ময়না
কানাই নীলিমার দরজায় গিয়ে আবার যখন কড়া নাড়ল তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে বিছানা থেকে উঠে মাসি জামাকাপড় পালটে নিয়েছে দেখে ভাল লাগল ওর।
“আরে কানাই,” নীলিমা ডাকল হাসিমুখে, “আয় আয়, ভেতরে আয়।”
সকালের মন খারাপের এতটুকুও চিহ্ন নেই আর মাসির মুখে। কানাই আন্দাজ করল নিশ্চয়ই এতক্ষণ অফিসে কাজকর্ম করে মুড ভাল হয়ে গেছে। মেসো মারা যাওয়ার ধাক্কা, এতগুলো বছরের একাকিত্ব তা হলে এভাবেই ভুলে থেকেছে মাসি–কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রেখে।
“ময়নাকে খবর দিয়েছি, এক্ষুনি এসে যাবে ও,” বলল নীলিমা, “তোকে নিয়ে একবার হাসপাতালটা ঘুরিয়ে দেখাতে বলেছি ওকে।”
“ময়না করেটা কী এখানে?” কানাই জিজ্ঞেস করল।
“ও এখানকার ট্রেনি,” নীলিমা জবাব দিল। “অনেক বছর ধরে এই ট্রাস্টে কাজ করছে, সেই আমরা যখন ‘বেয়ারফুট নার্স প্রোগ্রাম’ চালু করেছিলাম তখন থেকে। ওই প্রোজেক্টটা নেওয়া হয়েছিল এখানকার সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছনোর জন্য, দূরদূরান্তের গ্রামের লোকেরাও যাতে কিছু অন্তত চিকিৎসার সুবিধা পায় সেই জন্য। কয়েকজন নার্সকে আমরা সাধারণ কিছু ট্রেনিং দিয়ে দিয়েছিলাম–সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি, নিউট্রিশন, কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা, প্রসবের কাজ, আরও টুকিটাকি দু-একটা–যেমন কেউ জলে ডুবলে কী করতে হবে, এইসব। জলে ডোবার ঘটনা তো আকছার লেগেই আছে এখানে। তারপর ওই নার্সরা যার যার গ্রামে ফিরে গিয়ে নিজেরা ট্রেনিং ক্লাস চালায়।”
“কিন্তু তারপর তো ময়নার পদোন্নতি হয়েছে মনে হয়?”
“তা হয়েছে,” নীলিমা বলল। “এখন ও আর বেয়ারফুট নার্স নয়। হাসপাতালে পুরোদস্তুর নার্স হওয়ার জন্য ট্রেনিং নিচ্ছে। বছর কয়েক আগেই দরখাস্ত করেছিল, আর ওর রেকর্ডও বেশ ভাল ছিল, তাই হাসপাতালে নিয়ে নেওয়া হল ওকে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল এতদিন ও কাজ করছে আমাদের সঙ্গে, কিন্তু ও যে কে সেটাই জানতাম না আমরা মানে ও যে আমাদের কুসুমের ছেলের বউ সেটাই জানা যায়নি। একদিন ঘটনাচক্রে আমি জানতে পারলাম ব্যাপারটা।”
“কী করে?”
“আমি একদিন বাজারে গেছি, বুঝলি তো,” নীলিমা বলল, “হঠাৎ দেখি সেখানে ময়না, একটা ছোকরার সঙ্গে কথা বলছে; সঙ্গে একটা বাচ্চা। এখন, ফকিরকে এর আগে আমি যখন দেখেছি তখন তো ও বছর পাঁচেকের একটা বাচ্চা ছেলে। কাজেই বাজারে দেখে ওকে আমি চিনতে পারিনি। তো, আমি ময়নাকে জিজ্ঞেস করলাম, “এই ছোঁড়াটা তোর বর নাকি রে? ও বলে, ‘হা মাসিমা, আমার বর। জিজ্ঞেস করেছি, নাম কী রে ওর?’ বলে, ফকির মণ্ডল। এমনিতে নামটা খুবই কমন, কিন্তু আমি ঠিক বুঝতে পেরে গেছি। বললাম, এ কী রে? তুই কে বল তো? আমাদের কুসুমের ছেলে ফকির নাকি তুই?’ তো সে বলে ‘া।”
“যাক, তবু ভাল, কানাই বলল। “ফকির অন্তত নিরাপদে লুসিবাড়িতেই আছে।”
“ভাল হলে তো ভালই ছিল,” বলল নীলিমা, “কিন্তু খুব একটা ভাল নেই রে ওরা।”
“তাই? কেন?”
