আলাপ

স্নান সেরে জানালার পাশে চেয়ারটায় গা ডুবিয়ে বসল পিয়া। খানিক পরে দেখল ওর আর ওঠার ক্ষমতা নেই। এই কদিন স্রেফ উবু হয়ে আর আসন করে বসে থাকার পর একটা হেলান দেওয়ার জায়গা পেয়ে কেমন যেন এক অদ্ভুত আরামের অনুভূতি হচ্ছে। ইচ্ছেমতো পা-ও দোলানো যাচ্ছে–পড়ে যাওয়ার কোনও ভয় নেই। এখনও মনে হচ্ছে নৌকোর দুলুনি টের পাচ্ছে সারা শরীরে, কানে বাজছে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের ঝিরঝির শব্দ।

নৌকোয় চলার বোধটা ফেরত আসতেই হঠাৎ সকালের সেই ভয়ংকর ঘটনার কথা মনে পড়ে গা শিউরে উঠল পিয়ার। মাত্রই কয়েকঘন্টা আগের ঘটনা অনুভূতিগুলি যেন এখনও স্মৃতি হয়ে যায়নি; টাটকা, স্পষ্ট রয়ে গেছে মনের মধ্যে। পরিষ্কার দেখতে পেল পিয়া কুমিরটার মাথা মোচড় খেয়ে ঘুরে যাচ্ছে শূন্যে, দেখতে পেল এক মুহূর্ত আগেও ওর কবজিটা যেখানে ছিল ঠিক সেইখানটায় এসে খপাত করে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সরীসৃপটার হাঁ মুখ : হাতটা ধরে ফেলবে বলে এত নিশ্চিত ছিল কুমিরটা, যে ওকে ডিঙি থেকে টেনে জলের ভেতরে নিয়ে যাওয়ার জন্য শরীরের চলন যেরকম হওয়া দরকার ঠিক সেইভাবেই লাফ দিয়েছিল ওটা। পিয়া কল্পনা করল একটানে ওকে জন্তুটা নিয়ে চলে যাচ্ছে জলের নীচে, একবার মুহূর্তের জন্য আলগা হচ্ছে কামড়, তারপর ওর শরীরের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় এসে ফের বন্ধ হচ্ছে হাঁ-মুখ। দ্রুত ওকে নিয়ে চলে যাচ্ছে সেই অদ্ভুত উজ্জ্বল গভীরে, যেখানে সূর্যের আলোর কোনও দিক-দিশা নেই, যেখানে বোঝা যায় না কোনদিকে গেলে ওপরে ওঠা যাবে, আর কোনদিকে গেলে তলিয়ে যাবে আরও নীচে। লঞ্চ থেকে পড়ে যাওয়ার সময়কার আতঙ্কের কথা মনে পড়ে গেল ওর, মনে পড়ল সেই শরীর অবশ করা ভয়ের কথা, যখন চেতনার মধ্যে একটাই কথা বাজতে থাকে–এই অতল কারা থেকে মুক্তির কোনও উপায় নেই। পর পর এই সব দৃশ্যগুলো চোখের সামনে এসে এমন এক স্পষ্ট জীবন্ত মন্তাজ তৈরি হল যে পিয়ার হাত আবার থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। আর ফকিরের অনুপস্থিতিতে ঘটনাগুলিকে তখনকার থেকে অনেক বেশি ভয়াবহ মনে হল এখন।

জোর করে উঠে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল পিয়া। এখনও চাঁদ ওঠেনি, অন্ধকারে ঝুপসি কয়েকটা নারকেলগাছ আবছা নজরে আসছে, তার পরেই ফসল কাটা ন্যাড়া জমির বিস্তীর্ণ শূন্যতা। বাড়ির সামনের দিক থেকে একটা কথাবার্তার আওয়াজ ভেসে আসছে : কোনও মহিলার গলা আর তার সঙ্গে কানাইয়ের ভারী গম্ভীর কণ্ঠস্বর।

