ঘেরাটোপে
আমি গর্জনতলা থেকে ঘুরে আসার কয়েকদিন পর নীলিমা ফিরল তার কাজ শেষ করে। সঙ্গে নিয়ে এল বাইরের পৃথিবীর অজস্র খবর। নানা গল্প করতে করতে এ কথা সে কথার মাঝখানে হঠাৎই বলল, “আর মরিচঝাঁপিতেও মনে হয় এবার কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।”
আমার কান খাড়া হয়ে উঠল। “কী ঘটতে যাচ্ছে?”
“মনে হয় সরকার এবার ব্যাপারটার একটা হেস্তনেস্ত করতে চায়। সেরকম দরকার হলে কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া হবে ঠিক হয়েছে শুনলাম।”
কিছু বললাম না, শুধু মনে মনে ভাবতে লাগলাম কী করে খবরটা পৌঁছে দেওয়া যায় কুসুমের কাছে, কী করে সাবধান করে দেওয়া যায় ওদের। কিন্তু খুব দ্রুত ঘটনা গুরুতর মোড় নিল। সাবধান করে দেওয়ার কোনও পথই রইল না। পরদিন শোনা গেল বন সংরক্ষণ আইনে মরিচঝাঁপিতে যাতায়াত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। পুরো এলাকায় জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা। তার মানে চারজনের বেশি লোক এক জায়গায় জড়ো হওয়াও নিষিদ্ধ।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নদী বেয়ে স্রোতের মতো ছড়িয়ে যেতে শুরু করল নানা গুজব। শোনা গেল কয়েক ডজন পুলিশের নৌকো ঘিরে রেখেছে গোটা দ্বীপটাকে, কাদানে গ্যাস আর রাবার বুলেট চালানো হয়েছে, দ্বীপে কোনও খাবার-দাবার বা জল নিয়ে যেতে দেওয়া হচ্ছে না মরিচঝাঁপির লোকেদের, বেশ কয়েকটা নৌকো ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে, কয়েক জন নাকি মারাও গেছে। সময় যত যেতে লাগল গুজবগুলিও তত ফুলেফেঁপে উঠতে থাকল; মনে হল যেন যুদ্ধ লেগেছে শান্ত নিরিবিলি এই ভাটির দেশে।
নীলিমার কথা ভেবেই প্রাণপণে স্থির থাকার চেষ্টা করছিলাম আমি। মনের মধ্যে যে উথাল পাথাল চলছিল তাকে বাইরে প্রকাশ হতে দিচ্ছিলাম না। কিন্তু সেদিন সারারাত কিছুতেই দু’চোখের পাতা এক করতে পারলাম না। সকাল হতেই মনে মনে বুঝলাম মরিচঝাঁপিতে যেতে আমাকে হবেই। যে-কোনও উপায়েই থোক। তার জন্যে এমনকী নীলিমার সঙ্গে বিবাদে যেতেও আমি প্রস্তুত। আমার সৌভাগ্য, পরিস্থিতি সেদিকে যায়নি–অন্তত এখনও পর্যন্ত নয়। ভোরবেলায় স্কুলের কয়েকজন মাস্টারমশাই এলেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। তাঁদেরও কানে এসেছে গুজবগুলো, আর আমারই মতো তারাও চিন্তায় আছেন ওই দ্বীপবাসীদের জন্য। এতটাই উদ্বিগ্ন তাঁরা, যে একটা ভটভটি পর্যন্ত ভাড়া করে ফেলেছেন মরিচঝাঁপি যাওয়ার জন্য : যদি কোনওভাবে মিটমাটের একটা রাস্তা বের করা যায়। মাস্টারমশাইরা জিজ্ঞেস করলেন আমিও তাঁদের সঙ্গে যেতে রাজি আছি কি না। আমি তো এক পা তুলে খাড়া।