নীলিমা বলল, “ময়না মেয়েটা বেশ বুদ্ধিমতী, উচ্চাশাও আছে। বাড়ির দিক থেকে কোনও উৎসাহ ছাড়াই নিজের চেষ্টায় খানিকটা লেখাপড়া শিখেছে। ওদের গ্রামে কোনও স্কুল ছিল না, বেশ কয়েক কিলোমিটার হেঁটে আরেকটা গ্রামে গিয়ে রোজ স্কুল করত। ফাইনাল পরীক্ষাতেও ভালই করেছিল। তারপর ঠিক করল কলেজে ভর্তি হবে–ক্যানিং কি অন্য কোথাও। নিজে নিজেই সব ব্যবস্থা করে ফেলেছিল, এমনকী শিডিউলড কাস্ট সার্টিফিকেটও জোগাড় করেছিল, কিন্তু বাড়ির লোকেরা কিছুতেই যেতে দেবে না। ওকে আটকানোর জন্য বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলল। পাত্র ঠিক করল ফকিরকে। ছেলে হিসেবে ফকির এমনিতে সব দিক থেকেই ভাল, কিন্তু লেখাপড়া কিচ্ছু জানে না, নদী থেকে কাঁকড়া ধরে সংসার চালায়।
“তবে একটা ভাল ব্যাপার হল ময়না কিন্তু হাল ছাড়েনি,” বলল নীলিমা। “নার্স হবে বলে এমনই মনস্থির করে ফেলেছে ও, যে ট্রেনিং-এর সময়টা লুসিবাড়িতে থাকলে সুবিধে হবে বলে ফকিরকে পর্যন্ত নিয়ে চলে এসেছে এখানে।”
“ফকির খুশি তাতে?”
“মনে তো হয় না,” নীলিমা বলল। “মাঝে মাঝেই তো শুনি গণ্ডগোল হচ্ছে সেই জন্যই বোধহয় থেকে থেকেই ও নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। খুঁটিনাটি সব কিছু জানি না, মেয়েগুলো তো সব বলেও না আমায়। কিন্তু এটা জানি খুব ঝামেলার মধ্যে কাটছে ময়নার। আজকেই তো সকালে ভীষণ মনমরা দেখলাম ওকে।”
“তার মানে আজকে এসেছে ও কাজে?”
“হ্যাঁ, এসেছে তো,” নীলিমা বলল। “যে-কোনও সময় এসে যাবে এখানে। আমিই ওকে পাঠিয়েছি একবার হাসপাতালে, কয়েকটা ওষুধ এনে দেওয়ার জন্যে।
“কিন্তু ফকির কি আজকেও বাড়ি ফেরেনি?”
“না,” বলল নীলিমা, “আর চিন্তায় চিন্তায় বেচারি ময়নার মাথা খারাপ। সেজন্যেই ওকে বলেছি তোকে নিয়ে হাসপাতালটা দেখাতে, খানিকক্ষণ অন্তত যাতে অন্য কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকে।”
দরজায় খটখট করে আওয়াজ হল একটা। গলাটা একটু তুলে সাড়া দিল নীলিমা, “ময়না নাকি রে?”
