কাঁকড়া

ঠিক দুপুর নাগাদ, জল বেশ খানিকটা বেড়ে ওঠার পর পরিষ্কারই বোঝা গেল আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে শুশুকগুলো। শেষের কয়েকবার মা আর ছানার জুড়িটাকেই শুধু দেখতে পেল পিয়া। জলের ওপর নানারকম সব কসরত দেখাল তারা। সেরকম আগে কখনও বিশেষ দেখেনি পিয়া। প্রথমে পরপর কয়েকবার এমনভাবে ভেসে উঠল যে দুটো ডলফিনেরই পুরো শরীর দেখতে পাওয়া গেল জলের ওপর। ছানাটা দেখা গেল মিটার খানেকের মতো লম্বা আর মা-টা তার দেড়গুণ মতো। একটু পরে ফের দেখা গেল বার দুয়েক। চমৎকার লাগছিল দেখতে। মা আর ছানা মুখ দিয়ে ফোয়ারার মতো জল ছুঁড়ে দিচ্ছে শূন্যে। এই ‘থুতু ছেটানোর’ অভ্যেসটা এ জাতীয় ডলফিনদের একটা বৈশিষ্ট্য–পিয়ার নিজের ধারণা এটা ওরা করে শিকারকে বিভ্রান্ত করার জন্য। এত সুন্দর লাগছিল দেখতে যে ডেটাশিট রেখে ক্যামেরা বের করল পিয়া। মিনিট কয়েক পরেই আশ্চর্য এক কাণ্ড করল ছানা ডলফিনটা একটা মাছকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে আবার লুফে নিল মুখে। শিকার নিয়ে খেলা করাটা এদের বংশের ধারা–এই ওর্কায়েলা-দের জ্ঞাতি খুনে তিমিরও এ স্বভাব আছে। কিন্তু এত বছর নদী-নালায় ঘুরে ঘুরে কাজ করলেও, সব মিলিয়ে মাত্র বার ছয়েক এরকম দৃশ্য চোখে পড়েছে পিয়ার। আর এই প্রথম তার একটা স্পষ্ট ছবি তুলতে পারল ও।

খানিক বাদেই এ দুটো ডলফিনও বেপাত্তা হয়ে গেল। এখন দেখতে হবে সন্ধেবেলা জল নামলে আবার এখানে ফিরে আসে কিনা আঁকটা।

পিয়া যখন নৌকোর আগায় বসে জলের দিকে নজর রাখছিল, ফকির আর টুটুল তখন ডিঙির পেছন দিকটায় বসে খুব ধৈর্য ধরে একগোছা মাছ ধরার সুতোর পরিচর্যা করছিল। সুতোগুলো দেখে প্রথমটায় একটু চিন্তিত হয়েছিল পিয়া, কারণ কিছু কিছু মাছ ধরার সরঞ্জামে ডলফিনদেরও অনেক সময় আটকে পড়তে দেখা গেছে। কিন্তু ভাল করে দেখে বুঝতে পারল ফকিরের সুতোগুলো এতই পলকা, ডলফিনের মতো অত বড় প্রাণীকে তাতে আটকাতে পারবে না। এই নিয়ে তাই আর কোনও উচ্চবাচ্য করেনি ও। এই সামান্য সুতোগুলোতে কিছুই আসে যায় না। মাছেরাও মনে হল একইরকম ভাবছে; সারা সকাল চেষ্টা করে বাপ ব্যাটা কেউই একটা চুনোপুঁটিও ধরে উঠতে পারল না। কিন্তু ওদের দুজনের তাতে দেখা গেল কোনও হেলদোল নেই মনে হল, যা করছে তাই নিয়েই বেশ আছে, অন্তত আপাতত।

