে তুমি নিজে কেন ওর সঙ্গে কথা বলতে পারছ না? এই কাজটা কেন তোমার হয়ে আমাকে করে দিতে হবে?”
“ও আমার স্বামী, সেইজন্যেই এই নিয়ে ওর সঙ্গে আমি কথা বলতে পারি না কানাইবাবু,” শান্তভাবে জবাব দিল ময়না। “একজন বাইরের লোকের সঙ্গেই শুধু এসব নিয়ে কথা বলা যায়।”
“তুমি নিজে যেটা করতে পারছ না সেটা একজন বাইরের লোক কী করে পারবে?”
“পারবে কানাইবাবু,” ময়না বলল। “কারণ মুখের কথা হল গিয়ে বাতাসের মতন। যখন হাওয়া দেয় তখন দেখবেন জলের ওপরে কেমন ঢেউ ওঠে৷ আসল নদীটা থাকে তার নীচে–তাকে দেখাও যায় না শোনাও যায় না। নদীর ভেতর থেকে কিন্তু হাওয়া দিয়ে ঢেউ তোলা যায় না। সেটা করা যায় বাইরে থেকে। সেটা করার জন্যেই আপনার মতো কাউকে আমার দরকার।”
আবার হেসে উঠল কানাই। “মুখের কথা বাতাসের মতো হতে পারে ময়না, কিন্তু সে কথার মারপ্যাঁচ তো দেখছি তোমার দিব্যি জানা আছে।”
উঠে পড়ে টেবিলটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল কানাই। “আচ্ছা, সত্যি করে বলো তো ময়না, তোমার কি কখনও মনে হয় না অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে যদি তুমি থাকতে তা হলে কেমন হত? কখনও কৌতূহল হয় না তোমার?”
একটা হালকা ঠাট্টার সুর ছিল কানাইয়ের কথাটার মধ্যে। ঠিক সেটাই দরকার ছিল ময়নাকে উশকে দেওয়ার জন্য। চটে উঠল ময়না। “আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছেন, তাই না কানাইবাবু? আপনি চান আমি একবার হা বলি, আর তাই নিয়ে আপনি মজা করবেন। সব লোককে বলে বেড়াবেন আমি এরকম বলেছি, তাই না? আমি গাঁয়ের মেয়ে হতে পারি, কিন্তু এত বোকা নই যে আপনার এই কথার জবাব দেব। যে মেয়ের সঙ্গেই আপনার দেখা হয় তার সঙ্গেই আপনি এই খেলা খেলেন–ঠিক বুঝতে পেরেছি আমি।”
ঠিক জায়গায় ঘা লাগল ময়নার এই শেষ কথাটায়। একটু যেন কুঁকড়ে গেল কানাই। তড়িঘড়ি বলল, “ময়না, শোনো, রাগ কোরো না–আমি খারাপ কিছু বলতে চাইনি।”
শাড়ির খসখস শব্দ শোনা গেল আবার। উঠে পড়ে এক টানে দরজাটা খুলে ফেলল ময়না। তারপর অন্ধকারের মধ্যেই কানাই শুনতে পেল ও বলছে, “ওই মেমসাহেবের সঙ্গে মনে হয় আপনার ভালই জমবে কানাইবাবু। সেটা হলেই আমাদের সকলের মঙ্গল।”