“হ্যাঁ মাসিমা।”
“ভেতরে আয়।”
কানাই ফিরে দেখল মাথায় ঘোমটা দেওয়া অল্পবয়সি একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। খোলা দরজা দিয়ে বাইরের উজ্জ্বল আলো উপছে ঢুকে আসছে ঘরে, কিন্তু সেদিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে বলে ছায়া পড়েছে মেয়েটির মুখে, কানের দুলদুটো আর নথটা শুধু ঝিকমিক করছে; ওর ছায়া ছায়া ডিমাকৃতি মুখে নক্ষত্রপুঞ্জের তিনটে তারার মতো জ্বলজ্বল করছে সেগুলো।
“ময়না, এ হল কানাইবাবু,” আলাপ করিয়ে দিল নীলিমা, “আমার বোনপো।” ঘরের ভেতর ঢুকে এল মেয়েটি। বলল, “নমস্কার।”
“নমস্কার।” এখন আলো পড়েছে ময়নার মুখে, কাছে থেকে দেখেই কানাই লক্ষ করল একটু ধেবড়ে গেছে ওর চোখের কাজল। গায়ের রং মসৃণ কালো, কুচকুচে কালো চুল তেলে
মা টানা ভুরু, ‘পষ্ট চোয়াল; এক নজর দেখেই কানাই বলতে পারে সারা দুনিয়া ওর বিরুদ্ধে গেলেও নিজের জেদ রাখতে এ মেয়ে পিছপা হবে না। তবুও চোখের লালচে ভাব দেখে বোঝা গেল একটু আগেও কাঁদছিল ময়না।
“শোন কানাই,” ইংরেজিতে বলল নীলিমা, যাতে ময়না বুঝতে না পারে, “একটু সাবধান। মেয়েটার মন মেজাজ কিন্তু মনে হয় ভাল নেই।”
“ঠিক আছে মাসি,” বলল কানাই।
“রাইটি-ও, দেন,”নীলিমা বলল, “আই সাপোজ ইউ হ্যাড বেটার বি গোয়িং।”
“রাইটি-ও!” মাসিকে ইংরেজি বলতে এর আগে বিশেষ শোনেনি কানাই; এরকম স্পষ্ট সুন্দর উচ্চারণ শুনে আশ্চর্য হয়ে গেল ও। এত বছর এই ভাটির দেশে থেকে নীলিমার বাংলাটার থেকে শহুরে ছাপ মুছে এসেছে, প্রায় এখানকার লোকেদের ভাষার মতোই হয়ে গেছে সেটা। কিন্তু ইংরেজিটা বোধহয় বিশেষ ব্যবহার হয় না বলেই রজনের স্ফটিকের মধ্যে ফার্নের পাতার মতো অক্ষত রয়ে গেছে। সময়ের স্পর্শ তাতে পড়েনি, রোজকার ব্যবহারের মলিনতা ছুঁতে পারেনি ব্রিটিশ আমলের স্কুলে শেখা সে ইংরেজিকে। কানাইয়ের মনে হল যেন হারিয়ে যাওয়া কোনও ভাষা শুনছে ও, ফুরিয়ে যাওয়া সেই ঔপনিবেশিক যুগের উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজের মুখের ভাষা, যে ভাষা বলা হত সেকালের ইলোকিউশন স্কুল আর ডিবেটিং সোসাইটিতে শেখা স্পষ্ট দ্বিধাহীন উচ্চারণে।
হাসপাতালের রাস্তায় যেতে যেতে কানাই ময়নাকে জিজ্ঞেস করল, “মাসিমা কি আপনাকে বলেছেন যে আমি আপনার শাশুড়িকে চিনতাম?”
“না তো!” অবাক হয়ে কানাইয়ের দিকে তাকাল ময়না। “কিচ্ছু বলেননি তো মাসিমা। সত্যি চিনতেন?”
“হ্যাঁ,” কানাই বলল। “চিনতাম। অনেককাল আগে যদিও। ওর বয়েস তখন খুব বেশি হলে পনেরো-টনেরো হবে, আর আমি আরও ছোট।”
“কেমন ছিলেন উনি?”
“আমার যেটা মনে আছে সেটা হল ওর তেজ,” বলল কানাই। “ওইটুকু বয়েসেই খুব তেজি ছিল ও।”
মাথা নাড়ল ময়না। “লোকে বলে নাকি একটা ঝড়ের মতো ছিলেন উনি।”
“হ্যাঁ,” বলল কানাই। “সেরকমও বলা যেতে পারে। অবশ্য আপনি তো বোধহয় দেখেননি ওকে, তাই না?”
