» » » একটি হত্যা

বর্ণাকার

একটি হত্যা

মেঘার কেবিনগুলোর প্রত্যেকটার মধ্যেই একটা করে উঁচু প্ল্যাটফর্ম মতো জায়গা আছে, বাঙ্ক হিসাবে ব্যবহার করার জন্য। সেখানে কম্বল চাদর আর বালিশ পেতে একটা বিছানা বানিয়ে নিয়েছিল কানাই। খুব একটা শৌখিন কিছু না, তবে মোটামুটি আরামদায়ক। তার ওপরে শুয়ে বেশ ভালই ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ লোকজনের গলার আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল। মনে হল চারিদিকে অনেক লোকের হইচই। কিছু আওয়াজ দূর থেকে ভেসে আসছে, কিছু কাছ থেকে। হাতড়ে টর্চটা নিয়ে ঘড়ি দেখল কানাই–রাত তিনটে। ওপরের ডেক থেকে হরেন আর তার নাতির গলা পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে, দুজনেই মনে হল খুব উত্তেজিত।

ঘুমোতে যাওয়ার আগে জামাকাপড় ছেড়ে শুধু একটা লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে নিয়েছিল কানাই, এখন গা থেকে কম্বলটা সরাতেই হাওয়ার ঠান্ডা ভাবটা টের পেল বেশ। কেবিন থেকে বেরোনোর আগে একটা কম্বল তুলে পেঁচিয়ে নিল গায়ে। হরেন আর তার নাতি কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল, রেলিং-এর ওপর ঝুঁকে পড়ে তাকিয়ে ছিল পাড়ের দিকে।

“কী হয়েছে?” কানাই জিজ্ঞেস করল।

“ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। গায়ে কিছু একটা হয়েছে মনে হচ্ছে।”

মাঝনদীতে নোঙর করা রয়েছে বোটটা। বেশ কয়েক ঘণ্টা আগে জোয়ারও লেগে গেছে; পাড় থেকে ওদের দূরত্ব এখন কম করে এক কিলোমিটার। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তুলো তুলো মেঘের মতো হিম উঠে এসেছে  জলের বুক থেকে: ভোরের কুয়াশার মতো ঘন না হলেও দূরের পাড়ি অনেকটা আবছা লাগছে তাতে। কাঁপা কাঁপা হিমের চাদরের মধ্যে দিয়ে দেখা গেল কয়েকটা কমলা রং-এর  আলোর বিন্দু খুব তাড়াতাড়ি এদিক ওদিক নড়াচড়া করছে, যেন জ্বলন্ত মশাল নিয়ে পাড় বেয়ে দৌড়োদৌড়ি করছে কিছু লোক। কুয়াশা সত্ত্বেও এতটা দূর থেকে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে তাদের গলার আওয়াজ। এতগুলি লোক এই মাঝরাত্তিরে কেন এভাবে ছুটোছুটি করছে সেটা হরেন আর তার নাতিও মনে হল ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না।

হঠাৎ কনুইয়ে কার একটা ছোঁয়া পেল কানাই। ঘুরে তাকিয়ে দেখল পিয়া দাঁড়িয়ে আছে পাশে, চোখ ঘষছে হাত মুঠো করে। “কী হয়েছে?”

“সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি। এরাও কেউ বলতে পারছে না।”

“ফকিরকে একবার জিজ্ঞেস করুন না।”

ভটভটির পেছন দিকটায় গেল কানাই, পিয়াও গেল সঙ্গে সঙ্গে। নীচে নৌকোর ওপর টর্চের আলো ফেলতে দেখা গেল জেগেই আছে ফকির, একটা কম্বল মুড়ি দিয়ে নৌকোর মাঝখানটায় বসে আছে জড়োসড়ো হয়ে। মুখে আলো পড়তে হাত তুলে চোখ আড়াল করল। টর্চটা নিভিয়ে দিল কানাই। একটু ঝুঁকে পড়ে কী কথা বলল ফকিরের সঙ্গে।

