চিঠি

গেস্ট হাউসটা দোতলায়। পুরো দোতলাটা জুড়েই। সরু একটা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। সব মিলিয়ে চারটে ঘর, হুবহু এক ভাবে সাজানো–দুটো সিঙ্গল খাট, একটা ডেস্ক আর-একটা চেয়ার। ঘরগুলোর সামনে দিয়ে টানা একটা জায়গা। তার খানিকটা বারান্দা, খানিকটা ডাইনিং রুম, আর একদিকে রান্না-বান্নার ব্যবস্থা। বারান্দার শেষপ্রান্তে একটা বাথরুম, শাওয়ার লাগানো। গোটা বাড়িটায় এটুকুই যা বিলাসিতার ছোঁয়া। বাথরুমটা দেখে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল কানাই। পুকুরে গিয়ে স্নান করতে হবে ভেবে ও একটু ভয়ে ভয়েই ছিল এতক্ষণ।

ডাইনিং টেবিলের ওপর ঝকঝকে স্টেনলেস স্টিলের একটা টিফিন ক্যারিয়ার। ওর রাতের খাবার, কানাই আন্দাজ করল। নিজের সংসারের সব দুশ্চিন্তা সত্ত্বেও ময়না খাবারটা রেখে যেতে ভোলেনি। ঘুরে ফিরে দেখে একটা ঘরে ওর সুটকেসটা রাখল কানাই। ওরই জন্যে মনে হয় গুছিয়ে গাছিয়ে রাখা হয়েছে ঘরটা। তারপর ধীরে সুস্থে সিঁড়ির দিকে এগোল।

ছাদের ওপর উঠে এসে চোখ জুড়িয়ে গেল কানাইয়ের। সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সারা আকাশ লালে লাল। ভাটা পড়ে গেছে অনেকক্ষণ, দ্বীপগুলো জলের অনেক ওপরে মাথা তুলে জেগে রয়েছে। নীচে নদীর জলেও যেন লাল আবির ছড়িয়ে রয়েছে। ছাদটায় এক চক্কর মেরে কানাই দেখল এদিকে ওদিকে সব মিলিয়ে অন্তত গোটা ছয়েক দ্বীপ দেখা যাচ্ছে কাছাকাছি। আর আটটা নদী’। লুসিবাড়ির দক্ষিণে আর কোনও দ্বীপেই জনবসতি নেই। খেত-জমি বাড়ি-ঘরেরও তাই কোনও চিহ্ন নেই। গভীর ম্যানগ্রোভের জঙ্গলে ঢাকা দ্বীপগুলো।

ছাদের একধারে একটা লম্বাটে টিনের চালাঘর। দরজায় তালা আঁটা। এটাই তা হলে মেশোর পড়াশোনার ঘর ছিল। নীলিমার দেওয়া চাবিটা দিয়ে তালাটা খুলল কানাই। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল। মুখোমুখি উলটোদিকের দেওয়াল ভর্তি তাক, কাগজ আর বইপত্রে ঠাসা। একটাই মাত্র জানালা ঘরটার পশ্চিম দিকে। সেটা খুলে দিল কানাই। এখান থেকে রায়মঙ্গলের মোহনাটা দেখা যায়। জানালার ঠিক নীচে ডেস্ক। তার ওপর একটা দোয়াত, কয়েকটা কালির কলম, একটা পুরনো ধাঁচের অর্ধগোলাকার ব্লটার সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা। মনে হচ্ছে যেন কাছেই কোথাও গেছে নির্মল, একটু পরেই ফিরে এসে কাজে বসবে। ব্লটারটার নীচে বেশ বড়সড় একটা বন্ধ খাম, কানাইয়ের নাম লেখা। খামটা কয়েকপ্রস্থ প্লাস্টিকে মোড়া। সেগুলোকে আবার গঁদের আঠা দিয়ে জোড়া হয়েছে। তার ওপর বোধহয় কোনও নোটবই থেকে ছেঁড়া টুকরো একটা কাগজে কুড়ি বছর আগের নির্মলের হাতে লেখা কানাইয়ের নাম ঠিকানা। দু’আঙুলে চাপ দিয়ে বুঝতে পারল না কানাই ভেতরে কী আছে। কী করে প্যাকেটটা খোলা যাবে সেটাও কিছু বোঝা গেল না। প্লাস্টিকের পরতগুলো একেবারে গায়ে গায়ে সেঁটে গেছে মনে হচ্ছে। চারদিকে তাকিয়ে জানালার তাকের ওপর আধখানা দাড়ি কামানোর ব্লেড দেখতে পেল কানাই। সেটা নিয়ে এসে সাবধানে খামটার একদিকে কাটতে শুরু করল। বেশ কয়েক পরত কেটে ফেলার পর প্যাকেটটার ভেতরের বস্তুটা নজরে এল। একটা বাঁধানো খাতা। পাখির বাসার মধ্যে ডিমের মতো সযত্নে রাখা। একটু আশ্চর্য হল কানাই। ও ভেবেছিল হয়তো এক গোছা খোলা পাতা থাকবে, কবিতা বা প্রবন্ধ লেখা। একটা গোটা বাঁধানো খাতা ঠিক আশা করেনি। কয়েকটা পাতা উলটে পালটে দেখল। ঘন করে বাংলায় লেখা। জায়গা বাঁচানোর জন্য এত ছোট ছোট করে লেখা হয়েছে যে প্রায় গায়ে গায়ে লেগে গেছে লাইনগুলো। হাতের লেখাও ট্যারাবাকা, দেখেই মনে হয় খুব তাড়াহুড়ো করে লেখা হয়েছে। কাটাকুটিতে ভর্তি সমস্ত খাতাটা, একেকটা লাইন মার্জিনের বাইরে বেরিয়ে পড়েছে। এতগুলি প্লাস্টিকের মোড়কের মধ্যে রাখা সত্ত্বেও ছোপ ছোপ ড্যাম্প ধরে গেছে মাঝে মাঝে। কয়েক জায়গায় তো লেখা এমন ঝাপসা হয়ে গেছে যে প্রায় পড়াই যায় না।

