মরিচঝাঁপি

সবে ভোর হয়েছে। জানালায় পর্দা নেই, তাই নরম রোদে ধুয়ে যাচ্ছে ঘরটা। সাতসকালেই ঘুম ভেঙে গেল কানাইয়ের। মুখহাত ধুয়ে জামাকাপড় পালটে একটু বাদে নীচে নেমে এল ও। টোকা দিল নীলিমার দরজায়।

“কে?” কেমন যেন কাঁপা কাঁপা শোনাল মাসির গলাটা।

“আমি–কানাই।”

“আয়। ভোলাই আছে দরজা।” ঘরে ঢুকে কানাই দেখল পিঠের কাছে কয়েকটা বালিশ জড়ো করে তাতে ঠেস দিয়ে বসে আছে নীলিমা। পায়ের ওপর বড় একটা লেপ ফেলা রয়েছে অগোছালো ভাবে। চোখদুটো কুঁচকে রয়েছে, যেন দেখতে পাচ্ছে না ভাল করে। বিছানার পাশের টেবিলে এক কাপ চা আর একটা প্লেটে মারি বিস্কুট চার-পাঁচটা। ঘরে জামাকাপড় বা নীলিমার নিজের ব্যবহার্য জিনিসপত্র বলতে কিছুই নেই; শুধু বই আর ফাইলপত্র ঠাসা বিছানায়, মেঝেতে, এমনকী মশারির পুঁটলির ওপরে পর্যন্ত। খুবই সাদামাটা কেজো চেহারার ঘর, আসবাব বলতে প্রধানত কয়েকটা বইয়ের আলমারি আর ফাইল ক্যাবিনেট। নীলিমার বড় খাটটা না থাকলে এটাকে ট্রাস্টের আর-একটা অফিসঘর বলে ভুল হতে পারত।

“তোমাকে কিন্তু অসুস্থ দেখাচ্ছে মাসি, কানাই বলল। “ডাক্তারকে খবর দিয়েছ?” হাতের রুমালটায় একবার নাক ঝাড়ল নীলিমা। “ওই সর্দি লেগেছে একটু। সেটা বলে দিতে আবার ডাক্তার কেন লাগবে?”

“যাই বল মাসি, তোমার কাল ক্যানিং-এ যাওয়াটা ঠিক হয়নি,” বলল কানাই। “ধকলটা একটু বেশি হয়ে গেছে। শরীরের দিকে আরেকটু নজর দিতে হবে তোমাকে।”

হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর মতো ভঙ্গি করে কথাটা উড়িয়ে দিল নীলিমা। “ছাড় তো আমার কথা। তোর কথা বল। আয়, এখানে এসে বোস। ভাল ঘুম হয়েছিল তো রাত্তিরে?”

“তোফা।”

“আর প্যাকেটটা?” নীলিমার গলায় আগ্রহ ঝরে পড়ছে। “ওটা পেয়েছিস তো?”

“হ্যাঁ। যেখানে বলেছিলে সেখানেই রাখা ছিল।”

“বল না রে কী আছে ওটায়? গল্প না কবিতা?”

মাসির গলায় প্রত্যাশার সুরটুকু কানাইয়ের কান এড়াল না। ও বুঝতে পারছিল নীলিমার বিশ্বাস এমন কিছু আছে ওই প্যাকেটটায় যাতে মৃত্যুর পরেও তার স্বামীর সাহিত্যিক খ্যাতি নতুন করে ছড়িয়ে পড়বে। মাসিকে নিরাশ করতে খারাপ লাগছিল কানাইয়ের। যতটা সম্ভব নরমভাবে ও বলল, “আসলে আমি যা ভেবেছিলাম সেরকম কিছু নেই ওটায়। আমার মনে হয়েছিল হয়তো গল্প কি কবিতা বা প্রবন্ধ-টবন্ধ থাকবে, কিন্তু যেটা আছে সেটা একটা ডায়ারি বা জার্নাল মতো। সাধারণ একটা খাতায় লেখা, স্কুলের বাচ্চারা যেমন খাতা ব্যবহার করে সেরকম।”

“ও, তাই?” ম্লান হয়ে এল নীলিমার চোখ। একটা আশাভঙ্গের দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বুক থেকে। “কোন সময়কার লেখা রে? তারিখ-টারিখ কিছু আছে?”