“ও জানে কী হয়েছে?” পিয়া জানতে চাইল।

“না। ডিঙি নিয়ে যাবে বলছে পাড়ে। বলছে চাইলে আমরাও যেতে পারি ওর সঙ্গে।”

“সে তো যাবই।”

ফকিরের নৌকোয় চড়ে বসল কানাই আর পিয়া। নাতিকে ভটভটিটার দায়িত্বে রেখে হরেনও চলে এল ওদের সঙ্গে।

পাড় পর্যন্ত যেতে প্রায় মিনিট পনেরো লাগল। এগোতে এগোতেই বোঝা যাচ্ছিল, একটা নির্দিষ্ট জায়গাকে কেন্দ্র করে হল্লাটা হচ্ছে: মনে হল হরেনের আত্মীয়রা গ্রামের যে জায়গাটায় থাকে ঠিক সেইখানটাতেই এসে জড়ো হচ্ছে সব লোকজন। ডাঙা যত কাছে আসতে থাকল ততই জোর হতে লাগল লোকের কথাবার্তা আর চিৎকার চেঁচামেচি, বাড়তে বাড়তে একসময় সমস্ত আওয়াজ মিশে গিয়ে শুধু ক্রুদ্ধ ধকধকে একটা শব্দে পরিণত হল।

আওয়াজটা শুনতে শুনতে কেমন একটা ভয় ধরে গেল কানাইয়ের। হঠাৎ একটা ঝোঁকের মাথায় বলল, “পিয়া, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আমাদের আর এগোনোটা উচিত হবে কিনা।”

“কেন?”

“এই হইচই-টা শুনে আমার কী মনে হচ্ছে জানেন?” কানাই জিজ্ঞেস করল।

“কী, একটা জটলা-টটলা কিছু?”

“জটলা ঠিক নয়, বলা যেতে পারে ‘মব’–উত্তেজিত জনতা।”

“মব? এইটুকু একটা গ্রামে মব?”

“ব্যাপারটা বিশ্বাস করা কঠিন, তবে আওয়াজ যা শোনা যাচ্ছে তাতে আমার মনে হচ্ছে বড় ধরনের কোনও দাঙ্গা-হাঙ্গামা হচ্ছে ওখানে, আর দাঙ্গা আমি সামনাসামনি দেখেছি, চোখের সামনে লোক মরতেও দেখেছি। আমার মন বলছে সেইরকমই কিছু একটা হাঙ্গামার মধ্যে গিয়ে পড়তে চলেছি আমরা।”

চোখের ওপর হাত আড়াল করে কুয়াশার মধ্যে দিয়ে গ্রামটার দিকে দেখতে লাগল পিয়া। “ব্যাপারটা দেখাই যাক না গিয়ে।”

জোয়ার শেষ হয়ে ভাটা পড়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ হল, কিন্তু নদী এখনও টইটম্বুর। খুব সহজেই ফকির ডিঙির গলুইটা পাড়ের কাদার মধ্যে নিয়ে তুলল। সামনে থেকে উঠে গেছে ভেজা মাটির ঢাল, বাদাবনের অন্ধকারে ঢাকা, তাদের শ্বাসমূল আর ছোট ছোট চারায় ভর্তি চারদিক। ভিড়টা যেখানে জড়ো হয়েছে তার কাছাকাছি নৌকোটা নিয়ে গিয়ে ভিড়িয়েছে। ফকির, ডিঙি থেকে সামনে ছায়ার মতো দেখা যাচ্ছে বাঁধটা, তার ওপর জমাট কুয়াশা–লালচে আভা ধরেছে মশালের আলোয়।

