স্পন্দন

পূর্ণিমা আসতে এখনও ক’দিন বাকি। চাঁদের তিন ভাগ মাত্র দেখা যাচ্ছে। তাও এত উজ্জ্বল জ্যোৎস্না এসে পড়েছে জলের ওপর, মনে হচ্ছে নদীর ভেতর থেকে যেন আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। একটু ঠান্ডা ঠান্ডা পড়েছে রাতের দিকটায়, কিন্তু হাওয়া চলছে না। পাড় থেকেও কোনও শব্দ ভেসে আসছে না। নিঝুম নিস্তরঙ্গ চারদিক। অস্বচ্ছন্দ তন্দ্রায় একবার পাশ ফিরল পিয়া। ঠিক করে নিল ভাজ-করা শাড়ির বালিশটা। দেখে নৌকোর গলুই-এর কাঠটার ওপর মাথা রেখে শুয়ে আছে ও। হঠাৎ একটা নড়াচড়ার আওয়াজে ঘুম ছুটে গেল পিয়ার। কীসে যেন খচমচ করছে, নখ দিয়ে আঁচড়াচ্ছে নৌকোর গা, ডিঙি বেয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। যেন নৌকোর পেটের ভেতর থেকে কাঠ ভেদ করে কানে আসছে আওয়াজটা। কয়েকমিনিট লাগল পিয়ার বুঝতে, ব্যাপারটা কী। কিছুই না, ফকিরের ডিঙির জীবন্ত পণ্যভাণ্ডার। তক্তার নীচে কঁকড়াগুলি নড়াচড়া করছে, তারই শব্দে ঘুম ভেঙেছে পিয়ার। কঁকড়ার খোলার খটর খটর, দাঁড়াগুলোর কট কট আওয়াজ, ডালপালার খসখস স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল পিয়া। মনে হচ্ছিল ও যেন একটা দৈত্য, মাটিতে কান পেতে শুনছে কোনও পাতালপুরীর প্রাণস্পন্দন।

নৌকোটা দুলে উঠল হঠাৎ, মনে হল কারও নড়াচড়ায়। পায়ের দিকে তাকিয়ে পিয়া দেখল ডিঙির মাঝের জায়গাটায় ফকির বসে আছে। একটা চাদর দিয়ে তাঁবুর মতো করে ঘাড় পর্যন্ত মোড়া। পিয়া ভেবেছিল ও বোধহয় ঘুমোচ্ছে ছইয়ের নীচে। কিন্তু ফকিরের বসার ভঙ্গিটায় এমন একটা পাথুরে নিশ্চলতা রয়েছে, বোঝাই যাচ্ছিল বেশ খানিকক্ষণ ওই ভাবে বসে আছে ও। পিয়া যে ওর দিকে তাকিয়ে আছে সেটা যেন টের পেল ফকির। ঘুরে তাকাল ওর দিকে। পিয়া জেগে গেছে দেখে হাসল। হাসিটার মধ্যে একই সঙ্গে একটা কৈফিয়ত আর আত্মবিদ্রুপের ভাব। ওখানে বসে বসে ওকে আর টুটুলকে পাহারা দিচ্ছে ফকির, ভেবে ভাল লাগল পিয়ার। মনে পড়ল জলের তলায় প্রথম যখন ফকিরের হাতের ছোঁয়া পেয়েছিল, কী প্রচণ্ড চেষ্টা করেছিল পিয়া সেটাকে সরিয়ে দিতে–যতক্ষণ না ও বুঝেছিল যেটা ওকে ধরার চেষ্টা করছে সেটা কোনও হিংস্র প্রাণী নয়, একটা মানুষ, যার ওপর ও ভরসা করতে পারে, যে ওর কোনও ক্ষতি করবে না। বিশ্বাসই হচ্ছিল না পিয়ার যে কয়েক ঘণ্টা হয়েছে মাত্র ও উলটে পড়েছিল জলে ওই লঞ্চটা থেকে। ঘটনাটা মনে পড়তেই সারা শরীর কেঁপে উঠল পিয়ার। চোখ বুজতেই মনে হল আবার যেন জল চেপে ধরেছে ওকে চারদিক থেকে, ও যেন সেই অদ্ভুত উজ্জ্বল অতলে তলিয়ে যাচ্ছে ফের, যেখানে সূর্যের আলোর কোনও দিকদিশা নেই, যেখানে বোঝা যায় না কোনদিকে গেলে ওপরে ওঠা যাবে আর কোনদিকে গেলে ডুবে যাবে নিতল গভীরে।

