দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল, ভাটাও শেষ হতে চলেছে, এমন সময় দূরে দেখা গেল গর্জনতলা। আস্তে আস্তে মেঘা এগিয়ে চলল দহটার দিকে। দূরবিন হাতে ডেকের ওপর দাঁড়িয়েছিল পিয়া। ডলফিনের দঙ্গলটা চোখে পড়তেই খুশিতে ওর মনটা নেচে উঠল। জোয়ার-ভাটার সময় মেনে ঠিক এসে হাজির হয়েছে ওরা। দহ থেকে মেঘা তখনও কিলোমিটার খানেক দূরে। কিন্তু ডলফিনগুলোর নিরাপত্তার কথা ভেবে সেখানেই নোঙর ফেলতে ইশারা করল পিয়া।
এর মধ্যে কখন কানাই এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। পিয়া জিজ্ঞেস করল, “কাছ থেকে দেখতে চান নাকি ডলফিনগুলোকে?”
“নিশ্চয়ই,” জবাব দিল কানাই। “যে জানোয়ারদের কাছে মনপ্রাণ সঁপে দিয়েছেন আপনি তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্যে তো আমি উদগ্রীব হয়ে আছি।”
“চলে আসুন তা হলে। আমরা ফকিরের নৌকোয় করে যাব।”
বোটের পেছন দিকটায় গিয়ে ওরা দেখল দাঁড় হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছে ফকির। ডিঙিতে উঠে পিয়া গিয়ে গলুইয়ের ওপর নিজের জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে পড়ল, আর কানাই বসল নৌকোর মাঝামাঝি একটা জায়গায়।
খানিকক্ষণ দাঁড় টেনে সোজা দহটার মধ্যে পৌঁছে গেল ফকির। আর খানিক পরেই দুটো ডলফিন দল ছেড়ে এগিয়ে এল নৌকোর দিকে। তারপর পাক খেতে লাগল ডিঙিটাকে ঘিরে। ডলফিনদুটোকে চিনতে পেরে খুশি হয়ে উঠল পিয়া। সেই মা আর তার ছানাটা। পিয়ার মনে হল–আগেও ওর এরকম মনে হয়েছে ওর্কায়েলাদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ওকেও যেন চিনতে পেরেছে ডলফিনগুলো। কারণ নৌকোর পাশে পাশে বারবার ভেসে উঠছিল ওরা। বড়টা তো মনে হল সোজাসুজি তাকাল ওর চোখের দিকে।
কানাই এদিকে খানিকটা অবাক হয়ে ভুরু কুঁচকে লক্ষ করছিল প্রাণীগুলোকে। শেষে খানিকটা অবিশ্বাসের সুরে প্রশ্ন করল, “এগুলোই আপনার সেই ডলফিন তো? ঠিক জানেন আপনি?”
“অবশ্যই। এক্কেবারে ঠিক জানি।”
“কিন্তু একবার দেখুন ওদের দিকে,” কানাইয়ের গলায় পরিষ্কার অভিযোগের সুর। “খালি তো ভাসছে আর ডুবছে, আর ঘোঁতঘোঁত করছে।”
“এ ছাড়াও আরও অনেক কিছু ওরা করে কানাই,” বলল পিয়া। “কিন্তু সেসবের বেশিরভাগটাই করে জলের তলায়।”
“আমি তো ভেবেছিলাম আপনি আমাকে আমার মবি ডিক দেখাতে নিয়ে যাচ্ছেন,” কানাই বলল। “কিন্তু এ তো দেখছি জলের শুয়োর কতগুলো।”
হেসে ফেলল পিয়া। “আপনি কাদের কথা বলছেন জানেন কানাই? এরা কিন্তু খুনে তিমির খুড়তুতো ভাই।”
“শুয়োরদেরও অনেক সময় বড় বড় সব আত্মীয়স্বজন থাকে জানেন তো?” কানাই বলল।
“কানাই, ওর্কায়েলাদের সঙ্গে শুয়োরের চেহারার একেবারেই কোনও মিল নেই।”