কিন্তু ফকির আর টুটুল কখন ফিরতে চাইবে কে জানে। রাত্রে পিয়া আশা করেছিল সূর্য উঠলেই বোধহয় রওয়ানা হবে ওরা। কিন্তু এই ডলফিনগুলো এসেই সব পালটে দিল। এখন তো মনে হচ্ছে অন্তত কাল সকাল পর্যন্ত থাকতে হবে এখানে। সুন্দরবনের এই ডলফিনেরা এখানকার জোয়ার-ভাটার চক্রের সঙ্গে নিজেদের মতো করে খাপ খাইয়ে নিয়েছে কিনা তা বোঝার এটাই একমাত্র উপায় এখন দেখা যাচ্ছে আরও একটা ভাটা আর জোয়ার এখানে অপেক্ষা করে যাওয়া। অবশ্য এরকম হতেই পারে যে এ সমস্তই নিছক ওর কল্পনা, আর সে কল্পনা যদিও বা সত্যি হয় তা হলেও তার সমর্থনে উপযুক্ত তথ্য জোগাড় করে উঠতে বছরের পর বছর কেটে যাবে। এখনকার মতো অন্তত আরও একটু কিছু প্রমাণ চাই পিয়ার, সামান্য কিছু ইঙ্গিত, যাতে অন্তত বোঝা যায় যে ওর চিন্তাটা ঠিক দিকেই এগোচ্ছে। পরের সূর্যোদয়টা পর্যন্ত যদি কোনওভাবে থাকতে পারে এই জায়গাটায়, তা হলেই ওর চলবে।

সময় যত কাটতে লাগল ডলফিনদের ছেড়ে ফকির আর তার ছেলেকে নিয়ে উদ্বেগ বাড়তে থাকল পিয়ার। আর কতক্ষণ ওরা ধৈর্য ধরে থাকতে চাইবে এখানে কে জানে? কী করলে আটকে রাখা যাবে ওদের? পিয়া লক্ষ করছে ওদের ওই মাটির স্টোভটা একবারও জ্বালানো হয়নি আজকে। বাপ ব্যাটা শুধু কয়েকটা শুকনো রুটি খেয়ে আছে সকাল থেকে। ভাল লক্ষণ নয়। তার মানে রসদ ফুরিয়ে আসছে ওদের। অন্য কোনও পরিস্থিতি হলে ও আরও কিছু টাকা অফার করতে পারত ফকিরকে; কিন্তু এক্ষেত্রে সে প্রসঙ্গ তোলা যায় না কারণ সঙ্গে টুটুল আছে। বাবার কিছু বাড়তি পয়সা রোজগার হবে বলে ওইটুকু ছেলে খিদে সহ্য করে বসে থাকবে সেটা আশা করা যায় না। ‘: পিয়ার নিজেরই মিনারেল ওয়াটার কমে এসেছে, কিন্তু ও জানে যেটুকু আছে তা দিয়েই ও চালিয়ে নিতে পারবে। ওদের দুজনের জন্যেই ওর চিন্তা। শেষ পর্যন্ত থাকতে না-পেরে কোনওদিন ও যা করেনি তাই করল: ওর সাবধানে জমিয়ে রাখা নিউট্রিশন বারের প্যাকেট থেকে কয়েকটা বের করে দিতে চাইল ওদের। ফকির নিল না, কিন্তু টুটুল একটা নিয়ে বেশ তারিয়ে তারিয়েই খেল। একটু নিশ্চিন্ত হল পিয়া। সেরকম দরকার হলে আরও কয়েকটা বার দিয়ে দেবে ও তাতে যদি থেকে যায় ওরা তা হলেই পুষিয়ে যাবে ওর। কিন্তু তবুও মনটাকে শান্ত করতে পারছিল না পিয়া। ডেটাশিট ভরতে ভরতে বারবার আড়চোখে চাইছিল ওদের দুজনের দিকে। ওদের প্রতিটি ওঠাবসায় চমকে চমকে উঠছিল ও এই রে! এই বোধহয় ওরা ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করছে।

কিন্তু কেন কে জানে, সেরকম কিছুই হল না শেষ পর্যন্ত। রওয়ানা হওয়ার ব্যাপারে ওদের দু’জনের কারওরই কোনও আগ্রহ দেখা গেল না। দুপুরে সামান্য কিছু শুকনো রুটি মধু দিয়ে খেয়ে বাপ ব্যাটা গিয়ে ছইয়ের ভেতর ঢুকে শুয়ে পড়ল।

