লুসিবাড়ি ছাড়ার পর থেকেই নির্মলের নোটবইটা নিয়ে হরেনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ খুঁজছিল কানাই। বেশ খানিকক্ষণ পর মেঘা যখন অবশেষে একটা খোলা জায়গায় এসে পড়ল, তখন ও আস্তে আস্তে উঠে সারেঙের ঘরটায় গিয়ে ঢুকল। নোটবইটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এটা চিনতে পারেন হরেনদা?”
সামনে জলের দিকে চেয়েছিল হরেন। মুহূর্তের জন্য একবার নজর ফিরিয়ে দেখল নোটবইটা। নিরুত্তাপ গলায় বলল, “হ্যাঁ। সার ওটা আমাকে রাখতে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন আপনাকে দিয়ে দিতে।”
হরেনের সংক্ষিপ্ত জবাবে একটু চুপসে গেল কানাই। নির্মলের লেখায় বিভিন্ন প্রসঙ্গে এতবার হরেনের উল্লেখ আছে যে কানাই ভেবেছিল নোটবইটা দেখে ঠিক আবেগের বন্যায় ভেসে না গেলেও দু-একটা পুরনো স্মৃতি নিশ্চয়ই উশকে উঠবে ওর মনে।
“মেসো আপনার কথা অনেক লিখেছে এর মধ্যে,” ওকে একটু উৎসাহিত করার জন্য বলল কানাই। হরেন কিন্তু চোখই সরাল না জল থেকে। মাথাটা অল্প একটু নাড়াল শুধু।
ওর পেট থেকে কিছু বের করা খুব একটা সহজ কাজ হবে না বুঝতে পারল কানাই। এতটাই কি কম কথা বলে ও? নাকি বাইরের লোকের সামনে মুখ খুলতে চাইছে না? বলা মুশকিল।
“কোথায় ছিল খাতাটা?” কানাই নাছোড়বান্দা। “কোত্থেকে বেরোল এতদিন পরে?”
গলাটা একটু সাফ করে নিল হরেন। বলল, “হারিয়ে গিয়েছিল।”
“কী করে?”
“আপনি জানতে চাইলেন তাই বলছি,” বলল হরেন। “সার খাতাটা আমাকে দেবার পর আমি ওটাকে বাড়ি নিয়ে গেলাম। তারপর জল-টল যাতে না লাগে সেজন্য ভাল করে । প্লাস্টিকে মুড়ে আঠা লাগিয়ে আঠাটা শুকোনোর জন্যে রোদে দিলাম। তো বাড়ির কোনও বাচ্চা (ফকির কি?) ওটাকে খেলার জিনিস ভেবে উঠিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিল। তারপর বাচ্চাদের যেমন স্বভাব–বেড়ার খাঁজের মধ্যে ওটাকে লুকিয়ে রেখে ভুলেই গেল সে কথা। আমি চারদিকে কত খুঁজলাম, কিছুতেই পেলাম না। তারপর আস্তে আস্তে আমিও একসময় ভুলে গেলাম খাতাটার কথা।”
“শেষপর্যন্ত কী করে পাওয়া গেল তারপর?”
