» » » » নির্মল আর নীলিমার কথা

বর্ণাকার

নির্মল আর নীলিমার কথা

নির্মল আর নীলিমা বোস প্রথমবার লুসিবাড়িতে আসে একটা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। সেটা ১৯৫০ সাল, তখন একবছরও হয়নি ওদের বিয়ে হয়েছে।

নির্মলের আদি বাড়ি ঢাকায়। কলকাতায় ও এসেছিল পড়াশোনা করতে। তারপর স্বাধীনতা, দাঙ্গা, দেশভাগ–পরিবারের সঙ্গে সব যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেল। নির্মল নিজেও কলকাতাতেই থেকে যেতে চেয়েছিল। তখন ও উঠতি লেখক, একটু নাম-টামও হয়েছে বামপন্থী বুদ্ধিজীবী হিসেবে। সেই সময়েই একটা চাকরি জুটে গেল আশুতোষ কলেজে। ইংরেজি পড়ানোর চাকরি। নীলিমা ছিল সেই কলেজের ছাত্রী।

পরিবারগত ভাবে দেখতে গেলে নির্মল আর নীলিমার মধ্যে কোনও মিলই ছিল না। নীলিমা ছিল বনেদি পরিবারের মেয়ে, ওর বাপ-কাকাদের লোকে এক ডাকে চিনত। ওর ঠাকুর্দা ছিলেন কংগ্রেসের প্রথম সদস্যদের একজন। আর বাবা, অর্থাৎ কানাইয়ের দাদু, ছিলেন হাইকোর্টের ডাকসাইটে ব্যারিস্টার। নীলিমার যখন তেরো-চোদ্দো বছর বয়স, তখন একবার ওর প্রচণ্ড হাঁপানি হয়। তার প্রকোপ চলেছিল বেশ কিছুদিন। ফলে কয়েক বছর পর স্কুলের গণ্ডি পেরোতেই ওকে ভর্তি করে দেওয়া হল ওদের বালিগঞ্জ প্লেসের বাড়ির কাছে আশুতোষ কলেজে। বাড়ির একটা প্যাকার্ড গাড়ি রোজ সকালে ওকে কলেজ পৌঁছে দিত, আবার বিকেলে ফেরত নিয়ে আসত।

একদিন ছুটির পর একটা ছুতো করে বাড়ির ড্রাইভারকে ফেরত পাঠিয়ে দিল নীলিমা, আর বইখাতা বগলে নিয়ে কলেজের ইংরেজির অধ্যাপকের পেছন পেছন একটা বাসে গিয়ে উঠে পড়ল। অধ্যাপকের চোখের আদর্শবাদের দীপ্তি তখন আগুনের দিকে পতঙ্গের মতো টেনেছিল নীলিমাকে। ওর ক্লাসের অনেক মেয়েই তখন নির্মলের আগুনঝরা বক্তৃতা আর আবেগময় আবৃত্তিতে মুগ্ধ, এমনকী তাদের কেউ কেউ নির্মলের প্রেমে পাগলও ছিল, কিন্তু নীলিমার মানসিক শক্তি বা উদ্ভাবনী ক্ষমতা তাদের ছিল না। বাসে উঠে সেদিন ও ঠিক নির্মলের পাশের সিটটায় গিয়ে বসল; আর এক মাসের মধ্যেই বাড়িতে জানিয়ে দিল যে বিয়ের পাত্র ওর ঠিক করা হয়ে গেছে। বাড়ির লোকেদের স্বাভাবিক ভাবেই প্রচণ্ড আপত্তি ছিল এই বিয়েতে, কিন্তু তাতে নীলিমার জেদ বাড়ল বই কমল না। ১৯৪৯ সালে একদিন সাদামাটা এক অনুষ্ঠান করে বিয়ে হয়ে গেল ওদের। হোম-যজ্ঞ-মন্ত্রপাঠের বদলে পড়া হয়েছিল ব্লেক, মায়কোভস্কি আর জীবনানন্দের কবিতা। সে বিয়েতে পৌরোহিত্য করেছিল নির্মলের এক পাটি কমরেড।

