স্টেশনে পা দিয়েই মেয়েটাকে দেখতে পেল কানাই। ছোট করে ছাটা চুল, ঢিলে ট্রাউজার্স আর ঢোলা সাদা জামা পরা–যে কেউ দেখলেই হঠাৎ আঠারো-উনিশ বছরের ছেলে বলে ভুল করবে। কিন্তু কানাইয়ের হল জহুরির চোখ। স্টেশনের ওই চা-ওয়ালা আর চানাচুর-ওয়ালাদের ভিড়ের মধ্যেও ঠিক নজর করেছে। ব্যাপারটা ভেবে মনে মনে একটু অহংকারই বোধ করল কানাই। মেয়েদের চেনার ব্যাপারে ওর জুড়ি খুঁজে পাওয়া কঠিন। চেহারাটা মন্দ নয় মেয়েটার–সরু লম্বাটে মুখ, হাতে চুড়ি বালা কিছু নেই বটে, কপালে টিপও নেই, তবে রোদে পোড়া চামড়ার ওপর কানের রুপোলি দুলদুটো ঝকঝক করছে, এত দূর থেকেও চোখে পড়ছে সেটা।

কিন্তু মেয়েটার ভাবভঙ্গিতে কেমন একটা অচেনা ছাঁদ রয়েছে। যে ভাবে পা দুটো ফাঁক করে লাইটওয়েট বক্সারের মতো দাঁড়িয়ে আছে–ঠিক চেনা মেয়েলি ভঙ্গি তো এটা নয়। বিদেশি কি? শুধু গায়ের রঙে আর নাকের নথে কীই বা বোঝা যায়? অথবা হয়তো জন্মসূত্রে ভারতীয়, কিন্তু বহুদিনের প্রবাসী। হতেই পারে। পার্ক স্ট্রিটের কলেজের মেয়েদের ভিড়ে ওকে দেখলে হয়তো কানাইয়ের এরকম মনে হত না, কিন্তু এই ধুলো আর জঞ্জালে ভরা ঢাকুরিয়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ওর অচেনা ভঙ্গিটা খুব বেশি করে চোখে পড়ছে। তবে বিদেশিই যদি হয় তো এইখানে কী করছে মেয়েটা? টুরিস্ট ক্যানিং যাবার এই রেলরাস্তা তো ডেইলি প্যাসেঞ্জাররাই বেশি ব্যবহার করে। টুরিস্টরা তো আজকাল সুন্দরবন যাবার জন্য কলকাতা থেকেই লঞ্চ-টঞ্চ ভাড়া করে বলে শুনেছে কানাই। তা হলে কী করছে ও এখানে?

ঘাড় ঘুরিয়ে পাশের লোকটাকে কী যেন একটা জিজ্ঞেস করল মেয়েটা। খুব লোভ হল কানাইয়ের, ও কী বলছে সেটা শোনার। আড়াল থেকে লোকেদের কথাবার্তা শুনতে ওর বেশ মজা লাগে। মানুষের কথাবার্তা, ভাষা, এইসব নিয়েই তো ওর কারবার। আর শুধু তো পেশা নয়, এটা ওর নেশাও বটে।

ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ঠেলেঠুলে কাছাকাছি পৌঁছে ও মেয়েটার প্রশ্নের শেষটুকু শুধু শুনতে পেল। শুধু শেষ ক’টা শব্দ–”ট্রেন টু ক্যানিং?”

পাশে দাঁড়ানো লোকটি হাতমুখ নেড়ে ওকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু সে বলছিল বাংলায়, আর মেয়েটা তার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারছে বলে মনে হল না কানাইয়ের। লোকটাকে থামিয়ে দিয়ে খানিকটা ক্ষমাপ্রার্থীর মতো ও বলল, “আমি বাংলা জানি না।”

যে অদ্ভুত উচ্চারণে মেয়েটা বাংলা শব্দগুলি বলল, তাতেই কানাই পরিষ্কার বুঝতে পারল যে ও মিথ্যে বলছে না। সাধারণত সর্বত্রই বিদেশিরা যা করে, ও-ও তাই করেছে–নিজের বোধের অক্ষমতাটুকু জানিয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শব্দক’টা শিখে নিয়েছে।