পিয়ার মনে হল নৌকোটা যেন নড়ছে ওর শরীরের নীচে। বুঝতে পারছিল কাঁপুনি হচ্ছে ওর। একের পর এক লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে, এমন সময় কাঁধের কাছে একটা ঠান্ডা, দৃঢ় হাতের স্পর্শ পেল পিয়া। অদ্ভুত ভাবে, এই ছোঁয়াটাও ওকে সেই পড়ে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিল। ফকির এসেছে–বুঝতে পারল ও। চোখ মেলে দেখল উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে ফকির চেয়ে আছে ওর মুখের দিকে। একটু হাসার চেষ্টা করল পিয়া, কিন্তু খিচুনির মতো কাঁপছে সারা শরীর, তাই মুখবিকৃতির মতো দেখাল হাসিটা। ও বুঝতে পারল ফকিরের উৎকণ্ঠা আরও বেড়ে যাচ্ছে, তাই ওর হাতের ওপর একটা হাত রাখল। হাতটা ধরে নিয়ে ওর পাশে শুয়ে পড়ল ফকির, লম্বা হয়ে। ওর শরীরের লোনা, রোদে-পোড়া গন্ধ এখন পিয়ার নাকে; দু’জনের মধ্যে ব্যবধান বলতে একটা চাদর, সেটা ভেদ করে ফকিরের পাঁজরগুলি অনুভব করতে পারছিল পিয়া। ফকিরের গায়ের ওমে ধীরে ধীরে গরম হয়ে উঠল চাদরটা, শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে থিরথিরে কাঁপুনির ভাবটা থিতিয়ে এল আস্তে আস্তে। কাঁপুনি থামতে একটু অপ্রতিভ হয়ে ধড়মড় করে উঠে বসল পিয়া। ফকিরও ছিটকে উঠে পড়ল। পিয়া বুঝতে পারছিল একই রকম অপ্রস্তুত বোধ করছে ও-ও। কী করে বোঝানো যায় ফকিরকে যে সব ঠিক আছে, কিছু মনে করেনি পিয়া, ভুল বোঝেনি ওকে? ভেবে পেল না পিয়া। সশব্দে গলা পরিষ্কার করল একবার, তারপর শুধু বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ”। ঠিক সেই সময়েই, যেন এই অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে ওদের উদ্ধার করার জন্য ঘুমের মধ্যে কেঁদে উঠল টুটুল। সঙ্গে সঙ্গে উঠে ছইয়ের ভেতর ঢুকে গেল ফকির, ছেলেকে শান্ত করতে।

পুঁটুলি পাকানো শাড়িটার ওপর আবার মাথা নামাল পিয়া। মনে হল কাপড়টার ভাজে ভজে ওটার মালিকের গন্ধ পাচ্ছে ও। যেন হঠাৎ সে সশরীরে উপস্থিত হয়েছে এই নৌকোর ওপর। ভেবে ভাল লাগল পিয়ার, ফকিরকে যা বলতে চেয়েছিল একই কথা বলতে পারবে তাকেও –অনৈতিক কিছু করেনি ওরা, কিছু ঘটেইনি আদতে।

কীই বা ঘটতে পারত? ফকিরের বিষয়ে খুব একটা কিছু জানে না পিয়া, কিন্তু এটুকু তো বোঝা গেছে যে ও বিবাহিত এবং ওর একটা বাচ্চা আছে। আর নিজের সম্পর্কেও এটা অন্তত বলতে পারে পিয়া যে এরকম ব্যক্তিগত কোনও জটিলতায় জড়ানোর কথা ও স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। ও একটা কাজের দায়িত্ব নিয়ে এসেছে, এ জায়গাটা প্রকৃতপক্ষে ওর কর্মক্ষেত্র। আর ব্যক্তিগত সম্পর্কের থেকে দূরে থাকলেই একটা জায়গা কর্মক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। দুয়ের মধ্যে যে ভেদরেখা সেটার পবিত্রতায় বিশ্বাস করে পিয়া; নিজের কাজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না করে সে রেখা ও কিছুতেই পেরোতে পারবে না।