“না,” বলল ময়না। “উনি যখন মারা যান তখন তো আমি ছোট বাচ্চা। কিন্তু অনেক গল্প শুনেছি ওনার সম্পর্কে।”
“আপনার স্বামী কিছু বলেন না ওর কথা?”
কুসুমের কথা বলতে বলতে মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল ময়নার, কিন্তু ফকিরের প্রসঙ্গ উঠতেই আবার যেন মেঘ জমল সেখানে। “না,” ও বলল। “ও তো কখনও বলেই না ওনার কথা। আমার মনে হয় খুব একটা মনেও নেই ওর। উনি মারা যাওয়ার সময় তো ও খুবই ছোট ছিল–” কাধটা একটু ঝাঁকিয়ে কথাটা শেষ করে দিল ময়না। এ প্রসঙ্গটা আর না-টানাই ভাল মনে হল কানাইয়ের।
হাসপাতালের কাছাকাছি চলে এসেছিল ওরা। বাড়িটা কাছ থেকে দেখে নতুন করে বুঝতে পারল কানাই কী বিশাল কর্মযজ্ঞের পৌরোহিত্য করছে এখানে নীলিমা। এমনিতে যে বাড়িটা বিরাট বড় বা দেখতে খুব চমৎকার তা নয়–সাধারণ একটা দোতলা বাড়ি, চৌকো টাইপের জুতোর বাক্সর মতো দেখতে। ছাই-রঙা বাইরের দেওয়াল, আর সাদা বর্ডার টানা রয়েছে জানালা এবং লম্বা বারান্দার রেলিংগুলো বরাবর। সামনে একটা বাগান, তাতে বেশিরভাগই গাঁদাফুলের গাছ। কিন্তু সাধারণ হলেও, এই ভাটির দেশের কাদা আর ছাতলার মধ্যে ঝকঝকে তকতকে এই বাড়িটাকেই আকাশছোঁয়া বহুতলের মতো বলে মনে হচ্ছে। কানাইয়ের মনে হল শুধু এই বাড়িটা দেখেই অনেকটা ভরসা পাবে রোগীরা।
বাড়িটার বহিরঙ্গের সে প্রভাব ময়নার ওপরেও পড়েছে দেখা গেল। কানাইকে নিয়ে হাসপাতালে ঢুকতে ঢুকতেই একটা স্পষ্ট পরিবর্তন লক্ষ করা গেল ওর হাবেভাবে। প্রতিটি পদক্ষেপে মনে হল আরও ঋজু, আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে ওর চলাফেরার ভঙ্গি যেন বাড়িটার সংস্পর্শে আসতে-না-আসতেই সংসারভারগ্রস্ত এক স্ত্রী ও মায়ের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছে চটপটে পেশাদার একটা নতুন মানুষ।
হাসপাতালের গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে একটা দরজার সামনে কানাইকে নিয়ে এল ময়না। “এটা আমাদের মেটারনিটি ওয়ার্ড,” কথাটা বলার সময় গর্বে গলাটা যেন বুজে এল ওর।
এমনিতে হাসপাতাল-টাসপাতালের ব্যাপারে আদৌ কোনও আগ্রহ নেই কানাইয়ের। কিন্তু এই জায়গাটা ব্যতিক্রম: প্রতিটি ওয়ার্ড এত টিপটপ, দেখে অবাক না হয়ে পারল না ও। পুরো হাসপাতালটা তকতকে পরিষ্কার, আর যদিও মোটে চল্লিশটা বেড, কিন্তু হাসপাতালের আয়তনের তুলনায় ব্যবস্থাদির কোনও খামতি নেই। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সব পৃষ্ঠপোষকদের পয়সায় কেনা, বলল ময়না। তাদের মধ্যে দেশের লোকও আছে কিছু, আবার বিদেশিও অনেকে আছে। প্যাথোলজি ল্যাব আছে, একটা এক্স-রে রুম আছে, এমনকী একটা ডায়ালিসিস মেশিন পর্যন্ত আছে। হাসপাতালের ওপরের তলায় দু’জন। রেসিডেন্ট ডাক্তার থাকেন। তাদের মধ্যে একজন তো প্রায় দশ বছর আছেন এই লুসিবাড়িতে। অন্যজন ডাক্তারি পাশ করার পর ভেলোরের নামকরা হাসপাতালে প্রশিক্ষণ শেষ করে নতুন এসেছেন এখানে। ময়না বলল দু’জনকেই আশেপাশের সমস্ত দ্বীপের লোকজন খুব শ্রদ্ধা করে আর ভালবাসে। যে পেশেন্টই আসে হাসপাতালে, ডাক্তারবাবুদের জন্য হাতে করে কিছু না কিছু একটা নিয়ে আসে–কখনও একটা নারকেল, বা কিছু কেওড়া ফল, না হলে পাতায় মুড়ে একটা মাছ, কখনও বা দু-একটা মুরগি।
ময়না বলল এত নামডাক হয়ে গেছে এখন হাসপাতালটার যে দূরদূরান্ত থেকে রোগীরা এখানে দেখাতে আসে। এমনও অনেকে আসে এই লুসিবাড়ি হাসপাতালে যাদের পক্ষে ক্যানিং, এমন কী কলকাতা পর্যন্ত চলে যাওয়া এর তুলনায় সহজ হত। কারণ এখানকার সবাই জানে যে এ হাসপাতালে সামান্য খরচে যে যত্ন পাওয়া যায় সেরকম যত্ন অনেক জায়গায় অনেক পয়সা দিয়েও পাওয়া যায় না। আবার এত মানুষ এখানে যাতায়াত করে বলে এলাকার বেশ কিছু লোকের কিছু জীবিকার সংস্থান হয়েছে। গত কয়েক বছরে কতগুলো সাইকেল ভ্যানের স্ট্যান্ড হয়েছে। নতুন চায়ের দোকান আর গেস্ট হাউসগুলো তো রমরম করে চলছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এখন লুসিবাড়ির বেশিরভাগ লোকেরই জীবিকার উৎস এই হাসপাতাল।
দোতলায় উঠে ময়না দেখাল এ হাসপাতালে নির্মলের একমাত্র অবদান বিশাল একটা ওয়ার্ড, সাইক্লোন ঠেকানোর জন্য বিশেষভাবে বানানো। জানালাগুলিতে মোটা কাঠের পাল্লা দেওয়া, আর দরজাগুলো সব লোহার ফ্রেমে বাঁধানেনা। এমনিতে ট্রাস্টের কাজে কর্মে বিশেষ নাক গলাত না নির্মল, কিন্তু এই হাসপাতাল যখন তৈরি হয় তখন দেখতে এসেছিল যে সাইক্লোন ঠেকানোর ব্যবস্থা সব ঠিকমতো নেওয়া হয়েছে কিনা। সেরকম কিছু করা হয়নি শুনেই একেবারে আঁতকে উঠল–ভাটির দেশের বিধ্বংসী সব সাইক্লোনের ইতিহাস সবাই ভুলে গেছে নাকি? সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি লুসিবাড়িতে কখনও হবে না নাকি? নির্মলের নিবন্ধাতিশয্যেই শেষে তৈরি হল এই ওয়ার্ড।
দোতলার বারান্দা থেকে হাসপাতালের চারদিকের দোকানঘর আর ছোট ছোট কুঁড়েগুলো কানাইকে দেখাল ময়না। “ওদিকে দেখুন কানাইবাবু, দোকানগুলো দেখুন হাসপাতালের আশেপাশে। কত্তগুলো হয়েছে দেখেছেন?”
হাসপাতালটা নিয়ে ময়নার গর্ব দেখে বেশ ভাল লাগল কানাইয়ের, প্রায় অভিভূত হয়ে গেল ও। জিজ্ঞেস করল, “আপনি ফকিরকে কখনও নিয়ে এসেছেন এখানে?”
ছোট্ট করে একবার মাথা নাড়ল ময়না। “না।”
“কেন?”
মুখটা একটু বাঁকিয়ে বলল, “ও আসতে চায় না–বলে কেমন যেন লাগে ওর এখানে।”
“এখানে মানে–এই হাসপাতালে, না লুসিবাড়িতে?”