এই প্ল্যাটফর্মে অবশ্য কানাইও একজন ‘বাইরের লোক’, আর বহিরাগত হিসেবে সেও যে নিত্যযাত্রীদের খানিকটা মনোযোগ আকর্ষণ করেনি তা নয়। উচ্চতায় মাঝারি, এই বিয়াল্লিশ বছর বয়সেও যথেষ্ট ঘন চুল, জুলফির উপরে অল্প পাক ধরেছে। কানাইয়ের ঘাড় হেলানো আর দাঁড়ানোর ভঙ্গির মধ্যে রয়েছে একটা নিশ্চিত ভাব, যে-কোনও পরিস্থিতির টক্কর নেওয়ার মতো একটা দৃঢ় প্রত্যয় ওর সারা শরীরে যেন ফুটে বেরোচ্ছে। মুখে বয়সের ছাপ পড়েনি বিশেষ, চোখের কোনার চামড়ায় সামান্য ভাঁজ পড়েছে মাত্র। সেটাও ওর প্রাণোচ্ছল ভাবটাই আরও বেশি করে ফুটিয়ে তুলছে। একসময়ে রোগাপাতলা থাকলেও বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কোমর একটু ভারী হয়েছে, কিন্তু চলাফেরার ক্ষিপ্রতা তাতে যায়নি। আর তার সাথে আছে এক ধরনের সতর্ক ভাব, একটা পর্যটকসুলভ মুহূর্তযাপনের প্রবৃত্তি।

কানাইয়ের সঙ্গে ছিল টানা-হাতল আর চাকা লাগানো একটা এয়ারলাইন ব্যাগ। ক্যানিং লাইনের ফিরিওয়ালাদের কাছে ওই ব্যাগ কানাইয়ের মাঝবয়সি চাকচিক্য আর শহুরে স্বাচ্ছল্যের একটা অংশ–ওর সানগ্লাস, কüরয় ট্রাউজার্স আর সোয়েডের জুতোরই মতো। ফলে হকার, ভিখিরি আর চাঁদা-তোলা ছেলেছোকরার দল ওকে ছেকে ধরল। অবশেষে সবুজ-হলুদ রঙের ইলেকট্রিক ট্রেনটা ঘস ঘস করে স্টেশনে ঢোকার পর ওদের হাত থেকে রেহাই পেল কানাই।

গাড়িতে ওঠার সময় কানাই লক্ষ করল বিদেশি মেয়েটা চলাফেরায় যথেষ্ট অভ্যস্ত। ট্রেন স্টেশনে ঢুকতেই ও চট করে ওর বিশাল পিঠব্যাগদুটো নিজেই তুলে নিয়ে গোটাছয়েক কুলিকে পাশ কাটিয়ে দিব্যি এগিয়ে গেল। ওই ছোটখাটো দেখতে হলে কী হবে, হাতে-পায়ে শক্তিও আছে মেয়েটার। আর যে ভাবে ব্যাগদুটোকে ট্রেনের কামরায় তুলে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে ঠেলেঠুলে এগিয়ে গেল অনায়াসে, তাতে বোঝাই গেল এরকম একা চলাফেরার অভ্যাস ওর আছে। কানাই একবার ভাবল ওকে বলবে কিনা যে মেয়েদের জন্যও একটা আলাদা কামরা আছে এই ট্রেনে, কিন্তু কিছু বলার আগেই গাড়ির ভিড় মেয়েটাকে গিলে ফেলল। ওকে আর দেখতেই পেল না কানাই।

