রূপান্তর
হরেন যদি না থাকত, আবার হয়তো আমি আমার পুরনো অভ্যাসের চক্রেই ফিরে যেতাম; প্রবল ভালবাসায় যে অভ্যাসগুলো আঁকড়ে ধরে থাকে আমাকে, ছেড়ে যেতে চায় না কিছুতেই, তাদের মধ্যে থেকেই হয়তো সুখে কাটিয়ে দিতাম বাকি দিনগুলি। কিন্তু একদিন ঠিক খুঁজতে খুঁজতে এসে উপস্থিত হল হরেন। বলল, “সার, পৌষমাস তো শেষ হয়ে এল। বনবিবির পুজো তো এসেই গেল প্রায়। কুসুম আর ফকির একদিন গর্জনতলা যাবে বলছিল, তো আমি বলেছি ওদের নিয়ে যাব। কুসুম বলল আপনাকে একবার জিজ্ঞেস করতে, যদি যান।”
“গর্জনতলা? সেটা আবার কোথায়?”
“জঙ্গলের অনেক ভেতরে। ছোট একটা দ্বীপ। কুসুমের বাবা সেখানে বনবিবির একটা মন্দির বানিয়েছিল, তাই ও একবার যেতে চায় ওখানে।”
এ আরেক নতুন সমস্যা। এর আগে সব সময়ই যে-কোনও ধর্মীয় ব্যাপার থেকে আমি সাবধানে দূরে সরে থেকেছি। তা যে শুধু ধর্ম বিশ্বাসকে ভ্রান্ত চেতনা বলে মনে করি সে জন্যই নয়, সেই বিশ্বাস কত ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে দেশ বিভাগের সময় সেটা নিজের চোখে দেখেছি বলেও বটে। আর হেডমাস্টার হিসেবেও আমার মনে হয়েছে, হিন্দুই বল বা মুসলমানই বল, কোনও ধর্মের সঙ্গেই না জড়ানোটা আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। একটু আশ্চর্যের মনে হলেও, সেই কারণেই কখনও বনবিবির পুজো দেখিনি আমি, আর এই দেবীটি সম্পর্কে কোনও আগ্রহও কখনও হয়নি আমার। কিন্তু এখন তো আমি আর হেডমাস্টার নেই, কাজেই সেই নিয়মটাও আর খাটে না।
কিন্তু নীলিমা যে বারণ করে গেল, তার কী হবে? ও যে বার বার করে আমাকে মরিচঝাঁপি থেকে দূরে সরে থাকতে অনুরোধ করে গেল? নিজেকে বোঝালাম, এর সঙ্গে তো সেভাবে দেখতে গেলে মরিচঝাঁপির কোনও সম্পর্ক নেই, কারণ আমরা তো যাচ্ছি অন্য একটা দ্বীপে। “ঠিক আছে হরেন, আমি যাব গর্জনতলা। কিন্তু মনে রেখো, মাসিমার কানে যেন একটা কথাও না যায়।”
“সে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন সার।”
পরদিন ভোরবেলা হরেন এল, আর আমরা বেরিয়ে পড়লাম।
শেষ যেবার মরিচঝাঁপি এসেছিলাম তারপর কয়েকমাস কেটে গেছে। সেখানে পৌঁছতেই চোখে পড়ল অনেক পরিবর্তন হয়েছে এর মধ্যে : আগের সেই উদ্দীপনা কেটে গেছে, একটা ভীতি আর সন্দেহর পরিবেশ যেন চেপে ধরেছে দ্বীপটাকে। একটা কাঠের ওয়াচ টাওয়ার বানানো হয়েছে, উদ্বাস্তুরা ছোট ছোট দলে নদীর পাড় ধরে ঘুরে ঘুরে পাহারা দিচ্ছে। নৌকো পাড়ে ভিড়তেই বেশ কয়েকজন লোক এসে ঘিরে ধরল আমাদের। তারপর নানা জেরা। আপনাদের পরিচয় কী? কী দরকারে এসেছেন এখানে?