সকালে যখন ঘুম ভাঙল পিয়ার নৌকো ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে। চোখ খুলে দেখে রাতের ঠান্ডা বাতাস আর নদীর গরম জলের ধাক্কায় ধাক্কায় জমে ওঠা কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে আছে চারদিক। নিজের পাটুকু পর্যন্ত কোনওরকমে দেখতে পাচ্ছিল পিয়া; গায়ের চাদরটা চুপচুপে ভিজে গেছে হিমে। পুব আকাশে একটা আবছা আভা দেখে শুধু বোঝা যাচ্ছিল যে সূর্য উঠেছে। এই আলোতেও কী করে নৌকো চালাচ্ছে ফকির ভেবে একটু আশ্চর্য হল পিয়া। বোঝাই যাচ্ছে এই জলের রাস্তা ওর মুখস্থ প্রায়, তাই এই ঝুম কুয়াশাতেও নদী-খাঁড়ির কিনারা বুঝে বুঝে ডিঙি চালিয়ে নিয়ে যেতে কোনও অসুবিধাই হচ্ছে না।

উঠে পড়ার কোনও তাড়া ছিল না, তাই আবার আরামে চোখ বুজল পিয়া। একটু পরে হঠাৎ থেমে গেল নৌকোটা। পিয়ার ঘুম ভেঙে গেল। চেয়ে দেখল কুয়াশা এখনও বেশ ঘন, চারপাশের জল জঙ্গল কিছুই নজরে আসছে না। ডিঙির পেছনের দিক থেকে নোঙর নামানোর শব্দ কানে এল এবার। পিয়া একটু অবাক হল। এরকম একটা জায়গায় এনে কেন নোঙর ফেলছে ফকির? কুয়াশার জন্যই হবে নিশ্চয়ই। হয়তো বড় নদীতে কি মোহনায় এসে পড়েছে, ভাল করে না দেখে আর দিক ঠিক করা যাচ্ছে না।

আবার ঘুমিয়ে পড়তে যাচ্ছিল পিয়া, হঠাৎ একটা আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠে বসল সোজা হয়ে। ভাল করে শোনার জন্য হাত রাখল কানের পেছনে। আবার সেই আওয়াজ! ছলাৎ করে জলের শব্দ একটু, তারপর একটা চাপা নাক ঝাড়া দেওয়া শব্দ। যেন খুব মোটা রুমালের মধ্যে কেউ নাক পরিষ্কার করছে।

“আশ্চর্য!” ছিটকে উঠে হাঁটু গেড়ে বসল পিয়া, কুয়াশায় কান পেতে শুনতে লাগল মনোযোগ দিয়ে। মিনিট কয়েক ভাল করে শুনে বোঝা গেল বেশ কয়েকটা ডলফিন ঘোরাঘুরি করছে নৌকোর চারপাশে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে নানা দিক থেকে আসছিল শব্দগুলো, জায়গা বদলাচ্ছিল মুহূর্তে মুহূর্তে। কয়েকটা আওয়াজ খুব ক্ষীণ, মনে হয় যেন কিছুটা দূর থেকে আসছে; কয়েকটা আবার বেশ স্পষ্ট, ধারে কাছেই। দিনের পর দিন কাটিয়েছে পিয়া এই চাপা ঘোঁতঘোঁত আওয়াজ শুনে, ও জানে একমাত্র ইরাবড়ি ডলফিন, মানে ওর্কায়েলা ব্রেভিরোষ্ট্রিস ই পারে এরকম আওয়াজ করতে। অর্থাৎ একটা ওর্কায়েলার ঝক এই পথ দিয়ে যেতে যেতে নৌকোটাকে দেখে একটু থেমেছে এখানে। আর এমনই পিয়ার কপাল যে ঘটনাটা এমন একটা সময় ঘটছে যখন ও নিজের হাতের তেলো পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। আগের আগের অভিজ্ঞতা থেকে পিয়া জানে যে মিনিট কয়েক পরেই অস্থির হয়ে উঠবে ডলফিনগুলো। হয়তো ওর যন্ত্রপাতি বের করতে করতেই ওরা চলে যাবে দূরে।

