চিহ্ন

আজকেও তাড়াতাড়ি শুতে চলে গেল পিয়া। আগের রাতে ঘুম ভাল হয়নি, তাই কানাইও একটু আগেভাগেই শুয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুম বিশেষ হল না। বেশ জোরে হাওয়া বইছিল বাইরে, আর ভটভটির দুলুনির সাথে সাথে যেন ছেলেবেলার একটা দুঃস্বপ্ন বার বার ফিরে আসছিল কানাইয়ের তন্দ্রায় একটানা একই পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে বার বার, সেই স্বপ্ন। তফাতটা শুধু পরীক্ষকদের চেহারায়। ইস্কুলের মাস্টারমশাইদের মুখগুলোর বদলে সেখানে ভেসে আসছিল কুসুম আর পিয়া, নীলিমা আর ময়না, হরেন আর নির্মলের ছবি। শেষ রাতের দিকে হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে বসল কানাই, ঘামে ভিজে গেছে সারা গা : ঠিক কোন ভাষায় স্বপ্ন দেখছিল মনে পড়ল না, কিন্তু একটা শব্দই খালি ঘুরছিল ওর মাথার মধ্যে–‘পরীক্ষা’।

আধো ঘুমে কানাই বোঝার চেষ্টা করছিল কেন অপ্রচলিত পুরনো ইংরেজিতে ও অনুবাদ করতে চাইছিল শব্দটাকে : ‘ট্রায়াল বাই অর্ডিয়াল’–যন্ত্রণাদায়ক কঠোর বিচার। একেবারে ভোর পর্যন্ত ফিরে ফিরে আসতে থাকল স্বপ্নটা। তারপর অবশেষে ঘুম হল খানিকটা–গাঢ় গভীর ঘুম। বাঙ্ক থেকে যখন নামল কানাই, সকালের কুয়াশা ততক্ষণে কেটে গেছে। আর খানিকক্ষণ পরেই অন্য দিকে ঘুরে যাবে নদীর স্রোত।

কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে কানাই দেখল একটুও হাওয়া বইছে না কোনওদিকে, নদীর  জল একেবারে স্থির, পালিশ করা ধাতুর পাতের মতো বিছিয়ে রয়েছে। ভরা জোয়ারে থইথই করছে নদী,  জলের স্রোত পূর্ণ ভারসাম্যের বিন্দুতে এসে পৌঁছেছে, মনে হচ্ছে নদীটা যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক জায়গায়। ডেক থেকে গর্জনতলা দ্বীপটাকে মনে হচ্ছিল বিশাল একটা রুপোর ঢালের ধার বরাবর খোদাই করে বসানো দামি পাথরের সাজের মতো। দৃশ্যটা একই সঙ্গে যার পর নাই পার্থিব এবং অত্যন্ত রকম একান্ত; বিস্তারে বিশাল, আবার এই নিস্তরঙ্গ শান্তির মুহূর্তে কেমন বেমানান কোমলতাময়।

কার যেন পায়ের শব্দ শোনা গেল ডেকের ওপর। ফিরে তাকিয়ে কানাই দেখল পিয়া আসছে। হাতে ক্লিপবোর্ড আর ডেটাশিট। কেজো গলায় কানাইকে জিজ্ঞেস করল, “একটা কাজ করে দেবেন আমাকে? শুধু আজকে সকালটার জন্যে?”

“নিশ্চয়ই করে দেব। বলুন কী করতে হবে।”

“ডলফিনদের ওপর নজরদারির কাজ একটু করে দিতে হবে আমাকে,” পিয়া বলল। আসলে জোয়ার-ভাটার সময়টা পালটে যাওয়ায় একটু সমস্যায় পড়েছে পিয়া। শুরুতে ওর প্ল্যান ছিল জোয়ার এলে ডলফিনগুলো যখন দহটা ছেড়ে চলে যায়, তখন ওদের পেছন পেছন যাবে। কিন্তু এখন জোয়ারের সময়টা পালটে গেছে। জল বাড়তে শুরু করছে খুব ভোরের দিকে আর একেবারে সন্ধেবেলায়। তার মানে কোনওবারই শুশুকগুলোর দহ ছেড়ে যাওয়ার সময়টায় দিনের আলো পাওয়া যাবে না। এমনিতেই ওদের আসা-যাওয়া বোঝা যথেষ্ট কঠিন, আলো কম থাকলে তো সেটা একেবারেই অসম্ভব। পিয়া তাই ঠিক করেছে আপাতত ডলফিনগুলোর ফিরে আসার পথের একটা হিসেব রাখবে ও। ওর প্ল্যান হল দহটায় ঢোকার দুটো মুখে নজরদারির ব্যবস্থা করবে–একটা উজানের দিকে, আরেকটা ভাটির দিকে। উজানের দিকে নজর রাখবে ও নিজে, মেঘার ডেক থেকে। নদী সেখানে অনেকটা চওড়া, দূরবিন ছাড়া ওদিকটায় লক্ষ রাখা কঠিন। আর অন্যদিকটায় ফকির নজর রাখতে পারে তার ডিঙি থেকে। কানাইও যদি তার সঙ্গে থাকতে পারে তা হলে খুবই ভাল হয়–দূরবিনের অভাব দু’জোড়া চোখ খানিকটা পূরণ করতে পারবে।