ঠিক তক্ষুনি হুইসল বেজে উঠল আর কানাই নিজেও ধাক্কাধাক্কি করে উঠে পড়ল কামরাটায়। একটু ডাইনে-বাঁয়ে তাকিয়েই একটা খালি সিট দেখতে পেয়ে বসে পড়ল টুপ করে। ও ঠিক করেছিল এই ট্রেন জার্নির সময় কয়েকপাতা পড়ে নেবে, কিন্তু সুটকেস থেকে কাগজপত্রগুলো বের করতে গিয়েই টের পেল সিটটা মোটেই সুবিধের নয়। খুব একটা আলোও আসছে না, আর ঠিক ডানদিকেই এক মহিলার কোলে একটা বাচ্চা হাত-পা ছুঁড়ে সমানে চাঁচাচ্ছে। সারাপথ যদি ওই বাচ্চার খুদে হাত-পায়ের ঘুষি-লাথি সামলাতে সামলাতে যেতে হয়, তবে তো পড়ার দফা রফা। বাঁদিকের সিটটায় বসতে পারলে চমৎকার হত। দিব্যি আরামে পড়তে পড়তে যাওয়া যেত জানালার ধারে বসে। কিন্তু সেখানে একটা লোক বসে নিবিষ্ট মনে একটা বাংলা খবরের কাগজ পড়ে যাচ্ছে। লোকটাকে একটু মেপে নিল কানাই। নিরীহগোছের বয়স্ক মানুষ–একটু চাপাচাপি করলেই সরে যাবে মনে হয়।

“দাদা, একটু শুনবেন?” হাসি হাসি মুখে কানাই জিজ্ঞেস করল লোকটাকে। ভদ্রলোক কাগজ থেকে মুখ তুলে তাকাতেই ভারী ভালমানুষের মতো বলল, “আপনার অসুবিধা না থাকলে আমার সঙ্গে সিটটা চেঞ্জ করবেন? আমাকে আসলে একগাদা কাজ করতে হবে, জানালার কাছে বসলে আলোটাও একটু বেশি পাব–কাগজপত্রগুলো পড়তে সুবিধা হবে।” লোকটা একটু আশ্চর্য হয়ে ওর দিকে তাকাল। মুহূর্তের জন্য মনে হল বোধহয় মুখের ওপর ‘না’ বলে দেবে। কিন্তু কানাইয়ের পোশাক-আশাক চেহারাছবি দেখে শেষপর্যন্ত মনে হল মত পালটাল লোকটা। হয়তো ভাবল, কে জানে বাবা এর হাত কত লম্বা, হয়তো পুলিশ-দারোগা নেতা-টেতা চেনাশোনা আছে– কিছুই বলা যায় না। ঝামেলায় গিয়ে কাজ নেই, তার থেকে সিটটা পালটে নেওয়াই ভাল। মানে মানে সরে গিয়ে কানাইয়ের জন্য জায়গা করে দিল লোকটা।

যাক বাবা, বিশেষ ঝামেলা ছাড়াই সিটটা পাওয়া গেল। মাথা নেড়ে লোকটাকে ধন্যবাদ জানাল কানাই। মনে মনে ঠিক করল চা-ওয়ালা এলে ওকে একটা চা অফার করবে। গুছিয়ে বসে সুটকেসের সামনের ফ্ল্যাপ থেকে এক গোছা কাগজ টেনে বের করল ও। খুদে খুদে অক্ষরে বাংলা লেখা। হাঁটুর ওপর পেতে হাত দিয়ে পাতাগুলো সমান করে নিয়ে পড়তে শুরু করল কানাই।

“কথিত আছে, মহাদেব যদি তার জটার মধ্যে গঙ্গার প্রবল স্রোতকে সংযত না করতেন, তা হলে মর্তে অবতরণের সময় নদীর তীব্র গতি পৃথিবীকে চূর্ণ চূর্ণ করে দিত। এই কাহিনি থেকে গঙ্গার একটি বিশেষ রূপ কল্পনা করা যায় : যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা বিশাল এক জলের বেণী এলিয়ে পড়েছে এক শুষ্ক, তৃষ্ণার্ত সমভূমির ওপর। কিন্তু এই নদীকাহিনিতে যে কোথাও একটা মোচড় থাকতে পারে, গঙ্গার গতিপথের একেবারে শেষ পর্যায়ে আসার আগে সেটা বোঝাই যায় না। তবে গল্পের সেই চমকপ্রদ শেষাংশ কেউ কোথাও লিখে যাননি। হয়তো কল্পনাই করেননি কেউ। আমার মনে হয়, এইভাবে তা লেখা যেতে পারে : এই এলিয়ে পড়া জলরাশির বেণী এক সময় সম্পূর্ণ খুলে যায় এবং মহাদেবের জটপাকানো কেশগুচ্ছ ছড়িয়ে পড়ে বিস্তীর্ণ এক অঞ্চল জুড়ে। একটা সময় নদী সব বাঁধন ছিঁড়ে ছড়িয়ে পড়ে শত শত–হয়তো বা সহস্রাধিক–পরস্পরগ্রন্থিত জলধারায়।