“ফকির!” ও-ও শুনেছে কিনা আওয়াজগুলো সেটা বোঝার জন্য চাপা গলায় ডাকল পিয়া। একটু দুলে উঠল নৌকোটা। বুঝল ফকির এগিয়ে আসছে। তাও চমকে গেল পিয়া ওকে দেখে : কাঁধের কাছে ঘেঁড়া ছেঁড়া কুয়াশায় মনে হল ওর মাথাটা যেন ভাসছে শূন্যে, একটা মেঘের ওপর।

“লিসন,” শব্দগুলোর দিকে ইশারা করে কানের পেছনে একটা হাত রেখে বলল পিয়া। মাথা নাড়ল ফকির, কিন্তু অবাক হল না; যেন এই ডলফিনের ঝকের সঙ্গে দেখা হওয়াটা অপ্রত্যাশিত কিছু নয়, ও যেন আগে থেকেই জানত যে ওগুলি থাকবে এখানে। তা হলে ও কি রাত থেকে এদিকেই আসছিল, পিয়াকে ডলফিন দেখাবে বলে?

আরও গুলিয়ে গেল পিয়ার মাথাটা। ফকির করে জানবে যে ঠিক এই সময়ে এই এক ঝাক ওর্কায়েলা আসবে এখানে? হতে পারে নদীর এ জায়গাটায় ডলফিনের ঝাক মাঝে মাঝে আসে, কিন্তু তাও, আজকে এই সময়টাতেই যে ওরা এখানে থাকবে সেটা ও জানবে কী করে? আর যাই হোক, এরকম ভ্রাম্যমাণ শুশুকের ঝুঁকের চলাফেরার ঠিক ঠিকানা আগে থেকে অনুমান করা তো অসম্ভব ব্যাপার, সেটা তো অস্বীকার করা যায় না। যাক গে, এখন এসব প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। আপাতত এই কুয়াশার মধ্যেই যতটা পারা যায় তথ্য সংগ্রহ করে নিতে হবে।

হাতে সময় বেশি নেই যদিও, কিন্তু ব্যাগ থেকে কাজের যন্ত্রপাতি বের করার সময় পিয়া খুব ধীর এবং গোছানো। একগোছা ডেটাশিট বের করে ক্লিপবোর্ডে আটকাতে যাবে, ঠিক সেই সময় মাত্র মিটার খানেক দূরে ভেসে উঠল একটা ডলফিন। এত কাছে যে ওটার নিশ্বাসের সঙ্গে ফোয়ারার মতো বিন্দু বিন্দু জল এসে লাগল পিয়ার গায়ে। পিঠের পাখনা আর ভোঁতা নাকটা একবারের জন্য দেখা গেল। সন্দেহের আর কোনও জায়গা নেই, এগুলো ওর্কায়েলা-ই।

কোনওই ভুল নেই। যদিও শুরু থেকেই মোটামুটি নিশ্চিত ছিল পিয়া সে ব্যাপারে, তাও এবার চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন হয়ে গেল। নৌকোর এত কাছে ভেসে উঠেছিল শুশুকটা, যে জিপিএস মনিটরটা হাত বাড়িয়ে ধরে রেখেই রিডিং নিয়ে নিল পিয়া। ডেটাশিটে সংখ্যাগুলো লেখার সময় যেন একটা যুদ্ধজয়ের আনন্দ হচ্ছিল ওর–এক্ষুনি, এই মুহূর্তেও যদি চলে যায় ডলফিনগুলো, এই ছোট্ট কাগজের টুকরোটায় তো ধরা থেকে গেল এই তথ্যপ্রমাণ।