“হ্যাঁ। ১৯৭৯-তে লেখা,” কানাই বলল।

“১৯৭৯?” এক মুহূর্ত চুপ করে কী ভাবল নীলিমা। “কিন্তু সে বছরই তো ও মারা গেল। জুলাই মাসে। তুই ঠিক দেখেছিস? ওই বছরেই লেখা ওটা?”

“হ্যাঁ,” বলল কানাই। “কেন আশ্চর্য হচ্ছ তুমি?”

“বলছি,” নীলিমা বলল। “কারণ সে বছরটায় একেবারে লেখালিখির ধার দিয়েই যায়নি নির্মল। তার আগের বছরই ও রিটায়ার করল লুসিবাড়ি স্কুলের হেডমাস্টার হিসেবে। তার পর থেকেই ওর সময়টা ভাল যাচ্ছিল না। আমরা লুসিবাড়ি চলে আসার পর থেকেই, মানে প্রায় তিরিশ বছর ধরে ওই স্কুলটাই ছিল ওর প্রাণ। রিটায়ার করার পর থেকেই কেমন একটা যেন হয়ে গেল ও। আগেও ওর একটা মানসিক সমস্যা ছিল, সে তো জানিসই, তাই সব সময় খুব চিন্তায় থাকতাম আমি। দিনের পর দিন কোথায় উধাও হয়ে যেত, ফেরার পর আর মনেও করতে পারত না কোথায় গিয়েছিল। খুবই অস্থিরতার মধ্যে কেটেছিল সে বছরটা ওর। লেখার মতো অবস্থাতেই ছিল না।”

“হয়তো খানিকটা সময়ের জন্য সুস্থিতি ফিরে এসেছিল কখনও একটা,” বলল কানাই। “আমার এক ঝলক দেখে যা মনে হল, গোটা খাতাটা একদিনে, বা খুব বেশি হলে দু’দিনে লেখা।”

“তারিখটা লিখেছে কি?” খুঁটিয়ে কানাইকে নজর করতে করতে জিজ্ঞেস করল নীলিমা।

“লিখেছে,” কানাই বলল। “মেসো ওটা লিখতে শুরু করেছিল ১৯৭৯ সালের ১৫ মে সকালবেলা। মরিচঝাঁপি বলে একটা জায়গায়।”

“মরিচঝাঁপি!” শব্দটা বলতে গিয়ে হঠাৎ একটা শ্বাস টানল নীলিমা।

“হ্যাঁ, কানাই বলল। “সেখানে কী হয়েছিল বলো তো আমায়।”

নীলিমা বলতে শুরু করল। মরিচঝাঁপি এই ভাটির দেশেরই একটা দ্বীপ। লুসিবাড়ি থেকে নৌকোয় কয়েক ঘণ্টার পথ। সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের আওতায় ছিল দ্বীপটা, কিন্তু এ ধরনের অন্য দ্বীপগুলোর মতো দুর্গম ছিল না। ১৯৭৮ সালে একটা সময় হঠাৎ বহু মানুষ এসে হাজির হল মরিচঝাঁপিতে। যে দ্বীপে মানুষের কোনও বসতি ছিল না, প্রায় রাতারাতি হাজার হাজার লোক এসে থাকতে শুরু করল সেখানে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তারা বাদাবন সাফ করে, বাঁধ তৈরি করে, শত শত কুঁড়ে বানিয়ে ফেলল। এত তাড়াতাড়ি পুরো ব্যাপারটা ঘটল, শুরুতে তো কেউ জানতেই পারেনি এ লোকগুলো কারা, কোথা থেকে এসে উদয় হল এখানে। আস্তে আস্তে জানা গেল ওরা হল বাংলাদেশি রিফিউজি। অনেকে সেই পার্টিশনের সময় এসেছিল, অনেকে আবার পরে বিভিন্ন সময় বর্ডার পেরিয়ে এসে ঢুকেছে। একেবারে হতদরিদ্র সব মানুষ, বাংলাদেশে মুসলমানদের আর উঁচু জাতের হিন্দুদের অত্যাচারে টিকতে না পেরে চলে এসেছে এপারে।