“দুটোই,” বলল ময়না। “এখানে ওর ভাল লাগে না।”
“কেন বলুন তো?”
“গাঁয়ে যেমন ছিল তার থেকে সব আলাদারকম এখানে।”
“কী রকম আলাদা?”
কাঁধ ঝাঁকাল ময়না। “ওখানে ও সব সময় টুটুলকে নিয়ে থাকত–টুটুল আমাদের ছেলে,” বলল ও। “ট্রাস্টের কাজের জন্যে আমাকে অনেকটা সময় বাইরে বাইরে থাকতে হত তো, আর ও সারাদিন টুটুলকে নিয়ে নদীতে নদীতে ঘুরত। কিন্তু এখানে আসার পর আমাকে সেটা বন্ধ করে দিতে হল।”
“তাই? কেন বন্ধ করতে হল?”
“কারণ টুটুলকে তো স্কুলে যেতে হবে, না কি?” একটু যেন ঝঝ ময়নার গলায়। “ও-ও বাপের মতো কঁকড়া ধরে বেড়াবে সেটা আমি চাই না। ওতে কোনও ভবিষ্যৎ আছে নাকি?”
“কিন্তু ফকির তো তাই করে।”
“করে তো, কিন্তু কতদিন আর করবে বলুন?” বলল ময়না। “মাসিমা তো বলেন নতুন যেসব জাল-টাল লোকে ব্যবহার করছে তাতে পনেরো বছরের মধ্যে নদীতে মাছ আর কিছু থাকবে না।”
“কী নতুন জাল?”
“ওই যে সব নাইলন জাল চালু হয়েছে এখন। চিংড়ির মীন–মানে বাগদা চিংড়ির পোনা–ধরে ওতে করে। জালের ফুটোগুলো এত ছোট যে তাতে মীনের সঙ্গে অন্য সব মাছের ডিমও উঠে আসে। মাসিমা একবার চেষ্টা করেছিলেন নাইলন জাল বন্ধ করতে, কিন্তু কিচ্ছু করা গেল না।”
“কেন?”
“কেন আবার? চিংড়ির ব্যবসায় তো প্রচুর লাভ। আর সব নেতাদের ওরা পয়সা খাইয়ে রাখে। ওদের আর কী? নেতাদেরও কিছু যায় আসে না। মরবে তো আমাদের মতো লোকেরাই। আমাদেরই তাই ভাবতে হবে কী করা যায়। সেইজন্যেই তো আমি চাই টুটুলটা যাতে ভালভাবে লেখাপড়া শেখে। নইলে কী হবে ওর বলুন তো?” এক নিশ্বাসে এতগুলো কথা বলে গেল ময়না।
“আপনি যদি ভাল করে ফকিরকে বোঝান ও নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে,” কানাই বলল।
“সে চেষ্টা কি করিনি ভেবেছেন?” গলার আওয়াজ চড়ে গেল ময়নার। “কতবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু কী বুঝবে ও বলুন? লেখাপড়া জানে না তো এসব জিনিস ওকে বোঝানো অসম্ভব।”
ওর কথা শুনতে শুনতে কানাইয়ের মনে হচ্ছিল এই পরিস্থিতির মধ্যে থেকেও নিজের জগটুকু সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা আছে ময়নার। আর কী করে সেখানে চলতে হবে সেটাও ও ভাল করেই জানে। অবাক লাগছিল কানাইয়ের, শেষবার যখন ও এই ভাটির দেশে এসেছিল তারপর থেকে কত পালটে গেছে সবকিছু। বাইরের পরিবর্তনই শুধু নয়, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সবকিছুই অনেক বদলে গেছে। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই হাসপাতালটা তার সুযোগ সুবিধা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, সবকিছুই। এইসব পরিবর্তনের মধ্যে ময়নার মতো প্রতিভাময়ী একটা মেয়ের স্বপ্ন ওরকম একজন স্বামীর জন্য অপূর্ণ থেকে যাবে ভাবতেও খারাপ লাগল কানাইয়ের।