চেয়ার থেকে শরীরটাকে টেনে তুলে একতলায় নেমে এল পিয়া। দরজাটার সামনে হাতে একটা লণ্ঠন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কানাই লাল শাড়ি পরা এক মহিলার সঙ্গে কথা বলছে। খানিকটা অন্যদিকে ফিরে দাঁড়িয়েছিল মহিলা, পিয়াকে আসতে দেখে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে কানাইয়ের লণ্ঠনের আলোয় হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার মুখের একটা পাশ। পিয়া দেখল ওরই কাছাকাছি বয়স হবে মেয়েটির, ভরা শরীর, চওড়া হাঁ মুখ আর বড় বড় ঝকঝকে দুটো চোখ। দুই ভুরুর মাঝে বড় একটা লাল টিপ আর মাথায় চকচকে কালো চুলের মাঝখান দিয়ে একটা ক্ষতচিহ্নের মতো মোটা করে টকটকে লাল সিঁদুরের দাগ।

“আরে এই যে পিয়া”, কানাই বলল ইংরেজিতে। ওর গলায় বাড়তি উচ্ছ্বাসের সুরটা থেকে পিয়া আন্দাজ করল ওকে নিয়েই কথা হচ্ছিল এতক্ষণ। দেখল মেয়েটি স্পষ্ট স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে, যেন বুঝতে পেরেছে ও কে, আর মনে মনে যাচাই করে নিচ্ছে ওকে। তারপর ওই খোলা নজরে জরিপ করার মতোই অস্বস্তিকর ভঙ্গিতে হঠাৎ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল মুখটা। কানাইয়ের হাতে কয়েকটা স্টেনলেস স্টিলের কৌটো ধরিয়ে দিয়ে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে; তারপর অন্ধকারে ঢাকা ট্রাস্ট চৌহদ্দির মধ্যে মিলিয়ে গেল কোথায়।

“কে ওই মহিলা?” পিয়া জিজ্ঞেস করল কানাইকে।

“বলিনি আপনাকে? ও তো ময়না, ফকিরের বউ।”

“তাই বুঝি?”

ফকিরের বউয়ের চেহারা যেমন কল্পনা করেছিল পিয়া তার থেকে ময়না এতটাই আলাদা যে ব্যাপারটা হজম করতে একটু সময় লাগল ওর। তারপর বলল, “বোঝা উচিত ছিল আমার।”

“কী বোঝা উচিত ছিল?”

“যে ও ফকিরের বউ। ছেলেটার চোখদুটো ঠিক ওর মতো।”

“তাই নাকি?”

“হ্যাঁ,” বলল পিয়া। “কী বলতে এসেছিল ও?”।

“এই যে, এই টিফিন ক্যারিয়ারটা দিয়ে গেল,” স্টিলের কৌটোগুলো তুলে দেখাল কানাই। “আমাদের রাতের খাবার আছে এর মধ্যে। হাসপাতালের রান্নাঘর থেকে ময়না নিয়ে এসেছে আমাদের জন্য।”

মুহূর্তের জন্য কানাইয়ের ওপর থেকে মনোযোগ সরে গেল পিয়ার। ওই মেয়েটির কথা ভাবছিল ও, ফকিরের বউয়ের কথা। ফকির আর টুটুলের কাছে ফিরে গেল বউটি, আর ওকে ফিরে যেতে হবে গেস্ট হাউসের দোতলার শূন্যতায় ভেবে অল্প একটু ঈর্ষা হল মনে। এই চিন্তায় নিজেরই লজ্জা লাগল পিয়ার, আর সেটা ঢাকার জন্য ও কানাইয়ের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে তাড়াতাড়ি বলল, “আমি যেরকম ভেবেছিলাম তার সঙ্গে কোনওই মিল নেই ওর।”

“মিল নেই?”

“না।” আবার পিয়া দেখল ঠিক উপযুক্ত শব্দটা কিছুতেই মনে আসছে না। বলল, “মানে, বেশ ভালই দেখতে, না?”