“বেশিরভাগই ছিল আমরা এখন যাদের দলিত বলি সেরকম,” নীলিমা বলল। “তখন বলা হত হরিজন।”

মরিচঝাঁপিতে আসার সময় কিন্তু এরা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসেনি; তখন ওরা পালাচ্ছিল মধ্য ভারতের একটা সরকারি পুনর্বাসন শিবির থেকে। এই শিবির ছিল মধ্যপ্রদেশের দণ্ডকারণ্যে, গভীর জঙ্গলের মধ্যে। পশ্চিমবাংলা থেকে বেশ কয়েকশো কিলোমিটার দূরে। পার্টিশনের পর পরই তখনকার ওই পূর্ব পাকিস্তানি উদ্বাস্তুদের অনেককে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেখানে।

“সরকার তো ওগুলোকে বলত ‘পুনর্বাসন’ শিবির, কিন্তু লোকে বলত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, জেলখানা,” বলল নীলিমা। “ওই উদ্বাস্তুদের সব সময় পাহারা দিয়ে রাখত নিরাপত্তারক্ষীরা, ক্যাম্প ছেড়ে কোথাও যাওয়ার জো ছিল না। কেউ পালালে ঠিক খুঁজে বের করে ফিরিয়ে আনা হত তাকে।”

ক্যাম্পগুলো যেখানে বানানো হয়েছিল সেখানকার মাটি ছিল পাথুরে, বাংলাদেশের মাটির সঙ্গে তার কোনও মিল ছিল না। উদ্বাস্তুরা ওখানকার ভাষা বলতে পারত না, আর স্থানীয় লোকেরাও মনে করত ওদের ওখানে থাকার কোনও অধিকার নেই, উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। মাঝে মাঝেই তারা তির ধনুক আর মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে উদ্বাস্তুদের ওপর হামলা চালাত। অনেক বছর ধৈর্য ধরে ওই ক্যাম্পে ছিল মানুষগুলো। অবশেষে ১৯৭৮-এ কিছু লোক জোট বেঁধে পালাল ওখান থেকে। ট্রেনে করে, পায়ে হেঁটে ওরা পুবদিকে চলতে শুরু করল। ভাবল সুন্দরবনে গিয়ে বসত করবে। মরিচঝাঁপিতে আসবে বলেই ঠিক করে রেখেছিল ওরা।

তার কিছুদিন আগেই বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসেছে পশ্চিমবঙ্গে; রিফিউজিরা ভেবেছিল এই সরকার তাদের বিশেষ কিছু বলবে না। কিন্তু এইখানেই হিসেবে গণ্ডগোল হয়ে গিয়েছিল ওদের। সরকার বলল মরিচঝাঁপিকে সংরক্ষিত এলাকা বলে ঘোষণা করা হয়েছে, সেখান থেকে উঠে যেতেই হবে উদ্বাস্তুদের। প্রায় বছর খানেক ধরে বার বার রিফিউজিদের সংঘর্ষ হল সরকারি লোকেদের সঙ্গে।

“আর শেষ ঝামেলাটা হয়েছিল,” বলল নীলিমা, “আমার যদূর মনে পড়ছে, ওই ১৯৭৯-র মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে।”

“মানে তুমি বলছ ওই গণ্ডগোলটা যখন হয়েছিল মেসো তখন ওখানে ছিল?” এক মুহূর্ত থেমে গেল কানাই। আরেকটা সম্ভাবনার কথা মনে হল ওর। “নাকি পুরোটাই কল্পনা?”

“জানি না রে কানাই,” অন্যমনস্ক ভাবে নিজের হাতের দিকে চেয়ে বলল নীলিমা। “সত্যি জানি না। সে বছরটায় যেন একেবারে অন্য মানুষ হয়ে গিয়েছিল নির্মল। আমার সঙ্গে কথা বলত না, কথা লুকিয়ে রাখত। এমন ব্যবহার করত যেন আমি ওর শত্রুপক্ষের লোক।” কানাই দেখতে পাচ্ছিল আরেকটু হলেই কেঁদে ফেলবে নীলিমা। মাসির জন্য খুব খারাপ লাগছিল ওর। “খুব কষ্টে কেটেছে সে সময়টা তোমার,?”