“তার মানে আপনাকে কয়েকটা ঘণ্টা ফকিরের সঙ্গে ওর নৌকোয় কাটাতে হবে,” পিয়া বলল। “কিন্তু তাতে নিশ্চয়ই আপনার কোনও সমস্যা নেই?”

ফকিরের সঙ্গে ওর কোনও রকমের প্রতিযোগিতা আছে–এরকম একটা চিন্তা পিয়ার মনে এসেছে বলে আঁতে একটু ঘা লাগল কানাইয়ের। তাড়াতাড়ি বলল, “না না। ওর সঙ্গে কথা বলার একটা সুযোগ পাওয়া গেলে আমি তো খুশিই হব।”

“গুড। তাই ঠিক রইল তা হলে। আপনি কিছু খেয়ে-টেয়ে নিন, তারপরেই বেরিয়ে পড়া যাবে। ঘণ্টাখানেক পরে আমি ডেকে নেব আপনাকে।”

পিয়া যতক্ষণে ডাকতে এল তার মধ্যে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরোনোর জন্যে একেবারে তৈরি হয়ে গেছে কানাই। সারাটা দিন রোদে রোদে কাটাতে হবে বলে হালকা রঙের ট্রাউজার্স পরেছে একটা, গায়ে সাদা জামা, আর পায়ে চপ্পল। একটা টুপি আর সানগ্লাসও সঙ্গে নিয়ে নেবে ঠিক করেছে। প্রস্তুতি দেখে সন্তুষ্ট হল পিয়া। দু’বোতল জল হাতে দিয়ে বলল, “এগুলোও রেখে দিন সঙ্গে। প্রচণ্ড গরম হবে কিন্তু ওখানে।”

একসঙ্গে বোটের পেছন দিকটায় গিয়ে ওরা দেখল ফকিরও বেরোনোর জন্যে তৈরি হয়ে বসে আছে, দাঁড়দুটো রাখা আছে নৌকোর ওপর, আড়াআড়ি ভাবে। কানাই ডিঙিতে গিয়ে ওঠার পরে পিয়া ফকিরকে দেখিয়ে দিল ঠিক কোন জায়গাটায় নৌকোটা নিয়ে গিয়ে রাখতে হবে। মেঘা এখন যেখানে আছে সেখান থেকে জায়গাটা দু’ কিলোমিটার মতো দূরে, ভাটির দিকে। গর্জনতলা দ্বীপ্টা ওইখানটাতে বাইরের দিকে একটু বেঁকে গেছে, খানিকটা ঢুকে এসেছে নদীর ভেতর; ফলে খাতটা সরু হয়ে গেছে একটু। “মাত্র এক কিলোমিটারের মতো চওড়া হবে নদীটা ওই জায়গায়,”পিয়া বলল। “আমার মনে হয় ফকির যদি ঠিক মাঝনদীতে নোঙর করে, তা হলে ওদিক দিয়ে যে ডলফিনগুলো আসবে, আপনারা দুজনে মিলে সেগুলোর সবকটার ওপরেই নজর রাখতে পারবেন।

তারপর উজানের দিকে একটা জায়গা দেখিয়ে বলল, “আর আমি থাকব ওইখানটায়।” সেখানে বিশাল একটা মোহনায় গিয়ে মিশেছে নদীটা। “দেখতেই পাচ্ছেন ওখানে নদী অনেকটা চওড়া, কিন্তু লঞ্চে থাকব বলে খানিকটা উঁচু থেকে দেখতে পাব আমি। আর দূরবিনও থাকবে সঙ্গে, ফলে ওইদিকটা আমার পক্ষে সামলে নেওয়া কঠিন হবে না। আমরা মোটামুটি কিলোমিটার চারেক দূরে দূরে থাকব। আমি আপনাদের দেখতে পাব, কিন্তু আপনারা আমাকে দেখতে পাবেন বলে মনে হয় না।”