“তা বটে, এগুলোর পিঠের ওপর কী একটা যেন আছে।”
“ওটাকে বলে ফিন–পাখনা।”
“আর এগুলো শুয়োরের মতো অতটা সুস্বাদুও হবে না বোধহয়।”
“কানাই, স্টপ ইট।”
কানাই হাসল। “আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না, এই হাস্যকর শুয়োর প্যাটার্নের কতগুলো জন্তু দেখার জন্য এতদূর থেকে এত কষ্ট করে এসেছি আমরা। একটা জন্তুর জন্য যখন আপনি জেলে যেতেও রাজি আছেন, তখন আরেকটু সেক্স অ্যাপিল-ওয়ালা আর কিছু খুঁজে পেলেন না? এদের তো কোনও রকমেরই কোনও অ্যাপিলই নেই দেখছি।”
“ওর্কায়েলাদের অ্যাপিল কিছু কম নেই কানাই,” বলল পিয়া। “আপনাকে শুধু একটু ধৈর্য ধরতে হবে সেটা আবিষ্কার করার জন্য।”
রসিকতার সুরে কথা বললেও, কানাইয়ের বিস্ময়টা কিন্তু নির্ভেজাল। ওর মনে যে ডলফিনের ছবি ছিল সে হল সিনেমা কি অ্যাকুয়ারিয়ামে দেখা চকচকে ধূসর রঙের একটা জন্তু। হ্যাঁ, তার প্রতি একটা আকর্ষণ তৈরি হলেও হতে পারে। কিন্তু এই নৌকোর চারপাশে ভেসে বেড়ানো বোতামচোখো হাঁসফঁসে জানোয়ারগুলোর মধ্যে ইন্টারেস্টিং তো কিছুই নেই। ভুরু কোঁচকাল কানাই। “আপনি কি গোড়া থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন যে এই জন্তুগুলোর পেছন পেছন সারা পৃথিবী চষে বেড়াবেন?”
“না। সেটা বলতে পারেন একটা অ্যাক্সিডেন্ট,” পিয়া বলল। “প্রথম যখন আমি ওর্কায়েলা ডলফিন দেখি, এদের সম্পর্কে তখন কিছুই জানতাম না আমি। সে প্রায় বছর তিনেক আগের কথা।”
দক্ষিণ চিন সাগরে স্তন্যপায়ী জলজন্তুদের ওপর সার্ভের কাজ করছিল একটা দল, তাদের সঙ্গে ইন্টার্ন হিসেবে গিয়েছিল পিয়া। সার্ভের শেষে ওদের জাহাজ গিয়ে থামল কম্বোডিয়ার পোর্ট সিহানুকে। সেখান থেকে দলের কয়েকজন চলে গেল নম পেন, সেখানে এক আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংস্থায় তাদের কিছু বন্ধু কাজ করে সেই বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে। সেই তখনই মধ্য কম্বোডিয়ার এক ছোট্ট গ্রামে আটকে পড়া একটা নদীচর ডলফিনের কথা ওরা জানতে পারল।
“ভাবলাম যাই, একবার দেখে আসি গিয়ে।”
জায়গাটা দেখা গেল নম পেন থেকে ঘণ্টা খানেকের দূরত্বে, মেকং নদী থেকে অনেকটা ভেতরে। একটা ভাড়া করা মোটর সাইকেলের পেছনে চড়ে সেখানে গিয়ে পৌঁছল পিয়া। গ্রামটা দেখতে খানিকটা তালি দেওয়া কাপড়ের মতো–এখানে ওখানে কিছু কুঁড়েঘর, ধানক্ষেত, জলসেচের নালা, আর কয়েকটা অগভীর জলা। এরকমই একটা জলার মধ্যে–মাপে সেটা খুব বেশি হলে একটা সুইমিং পুলের মতো হবে–আটকে পড়েছিল ডলফিনটা। বর্ষার সময় বানের জলে যখন থইথই করছিল চারদিক সেই সময়েই এসে ঢুকেছিল, কিন্তু কোনও কারণে দলের বাকিদের সঙ্গে ফিরে যেতে পারেনি আর। বর্ষা কেটে যেতে এদিকে চাষের নালা-টালাও সব গেছে শুকিয়ে, ফলে বেরোনোর সব পথও বন্ধ হয়ে গেছে।