আশা-নিরাশার দোলায় পিয়ার টেনশন এদিকে বেড়েই চলেছে। ভাটা পড়া পর্যন্ত এই কয়েকটা ঘণ্টা চুপ করে এক জায়গায় বসে থাকতেই পারছে না ও। শেষে ঠিক করল এই সময়টা নদীর নীচের এই জায়গাটার ম্যাপ তৈরি করবে। সত্যিই ওই ওর্কায়েলা-দের জড়ো হওয়ার মতো কোনও দহ এখানটায় আছে নাকি দেখা যাবে। এ ধরনের ম্যাপ তৈরির কিছু অভিজ্ঞতা ওর আছে, এটুকু জানে যে খুব একটা কঠিনও নয় কাজটা, তবে বেশ ঝামেলার: ডেপ্‌থ সাউন্ডিং করে নদীর নীচ থেকে ফিরে আসা প্রতিধ্বনি মেপে মেপে গভীরতার মাপ কাগজে তুলতে হবে, তারপর সেগুলো জুড়ে জুড়ে নদীগর্ভের ঢালের একটা রেখাচিত্র বানাতে হবে। গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমের সুবিধা থাকায় অবশ্য প্রত্যেকবার শব্দ ক্ষেপণের জায়গার নিখুঁত অবস্থানটা ঠিক করে নেওয়া সহজ, ফলে নিয়মিত জ্যামিতিক বৃত্তচাপ বরাবর ঠিকমতো রিডিংগুলো নেওয়াও খুব একটা কঠিন হবে না।

কিন্তু সমস্যা হল ফকিরকে সেটা বোঝানো যাবে কী করে?

আস্তে আস্তে ছইয়ের সামনে গেল পিয়া, দেখল বেঘোরে ঘুমোচ্ছে ফকির আর তার ছেলে। দু’জনেই পাশ ফিরে শুয়ে আছে, বাবার শরীরের বাঁকের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে টুটুলের ছোট্ট চেহারাটা দেখা যাচ্ছে। ছেলেটা একটু নাদুস-নুদুস, বাপের প্রায় কঙ্কালসার কাঠখোট্টা ভাবের একেবারে উলটো। ফকিরের গায়ে তো খালি হাড়-পাঁজরা আর পাকানো পেশি কয়েকটা। পুরুষের গঠনতন্ত্রের শুধু সারটুকু দিয়ে যেন তৈরি ওর শরীরটা। আচ্ছা, ছেলেটা কি তা হলে বাবার থেকে ভাল খেতে পায়? এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোনও গল্প আছে, সেটা জানতে পারলে বেশ হত। ছেলেটার দেখাশোনা কে করে? কেউ কি নিজে না-খেয়ে রেখে দেয় খাবারটা, যাতে ঠিক মতো খেতে পায় টুটুল?

ঘুমের মধ্যে একসঙ্গে ওঠানামা করছিল দু’জনের বুক। ওদের শ্বাসের ছন্দটা দেখে মা ডলফিন আর ছানাটার কথা মনে পড়ে গেল। এত নিশ্চিন্তে ওদের ঘুমোতে দেখে নিজের মনটাও একটু শান্ত হল পিয়ার–ওর মনের ভেতরের উথাল পাথালের সঙ্গে ওদের এই শান্তির ঘুমের আকাশ পাতাল ফারাক। ফকিরকে জাগানোর জন্য হাতটা বাড়াতে একটু দ্বিধা হচ্ছিল পিয়ার: এই ভরদুপুরের কাঁচা ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলে কি ও বিরক্ত হবে? তারপর যদি বাড়ি ফিরে যেতে চায় তক্ষুনি? পিয়া দেখল ফকিরের কপালের পাশ দিয়ে একটা ঘামের ফোঁটা গড়িয়ে নামছে চোখের কোণের দিকে। কিছু না-ভেবেই একটা আঙুল বাড়িয়ে ঘামটা মুছে দিল ও।

সঙ্গে সঙ্গে জেগে গেল ফকির। উঠে বসল ধড়মড় করে। পিয়ার আঙুলের ডগাটা ওর চামড়ার যে জায়গায় ছুঁয়েছিল সেখানটা ঘষতে লাগল হাত দিয়ে। অপ্রস্তুত হয়ে একটু পিছিয়ে গেল পিয়া। মুখ থেকে বেরিয়ে এল, “আই অ্যাম সরি। আই ডিডন্ট মিন…” নির্লিপ্তভাবে মাথাটা একবার ঝাঁকাল ফকির, তারপর হাত মুঠো করে চোখ কচলাতে লাগল, যেন বাকি ঘুমটুকু ঘষে ঘষে চোখ থেকে মুছে দিতে চাইছে।