“আপনার তাই মনে হল?”

বুঝতে পারছিল পিয়া এ প্রসঙ্গটা এখানেই শেষ করে দেওয়া ভাল, কিন্তু তাও থামল না, ক্ষতস্থানের ওপর থেকে মামড়ি খুঁটে তোলার মতো বলেই যেতে লাগল : “তাই তো। বেশ সুন্দরীই বলা চলে।”

“ঠিকই বলেছেন, নিজেকে সামলে নিয়ে একটু মোলায়েম সুরে বলল কানাই। “খুবই অ্যাট্রাক্টিভ। কিন্তু আরও গুণ আছে ওর সেসব দেখতে গেলে খুব একটা সাধারণ মেয়ে নয় ময়না।”

“তাই নাকি? কী রকম?”

“অদ্ভুত ওর জীবনের কাহিনি,” বলল কানাই। “অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও নিজের চেষ্টায় লেখাপড়া শিখেছে, শিগগিরই হয়তো পুরোদস্তুর নার্স হয়ে যাবে এই হাসপাতালে, নিজের এবং পরিবারের জন্য ও ঠিক কী চায় সেটা ও জানে, এবং সেটা অর্জন করার জন্য যে-কোনও বাধাকে তুচ্ছ করে এগিয়ে যাওয়ার জোর ওর আছে। ওর মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে, এক ধরনের বলিষ্ঠতা আছে। অনেকদূর যাবে ওই মেয়ে।”

কানাইয়ের কথার মধ্যে কোথায় যেন একটা তুলনামূলক বিচারের আভাস রয়েছে মনে হল। সেই বিচারে ও নিজে কোন জায়গায় দাঁড়াবে মনে মনে না ভেবে পারল না পিয়া–ওর কখনওই বিশেষ কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না, আর পড়াশোনা শেখার জন্যও কখনও নিজের চারপাশের পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করতে হয়নি। ও জানে, কানাইয়ের চোখে ও একটা নরম-সরম, বাপ-মার আদরে মানুষ হওয়া সাদামাটা ধরনের মেয়ে। তবে এই ভাবে ওকে বিচার করার জন্য কানাইকে দোষ দেয় না পিয়া; কানাইয়ের সম্পর্কেও তো ওর যেমন মনে হয় যে বিশেষ একটা ধাঁচের ভারতীয় ছেলেরা যে রকম হয় সেই রকম ধরনের মানুষ ও–দাম্ভিক, আত্মকেন্দ্রিক, জোর করে নিজের মতামত অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে আগ্রহী–তবু, এ সব কিছু সত্ত্বেও অপছন্দ করার মতো নয়।

এবার একটা নিরাপদ দিকে কথা ঘোরাল পিয়া, “ওরা কি এই লুসিবাড়িরই লোক? ফকির আর ময়না?”

“না,” কানাই বলল। “ওদের দুজনেরই বাড়ি ছিল অন্য একটা দ্বীপে, সাতজেলিয়ায়। এখান থেকে অনেকটা দূরে।”

“তা হলে ওরা এখানে কেন থাকে?”

“একটা কারণ হল ময়না এখানে নার্সিং-এর ট্রেনিং নিচ্ছে, আর একটা কারণ হচ্ছে ও ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতে চায়। ফকির টুটুলকে নিয়ে মাছ ধরতে চলে গিয়েছিল বলেই তাই রেগে গেছে ময়না।”

“দু’দিন ধরে আমিও যে ছিলাম ওই নৌকোতে সেটা ও জানে?”