সেই প্রথম একটা ওর্কায়েলা ব্রেভিরোষ্ট্রিস চোখে দেখল পিয়া। লম্বায় প্রায় মিটার খানেক, চওড়ায় তার অর্ধেক, ছাই ছাই রঙের শরীর, আর পিঠের ওপর একটা পাখনা। সাধারণত ডলফিনদের মুখের সামনের দিকটা যেমন হাঁসের ঠোঁটের মতো দেখতে হয়, সেরকম কোনও কিছুর কোনও বালাই নেই। গোল মাথা আর বড় বড় চোখের প্রাণীটাকে দেখে অদ্ভুত লাগল পিয়ার, মনে হল খানিকটা গোরু জাতীয় জাবর কাটা কোনও জন্তুর মতো দেখতে। ডলফিনটার নাম দিয়েছিল ও মিস্টার স্লোয়েন, ওর স্কুলের এক টিচারের নাম। ভদ্রলোকের চেহারার সঙ্গে হালকা একটা সাদৃশ্য ছিল জন্তুটার।
খুবই ফ্যাসাদে পড়েছিল এই মিস্টার স্লোয়েন। ডোবাটার জল দ্রুত শুকিয়ে আসছে, সব মাছও গেছে ফুরিয়ে। মোটর সাইকেল ড্রাইভারের সঙ্গে পাশের কামপংটায় গিয়ে কিছু মাছ কিনে নিয়ে এল পিয়া বাজার থেকে। বাকি সারাটা দিন ধরে ওই ডোবার পারে বসে নিজের হাতে সবগুলো মাছ খাওয়াল ডলফিনটাকে। পরের দিন আবার গেল সেখানে, একটা কুলার ভর্তি মাছ সঙ্গে নিয়ে। আশ্চর্য ব্যাপার, গ্রামের অনেক চাষিবাসি বাচ্চাকাচ্চা সব ভিড় করে দাঁড়িয়ে ছিল জলাটার ধারে, কিন্তু পিয়া যেই গেল, তাদের কাউকে পাত্তা না দিয়ে সোজা ওর দিকে চলে এল প্রাণীটা।
“বাজি রেখে বলতে পারি আমাকে চিনতে পেরেছিল ও।”
এদিকে তো নম পেনে যে কয়জন পশুপ্রেমী ছিল তারা খুবই চিন্তায় পড়ে গেছে। মেকং-এর ওর্কায়েলাদের সংখ্যা খুবই দ্রুত কমে আসছে, আর কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো হাতের বাইরে চলে যাবে পরিস্থিতি। কম্বোডিয়ার দুর্দিনে যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে মেকং ওর্কায়েলাদেরও। ১৯৭০-এর দশকে মার্কিনি কার্পেট বম্বিং-এর শিকার হয়েছে ওরা। আর তারপর খুমের রুজদের সময়ে ওর্কায়েলারাও হাজারে হাজারে মরেছে ওদের হাতে। পেট্রোলিয়ামের জোগান ক্রমশ কমে আসায় বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ডলফিনের তেল ব্যবহার করতে শুরু করেছিল খুমেররা। কম্বোডিয়ার সবচেয়ে বড় মিঠে জলের হ্রদ টোনলে স্যাপের অগুন্তি ডলফিন একটা সময় প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল এভাবে। রাইফেল আর বোমা ছুঁড়ে ডলফিন মারা হত তখন, তারপর তাদের ঝুলিয়ে রাখা হত রোদের মধ্যে। সূর্যের তাপে তাদের চর্বি গলে গলে পড়ত নীচে রাখা বালতিতে। তারপর মোটর সাইকেল আর নৌকো চালানোর কাজে লাগত সেই চর্বি। ২৮৬
“মানে, আপনি বলতে চাইছেন ডলফিনের চর্বি গলিয়ে তাই দিয়ে ডিজেলের কাজ চালানো হত?” কানাই জিজ্ঞেস করল।
