সকাল সকালই শুয়ে পড়েছিল পিয়া। মাঝরাত্রে ঘুমটা চটে গেল হঠাৎ, উঠে বসে পড়ল বাঙ্কের ওপর। কয়েকটা মিনিট ধরে চেষ্টা করল যদি আবার ঘুম আসে। লাভ হল না। হাল ছেড়ে দিয়ে কম্বলটা গায়ে পেঁচিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এল ডেকের উপর। চাঁদের আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে চারদিক। এত ফটফটে জ্যোৎস্না, যে এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে গেল ও, পিটপিট করে সইয়ে নিতে হল চোখ। একটু অবাক হয়ে দেখল কানাইও বসে আছে বাইরে। ছোট একটা কেরোসিন লণ্ঠনের আলোয় কী পড়ছে একমনে। এগিয়ে গিয়ে অন্য চেয়ারটায় বসে পড়ল পিয়া। বলল, “এখনও জেগে? মেশোর নোটবুকটা পড়ছেন বুঝি?”
“হ্যাঁ। পড়া আসলে হয়ে গেছে, আরেকবার উলটে পালটে দেখছিলাম।”
“আমি একটু দেখতে পারি?”
“নিশ্চয়ই।” খাতাটা বন্ধ করে পিয়ার দিকে এগিয়ে দিল কানাই। আলগোছে নোটবইটা নিয়ে খুলে ধরল পিয়া।
“খুব খুদে খুদে লেখা।”
“হ্যাঁ,” বলল কানাই। “পড়া একটু কঠিন।”
“বাংলায় লেখা, তাই না?”
“হ্যাঁ।” সাবধানে খাতাটা বন্ধ করে কানাইকে ফিরিয়ে দিল পিয়া। “কী আছে এর মধ্যে?” মাথা চুলকোল কানাই। নোটবইয়ের বিষয়বস্তু কীভাবে বর্ণনা করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। “কী নিয়ে মানে… নানারকম বিষয় নিয়েই লেখা আছে; বিভিন্ন জায়গার কথা, অনেক সব লোকেদের কথা, এইসব আর কী–”।
“সেসব লোকেদের কাউকে আপনি চেনেন?”
“চিনি। আমাদের ফকিরের মাকে নিয়েও অনেক কথা লেখা আছে এই নোটবইতে। ফকিরের কথাও আছে–তবে মেসো ওকে যখন দেখেছিলেন তখন ও খুবই ছোট।”
বিস্ময়ে চোখ গোল গোল হয়ে গেল পিয়ার। “ফকির আর ওর মা? ওদের কথা কী করে এল?”
“আপনাকে বলেছিলাম না, যে কুসুম–ফকিরের মা–এখানকার একটা দ্বীপে বসতি তৈরির একটা চেষ্টার সঙ্গে জড়িত ছিল?”
“তা বলেছিলেন।”
হাসল কানাই। “মনে হয় নিজের অজান্তেই খানিকটা কুসুমের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন আমার মেসো।”
“তাই লিখেছেন উনি এই খাতায়?”
“না,” জবাব দিল কানাই। “কিন্তু সে উনি লিখতেনও না।”
“কেন?”
“উনি যেরকম ছিলেন, যে যুগের যে জায়গার মানুষ ছিলেন–তাতে এরকম কিছু লেখাটাকে বাঁচালতা মনে করতেন হয়তো,” কানাই বলল।
নিজের ছোট ছোট কেঁকড়া চুলে আঙুল বোলাল পিয়া। “বুঝলাম না ঠিক। আচ্ছা, উনি কী ধরনের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন?”
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল কানাই। প্রশ্নটা ভাবতে সময় নিল একটু। তারপর বলল, “একটা সময় উনি ছিলেন প্রগতিবাদী। এমনকী এখনও যদি আপনি আমার মাসিকে জিজ্ঞেস করেন, মাসি বলবেন মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তুদের সঙ্গে মেসো জড়িয়ে পড়েছিলেন কারণ বিপ্লবের ভূতটাকে উনি মাথা থেকে কখনও তাড়াতে পারেননি।”
“আপনি মনে হচ্ছে মাসির সঙ্গে একমত নন?”