“খুব কষ্টে রে,” নীলিমা বলল। “মরিচঝাঁপি নিয়ে যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল মানুষটা। আমার ভাল লাগত না। বুঝতে পারছিলাম একটা ঝামেলা হতে যাচ্ছে ওখানে; নির্মলকে তার থেকে দূরে রাখতে চাইছিলাম আমি।”

কানাই মাথা চুলকাল একবার। “একটা জিনিস আমি বুঝতে পারছি না। এই ব্যাপারটা নিয়ে এত কেন ভাবছিল মেসো?”

একটু সময় নিয়ে জবাবটা দিল নীলিমা। “একটা জিনিস ভুলে যাস না কানাই, কম বয়সে বিপ্লবের কথা ভাবতে ভালবাসত নির্মল। পার্টি বা পুরনো কমরেডদের থেকে সরে এলেও এরকম লোকেরা জীবনে সেসব কথা ভুলতে পারে না। বুকের মধ্যে থেকে গোপন ঈশ্বরের মতো সে চিন্তা ওদের চালিয়ে নিয়ে বেড়ায়, ওদের প্রাণশক্তির কাজ করে। যন্ত্রণার মধ্যে, বিপদের মধ্যে ওরা আনন্দ পায়। মেয়েদের কাছে সন্তানের জন্ম দেওয়ার অনুভূতি যে রকম, ভাড়াটে যোদ্ধাদের কাছে যুদ্ধ যে রকম, বিপ্লবের চিন্তায়, আপদ বিপদের মধ্যে সেই রকম অনুভূতি হয় ওদের।”

“কিন্তু মরিচঝাঁপিতে যারা এসেছিল তারা তো আর বিপ্লব করছিল না।”

“না,” বলল নীলিমা। “একেবারেই না। ওদের উদ্দেশ্য ছিল একেবারে সোজাসাপটা। ওরা শুধু মাথা গোঁজার জন্য একটু জমি চেয়েছিল। কিন্তু তার জন্য সরকারের সঙ্গে লড়তে প্রস্তুত ছিল ওরা। একদম শেষ পর্যন্ত লড়াইয়ের জন্য ওরা তৈরি ছিল। তাই যথেষ্ট। তার মধ্যেই বিপ্লবের কাছাকাছি পৌঁছনোর একটা রাস্তার ছায়া দেখতে পেয়েছিল নির্মল। ওদের লড়াইয়ে তাই অংশ নিতে চেয়েছিল ও। খানিকটা হয়তো নিজের বয়সটাকে ভুলে থাকার ইচ্ছেও কাজ করছিল এর পেছনে।”

মেসোর চেহারাটা কানাইয়ের চোখে ভাসছিল। ওই ধুতি-পাঞ্জাবি পরা শান্ত নম্র মানুষটাকে ঠিক বিপ্লবী বলে কিছুতেই ভাবতে পারছিল না ও। “তুমি কখনও বোঝাতে চেষ্টা করেছিলে মেসোকে?”

“করিনি আবার?” নীলিমা বলল। “কিন্তু শুনলে তো! আমাকে বলত, “তুমিও ওই সরকারি লোকেদের মতো হয়ে গেছ, ওদের মতো করে ভাবছ। এই যে সমাজসেবা করে যাচ্ছ এত বছর ধরে, সেজন্যেই তোমার দৃষ্টিভঙ্গি এরকম পালটে গেছে। সেইজন্যেই এরকম সব চিন্তা আসছে তোমার মাথায়। আসল ব্যাপারগুলোই আর চোখে পড়ছে না তোমার।” সারা জীবন ধরে একটু একটু করে গড়ে তোলা ওর কাজকে কেমন এককথায় উড়িয়ে দিয়েছিল নির্মল সে কথা মনে করে একবার চোখ বন্ধ করল নীলিমা। গড়িয়ে পড়া চোখের জল মুছে নিতে মাথাটা ঘুরিয়ে নিল ও। “আমরা দু’জন যেন দুটো ভূতের মতো বাস করছিলাম একটা বাড়িতে। শেষের দিকটায় আমাকে যেন শুধু কষ্ট দিতেই ভাল লাগত ওর। আচ্ছা ভাব, অন্য কী কারণ থাকতে পারে তা ছাড়া এই খাতাটা আমাকে না দিয়ে তোকে দিয়ে যেতে চাওয়ার?”