সকাল দশটা নাগাদ ছাড়ল আমাদের ভটভটি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দূর থেকে দেখা গেল আমাদের গন্তব্য। এখানে একটা কথা বলে রাখি–মরিচঝাঁপি বিশাল দ্বীপ, ভাটির দেশের সবচেয়ে বড় দ্বীপগুলির একটা। এখানকার তটরেখার দৈর্ঘ্য প্রায় কুড়ি কিলোমিটার। প্রথম যখন চোখে পড়ল দ্বীপটা, তখনও আমরা প্রায় দু-তিন কিলোমিটার দূরে। দেখলাম ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে দ্বীপের ওপর।
খানিক পরেই দেখা গেল সরকারি মোটরবোটগুলিকে। টহল দিচ্ছে দ্বীপের চারপাশে। আমাদের ভটভটিওয়ালা দেখলাম বেশ ভয় পেয়ে গেছে। অনেক কাকুতি-মিনতি করে তাকে আরেকটু কাছাকাছি যেতে রাজি করানো গেল। রাজি সে হল বটে, কিন্তু একটা শর্তে : আমাদের নৌকো যাবে নদীর অন্য পাড় ধরে–দ্বীপ থেকে যতটা সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে। অতএব সে ভাবেই এপাশের কিনারা ঘেঁষে এগোতে লাগলাম আমরা, আর আমাদের দৃষ্টি ফেরানো রইল অন্যদিকে, মরিচঝাঁপির দিকে।
এভাবে চলতে চলতে একটা গ্রামের কাছাকাছি এসে পৌঁছলাম আমরা। দেখতে পেলাম পাড়ের ওপর বহু লোক জড়ো হয়েছে, ব্যস্তসমস্ত ভাবে তারা একটা নৌকোয় প্রচুর মালপত্র বোঝাই করছে। ভটভটি বা পালের নৌকো নয় কিন্তু, এমনি সাধারণ ডিঙি নৌকো, হরেনের যেরকম একটা ছিল। খানিকটা দূর থেকেও দিব্যি বোঝা গেল নৌকোটাতে রসদ বোঝাই করছে ওরা–বস্তা বস্তা চাল-ডাল আর জেরিক্যান ভর্তি খাবার জল। তারপর এক এক করে অনেকে গিয়ে উঠে পড়ল নৌকোটাতে। বেশিরভাগই পুরুষ, তবে কিছু মহিলা এবং বাচ্চাও ছিল। কয়েকজন তো বোঝাই যাচ্ছিল দিনমজুর–কাজের জন্য গিয়েছিল অন্য কোনও দ্বীপে, তারপরে আর ফিরতে পারেনি। বাকিরা মনে হল কোনও কারণে আত্মীয়স্বজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল, আর এখন যে-কোনও রকমে ফেরার চেষ্টা করছে মরিচঝাঁপিতে। তবে কারণ যাই হোক না কেন, ওদের গরজটা বেশ বোঝা যাচ্ছিল। গাদাগাদি করে এই রকম একটা পলকা ডিঙিতে ওঠার ঝুঁকি নিতেও তাই দ্বিধা ছিল না ওদের। অবশেষে নৌকো যখন ছাড়ল তখন তাতে অন্তত ডজন দুয়েক লোক। কোনও রকমে টলমল করতে করতে স্রোতের মুখে গিয়ে পড়ল ডিঙিটা। টইটম্বুর ভর্তি ওইটুকু একটা মোচার খোলা–কীভাবে যে ভেসে ছিল না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। খানিকটা দূর থেকে রুদ্ধশ্বাসে আমরা দেখতে লাগলাম। সকলেরই বুক দুরুদুরু–কী হয় কী হয়। বোঝাই যাচ্ছিল ওদের আশা পুলিশকে এড়িয়ে কোনও রকমে পৌঁছতে পারবে মরিচঝাঁপিতে, আটকা-পড়া দ্বীপবাসীদের কাছেও পৌঁছে দেবে কিছু রসদ। এখন পুলিশ কী করবে? আমাদের নৌকোয় প্রত্যেকেরই দেখলাম এ ব্যাপারে নিজস্ব কিছু বক্তব্য রয়েছে।