বিয়ের পর মাস খানেকও হয়নি, হঠাৎ একদিন সকালে ওদের মুদিয়ালির ছোট্ট ফ্ল্যাটে পুলিশ হানা দিল। আগের বছর কলকাতায় সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনালের এক কনফারেন্সে অংশ নিয়েছিল নির্মল–সেই সূত্রে। (গল্পের ঠিক এই জায়গায় এসে নির্মল একটু থেমে যেত, তারপর একটু ঝোঁক দিয়ে শুরু করত পরের বাক্যটা। ওর মতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে কলকাতার এই কনফারেন্স ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এমনকী দশ-বিশ বছর পরেও এশিয়ার সমস্ত গণ অভ্যুত্থানের সঙ্গে পশ্চিমি গোয়েন্দা দফতরগুলি এই কনফারেন্সের যোগসূত্র খুঁজে বের করত–সে ভিয়েতনামই হোক, কি মালয়েশিয়ার আন্দোলন, অথবা বার্মার রেড ফ্ল্যাগ অভ্যুত্থান। ওদের মতে এই সবকিছুর মূলেই ছিল ১৯৪৮-এর কলকাতা কনফারেন্সের ‘সশস্ত্র সংগ্রাম নীতি’। নির্মল বলত এমনিতে যে এসব কথা সবাইকে জানতেই হবে তার কোনও মানে নেই, কিন্তু এই ভাটির দেশে এ ধরনের খবরের বিশেষ মূল্য আছে। বাইরের পৃথিবীর বড় বড় ঘটনার খোঁজ এখানে সহজে এসে পৌঁছয় না, সেই জন্যেই আরও বেশি করে সেগুলি এখানকার মানুষকে মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। কারণ ইতিহাসের প্লাবনের ঢেউ এক সময় না এক সময় পৃথিবীর দুর্গমতম অঞ্চলেও গিয়ে ধাক্কা দেয়।)

আটচল্লিশের কনফারেন্সে অবশ্য নির্মলের ভূমিকা ছিল খুবই সামান্য, সে ক’দিন ওকে বার্মিজ ডেলিগেশনের গাইড হিসেবে কাজ করতে হয়েছিল। কিন্তু বার্মায় কমিউনিস্ট আন্দোলন শুরু হওয়ার পর সেই সূত্র ধরেই পুলিশ এল ওর বাড়িতে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওরা নিয়ে গেল ওকে। এখনও ওই ডেলিগেশনের কারও সাথে ওর যোগাযোগ আছে কিনা, অথবা ওদের সম্পর্কে নতুন কিছু খবর যদি ও দিতে পারে, এই সব তথ্য ওর কাছে জানতে চেয়েছিল পুলিশ।

সবসুদ্ধ মাত্র দু-এক দিনই লক-আপে থাকতে হয়েছিল নির্মলকে। কিন্তু ওর পক্ষে সে অভিজ্ঞতার ফল হল মারাত্মক। সে সময় নীলিমার পরিবারের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই, নিজের বাড়ির থেকেও একেবারে বিচ্ছিন্ন, ফলে নিজের মধ্যে কেমন গুটিয়ে গেল নির্মল। কলেজে যেত না, দিনের পর দিন বিছানা থেকে উঠতে চাইত না। ব্যাপারটা বাড়াবাড়ির দিকে যাচ্ছে দেখে লজ্জার মাথা খেয়ে অবশেষে বাপের বাড়ির শরণাপন্ন হল নীলিমা। নির্মলের সঙ্গে বিয়েটা পরিবারের লোকেরা কখনওই ক্ষমার চোখে দেখেনি, কিন্তু এই বিপদের দিনে ওরাই ওর পাশে এসে দাঁড়াল। নীলিমার বাবার কথায় কয়েক জন ডাক্তার এসে নির্মলকে দেখে হাওয়া বদলের পরামর্শ দিলেন। নির্মলের পার্টির লোকেদেরও মনে ধরল কথাটা। আসলে ওরাও বুঝে গিয়েছিল এই রকম দুর্বল মানসিকতার লোক পার্টির বিশেষ কাজে আসবে না। নীলিমাও খুশি হল–শহর থেকে দূরে গেলে নির্মলও সেরে উঠবে, ওর নিজের হাঁপানিরও হয়তো কিছুটা উপশম হবে। কিন্তু কোথায় যাওয়া হবে সেটা ঠিক করাই হল সমস্যা। এবারেও মুশকিল আসান করলেন নীলিমার বাবা। সে সময় হ্যামিলটন এস্টেটের কিছু কাজকর্ম উনি দেখাশোনা করতেন। সেই সূত্রেই জানতে পারলেন এস্টেটের ম্যানেজার একজন শিক্ষকের খোঁজ করছেন লুসিবাড়ির স্কুলটা চালানোর জন্য।

