তরী থেকে তীরে

নৌকো যখন গর্জনতলায় পৌঁছল, এমনিতে তখন ভাটার সময়। কিন্তু ঝড়ের টানে এমন ফুলে উঠেছে নদী যে ভরা জোয়ারেও অতটা জল উঠতে কখনও দেখেনি পিয়া। হাওয়ার তোড়ে নদীটা যেন খানিকটা হেলে পড়েছে একদিকে। জলটাকে যেন ক্রমশ ঢালু হয়ে আসা একটা ঢিপির মতো করে এক জায়গায় জড়ো করে রেখেছে কেউ। সে ঢিপির মাথাটা দ্বীপের পাড়ের চেয়েও বেশ খানিকটা উঁচু।

জটপাকানো শেকড়-বাকড়ের ফাঁক দিয়ে ডিঙিটাকে কতগুলো ঘন হয়ে দাঁড়ানো গাছের একেবারে মাঝখানে নিয়ে চলে এল ফকির। পিয়া লক্ষ করল, অন্যান্যবার গর্জনতলায় এসে ফকির যেখানে ডিঙি রাখে এবার কিন্তু সেদিকটায় ও গেল না। তার বদলে জলের মধ্যে থেকে বেরিয়ে থাকা দ্বীপের সবচেয়ে উঁচু জায়গাটার দিকে নিয়ে গেল নৌকোটাকে।

ডিঙির মাথাটা যখন গাছগুলোর একদম কাছাকাছি এসে গেছে, পাশ দিয়ে এক লাফ মেরে ফকির নেমে গেল জলের মধ্যে। তারপর নৌকোটাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল দ্বীপের আরও ভেতরে। গলুইয়ের একদম সামনে থেকে টানছিল ফকির, যাতে সহজে নৌকোর দিক বদলানো যায় দরকার মতো। আর পিয়া চলে গেল একেবারে পেছনে, যেখান থেকে সর্বশক্তিতে ঠেলা মারা যায়। ঠেলতে ঠেলতে নৌকোটাকে কতগুলো গুঁড়ির ফাঁকে ঢুকিয়ে দিল দু’জনে। তারপর এক লাফ মেরে ফকির উঠে পড়ল তার ওপর। আস্তে আস্তে নৌকোর পেছন দিকে গিয়ে খুলে ফেলল খোলের পাটাতনটা। পিয়াও উঠে এসেছে ততক্ষণে। ফকিরের কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি মেরে আশ্চর্য হয়ে দেখল এত ঝড়-ঝাঁপটা সত্ত্বেও নৌকোর খোলটা আর তার ভেতরের জিনিসপত্র কিন্তু মোটামুটি ঠিকঠাকই আছে। ফকিরের উনুন আর বাসনপত্রের সঙ্গে কয়েকটা নিউট্রিশন বারও দেখা যাচ্ছে সেখানে। তার মধ্যে গড়াগড়ি যাচ্ছে গোটা দুই জলের বোতল। নিউট্রিশন বারগুলোকে জিনসের পকেটে পুরে নিল পিয়া, আর এক বোতল জল নিয়ে ফকিরের হাতে দিল। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে এলেও খুব সাবধানে সামান্য একটু জল নিজের গলায় ঢালল। এই দু’ বোতল দিয়েই কতক্ষণ যে চালাতে হবে কে জানে।