হঠাৎ, ঠিক যেন আমাদের সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটানোর জন্যই, বাগনা নদী বেয়ে গর্জন করতে করতে ধেয়ে এল একটা পুলিশের স্পিডবোট। তিরবেগে ডিঙিটার কাছে পৌঁছে তার চারদিকে পাক খেতে লাগল সেটা। পুলিশের বোটে দেখা গেল একটা লাউডস্পিকার আছে। যদিও আমরা বেশ খানিকটা দূরেই ছিলাম, মাইকে পুলিশ কী বলছে তার দু-একটা টুকরো ঠিকই কানে এসে পৌঁছচ্ছিল। ডিঙির মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে যেখান থেকে এসেছে আবার সেখানেই ফেরত যেতে বলছিল ওরা। জবাবে নৌকোর লোকেরা কী বলল সেটা শুনতে পেলাম না, কিন্তু ভাবভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছিল পুলিশগুলোকে মিনতি করছে ওরা, বলছে ওদের যেতে দিতে মরিচঝাঁপিতে।
ফল হল উলটো। পুলিশের লোকগুলো ভয়ানক খেপে চিৎকার করতে লাগল। মাইকে। আচমকা, বাজ পড়ার মতো, একটা বন্দুকের আওয়াজ শোনা গেল। শূন্যে গুলি ছুঁড়েছে পুলিশ।
এবার নিশ্চয়ই ফিরে আসবে নৌকোর লোকগুলো? মনে মনে আমরা সবাই চাইছিলাম ওরা ফিরে আসুক। কিন্তু তার বদলে যা হল সে একেবারে অপ্রত্যাশিত। হঠাৎ নৌকোর সব লোক এক সাথে গলা মিলিয়ে চিৎকার করতে শুরু করল : “আমরা কারা? বাস্তুহারা।”
জলের ওপর দিয়ে ভেসে আসা করুণ সেই চিৎকার শুনে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হল আমার। সেই মুহূর্তে মনে হল প্রতিবাদ নয়, এ যেন বিশ্বজগতের কাছে ওই মানুষগুলির ব্যাকুল জিজ্ঞাসা। যেন হতবুদ্ধি এই মানবজাতির হয়ে প্রশ্ন করছে ওরা। আমরা কারা? কোথায় আমাদের স্থান? সেই উচ্চারণ শুনতে শুনতে মনে হল ওরা তো আমারই হৃদয়ের গভীরতম অনিশ্চয়তার কথা বলছে–নদীর কাছে, স্রোতের কাছে। আমি কে? কোথায় আমার স্থান? কলকাতায় না এই ভাটির দেশে? ভারতে সীমান্তের ওপারে? গদ্যে না পদ্যে?
তারপর আমরা শুনতে পেলাম সে প্রশ্নের জবাব। নৌকো থেকে ভেসে এল কয়েকটা পুনরাবৃত্ত শব্দের একটা নতুন শ্লোগান : “মরিচঝাঁপি ছাড়ছি না, ছাড়ছি না, ছাড়ব না।”
ভটভটির ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগলাম। অপূর্ব! যে জায়গা ছাড়তে প্রাণ চায় না সেই তো আমার দেশ।
ওদের চিৎকারে আমার ক্ষীণ কণ্ঠ মিলিয়ে আমিও বলে উঠলাম, “মরিচঝাঁপি ছাড়ব না!”