“জানে,” বলল কানাই। “সবই জানে–ফরেস্ট গার্ড টাকা নিয়ে নিয়েছিল, আপনি জলে পড়ে গিয়েছিলেন, আপনাকে বাঁচাতে ফকির ঝাঁপ দিয়েছিল–সব। কুমিরের ঘটনাটাও জানে দেখলাম–বাচ্চাটা সব বলেছে ওকে।”

কানাই যে শুধু বাচ্চার কথাটাই উল্লেখ করছে সেটা লক্ষ করল পিয়া : তার মানে কি ফকির ময়নাকে বিশেষ কিছু বলেনি এই দু’দিনের ঘটনা সম্পর্কে, না কি ও অন্য রকম কিছু বিবরণ দিয়েছে? এই দুটো প্রশ্নের কোনওটারই উত্তর কানাইয়ের জানা আছে কিনা বুঝতে পারল না পিয়া, কিন্তু জিজ্ঞেসও করে উঠতে পারল না নিজে থেকে। তার বদলে বলল, “ময়না নিশ্চয়ই ভাবছে আমি কী করতে এসেছি এখানে?”

“সে তো বটেই,” বলল কানাই। “আমাকে জিজ্ঞেসও করল। আমি বললাম যে আপনি একজন বৈজ্ঞানিক। খুব ইমপ্রেসড হল ও।”

“কেন?”

“বুঝতেই পারছেন, লেখাপড়া সংক্রান্ত যে-কোনও বিষয়েই ওর খুব আগ্রহ।”

“ওকে বললেন নাকি যে আমরা কাল যাব ওদের বাড়িতে?”

“বললাম,” কানাই জবাব দিল। “ওরা থাকবে বাড়িতে, অপেক্ষা করবে আমাদের জন্য।” কথা বলতে বলতে দোতলায় গেস্ট হাউসে উঠে এসেছে কানাই আর পিয়া। হাতের টিফিন ক্যারিয়ারটা টেবিলের ওপর রাখল কানাই। “নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে আপনার?” বাটিগুলো আলাদা করতে করতে জিজ্ঞেস করল ও। “সব সময় এত খাবার নিয়ে আসে ময়না–আমাদের দুজনের কুলিয়ে বেশি হয়ে যাবে। দেখি কী এনেছে–ভাত আছে, ডাল আছে, মাঝের ঝোল আছে, চচ্চড়ি আর বেগুন ভাজা। নিন, কী দিয়ে শুরু করবেন?”

পাত্রগুলোর দিকে একটু সংশয়ের দৃষ্টিতে তাকাল পিয়া। বলল, “কিছু মনে করবেন না আশা করি, কিন্তু এগুলোর একটাও কিছু খাওয়ার সাহস নেই আমার। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে আমাকে খুব সাবধানে থাকতে হয়।”

“এমনি ভাত খান হলে একটু,” কানাই বলল। “সেটা তো খেতেই পারেন?” মাথা নাড়ল পিয়া। “হ্যাঁ, সেটা হয়তো খেতে পারি একটু–শুধু প্লেন, সাদা ভাত।”

“এই নিন।” কয়েক হাতা ভাত পিয়ার প্লেটে তুলে দিল কানাই। একটা চামচও দিল। তারপর জামার হাতাটা গুটিয়ে, নিজের থালাতে খানিকটা ভাত নিয়ে খেতে শুরু করল হাত দিয়ে।

খেতে খেতে লুসিবাড়ির বিষয়ে অনেক কথা বলল কানাই। ড্যানিয়েল হ্যামিলটনের কথা বলল, কী করে এই দ্বীপে বসতি শুরু হল সে কথা বলল, নির্মল আর নীলিমা কীভাবে এখানে এসেছিল সেই গল্প করল। জায়গাটার বিষয়ে ও এত্ব কিছু জানে দেখে শেষে পিয়া জিজ্ঞেস করল, “আপনার কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছে যেন আপনি বহু দিন কাটিয়েছেন এখানে। কিন্তু সেটা তো ঠিক নয়, তাই না?”

