ফকির
লঞ্চের শব্দটা দূরে মিলিয়ে যেতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল পিয়া। বিপদ কেটে যাওয়ার পর এতক্ষণে ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে এল পেশিগুলো, মারাত্মক ধকলটা যেন শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে টের পাওয়া গেল। হঠাৎ হাত-পাগুলি কঁপতে শুরু করল, থুতনিটা বার বার ঠকঠক করে এসে ধাক্কা খেতে লাগল হাঁটুর ওপরে। মুহূর্তের মধ্যে এমন একটা কাঁপুনি এল সারা শরীরে যে গোটা ডিঙিটা দুলতে লাগল, ছোট ছোট ঢেউ ছড়িয়ে গেল নদীর জলে।
কার যেন একটা ছোঁয়া লাগল কাঁধের কাছে। পাশ ফিরে তাকিয়ে পিয়া দেখল বাচ্চা ছেলেটা, ওর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। পেছন থেকে পিয়ার গলা জড়িয়ে ধরল বাচ্চাটা, নিজের গায়ের ওম দিয়ে ওর শরীরে তাপ দিতে লাগল। স্বস্তিতে, আরামে চোখ বন্ধ হয়ে এল পিয়ার। দাঁতের খটখট বাজনা বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আর চোখ খুলল না ও।
চোখ মেলেই দেখল ওর সামনে উবু হয়ে বসে আছে জেলেটা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে ওর মুখ, চোখে চিন্তার ছাপ। পিয়ার শরীরের কাঁপুনি থেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে লোকটার চেহারাতেও আস্তে আস্তে স্বস্তি ফিরে এল। একটা হাসির আভাসও দেখা গেল ঠোঁটের কোনায়। বুকের ওপর একটা আঙুল রেখে ও বলল, “ফকির”। ওর নাম। পিয়াও নিজের দিকে দেখিয়ে বলল, “পিয়া”। মাথা নাড়ল ফকির। বুঝতে পেরেছে। এবার বাচ্চাটার দিকে ইশারা করে বলল, “টুটুল”। তারপর আঙুল দিয়ে একবার বাচ্চাটার দিকে আর একবার নিজের দিকে দেখাতে লাগল। পিয়া বুঝতে পারল ওরা বাপ আর ছেলে।
“টুটুল।”
বাচ্চাটার দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখল পিয়া। যা মনে হচ্ছিল ওর বয়স আসলে তার থেকেও কম। খুব বেশি হলে বছর পাঁচেক হবে। এই নভেম্বরের ঠান্ডায় শুধু টিঙটিঙে পাতলা একটা সোয়েটার পরে রয়েছে ছেলেটা। আর একটা বেটপ রং-জ্বলা হাফপ্যান্ট। নিশ্চয়ই কারও পুরনো স্কুলের পোশাক হবে। বাচ্চাটার হাতে ওটা কী? তুলে দেখাল–পিয়ার ডিসপ্লে কার্ডটা। কোথা থেকে কুড়িয়ে পেয়েছে কে জানে। ওটা যে আবার ফিরে পাওয়া যাবে ভাবেইনি পিয়া। একটা ট্রের মতো করে ধরে ওটা পিয়ার সামনে নিয়ে এল ছেলেটা। তারপরে ওর আঙুলগুলো ধরে আলতো একটা চাপ দিল, যেন বলতে চাইছে “ভয় পেয়োনা, আমি তো আছি।”
কিন্তু বাচ্চাটার আশ্বাসে উলটো প্রতিক্রিয়া হল পিয়ার ওপর। আচমকা ওর নিজেকে খুব অসহায় মনে হল। একেবারেই নতুন এই অনুভূতি পিয়ার। এর আগে বহুবার ও একা একা জলে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছে, অনেক সময়ই একেবারে অচেনা লোকেদের সাথেও ঘুরেছে, কিন্তু আজকে ওই ফরেস্ট গার্ড আর মেজদার ব্যবহারে আত্মবিশ্বাস একটু চিড় খেয়ে গেছে পিয়ার। এখনও ওর মনে হচ্ছে ও যেন আস্তে আস্তে একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে থেকে জেগে উঠছে, যেন এই মাত্র কয়েকটা হিংস্র পশুর হাত থেকে কোনও রকমে প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছে। সত্যিই, এই ডিঙিতে বাচ্চাটা আছে বলে অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করল পিয়া।