কানাই আর পিয়া বনবাদাড়ের মধ্যে দিয়ে আস্তে আস্তে এগোচ্ছিল সামনের দিকে, হাত নেড়ে ওদের থামিয়ে দিল হরেন। কানাইয়ের হাত থেকে টর্চটা নিয়ে পায়ের কাছে মাটিতে একটা জায়গায় আলো ফেলল। কাছে গিয়ে কানাই আর পিয়া দেখল মাটির মধ্যে একটা দাগের ওপর গিয়ে পড়েছে আলোটা। মাটিটা এখানে একটু নরম, ঠিক ভেজাও নয়, আবার শুকনোও নয়। তার ওপর স্পষ্ট হয়ে বসে গেছে ছাপটা, স্টেনসিলে আঁকা ছবির মতো। ওটা কীসের দাগ সেটা বুঝতে একটুও সময় লাগল না কানাইয়ের আর পিয়ার। রান্নাঘরের মেঝেতে বেড়ালের পায়ের ছোপ যেরকম দেখতে লাগে, এই দাগটাও খানিকটা সেইরকম–শুধু তার চেয়ে বহুগুণ বড়। এত স্পষ্টভাবে ছাপটা পড়েছে যে তার মধ্যে থাবার গোলগোল মাংসল অংশের গড়ন আর গুটিয়ে নেওয়া নখের দাগ আলাদা করে দেখা যাচ্ছিল। টর্চের আলোটা সামনের দিকে ফেলল হরেন। হুবহু একরকম ছাপ পরপর নদীর পাড় থেকে সোজা চলে গেছে বাঁধের ওপর। দাগগুলো দেখে জানোয়ারটা কোন পথে এসেছে তার একটা আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছিল। ওপারের জঙ্গল থেকে নেমে সাঁতরে নদী পার হয়েছে, আর এদিকে এসে পাড়ে যেখানটায় উঠেছে, ঠিক সেই জায়গাটাতেই এখন ভাসছে ফকিরের নৌকো।

“যেখান দিয়ে ওটা নদী পেরিয়েছে সেই জায়গাটা মেঘার থেকে নিশ্চয়ই দেখা যাচ্ছিল,” পিয়া বলল।

“খুব সম্ভবত। কিন্তু আমরা সবাই যেহেতু ঘুমিয়ে ছিলাম তাই কেউ দেখে ফেলার ভয়টা মনে হয় ছিল না ওর।”

বাঁধের মাথার কাছাকাছি পৌঁছে মাটিতে বড়সড় একটা ছাপের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাল হরেন। ইশারায় বলল এখানে বসেই গ্রামটাকে পর্যবেক্ষণ করে ওর শিকার বেছে নিয়েছিল জানোয়ারটা। মাটিতে আরেকটা দাগের দিকে দেখিয়ে বলল খুব সম্ভবত এখান থেকেই লাফ দিয়ে পড়েছিল শিকারের ওপর। বলতে বলতে উদ্বেগে অধীর হয়ে সামনের দিকে ছুটতে শুরু করল বুড়ো মানুষটা। ফকিরও দৌড়ল সঙ্গে সঙ্গে। কয়েক পা পেছনেই চলল পিয়া আর কানাই। কিন্তু বাঁধের ওপরে পৌঁছতেই যে দৃশ্য চোখে পড়ল তাতে সবাই থমকে থেমে গেল একসঙ্গে। মশালের আলোয় দেখা যাচ্ছিল গোটা গ্রামটা গায়ে গায়ে লাগা কতগুলি মাটির বাড়ির জটলার মতো। বাঁধের সমান্তরাল ভাবে পরপর চলে গেছে বাড়িগুলো। ওদের ঠিক সামনে, শখানেক মিটার দূরে, দেখা যাচ্ছিল একটা মাটির দেওয়ালওয়ালা ঘর, খোড়ো ছাউনি দেওয়া। কুঁড়েটার চারদিকে ঘিরে প্রায় একশো লোক জড়ো হয়েছে। বেশিরভাগই পুরুষমানুষ, তাদের অনেকের হাতে লম্বা বাঁশের বল্লম, সামনের দিকটা চেঁছে ছুঁচোলো করা। সেই বল্লমগুলো ওরা বারবার গেঁথে দিচ্ছে মাটির ঘরটার মধ্যে। প্রচণ্ড ভয় আর ক্রোধে বিকৃত হয়ে গেছে লোকগুলোর মুখ। ভিড়ের মধ্যে যে ক’জন মহিলা আর বাচ্চা আছে সমস্বরে তারা চিৎকার করছে:

“মার! মার!”