বোট থেকে কাছি খুলে নিল ফকির। পিয়া হাত নাড়ল ওদের দিকে। মুখের সামনে দুটো হাত জড়ো করে চেঁচিয়ে বলল, “যদি মনে হয় আর পারছেন না কানাই, ফকিরকে বলবেন, ও এসে বোটে দিয়ে যাবে আপনাকে।”

কানাইও হাত নাড়ল, “কিছু অসুবিধা হবে না। আমাকে নিয়ে কিছু ভাবতে হবে না আপনাকে।”

ডিঙি খানিক দূর এগোতে এগোতেই লঞ্চের চিমনি থেকে দমকে দমকে কালো ধোঁয়া বেরোতে শুরু করল। আস্তে আস্তে সরতে শুরু করল মেঘা, ইঞ্জিনের ধাক্কায় ঢেউ উঠল জলে। পরের কয়েক মিনিট ধরে সেই ঢেউয়ে ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগোতে লাগল ফকির আর কানাই।  জল আবার শান্ত হল লঞ্চটা একেবারে চোখের আড়ালে চলে যাওয়ার পর।

গোটা জায়গাটা জনমানবশূন্য হয়ে যাওয়ার পর এবার কানাইয়ের আর ফকিরের মধ্যে দূরত্ব যেন শতগুণে কমে গেল। তবুও, নৌকোটা যদি দু’কিলোমিটার লম্বা হত, ততটাই দূরে থাকত ওরা একে অপরের থেকে। ডিঙির একেবারে সামনের দিকে বসেছিল কানাই, আর ফকির ছিল পেছনে, ছইয়ের আড়ালে। মাঝখানে ছইয়ের বেড়াটা থাকার জন্য কেউ কাউকে দেখতেও পাচ্ছিল না।  জলের ওপরে প্রথম ঘণ্টা কয়েক কোনও কথাও বিশেষ হয়নি দু’জনের মধ্যে। বার দুয়েক কানাই কথা বলার চেষ্টা করেছিল বটে, কিন্তু প্রতিবারই দায়সারা একটা দুটো হু হা ছাড়া বিশেষ কোনও জবাব পায়নি।

দুপুর নাগাদ, জল যখন নামতে শুরু করেছে, হঠাৎ খুব উত্তেজিত হয়ে লাফিয়ে উঠল ফকির। ভাটির দিকে ইশারা করে বলল, “ওই যে–ওইখানে।”

চোখের ওপর হাত আড়াল করে কানাই দেখল সরু খাঁজকাটা তেকোনা একটা পাখনা বাঁক খেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে জল কেটে।

“ছইটা ধরে উঠে দাঁড়ালে আরও ভাল করে দেখতে পাবেন।”

“ঠিক আছে।” প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে নৌকোর মাঝামাঝি জায়গাটায় গিয়ে পৌঁছল কানাই, উঠে দাঁড়াল কোনওরকমে, ছইয়ের বাতায় হেলান দিয়ে টাল সামলে নিল।

“আরেকটা। ওই যে, ওইখানটায়।”

ফকিরের আঙুল বরাবর তাকিয়ে জল কেটে এগোনো আরও একটা পাখনা দেখতে পেল কানাই। সামান্য পরেই আরও দুটো ডলফিন দেখা গেল–ফকিরই দেখতে পেয়েছে সবগুলো।

হঠাৎ এই হুড়োহুড়িতে ফকিরের নীরবতার বেড়ায় ছোট্ট একটু ফাঁক তৈরি হয়েছে মনে হল, কানাই তাই আরেকবার চেষ্টা করল ওকে কথাবার্তায় টেনে আনতে। “আচ্ছা ফকির, একটা কথা বলো তো আমাকে,” ছইয়ের ওপর দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল কানাই, “সারের কথা তোমার একটুও মনে আছে?”

চট করে কানাইয়ের দিকে একবার তাকিয়ে ফের অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিল ফকির। বলল, “না একটা সময় উনি খুব আসতেন আমাদের এখানে, কিন্তু তখন তো আমি খুব ছোট। মা মারা যাওয়ার পরে ওনাকে আর বিশেষ দেখিনি আমি। ওনার কথা কিছুই প্রায় মনে নেই আমার।”

“আর তোমার মা? তার কথা মনে আছে তোমার?”

“মা-কে কী করে ভুলব বলুন? মা-র মুখ তো সব জায়গায়।”

এমন সহজ সাধারণ ভাবে কথাটা ও বলল যে একটু হকচকিয়ে গেল কানাই।.”কী বলছ ফকির? কোথায় মা-র মুখ দেখো তুমি?”

