পুনরাগমনায় চ
ভেবেছিলাম মরিচঝাঁপির সাময়িক উত্তেজনা আমার চেহারায় যে ছাপ ফেলেছে, লুসিবাড়িতে ফিরতে ফিরতে তা মিলিয়ে যাবে : নদীর হাওয়ায় শরীরও স্নিগ্ধ হবে, আর হরেনের নৌকোর দুলুনিতে ধীর হয়ে আসবে আমার উত্তেজিত হৃৎস্পন্দন। কিন্তু কই? দেখা গেল ঠিক তার উলটোটাই ঘটছে : প্রতিটি বাঁক ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখের সামনে যেন একে একে নতুন সব সম্ভাবনার দরজা খুলে যাচ্ছে। স্থির হয়ে আর বসে থাকতে পারলাম না। ছাতাটা এক ধারে সরিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালাম, দু’হাত ছড়িয়ে দিলাম দু’দিকে, যেন আলিঙ্গন করতে চলেছি বাতাসকে। হাওয়ার টানে পালের মতো ফুলে উঠল আমার ধুতি, আর আমি দাঁড়িয়ে রইলাম সটান মাস্তুলের মতো–যেন ডিঙিটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাব দিগন্তের দিকে।
“সার,” চেঁচিয়ে উঠল হরেন, “বসে পড়ুন, বসে পড়ুন। নৌকো কাত হয়ে যাবে যে! একেবারে উলটে পড়বেন জলে।”
“তোমার মতো মাঝি থাকতে নৌকো কখনও উলটোতে পারে হরেন? তুমি ঠিক ভাসিয়ে রাখবে আমাদের।”
“সার, আজ আপনার কী হয়েছে বলুন তো?” হরেন জিজ্ঞেস করল। “আপনাকে আগের মতো তো আর লাগছে না–যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছেন একেবারে।”
“ঠিক বলেছ হরেন। আমি আর সে আমি নেই। একেবারে পালটে গেছি। আর তোমার জন্যই সম্ভব হয়েছে সেটা।”
“কী করে সার?”
“তুমিই তো আমাকে মরিচঝাঁপিতে নিয়ে গেলে, না কি?”
“না সার, ঝড়ে নিয়ে গেল।”
এই রকম বিনয়ী, আমাদের এই হরেন। “ঠিক আছে, ঝড়েই না হয় নিয়ে গেল,” হাসলাম আমি। “এই ঝড়ই তা হলে আমাকে বুঝিয়ে দিল যে রিটায়ার করার পরেও একটা লোকের জীবনে পরিবর্তন আসতে পারে, তার পরেও নতুন করে আবার সব কিছু শুরু করা যায়।”
“কী শুরু করা যায় সার?”
“নতুন জীবন শুরু করা যায় হরেন, নতুন জীবন। এর পর যখন মরিচঝাঁপি যাব আমি, আমার ছাত্ররা সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। জীবনে কখনও যে ভাবে পড়ানোর সুযোগ পাইনি, সেইভাবে ওদের পড়াব আমি।”
“কী পড়াবেন সার ওদের? কী শেখাবেন?”
“কেন, আমি ওদের বলব—”
সত্যিই তো, কী বলব আমি ওদের? পাকা মাঝি বটে হরেন, ঠিক হাওয়া কেড়ে নিয়েছে আমার পাল থেকে।
বসে পড়লাম আমি। ভাল করে চিন্তা করা দরকার বিষয়টা নিয়ে।
ঠিক আছে, এই সব ছেলেমেয়েরা যে ধরনের কাল্পনিক কাহিনি-টাহিনির সঙ্গে পরিচিত সেইখান থেকেই শুরু করব আমি। “বল দেখি তোমরা, আমাদের পৌরাণিক গল্পগুলির সাথে ভূগোলের মিল কোথায়?” এরকম ভাবে আরম্ভ করা
যেতে পারে। প্রশ্নটা শুনে নিশ্চয়ই আগ্রহ জাগবে ওদের মনে। চোখ কুঁচকে মিনিট দুয়েক ভাববে, তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করবে–
“কোথায় মিল সার?”