১৯৩৯-এ স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিলটন মারা যাওয়ার পর এস্টেটের মালিকানা বর্তায় তার ভাইপো জেমস হ্যামিলটনের ওপর। কিন্তু জেমস থাকতেন স্কটল্যান্ডের অ্যারান দ্বীপে। কাকার সম্পত্তি পাওয়ার আগে কখনও ভারতে আসার কথা তার চিন্তাতেও আসেনি। স্যার ড্যানিয়েলের মৃত্যুর পর কয়েকদিনের জন্য উনি গোসাবায় এসেছিলেন বটে, কিন্তু এস্টেটের কাজেকর্মে কখনও মাথা গলাননি। সেসব দেখাশোনা করত ম্যানেজার আর কর্মচারীরা। ফলে নীলিমার বাবা একবার বলে দিলেই যে নির্মলের চাকরিটা হয়ে যাবে সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ ছিল না।

কিন্তু বেঁকে বসল নির্মল নিজে। এতদিন বামপন্থী রাজনীতি করার পর শেষে একজন পুঁজিপতির এস্টেটে গিয়ে কাজ করতে হবে? সে কী করে সম্ভব? অনেক সাধ্যসাধনার পর নীলিমা একবার গিয়ে জায়গাটা দেখে আসতে রাজি করাল ওকে। অবশেষে একদিন ওরা দু’জন গোসাবায় গিয়ে পৌঁছল। ঘটনাচক্রে সেদিন ছিল হ্যামিলটনের জন্মদিন। অবাক হয়ে ওরা দেখল ঠিক একটা পুজোর মতো করে জয়ন্তী উদ্যাপন করা হচ্ছে। এস্টেটের বিভিন্ন জায়গায় স্যার ড্যানিয়েলের মূর্তিগুলোকে মালা চন্দন দিয়ে সাজানো হয়েছে, ধূপ-ধুনো জ্বলছে সামনে, মূর্তির সামনে গিয়ে লোকে গড় হয়ে প্রণাম করছে। বোঝাই যাচ্ছিল স্থানীয় মানুষের কাছে এই স্কট সাহেব একজন প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি, প্রায় ভগবানের মতো ভক্তি করে হ্যামিলটনকে এখানকার লোকেরা। বাসিন্দাদের কাছে এস্টেটের আদর্শবাদী প্রতিষ্ঠাতার গল্প শুনে অবশেষে মত পরিবর্তন করতে বাধ্য হল নির্মল আর নীলিমা। মনে মনে একটু লজ্জাও হল ওদের।

কোথাকার কোন বিদেশি পুঁজিপতি এই জল-জঙ্গলের দেশে এসে গরিব মানুষের দুঃখ দূর করার জন্য কত কিছু করেছেন, আর সেখানে কলকাতা শহরের বাইরে মানুষ কীভাবে থাকে সে ব্যাপারে ওদের কোনও ধারণাই নেই। এতদিন ধরে যা বড় বড় প্রগতিশীল কথা বলে এসেছে সেগুলি হঠাৎ কেমন শূন্যগর্ভ মনে হল নির্মলের।