তা না হলে আগেকার মতো সম্পূর্ণ অচেনা একটা লোকের ওপর কিছুতেই হয়তো আর ভরসা রাখতে পারত না। এক হিসাবে দেখতে গেলে তো বাচ্চাটা সত্যিই ওর রক্ষাকর্তা এখন। হঠাৎ কী রকম একটা মমতা-মাখা কৃতজ্ঞতায় বুকটা ভরে গেল পিয়ার। ওর স্বভাবের সঙ্গে ঠিক খাপ খায় না ব্যাপারটা, কিন্তু এখন এই টলমলে নৌকোর ওপর পিয়ার আবেগ আর বাঁধ মানল না–দু’হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটাকে ও বুকে টেনে নিল।
আদর শেষে হাত আলগা করতে গিয়ে পিয়া লক্ষ করল ছেলেটা একদৃষ্টে ওর হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। নজর পড়তে দেখল মানিব্যাগটা এখনও দু আঙুলের ফাঁকে ধরা। হঠাৎ নিজেকে একটু অপরাধী মনে হল পিয়ার, মনে পড়ল জেলেটার সঙ্গে এখনও টাকাপয়সার ব্যাপারে কোনও কথাই বলা হয়নি। মানিব্যাগ থেকে একতাড়া টাকা নিয়ে পাতলা একটা গুছি আলাদা করে বের করল ও। টাকাটা গুনতে গুনতেই মনে হল ওরা বাপ-ব্যাটা দু’জনে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মুখ তুলে দেখল ওদের নজর যেন আঠার মতো আটকে গেছে ওর হাতের সঙ্গে, স্তব্ধ বিস্ময়ে ওরা লক্ষ করছে ওর আঙুলের প্রতিটি নড়াচড়া যেন কোনও মায়াবিনীর হাতের জাদু। লোভ কিন্তু নয়, এমন একটা মুগ্ধতা ছিল ওদের দৃষ্টিতে যে পিয়া বুঝতে পারল জীবনে এই প্রথম ওরা এত টাকা একসঙ্গে দেখছে। এতগুলো কড়কড়ে নোট এত কাছ থেকে দেখার ভাগ্য ওদের আগে কখনও হয়নি। কিন্তু ওর জন্যেই যে ওগুলো গুনছে পিয়া সেটা মনে হল ফকিরের কল্পনায়ও আসেনি। গোনা শেষ করে টাকাটা এগিয়ে দিতেই অপরাধীর মতো কুঁকড়ে গেল ফকির, যেন পিয়া কোনও নিষিদ্ধ জিনিস ওর হাতে তুলে দিতে চাইছে।
মাত্র তো কয়েকটা টাকা, দু’কাপ কফি আর স্যান্ডউইচের জন্যেও পিয়া অনেক সময় এর থেকে বেশি খরচ করেছে। আর রিসার্চ গ্রান্ট হিসেবে যে পয়সা পাওয়া যায় তাতে বেহিসেবি হওয়ার সুযোগও বিশেষ মেলে না। এই সামান্য ক’টা টাকা ওদের প্রাপ্য বলেই ওর মনে হয়েছিল। লোকটার পরনে যদি কোনও জামা থাকত পিয়া ওর পকেটেই খুঁজে দিতে পারত টাকাগুলো, কিন্তু কোমরে জড়ানো ওই ভেজা টুকরো কাপড়টা ছাড়া আর কিছুই নেই ওর গায়ে। অবশ্য একটা মাদুলি বাঁধা আছে এক হাতে। উপায়ান্তর না দেখে ওই মাদুলির সুতোটার মধ্যেই পিয়া টাকা ক’টা মুড়িয়ে খুঁজে দিল। লোকটার সারা গায়ে ঘামাচির মতো কাটা দিয়ে উঠল। সে ওর হাতের ছোঁয়ায়, নাকি এই নভেম্বরের সন্ধ্যার হাওয়ায়, সেটা বুঝতে পারল না পিয়া।
মাদুলির বাঁধন থেকে টাকাটা বার করে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল ফকির। এতগুলো টাকা নিজের হাতে ধরে আছে সেটা যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না ওর। মুখের সামনে থেকে একটু দূরে রেখে নোটগুলো নিরীক্ষণ করতে লাগল ও। অবশেষে লঞ্চটা যেদিকে গেছে সেদিকে ইশারা করে একটা মাত্র নোট আলাদা করে নিল। পিয়া বুঝতে পারল ও আসলে বলতে চাইছে যে লঞ্চের লোকগুলো তো এই ক’টা টাকাই নিয়ে গেছে, তাই এর থেকে বেশি ও নেবে না। আলাদা করে রাখা নোটটা ছেলের হাতে দিতেই সে দৌড়ে চলে গেল ছইয়ের মধ্যে ওটাকে লুকিয়ে রাখতে।
বাকি টাকাগুলো পিয়াকে ফেরত দিয়ে দিল ফকির। প্রতিবাদের চেষ্টা করতেই দিগন্তের দিকে হাত তুলে হড়বড় করে একটানা অনেক কথা বলে গেল। তার মধ্যে শুধু লুসিবাড়ি’ শব্দটা পিয়ার কানে চেনা ঠেকল। মোটের ওপর বোঝা গেল লুসিবাড়ি পৌঁছানো পর্যন্ত এই দেনাপাওনার ব্যাপারটা স্থগিত রাখতে চায় ও। আপাতত সেই ব্যবস্থাতেই সম্মত হল পিয়া।