“কেন? দেবদেবীদের কথা ভুলে গেলে?” বিজয়গর্বে পালটা প্রশ্ন করব আমি। “দেবদেবীদের বিষয়টাতেই তো মিল ভুগোল আর পুরাণের।”
ওরা একে অপরের দিকে তাকাবে, ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করবে, “সার কি ঠাট্টা করছেন আমাদের সঙ্গে? মজার কথা বলছেন কিছু?” অবশেষে মিনমিনে দ্বিধাগ্রস্ত গলায় কেউ একজন বলে উঠবে : “কিছু বুঝতে পারছি না তো সার।”
“ভাবো, ভাবো,” বলব আমি। “ভাল করে ভেবে দেখলেই ঠিক বুঝতে পারবে। তখন দেখবে শুধু দেবদেবী কেন, অনেক বিষয়েই মিল আছে পুরাণ আর ভূগোলের মধ্যে। একেকটা পৌরাণিক কাহিনির নায়কদের কথা ভাবো, কী বিশাল তাদের চেহারা–এক দিকে এই সব স্বর্গের দেবদেবীরা, আরেক দিকে এই মাটির পৃথিবীর বিপুল প্রাণস্পন্দন–দুটোই আমাদের কাছে যেন অচেনা, অনেক দূরের কোনও জগৎ। আবার, পুরাণেই বলো কি ভূগোলেই বলো, দেখবে কাহিনিগুলো বা ঘটনাগুলো একের পর এক সব এমনভাবে চলতে থাকে যে প্রতিটা ঘটনারই একটা শুরু আর শেষ থাকে, কিন্তু একটা ঘটনার সঙ্গে পরেরটার একটা যোগ থেকে যায়। একটা কাহিনির শেষ থেকেই গজিয়ে ওঠে আরেকটা কাহিনি। তার পরে ধরো, সময়ের হিসেব–ওদিকে যেমন কলিযুগ, এদিকে তেমনি ভূগঠনের চতুর্থ যুগ। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা খেয়াল করো–এই দুই ক্ষেত্রেই কিন্তু ঘটনাগুলো ঘটছে বিশাল সময় জুড়ে, কিন্তু এমন ভাবে সব কিছু হচ্ছে যে খুব ছোট করেও সেই গল্পগুলি বলে দেওয়া যায়।”
“কী করে, সার, কী করে? এরকম একটা গল্প বলুন না, সার।”
তখন আমি শুরু করব।
বিষ্ণুর উপাখ্যান দিয়েই শুরু করতে পারি। বামনাবতার রূপে কীভাবে মাত্র তিনটি বিশাল পদক্ষেপে গোটা পৃথিবীকে মেপে ফেলেছিলেন বিষ্ণু, সেই কাহিনি শোনাতে পারি। আমি ওদের বলব কেমন ভাবে ভগবানের সেই চলার পথে একবার একটুখানি ভুল পা ফেলার জন্য তাঁর পায়ের একটা লম্বা নখের ছোট্ট একটু আঁচড় লেগে গেল পৃথিবীর গায়ে। সেই আঁচড়ের দাগ থেকেই সৃষ্টি হল আমাদের এই চিরকালের চেনা নদী–যুগ যুগান্ত ধরে যে জগতের সমস্ত পাপ ধুয়ে নিয়ে চলেছে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নদী–আমাদের এই গঙ্গা।
“গঙ্গা? পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নদী?” আমার কথার মারপ্যাঁচে এত উত্তেজিত হয়ে যাবে ওরা যে আর বসে থাকতে পারবে না। উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে বলবে, “কিন্তু সার, গঙ্গার থেকে লম্বা তো অনেক নদীই আছে : নীলনদ আছে, আমাজন আছে, মিসিসিপি আছে, ইয়াংসিকিয়াং আছে।” তখন আমি বের করব আমার গুপ্তধন, আমার এক ছাত্রের পাঠানো উপহার–সেটা হল ভূতাত্ত্বিকদের