দু-একদিনের মধ্যেই মন স্থির করে ফেলল ওরা। আর লুসিবাড়িতে পা দেওয়ার পর ঠিক করে ফেলল এই দ্বীপেই এসে কাটাবে কয়েক বছর। সেবার কলকাতায় ফিরে গিয়ে নিজেদের সামান্য জিনিসপত্র যা ছিল গুছিয়ে নিল নির্মল আর নীলিমা, তারপর বর্ষা কেটে যাওয়ার পর একদিন চাটিবাটি গুটিয়ে এসে উঠল লুসিবাড়িতে।

প্রথম কয়েক মাস ওরা যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। সব কিছুই এখানে একেবারে নতুন, সব জায়গার থেকে আলাদা। এমনিতে গ্রামগঞ্জের ব্যাপারে যেটুকু ধারণা ওদের ছিল সেসব সাধারণ সমতলের গ্রাম। সেসব জায়গার সঙ্গে এতটুকুও মিল নেই এই ভাটির দেশের। অদ্ভুত এখানকার মানুষের দৈনন্দিন জীবনপ্রণালী ওদের মতো শহুরে লোকেদের বোধবুদ্ধির বাইরে। কতটুকুই বা দূর এখান থেকে কলকাতা শহর? মেরেকেটে সাতানব্বই কিলোমিটার। কিন্তু এদের সম্পর্কে বলতে গেলে কিছুই জানে না কলকাতার মানুষ। কত কথাই তো বলা হয় গ্রামভারতের স্মরণাতীত কালের ঐতিহ্য নিয়ে, কিন্তু চেনা জগতের থেকে একেবারে অন্যরকম এই পৃথিবীর কথা ক’টা লোক জানে? ক’জন চোখে দেখেছে এরকম একটা জায়গা যেখানে জাতপাত নেই, উঁচুনিচুর ভেদ নেই? আবার অন্যদিকে, কোথায় গেল সেই সমবায় ঋণ ভিত্তিক গণতান্ত্রিক দেশ? এখানকার সেই আলাদা মুদ্রা আর ব্যাঙ্কেরই বা কী হল? ভাটির দেশের কাদায় সোনা ফলানোর যে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল সে সোনা কোথায়?

দারিদ্র্য এত চরম এই ভাটির দেশে যে পঞ্চাশের মন্বন্তরের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল নির্মল আর নীলিমার। তফাত শুধু একটা খিদে, মৃত্যু আর বিপর্যয় লুসিবাড়ির মানুষের রোজকার জীবনযাপনের অঙ্গ। দশকের পর দশক ধরে মানুষ বাস করছে এই দ্বীপে, কিন্তু বহু চেষ্টায়ও এখানকার জমির লোনাভাব পুরোপুরি দূর করা যায়নি। চাষবাস তাই বিশেষ হয় না, যেটুকু ফসল ওঠে তাও খুবই নিকৃষ্ট মানের। দ্বীপের বেশিরভাগ মানুষই একবেলা খেয়ে থাকে। এত বছর ধরে এত পরিশ্রমে যে বাঁধ বাঁধা হয়েছে, তার ওপরেই বা কতটুকু ভরসা করা যায়? ঝড়ে বন্যায় প্রায়ই ফাটল ধরে এখানে সেখানে। আর বাঁধ ভেঙে একবার যদি লোনা জল ঢুকে পড়ে গ্রামের মধ্যে, বেশ কয়েক বছরের মতো চাষবাসের দফারফা। শুরুতে যারা এসে বসত শুরু করেছিল লুসিবাড়িতে তাদের বেশিরভাগই ছিল চাষিবাসি মানুষ। বিনেপয়সার চাষের জমি দিয়ে এখানে এনে বসানো হয়েছিল তাদের। এদিকে অনাবাদি জমিতে ফসল ভাল হয় না। অথচ পেটের জ্বালাও বড় বালাই। তাদের কেউ তাই শুরু করল মাছ ধরতে, আবার কেউ বা গেল জঙ্গলের দিকে, যদি কিছু শিকার পাওয়া যায় সেই আশায়। ফল হল মারাত্মক। বহু লোক জলে ডুবে মরল, অনেককে কুমিরে কামটে টেনে নিয়ে গেল। এই বাদাবন থেকে যা পাওয়া যায় তাতে রোজকার পেটের খিদে মেটে না। তবুও হাজার হাজার মানুষ জঙ্গলে যেতে শুরু করল, সামান্য একটু মধু, মোম, জ্বালানি কাঠ বা কেওড়া গাছের টোকো ফলের আশায়। ফলে প্রতিদিনই একটা না একটা লোক মরত হয়–বাঘের বা কুমিরের মুখে, কিংবা সাপের ছোবলে।