একটু হেসে ফকির সব দিকে ইশারা করে দেখাতে লাগল। কম্পাসের সবগুলো দিক ছাড়াও নিজের মাথার দিকে আর পায়ের দিকেও দেখাল : “এদিকে দেখি, এদিকে দেখি, এদিকে দেখি, এদিকে দেখি। সব জায়গায় দেখি।”

এত সরল বাক্যগঠন যে প্রায় শিশুর কথা বলার মতো শুনতে লাগল সেটা। কানাইয়ের মনে হল অবশেষে ও বুঝতে পেরেছে সব কিছু সত্ত্বেও ময়নার কেন এমন গভীর টান তার স্বামীর প্রতি। ফকিরের স্বভাবের মধ্যে কিছু একটা এখনও খুব কঁচা অবস্থায় রয়ে গেছে, আর সেটাই ময়নাকে টানে; নরম মাটির দলা সামনে পেলে কুমোরের হাত যেমন নিশপিশ করে, ফকিরের জন্য সেভাবেই নিশপিশ করে ময়নার মন।

“আচ্ছা ফকির, তোর শহরে যেতে ইচ্ছে করে না কখনও?”

কথাটা বলেই কানাইয়ের খেয়াল হল, নিজের অজান্তেই তুমি থেকে তুই-এ নেমে এসেছে ও, যেন সত্যি সত্যিই ফকির আসলে বাচ্চা একটা ছেলে। ফকির কিন্তু সেসব লক্ষ করেছে বলে মনে হল না। “এখানেই আমার ভাল,” জবাব দিল ও। “শহরে গিয়ে আমি কী করব?” তারপরে, কথাবার্তা শেষ করার জন্যেই যেন দাঁড় তুলে নিল হাতে। “এবার লঞ্চে ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে।”

জলে দাঁড় ডোবাতেই দুলে উঠল নৌকো। তাড়াতাড়ি গলুইয়ের ওপর নিজের জায়গাটায় গিয়ে বসল কানাই। বসার পর তাকিয়ে দেখল ফকির জায়গা পালটেছে। এখন ও ডিঙির ঠিক মাঝামাঝি জায়গায়; এমনভাবে বসেছে যাতে দাঁড় টানার সময় মুখটা কানাইয়ের দিকে ফেরানো থাকে। ঝলসানো গরমের ভাপ উঠছে নদী থেকে, মনে হচ্ছে যেন মরীচিকা নাচছে জলের ওপর। গরমে আর  জল থেকে ওঠা ভাপে আস্তে আস্তে কেমন ঘোর লেগে গেল কানাইয়ের, যেন স্বপ্নের মধ্যে ফকিরের একটা ছবি ভেসে এল ওর চোখের সামনে ফকির যেন সিয়াটেল যাচ্ছে পিয়ার সঙ্গে। দেখতে পেল ওরা দু’জনে প্লেনে গিয়ে উঠছে, পিয়ার পরনে জিনস আর ফকির পরে আছে লুঙ্গি আর একটা ধুন্ধুড়ে টি-শার্ট দেখতে পেল একটা সিটের ওপর কুঁকড়ে বসে আছে ফকির জীবনে সেরকম সিট ও চোখে দেখেনি; হাঁ করে আইলের এপাশ থেকে ওপাশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। তারপর পশ্চিমের হিমঠান্ডা কোনও শহরে ফকিরকে কল্পনা করল কানাই, কাজের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছে রাস্তায় রাস্তায়, ঘুরতে ঘুরতে পথ হারিয়ে ফেলেছে, কিন্তু কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছে না।

অপ্রীতিকর ছবিটা চোখের সামনে থেকে তাড়ানোর জন্যে মাথা ঝাঁকাল কানাই।

ওর মনে হল যে পথে ওরা এসেছিল তার তুলনায় গর্জনতলা দ্বীপের অনেক কাছ দিয়ে যাচ্ছে এখন। কিন্তু জল একেবারে নীচে নেমে গেছে বলে বোঝা মুশকিল যে ইচ্ছে করেই পথ পালটেছে ফকির, না ভাটার সময় নদী সরু হয়ে গেছে বলে চোখের ভুলে এরকম মনে হচ্ছে। দ্বীপের পাশ দিয়ে যেতে যেতে হাতের তালুতে রোদ আড়াল করে বাঁদিকে তাকাল ফকির। পাড়টা ঢালু হয়ে সেখানে নেমে এসেছে জলে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ টানটান হয়ে গেল ওর পেশিগুলো, সোজা হয়ে একটু উঠে বসল। ডান হাতে যন্ত্রের মতো লুঙ্গির আলগা দিকটা তুলে কেঁচা মেরে নিল, ল্যাঙোটের মতো হয়ে গেল অত বড় কাপড়টা। আধা-হামাগুড়ি অবস্থায় নৌকোর ধারে হাতের ভর দিয়ে শরীরটা সামনে ঝুঁকিয়ে দিল–খেলার মাঠে দৌড় শুরু করার সময় লোকে যে ভাবে দাঁড়ায়, অনেকটা সেই ভঙ্গিতে। অল্প টলমল করে উঠল ডিঙি। হাত তুলে পাড়ের দিকে ইশারা করল ফকির : “দেখুন, ওই জায়গাটায় দেখুন।”

“কী ব্যাপার?” জিজ্ঞেস করল কানাই। “কী দেখছিস তুই ওখানে?”