“এখানে সমুদ্র এবং বাংলার সমতলভূমির মধ্যে সংযোগসাধন করেছে এক বিশাল দ্বীপপুঞ্জ। তার বিশাল বিস্তার চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। প্রায় তিনশো কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে আছে এই দ্বীপগুলি–পশ্চিমবঙ্গের হুগলি নদী থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মেঘনার তীর পর্যন্ত।

“এই দ্বীপগুলি যেন ভারতমাতার বস্ত্রের প্রান্তভাগ, যেন তার লুটিয়ে পড়া শাড়ির আঁচল–সমুদ্রের লোনা জলে আধো ভেজা। হাজার হাজার এইরকম দ্বীপ ছড়িয়ে আছে এই অঞ্চলে। তাদের মধ্যে কয়েকটির আয়তন বিশাল, আবার কয়েকটি ছোট্ট বালির চর মাত্র। কিছু দ্বীপ আছে লিখিত ইতিহাসের সমান বয়সি, কিছু আবার গজিয়ে উঠেছে মাত্র দু’-এক বছর আগে। এই দ্বীপগুলি যেন মাটির পৃথিবীর কাছে জলের ক্ষতিপূরণ–সারা যাত্রাপথে ধরিত্রীমায়ের কাছ থেকে সে যা গ্রহণ করেছে, এখানে সাগরে পড়ার আগে সে যেন সেই ঋণ শোধ করে দিয়ে যেতে চায়। তবে এই দানের ওপর জল কিন্তু তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। তার স্রোতধারা ছড়িয়ে থাকে সমস্ত স্থলভাগের ওপর সূক্ষ্ম এক জালের মতো। এখানে জল-স্থলের সীমা সর্বদাই পরিবর্তনশীল–সতত অনিশ্চিত।

“নদীপ্রণালীগুলির মধ্যে কয়েকটি আয়তনে বিশাল–এক তীর থেকে অন্য তীর দেখা যায় না। আবার অনেকগুলি মাত্র কয়েকশো মিটার চওড়া, লম্বায় খুব বেশি হলে দু-তিন কিলোমিটার। তবুও এদের প্রত্যেকেই একেকটি নদী, প্রতিটির একটি করে আশ্চর্য দ্যোতনাময় নামও রয়েছে। এই নদীগুলি যেখানে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয়–একটা দুটো নয়, চার পাঁচটা, এমনকী কখনও কখনও ছ’টা পর্যন্ত–সে সঙ্গমস্থলের বিস্তার প্রায় দিগ্বলয়কে স্পর্শ করে। দূরে আবছায়া দেখা যায় জঙ্গল, দিগন্তের কাছে স্থলভূমির প্রতিধ্বনির মতো। কথ্য ভাষায় এই সঙ্গমের নাম মোহনা–এক আশ্চর্য মনোমুগ্ধকর শব্দ, প্রায় মাদকতাময়।

“এইখানে মিঠেজল আর লোনাজল, নদী আর সমুদ্রের মধ্যে কোনও সীমারেখা নেই। জোয়ারের স্রোত উজানে তিনশো কিলোমিটার পর্যন্ত পৌঁছয়, আর প্রতিদিন বানের সময় হাজার হাজার একর জঙ্গল চলে যায় জলের তলায়। ভাটা এলে জল নেমে যায়, আবার মাথা তুলে ওঠে অরণ্য। জলের স্রোত এমনই তীব্র যে দ্বীপগুলির আকৃতি প্রায় প্রতিদিনই বদলে যায়। কোনওদিন হয়তো গোটা একটা উপদ্বীপ বা ছোটখাটো অন্তরীপ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় স্রোতের টানে, আবার কখনও বা জলের মধ্যে। হঠাৎ জেগে ওঠে একটা নতুন চর।