লেখাটার প্রথম কয়েকটা শব্দ খুবই অস্পষ্ট। খাতাটা প্রায় নাকের কাছে নিয়ে এসে সেগুলো পাঠোদ্ধার করতে হল। প্রথম পাতার একেবারে ওপরে বাঁদিকে তারিখ আর সময় ইংরাজিতে লেখা : May 15, 1979, 5.30 a.m. তার ঠিক নীচে কানাইয়ের নাম। বিশেষ কোনও সম্ভাষণ দিয়ে শুরু না হলেও, পড়তে শুরু করলেই বোঝা যায় এটা আসলে কানাইয়ের জন্যই লেখা লম্বা একটা চিঠি।

প্রথম কয়েকটা লাইন পড়তেই সে ব্যাপারে নিঃসন্দিগ্ধ হয়ে গেল কানাই : “এ লেখাটা আমি এমন একটা জায়গায় বসে লিখছি যে জায়গার নাম তুমি হয়তো শোনেইনি। ভাটির দেশের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তের এই দ্বীপের নাম মরিচঝাঁপি..”

খাতা থেকে মুখ তুলে নামটা নিয়ে মনের মধ্যে কয়েকবার নাড়াচাড়া করল কানাই। অভ্যাসের বশেই প্রায় শব্দটার একটা মানেও চলে এল মনে : ‘লঙ্কার দ্বীপ।

আবার খাতার দিকে মন দিল ও :

“ঘড়ির কাটা যেন আর ঘুরতেই চাইছে না। অজানা এক ভয়ংকরের আশঙ্কায় কাটছে প্রতিটা মুহূর্ত। মনে হচ্ছে যেন খানিক বাদেই এসে আছড়ে পড়বে প্রচণ্ড সাইক্লোন, আমরা সবাই যেন তার অপেক্ষায় গুটিসুটি মেরে ঘরের ভেতরে বসে আছি। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। একেকটা সেকেন্ড মনে হচ্ছে একেকটা যুগ। বাতাসও যেন গম্ভীর, স্থির হয়ে আছে। সময় যেন নিথর হয়ে গেছে ভয়ের ধাক্কায়।