হাত তুলে দেখাল ফকির : “দেখুন না।”

চোখ কুঁচকে ওর আঙুল বরাবর তাকাল কানাই, কিন্তু দেখার মতো কিছু চোখে পড়ল না। জিজ্ঞেস করল, “কী দেখব?”

“দাগ, চিহ্ন–কালকে যেমন দেখেছিলাম সেইরকম। সোজা চলে গেছে খোঁচগুলো, দেখতে পাচ্ছেন না? ওই ঝোঁপটার কাছ থেকে জল পর্যন্ত এসে আবার ফিরে গেছে।”

ভাল করে ফের একবার দেখল কানাই। মনে হল কয়েকটা জায়গায় মাটি যেন বসে বসে গেছে একটু। কিন্তু কাদা থেকে উঠে থাকা গর্জনগাছের ছুঁচোলো শ্বাসমূলে একেবারে ভর্তি জায়গাটা। মাটির তলার শেকড় থেকে বের হয়ে আসা এই মূলগুলো দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাসের কাজ চালায় এ গাছ। খাড়া হয়ে থাকা বর্শার মতো সেই শুলোর ভিড়ে একটা দাগ থেকে আরেকটা দাগের তফাত করা একেবারে অসম্ভব।

মাটি দেবে যাওয়া যে দাগ এখানে ফকিরের চোখে পড়েছে, গতকালের দেখা স্পষ্ট ছোপগুলোর সঙ্গে তার কোনও মিলই নেই। কানাইয়ের মনে হল নির্দিষ্ট কোনও আকৃতিহীন এই দাগগুলো থেকে পরিষ্কার ভাবে কিছুই বলা যায় না; এগুলো এমনকী কঁকড়ার গর্ত বা জল নামার সময় স্রোতের টানে তৈরি খাতও হতে পারে।

“দেখছেন কেমন একটা লাইন ধরে গেছে খোঁচগুলো?” ফকির বলল। “একেবারে  জলের ধার পর্যন্ত চলে গেছে। তার মানে জল নেমে যাওয়ার পরে হয়েছে–এগুলো হয়তো যখন আমরা এদিকে আসছিলাম, সেই সময়। জানোয়ারটা নিশ্চয়ই দেখতে পেয়েছে আমাদের। আরও ভাল করে দেখার জন্যে তাই নেমে এসেছিল।”

ওরা মোহনা পেরিয়ে এগোচ্ছে, সেটা ভাল করে দেখার জন্যে একটা বাঘ জলের ধার পর্যন্ত নেমে আসছে–এই পুরো ভাবনাটাই এত কষ্টকল্পিত, যে হাসি পেয়ে গেল কানাইয়ের।

“আমাদের কেন দেখতে চাইবে?” ফকিরকে জিজ্ঞেস করল ও।

“আপনার গন্ধ পেয়েছে হয়তো। নতুন লোকেদের চোখে চোখে রাখতে ভালবাসে এ জানোয়ার।”