পিয়ার বক্তব্য সমর্থন করল কানাই, “একেবারেই না। আমি এর আগে একবার মাত্র এসেছিলাম এখানে। ছোটবেলায়। সত্যি কথা বলতে কী, এখনও এত স্পষ্ট সব কিছু মনে আছে দেখে আমি নিজেই আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। আরও বিশেষ করে, কারণ আমাকে তো আসলে শাস্তি দেওয়ার জন্য পাঠানো হয়েছিল এখানে।”

“কেন আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছেন?”

কাধ ঝাঁকাল কানাই। “আমি আসলে যে ধরনের মানুষ তাতে আমার পক্ষে এটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। আমি অতীত আঁকড়ে পড়ে থাকি না। সব সময় সামনের দিকে তাকিয়ে চলতে পছন্দ করি।”

“কিন্তু এখানে, এই লুসিবাড়িতে এখন তো আমরা অতীতে নেই, আমরা তো বর্তমানে আছি, তাই না?” হেসে বলল পিয়া।

“মোটেও না,” জোর দিয়ে বলল কানাই। “আমার কাছে লুসিবাড়ি সবসময় অতীতেরই অংশ হয়ে থাকবে।”

ভাত শেষ হয়ে গিয়েছিল পিয়ার, টেবিল থেকে উঠে থালা বাসনগুলো গুছোতে শুরু করল ও। তাই দেখে ব্যস্ত হয়ে উঠল কানাই।

“আরে, বসে পড়ুন। আপনি আবার এগুলোতে কেন হাত দিচ্ছেন? ওসব ময়না করে নেবে এখন।”

“আমি ময়নার থেকে কিছু খারাপ করব না,” পিয়া জবাব দিল।

কানাই কাঁধ ঝাঁকাল। “বেশ।”

নিজের প্লেটটা ধুতে ধুতে পিয়া বলল, “এই যে আপনি এখানে আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করলেন, এত কিছু করলেন, কিন্তু আমার এদিকে মনে হচ্ছে আমি তো আপনার সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না বলতে গেলে। শুধু নামটা ছাড়া।”

“তাই?” একটু অবাক হয়ে হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠল কানাই। “কেমন করে ঘটল। এই আশ্চর্য ঘটনাটা বলুন তো? আমার খুব একটা বাক্ সংযম আছে বলে তো বাজারে কোনও দুর্নাম নেই।”

“তা হলেও, কথাটা সত্যি। এমনকী আপনি কোথায় থাকেন সেটা পর্যন্ত আমি জানি না।”

“এক্ষুনি সব সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছি,” কানাই বলল। “আমি থাকি নতুন দিল্লিতে, আমার বয়স বিয়াল্লিশ এবং বেশিরভাগ সময়েই আমি সঙ্গিনীহীন।”

“তাই বুঝি?” একটু কম ব্যক্তিগত দিকে কথা ঘোরাল পিয়া, “আর আপনি তো ট্রান্সলেটর, তাই না? এই একটা কথা বলেছিলেন মনে আছে আমার।”

“একদম ঠিক। মৌখিক এবং লিখিত অনুবাদের কাজ করি আমি। যদিও এখন সেসব কিছুর চেয়ে ব্যবসাটাই বেশি করে করছি। বছর কয়েক আগে আমি খেয়াল করি যে দিল্লিতে পেশাদার ভাষাবিদের সংখ্যা খুব কম। তখন নিজেই একটা অফিস খুলে বসলাম। এখন আমার কোম্পানি সমস্ত রকম সংস্থার জন্য সব রকমের অনুবাদের কাজ করে–ব্যবসায়ীদের জন্য, বিভিন্ন দূতাবাসের জন্য, সংবাদমাধ্যমের জন্য, নানারকম সব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের জন্য–এক কথায়, যারাই পয়সা দেয় তাদেরই জন্য কাজ করি আমরা।”

“এ কাজের চাহিদা কী রকম বাজারে?”