ভিড়টার একধারে হরেনকে দেখতে পেয়ে কানাই আর পিয়া সেদিকে এগিয়ে গেল। “এখানেই আপনার আত্মীয়রা থাকেন?” জিজ্ঞেস করল কানাই।

“হ্যাঁ,” বলল হরেন। “এখানেই থাকে ওরা।”

“কী হয়েছে? গণ্ডগোলটা কীসের?”

“সেই যে মোষের বাচ্চা হওয়ার আওয়াজ শুনেছিলাম আমরা মনে আছে?” হরেন বলল।

“সেই থেকেই শুরু হয়েছে ব্যাপারটা। নদীর ওপার থেকে বড়মিঞাও শুনেছে আওয়াজটা। তারপর  জল পেরিয়ে চলে এসেছে এদিকে।”

সামনের কুঁড়েটা আসলে একটা গোয়ালঘর, বলল হরেন। কাছেই একটু বড় আরেকটা কুঁড়েতে থাকে ওর আত্মীয়রা। আধঘণ্টাখানেক আগে হঠাৎ হুড়মুড় করে একটা শব্দ আর গোরুমোষের চিৎকারে ওদের ঘুম ভেঙে যায়। বাইরে তখন ঘন অন্ধকার। কুয়াশাও ছিল বেশ। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে তাই কিছুই দেখতে পায়নি ওরা, কিন্তু যেটুকু শুনতে পেয়েছে তাতেই পরিষ্কার বোঝা গেছে কী ঘটেছে ব্যাপারটা: বড় একটা জানোয়ার লাফ দিয়ে এসে পড়েছে গোয়ালঘরটার ওপর, আর নখ দিয়ে খড়ের চালে গর্ত করার চেষ্টা করছে। একটু পরেই আরেকটা ধড়মড় করে আওয়াজে বোঝা গেছে জানোয়ারটা ঢুকে পড়েছে গোয়ালের ভেতরে। বাড়িতে ছয় ছয়টা জোয়ান লোক। ওরা দেখল এরকম সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। বাঘটা এ গাঁয়ে নতুন নয়, আগেও এসেছে বেশ কয়েকবার। দু’বার দুটো লোককে মেরেছে, গোরু-ছাগলও খেয়েছে অনেকগুলো। এখন গোয়ালঘরের মধ্যে ওটা যতটুকু সময় আছে তার মধ্যে ওকে কবজা করা খুব একটা কঠিন হবে না। কারণ ওখান থেকে পালাতে হলে ওকে খাড়া লাফ দিয়ে চালের ওই ঘেঁদাটার মধ্যে দিয়ে বেরোতে হবে। একটা বাঘের পক্ষেও সেটা খুব একটা সোজা কাজ নয়। আর মুখে একটা বাছুর নিয়ে ওভাবে লাফিয়ে বেরোনো তো আরও কঠিন।

বাড়িতে যে ক’টা মাছ-ধরা জাল ছিল সবগুলো নিয়ে ওরা বেরিয়ে এল। একটার পর একটা সেগুলোকে ছুঁড়ে দিল গোয়ালঘরের চালের ওপর। তারপর কাঁকড়া ধরার নাইলন দড়ি দিয়ে শক্ত করে একসঙ্গে বাঁধল জালগুলোকে। এবার বাঘটা বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য যেই লাফ দিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে গেছে জালে; আর ফের গিয়ে পড়েছে গোয়ালঘরের ভেতর। বেরোনোর জন্য ছটফট করছে ওটা তখন। সেই সময় ছেলেদের মধ্যে একজন একটা বাঁশের বল্লম জানালা দিয়ে সোজা ঢুকিয়ে দিয়েছে ওর চোখের মধ্যে।

হরেন যেমন যেমন বলে যাচ্ছিল, সঙ্গে সঙ্গে কথাগুলি ইংরেজিতে অনুবাদ করে যাচ্ছিল কানাই পিয়ার জন্য। কিন্তু এই পর্যন্ত শুনেই ওকে থামিয়ে দিল পিয়া। কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “তার মানে আপনি বলতে চাইছেন বাঘটা এখনও এই চালাঘরটার মধ্যে রয়েছে?”