“লুক!” পজিশনিং মনিটরটা ফকিরের মুখের সামনে ধরে স্ক্রিনের দিকে ইশারা করল পিয়া। “ওভার হিয়ার।” আশ্চর্য হয়ে দেখল ফকির বুঝতে পারছে ওর বক্তব্য। তারপর পিয়া যখন ওই বিন্দু আর রেখাগুলোর মানে বোঝাতে শুরু করল, মনিটরটার দিকে ঝুঁকে পড়ে মন দিয়ে দেখতে লাগল ফকির।

সবচেয়ে কঠিন সমস্যাটা হল মনিটরের পর্দায় যে ওদের এখনকার অবস্থানটা দেখা যাচ্ছে সেটা কী করে ওকে বোঝাবে পিয়া। বিভিন্ন কিছুর দিকে ইশারা করে বোঝানোর চেষ্টা করল–একবার স্ক্রিনের দিকে, একবার নিজের দিকে, একবার ফকিরের দিকে, একবার ছেলেটার দিকে, কিন্তু কোনও লাভ হল না। পিয়া দেখল ঘাবড়ে যাচ্ছে ফকির, ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না কী করবে। মনে হল ইশারাগুলিতে ও ভেবেছে ওকে কাছে সরে আসতে বলছে পিয়া। পাগল পাগল লাগছিল পিয়ার। কী করে বোঝানো যায় একে! শেষে ঠিক করল অন্য কায়দা করে দেখবে একবার। একটা কাগজ নিয়ে এল পিয়া। ব্যাপারটাকে দ্বিমাত্রিক ক্ষেত্রে নিয়ে এলে হয়তো বোঝানো একটু সহজ হবে। সরল একটা ছবি দিয়ে, বাচ্চারা যেমন কাঠি কাঠি হাত-পাওয়ালা মানুষ আঁকে সেরকম এঁকে ফকিরকে জিনিসটা বোঝানোর চেষ্টা করবে ও। কিন্তু মুশকিল হল, ছবি আঁকাটা পিয়ার কখনওই ঠিক আসে না। অর্ধেকটা এঁকেও হঠাৎ থেমে গেল ও। নতুন একটা সমস্যার কথা মাথায় এল এবার। আগে যখনই এরকম মানুষের ছবি ও এঁকেছে, মহিলা বোঝানোর জন্যে সবসময় কাঠিটার মধ্যে একটা তিনকোণা স্কার্ট এঁকে দিয়েছে। কিন্তু এখানে তো তা করলে চলবে না–এখানে তো পুরুষের পরনে লুঙ্গি আর মহিলার পরনে প্যান্ট। কাগজটাকে দলা পাকিয়ে ফেলল পিয়া। ফেলেই দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু ওর হাত থেকে সেটা প্রায় ছিনিয়ে নিল ফকির, গুছিয়ে রেখে দিল জ্বালানি করবে বলে।

পরের ছবিটা ও শুরু করল জায়গাটার মোটামুটি একটা নকশা দিয়ে। নিজেদের অবস্থানটা দেখানোর আগে প্রথমে নদীর পাড়ের বাকটা এঁকে নিল। দেখা গেল ঠিকই আন্দাজ করেছিল ও, ত্রিমাত্রিক ক্ষেত্র ছেড়ে দুই মাত্রায় আসতেই ফল পাওয়া গেল: ওর নকশাটার সঙ্গে মনিটরের পর্দার লাইনগুলো কীভাবে মিলে যাচ্ছে একবার দেখিয়ে দিতেই জলের মতো সোজা হয়ে গেল বাকিটা। পেনসিলের কয়েকটা আঁচড়েই তারপর ও ফকিরকে বুঝিয়ে দিল কীভাবে মোটামুটি ত্রিভুজাকার একটা বৃত্তচাপের মধ্যে পরপর সমান্তরাল পথে নৌকোটা বেয়ে নিয়ে যেতে হবে ওকে। চাপের শীর্ষবিন্দুটা প্রায় ছুঁয়ে থাকবে নদীর অন্য পাড়টাকে।

পিয়া ভেবেছিল বোধহয় গাঁইগুঁই করবে ফকির, এমনকী হয়তো নাও রাজি হতে পারে। কিন্তু আদৌ সেরকম কিছু ঘটল না। বরং মনে হল বেশ খুশিই হয়েছে ও, এমনকী উৎসাহের চোটে চেঁচিয়ে-মেচিয়ে টুটুলকে পর্যন্ত ঘুম থেকে তুলে দিল। ওই সরলরেখা বরাবর পারাপারের ব্যাপারটাতেই মনে হল ওর বেশি উৎসাহ। কেন, সেটা একটু পরেই বুঝতে পারল পিয়া–যখন তক্তার নীচ থেকে একগোছা মাছ ধরার সুতো বের করে আনল ফকির। বোঝাই যাচ্ছে এই সুযোগে ও কিছু মাছ ধরে নিতে চায়।