“ঠিক তাই।” গত কয়েক বছর ধরে নানা কারণে আরও বেশি করে বিপন্ন হয়ে পড়েছে কম্বোডিয়ার এই ওর্কায়েলারা। মেকং নদীর উজানে পাথর ফাটিয়ে খাত চওড়া করার একটা পরিকল্পনা হচ্ছে, যাতে করে সোজা চিন দেশ পর্যন্ত নৌ চলাচল সহজ হয়ে যাবে। সেই মতো কাজ যদি এগোতে থাকে, তা হলে এই ডলফিনদের কিছু কিছু স্বাভাবিক বসতি নষ্ট হয়ে যাবে। অর্থাৎ মিস্টার স্লোয়েনের এই দুর্দশা কোনও একটি প্রাণীর সমস্যা নয়–এ হল গোটা একটা প্রজাতির বিপর্যয়ের সংকেত।
ডলফিনটাকে নদীতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করার সময়ে পিয়াকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল প্রাণীটার দেখাশোনা করার। ছ’দিন ধরে প্রত্যেক সকালে কুলার ভর্তি মাছ নিয়ে ও চলে যেত জলাটার ধারে। সাত দিনের দিন গিয়ে দেখল মিস্টার স্লোয়েনের কোনও চিহ্ন নেই সেখানে। শুনল আগের দিন রাত্রে নাকি মারা গেছে ডলফিনটা। কিন্তু সেই খবরের সমর্থনে কোনও প্রমাণ ও খুঁজে পেল না। জলার মধ্যে থেকে প্রাণীটার শেষ চিহ্ন পর্যন্ত কীভাবে লোপাট হয়ে গেল তারও কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া গেল না। যেটা চোখে পড়ল তা হল জলার ধারের কাদায় ভারী কোনও গাড়ির–খুব সম্ভবত একটা ট্রাকের–টায়ারের দাগ। জলের একেবারে কাছাকাছি গিয়ে শেষ হয়েছে দাগটা। কী ঘটেছে সেটা বুঝতে ওদের একটুও অসুবিধা হয়নি–বেআইনি কোনও বন্যপ্রাণী পাচার চক্রের শিকার হয়েছে মিস্টার স্লোয়েন। পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় নতুন নতুন অ্যাকুয়ারিয়াম ভোলা হচ্ছে, সে জন্য নদীর ডলফিনের চাহিদা দিনে দিনে বাড়ছে। সে বাজারে মিস্টার স্লোয়েনের দাম অনেক। এই একটা ইরাবড়ি ডলফিন এক লাখ মার্কিন ডলারে পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে এরকমও শোনা গেছে।
“এক লাখ ডলার?” কানাইয়ের গলায় অবিশ্বাস। এই জন্তুগুলোর জন্যে?”
“হ্যাঁ।”
জানোয়ার নিয়ে আদিখ্যেতার স্বভাব পিয়ার কোনওকালে ছিল না, কিন্তু মিস্টার স্লোয়েন একটা দর্শনীয় সামগ্রী হিসেবে কোনও অ্যাকুয়ারিয়ামে বিক্রি হয়ে যাবে–কথাটা ভাবতেই ওর মাথার ভেতরে কেমন করতে লাগল। তারপর বেশ কয়েকদিন ধরে ওর স্বপ্নে ঘুরে ঘুরে আসতে লাগল একটা ছবি–একদল শিকারি জলাটার এক ধারে কোণঠাসা করে ফেলছে মিস্টার স্লোয়েনকে, তাদের হাতে মাছ ধরার জাল।
ব্যাপারটা মন থেকে মুছে ফেলার জন্য পিয়া ঠিক করল আবার আমেরিকায় ফিরে যাবে। সেখানে লা জোলার স্ক্রিপ্স ইন্সটিটিউটে ভর্তি হবে পি এইচ ডি করার জন্য। কিন্তু তার মধ্যেই একটা অদৃষ্টপূর্ব ঘটনা ঘটে গেল : নম পেনের এক বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংস্থা মেকং ওর্কায়েলাদের ওপর সার্ভে করার জন্য একটা কন্ট্রাক্ট দিতে চাইল ওকে। সব দিক থেকেই ভাল ছিল অফারটা। যে টাকা ওরা দিতে