বানানো সাগরতলের একটা ম্যাপ। উলটো রিলিফ ম্যাপের মতো সে মানচিত্রে নিজের চোখেই দেখতে পাবে ওরা যে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছেই গঙ্গার যাত্রা শেষ হয়ে যায়নি–ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিশে সমুদ্রের নীচে স্পষ্ট এক খাত ধরে আরও বহু দূর বয়ে চলে গেছে। এমনিতে যা জলের তলায় ঢাকা পড়ে থাকে, এই ম্যাপে ওরা তা দেখতে পাবে : দেখতে পাবে মাটির ওপর দিয়ে যতটা পথ গেছে গঙ্গা, তার চেয়ে অনেক দীর্ঘ পথ বয়ে গেছে সমুদ্রের তলার খাত ধরে।
“দেখো, বন্ধুগণ, নিজের চোখেই দেখে নাও,” বলব আমি। “এই ম্যাপে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে পুরাণে যেমন বলা আছে ঠিক তেমনই একটা দৃশ্য গঙ্গা আর একটা লুপ্ত গঙ্গা সত্যি সত্যিই রয়েছে; একটা বয়ে চলেছে মাটির ওপর দিয়ে, আরেকটা বইছে জলের তলা দিয়ে। এবার দুটোকে জুড়ে নাও, তারপর দেখো গঙ্গা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নদী কি না।”
আর তার পরে, আমি ঠিক করলাম, ওদের সেই গ্রিক দেবীর গল্প শোনাব যিনি আমাদের এই গঙ্গার আসল মা। ভূগোলের পথ ধরে বহু বহু যুগ পিছিয়ে নিয়ে যাব ওদের, দেখাব এখন যেখান দিয়ে গঙ্গার ধারা বয়ে চলেছে সেই রেখা এক সময় ছিল উপকূল রেখা–এশীয় ভূখণ্ডের সর্বদক্ষিণ তটভূমি। এই ভারতবর্ষ তখন অনেক অনেক দুরে, অন্য গোলার্ধে। অস্ট্রেলিয়া আর অ্যান্টার্কটিকার সঙ্গে জোড়া ছিল এই দেশ তখন। আমি ওদের দেখাব এশিয়ার দক্ষিণের সেই সমুদ্র, যার নাম ছিল টেথিস। গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী টেথিস হলেন ওশেনাসের পত্নী। হিমালয় তখন ছিল না, আর এই সব পুণ্যতোয়া নদী–গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী, ব্রহ্মপুত্র তারা তখন কোথায়? আর নদী যেহেতু ছিল না, তাই কোনও ব-দ্বীপও ছিল না। এই বন্যাবিধৌত সমভূমিই বলো, কি পলল মৃত্তিকাই বলো, বা এই বাদাবনই বলো–এসবেরও কোনও চিহ্ন ছিল না। এক কথায়, আমাদের এই বাংলারই কোনও অস্তিত্ব ছিল না তখন। তামিলনাড়ু আর অন্ধ্রপ্রদেশের এই সবুজ তীরভূমি তখন জমাট বরফে ঢাকা, কোনও কোনও জায়গায় সে বরফ পঞ্চাশ থেকে ষাট মিটার পর্যন্ত গভীর। এখন যেটা গঙ্গার দক্ষিণ কূল, সে জায়গা তখন বরফ-জমা এক সাগরতীর–ক্রমশ ঢালু হয়ে নেমে গেছে টেথিস সমুদ্রে, যে সমুদ্রের এখন আর কোনও অস্তিত্ব নেই।