“দেখুন।”
একটা অপারেটিং থিয়েটারের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা। হঠাৎ ময়না গিয়ে দরজার কাঁচ লাগানো গোল ফুটোটার মধ্যে উঁকি দিয়ে ভেতরে দেখতে লাগল। দেখছে তো দেখছেই। কানাই ভাবল ভেতরে নিশ্চয়ই কোনও অপারেশন চলছে। কিন্তু অবশেষে ময়না সরে এসে ওকে যখন দেখতে দিল, কানাই দেখল ঘরটা খালি, শুধু যন্ত্রপাতিগুলো রয়েছে।
“কী দেখছিলেন এতক্ষণ?” ও জিজ্ঞেস করল ময়নাকে।
“এই নতুন যন্ত্রগুলো। আমার খুব ভাল লাগে ওগুলো দেখতে,” একটু হেসে বলল ময়না। “আমার কোর্সটা শেষ হয়ে গেলে আমিও হয়তো একদিন কাজ করব ওখানে।”
“নিশ্চয়ই করবেন।”
ঠোঁটদুটো একটু কোঁচকাল ময়না। “ভগবান জানে।”
ওর গলা শুনে স্পষ্ট বুঝতে পারল কানাই, যে এই নার্স হওয়ার স্বপ্ন ওর কোনও সাধারণ শখের ব্যাপার নয়–এ স্বপ্নের উৎস যে আকাঙ্ক্ষায়, সম্পূর্ণতায় বা ঋদ্ধিতে মনের মধ্যে লালিত তার রূপ কোনও কবিতা বা উপন্যাসের তুলনায় কোনও অংশে কম নয়। নিজেকে আরও পরিশীলিত করে সামনের বিরাট পৃথিবীর দিকে হাত বাড়ানোর দুর্দম ইচ্ছার চেহারাটা আজ ফের ধরা দিল কানাইয়ের কাছে। ময়নার কথা শুনতে শুনতে ও যেন হারিয়ে যাওয়া নিজের ছবি নতুন করে খুঁজে পেল।
দরজার গায়ের গোল কাঁচটার মধ্যে নিজের মুখের ছায়ার পাশে ময়নার মুখটা দেখতে পেল কানাই। কাঁচের গায়ে টোকা দিয়ে অন্ধকার অপারেটিং থিয়েটারটার দিকে দেখাল ময়না। “এই ঘরটাতেই আমার টুটুল হয়েছিল,” ও বলল। “মাসিমাই আমার ভর্তির সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। জানেন, আমার আগে আমাদের বাড়ির কোনও মেয়ে বাচ্চা হওয়ার সময় হাসপাতালে ভর্তি হয়নি। টুটুল যখন হয়, তখন তিনজন নার্স ছিল এখানে। আমাকে দেওয়ার আগে ওরা সবাই একবার করে কোলে নিল ওকে। আমার শুধু মনে হচ্ছিল ওদের কী ভাগ্য; খুব ইচ্ছে করছিল তখন ওদের মতো হতে।”
স্পষ্ট পড়া যাচ্ছিল ময়নার মুখে আঁকা উচ্চাশার ছবি। সেদিকে তাকিয়ে অদ্ভুত একটা মমতায় ভরে গেল কানাইয়ের মন: আমাদের একান্ত নিজস্ব সব আকাঙ্ক্ষা–যেগুলো হয়তো সারাজীবন ধরে শুধু আড়াল করার চেষ্টা করে যাই আমরা–হঠাৎ তার ছায়া যদি ছেলেবেলার পুরনো কোনও ছবিতে চোখে পড়ে তা হলে যেমন মনে হয়, খানিকটা সেইরকম একটা কোমল অনুভূতিতে মনটা ছেয়ে গেল ওর।
“চিন্তা কোরো না ময়না,” বলল কানাই। “খুব শিগগিরই এখানে কাজ করবে তুমি।” কথাটা বলেই খেয়াল হল জিজ্ঞেস না করেই ও ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করেছে ময়নাকে। ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত নয়, কিন্তু সেটা নিয়ে কিছু বলার দরকার আছে বলে মনে হল না কানাইয়ের। মনে হল এই তো ভাল। আলাদা করে বলার কী-ই বা প্রয়োজন?