“কী বলব বুঝতে পারছি না।” কানাই ভেবেছিল খাতাটা ওকে দিয়ে যাওয়ার কারণ হল ওর সঙ্গেই শুধু বাইরের বধির জগৎটার একটা যোগসূত্র আছে বলে মনে করেছিল মেসো। এক মুহূর্তের জন্যেও ওর মনে হয়নি যে নীলিমার মনে ব্যথা দিতে চেয়েছিল নির্মল। ব্যাপারটা ভেবেই একটু শিউরে উঠল কানাই। বরাবরই মেসোকে একটু খ্যাপাটে মানুষ বলে জানে ও, কিন্তু তার মধ্যে কোনও নিষ্ঠুরতা আছে বলে কখনওই মনে হয়নি। আর নীলিমার প্রতি নিষ্ঠুর হবে নির্মল সে তো ও স্বপ্নেও ভাবেনি কখনও। আর সকলের মতো কানাইও এতদিন জানত যে বেশ ভালই ছিল ওদের দুজনের জীবন; ঠিক রাজযোটক যাকে বলে তা না হলেও, সুখী দম্পতিই ছিল ওরা। এখন ও বুঝতে পারল নির্মল লুসিবাড়ি ছেড়ে বেরোত না বলেই এই ধারণাটা ওদের কোনওদিন বদলায়নি।

কী কষ্টের মধ্যে মাসিকে এতগুলো বছর কাটাতে হয়েছে ভেবে কী যেন একটা দলা

পাকিয়ে উঠছিল কানাইয়ের গলার ভেতরে। “শোনো,” দাঁড়িয়ে উঠল কানাই, “আমি এক্ষুনি তোমাকে খাতাটা এনে দিচ্ছি। তুমি রেখে দাও, ফেলে দাও–যা ইচ্ছে করো। ওটা আমার কোনও দরকার নেই।”

“না, কানাই!” নীলিমা যেন চেঁচিয়ে উঠল। “বোস, বোস।” হাতটা ধরে টেনে ওকে। চেয়ারে বসাল নীলিমা। “কানাই, আমার কথাটা একবার শোন। আমি সব সময় নির্মলের প্রতি আমার কর্তব্য করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। ওর শেষ ইচ্ছের যাতে অসম্মান না হয় সেটা দেখাটাও খুব বড় ব্যাপার আমার কাছে। আমি জানি না কেন নির্মল ওটা তোকে দিয়ে যেতে চেয়েছিল, ওটায় কী আছে তাও জানি না আমি, কিন্তু ওর ইচ্ছাটা আমাকে রাখতেই হবে।”

চেয়ার থেকে উঠে বিছানায় মাসির পাশে গিয়ে বসল কানাই। ওর একটু অস্বস্তি হচ্ছিল কুসুমের প্রসঙ্গটা তুলতে, কিন্তু আর কোনও উপায় দেখল না ও। “আচ্ছা,” খুব আস্তে বলল কানাই, “তোমার কি মনে হয় কুসুমের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ আছে ব্যাপারটার?”

নামটা শুনেই যেন একটু কুঁকড়ে গেল নীলিমা। “হ্যাঁ কানাই, এরকম একটা গুজব সে সময় শোনা গিয়েছিল। সেটা অস্বীকার করব না।”

“কিন্তু মরিচঝাঁপিতে কী করতে গিয়েছিল কুসুম?”

“কী করে কী ঘটেছিল সে আমি জানি না, কিন্তু সে সময় কুসুম ছিল মরিচঝাঁপিতে।”

“যে সময়টায় ও ওখানে ছিল তার মধ্যে কুসুমের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তোমার?” কানাই জিজ্ঞেস করল।

ঘাড় নাড়ল নীলিমা। “হ্যাঁ, একবার মাত্র। দেখা করতে এসেছিল ও আমার সঙ্গে। এই ঘরেই।”