আর স্কুলটারও যা ছিরি দেখল ওরা সে আর বলবার নয়। থাকার মধ্যে আছে চারটে দেওয়াল আর মাথার ওপরে একটা ছাদ। এস্টেটের তো ভাঁড়ে মা ভবানী। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, উন্নয়ন, সবকিছুর জন্য পয়সার বরাদ্দ আছে ঠিকই, কিন্তু সে পয়সা যে কোথায় যায় তা কেউ জানে না। লোকে বলে ফান্ডের সব টাকাই যায় আসলে ম্যানেজারবাবুর পকেটে, আর সে নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করলেই পোষা গুণ্ডা লেলিয়ে তার মুখ বন্ধ করার ব্যবস্থা আছে। পুরো জায়গাটাই যেন দ্বীপান্তর পাওয়া লোকেদের কলোনি। পরিবেশটাও দমবন্ধ, প্রায় জেলখানার মতো।

নির্মল আর নীলিমা হ্যামিলটনের স্বপ্নরাজ্যের খোঁজে লুসিবাড়িতে আসেনি বটে, কিন্তু এখানে এসে দারিদ্র্যের এরকম নির্মম চেহারা দেখতে হবে সেটাও ওদের কল্পনাতে ছিল না। সব দেখেশুনে একটাই প্রশ্ন মনে এল ওদের : “কী করা যায় এই মানুষগুলোর জন্য?”

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নির্মল লেনিনের “কী করতে হবে” বইটা বারবার পড়তে লাগল, কিন্তু সন্তোষজনক কোনও পথ খুঁজে পেল না। তুলনায় নীলিমার বাস্তবুদ্ধি অনেক বেশি। পুকুরে বা কুয়োতে স্নান করতে কি কাপড় কাঁচতে গিয়ে গ্রামের মহিলাদের সঙ্গে দেখা হলে তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে শুরু করল ও। তাদের সুখদুঃখের খবরও জেনে নিতে লাগল।

লুসিবাড়িতে আসার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করল নীলিমা। দ্বীপের মহিলাদের বেশিরভাগেরই বেশভূষা বিধবাদের মতো–সাদা শাড়ি, সাদা সিঁথি, হাতে একগাছা রুলিও নেই। মাঝে মাঝে তো এমন হয় যে একজনও সধবা মহিলা খুঁজে পাওয়া যায় না পুকুরঘাটে কি কুয়োতলায়। খোঁজখবর করে নীলিমা জানতে পারল ভাটির দেশের এ এক অদ্ভুত নিয়ম। এখানকার মেয়েরা ছোটবেলা থেকেই জেনে আসে শাখা সিঁদুরের জোর ওদের নেই। বিয়ে যদি হয়ও, কয়েক বছরের মধ্যেই স্বামীহারা হতেই হবে। কেউ ঠেকাতে পারবে না। পঁচিশ, কি খুব বেশি হলে তিরিশ বছর, তার বেশি বয়স পর্যন্ত স্বামী-সোহাগ লেখা নেই ওদের কপালে। এ ধারণা ওদের একেবারে মর্মে মর্মে গেঁথে গেছে। সেই জন্যই ঘরের লোক মাছ ধরতে কি জঙ্গল করতে গেলে এখানকার মেয়েরা রঙিন শাড়ি ছেড়ে সাদা কাপড় পরে, সিঁদুর ধুয়ে ফেলে মাথা থেকে। যেন আগে থেকে দুঃখভোগ করে নিতে চায় স্বেচ্ছায়–যদি তাতে একটু দেরিতে আসে সে দুঃখের দিন। নাকি অনিবার্য ভবিষ্যতের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করে নিতেই এই নিয়ম বানিয়ে নিয়েছে এরা?