কিন্তু মাছ ধরার সুতোটা দেখে একটু ধাঁধা লাগল পিয়ার। এশিয়ার বিভিন্ন নদীতে জেলেদের সঙ্গে ও কাজ করেছে, এরকম কিছু তো কোথাও আগে দেখেনি। একটু মোটা নাইলনের শক্ত সুতো, আর পুরো দৈর্ঘ্য বরাবর মিটার খানেক পরপর একটা করে ওজন বাঁধা ছোট ছোট টুকরো করা টালি কতগুলো। আরও অদ্ভুত যেটা, বঁড়শি-টরশির কোথাও কোনও বালাই নেই। তার বদলে ওজনগুলোর মাঝে মাঝে মাছের শুকনো হাড়কাটা কয়েকটা বাঁধা রয়েছে। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না কী করে কাজ করে জিনিসটা। দেখে তো মনে হচ্ছে যেন ওরা আশা করছে যে মাছেরা নিজের থেকেই এসে আটকে যাবে সুতোটার মধ্যে, আর ওরা শুধু সেটা গুটিয়ে তুলবে। কিন্তু সেরকম কি আদৌ সম্ভব? তা হলে কী ধরবে ওটা দিয়ে? কোনওরকম কোনও ব্যাখ্যাই খুঁজে পেল না পিয়া। তবে একটা ব্যাপার অন্তত পরিষ্কার, ওই সুতোতে ডলফিনদের কোনও ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই। তাই নৌকো যদি ঠিকঠাক পথে চলে তা হলে ওতে আপত্তি করারও কোনও কারণ দেখল না পিয়া।

আবার নৌকোর আগার দিকটায় ফিরে গেল ও, ম্যাপ বানানোর সব প্রস্তুতি করতে শুরু করল। মনিটরটা হাতে নিয়ে ফকিরকে ইশারা করে দেখাল ঠিক কোন জায়গাটা থেকে শুরু করতে হবে। তারপর, টুটুলও মাছ-ধরা সুতোর প্রথম ওজনটা জলে ফেলল, আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ইকো সাউন্ডারটাও ডুবিয়ে দিয়ে বোতাম টিপল পিয়া।

প্রথম দফায় প্রায় কিলোমিটার খানেক যেতে হল ওদের। সবটা সুতোই এর মধ্যে জলে ফেলা হয়ে গেছে টুটুলের। পুরোটা যাওয়ার পর আবার যখন নৌকোর মুখ ফিরিয়ে উলটোদিকে চলতে শুরু করল ওরা, তখন পিয়া আবিষ্কার করল কী করে ওরা ওই সুতোটা দিয়ে। সুতোটা টেনে তোলার সময় দেখা গেল সাত-আটটা টোপ পরপরই একটা করে কাঁকড়া ঝুলছে। শক্ত করে পঁাড়া দিয়ে চেপে ধরে আছে সুতোয় বাঁধা মাছের কাঁটাগুলো। ফকির আর টুটুল একটা জাল দিয়ে কাঁকড়াগুলোকে ছাড়িয়ে আনল, তারপর পাতা দিয়ে ভর্তি একটা পাত্রের মধ্যে রেখে দিল সেগুলোকে। দেখতে দেখতে হাসি পেয়ে গেল পিয়ার। এর থেকেই তা হলে ‘ক্র্যাবি’ কথাটা এসেছে ইংরেজিতে? এত একগুঁয়ে প্রাণীগুলো, ধরা পড়বে তবু খাবার ছাড়বে না।

বার কয়েক যাতায়াতের পরই বোঝা গেল ঠিকই ভেবেছিল পিয়া, নদীর নীচে একটা ঢালু জায়গাতেই এসে জমা হয় ডলফিনগুলো। সাউন্ডিং করে দেখা গেল নদীর খাতটা এই জায়গায় এসে পাঁচ থেকে আট মিটার পর্যন্ত গম্ভীর হয়ে গেছে; ফলে ভাটায় জল নেমে গেলেও ডলফিনরা এখানে এসে স্বচ্ছন্দে কাটাতে পারে সেই সময়টা।