খোলের মধ্যে থেকে ফকির তারপর পুরনো একটা শাড়ি বের করে আনল। পিয়ার মনে পড়ল কদিন আগেই ওটাকে একদিন মাথার বালিশ করে শুয়েছিল ও। কাপড়টাকে শরীর দিয়ে আড়াল করে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে একটা দড়ি বানিয়ে ফেলল ফকির; ইশারায় পিয়াকে বলল সেটাকে কোমরে বেঁধে নিতে। কারণটা বুঝতে না-পারলেও ফকিরের কথামতো দড়িটা কোমরে জড়িয়ে নিল পিয়া। ফকির ততক্ষণে আবার খোলের ভেতর হাত ঢুকিয়ে গোল করে গুটিয়ে রাখা কাঁকড়া ধরার সুতোটা বের করে এনেছে। নাইলন সুতোর বান্ডিলটা পিয়ার হাতে দিয়ে দিল ও। ইশারায় বলল সাবধানে ধরতে। একটু অসতর্ক হলেই সুতোয় বাঁধা খোলামকুচি কি মাছের কাটায় কেটেকুটে যেতে পারে হাত-পা। এরপর ডিঙি থেকে নেমে এসে পিয়াকে দেখিয়ে দিল কী করে বান্ডিলটাকে বুক দিয়ে হাওয়া থেকে আড়াল করে সুতো ছাড়তে হয়। নৌকোটাকে উলটে দিয়ে তার তক্তার ফঁকফোকরের মধ্যে দিয়ে সুতো গলিয়ে সুতোর বাকি অংশটা চারপাশের গাছগুলোর চারদিকে জড়িয়ে দিতে লাগল ফকির তারপর। পিয়া বুঝতে পারল ওর কাজ হচ্ছে সুতোটার দিকে নজর রাখা, যাতে সেটা টানটান থেকে সব জায়গায়। কারণ কোথাও একটু আলগা হলেই হাওয়ার টানে উড়ে যাবে সুতো, তাতে বাঁধা কঁকড়ার চার আর খোলামকুচি গুলিগোলার মতো এসে লাগবে গায়ে।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘন মাকড়শার জালের মতো নাইলনের সেই সুতোর বুনোনে চারপাশের গাছগুলোর সঙ্গে বাঁধা হয়ে গেল ডিঙিটা। কিন্তু যতটা সম্ভব সতর্ক থাকা সত্ত্বেও সুতোয় বাঁধা শক্ত জিনিসগুলোর থেকে পুরোপুরি গা বাঁচাতে পারেনি ফকির। কাজ শেষ হওয়ার পর দেখা গেল ছোট ছোট কাটা-ছড়ার দাগে ভর্তি হয়ে গেছে ওর সারাটা মুখ আর বুক।

তারপর পিয়ার হাত ধরে দ্বীপের আরও গভীরে এগিয়ে চলল ফকির। হাওয়ার উলটোদিকে চলার জন্যে নিচু হয়ে প্রায় গুঁড়ি মেরে এগোতে হচ্ছিল ওদের। চলতে চলতে একসময় লম্বা একটা গাছের কাছে এসে পৌঁছল দু’জন। গাছটা সাধারণ বাদাবনের গাছের তুলনায় অস্বাভাবিকরকম উঁচু, গুঁড়িটাও অনেকটা মোটা। ইশারায় ফকির সেই গাছের ওপরে উঠে পড়তে বলল পিয়াকে। তারপর নিজেও উঠতে লাগল পেছন পেছন। মাটি থেকে মিটার তিনেক ওপরে ওঠার পর একটা মোটা ডাল বেছে নিয়ে তার ওপরে বসতে বলল পিয়াকে। ইশারায় দেখিয়ে দিল কীভাবে গুঁড়ির দিকে মুখ করে দু’পা দু’দিকে ঝুলিয়ে বসতে হবে। তারপর মোটর সাইকেলের পেছনের সিটে যেভাবে বসে, সেইভাবে পিয়ার পেছনে বসে পড়ল নিজে। ঠিকমতো বসার পর হাতের ইশারায় পিয়ার কোমরে বাঁধা পেঁচানো শাড়িটা চাইল ফকির। এতক্ষণে পিয়া বুঝতে পারল ফকির কেন ওটা সঙ্গে নিয়ে এসেছে–গাছের গুঁড়ির সঙ্গে শাড়িটা দিয়ে নিজেদের বাঁধতে চাইছে ও। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে পেঁচানো কাপড়টার একটা প্রান্ত ফকিরের হাতে দিল পিয়া। গাছের চারদিকে সেটাকে বেড় দিয়ে আনতে হাত লাগাল নিজেও। শাড়িটা দিয়ে দু’বার বেড় দেওয়া গেল গাছটাকে। তারপর তার দুটো প্রান্ত একসঙ্গে এনে কষে একটা গিট বেঁধে ফেলল ফকির।

এক মুহূর্তের জন্যেও বিরাম নেই ঝড়ের, উলটে বরং সমানে বেড়েই চলেছে হাওয়ার তেজ। ঝড়ের শব্দ একটা সময় এত জোরালো হয়ে উঠল যে পিয়ার কানে একেবারে অন্যরকম শোনাতে লাগল সেটা। যেন তা বাতাসের আওয়াজ নয়, অন্য কোনও নৈসর্গিক শক্তির গর্জন। শোঁ শোঁ সড়সড় খসখস আওয়াজের জায়গা নিল বুক কাঁপানো একটা গম্ভীর গুমগুম শব্দ–মনে হল যেন নড়েচড়ে উঠছে গোটা পৃথিবীটা। তীব্র হাওয়ার সঙ্গে ঘন কুয়াশার মতো উঠে আসছে ধুলো, জলের কণা, কাঠকুটো, গাছের ঘেঁড়া পাতা, ডালপালা। ফলে কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না কোনওদিকে। এমনিতেও অন্ধকার হয়ে এসেছে চারদিক; ঘড়ির কাটায় সবেমাত্র দুপুর একটা, কিন্তু আলো এত কমে গেছে যে মনে হচ্ছে যেন রাত নেমে এসেছে প্রায়। বাতাসের তেজ যে এর থেকেও বেশি হতে পারে, আরও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে ঝড়ের তাণ্ডব, এই মুহূর্তে সেটা কল্পনা করাও কঠিন। কিন্তু পিয়া মনে মনে পরিষ্কার বুঝতে পারছিল যে এ ঝড় আরও বাড়বে বই কমবে না।