একদিন সকালবেলা–১৯৭৮ সালে–এসেছিল ও। নীলিমা তখন নিজের টেবিলে বসে কাজ করছে। একজন নার্স এসে বলল কে যেন দেখা করতে এসেছে, বলছে নাকি নীলিমাকে চেনে। কী নাম জিজ্ঞেস করতে বলতে পারল না নার্সটি। “ঠিক আছে,” বলল নীলিমা, “নিয়ে এসো এখানে।” খানিক পরে দরজা খুলে ভেতরে এল একটি কমবয়সি মহিলা, সঙ্গে একটা বছর চার-পাঁচেকের বাচ্চা ছেলে। মহিলার বয়স মনে হল খুব বেশি হলে বছর কুড়ি-বাইশ হবে। কিন্তু সাদা শাড়ি পরা, শাঁখা-সিঁদুর কিছু নেই। অন্য কোথাও হলে দেখেই বোঝা যেত বিধবা, কিন্তু লুসিবাড়িতে সেটা বলা কঠিন।

চেনা চেনা লাগছিল নীলিমার। মুখটা ততটা নয়, কিন্তু চোখদুটো আর তাকানোর ভঙ্গিটা খুব পরিচিত মনে হল। কিন্তু নামটা ও কিছুতেই মনে করতে পারল না। মেয়েটি এসে প্রণাম করল পা ছুঁয়ে। নীলিমা বলল, “তুমি কে বলো তো মা?”

মেয়েটি বলল, “আমাকে চিনতে পারছেন না মাসিমা? আমি কুসুম।”

“কুসুম!” প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ওকে বকতে শুরু করল নীলিমা। “কোথায় ছিলি বল তো এতদিন? কোনও খোঁজ নেই, খবর নেই। কত খুঁজেছি জানিস তোকে আমরা?”

হেসে ফেলল কুসুম। “কত কী হয়ে গেছে মাসিমা এর মধ্যে। একটা-দুটো চিঠিতে অত কিছু ধরতই না।”

ও উঠে দাঁড়াতে নীলিমা দেখল পুরোদস্তুর শক্ত সমর্থ ঝকঝকে চোখের মহিলা হয়ে উঠেছে কুসুম। “এই ছেলেটা কে রে, কুসুম?”

“আমার ছেলে,” জবাব দিল কুসুম। “ওর নাম ফকির–ফকিরচাঁদ মণ্ডল।”

“আর ওর বাবা?”

“ওর বাবা মারা গেছে মাসিমা। আমিই এখন ওর সব।”

নীলিমা দেখে খুশি হল এই অকালবৈধব্য কুসুমের মুখের হাসিটা কেড়ে নিতে পারেনি। “বল এবার, এখানে কেন এসেছিস?”

তখন কুসুম বলল যে ও মরিচঝাঁপিতে থাকে। ও এসেছে নীলিমাকে বলতে যদি ওখানকার জন্য লুসিবাড়ি থেকে ডাক্তার, ওষুধ কিছু পাঠানো যায়।

সঙ্গে সঙ্গে সাবধান হয়ে গেল নীলিমা। বলল মেডিকেল টিম পাঠাতে পারলে খুবই খুশি হত ও, কিন্তু সেটা অসম্ভব। সরকার পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে যে মরিচঝাঁপির জবরদখলিদের উচ্ছেদ করা হবেই। কাজেই ওদের কোনওরকম সাহায্য করতে গেলেই এখন সরকারের কোপে পড়তে হবে। এই হাসপাতাল আর মহিলা সমিতির কথা তো ভাবতে হবে নীলিমাকে। সরকারকে বাদ দিয়ে ও চালাতে পারবে না। বেশি লোকের যাতে মঙ্গল হয় সেভাবেই চলতে হবে নীলিমাকে।

আধঘণ্টা খানেক পর চলে গেল কুসুম। আর কখনও ওকে দেখেনি নীলিমা।

“তার পর তা হলে কী ঘটল?” জিজ্ঞেস করল কানাই। “কুসুম কোথায় গেল?”

“কোথাও যায়নি রে কানাই, ও তো খুন হয়ে গেল তারপর।”

“খুন?” কানাই জিজ্ঞেস করল। “সে কী? কী করে?”

“ওই ম্যাসাকারের সময়ই মারা গিয়েছিল ও। মরিচঝাঁপি গণহত্যা।”

দু’হাত দিয়ে মুখ ঢাকল নীলিমা। “ভীষণ ক্লান্ত লাগছে রে। খানিকটা বিশ্রাম নিলে মনে হয় ভাল লাগবে।”