একটু অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যেই গিয়ে পৌঁছলাম কুসুমের কুঁড়েতে। দেখলাম ও-ও একটু মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছে। বলল কয়েক সপ্তাহ ধরেই নানাভাবে আরও চাপ দিতে শুরু করেছে সরকার। কয়েক জন অফিসার, পুলিশের লোকজন ঘুরে গেছে এর মধ্যে। দ্বীপ ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্বাস্তুদের প্রথমে নানা রকম লোভ দেখিয়েছে। তাতে কাজ না হওয়ায় তারপর সরাসরি হুমকি দিয়েছে। যদিও হটেনি উদ্বাস্তুরা, কিন্তু একটা ভীতির পরিবেশ তৈরি হয়েছে : কেউ জানে না কী হবে এবার।
বেলা হয়ে গিয়েছিল, তাই পা চালিয়ে চললাম আমরা। কুসুম আর ফকির বনবিবি এবং তার ভাই শা জঙ্গলির ছোট ছোট মূর্তি গড়ে এনেছিল মাটি দিয়ে, সেগুলিকে হরেনের নৌকোয় তোলা হল। তারপর দ্বীপ ছেড়ে রওয়ানা হলাম আমরা।
নদীতে বেরিয়ে পড়বার পর স্রোতের টানে সবার মেজাজ ভাল হয়ে গেল। চারপাশে আরও অনেক নৌকো দেখতে পেলাম, সবাই কোথাও না কোথাও যাচ্ছে। পুজো দিতে। কয়েকটা নৌকোয় দেখলাম কুড়ি-ত্রিশজন পর্যন্ত লোক আছে। সুন্দর রং করা বনবিবি আর শা জঙ্গলির বিশাল বিশাল মূর্তি নিয়ে যাচ্ছে তারা, সঙ্গে গানের লোকজন আর ঢাকঢোলও আছে দেখলাম।
আমাদের নৌকোয় শুধু আমরা চারজন–হরেন, ফকির, কুসুম আর আমি।
“তোমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে এলে না কেন হরেন? তারা সব কোথায়?” জিজ্ঞেস করলাম আমি।
“ওরা সব আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেদের সঙ্গে গেছে,” কেমন একটু মিনমিন করে জবাব দিল হরেন। “ওদের নৌকোটা বড়।”
একটা মোহনায় এসে পৌঁছলাম আমরা। মোহনা পেরোতে পেরোতে লক্ষ করলাম কোনও মন্দির অথবা ঠাকুর দেবতার মূর্তি-টুর্তির সামনে এলে মানুষ যেমন করে, হরেন আর কুসুম সেই রকম ভক্তিভরে বারবার নমস্কার করছে। ফকির দেখলাম খুব মন দিয়ে লক্ষ করছে, আর ওদের দেখাদেখি ও-ও হাতদুটো একবার কপালে ঠেকাচ্ছে, আরেকবার বুকের কাছে নিয়ে আসছে।
“কী ব্যাপার বল তো?” একটু আশ্চর্য হয়েই জিজ্ঞেস করলাম আমি। “কী দেখতে পেলে তোমরা? এখানে তো কোনও মন্দির-টন্দির নেই? আমি তো চারিদিকে জল ছাড়া আর কিছু দেখছি না।”
হেসে উঠল কুসুম। প্রথমে তো কিছুতেই বলবে না, তারপর একটু সাধাসাধি করতে শেষে বলল, ভাটির দেশকে ভাগ করার জন্য বনবিবি যে গণ্ডী টেনে দিয়েছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে, ওই মাঝ-মোহনায় আমরা সেই গণ্ডী পেরোলাম। অর্থাৎ মানুষদের জগৎ আর দক্ষিণরায় এবং তার চেলা চামুণ্ডা সব দৈত্য দানবদের জগতের মাঝের সীমানাটা পেরিয়ে এলাম আমরা। ভেবে একটু শিউরে উঠলাম যে আমার কাছে একটা সত্যিকারের কাটাতারের বেড়া যেরকম, কুসুম আর হরেনের কাছে এই কাল্পনিক রেখা ঠিক সেরকমই বাস্তব।
আমার চোখেও এখন যেন চারিদিকের দৃশ্য সব নতুন ঠেকতে লাগল–সবকিছুই মনে হতে লাগল অপ্রত্যাশিত, বিস্ময়কর। সময় কাটানোর জন্য একটা বই নিয়েছিলাম সঙ্গে, কিন্তু এখন মনে হল একদিক থেকে দেখতে গেলে তো এই ভূদৃশ্যের সঙ্গে বইয়ের খুব একটা তফাত নেই–এও তো ঠিক সেই পর পর সাজানো পাতার মতো, কিন্তু একটা পাতা আরেকটার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই বই মানুষ খোলে নিজের নিজের রুচি এবং শিক্ষা, স্মৃতি এবং সাধ অনুযায়ী : একজন ভূতাত্ত্বিকের চোখের সামনে তার এক রকম পাতা খুলে যায়, নৌকোর মাঝি দেখতে পায় অন্য এক পাতা, জাহাজের পথপ্রদর্শক বা শিল্পীর জন্যেও সে রকম আলাদা আলাদা পাতা রয়েছে এ বইয়ে। কখনও কখনও সে পাতার লাইনগুলির নীচে দাগ টানা থাকে, যে দাগ কিছু মানুষ দেখতেই পায় না, আবার কিছু মানুষের কাছে সে দাগ প্রত্যক্ষ বাস্তব, বৈদ্যুতিক তারের মতোই মারাত্মক।