মোটরবোটের পুলিশগুলো উদ্বাস্তুদের ওই শ্লোগানের কী অর্থ করতে পারে সেটা ভাবার কথা আমার খেয়াল হয়নি। মিনিট কয়েক ধরে একই জায়গায় থেমে ছিল বোটটা; হঠাৎ দেখলাম ইঞ্জিন চালু করল। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে নৌকোটার থেকে দূরে সরে যেতে লাগল। খানিকক্ষণ পর্যন্ত মনে হল মন গলেছে পুলিশদের, উদ্বাস্তুদের ডিঙিটাকে ওরা চলে যেতে দেবে।
কিন্তু শিগগিরই ভুল ভাঙল। খানিকদূর যাওয়ার পর একটা চক্কর খেয়ে ঘুরে দাঁড়াল বোটটা। তারপর হঠাৎ প্রচণ্ড গতিতে সোজা ছুটতে লাগল মানুষ আর মালপত্রে ভরা টলমলে নৌকোটার দিকে। ধাক্কাটা লাগল নৌকোর ঠিক মাঝখানটায়। চোখের সামনে কাঠের তক্তাগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে গেল চতুর্দিকে। জলের মধ্যে আঁকুপাকু করতে লাগল ডজন দুয়েক ছেলেবুড়ো মেয়েম।
হঠাৎ খেয়াল হল কুসুম আর ফকিরও তো থাকতে পারে ওদের মধ্যে। ধক করে উঠল আমার বুকের ভেতর।
আমরা চেঁচিয়ে আমাদের ভটভটিওয়ালাকে বললাম জায়গাটার আরেকটু কাছাকাছি যেতে–যদি একটু সাহায্য করতে পারি মানুষগুলোকে। ও একটু ইতস্তত করছিল, ভয় পাচ্ছিল যদি পুলিশ কিছু বলে। অনেক করে বোঝানো হল ভয়ের কোনও কারণ নেই, একদল স্কুলের মাস্টারমশাইকে পুলিশ কিচ্ছু বলবে না। অবশেষে রাজি হল ও।
আমরা এগোতে শুরু করলাম। খুব আস্তে আস্তে যেতে হচ্ছিল, পাছে জলের মধ্যে কারও সঙ্গে ধাক্কা লেগে যায়। ভটভটির ওপর থেকে হাত বাড়িয়ে দিলাম ভাসন্ত লোকগুলির দিকে। একজন দু’জন করে ডজনখানেক লোককে টেনে তোলা হল। ভাগ্যক্রমে জল খুব একটা গভীর ছিল না, অনেকেই তার মধ্যে পাড়ে গিয়ে উঠে পড়েছে।
ভটভটিতে টেনে তোলা একটা লোককে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কুসুম মণ্ডলকে চেনো? ও কি ওই নৌকোয় ছিল?” দেখা গেল লোকটা চেনে কুসুমকে। মাথা নাড়ল ও। কুসুম মরিচঝাঁপিতেই আছে। প্রচণ্ড একটা স্বস্তিতে অবসন্ন হয়ে গেল শরীর। কিন্তু দ্বীপের ওপর ঘটনা যে কোন দিকে মোড় নিচ্ছে সে তখন আমি কিছুই জানি না।
এদিকে পুলিশের লোকগুলো তো তেড়ে এল আমাদের দিকে। ধমকে জিজ্ঞেস করল, “কে আপনারা? কী করছেন এখানে?”
আমাদের কোনও কথাতেই কান দিল না ওরা। বলল পুরো এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি আছে, বেআইনি জমায়েতের জন্য গ্রেফতার হয়ে যেতে পারি আমরা।
গুটিয়ে গেলাম আমরা। সবাই সাধারণ ইস্কুলমাস্টার, অনেকেরই বউ-বাচ্চা আছে; চুপচাপ পাড়ে গিয়ে জল থেকে টেনে তোলা মানুষগুলোকে নামিয়ে দিয়ে রওয়ানা হলাম ঘরের দিকে।
কলমের কালি ফুরিয়ে গেছে, পেন্সিলের টুকরোটার যেটুকু বাকি আছে এবার সেটা দিয়ে লিখছি। বাইরে পায়ের শব্দ শুনলেই মনে পড়ে যাচ্ছে যে-কোনও সময় কুসুম আর হরেন ফিরে আসবে, আর এসেই তক্ষুণি রওনা হয়ে পড়তে চাইবে হরেন। কিন্তু থামার উপায় নেই আমার। এখনও কত কী বলা বাকি রয়ে গেছে।