চাইছিল সেটা বছর দুয়েক চালিয়ে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট, তা ছাড়া ও ভেবে দেখল এই সার্ভেটা করলে ওর পি এইচ ডি-র কাজটাও খানিকটা এগিয়ে যাবে। কাজটা নিয়েই নিল পিয়া। মেকং-এর উজানে ক্রেতি নামের এক আধঘুমন্ত শহরে গিয়ে আস্তানা গাড়ল। তারপর তিন বছরের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন ওর্কায়েলা বিশেষজ্ঞদের একজন হয়ে উঠল ও। সারা পৃথিবীর যেখানে যেখানে ওর্কায়েলা ডলফিনদের দেখা পাওয়া যায় সেইসব জায়গায় গিয়ে সার্ভের কাজ করল পিয়া–বার্মা, উত্তর অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন্স, থাইল্যান্ড–সব জায়গায়। কেবল একটা জায়গা ছাড়া। প্রথম যেখানে এই ডলফিনরা প্রাণিতত্ত্ববিদদের রেকর্ড বইয়ে জায়গা পেয়েছিল, সেই ইন্ডিয়াতে এসে কাজ করা ওর হয়ে ওঠেনি।
কাহিনির একেবারে শেষের দিকে এসে পিয়ার খেয়াল হল নৌকোয় উঠে অবধি ফকিরের সঙ্গে একটাও কথা বলেনি। সেটা মনে পড়ে একটু খারাপ লাগল ওর।
কানাইকে ডেকে বলল, “আচ্ছা, একটা ব্যাপার আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। দেখুন, ফকির তো এই এলাকাটাকে, এই গর্জনতলা দ্বীপটাকে মনে হয় খুব ভালভাবে চেনে। ডলফিনদের সম্পর্কেও অনেক কিছু জানে–ওরা কোথা থেকে আসে, কোথায় যায়… আমার জানতে ইচ্ছে করে প্রথম কীভাবে ও এই জায়গাটায় এল, এইসব কথা ও কীভাবে জানল। আপনি একটু জিজ্ঞেস করবেন ওকে?”
“নিশ্চয়ই।” ফকিরের দিকে ফিরে পিয়ার প্রশ্নটা ব্যাখ্যা করল কানাই। তারপর ফকির তার জবাব শুরু করতেই পিয়ার দিকে ঘুরে বসল ও। “ও যা বলছে সেটা শোনাচ্ছি আপনাকে।”
“প্রথম কবে এই জায়গার কথা জানলাম সেটা মনেই পড়ে না আমার। যখন খুব ছোট্ট ছিলাম, এইসব দ্বীপ নদী কিছু চোখেই দেখিনি, তখন থেকেই মায়ের কাছে গর্জনতলার গল্প শুনেছি। মা আমাকে গান গেয়ে গেয়ে শোনাত, এই দ্বীপটার গল্প বলত। মা বলেছিল যার মনে কোনও পাপ নেই এই দ্বীপে তার কোনও ভয় নেই।
“আর এই বড় শুশদের কথা জিজ্ঞেস করছেন? ওদের কথাও আমি জানতাম, এখানে আসার অনেক আগেই। শুশদের সব গল্পও মা বলত আমাকে। বলত ওরা হল বনবিবির দূত, এখানকার নদীনালার সব খবর ওরাই পৌঁছে দেয় বনবিবিকে। মা বলেছিল ওরা ভাটার সময় এখানে আসে, যাতে ভাল করে সব দেখে-টেখে গিয়ে বনবিবিকে বলতে পারে। আর জোয়ার এলেই বনের ধারে ধারে ছড়িয়ে গিয়ে বনবিবির চোখ-কান হয়ে যায়। এই গোপন খবরটা দাদু বলেছিল মাকে। বলেছিল শুশুকদের পেছন পেছন চলতে যদি শিখতে পার তা হলে মাছ পেতে কখনও কোনও অসুবিধা হবে না।