সারা শরীর, গায়ের জামাকাপড় সব মাখামাখি হয়ে গেছে কাদায়। খালি পায়ে প্রায় হামাগুড়ি দিতে দিতে উঁচু পাড়িটা পেরিয়ে এল কানাই, হাওয়ার ঝাঁপটা থেকে বাঁচার জন্য গুটিসুটি মেরে বসে রইল বাঁধের গোড়ায়। ভিজে সপসপ করছে মাথার চুল থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত, তার ওপরে ঝড়ের তেজ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা হয়ে আসছে বাতাস। দু’হাতে নিজেকে জড়িয়ে ধরে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে কানাই আকাশের দিকে তাকাল।

নীলের কোনও চিহ্ন নেই আকাশে, কিন্তু কালো রংটাও টানা একরকম নয় সব জায়গায়। কোথাও গাঢ়, কোথাও হালকা–নানারকম শেডের কালো মেঘে ছেয়ে আছে সমস্ত আকাশ। কোথাও সে মেঘ ছাইয়ের মতো ধূসর, কোথাও সিসার মতো নীলচে কালো। গোটা আকাশ জুড়ে নানা স্তরে যেন ছড়িয়ে রয়েছে নানারকম মেঘ। তাদের প্রত্যেকের রং আলাদা, গতি আলাদা। কানাইয়ের মনে হল আকাশটা যেন কালো কাঁচের একটা আয়না, ভাটির দেশের জলের ছায়া পড়েছে তাতে। সে জলের নানারকম স্রোত, ছোট বড় ঘূর্ণি–সবকিছু দেখা যাচ্ছে ওই আয়নায়। রঙের তফাত সামান্য হলেও আয়নার গায়ে নদী নালা ঘূর্ণিগুলোকে চিনে নিতে অসুবিধা হচ্ছে না একটুও।

বাঁধ বরাবর টানা সারি দেওয়া ঝাউগাছগুলো হাওয়ার দাপটে নুয়ে প্রায় দু’ ভাঁজ হয়ে গেছে। আশেপাশে নারকেলগাছ যে ক’টা আছে তাদের পাতাগুলো সব মুচড়ে পাকিয়ে গিয়ে আগুনের শিখার মতো চেহারা নিয়েছে। ফলে এমনিতে বাঁধের কাছ থেকে দ্বীপের ভেতরে যতটা দেখা যায় তার থেকে অনেক বেশিদূর পর্যন্ত চোখ চলে যাচ্ছে এখন। লুসিবাড়ির সবচেয়ে উঁচু বাড়িগুলির একটা হল হাসপাতালটা, সেটা খুব সহজেই চোখে পড়ছে এখান থেকে।

হাসপাতালের দিকে দৌড়তে শুরু করল কানাই, কিন্তু কয়েক পা গিয়েই গতি কমাতে হল। পিছল হয়ে আছে ভেজা রাস্তা, কাদার মধ্যে বারবার হড়কে যাচ্ছে খালি পা। বেশ খানিকটা এগোনোর পরও কোনও লোকজন চোখে পড়ল না পথে–বেশিরভাগই বোধহয় পালিয়েছে ঘরবাড়ি ছেড়ে। যারা রয়ে গেছে, তারাও মনে হল শক্ত করে খিল এঁটে বসে রয়েছে নিজের নিজের নিরাপদ আশ্রয়ে। কিন্তু হাসপাতাল চত্বরের গেটটা যখন চোখে পড়ল, কানাই দেখল দলে দলে মানুষ সার বেঁধে এগিয়ে চলেছে সেদিকে–সবাই হাসপাতাল বাড়িতে গিয়ে উঠতে চায়। কারণটা বোঝা খুব একটা কঠিন নয়। বেশ শক্তপোক্ত গড়ন বাড়িটার, দেখলেই বেশ ভরসা পাওয়া যায় মনে। বেশিরভাগ মানুষই আসছে পায়ে হেঁটে। কেউ কেউ আবার রিকশা ভ্যানে চড়ে বসেছে– বিশেষ করে বুড়োবুড়ি আর কচি বাচ্চারা। কানাইও পায়ে পায়ে এগোল ভিড়ের সঙ্গে। দালানে পা দিয়েই দেখল পুরোদস্তুর উদ্বাসনের কাজ শুরু হয়ে গেছে সেখানে। দলে দলে নার্স আর ভলান্টিয়াররা ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে, করিডোর ধরে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পেশেন্টদের, সিঁড়ি দিয়ে ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে তুলছে ওপরের সাইক্লোন শেল্টারে।