“না,” জবাব দিল কানাই। “আমার মনে হয় মাসির ধারণাটা ভুল। আমার চোখে মেসোর ঘাড়ে যে ভূত ভর করেছিল তা রাজনীতির নয়, শব্দবাক্য-অক্ষরের। কিছু কিছু মানুষ থাকে দেখবেন যারা কবিতার জগতেই জীবন কাটায়। আমার মেসো ছিলেন সেইরকম একজন লোক। মাসির পক্ষে এরকম মানুষকে বুঝে ওঠাটা কঠিন ছিল কিন্তু মেসোর ধরনটাই ছিল ওই। কবিতা পড়তে ভালবাসতেন উনি, বিখ্যাত জার্মান কবি রাইনের মারিয়া রিলকের কবিতা। আমাদের কয়েকজন নামকরা কবি সেসব কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেছেন। রিলকে বলেছিলেন, ‘জীবন যাপিত হয় পরিবর্তনে’, আর আমার মনে হয় কবির এই কথাটা মেসো মর্মে মর্মে গেঁথে নিয়েছিলেন–কাপড় যেমন কালি শুষে নেয়, সেইভাবে। ওঁর কাছে কুসুম ছিল রিলকের সেই পরিবর্তনের ধারণার মূর্ত রূপ।”
“মার্ক্সবাদ আর কবিতা?” ভুরু তুলে শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করল পিয়া। “একটু অদ্ভুত কম্বিনেশন–না?”
“তা ঠিক,” কানাই সায় দিল। “আসলে এই ধরনের পরস্পর বিরোধিতাগুলি ছিল ওঁদের প্রজন্মের বৈশিষ্ট্য। যেমন, মেসোর মতো বস্তুবোধশূন্য মানুষ আমি দুটো দেখিনি, কিন্তু নিজেকে ঐতিহাসিক বস্তুবাদী বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে ভালবাসতেন উনি।”
“তার মানেটা ঠিক কী?”
“ওঁর কাছে তার মানে হল, এ জগতে সমস্ত কিছুই পরস্পর সম্পর্কিত–গাছপালা, আকাশ, জল-হাওয়া, মানুষ-জন, কাব্য-কবিতা, বিজ্ঞান, প্রকৃতি–সবকিছু। খুঁজে খুঁজে তথ্য সংগ্রহ করতেন মেসো সবসময়, অনেক পাখি যেমন চকচকে কিছু দেখলেই চুরি করে নিয়ে গিয়ে বাসায় জড়ো করে, তেমনি। কিন্তু সেসব তথ্য যখন উনি একসঙ্গে গেঁথে তুলতেন, সেগুলো হয়ে উঠত একেকটা গল্প–এক ধরনের কাহিনি।”
হাতের মুঠোয় চিবুকের ভর রেখে বসল পিয়া। “যেমন?”
মিনিট খানেক ভাবল কানাই। “মেসোর বলা একটা গল্প আমার এক্ষুনি মনে পড়ছে–কিছুতেই ভুলতে পারি না আমি গল্পটা।”
“কী নিয়ে সেটা?”
“ক্যানিং-এর কথা মনে আছে আপনার, গঞ্জ মতো যে জায়গাটায় এসে ট্রেন থেকে নামলাম আমরা?”