“হ্যাঁ,” বলল কানাই। “এখানেই আটকে রয়েছে বাঘটা এখন, অন্ধ অবস্থায়।”

পিয়া একবার মাথাটা ঝাঁকাল, যেন একটা দুঃস্বপ্ন থেকে জেগে ওঠার চেষ্টা করছে। দুর্বোধ্য একটা দৃশ্য ঘটে যাচ্ছে চোখের সামনে, কিন্তু তার প্রতিটা খুঁটিনাটি এত স্পষ্ট, যে এতক্ষণে পিয়া বুঝতে পারল এই সব তীক্ষ্ণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এতগুলি লোক আসলে ওই আহত প্রাণীটাকে আক্রমণ করছে। পুরো ব্যাপারটা তখনও ও বোঝার চেষ্টা করছে, এমন সময় সাড়া দিল বাঘটা, এই প্রথম বার। মুহূর্তের মধ্যে গোয়ালঘরের থেকে দূরে সরে গেল লোকজন। বল্লম-উল্লম ফেলে হাত দিয়ে মুখ আড়াল করল সবাই, যেন প্রচণ্ড কোনও বিস্ফোরণ থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে। এমন তীব্রতা সে আওয়াজের যে পায়ের নীচের মাটি পর্যন্ত কেঁপে কেঁপে উঠছিল তাতে, নিজের খালি পায়ের চেটোয় সেটা স্পষ্ট অনুভব করল পিয়া। এক মুহূর্তের জন্য সকলের সব নড়াচড়া থেমে গেল। তারপর যেই পরিষ্কার হল যে বাঘটা এখনও গোয়ালঘরের মধ্যেই অসহায় বন্দি অবস্থাতেই রয়েছে, অমনি বল্লম তুলে নিয়ে দ্বিগুণ ক্রোধে সেদিকে তেড়ে গেল সবাই।

কানাইয়ের হাতটা খামচে ধরে ওর কানের কাছে চিৎকার করে পিয়া বলল, “এক্ষুনি কিছু একটা করতে হবে, কানাই। এটা কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না।”

“কিছু করতে পারলে ভাল হত পিয়া, কিন্তু উপায় কিছু আছে বলে তো মনে হচ্ছে না।”

“কিন্তু একটা চেষ্টা তো করে দেখা যেতে পারে, কানাই, করা যায় না কিছু?” পিয়ার গলায় অনুনয়ের সুর।

এর মধ্যে হরেন এসে ফিসফিস করে কী যেন বলল কানাইয়ের কানে কানে। সঙ্গে সঙ্গে পিয়ার হাতটা ধরে বাঁধের দিকে ফেরানোর চেষ্টা করল কানাই। “শুনুন পিয়া, আমাদের ফিরে যেতে হবে এখন।”

“ফিরে যেতে হবে? কোথায়?”

“লঞ্চে ফিরতে হবে,” কানাই বলল।

“কেন?” জিজ্ঞেস করল পিয়া। “কী হবে এখন এখানে?”

পিয়ার হাতটা ধরে টানতে শুরু করল কানাই। “যাই হোক না কেন, এখানে দাঁড়িয়ে সেটা না দেখাই ভাল আপনার।”

মশালের আলোয় উজ্জ্বল ওর মুখের দিকে তাকাল পিয়া। “কী লুকোচ্ছেন আপনি আমার থেকে? কী করতে চাইছে এরা?”