নদীর নীচের এই দহ শুধু যে ডলফিনদের জন্যই উপযুক্ত তা নয়–কঁকড়াদেরও মনে হয় খুবই বাড়বাড়ন্ত এখানে। প্রতিবার যাতায়াতের সময়ই রাশি রাশি কঁকড়া উঠে আসছে ফকিরের সুতোয়। শুরুতে পিয়া ভেবেছিল ওদের দুজনের কাজের বোধহয় ব্যাঘাত ঘটবে–ওর ডেথ সাউন্ডিং-এর ফলে ফকিরের মাছেরা পালিয়ে যাবে অথবা উলটোটা হবে। কিন্তু ও সবিস্ময়ে লক্ষ করল আদৌ সেরকম কিছু ঘটল না। সুতোটা জলে ফেলার জন্য প্রত্যেকবারই একেবারে ঠিক সময়ে নৌকো থামিয়েছে ফকির। ঠিক ওই সময়গুলোতেই পিয়ারও থামার দরকার ছিল সাউন্ডিং নেওয়ার জন্য। তা ছাড়া ফকিরের সুতোটা ঠিকমতো পথপ্রদর্শনের কাজেও সাহায্য করছিল–সুতো বরাবর একেবারে সোজা পথে চলছিল নৌকোটা। আর ফেরার সময়ও প্রতিবারই ঠিক যে জায়গাটা থেকে রওয়ানা হয়েছিল নিঃসন্দিগ্ধভাবে সেখানটাতেই এসে পৌঁছনো যাচ্ছিল আবার। অন্য সময় হলে প্রতিবারই পথ ঠিক রাখার জন্য ওর গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমটা ব্যবহার করতে হত পিয়াকে। কিন্তু এখানে ওই সুতোটা দিয়েই সে কাজ হয়ে যাচ্ছিল। শুধু প্রত্যেকবার পারাপারের সময় বৃত্তচাপ বরাবর আগেরবারের থেকে যাতে ঠিক পাঁচ মিটার দুরে যাত্রা শুরু হয় সেটা ঠিক করার জন্য মনিটরটা কাজে লাগাতে হচ্ছিল। এতে কিন্তু ফকিরেরও লাভ হচ্ছিল, কারণ কখনওই এক জায়গায় দু’বার পড়ছিল না ওর কাঁকড়া-ধরা সুতোটা।

খুবই আশ্চর্যের বিষয় যে এতটুকুও বিরোধ হচ্ছিল না ওদের দুজনের কাজের। আশ্চর্যের এইজন্য যে একজন কাজ করছে ভূসমলয় কক্ষের কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে, আর অন্যজনের কাজের সরঞ্জাম হল কয়েকটা মাছের কাটা আর ভাঙা টালির টুকরো। কিন্তু দু’জন একেবারে দু’রকমের মানুষ, যারা পরস্পরের সঙ্গে একটা বাক্যও বিনিময় করতে পারে না, একজন কী ভাবছে অন্যজনের সেটা জানা বা বোঝার কোনও উপায়ই নেই, তারা যে একই সঙ্গে নির্বিবাদে নিজের নিজের কাজ করে যাচ্ছে, সেটা মনে হল আরও বিস্ময়কর–যেন প্রায় দৈবঘটিত। ব্যাপারটাতে শুধু যে পিয়াই আশ্চর্য হয়েছে তা নয়, একবার হঠাৎ করে ফকিরের চোখে চোখ পড়ায় ওর মুখের ভাবেও বোঝা গেল বেশ অদ্ভুত লাগছে ওর। দু’জনের উদ্দেশ্য এবং তৃপ্তির এরকম স্বচ্ছন্দ মিশ্রণ কী করে সম্ভব হল সেটা ও যেন বুঝে উঠতে পারছে না।