ফকিরের হাবভাবের মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল যাতে কানাইয়ের দৃঢ় ধারণা হল ও একটা খেলা খেলছে কানাইয়ের সঙ্গে, হয়তো নিজের অজান্তেই। কথাটা ভেবে বেশ মজা লাগল ওর। পরিস্থিতির পরিবর্তনই হয়তো ফকিরকে প্রলুব্ধ করেছে চারপাশের এই ভয়াল রূপকে আরও বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলতে। ব্যাপারটা বুঝতে বিশেষ অসুবিধা হল না কানাইয়ের। ওকেও অনেকবার ফকিরের মতো এভাবে নিরুপায় কোনও বিদেশির সামনে অচেনা জগতের জানালা খুলে দেওয়ার কাজ করতে হয়েছে। মনে পড়ল, সেসব সময়ে ওরও অনেকবার কেমন লোভ হয়েছে সূক্ষ্মভাবে চারপাশের জগৎকে একটু তির্যক করে দেখানোর, অচেনা জায়গাকে আরও রহস্যময় করে তোলার। মনের কোনায় কোনও বিদ্বেষই যে সব সময় মানুষকে দিয়ে এরকম করায় তা নয়, এটা আসলে বাইরের লোকের সামনে ভেতরের লোকের অপরিহার্যতাকে চোখে আঙুল দিয়ে বোঝানোর একটা উপায়–প্রতিটি নতুন বিপদের সম্ভাবনায় প্রমাণ হয়ে যায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ তার উপস্থিতি, প্রতিটি নতুন সমস্যা তার দাম বাড়িয়ে দেয় বিদেশির কাছে। গাইড আর অনুবাদকদের সামনে এ প্রলোভনের হাতছানি সব সময়ই থাকে–সে হাতছানি উপেক্ষা করলে নিজের অপরিহার্যতা বজায় রাখা কঠিন, আবার তার কাছে আত্মসমর্পণ করলে কথার দাম বলেও আর কিছু থাকে না, পুরো কাজটাই হয়ে যায় মূল্যহীন। আর এই দ্বিধার ব্যাপারটা কানাইয়ের কাছে অপরিচিত নয় বলেই এটাও ও জানে যে অনুবাদককে কখনও কখনও যাচাই করে নিতে হয়।

পাড়ের কাদার দিকে দেখিয়ে অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল কানাই। একটু হেসে বলল, “ধুর, এ তো এমনি গর্ত। দেখা যাচ্ছে কাঁকড়ারা মাটি খুঁড়ছে ওগুলোর মধ্যে। এ দাগগুলো বড় শেয়ালের তুই কী করে বুঝলি?”

ওর দিকে ফিরে হাসল ফকির। ঝকঝক করে উঠল সাদা দাঁতগুলো। “কী করে বুঝলাম দেখবেন?”

একটু ঝুঁকে কানাইয়ের একটা হাত টেনে নিয়ে নিজের ঘাড়ের ওপর রাখল ও। আচমকা এই স্পর্শের ঘনিষ্ঠতায় একটা যেন ঝটকা লাগল কানাইয়ের হাতে। একটানে হাতটা সরিয়ে নিতে নিতে কানাই টের পেল ফকিরের ভেজা চামড়ায় কাটা কাটা হয়ে ফুটে উঠেছে। রোমকূপগুলো।

আবার ওর দিকে তাকিয়ে হাসল ফকির। বলল, “দেখলেন তো কী করে বুঝলাম? ভয় দিয়েই বুঝতে পারি আমি।” তারপর উবু হয়ে একটু উঠে বসে সপ্রশ্ন চোখে তাকাল কানাইয়ের দিকে। জিজ্ঞেস করল, “আর আপনি? আপনি ভয় টের পাচ্ছেন না?”

কথাগুলো কানাইয়ের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করল স্বতস্ফূর্ততায় তার সঙ্গে ফকিরের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠার খুব একটা তফাত নেই। চেতনা থেকে হঠাৎ মুছে গেল এই বাদাবন,  জল আর নৌকোর পারিপার্শ্বিক; এ মুহূর্তে ও কোথায় বসে আছে সে কথা ভুলে গেল কানাই। ওর মন যেন ফিরে যেতে চাইল নিজের চেনা কাজের বৃত্তে যে কাজের অভ্যাসে জড়িয়ে আছে দীর্ঘ দিনের অনুশীলন আর তিল তিল করে গড়ে ওঠা দক্ষতা। এই মুহূর্তে ওর ভাবনায় ভাষা ছাড়া আর কিছুরই কোনও অস্তিত্ব নেই, ফকিরের প্রশ্নের শুদ্ধ ধ্বনি-কাঠামোটুকুই এখন ওর চেতনার সবটা জুড়ে রয়েছে। মনকে যতটা সম্ভব একাগ্র করে প্রশ্নটা বিচার করল কানাই। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উত্তরটা মনে এসে গেল : নেতিবাচক উত্তর। ফকিরের গায়ে যেরকম ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে, কানাইয়ের আদৌ সেরকম ভয় লাগছে না। এমনিতে যে ও অসাধারণ সাহসী সেরকম বলা যায় না–তা ও একেবারেই নয়। কিন্তু এটাও কানাই জানে যে সাধারণত যেরকম বলা হয়ে থাকে ভয় জিনিসটা আদৌ সেরকম জন্মগত কোনও প্রবৃত্তি নয়। মানুষ ভয় পেতে শেখে; পূর্বজ্ঞান, অভিজ্ঞতা আর আজন্ম শিক্ষার থেকেই আস্তে আস্তে ভয় জমে ওঠে মনের মধ্যে। ভয়ের অনুভূতি কারও সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার থেকে কঠিন কাজ আর কিছু হতে পারে না। আর এই মুহূর্তে যে ভীতির সঞ্চার ফকিরের মনের মধ্যে হয়েছে, সে ভীতি এতটুকুও অনুভব করতে পারছে না কানাই।

