» » » » স্যার ড্যানিয়েল

বর্ণাকার

স্যার ড্যানিয়েল

“ভাটির দেশের সঙ্গে মরুভূমির অনেক মিল আছে”, বলেছিল নির্মল। “যেমন ধরো, মরুভূমির মতো এখানেও মরীচিকা দেখা যায় যা নেই তাও দেখতে পায় মানুষ। স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিলটনও দেখেছিলেন। ভাটির দেশের কাঁকড়ায় ভরা নদীতীর দেখে স্কটল্যান্ড থেকে আসা সাহেবের মনে হয়েছিল কাদামাটি নয়, সোনার চেয়েও ঝকমকে কিছু দিয়ে তৈরি এ জায়গাটা। কত দাম হতে পারে এখানকার এই কাদার, বলেছিলেন উনি। ‘বাংলাদেশের এক একর জমি পনেরো মণ ধান ফলাতে পারে। কিন্তু এক বর্গমাইল সোনায় কী ফসল হবে? কিছুই না।’ “

আঙুল তুলে দেওয়ালে ঝোলানো একটা পোর্ট্রেট দেখিয়েছিল নির্মল। “দেখো, এই হল ড্যানিয়েল হ্যামিলটনের নাইটহুড পাওয়ার দিনের ছবি। এইদিন থেকেই স্যার উপাধি বসল ওঁর নামের আগে–উনি হলেন স্যার ড্যানিয়েল।”

ছবির সাহেবের পায়ে মোজা, বকলস-বাঁধা জুতো, হাঁটু অবধি ব্রিচেস আর পরনে জ্যাকেট, পেতলের বোতাম আঁটা। নাকের নীচে ঝুপো সাদা গোঁফ, কোমরে বেল্টের সঙ্গে মনে হয় একটা তলোয়ার বাঁধা; সেটার বাঁটটা শুধু দেখা যাচ্ছে। চোখদুটো দেখলে মনে হয় সরাসরি তাকিয়ে আছে দর্শকের দিকে, মায়ামাখা দৃষ্টিতে খানিকটা কঠোরতার ছায়া। তার সঙ্গে মিশে আছে একটু রূঢ়তা আর কিছুটা খ্যাপামি। সব মিলিয়ে চোখদুটোতে এমন একটা কিছু ছিল, যে অস্বস্তি হচ্ছিল কানাইয়ের। ছবির হ্যামিলটনের নজর এড়ানোর জন্যে মেসোর আড়ালে সরে গিয়েছিল ও।

“স্যার ড্যানিয়েলের শিক্ষা শুরু হয়েছিল স্কটল্যান্ডে,” বলে চলেছিল নির্মল। “সে দেশের প্রকৃতি ছিল রুক্ষ আর পাথুরে, প্রচণ্ড ঠান্ডা আর নির্মম। ইস্কুলে মাস্টারমশাইদের কাছে উনি শিখেছিলেন কঠোর পরিশ্রমের কোনও বিকল্প নেই। একমাত্র পরিশ্রম দিয়েই সবকিছুকে জয় করা যায়–পাহাড় পাথর সবকিছু। কাদামাটিও। তো, সে সময়কার বেশিরভাগ স্কটল্যান্ডবাসীর মতো ড্যানিয়েল হ্যামিলটনও একদিন বের হলেন ভাগ্যের সন্ধানে। যাওয়ার জায়গা ছিল একটাই–স্বপ্নের দেশ, সোনার দেশ ভারতবর্ষ। এসে পৌঁছলেন কলকাতায়। পারিবারিক যোগাযোগের সূত্রে কাজও জুটে গেল একটা, ম্যাকিনন ম্যাকেঞ্জিতে। ম্যাকিন ম্যাকেঞ্জি তখন পি অ্যান্ড ও জাহাজ কোম্পানির জন্য টিকিট বেচত। জাহাজের ব্যবসায় সেকালের দুনিয়ায় পি অ্যান্ড ও-র ধারেকাছে কেউ ছিল না। হ্যামিলটনের জোয়ান বয়স, খাটতেও পারতেন খুব, দিনরাত পরিশ্রম করে প্রচুর টিকিট বিক্রি করে দিলেন–ফার্স্ট ক্লাস, সেকেন্ড ক্লাস, থার্ড ক্লাস, স্টিয়ারেজ–সবরকমের টিকিট। কলকাতা বন্দর থেকে একেকটা জাহাজ ছাড়ত আর শত শত টিকিট বিক্রি হত। টিকিট এজেন্ট মাত্র একজন। কাজেই হ্যামিলটনের তো পোয়াবারো। উন্নতির সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠতে উঠতে কিছুদিনের মধ্যেই একেবারে কোম্পানির কর্তা হয়ে বসলেন। বিশাল ধনসম্পত্তির মালিক হ্যামিলটন হয়ে উঠলেন ভারতের সবচেয়ে ধনী লোকেদের একজন। উনি ছিলেন, যাকে বলে মনোপলি ক্যাপিটালিস্ট। এত ধনসম্পদ উপার্জন করার পর অন্য যে-কোনও লোক হয় এখানকার পাততাড়ি গুটিয়ে দেশে ফিরে যেত, নয়তো আরাম-বিলাসে পয়সা ওড়াত–এটাই ছিল সে সময়ের দস্তুর। কিন্তু স্যার ড্যানিয়েল ছিলেন অন্য ধাতুতে গড়া।”