“এইভাবে জোয়ার-ভাটার টানে যখনই একটা নতুন চর মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, প্রায় রাতারাতি সেখানে গজিয়ে উঠতে থাকে ম্যানগ্রোভ জাতীয় গাছ। পরিবেশ যদি অনুকূল হয়, মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই ঘন জঙ্গলে ছেয়ে যায় পুরো দ্বীপ। এই ম্যানগ্রোভ অরণ্য যেন সম্পূর্ণ আলাদা এক জগৎ–অন্য কোনও বনজঙ্গলের সঙ্গে কোনও মিলই নেই এর। অন্য জঙ্গলের মতো কোনও আকাশছোঁয়া গুল্মশোভিত গাছ এখানে নেই, ফার্ন বা জংলা ফুল নেই, কাকাতুয়ার মতো পাখিও এখানে চোখে পড়ে না। ম্যানগ্রোভ জাতীয় গাছের পাতা হয় পুরু এবং শক্ত। গ্রন্থিল শাখা এবং ঘন পল্লবরাজির জন্য এ ধরনের জঙ্গল হয় একেবারে দুর্ভেদ্য। বনের গভীরে আলো প্রায় ঢোকে না বললেই চলে। ফলে দিনের বেলাতেও সামান্য দূরের জিনিস কষ্ট করে ঠাহর করতে হয়। বাতাসও এখানে নিশ্চল আর পূতিগন্ধময়। এ বনে ঢোকা মাত্রই যে কারও মনে হবে এ এক ভয়ংকর শত্ৰুপুরী। জীবন্ত এক ধূর্ত প্রাণীর মতো যেন তেন প্রকারেণ এই জঙ্গল আগন্তুককে হয় প্রাণে মারতে চায়, নয়তো দূর করে দেয় তার ত্রিসীমানা থেকে। প্রতি বছরই এই দুর্ভেদ্য অরণ্যে প্রাণ দেয় বহু মানুষ হয়–বাঘের হাতে, নয়তো কুমির বা সাপের কামড়ে।

“এ অরণ্যে এমন কিছুই নেই কোনও বহিরাগতের কাছে সুন্দর বলে মনে হতে পারে। তবুও সারা পৃথিবী এই দ্বীপপুঞ্জকে ‘সুন্দরবন’ নামেই জানে। অনেকে মনে করে ম্যানগ্রোভজাতীয় সুন্দরী গাছ–হেরিটেরিয়া মাইনর–এখানে বেশি আছে বলে এ বনের নাম সুন্দরবন। তবে এ জঙ্গলের নাম বা ইতিহাস খুঁজে বের করা এক কঠিন কাজ, কেননা মুঘল আমলের নথিপত্রে এই জায়গার প্রসঙ্গে কোনও বিশেষ গাছের নাম করা হয়নি, বরং উল্লেখ করা হয়েছে নদীর স্রোতবিশেষের–ভাটির। এখানকার দ্বীপবাসীরাও এ দেশকে ভাটির দেশ বলেই জানে। জোয়ার নয়, সমুদ্রমুখী জলের টান, অর্থাৎ ভাটা থেকেই এ জায়গা তার নাম পেয়েছে। কেননা জোয়ার যখন আসে, এ অঞ্চলের অধিকাংশই তখন চলে যায় জলের তলায়। কেবল মাত্র ভাটার সময়ই জল থেকে জন্ম নেয় জঙ্গল। অরণ্যের এই জন্মপ্রক্রিয়া (যেখানে ধাইয়ের কাজটা করে চাঁদ) লক্ষ করলেই বোঝা যাবে যে ‘ভাটির দেশ’ নামটি শুধু যথার্থই নয়, এটাই আসল নাম হওয়া উচিত এই অঞ্চলের। কারণ রিলকের কবিতার হ্যাঁজেল গাছ থেকে ঝুলন্ত তন্তুজাল বা কালো মাটির ওপর বসন্তের বৃষ্টির মতো, ভাটার স্রোতের দিকেও যখন আমরা তাকাই,

এই আমরা, যারা আনন্দকে

জেনেছি উদীয়মান, ঊর্ধ্বগামী, আমাদেরও হয় অনুভূত

সেই সূক্ষ্ম আবেগ, যা প্রায় বিহ্বল করে যখন আনন্দময় কোনো-কিছু

পড়ে যায়।”