মাটিতে থুতু ফেলল কানাই। একটা জিনিস বোঝার চেষ্টা করুন পিয়া–এই জানোয়ারটা বহুদিন ধরে বার বার এ গ্রামে হানা দিচ্ছে। দু-দুটো লোককে মেরেছে, গোরু-ছাগল যে কত মেরেছে তার ইয়ত্তা নেই–”

“কিন্তু ওটা তো জানোয়ার, কানাই,” বলল পিয়া। “জানোয়ারের ওপর আপনি প্রতিশোধ নিতে পারেন না।”

চারিদিকে উন্মত্তের মতো চিৎকার করছে গ্রামের লোকেরা, মশালের দপদপে আলোয় চকচক করছে তাদের মুখগুলো: মার! মার! পিয়ার কনুইটা ধরে ওকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল কানাই। “দেরি হয়ে গেছে পিয়া, আর কিছু করার নেই। আমাদের চলে যেতে হবে এখন।”

“চলে যাব?” পিয়ার গলায় বিস্ময়। “কিছুতেই যাব না আমি। আমি এটা আটকাব।”

“পিয়া, এটা একটা উন্মত্ত মব, খেপে গেলে আমাদেরও অ্যাটাক করতে পারে ওরা। আমরা এখানে বাইরের লোক।”

“তা হলে শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবেন?”

“আমাদের পক্ষে এখানে কিছু করা সম্ভব নয় পিয়া,” প্রায় চিৎকার করে বলল কানাই। “ঠান্ডা মাথায় একটু বোঝার চেষ্টা করুন ব্যাপারটা। চলুন, চলে যাই এখান থেকে।”

এক ঝাঁকুনি দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিল পিয়া। “আপনি যেতে চান তো চলে যান, কিন্তু আমি কিছুতেই এভাবে কাপুরুষের মতো পালাব না। আপনি যদি কিছু না করেন, তা হলে আমি করব। আর ফকির–আমি জানি ফকিরও করবে। ও কোথায় গেল?”

আঙুল তুলে দেখাল কানাই। “ওখানে। দেখুন।”

বুড়ো আঙুলের ওপর ভর দিয়ে ডিঙি মেরে পিয়া দেখল ভিড়টার একেবারে সামনের দিকে দেখা যাচ্ছে ফকিরকে, একটা বাঁশের বল্লম চেঁছে ছুঁচোলো করে দিচ্ছে একজনকে। এক ধাক্কায় কানাইকে সরিয়ে দিয়ে ভিড়টার মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল পিয়া। ঠেলতে ঠেলতে চলে গেল ফকিরের কাছ পর্যন্ত। সঙ্গে সঙ্গে ওদের চারপাশের ভিড়টা বেড়ে উঠল, মানুষের চাপে ফকিরের পাশের লোকটার গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে গিয়ে পড়ল পিয়া। মশালের দপদপে আলোয় কাছ থেকে বল্লমটা দেখতে পেল পিয়া। ছুঁচোলো ডগাটায় রক্তের দাগ। আর বাঁশের চেঁাচের ফাঁকে ফাঁকে লেগে আছে কয়েকগুছি হলদে কালো লোম। হঠাৎ পিয়ার মনে হল ও যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে জানোয়ারটাকে–ভয়ে গুটিসুটি মেরে এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে গোয়ালঘরটার ভেতরে, সরে সরে গিয়ে ছুঁচোলো বল্লমগুলোর থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করছে, গায়ের জায়গায় জায়গায় গর্ত হয়ে গেছে মাংসের মধ্যে, সেই ক্ষতস্থানগুলি চাটছে। হাত বাড়িয়ে একটানে বল্লমটা কেড়ে নিল ও, সামনের লোকটার কাছ থেকে। তারপর পায়ের চাপে সেটাকে ভেঙে ফেলল দু’টুকরো করে।