“জিজ্ঞেস করলি তাই বলছি,” কানাই জবাব দিল, “সত্যি কথাটা হল, না। আমার ভয় লাগছে না। তুই যেরকম ভয় পাচ্ছিস সেরকম তো পাচ্ছিই না।”

পুকুরের  জলের ওপর যেমন বৃত্তাকার ঢেউ ছড়িয়ে যায়, সেরকম একটা হঠাৎ জেগে-ওঠা আগ্রহের ভাব ফকিরের সারা মুখে ছড়িয়ে গেল। সামনে একটু ঝুঁকে এসে জিজ্ঞেস করল, “ভয় যদি না পান, তা হলে আরও একটু কাছ থেকে গিয়ে দেখতেও আপনার নিশ্চয়ই কোনও অসুবিধা নেই? কী বলেন?”

একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ফকির, চোখের পলক পড়ছে না। কানাইও নিজেকে চোখ নামিয়ে নিতে দেবে না কিছুতেই। বাজি দ্বিগুণ করে দিয়েছে ফকির, ওকে এখন ঠিক করতে হবে কী করবে পিছিয়ে যাবে, না যাচাই করে নেবে ফকিরের কথাটা।

মনের মধ্যে একটু অনিচ্ছার ভাব যদিও ছিল, তা সত্ত্বেও কানাই বলল, “ঠিক আছে। যাওয়া যাক তা হলে।”

মাথা নাড়ল ফকির। একটা দড়ে জল টেনে ঘুরিয়ে নিল ডিঙি। নৌকোর মুখ পাড়ের দিকে ফিরতে বাইতে শুরু করল তারপর। জলের দিকে একবার তাকাল কানাই : পালিশ করা পাথরের মেঝের মতো শান্ত নদী, তার ওপরে খোদাই করা স্রোতের নকশাগুলো মনে হচ্ছে যেন স্থির হয়ে আছে একেবারে, মার্বেলের ফলকের ওপর শির-টানা দাগের মতো।

“আচ্ছা ফকির, একটা কথা বল তো আমাকে, কানাই বলল।

“কী?”

“তুই তো বলছিস ভয় পেয়েছিস। তা হলে ওখানে কেন যেতে চাইছিস?”

“মা আমাকে বলেছিল এ জায়গাটায় এসে ভয় না পেতে শিখতে হবে। এখানে যদি কেউ একবার ভয় পায় তা হলে তার দফা রফা,” বলল ফকির।

“সেইজন্যে এসেছিস তুই এখানে?”

“কে জানে,” ঠোঁট ওলটাল ফকির। তারপর একটু হেসে বলল, “এবার আমি আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব কানাইবাবু?”

বলতে বলতে মুখের হাসি চওড়া হল ফকিরের। দেখে কানাইয়ের মনে হল নিশ্চয়ই কিছু একটা রসিকতার কথা বলবে। “কী?”

“আপনার মনটা কি পরিষ্কার, কানাইবাবু?”

চমকে উঠে বসল কানাই। “মানে? কী বলতে চাস?”

ফকির কাঁধ ঝাঁকাল : “মানে, বলতে চাইছিলাম, আপনি মানুষটা কি ভাল?”

“আমার তো তাই মনে হয়,” কানাই বলল। “অন্তত আমি যা করি তা ভাল ভেবেই করি। বাকিটা–কে জানে।”

“কিন্তু আপনার কখনও সেটা জানতে ইচ্ছে করে না?”

“সে কি কখনও কেউ জানতে পারে?” ..

“আমার মা কী বলত জানেন? বলত, এই গর্জনতলায় এসে মানুষ যা জানতে চায়, বনবিবি তা-ই তাকে জানিয়ে দেন।”

“কী করে?”

আবার ঠোঁট ওলটাল ফকির। “মা এরকম বলত।”

নৌকোটা দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছতেই বনের চাঁদোয়া ছিঁড়ে এক ঝাঁক পাখি ডানা মেলল। বাতাসে ভাসা মেঘের মতো খানিক চক্কর কেটে আবার গিয়ে বসল গাছে। বাদাবনের গাছের পাতার মতো পান্না-সবুজ একটা টিয়ার ঝক। এক সঙ্গে দলটা যখন উড়ল, মুহূর্তের জন্যে মনে হয়েছিল হঠাৎ যেন গাছের মাথার সবুজ কেশর ফুলে উঠেছে, দমকা হাওয়ায় আলগা হয়ে গেছে জঙ্গলের পরচুলা।