পুরো ব্যবস্থাটার প্রচণ্ড তীব্রতা নীলিমাকে যেন একটা ঝাঁকি দিয়ে গেল। ওর চেনা। জগতের মহিলারা–ওর মা কি দিদি তো মরে গেলেও এভাবে তাদের সধবার বেশ ত্যাগ করতে পারবে না। নিজেই কি পারবে নীলিমা? এত প্রগতিশীলতার শিক্ষা সত্ত্বেও তো ওর কাছে এখনও সজ্ঞানে শাঁখা সিঁদুর ফেলে দেওয়া আর স্বামীর বুকে শেল বিধিয়ে দেওয়া একই ব্যাপার। কিন্তু এই মেয়েদের জন্য বৈধব্যের পরীক্ষা বৃথা যায় কমই। ভাটির দেশের নদী-খাড়ির বাঁকে বাঁকে মরণ ওত পেতে থাকে। পেটের ভাতের জন্য জলে-জঙ্গলে যাওয়া ছাড়া যাদের গতি নেই বেশি দিন শাঁখা-সিঁদুরের বিলাসিতা ভোগ করা তাদের ঘরের বউ মেয়েদের কপালে নেই।

হিন্দু সমাজের প্রান্তবাসী ভাটির দেশের এই গ্রামে অবশ্য সামাজিক অনুশাসনের চোখরাঙানি নেই। বিধবারা যদি চায় আরেকবার বিয়ে করতেই পারে। কিন্তু সমর্থ পুরুষ মানুষেরই যেখানে আকাল সেখানে সে বাধা থাকাই বা কী, না থাকাই বা কী। বরঞ্চ নীলিমা দেখল সমতলের গ্রাম-শহরের তুলনায় এখানেই বিধবাদের আরও বেশি পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়, বছরের পর বছর সহ্য করে যেতে হয় পীড়ন আর লাঞ্ছনা।

কীভাবে ব্যাখ্যা করা যায় এই মেয়েদের যন্ত্রণার জীবনকে? কোন শব্দ দিয়ে বর্ণনা করবে এদের নীলিমা? এরা তো একটা অন্য শ্রেণী। কিন্তু নির্মলকে কে বোঝাবে। তার মতে শুধুমাত্র এই মেয়েদের কী করে একটা শ্রেণীতে ফেলা যায়? শ্রমিকরা হল একটা শ্ৰেণী, কিন্তু শ্রমিকের বিধবাদের একটা শ্ৰেণী বলে উল্লেখ করার কোনও মানেই হয় না, এরকম কোনও শ্রেণী কখনও হতে পারে না।

কিন্তু এরা যদি একটা আলাদা শ্রেণী না হয়, তা হলে এরা কী?

শব্দ আর তত্ত্বের ভাড়ার যখন খালি হয়ে এল তখন অবশেষে বোধোদয় হল নীলিমার। কী আসে যায় নামে? শ্রেণী হোক বা না হোক, এই মেয়েদের কষ্টের জীবন পালটাতেই হবে। সে যে করেই হোক। স্কুলের কাছেই থাকত বছর পঁচিশ বয়সের এক বিধবা মহিলা, তাকে গিয়ে নীলিমা একদিন জিজ্ঞেস করল সে গোসাবা থেকে কিছু সাবান, দেশলাই ও আরও দু-একটা টুকিটাকি জিনিস কিনে আনতে পারবে কি না। লুসিবাড়িতে ওই সব জিনিসের যা দাম, তাতে সেগুলো বিক্রির পর ওর যাতায়াত ভাড়া বাদ দিয়েও হাতে বেশ কিছুটা পয়সা থেকে যাবে। তার অর্ধেক ও নিজের জন্য রাখতে পারে। নীলিমার এই ভাবনার বীজ থেকেই ধীরে ধীরে পাতা মেলল লুসিবাড়ির মহিলা সংগঠন। আর সেদিনের সেই চারাগাছ অবশেষে মহীরুহের আকার নিল বাদাবন ট্রাস্টের জন্মের পর।