অন্য কোনও পরিস্থিতিতে হলে হয়তো এরকম ক্ষেত্রে আমি কিছু একটা পড়ার চেষ্টা করতাম। কিন্তু এখন এই খাতা, ডটপেন আর রিলকের দুইনো এলিজির ইংরাজি আর বাংলা অনুবাদগুলো ছাড়া আর কিছুই নেই আমার সঙ্গে। এমনিতেও অবশ্য খানিকক্ষণ আগে পর্যন্ত কিছুই পড়া সম্ভব ছিল না। কারণ এইমাত্র ভোরের আলো ফুটছে, আর আমি বসে আছি একটা ঘঁচের বেড়ার ঘরে, যেখানে একটা মোমবাতি পর্যন্ত নেই। ছাঁচের বেড়ার ফাঁক দিয়ে সামনে গারল নদী দেখা যাচ্ছে। সবে মাত্র সূর্য উঠতে শুরু করেছে, আর তার সঙ্গে যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নদীর জল। জোয়ার আসছে। আশেপাশের দ্বীপগুলো তলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। খানিক পরেই মেরু সমুদ্রের আইসবার্গের মতো ওগুলোর বেশিরভাগটাই চলে যাবে জলের নীচে। শুধু সবচেয়ে উঁচু গাছের চুড়াগুলো জেগে থাকবে নদীর ওপর। এখনই দ্বীপের ধারের চর আর জালের মতো ঠেসমূলগুলোর ওপর দিয়ে জল বয়ে যাচ্ছে–শেকড়-বাকরগুলি জলের নীচে কেমন একটা ঝাপসা ভূতুড়ে চেহারা নিয়েছে মনে হচ্ছে যেন ওগুলো কোনও সামুদ্রিক আগাছা, থিরথির করে কাঁপছে স্রোতের টানে। একটু দূরে একঝাক বক উড়ে যাচ্ছে জলের ঠিক ওপর দিয়ে। জোয়ার আসছে, তাই ডুবন্ত দ্বীপগুলোর থেকে দূরে কোনও নিশ্চিন্ত আস্তানার খোঁজে যাচ্ছে ওরা। ভোর হচ্ছে, ভাটির দেশের মিষ্টি সুন্দর ভোর।

যে ঘরটায় আমি এখন বসে আছি সেটা আসলে আমার ঘর নয়। আমি এখানে অতিথি। এ ঘরের মালকিনকে তুমি চেন–কুসুম। প্রায় বছরখানেক হল ও ছেলেকে নিয়ে এখানে আছে। আচ্ছা, এই এক বছর রোজই তো ঘুম ভেঙে উঠে ওরা এই রকম ভোর দেখেছে–কুসুম আর ফকির। কেমন লেগেছে ওদের? ওদের প্রতিদিনের জীবন-যাপনের যন্ত্রণায় কতটুকু শান্তির প্রলেপ দিতে পেরেছে এই ভোর? কে বলতে পারে? এখন, এই অন্তহীন অপেক্ষার সময়, আমার শুধু কবির কথাগুলোই মনে পড়ছে:

‘সৌন্দর্য আর-কিছু নয়,

শুধু সেই আতঙ্কের আরম্ভ, যা অতি কষ্টে আমাদের পক্ষে নয়

এখনো অসহনীয়। আরাধ্য সে আমাদের, যেহেতু সে শান্ত উপেক্ষায়

তার সাধ্য সংহার হানে না।’

কাল সারারাত ধরে আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছি, কাকে ভয় পাচ্ছি আমি? কীসের ভয়? আজ, এই সূর্যোদয়ের সময় আমি সে প্রশ্নের উত্তর পেলাম। আমি ভয় পাচ্ছি কারণ আমি জানি এই ঝড় কেটে গেলে তার আগের কথা কেউ আর মনে রাখবে না। এই ভাটির দেশের পলি কত তাড়াতাড়ি অতীতকে ঢেকে দেয় তা আমার চেয়ে ভাল তো আর কেউ জানে না।

যে অনাগত ভয়ংকরের অপেক্ষায় আমরা এখানে প্রহর গুনছি, তাকে বাধা দেওয়ার মতো শক্তি আমার নেই। কিন্তু এক সময় তো আমি সাহিত্যচর্চা করেছি। যা এখানে ঘটছে, ঘটতে চলেছে, তার কিছুটা তো আমি লিখে রেখে যেতে পারি। একটু তো অন্তত দাগ রেখে যেতে পারি মহাকালের স্মৃতির পাতায়। এই ভাবনা আর এই ভয়ই আমাকে দিয়ে আজ এক অসাধ্য সাধন করিয়ে নিল–তিরিশ বছর পর কলম ধরিয়ে ছাড়ল আমাকে।

জানি না কতটা সময় আমার হাতে আছে। হয়তো শুধু আজকের দিনটাই। তার মধ্যেই আমি চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব লিখে রেখে যেতে যদি কোনওদিন তোমার হাতে গিয়ে পৌঁছয় এ লেখা। তুমি হয়তো ভাববে, এত লোক থাকতে তোমার জন্যই কেন লিখছি। কারণ হিসাবে এটুকুই আমি বলতে পারি যে এ গল্প আসলে আমার গল্প নয়। যাকে নিয়ে এই লেখা, লুসিবাড়িতে থাকার দিনগুলিতে সেই ছিল তোমার একমাত্র সঙ্গী। সে হল কুসুম। আমার জন্য না হলেও, কুসুমের কথা মনে করে অন্তত লেখাটা পড়ো।”