“কেন মনে থাকবে না?” পিয়া বলল। “ওখানেই তো পারমিটটা পেলাম আমি। আমার অবশ্য জায়গাটাকে খুব একটা স্মরণীয় স্থান বলে মনে হয়নি।”
“ঠিকই বলেছেন,” বলতে লাগল কানাই। “আমি প্রথম ওখানে যাই ১৯৭০ সালে, মেসো আর মাসির সঙ্গে লুসিবাড়ি আসার পথে। জঘন্য লেগেছিল জায়গাটা আমার মনে হয়েছিল বীভৎস কাদা-প্যাঁচপ্যাটে ছোট শহর একটা। সেইরকমই একটা কিছু বোধহয় বলেছিলাম আমি। আর মেসো তো সঙ্গে সঙ্গে খেপে আগুন। প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন আমার ওপর, একটা জায়গা কীরকম সেটা নির্ভর করে তুমি তাকে কীভাবে দেখছ তার ওপর। তারপর একটা গল্প বললেন আমাকে। এমন অদ্ভুত গল্প, যে আমি ভাবলাম সেটা বুঝি তক্ষুনি বানালেন মুখে মুখে। কিন্তু পরে যখন বাড়ি ফিরে গেলাম, সত্যি সত্যিই বইপত্র ঘেঁটে দেখেছিলাম আমি–এক বিন্দুও বানিয়ে বলেননি মেসো।”
“কী ছিল গল্পটা?” জিজ্ঞেস করল পিয়া। “মনে আছে আপনার? আমার শুনতে ইচ্ছে করছে।”
“বেশ। মেসো যেমন যেমন বলেছিলেন সেভাবেই আমি আপনাকে বলার চেষ্টা করছি,” কানাই বলল। “কিন্তু একটা ব্যাপার আপনাকে মনে রাখতে হবে–মেসো গল্পটা বলেছিলেন বাংলায়। আমি কিন্তু মনে মনে অনুবাদ করে সেটা বলব আপনাকে।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, বলুন আপনি।”
আকাশের দিকে তর্জনী তুলে বলতে শুরু করল কানাই: “ঠিক আছে তা হলে বন্ধুগণ, আমি বলছি, তোমরা মন দিয়ে শোনো। আমি এখন তোমাদের বলব মাতলা নদীর কথা, এক ঝড়ে-পাওয়া মাতালের কথা, আর ক্যানিং নামে এক লাটসাহেবের মাতলামির কথা। শোনো, কান পেতে শোনো।
এই ভাটির দেশের অন্য আরও অনেক জায়গার মতোই ক্যানিং-এর নামও দিয়েছিলেন একজন ইংরেজ সাহেব। সে সাহেব আবার যে সে সাহেব নয়, একেবারে লাটসাহেব–ভাইসরয় লর্ড ক্যানিং। এই লাটসাহেব আর তার লেডি দেশজুড়ে যেখানে সেখানে নিজেদের নাম ছড়িয়ে বেড়াতে ভালবাসতেন। তাদের পরবর্তী প্রজন্মের রাজনীতিকরা যেমন নিজেদের ছাই ছড়াতে পছন্দ করতেন, অনেকটা সেইরকম। অদ্ভুত অদ্ভুত সব জায়গার নাম আছে এই সাহেব-মেমের নামে রাস্তার নাম, জেলের নাম, পাগলাগারদের নাম। মজার ব্যাপারও অনেক হত। যেমন, লেডি ক্যানিং ছিলেন লম্বা, রোগা, একটু বদমেজাজি, কিন্তু কলকাতার এক মিঠাইওয়ালার মাথায় কী খেলল কে জানে, নতুন একটা মিষ্টি তৈরি করে তার নাম দিয়ে দিল মেমসাহেবের নামে। সে মিঠাই কিন্তু গোল, কালো আর রসে টইটম্বুর–মানে লেডি ক্যানিং-এর চেহারা কি স্বভাব কোনওটার সঙ্গেই কোনও মিল নেই তার। তবুও কপাল খুলে গেল মিষ্টিওয়ালার। হু হু করে বিক্রি হতে লাগল তার আবিষ্কৃত সেই নতুন মিঠাই। এত পরিমাণে লোকে সে মিষ্টি খেতে লাগল যে ‘লেডি ক্যানিং’–এই পুরো কথাটা উচ্চারণ করতে যে সময় লাগে সে সময়টাও দিতে চাইল না তারা। মুখে মুখে মিষ্টিটার নাম হয়ে দাঁড়াল ‘লেডিগেনি’।
এখন, লোকের মুখে ভাষা এবং শব্দের পরিবর্তনের নিশ্চয়ই নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম আছে। সেই নিয়মে যদি লেডি ক্যানিং হয়ে দাঁড়ায় লেডিগেনি, পোর্ট ক্যানিং-এর নামও তা হলে আস্তে আস্তে পালটে পোটুগেনি বা পোডগেনি হয়ে যাওয়া উচিত ছিল, তাই না? কিন্তু দেখ বন্ধুগণ, এই বন্দর শহরের নাম কিন্তু অপরিবর্তিত রয়ে গেল। এখনও মানুষ ওই লাটসাহেবের নামেই চেনে ক্যানিংকে।
কিন্তু কেন? কেন একজন লাটসাহেব তার সুখের সিংহাসন ছেড়ে এই মাতলার কাদায় এসে নিজের নামের চাষ করতে গেলেন?