কঁকড়ার পাত্রটা ভর্তি হয়ে যাওয়ার পর সেটার মুখটা একটা অ্যালুমিনিয়ামের প্লেট দিয়ে ঢেকে কাঁকড়াগুলোকে নৌকোর খোলের মধ্যে ঢেলে দেওয়ার জন্য পিয়ার হাতে দিল ফকির। ঢাকনা ফাঁক করে পিয়া দেখল ভেতর থেকে গোটা পনেরো কঁকড়া কটমট করে ওর দিকে চেয়ে দাঁড়া শানাচ্ছে। ডিঙির খোলের মধ্যে পাত্রটা উলটে দিতে হুড়মুড় করে একটা লম্বা শেকলের মতো বেরিয়ে এল কাঁকড়াগুলো, প্রচণ্ড রেগে খটখট আওয়াজ করতে করতে ঢুকে গেল তক্তার নীচে। কাঁকড়াদের এই অভাবনীয় মুখরতায় হাসি পেয়ে গেল পিয়ার। ওর জন্ম হয়েছিল জুলাই মাসে। মাঝে মাঝেই ওর তাই মনে হয়েছে এত প্রাণী থাকতে প্রাচীনকালের লোকেরা কাঁকড়াকে কেন রাশিচক্রের মধ্যে ঢুকিয়েছিল। কিন্তু এখন এই কঁকড়াগুলোকে তড়বড় করে নৌকোর খোলের মধ্যে ঢুকে যেতে দেখতে দেখতে পিয়ার মনে হল প্রাণীগুলোর বিষয়ে আরও কিছু জানা থাকলে বেশ হত। মনে পড়ল একবার একটা ক্লাসে ওদের এক অধ্যাপক দেখিয়েছিলেন কিছু প্রজাতির কাঁকড়া কীভাবে তাদের বাসার কাদাটা সত্যি সত্যি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে কাদার প্রতিটা দানা ওরা সাফ করে ঘষে ঘষে। ওই কঁকড়াদের পায়ে এবং শরীরের ধার বরাবর সূক্ষ্ম লোমের আবরণ থাকে। সেই লোমগুলোই আণুবীক্ষণিক বুরুশ আর চামচের মতো কাজ করে। ওগুলো দিয়েই কাদার সূক্ষ্ম কণার গায়ে লেগে থাকা ক্ষুদে শ্যাওলা আর অন্যান্য সব খাদ্যবস্তু চেঁছে তোলে ওরা। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যবিভাগ এবং পরিচ্ছন্নতা দপ্তরের কাজ করে এই কাঁকড়ারা–বাদাবনের পচা পাতা, জঞ্জাল সাফ করে ওরাই বাঁচিয়ে রাখে বনকে। ওরা না-থাকলে তো নিজেদের আবর্জনার চাপেই দমবন্ধ হয়ে মারা পড়ত জঙ্গলের সব গাছ। বাদাবনের জৈবতন্ত্রের একটা বিরাট অংশই যে এই কঁকড়ারা, সেটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে? ডালপাতা সমেত সমস্ত গাছের তুলনায়ও যে একটা বাদাবনে কাঁকড়াদের গুরুত্ব বেশি সেটা তো সত্যি? কেউ একজন তো বলেইছিলেন যে ম্যানগ্রোভের বদলে এই ধরনের নদীমুখের জঙ্গলগুলির নাম কঁকড়াদের নামেই হওয়া উচিত। কারণ বাঘ বা কুমির বা ডলফিন নয়, এই কঁকড়ারাই হল গোটা বাদাবনের জৈবতন্ত্রের মূল ধারক।

এতদিন পর্যন্ত এই সমস্ত বিষয়ে যখনই ভেবেছে পিয়া–এই জৈবতন্ত্র, মূল প্রজাতি এইসব–সবসময়েই নিজেকে তার বাইরে রেখে, অন্যান্য সমস্ত কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে ভেবেছে। সংক্ষেপে, প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে ভেবেছে–কারণ কে বলেছে যে মনুষ্যসৃষ্ট সমস্ত কিছুকে বাদ দিয়ে যা বাকি থাকে তাই হল ‘প্রকৃতি’? কিন্তু আজকে যে ও এখানে এসেছে সে তো নিজের ইচ্ছায় আসেনি; এই কঁকড়াদের জন্যই এসেছে। কারণ এরাই হল ফকিরের জীবিকা, আর এরা–থাকলে ফকির জানতেও পারত না কোথায় কোন নদীর দহে এই ওর্কায়েলাশুশুকেরা আসে। হয়তো ঠিকই করেছিল সেই প্রাচীনকালের লোকেরা। হয়তো আসলে পিয়ার নিয়তির জোয়ার ভাটার দিক নির্দেশ করছে এই কাঁকড়ারাই। কে বলতে পারে!