একতলার লম্বা বারান্দার একপ্রান্তে দাঁড়িয়েছিল ছোট্টখাট্ট চেহারার একটা বাচ্চা ছেলে। ভিড় কাটিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল কানাই–”টুটুল?”

ছেলেটা চিনতে পারল না ওকে। জবাবও দিল না কোনও। কানাই উবু হয়ে ওর সামনে বসে আবার জিজ্ঞেস করল, “টুটুল, তোমার মা কোথায়?”

মাথা নেড়ে সামনের একটা ওয়ার্ডের দিকে ইশারা করল টুটুল। সেদিকে যাবে বলে কানাই যেই উঠে দাঁড়াতে গেছে, ঝড়ের মতো সেখান থেকে বেরিয়ে এল ময়না–তার পরনে নার্সের সাদা ইউনিফর্ম। কানাইয়ের ভেজা লুঙ্গি আর কাদামাখা জামার দিকে তাকাল একবার; চিনতে পারল না।

“ময়না, আমি কানাই।”

বিস্ময়ে মুখে হাত চাপা দিল ময়না। “কানাইবাবু! এ কী অবস্থা হয়েছে আপনার?”

“সে কথা পরে হবে,” বলল কানাই। “শোনো, একটা জরুরি কথা বলার আছে। তোমাকে–”

কথার মাঝখানেতে ওকে থামিয়ে দিল ময়না। “ওরা কোথায়? আমার বর আর ওই আমেরিকান মেয়েটা?”

“সেটাই বলতে যাচ্ছি তোমাকে, ময়না,” জবাব দিল কানাই। “ওরা গর্জনতলায় রয়ে গেছে। ওদের ওখানে রেখেই চলে আসতে হয়েছে আমাদের।”

“ওদের ফেলে রেখে চলে এলেন আপনি?” ঘৃণা আর ক্রোধ ঝরে পড়ছে ময়নার দু’চোখে। “এই প্রচণ্ড সাইক্লোন আসছে–তার মধ্যে জঙ্গলে ফেলে রেখে চলে এলেন ওদের?”

“আমার নিজের ইচ্ছায় আসিনি ময়না। ফিরে আসার ব্যাপারটা হরেনই ঠিক করেছিল। ও-ই বলল ফিরতে হবে, তা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।”

“আচ্ছা?” হরেনের নামটা শুনে একটু যেন ঠান্ডা হল ময়না। কিন্তু ওরা এখন কী করবে? ওই জঙ্গলের মধ্যে–একটুও আড়াল নেই কোথাও…”

“কিছু হবে না, ময়না,” বলল কানাই। “ফকির সব জানে, কীভাবে কী করতে হয় এরকম অবস্থায়। তোমার কোনও চিন্তা নেই। আগেও তো ওই দ্বীপে কত লোক ঝড়ের মুখ থেকে ফিরে এসেছে। ফকিরের দাদুই তো একবার ঝড়ে পড়েছিলেন ওখানে, তাই না?”

খানিকটা যেন হাল ছেড়ে দিয়ে মাথা নাড়ল ময়না। “এখন তো আর কিছুই করার নেই, শুধু ভগবানকে ডাকা ছাড়া।”

“হরেন তোমাকে বলতে বলে দিয়েছে যে ঝড়টা থামলেই ও ফিরে যাবে ওখানে। আমিও যাব বলেছি। যাওয়ার পথে হরেন তুলে নিয়ে যাবে আমাকে।”

“বলবেন আমিও যাব,” এক হাতে টুটুলের হাত ধরে বলল ময়না। “মনে করে বলবেন কিন্তু।”

“নিশ্চয়ই বলব,” গেস্ট হাউসটার দিকে এক নজর তাকিয়ে জবাব দিল কানাই। “আমি বরং একবার গিয়ে দেখি মাসিমা কোথায় আছেন?”

“মাসিমাকে নিয়ে গেস্ট হাউসের দোতলায় উঠে যান,” ময়না বলল। “আমি জানালাগুলো সব বন্ধ করে দিয়ে এসেছি। কোনও অসুবিধা হবে না।”