“কেন?”

“ধীরে বৎস, ধীরে। সে কথায় আসব আমরা। তার আগে একবার দেওয়ালের ওই ছবির দিকে তাকাও, তারপর চোখ বন্ধ করে কল্পনা করো, এই সায়েব, স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিলটন, খাড়া দাঁড়িয়ে আছেন পি অ্যান্ড ও কোম্পানির জাহাজের ডেকে, ভেঁপু বাজিয়ে জাহাজ কলকাতা ছেড়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে বঙ্গোপসাগরের দিকে। সহযাত্রী অন্য সাহেব-মেম যাঁরা আছেন তারা যে যার মতো হাসছেন গাইছেন পানভোজন ফুর্তিতে মেতে আছেন। স্যার ড্যানিয়েল কিন্তু সেসবের মধ্যে নেই। ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি তখন দু’ চোখ ভরে পান করছেন চারপাশের দৃশ্য–এই বিশাল নদী, এই কাদামাটির চর, এই ম্যানগ্রোভে ঢাকা দ্বীপ। দেখতে দেখতে সাহেবের মনে হল, ‘এই জায়গাগুলো খালি পড়ে আছে কেন? কেন কেউ এই দ্বীপগুলিতে থাকে না? এতসব জমি শুধু পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে?’ জংলা দ্বীপগুলোর দিকে সাহেবকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে দেখে জাহাজের এক খালাসি এগিয়ে এল। আঙুল তুলে দূরে ইশারা করে বলল, “ওই দেখুন স্যার, জঙ্গলের মধ্যে একটা মন্দির দেখা যাচ্ছে। আর ওইদিকে দেখুন, একটা মসজিদ। এসব জায়গায় একসময় মানুষের বাস ছিল, কিন্তু ঝড়-ঝঞ্ঝা আর বাঘ-কুমিরের উপদ্রবে লোকে টিকতে পারেনি। তাই নাকি? স্যার ড্যানিয়েল বললেন, ‘একসময়ে যদি এখানে মানুষের বাস থেকে থাকে, তা হলে তো নতুন করে আবার বসতি গড়ে তোলাই যায়। আর এমন কিছু দূরধিগম্যও নয় জায়গাটা, ভারতের প্রবেশপথই বলা যেতে পারে বিশাল একটা উপমহাদেশে ঢোকার দরজায় একেবারে। পুবদিক থেকে এসে যারাই গাঙ্গেয় সমভূমিতে ঢোকার চেষ্টা করেছে তাদের প্রত্যেককে এখান দিয়ে যেতে হয়েছে, সে তোমার আরাকানিদেরই বললো, কি খমেরদেরই বলো অথবা যবদ্বীপের লোকেদের, কি ওলন্দাজ, মালয়ি, চিনে, পর্তুগিজ, ব্রিটিশ সক্কলকে। অনেকেই জানে এই ভাটির দেশের সবকটা দ্বীপে মানুষ থাকত কোনওনা-কোনও সময়। কিন্তু দেখে বলবে কার সাধ্যি? আসলে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের বৈশিষ্ট্যই হল এই। শুধু দ্বীপের পর দ্বীপ গিলে ফেলেই ক্ষান্ত হয় না, সময়কে একেবারে মুছে ফেলে দেয় এ জঙ্গল। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নতুন নতুন প্রেতের জন্ম দিয়ে চলে।