আমার মতো একজন শহুরে লোকের কাছে এই ভাটির দেশের জঙ্গল ছিল শুধুমাত্র এক শূন্যতা, যেখানে সময় স্থির হয়ে আছে। এখন আমি বুঝতে পারলাম, সে ছিল আমার চোখের ভুল। আসল ঘটনা ঠিক তার উলটো। সময়ের চাকা এখানে এত দ্রুত ঘুরছে যে তা চোখে দেখাই যায় না। অন্য জায়গায় একটা নদীর গতিপথ বদলাতে কয়েক দশক লাগে, কখনও কখনও কয়েকশো বছর পর্যন্ত লেগে যায়; এক যুগ লেগে যায় একটা দ্বীপ গড়ে উঠতে। কিন্তু পরিবর্তনই হল ভাটির দেশের ধর্ম। এক এক সপ্তাহে এখানে নদীর খাত বদলায়, দিনে দিনে গড়ে ওঠে বা মিলিয়ে যায় গোটা দ্বীপ। অন্য জায়গায় নতুন করে একটা জঙ্গল তৈরি হতে কয়েক শতক, এমনকী কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত লেগে যায়, কিন্তু এখানে মাত্র দশ কি পনেরো বছরে নেড়া একটা দ্বীপ ঢেকে যায় ঘন বাদাবনে। এরকম কি হতে পারে, যে পৃথিবীর ছন্দটাই অনেক দ্রুত হয়ে গেছে এখানে এসে? আর সেইজন্যই এত তাড়াতাড়ি এখানে ঘটছে সমস্ত কিছু?
রয়্যাল জেমস অ্যান্ড মেরি নামের সেই বিলিতি জাহাজের কথা মনে পড়ে গেল আমার। ১৬৯৪ সালে সেই জাহাজ এই ভাটির দেশের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। রাতের অন্ধকারে এক চড়ায় ধাক্কা খেয়ে বহু মাস্তুলবিশিষ্ট সেই বিশাল সমুদ্রপোত তলিয়ে গেল জলে। ক্যারিবিয়ান সাগর কি ভূমধ্যসাগরের শান্ত জলে যদি এই দুর্ঘটনা ঘটত, তা হলে কী হত? সাগরতলের প্রাণী এবং উদ্ভিদে নিশ্চয়ই ছেয়ে যেত সে ধ্বংসাবশেষ এবং সেই অবস্থাতেই রয়ে যেত শত শত বছর। ডুবুরি আর অভিযাত্রীরা নিশ্চয়ই সেখানে নেমে খুঁজে বেড়াত হারিয়ে যাওয়া ধনরত্ন। কিন্তু এখানে? মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে সেই বিশাল জাহাজটাকে স্রেফ হজম করে ফেলল এই ভাটির দেশ। এতটুকু চিহ্নও আর রইল না কোথাও।
এটাই এরকম একমাত্র ঘটনা নয়। স্মৃতির পথে পিছু হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ল এমন অসংখ্য প্রাচীন জাহাজের সলিল সমাধি ঘটেছে এই ভাটির দেশের নদী-খাঁড়িতে। সেই ১৭৩৭-এর ভয়ংকর ঝড়ে তো দু’ডজনেরও বেশি জাহাজডুবি হয়েছিল এখানে। আর ১৮৮৫-তে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির গর্ব সেই দুই স্টিমার, আর্কট আর মাহরাট্টা তো এখানেই তলিয়ে গিয়েছিল জলে। আর ১৮৯৭-এ সিটি অব ক্যান্টারবেরির ডুবে যাওয়ার ঘটনাই বা ভুলি কী করে? কিন্তু সেসব দুর্ঘটনার জায়গায় গেলে কিছুই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না এখন। এই হিংস্র স্রোতের করাল গ্রাস থেকে কোনও কিছুরই কোনও ছাড় নেই; সব কিছুই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে শেষ পর্যন্ত মিহি পলির চেহারা নেয়, রূপান্তর ঘটে পরিণত হয় নতুন কোনও পদার্থে।
মনে হল যেন গোটা ভাটির দেশটাই কবির কণ্ঠে বলছে : “জীবন যাপিত হয় রূপান্তরে।”
মরিচঝাঁপিতে এখন বিকেল। দ্বীপের এই ওয়ার্ডের উদ্বাস্তুদের মিটিং থেকে এক্ষুনি ফিরল কুসুম আর হরেন। গুজব যা শোনা গিয়েছিল সেটা সত্যি। নদীর অন্য পারে যে গুণ্ডাবাহিনী জড়ো হয়েছে ওদেরই এখানে নিয়ে আসা হবে উদ্বাস্তুদের তাড়ানোর জন্য। কিন্তু সে আক্রমণ শোনা গেল খুব সম্ভবত কাল শুরু হবে। আরও কয়েক ঘণ্টা সময় হাতে আছে আমার।