মহম্মদ বিন তুঘলকের কথা মনে আছে তো তোমাদের? সেই পাগলা বাদশা, যিনি দিল্লি শহর ছেড়ে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন এক অজ পাড়াগাঁয়? সেই একই ভূতে ধরেছিল বিলিতি সাহেবদেরও। একদিন হঠাৎ ওরা ঠিক করল নতুন একটা বন্দর চালু করতে হবে, বাংলাদেশের একটা নতুন রাজধানীর প্রয়োজন–দ্রুত পলি জমছে কলকাতার হুগলি নদীতে, ওদের তাই মনে হল কলকাতা বন্দরের ডকগুলি আর কিছুদিনের মধ্যেই বুজে যাবে কাদায়। যথারীতি, সব প্ল্যানার আর সার্ভেয়াররা বেরিয়ে পড়ল দলে দলে, পরচুলা আর চাপা পাতলুন পরে চষে বেড়াতে লাগল সারা রাজ্য, মাপজোক আর ম্যাপ তৈরি শুরু হয়ে গেল পুরো দমে। অবশেষে, এই মাতলার তীরে এসে একটা জায়গা পছন্দ হল ওদের। জেলেদের ছোট্ট একটা গ্রাম, তার সামনে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদী, আর সে নদী এমন চওড়া যে দেখলে মনে হয় সোজা সাগর পর্যন্ত বিছানো এক রাজপথ।
এখন, এটা তো সবাই জানে যে বাংলায় মাতলা’ কথাটার মানে মত্ত। আর এ নদীকে যারা চেনে তারা ভালই জানে কেন এর এই নাম। কিন্তু নাম আর শব্দ নিয়ে মাথা ঘামানোর এত সময় কোথায় সেই ইংরেজ টাউন প্ল্যানারদের? সোজা লাটসাহেবের কাছে ফিরে গিয়ে তাঁকে জানাল কী চমৎকার জায়গা একখানা খুঁজে পাওয়া গেছে। শোনাল কেমন বিশাল চওড়া আর গভীর নদী, সোজা গিয়ে মিশেছে সাগরে, তার পাশে কেমন সুন্দর টানা সমতল জায়গা; লাটসাহেবকে তাদের প্ল্যান আর ম্যাপ-ট্যাপ যা যা ছিল দেখাল, সেখানে কী কী বানানোর পরিকল্পনা আছে শোনাল তাঁকে–হোটেল, বেড়ানোর জায়গা, পার্ক, বিরাট বিরাট প্রাসাদ, ব্যাঙ্ক, রাস্তাঘাট আরও কত কী। ওঃ, দারুণ সুন্দর একখানা শহর গড়া যাবে ওই মাতলার তীরে–কোনও কিছুর কোনও অভাব থাকবে না বাংলার সেই নতুন রাজধানীতে।
ঠিকাদারদের ডেকে সব বুঝিয়ে-টুঝিয়ে দেওয়া হল, কাজও শুরু হয়ে গেল চটপট: হাজার হাজার মিস্ত্রি, মহাজন আর ওভারসিয়াররা এসে জড়ো হল মাতলার পাড়ে, শুরু করল খোঁড়াখুঁড়ি। মাতলার জল খেয়ে মাতালের মতো কাজ করতে লাগল তারা, সব বাধা তুচ্ছ করে–এমনকী ১৮৫৭-র বিদ্রোহের সময়ও বন্ধ হল না কাজ। তোমরা যদি তখন এই মাতলার পাড়ে থাকতে বন্ধুগণ, তোমরা জানতেও পারতে না যে উত্তর ভারতে কেমন গ্রাম থেকে গ্রামে খবর চালাচালি হচ্ছে চাপাটির সঙ্গে, মঙ্গল পাণ্ডে কখন