“এই ভাটির দেশে আসার অনেক আগেই আমি এসব গল্প শুনেছি। ছোটবেলা থেকেই আমার মনে তাই এই জায়গাটা দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। তারপর আমরা যখন মরিচঝাঁপিতে থাকতে এলাম, আমি প্রায়ই মাকে বলতাম, কবে যাব মা? কবে আমরা গর্জনতলা যাব? কিন্তু সময়ই হত না–এত কাজ ছিল মা-র তখন। মারা যাওয়ার সপ্তাহ কয়েক আগে মা প্রথম আমাকে নিয়ে এসেছিল এখানে। সেজন্যেই হয়তো তারপর থেকে মা-র কথা মনে পড়লেই অমনি গর্জনতলার কথাও মনে পড়ে যেত আমার। পরে কতবার আমি এসেছি এখানে। আস্তে আস্তে এই শুশরাও আমার বন্ধুর মতো হয়ে গেল। ওরা যেখানে যেত আমিও ওদের পেছন পেছন গেছি কতবার।
“‘সেদিন আপনি যখন ওই ফরেস্টের লোকেদের সঙ্গে লঞ্চে করে এসে আমার নৌকো থামালেন, তখনও আমি আমার ছেলেকে নিয়ে এখানেই আসছিলাম। তার আগের দিন রাত্রে আমার মা স্বপ্নে এসেছিল। বলল, আমি তোর ছেলেকে দেখতে চাই। ওকে কখনও গর্জনতলায় নিয়ে আসিস না কেন? তোর তো আর কিছুদিনের মধ্যেই আমার কাছে চলে আসার সময় হয়ে যাবে, তারপর ওকে আমি আবার কবে দেখতে পাব কে জানে? যত তাড়াতাড়ি পারিস ওকে নিয়ে আয়।’
“আমি আমার বউকে এসব কথা বলতে পারিনি। বিশ্বাসই করবে না আমাকে। মাঝখান থেকে খেপে যাবে। তাই পরের দিন টুটুলকে স্কুলে না নিয়ে গিয়ে নৌকোয় তুলে সোজা এখানে আসার জন্য বেরিয়ে পড়েছিলাম। পথে এক জায়গায় থেমেছিলাম কিছু মাছ ধরার জন্যে, সেই সময়েই আপনি এলেন লঞ্চে করে।”
“তারপর কী হল? তোমার মা কি ওকে দেখতে পেয়েছিলেন মনে হয়?” জিজ্ঞেস করল পিয়া।
“হ্যাঁ। আগের দিন যখন এখানে রাতের বেলায় নৌকোয় ঘুমোচ্ছিলাম, আবার স্বপ্নে মাকে দেখতে পেলাম আমি। খুব খুশি হয়েছে। বলল, খুব ভাল লাগল তোর ছেলেকে দেখে। যা, এবার ওকে গিয়ে বাড়িতে রেখে আয়। তারপর আমরা আবার একসাথে হব।”
এতক্ষণ পর্যন্ত মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যাচ্ছিল পিয়া। কানাইয়ের অস্তিত্বের কথা যেন ভুলেই গিয়েছিল প্রায়, কেমন একটা ঘোরের মধ্যে মনে হচ্ছিল যেন সরাসরি ফকিরের সঙ্গেই কথা বলছিল ও। কিন্তু হঠাৎ ঘোরটা ভেঙে গেল এবার, পিয়া যেন চমকে জেগে উঠল ঘুমের থেকে।
“এটা ও কী বলছে কানাই?” ও প্রশ্ন করল। “জিজ্ঞেস করুন না, এটা কী বলতে চাইছে ও?”
“ও বলছে এটা একটা স্বপ্ন দেখেছিল শুধু।”
পিয়ার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে ফকিরকে কী যেন একটা বলল কানাই। আর তারপরেই হঠাৎ আশ্চর্য হয়ে পিয়া শুনল ফকির একটা গান গাইতে শুরু করেছে, অথবা গানও ঠিক বলা যায় না সেটাকে, মনে হল যেন খুব দ্রুত লয়ে একটা কিছু মন্ত্র বলছে।
“ও কী বলছে ওটা?” কানাইকে জিজ্ঞেস করল পিয়া। “ইংরেজি করে বলে দিতে পারবেন আপনি?”
“সরি পিয়া,” জবাব দিল কানাই। “এ আমার ক্ষমতার বাইরে। ফকির বনবিবির উপাখ্যান থেকে গাইছে–খুব জটিল ছন্দটা। এটা আমার দ্বারা হবে না।”