“চাহিদা আছে, চাহিদা আছে,” মাথা নেড়ে বলল কানাই। “দিল্লি এখন হল পৃথিবীর ব্যস্ততম কনফারেন্স সিটিগুলির মধ্যে একটা। মিডিয়ারও প্রচুর কাজ। কিছু না কিছু একটা সব সময় লেগেই আছে। আমি তো কাজ করে কুলিয়ে উঠতে পারি না অনেক সময়। ব্যবসা সমানে বেড়েই যাচ্ছে। এই তো কয়েকদিন আগেই আমরা চালু করলাম একটা স্পিচ ট্রেনিং অপারেশন। কল সেন্টারে যারা কাজ করে তাদের ইংরেজি উচ্চারণ শেখানোর জন্য। সেই বিভাগের কাজ তো এখন দিনে দিনে বাড়ছে।”

শুধু মাত্র ভাষার আদান প্রদানের ওপর নির্ভর করে যে একটা ব্যবসা দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায় এই ধারণাটাই খুব আশ্চর্য মনে হল পিয়ার। “তা হলে আপনি নিজেও নিশ্চয়ই

অনেকগুলো ভাষা জানেন, তাই না?”

“ছ’টা,” মুচকি হেসে সঙ্গে সঙ্গে বলল কানাই। “হিন্দি, উর্দু আর বাংলাটাই প্রধানত কাজে লাগে এখন। আর ইংরেজি তো আছেই। তা ছাড়াও আরও দুটো জানি, ফরাসি আর আরবি–সেগুলোও সময়ে অসময়ে কাজে লেগে যায়।”

অদ্ভুত লাগল পিয়ার এই দুটো ভাষার কথা শুনে। “ফরাসি আর আরবি! এই ভাষাগুলো আবার কী করে শিখলেন?”

“স্কলারশিপ,” একটু হেসে বলল কানাই। “বিভিন্ন সব ভাষার ব্যাপারে আমার সব সময়ই খুব আগ্রহ। ছাত্র অবস্থায় প্রায়ই ঢু মারতাম কলকাতার অলিয়স ফ্রঁসেতে। তারপর এটা ওটা নানা যোগাযোগে স্কলারশিপ পেয়ে গেলাম একটা। তারপর প্যারিসে যখন ছিলাম সেই সময় একটা সুযোগ এল টিউনিশিয়াতে গিয়ে আরবি শেখার। এরকম সুযোগ আর কে ছাড়ে? তারপর থেকে আর কখনও পেছনে তাকাতে হয়নি।”

একটা হাত তুলে ডান কানের রুপোর দুলটা খুঁটতে লাগল পিয়া। ভঙ্গিটার আত্মবিস্মৃত ভাবটা ছেলেমানুষি, কিন্তু তারই মধ্যে যুবতীসুলভ একটা সুষমাও রয়েছে। “আপনি তা হলে ঠিকই করে নিয়েছিলেন যে এই অনুবাদের কাজটাকেই এক সময় পেশা করবেন?”

“না না,” বলল কানাই। “একেবারেই না। আমি যখন আপনার বয়সি ছিলাম, কলকাতার আর পাঁচটা কলেজের ছাত্রর মতো তখন আমারও মাথার মধ্যে গজগজ করত কবিতার ভূত। পেশাদারি জীবনের শুরুতে আমার ইচ্ছে ছিল আমি জীবনানন্দ অনুবাদ করব আরবিতে আর অ্যাডোনিস অনুবাদ করব বাংলায়।”

“তারপর কী হল?” নাটকীয় ভাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল কানাই। “সংক্ষেপে বলতে গেলে, কিছুদিনের মধ্যেই আমি আবিষ্কার করলাম যে ভাষা হিসেবে যদিও বাংলা এবং আরবি দুটোরই সম্পদ অপরিমেয়, কিন্তু এই দুটোর কোনও ভাষাতেই শুধু সাহিত্যিক অনুবাদের কাজ করে পেট চালানো সম্ভব নয়। বড়লোক আরবদের বাংলা সাহিত্যের বিষয়ে কোনও আগ্রহই নেই, আর বড়লোক বাঙালিদের কীসে আগ্রহ আছে তাতে কিছুই যায় আসে না, কারণ সংখ্যায় তারা এত কম যে তাদের পক্ষে কিছু করে ওঠা সম্ভব নয়। একটা সময় এসে তাই আমি নিজেকে ভাগ্যের হাতে সঁপে দিলাম, আর এইসব ব্যবসায়িক কাজ শুরু করলাম। তবে এটা বলতেই হবে খুবই ভাল সময়ে শুরু করেছি আমি : অনেক কিছু হচ্ছে এখন এই দেশে, আর তার অংশ হতে পারাটা বেশ একটা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা আমার মনে হয়।”