বন্দুক ঘুরিয়ে ধরেছে তার অফিসারদের দিকে, কাতারে কাতারে কোথায় খুন হয়ে যাচ্ছে নারী শিশু, কোথায় বিদ্রোহীদের উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে কামানের মুখে বেঁধে। এখানে প্রশান্ত নদীর পারে কাজ চলতে লাগল অবিশ্রাম: বাঁধ তৈরি হল, ভিত খোঁড়া হল, নদীর ধার ঘেঁষে বানানো হল রাস্তা, বসানো হল রেলের লাইন। এবং এই পুরো সময়টা ধরে শান্ত ধীর গতিতে বয়ে চলল মাতলা, অপেক্ষা করে রইল। কিন্তু নদীও সব সময় তার সব গোপন কথা আড়াল করে রাখতে পারে না। এখানে যখন বন্দর তৈরির কাজ চলছিল, ঠিক সেই সময় কলকাতা শহরে বাস করতেন এক ভদ্রলোক, স্বভাব তারও অনেকটা এই মাতলা নদীরই মতো। সামান্য একটা শিপিং ইন্সপেক্টরের চাকরি করতেন তিনি ইংরেজ সাহেব, নাম হেনরি পিডিংটন। ভারতে আসার আগে এই পিডিংটন সাহেব কয়েক বছর কাটিয়েছিলেন ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে। সেখানকারই কোনও এক দ্বীপে থাকার সময় প্রেমে পড়েছিলেন সাহেব। না, কোনও মহিলাকে ভালবাসেননি ভদ্রলোক, এমনকী এরকম নির্জন জায়গায় বেশিদিন কাটালে অনেক সাহেব যেমন পাগলের মতো তাদের কুকুরকে ভালবাসে, সেরকমও কিছু ঘটেনি তার জীবনে। মিস্টার পিডিংটন সেখানে ঝড়ের প্রেমে পড়েছিলেন। ওই সব দ্বীপে সে ঝড়ের নাম ছিল হারিকেন, আর সেই হারিকেনকেই ভীষণ ভালবেসে ফেললেন সাহেব। অনেক লোক যেমন পাহাড় বা আকাশের তারা ভালবাসে, পিডিংটনের ভালবাসা কিন্তু ঠিক সেরকম ছিল না। ঝড় ছিল তার কাছে বইয়ের মতো, সংগীতের মতো। প্রিয় লোক বা : গায়কের প্রতি যেরকম একটা টান থাকে মানুষের, ক্যারিবিয়ানের তুফান ঠিক সেইভাবে টানত সাহেবকে। পিডিংটন ঝড়কে পড়তেন, শুনতেন, বুঝতে চেষ্টা করতেন, ঝড় নিয়ে চর্চা করতেন। ঝড়কে এত ভালবাসতেন উনি যে নতুন একটা নামই তৈরি করে ফেললেন–‘সাইক্লোন’।
এখন, আমাদের কলকাতা পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের মতো অতটা রোমান্টিক জায়গা হতে পারে, কিন্তু পিডিংটন সাহেবের প্রণয়চর্চার জন্য এ শহরও কোনও অংশে খারাপ ছিল না। ঝড়ের ভয়াল রূপের হিসাবে যদি বিচার করা যায়, দেখা যাবে বঙ্গোপসাগরের স্থান অন্য সব সমুদ্রের ওপরে–সে ক্যারিবিয়ান সাগরই হোক, কি দক্ষিণ চিন সমুদ্র। আমাদের এই সাগরের তুফান থেকেই তো ‘টাইফুন’ শব্দটা তৈরি হয়েছে, তাই না?