এক মুহূর্তের জন্য ভীষণ হতভম্ব হয়ে গেল লোকটা। তারপর হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে কী সব বলতে লাগল আর একটা হাত মুঠো করে ঝাঁকাতে থাকল পিয়ার মুখের সামনে। মিনিট খানেকের মধ্যে আরও জনা ছয়েক এসে জুটে গেল লোকটার সঙ্গে। বয়স কারওরই খুব একটা বেশি নয়, মাথায় একটা করে চাদর জড়ানো সবার। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কী যে বলতে লাগল একবর্ণও তার বুঝল না পিয়া। এমন সময় কার একটা হাত এসে ধরল ওর কনুইটা। ফিরে তাকিয়ে দেখল ফকির দাঁড়িয়ে রয়েছে ওর পেছনে। ওকে দেখে ভরসা পেল পিয়া: আশায় আর স্বস্তিতে হঠাৎ যেন অবশ হয়ে গেল মনটা। মনে হল ফকির ঠিক জানবে কী করতে হবে, এই সব পাগলামি বন্ধ করার কিছু একটা উপায় ঠিক ও বের করবে। কিন্তু সেসব কিছু করার বদলে ফকির এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল ওকে, বুকের সঙ্গে চেপে ধরে সরিয়ে নিয়ে চলল ভিড় ঠেলে। দু’পায়ে ওর হাঁটুতে লাথি মারতে লাগল পিয়া, খামচে দিল হাতদুটো। তার মধ্যেই হঠাৎ দেখতে পেল ভিড়টার মধ্যে থেকে একটা আগুনের গোলা উড়ে গিয়ে পড়ল গোয়ালঘরটার ওপর। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চালাটার ওপর গজিয়ে উঠতে শুরু করল লকলকে আগুনের শিখা। আরেকবার শোনা গেল গর্জন। তার এক মুহূর্ত পর ভিড়টা থেকে জবাব এল সে গর্জনের, উন্মত্ত রক্তলোলুপ চিৎকার–মার! মার! গোয়ালের ওপর লাফিয়ে বাড়তে লাগল আগুন, কাঠকুটো আর শুকনো খড় দিয়ে সেটাকে আরও উশকে দিতে থাকল লোকজন।

ফকিরের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল পিয়া। চিৎকার করতে শুরু করল: “ছাড়ো আমাকে ছেড়ে দাও!”

কিন্তু ছেড়ে দেওয়ার বদলে ওকে ঘুরিয়ে ধরল ফকির, চেপে ধরল নিজের শরীরের সঙ্গে; তারপর খানিকটা হেঁচড়ে, খানিকটা পাঁজাকোলা করে বাঁধের ওপর নিয়ে গিয়ে তুলল। লাফিয়ে বাড়তে থাকা আগুনের আলোয় পিয়া দেখল কানাই আর হরেন সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চারপাশ থেকে ঘিরে ওকে বাঁধ থেকে নামিয়ে নৌকোর দিকে নিয়ে চলল ওরা।

বাঁধের গা বেয়ে হোঁচট খেতে খেতে নামতে নামতে কোনওরকমে নিজেকে সংযত করে খুব ঠান্ডা গলায় পিয়া শুধু বলতে পারল, “ফকির, আমাকে ছেড়ে দাও। কানাই, ওকে বলুন আমাকে ছেড়ে দিতে।”

হাতটা একটু আলগা করল ফকির, কিন্তু অনিচ্ছার সঙ্গে। পিয়া একটু সরে দাঁড়াতেই প্রায় লাফ দিয়ে উঠল ও, মনে হল গ্রামের দিকে ফের দৌড়তে চেষ্টা করলেই গিয়ে ধরে ফেলবে আবার।

বাঁধের এপার থেকে ধু ধু করে জ্বলা আগুনের শব্দ কানে আসছিল পিয়ার, হাওয়ায় ভেসে আসছিল পোড়া চামড়া আর মাংসের গন্ধ। ওর কানের কাছে মুখ এনে কী যেন একটা বলল ফকির। কানাইয়ের দিকে ফিরে পিয়া জিজ্ঞেস করল, “কী বলল ও?”

“ও আপনাকে এতটা আপসেট হতে বারণ করছে।”

“আপসেট হব না? কী বলছেন আপনি? এরকম ভয়ংকর ব্যাপার আমি জীবনে দেখিনি–জ্যান্ত একটা বাঘকে পুড়িয়ে মেরে ফেলল?”

“ও বলছে বাঘ যখন গ্রামে আসে তখন মরতে চায় বলেই আসে।”

হাত দিয়ে দু’কান চেপে ফকিরের দিকে ফিরল পিয়া, “স্টপ ইট। এই নিয়ে আর কোনও কথা আমি শুনতে চাই না। লেটস জাস্ট গো।”