“কলকাতায় ফিরে এসেই হ্যামিলটন খোঁজ শুরু করলেন, কার কাছে এইসব জায়গার সম্পর্কে আরও খবর পাওয়া যায়। বিভিন্ন লোকের সঙ্গে কথাবার্তা বলে জানতে পারলেন ওখানকার সব সমস্যার চেয়ে বড় সমস্যা হল খোদ ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট। পুরো সুন্দরবনটাকে ওরা ওদের জমিদারি মনে করে। কিন্তু ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টকে গোড়াই কেয়ার করেন হ্যামিলটন। ১৯০৩ সালে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ভাটির দেশের দশ হাজার। একর জমি কিনে নিলেন উনি।”

“দশ হাজার একর! সেটা কতটা জায়গা?”

“সে বহু দ্বীপ কানাই, বহু বহু দ্বীপ। সরকার অবশ্য খুশি হয়েই বেচে দিয়েছিল সেগুলি। ফলে গোসাবা, রাঙ্গাবেলিয়া, সাতজেলিয়া–এইসব জায়গা চলে এল হ্যামিলটনের দখলে। এই নামগুলির সঙ্গে পরে যোগ হল আমাদের এই দ্বীপের নাম, এই লুসিবাড়ির। সায়েব অবশ্য চেয়েছিলেন তার নতুন জমিদারির নাম হবে অ্যান্ড্রপুর, স্কটল্যান্ডের সেন্ট অ্যান্ড্রর নামে। এই সেন্ট অ্যান্ড্র শুরুতে ছিলেন খুব গরিব, সোনাদানা তার কিছুই ছিল না। পরবর্তী জীবনে তিনি প্রচুর টাকার মালিক হন। কিন্তু অ্যান্ড্রপুর নামটা চলল না। লোকের মুখে মুখে জমিদারির নাম হল হ্যামিলটনাবাদ। দিনে দিনে তোক যত বাড়তে লাগল, নতুন নতুন সব গ্রাম গজিয়ে উঠল, আর স্যার ড্যানিয়েল সেগুলোর নতুন নতুন নাম দিতে লাগলেন। যেমন একটা গ্রামের নাম দিয়েছিলেন সব নমস্কার’, আরেকটার নাম ‘রজত জুবিলি’, এইরকম। এই দ্বিতীয় নামটা বোধহয় কোনও রাজা মহারাজার রজত জয়ন্তী উপলক্ষে দেওয়া হয়েছিল। এর পরে সাহেব তার আত্মীয়স্বজনদের নামে বিভিন্ন গ্রামের নাম দিতে শুরু করলেন–জেমসপুর, অ্যানপুর, এমিলিবাড়ি। এই লুসিবাড়ির নামটাও সেভাবেই হয়েছে।”

“কারা থাকত এইসব জায়গায়।”

“শুরুতে কেউই থাকত না। একটা কথা খেয়াল রাখতে হবে–সে সময় এই জায়গাগুলি ছিল গভীর বন। কোনও লোকজন ছিল না, বাঁধ ছিল না, খেতজমি কিছু ছিল । শুধু কাদার বাদা আর ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। জোয়ারের সময় বেশিরভাগ অঞ্চল জলে ডুবে যেত। আর চারদিকে হিংস্র বন্য জন্তু–বাঘ, কুমির, কামট, লেপার্ড।”

“তা হলে লোকে কেন এল এখানে?”

“জমির জন্য এল। একটা সময় ছিল যখন লোকে এক-দু’ বিঘা জমির জন্য নিজেদের বিক্রি করে দিত। আর এই জায়গাটা তো দেশেরই মধ্যে, কলকাতা থেকে বেশি দূরেও নয়। জাহাজে করে বার্মা কি মালয় কি ফিজি কি ত্রিনিদাদ তো যেতে হল না। আর সবচেয়ে বড় কথা এখানে জমি পাওয়া যাচ্ছিল বিনে পয়সায়, একেবারে মুফতে।”

“সেইজন্য লোকে চলে এল?”