লাটসাহেবের নতুন বন্দরের কথা একদিন কানে এল পিডিংটনের। ওঁর কিন্তু এতটুকু সময় লাগল না বুঝতে যে কী মত্ততা লুকিয়ে আছে এই নদীর মধ্যে। এই মাতলার পাড়ে দাঁড়িয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে সাহেব বললেন, “ওই সার্ভেয়ারদের তুমি কঁকি দিতে পার, কিন্তু আমার সঙ্গে তোমার ওসব চালাকি খাটবে না। তোমার কী ধান্দা তা আমার জানতে কিছু বাকি নেই। বাকিরাও যাতে জানতে পারে সে ব্যবস্থাও আমি শিগগিরই করছি।”
মনে মনে হাসল মাতলা। বলল, “যাও না, এক্ষুনি যাও। বলো না গিয়ে। তোমাকেই সবাই বলবে মাতলা–বলবে লোকটা নাকি নদী আর ঝড়ের মনের কথা পড়তে পারে।”
কলকাতায় নিজের বাড়িতে বসে একের পর এক চিঠি লিখতে লাগলেন পিডিংটন। প্ল্যানারদের লিখলেন, সার্ভেয়ারদের লিখলেন–কী বিপজ্জনক কাজ তারা করছে বললেন সে কথা; বললেন ভাটির দেশের এত গভীরে শহর গড়ার চিন্তা নিছক পাগলামি বই কিছু নয়; বাদাবন হল সাগরের সঙ্গে লড়ার জন্য বাংলার অস্ত্র, প্রকৃতির প্রচণ্ড আক্রমণ থেকে, দক্ষিণ বাংলাকে আড়াল করে রাখে এই জঙ্গল; ঝড়, ঢেউ, আর জলোচ্ছ্বাসের প্রথম ঝাঁপটাটা এই সুন্দরবনই সামলায়। ভাটির দেশ যদি না থাকত কবে জলের তলায় চলে যেত বাংলার সমতলক্ষেত্র: এই বাদাবনই তো এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছে পশ্চাভূমিকে। কলকাতার দীর্ঘ আঁকাবাঁকা সমুদ্রসড়ক আসলে হল সাগরের তুমুল শক্তির হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। সেই তুলনায় তো এই নতুন বন্দর ভয়ানক অরক্ষিত। কখনও যদি সেরকম জোরালো স্রোত আর হাওয়ার টান ওঠে তা হলে সামান্য একটা ঝড়েই ভেসে যাবে গোটা জায়গাটা–সাইক্লোনের টানে একটা ঢেউ ওঠার শুধু অপেক্ষা। মরিয়া হয়ে পিডিংটন ভাইসরয়কে পর্যন্ত লিখে ফেললেন একটা চিঠি: বিষয়টা আরেকবার ভাল করে ভেবে দেখতে অনুরোধ করলেন, ভবিষ্যদ্বাণীও করলেন–বললেন, সত্যি সত্যি যদি বন্দর তৈরি হয় এই জায়গায়, পনেরো বছরের বেশি সে বন্দর টিকবে না। একদিন আসবে, যখন প্রচণ্ড সাইক্লোনের সঙ্গে আছড়ে পড়বে লোনা জলের বিশাল ঢেউ, ডুবিয়ে দেবে গোটা বসতিটাকে; এর জন্য মানুষ হিসাবে এবং বৈজ্ঞানিক হিসাবে নিজের মানসম্মান পণ রাখতেও তিনি রাজি–লিখলেন পিডিংটন।
খ্যাপা সাহেবের এসব কথায় অবশ্য কেউই কান দিল না; প্ল্যানারদের বা লাটসাহেবের কারওরই এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় ছিল না। কে পিডিংটন? সামান্য একটা শিপিং ইন্সপেক্টর বই তো কেউ নয়। সাহেবদের জাতপাতের হিসেবে একেবারে নীচের দিকে তার স্থান। লোকে ফিসফাস করতে শুরু করল–আসলে মানুষটা একটু খ্যাপাটে তো, মাথায় অল্পবিস্তর গণ্ডগোল থাকাও বিচিত্র নয়। ও-ই তো কিছুদিন আগে বলেছিল না, যে ঝড় হল গিয়ে আসলে এক রকমের ‘আশ্চর্য ধূমকেতু’?