আমি ওদের বলব কেমন করে আজ থেকে চোদ্দো কোটি বছর আগে অস্ট্রেলিয়া আর অ্যান্টার্কটিকা থেকে হঠাৎ ভেঙে বেরিয়ে এসে ভারতবর্ষ শুরু করল তার উত্তরমুখী যাত্রা। ওরা দেখবে কী বেগে ওদের এই উপমহাদেশ এগিয়ে চলেছে, পৃথিবীর অন্য কোনও ভূখণ্ডই কখনও সেই বেগ, অর্জন করতে পারেনি। ওরা দেখবে কীভাবে বিশাল এই ভূভাগের ওজনের চাপে ধীরে ধীরে গজিয়ে উঠছে হিমালয় পর্বত; দেখবে সেই বেড়ে ওঠা পর্বতমালার গায়ে কেমন করে জন্ম নিচ্ছে তিরতিরে একটা ছোট্ট নদী–আমাদের এই গঙ্গা। চোখের সামনে ওরা দেখতে পাবে ভারত যত উত্তরে এগোচ্ছে তত ছোট হয়ে আসছে টেথিস, ক্রমশ সরু হয়ে আসছে মাঝের ফাঁকটুকু। ওরা দেখবে কীভাবে আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল সে সমুদ্র কেমন করে দুই ভূখণ্ড মিলে এক হয়ে গেল তাদের সাগর-মায়ের অস্তিত্বের মূল্যে। কিন্তু চোখের সামনে টেথিসের মৃত্যু দেখেও এতটুকু অশ্রুপাত করবে না ওরা, কারণ সঙ্গে সঙ্গে ওদের সামনেই তো জন্ম নেবে দুই নদী, যাদের মধ্যে ধরা থাকবে তার স্মৃতি, জন্ম নেবে টেথিসের দুই যমজ সন্তান–সিন্ধু আর গঙ্গা।
“বলতে পার, কেমন করে বলা যায় যে এক সময় সিন্ধু আর গঙ্গা নদী পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত ছিল?”
“কী করে বলা যায় সার?”
“এই শুশুকদের দেখে। এক সময়কার সাগরবাসী এই প্রাণীই হল দুই যমজ নদীর জন্য রেখে যাওয়া টেথিস সমুদ্রের উত্তরাধিকার। সে উত্তরাধিকারকে সযত্নে লালন করেছে এই দুই নদী, আস্তে আস্তে আপন করে নিয়েছে তাকে। সিন্ধু আর গঙ্গা ছাড়া পৃথিবীর আর কোনও নদীতেই এই জাতের শুশুক দেখতে পাওয়া যায় না।”
শুনতে শুনতে যদি দেখি অধৈর্য হয়ে পড়ছে ওরা, তখন এক প্রেমের গল্প বলে আমি শেষ করব আমার কথা। শান্তনু নামের সেই রাজার কথা বলব আমি ওদের, কেমন করে নদীর পাশ দিয়ে যেতে যেতে রাজা একদিন পরমাসুন্দরী একটি মেয়েকে দেখলেন সেই কাহিনি শোনাব আমি। সেই সুন্দরী আর কেউ নন, স্বয়ং গঙ্গা। কিন্তু রাজা সে কথা জানেন না। নদীর পাড়ে এলে যে কোনও স্থিতধী মানুষেরই মাথা ঘুরে যেতে পারে। তো, এই সুন্দরীকে দেখে শান্তনুর খুবই ভাল লেগে গেল, পাগলের মতো তার প্রেমে পড়ে গেলেন তিনি; রাজা প্রতিজ্ঞা করলেন রূপবতী যা চাইবেন তাই তাঁকে দেবেন তিনি, এমনকী তিনি যদি নিজের সন্তানদের জলে ভাসিয়ে দিতে চান তাতেও বাধা দেবেন না।
নদীর তীরে এক রাজার এই মুহূর্তের হৃদয়দৌর্বল্যের কাহিনি থেকে শুরু করেই লেখা হয়ে গেল মহাভারতের গোটা একখানা পর্ব।
সেকালের পুরাণকাররাও যে সত্যকে মেনে নিয়েছিলেন সামান্য এক স্কুলমাস্টার কী করে তাকে অস্বীকার করবে? যে-কোনও নদীতেই আসলে বয়ে চলে ভালবাসার স্রোত। “ছেলেমেয়েরা, এই তা হলে আজকের পড়া। এবার শোনো কবি কী বলেছেন :
“এক কথা, প্রেয়সীকে গান গাওয়া। আর, হায়, অন্য এক কথা
সেই গুপ্ত, অপরাধী শোণিতের দেবতুল্য নদ।”