“শুধু চলে এল নয়, হাজারে হাজারে এল, আসতেই থাকল। হ্যামিলটন সাহেব বলেছিলেন যে কেউ গতরে খাটতে রাজি থাকবে সেই জমি পাবে। তবে হ্যাঁ, একটা শর্তে। ওইসব বিভেদ-বিবাদ জাতপাত এখানে চলবে না। তুমি বামুন কি শুদ্র, বাঙালি কি উড়িয়া সেসব ভুলে যেতে হবে। সবাইকে একসঙ্গে থাকতে হবে, একসঙ্গে খেটে যেতে হবে। যেই না এ খবর ছড়িয়ে পড়ল, অমনি স্রোতের মতো মানুষ আসতে লাগল উত্তর উড়িষ্যা থেকে, পুব বাংলা থেকে, সাঁওতাল পরগণা থেকে। নৌকো করে এল, ডিঙি করে এল, হাতের সামনে যা পেল তাতে করেই চলে এল। হাজারে হাজারে। ভাটার সময় তারা দা-কাটারি দিয়ে জঙ্গল সাফ করত, আর জোয়ার এলে মাচার ওপর বসে অপেক্ষা করত কখন জল নামবে। রাত্তিরে তারা উঁচু গাছের ওপর দোলনার মতো বানিয়ে তার ওপর ঘুমোত, জোয়ারের জলে যাতে ভেসে না যায়।

অবস্থাটা একবার কল্পনা করার চেষ্টা করো: প্রতিটা দ্বীপে অসংখ্য নদী-খাঁড়ি আর জঙ্গলে বাঘ, কুমির, সাপ কিলবিল করছে। তাদের তো একেবারে ভোজ লেগে গেল। শত শত লোককে বাঘে খেল, কুমিরে নিল, সাপে কাটল। এত লোক মরতে লাগল যে স্যার ড্যানিয়েলকে পুরস্কার ঘোষণা করতে হল। যে-ই একটা বাঘ বা কুমির মারতে পারবে সে-ই পুরস্কার পাবে।”

“কিন্তু কী দিয়ে মারবে?”

“খালি হাতে মারবে, ছুরি দিয়ে মারবে, বাঁশের তৈরি বর্শা দিয়ে মারবে। যা পাবে তাই দিয়ে মারবে। হরেনকে মনে আছে তোমার? যে আমাদের ক্যানিং থেকে নৌকো করে নিয়ে এল?”

“মনে আছে,” মাথা নাড়ল কানাই।

“ওর কাকা বলাই একবার মাছ ধরতে যাওয়ার সময় একটা বাঘ মেরেছিল। স্যার ড্যানিয়েল ওকে দু’ বিঘে জমি দিলেন, এই লুসিবাড়িতে। তারপর তো বহু বছর বলাই এ দ্বীপে বীরের সম্মান পেত।”

“কিন্তু স্যার ড্যানিয়েল কেন করেছিলেন এসব? টাকার জন্যে?”

“না। টাকার আর দরকার ছিল না সাহেবের। উনি চেয়েছিলেন একটা নতুন ধরনের সমাজ গড়তে, একটা নতুন দেশ গড়তে। ওঁর ইচ্ছে ছিল সে দেশটা চলবে সমবায় পদ্ধতিতে। সেখানে প্রত্যেকের জন্য জমি থাকবে, কেউ কাউকে শোষণ করবে না। এ নিয়ে মহাত্মা গাঁধী রবীন্দ্রনাথের মতো সব বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন স্যার ড্যানিয়েল। বুর্জোয়ারা তার সঙ্গে একমত হলেন। ঠিক হল একেবারে অন্যরকম একটা দেশ তৈরি হবে এখানে একটা আদর্শ দেশ।”

“কিন্তু এটা দেশ কী করে হবে? তখন তো কিছুই নেই এখানে রাস্তাঘাট নেই, ইলেকট্রিসিটি নেই…”

নির্মল একটু হেসেছিল। “সে সবই হয়েছিল।” দেওয়ালের দিকে দেখিয়ে বলেছিল, “ওইদিকে একবার তাকাও।” কানাই তাকিয়ে দেখল দেওয়ালের ধার ঘেঁষে একটা রং জ্বলে যাওয়া ইলেকট্রিকের তার চলে গেছে ঘরের একদিক থেকে অন্যদিকে। “দেখেছ তো? বিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছিলেন স্যার ড্যানিয়েল। শুরুর দিকে একটা বিশাল জেনারেটর ছিল এখানে, ঠিক স্কুলটার পাশে। পরে ওটা খারাপ হয়ে যায়। তদ্দিনে সাহেবও মারা গেছেন, আর অন্য কেউ উদ্যোগ নিয়ে ওটা সারাবার ব্যবস্থা করেনি।”