এর মধ্যে পাতলা হয়ে এসেছে কুয়াশা। ভাটাও শেষ হতে চলল প্রায়; কয়েকশো মিটার দূরেই ডাঙা দেখা যাচ্ছে। পিয়া লক্ষ করল ফকির নৌকোটা যেখানে এনে দাঁড় করিয়েছে, সেটা একটা বাঁকের মুখ। পাড়টা এখানে এসে একটা ভাঁজ করা হাতের মতো বেঁকে গেছে। ফলে কনুইয়ের বাঁকটায় একটা নিস্তরঙ্গ এলাকা তৈরি হয়েছে নদীর মধ্যে। আর ঠিক এই স্থির গভীর জায়গাটার মধ্যেই এসে নোঙর ফেলেছে ফকির। খানিকটা বুমেরাং-এর মতো দেখতে এই দহটা লম্বায় প্রায় এক কিলোমিটার। এই জায়গাটুকুতেই, যেন অদৃশ্য একটা পুকুরের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে ওই ডলফিনগুলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ভোরের কুয়াশা আর রাতের ঠান্ডা সুদূর স্মৃতির মতো কোথায় মিলিয়ে গেল। উঁচু বাঁধ আর ঘন জঙ্গলের বাধা পেরিয়ে কোনও হাওয়াও আসতে পারছে না নদী পর্যন্ত। স্থির জলের বুকে নদীর মধ্যে যেন আর একখানা সূর্য জ্বলছে। ওপরের মেঘহীন আকাশ থেকে আগুনের হলকা নামছে, জলের বুক থেকেও ঠিকরে উঠে আসছে তাপ। পারা চড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাঁসফাস করতে করতে মাটির নীচের জীবনপ্রবাহ উঠে আসছে পাড়ের কাদায়। পালে পালে কঁকড়া চলে বেড়াচ্ছে সেখানে, ঝাঁপিয়ে পড়ছে নদীর রেখে যাওয়া পাতা আর অন্যান্য রসালো আবর্জনার ওপর।

দুপুর পর্যন্ত ডেটা যা জোগাড় হল তাতে ঝকটায় কটা ডলফিন আছে মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই আন্দাজ করা চলে। পিয়া হিসাব করে দেখল সব মিলিয়ে সাতটা। তার মধ্যে একটা জোড়া মনে হচ্ছে একসাথে সাঁতরাচ্ছে আর মোটামুটি একই সঙ্গে ভেসে উঠছে। জোড়াটার একটা ডলফিন দলের অন্যগুলোর চেয়ে মাপে একটু ছোট। ওটা নিশ্চয়ই একটা ছানা; একেবারে কচি বাচ্চাও হতে পারে। হয়তো এখনও মাকে ছেড়ে নিজে নিজে আলাদা সাঁতরানোর বয়স হয়নি। পিয়া দেখল ছানাটা বার বার পাক খেতে খেতে উঠে আসছে জলের তলা থেকে, ছোট্ট মাথাটা ভেসে উঠছে জলের ওপর–মানে এখনও ঠিকমতো শ্বাস নিতেও শেখেনি ওটা। যতবার ওই কচি মাথাটা ভেসে উঠছিল, আনন্দে নেচে উঠছিল পিয়ার মনটা : তার মানে ওর্কায়েলারা এখনও বংশবৃদ্ধি করছে এখানে।

সাঁতার কেটেই যাচ্ছে শুশুকগুলো, বাঁকের মুখটা ছেড়ে অন্যদিকে যাচ্ছেই না প্রায়। নদীর ওই ছোট্ট গভীর অংশটার মধ্যে পাক খেয়ে যেতেই যেন ভাল লাগছে ওদের। নৌকোটার জন্য যে ওরা এখানে ঘুরঘুর করছে তাও নয়; যেটুকু আগ্রহ নৌকোটার প্রতি ওদের ছিল সে কখন ফুরিয়ে গেছে।

তা হলে কীসের জন্য ঘুরছে ডলফিনগুলো এখানে? এ জায়গাটায় ওরা এসেছেই বা কেন, আর কীসের জন্যই বা অপেক্ষা করছে? খুবই গোলমেলে সমস্যা। পিয়ার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে খুব কৌতুলহজনক কিছু একটা ঘটছে এখানে; এমন কিছু, যা থেকে ইরাবড়ি ডলফিন এবং তাদের স্বভাব সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নতুন তথ্য জানা যেতে পারে। ওকে শুধু মাথা খাঁটিয়ে বের করতে হবে রহস্যটা কী।