পিয়ার মনে পড়ল বাবার কাছে শোনা ইন্ডিয়ার গল্প, যে দেশ ছেড়ে বাবা চলে গিয়েছিল আমেরিকায় : সে ছিল এমন এক দেশ যেখানে গাড়ি ছিল মাত্র দু’রকমের, আর যেখানে মধ্যবিত্ত জীবনকাঠামোর প্রধান ধর্ম ছিল বিদেশি যে-কোনও কিছুর প্রতি এক তীব্র আকর্ষণ। কিন্তু কানাই যে জগতে বাস করে এই লুসিবাড়ি বা ভাটির দেশের থেকে সে পৃথিবী যতটা দূরে, পিয়ার বাবার স্মৃতির ভারতের সঙ্গে তার দূরত্ব কোনও অংশে কম নয়।

“আপনার কখনও আবার সাহিত্যিক অনুবাদের কাজে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে হয় না?” ও জিজ্ঞেস করল কানাইকে।

“হয় কখনও কখনও। খুব বেশি হয় না। সব মিলিয়ে এটা স্বীকার করতেই হবে যে একটা গোটা অফিস চালাতে আমার বেশ ভালই লাগে। ভাবতে ভাল লাগে আমি লোকজনদের চাকরি দিচ্ছি, মাইনে দিচ্ছি, অর্থহীন ডিগ্রিওয়ালা ছাত্রছাত্রীদের কাজের সুযোগ করে দিচ্ছি। আর, পয়সা এবং স্বাচ্ছন্দ্যটাও যথেষ্ট উপভোগ করি আমি। সেটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। পয়সাওয়ালা একা লোকের পক্ষে দিল্লি বেশ ভাল জায়গা। অনেক ইন্টারেস্টিং মহিলার সঙ্গে যোগাযোগ হয়।”

এই শেষ কথাটায় একেবারে আশ্চর্য হয়ে গেল পিয়া। এক মুহূর্ত ঠিক বুঝে উঠতে পারল

কী বলবে। বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে সদ্য বোয়া প্লেটগুলোকে গুছিয়ে রাখছিল ও। শেষ প্লেটটা রেখে একটা হাই তুলল, এক হাত তুলে আড়াল করল মুখটা।

“সরি।”

সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে কানাই বলল, “এত সব ঘটনার পরে নিশ্চয়ই খুব টায়ার্ড আপনি?”

“ভীষণ। মনে হচ্ছে ঘুমোতে যেতে হবে এবার।”

“এক্ষুনি?” জোর করে একটু হাসল কানাই, যদিও বোঝাই যাচ্ছিল বেশ একটু হতাশ হয়েছে ও। “অবশ্য ঠিকই তো, যা ধকলটা গেছে। আপনাকে বলেছি কি যে আর ঘণ্টাখানেক বাদে কিন্তু ইলেকট্রিক আলো বন্ধ হয়ে যাবে। হাতের কাছে মোমবাতি রাখবেন একটা।”

“তার অনেক আগেই আমি ঘুমিয়ে পড়ব।”

“গুড। আশা করি ভাল করে বিশ্রাম নিতে পারবেন রাত্তিরটা। আর যদি কিছু দরকার হয়, ওপরে গিয়ে দরজা ধাক্কাবেন। আমি মেসোর পড়ার ঘরে থাকব।”