একটা টেবিলের পাশে নিচু হয়ে বসে আরেক গোছা তার দেখিয়েছিল নির্মল। “এই দেখো। টেলিফোনও ছিল এখানে। এমনকী কলকাতাতেও ফোন চালু হওয়ার আগে গোসাবায় টেলিফোন এনেছিলেন স্যার ড্যানিয়েল। সমস্ত কিছুর ব্যবস্থা করেছিলেন সাহেব এই দ্বীপগুলিতে, কিচ্ছু বাকি রাখেননি। গোসাবায় একটা সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ছিল, এমনকী আলাদা টাকাও ছিল–গোসাবা মুদ্রা।”

দেওয়ালের গায়ে সারি সারি বইয়ের তাকগুলোর কাছে গিয়ে একটা ধূলিধূসরিত ঘেঁড়া কাগজের টুকরো নামিয়ে এনেছিল নির্মল। “এই দেখ, একটা ব্যাঙ্কনোট। কী লেখা আছে দেখেছ? ‘এ শুধু নিষ্প্রাণ মুদ্রা নয়, এই নোটের পেছনে আছে জীবিত মানুষ। এমনিতে এর দাম কানাকড়িও নয়, কিন্তু এর প্রকৃত মূল্য প্রচুর–যতটা জঙ্গল সাফাই হবে, যতগুলি পুকুর কাটা হবে, যতগুলি ঘরবাড়ি তৈরি হবে, তার একশো শতাংশ। এক সুস্থ, পরিপূর্ণ জীবনের সমান এ ব্যাঙ্কনোটের মূল্য।”

কাগজটা কানাইয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল নির্মল। “ভাল করে দেখে নাও। পড়ে মনে হয় যেন খোদ কার্ল মার্ক্স লিখেছেন। এ তো পরিষ্কার লেবার থিয়োরি অব ভ্যালু। কিন্তু নীচে সইটা দেখো। কী লেখা আছে? স্যার ড্যানিয়েল ম্যাকিনন হ্যামিলটন।”

কাগজের টুকরোটা হাতে নিয়ে উলটে পালটে দেখছিল কানাই। “কিন্তু উনি কীসের জন্য করেছিলেন এইসব? পয়সা রোজগারের দরকার না থাকলে এত কষ্ট কেন করতে গেলেন হ্যামিলটন? আমার তো মাথায় ঢুকছে না।”

“তোমার কী মনে হয় কানাই?” জিজ্ঞেস করেছিল নির্মল। “আসলে সাহেবের একটা স্বপ্ন ছিল। যারা স্বপ্নের পেছনে ছোটে তারা যা চায়, স্যার ড্যানিয়েলও তাই চেয়েছিলেন। উনি চেয়েছিলেন একটা দেশ গড়তে যেখানে কোনও শোষণ-বঞ্চনা থাকবে না, সমাজে উঁচু-নিচু ভেদ থাকবে না, তুচ্ছ সব বিষয় নিয়ে বিবাদ-বিসংবাদ থাকবে না। উনি স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন একটা জায়গার যেখানে সব্বাই পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে সক্কলে–সকালবেলায় হবে চাষি, দুপুরে কবি, আর সন্ধ্যাবেলায় ছুতোরমিস্ত্রি।”

হো হো করে হেসে উঠেছিল কানাই। “কী হাল হয়েছে সেই স্বপ্নের। রয়ে গেছে শুধু কতগুলো পোকায়-খাওয়া ইঁদুরে-কাটা দ্বীপ।”

এইটুকু একটা বাচ্চা ছেলের থেকে এতটা বিদ্রূপ ঠিক আশা করেনি নির্মল। একটু হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। খানিকটা খাবি খাওয়ার মতো ভাব করে শেষে বলেছিল, “হেসো না কানাই। আসলে এসব কিছুর জন্য তখনও প্রস্তুত হয়ে উঠতে পারেনি এই ভাটির দেশ। কে বলতে পারে, হয়তো কোনওদিন সত্যি হয়ে উঠতে পারে হ্যামিলটন সাহেবের সেই স্বপ্ন।”