“বলছি সে কথা,” শান্ত, মাপা গলায় বলতে লাগল হরেন। “প্রায় বছর খানেক হবে–আমি ঠিক করলাম আমাদের পুরনো চালাঘরটা ভেঙে একটা পাকা বাড়ি বানাব। সেই ঘর ভাঙার সময়ই খুঁজে পাওয়া গেল ওটা। আমাকে যখন এনে দিল খাতাটা আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না কী করব ওটাকে নিয়ে। ডাকে পাঠাতে চাইনি, যদি ঠিকানা ভুল হয়ে যায়। আর মাসিমাকে নিয়ে গিয়ে যে দেব, সে সাহসও আমার ছিল না। কত বছর হল ওনার সঙ্গে কোনও কথাই হয়নি। তারপর খেয়াল হল ময়না তো যায় মাঝে মাঝে গেস্ট হাউসে। শেষে ওর হাত দিয়েই পাঠিয়ে দিলাম খাতাটা। ওকে বললাম, “এটা নিয়ে চুপচাপ সারের পুরনো পড়ার ঘরটাতে গিয়ে রেখে দিয়ে আয়। সময় হলে ওরা ঠিক খুঁজে পাবে। তো এই হল ঘটনা।”
এই বলে মুখ বন্ধ করল হরেন। এমনভাবে কথাটা শেষ করল যে বোঝা গেল এই বিষয়ে আর কোনও বাক্যব্যয় করতে রাজি নয় ও।
ঘণ্টা তিনেক একটানা চলার পর হঠাৎ একবার ইঞ্জিনের শব্দটা মুহূর্তের জন্য বেতালা শোনাল পিয়ার কানে। মেঘার ডেকের ওপর একইভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ও, কিন্তু শুরুতে সেই যে একটা গ্যাঞ্জেটিক ডলফিনকে একঝলক দেখা গিয়েছিল, তারপর থেকে এ পর্যন্ত কিছুই আর চোখে পড়েনি। তার ফলে ওর সেই দহটাতে তাড়াতাড়ি গিয়ে পৌঁছনোর ইচ্ছেটা আরও বেড়েছে বই কমেনি৷ এইসময় যদি ইঞ্জিন গড়বড় করে তা হলে খুবই আফশোসের ব্যাপার হবে। জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কান খাড়া করে ইঞ্জিনের আওয়াজটা শুনতে লাগল পিয়া। খানিকক্ষণের মধ্যেই ধকধক শব্দের ছন্দটা আবার ফিরে আসতে হাঁফ ছাড়ল ও।
কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য নয়। মিনিট পনেরো পরেই ফের তাল কাটল ইঞ্জিনের। একটা ফঁপা ফটফট আওয়াজ হল কয়েকবার, তারপর ক্লান্ত কাশির মতো কয়েকটা শব্দ, তারপর আচমকা সব চুপচাপ। মোহনার মাঝ বরাবর এসে একেবারে থেমে গেল মেঘার ইঞ্জিন।
পিয়া বুঝতে পারছিল এ গোলমাল সহজে সারবার নয়। এত বিরক্ত লাগছিল যে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছে করছিল না। কেউ না কেউ এক্ষুনি সেটা জানাতে আসবে নিশ্চয়ই, তাই ইঞ্জিনঘরের দিকে এগিয়ে দেখার চেষ্টা না করে নিজের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইল ও। বাতাসে ঢেউ তোলা নদীর দিকে চেয়ে দেখতে লাগল এক মনে।
যা ভাবা গিয়েছিল, খানিক বাদেই গুটিগুটি পায়ে কানাই এসে দাঁড়াল পাশে। “একটা খারাপ খবর আছে পিয়া।”
“আজকে আর হবে না, তাই তো?”
“মনে হয় না।”
হাত তুলে দূরে পাড়ের দিকে ইশারা করল কানাই। ওখানে একটা ছোট গ্রাম আছে। স্রোতের টানে টানে ওই পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়াটা নাকি খুব একটা সমস্যা হবে না, হরেন বলেছে। সেখানে হরেনের কিছু আত্মীয়স্বজন আছে। তাদের একজন নাকি এইসব ইঞ্জিন-টিঞ্জিনের কাজ জানে। সব যদি ঠিকঠাক চলে তা হলে কাল সকাল নাগাদ গর্জনতলার দিকে রওয়ানা হওয়া যেতেও পারে।
পিয়া মুখ বাঁকাল। “কী আর বলব? কী আর করা যাবে এ ছাড়া।”
“নাঃ। সত্যিই আর কোনও উপায় নেই।”
ইতোমধ্যে ভটভটিটাকে ঘুরিয়ে নিয়েছে হরেন। বোটের মুখ এখন দূরের ওই গাঁয়ের দিকে। খানিকক্ষণের মধ্যেই বোঝা গেল স্রোতের টানে ধীরে ধীরে মোহনা পেরিয়ে যাচ্ছে ওরা। যদিও ভাটা পড়ে গেছে, ফলে নদীর টান এখন ওদের অনুকূলে, কিন্তু তা সত্ত্বেও ভয়ানক আস্তে আস্তে এগোচ্ছে মেঘা। অবশেষে যখন গন্তব্য স্পষ্টভাবে নজরে এল, দিন তখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।