নির্মল আর নীলিমার লুসিবাড়িতে আসার কয়েক বছরের মধ্যেই জমিদারি উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিল সরকার। আইন হল কোনও একজন ব্যক্তি বা সংগঠনের মালিকানায় খুব বেশি জমি থাকতে পারবে না। টুকরো টুকরো হয়ে গেল হ্যামিলটন এস্টেটের সম্পত্তি। যেটুকু যা বাকি ছিল মামলা-মোকদ্দমায় তারও শোচনীয় অবস্থা দাঁড়াল। অন্যদিকে নীলিমার মহিলা সংগঠন তখন দিনে দিনে বাড়ছে। রোজ নতুন নতুন মেয়েরা আসছে নাম লেখাতে, কাজও বেড়ে চলেছে পাল্লা দিয়ে চিকিৎসা, চাষ-আবাদ, ছোটখাটো আইনি সমস্যা–সব ব্যাপারে মানুষকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে সংগঠন। আস্তে আস্তে এত বিশাল আকার নিল নীলিমাদের এই আন্দোলন যে সেটা রেজিষ্ট্রি করানোর প্রশ্ন এল তখন। সাথে সাথে খাতায়-কলমে যাত্রা শুরু হল বাদাবন ট্রাস্টের।

নীলিমার এই কাজ কিন্তু কখনওই নির্মলের পুরোপুরি সহযোগিতা পায়নি। সমাজসেবার গন্ধলাগা এই সব কাজে কোনওদিনই ও বিশেষ উৎসাহ পায়নি। ট্রাস্টের নামটা অবশ্য ওরই দেওয়া। কিন্তু ওই পর্যন্তই।

আসলে ‘বাদাবন’ শব্দটা ছিল নির্মলের খুব পছন্দের। ও বলত ইংরেজি ‘বেদুইন’-এর মতো বাদাবনও এসেছে আরবি ‘বাদিয়া’ শব্দ থেকে, যার অর্থ মরুভূমি। “কিন্তু ইংরেজরা তো আরবি শব্দটাকেই শুধু একটু পালটে নিয়েছে। আর বাঙালিরা আরবি বাদা’র সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে সংস্কৃত ‘বন’,” নীলিমাকে প্রায়ই বলত নির্মল। “বাদাবন শব্দটা নিজেই যেন দুটো বিরাট ভাষার মোহনায় গড়ে ওঠা একটা দ্বীপের মতো যেন গঙ্গা আর ব্রহ্মপুত্রের মাঝে জেগে ওঠা আরেকটা ভাটির দেশ। তোমার ট্রাস্টের জন্য এর থেকে ভাল নাম আর কিছু হতে পারে না।”

ট্রাস্ট তৈরি হওয়ার পর প্রথমেই দ্বীপের মাঝামাঝি একটা জায়গায় বেশ খানিকটা জমি কিনল নীলিমারা। পরে, সত্তরের দশকের শেষদিকে, সেই জমির ওপরেই আস্তে আস্তে গড়ে উঠল ওদের নিজস্ব হাসপাতাল, ওয়ার্কশপ, অফিসঘর আর গেস্ট হাউস। কিন্তু সেসব তো বছর দশেক পরের কথা। কানাই প্রথম যখন লুসিবাড়িতে আসে–সেই ১৯৭০ সালে–এসবের কোনও চিহ্নই ছিল না তখন। মহিলা সমিতির মিটিং-ও তখন নির্মলদের ‘বাংলো’র উঠোনেই হত। আর সেখানেই কুসুমের সঙ্গে প্রথম দেখা হল কানাইয়ের।