সুতরাং কাজ চলতেই থাকল, বন্দরও তৈরি হয়ে গেল। বাঁধানো রাস্তাঘাট হল, রং-টং করা তকতকে সব হোটেল ঘরবাড়ি হল, মোটকথা যেমন যেমন ভাবা হয়েছিল ঠিক সেইভাবে বানানো হল শহরটাকে। তারপর একদিন খুব হইহল্লা করে ঢাকঢোল বাজিয়ে উৎসব হল, ভাইসরয় পা রাখলেন মাতলার পাড়ে, নতুন বন্দরের নাম দিলেন পোর্ট ক্যানিং।
পিডিংটন সাহেবকে কিন্তু সে উৎসবে যোগ দিতে ডাকা হয়নি। কলকাতার রাস্তায় তাকে দেখা গেলেই এখন লোকজন হাসি তামাশা করে: ওই যে, ওই দেখ রে, মাতাল পিডিংটন বুড়ো যাচ্ছে। ওই লোকটাই তো নতুন বন্দরের কাজ আটকানোর জন্য জ্বালিয়ে মারছিল লাটসাহেবকে। কী একটা যেন ভবিষ্যদ্বাণীও করেছিল না? আবার নাকি মানসম্মান পণ রেখেছিল নিজের?
অপেক্ষা করো, অপেক্ষা করো, বললেন পিডিংটন–পনেরো বছর সময় দিয়েছি আমি। মাতাল সাহেবের ওপর দয়া হল মাতলার। পনেরো বছর তো অনেক লম্বা সময়, এর মধ্যেই যথেষ্ট ভোগান্তি হয়েছে লোকটার। একটা বছর সাহেবকে অপেক্ষা করিয়ে রাখল মাতলা, তারপর আরও এক বছর, তারপর আরও এক। এই করে করে কেটে গেল পাঁচ পাঁচটা বছর। অবশেষে একদিন, ১৮৬৭ সালে, যেন শক্তিপরীক্ষার সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে ফুঁসে উঠল নদী। আছড়ে পড়ল ক্যানিং-এর ওপর। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভেসে গেল শহরটা–কঙ্কালটুকু শুধু পড়ে রইল।
বিশাল কোনও তুফান নয়, পিডিংটন ঠিক যেমনটি বলেছিলেন, সেইরকম সাধারণ একটা ঝড় উঠেছিল। সেই ঝড়ের হাওয়ায় নয়, তার সঙ্গে ওঠা একটা ঢেউয়ে একটা জলোচ্ছ্বাসে–গুঁড়িয়ে গেল গোটা শহর। তার চার বছর পর, ১৮৭১ সালে, অবশেষে পরিত্যক্ত বলে ঘোষণা করা হল বন্দরটাকে। যে বন্দরের একদিন পুব সাগরের রানি হয়ে ওঠার কথা ছিল, টক্কর দেওয়ার কথা ছিল বোম্বাই, সিঙ্গাপুর আর হংকং-এর সঙ্গে, সে এখন হয়ে গেল মাতলার কেনা বাঁদী–ক্যানিং।”
“মেশোর সব গল্পেরই শেষটা কিন্তু সবসময় রাখা থাকত সেই রিলকের জন্য,” কানাই বলল। বুকের ওপর হাত রেখে আবৃত্তি করতে লাগল:
‘তবু, হায়, কী-অদ্ভুত আর্তিপুরে জনপদগুলি…
আহা, দেবদূত, তিনি কেমন পায়ের তলে ধ্বস্ত করে দেবেন ওদের
সান্ত্বনা বাজার, যার এক পাশে তৈরি করা গির্জেটি নগদ মূল্যে
ক্রীত হয়ে, পড়ে আছে হতাশ ও পরিচ্ছন্ন–রুদ্ধ, যেন রবিবারে পোস্টাপিস।’
“বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা,” বলল কানাই। পিয়া ততক্ষণে হাসতে শুরু করেছে। “সেই ১৮৬৭ সালে মাতলা যেদিন লাটসাহেবের সাধের স্বপ্নকে গুঁড়িয়ে দিল, তারপর থেকে এভাবেই রয়ে গেছে ক্যানিং–রবিবারের ডাকঘরের মতো।”