দেখা গেল মোহনার ঠিক ধারে নয় গ্রামটা। একটু ভেতরে, কয়েক কিলোমিটার চওড়া একটা নদীর পাড়ে। ভাটা চলছে বলে এখন পাড়টাকে মনে হচ্ছে আকাশছোঁয়া, বোট থেকে। গ্রামটা চোখেই পড়ছে না। বাঁধের মাথায় শুধু দেখা যাচ্ছে বেশ কয়েকটা জটলা–কিছু লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে, যেন অপেক্ষা করছে মেঘার জন্য। ভটভটিটা কাছাকাছি পৌঁছতে দেখা গেল কয়েকজন নেমে আসছে কাদা ভেঙে, হাত নাড়ছে ওদের উদ্দেশে। জবাবে বোটের রেলিংয়ের ওপর ঝুঁকে পড়ে হাত দুটো মুখের সামনে জড়ো করে এক হাঁক পাড়ল হরেন। খানিক বাদেই দেখা গেল একটা নৌকো সড়সড় করে পাড় বেয়ে নেমে জলে পড়ল, তারপর আস্তে আস্তে এসে থামল মেঘার পাশে। দুটো লোক ছিল নৌকোটায়। একজনকে আলাপ করিয়ে দিল হরেনের আত্মীয় বলে, সামনের গ্রামটাতেই সে থাকে, পেশায় জেলে। আর অন্যজন তার বন্ধু, পার্ট-টাইম মোটর মিস্ত্রি। বেশ খানিকক্ষণ ধরে চলল আলাপ পরিচয়ের পালা, তারপর ওদের দুজনকে নিয়ে হরেন নেমে গেল ভটভটির খোলের ভেতর। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিস্ত্রির যন্ত্রপাতির আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ল গোটা বোটে। হাতুড়ি-বাটালির প্রবল খটখট শব্দের মধ্যে অস্ত গেল সূর্য।
খানিক পরে সন্ধের আবছায়া চিরে হঠাৎ বিকট একটা জান্তব আওয়াজ শোনা গেল; মনে হল প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে কাতর আর্তনাদ করছে কেউ। হাতে টর্চ নিয়ে পিয়া আর কানাই দৌড়ে বেরিয়ে এল নিজের নিজের কেবিন থেকে। দু’জনেরই মাথায় একই চিন্তা। কাউকে নিশ্চয়ই বাঘে ধরেছে, তাই না?” জিজ্ঞেস করল পিয়া।
“জানি না।”
রেলিংয়ের ওপর ঝুঁকে পড়ে চেঁচিয়ে হরেনকে কী একটা জিজ্ঞেস করল কানাই। এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল হাতুড়ির আওয়াজ। তারপরেই খোলের ভেতর থেকে ভেসে এল। হরেনদের অট্টহাসির শব্দ।
“ব্যাপারটা কী?” পিয়া কানাইয়ের দিকে তাকাল।
কানাইয়ের মুখেও হাসি। বলল, “আমি জিজ্ঞেস করলাম কাউকে বাঘে ধরেছে কিনা, তাতে ওরা বলল গাঁয়ে একটা মোষ বাছুর বিয়োচ্ছে, ওটা তারই আওয়াজ।”
“কী করে জানল ওরা?”
“কারণ মোষটার মালিক হরেনের আত্মীয়। বাঁধের একেবারে পাশেই ওদের বাড়ি–ওই দিকটায়।”
পিয়াও হেসে ফেলল এবার। “আমরা মনে হয় খামখাই ঘাবড়ে যাচ্ছি।” দু’ হাতের আঙুলগুলো জড়ো করে লম্বা একটা আড়মোড়া ভাঙল ও। হাই তুলল একবার। “সকাল সকাল শুয়ে পড়তে হবে মনে হচ্ছে।”
“আজকেও?” একটু বিরক্তির আভাস কানাইয়ের গলায়। তারপর, যেন বিরক্ত ভাবটাকে চাপা দেওয়ার জন্যই যোগ করল, “খাওয়া-দাওয়া করবেন না?”
“একটা নিউট্রিশন বার খেয়ে নেব। তাতেই কাল সকাল পর্যন্ত চলে যাবে আমার। কিন্তু আপনার কী প্ল্যান? অনেক রাত পর্যন্ত জাগবেন নাকি?”
“হ্যাঁ, কানাই বলল। “মনুষ্যজগতের অধিকাংশের মতো এই অধমেরও নিশাকালে কিঞ্চিৎ আহার্য গ্রহণের বদভ্যাস আছে। আর, আজকে তারপরেও খানিকক্ষণ জেগে থাকার পরিকল্পনা আছে আমার–মেসোর নোটবইটা আজকেই পড়ে শেষ করব ঠিক করেছি।”
“পড়া কি প্রায় হয়ে এসেছে?”
“হ্যাঁ, শেষের দিকে,” বলল কানাই।