পাড়ের কাছাকাছি এসে গতি বেড়ে গেল নৌকোর। দাঁড়ের শেষ টানের সাথে সাথে ডিঙির মাথাটা গিয়ে কাদার গভীরে গেঁথে গেল। মালকোঁচা মেরে পাশ দিয়ে নেমে পড়ল ফকির। তারপর পাড়ের দিকে দৌড় দিল, ছাপগুলোকে কাছ থেকে ভাল করে দেখার জন্যে।

“আমি ঠিকই বলেছিলাম,” কাদার ওপর হাঁটু গেড়ে বসতে বসতে বলল ও। গলার স্বরে জয়ের আনন্দ। “একেবারে টাটকা দাগ। এই ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই হয়েছে।”

কানাইয়ের কিন্তু এখনও একই রকম আকৃতিহীন মনে হল গর্তের মতো ছাপগুলোকে। বলল, “আমি তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না।”

“দেখবেন কী করে?” নৌকোর দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে হাসল ফকির। “অনেক দূরে আছেন তো আপনি। ডিঙি থেকে নেমে আসতে হবে। এখানে এসে একবার ভাল করে নজর করুন, দেখতে পাবেন কেমন সোজা জঙ্গলের দিকে উঠে গেছে খোঁচগুলো,” পাড়ের ঢাল বরাবর ইশারা করল ফকির। ঢালটার ওপরে খাড়া হয়ে আছে বাদাবনের পাঁচিল।

“ঠিক আছে, আমি আসছি।” লাফ দেওয়ার জন্য কানাইকে তৈরি হতে দেখে বারণ করল ফকির : “দাঁড়ান দাঁড়ান। আগে প্যান্টটা গুটিয়ে ফেলুন, তারপর চটিটা খুলে রেখে নামুন। নইলে কাদায় চটি হারিয়ে যাবে। খালি পায়ে নামাই ভাল।”

চটিগুলো পা থেকে ছুঁড়ে ফেলে কানাই হাঁটু অবধি গুটিয়ে নিল প্যান্টটাকে। তারপর নৌকোর পাশ দিয়ে পা ঝুলিয়ে নেমে পড়েই ডুবে গেল কাদায়। শরীরের ওপরের অংশটা হুমড়ি খেয়ে এগিয়ে গেল সামনের দিকে, ডিঙিটাকে ধরে কোনওরকমে টাল সামলাল কানাই : এই কাদার মধ্যে এখন পড়ে গেলে আর মুখ দেখানোর জায়গা থাকবে না। খুব সাবধানে ডান পা-টাকে কাদা থেকে বের করে এনে একটু সামনের দিকে ফেলল। এরকম করে বাচ্চাদের মতো পা ফেলতে ফেলতে কোনওরকম দুর্ঘটনা ছাড়াই শেষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছল ফকিরের কাছে।

“দেখুন,” মাটির দিকে ইশারা করল ফকির। “এই যে, এইগুলো নখের দাগ, আর এইখানটা থাবা।” তারপর মুখ ঘুরিয়ে ঢালটার দিকে দেখাল : “আর ওই দেখুন, এই দিকটা দিয়ে গেছে জানোয়ারটা, ওই গাছগুলোর পাশ দিয়ে। হয়তো এখনও দেখছে আপনাকে।”

ফকিরের গলার ঠাট্টার সুরটা গায়ে লাগল কানাইয়ের। ও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “তুই কী করতে চাইছিস ফকির? ভয় দেখাতে চাইছিস আমাকে?”

“আপনাকে ভয় দেখাব?” ফকির হাসল। “কিন্তু ভয় পাবেন কেন আপনি? বলেছি না আমার মা কী বলেছিল? মন যার পরিষ্কার তার এখানে কোনও ভয় নেই।”

তারপর হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে কাদার ওপর দিয়ে নৌকোর দিকে চলল ফকির। ডিঙির কাছে গিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিল ছইয়ের মধ্যে। তারপর আবার যখন সোজা হয়ে দাঁড়াল, কানাই দেখল ফকির ওর দা-টা বের করে নিয়ে এসেছে ছইয়ের ভেতর থেকে।

দায়ের ধারালো দিকটা হাতে ধরে ফকির ওর দিকে এগোতে শুরু করতেই, নিজের অজান্তেই কেমন কুঁকড়ে গেল কানাই। চকচকে অস্ত্রটার দিক থেকে চোখ তুলে জিজ্ঞেস করল, “ওটা আবার কীসের জন্যে লাগবে?”

“ভয় পাস না,” বলল ফকির। “জঙ্গলে ঢুকতে গেলে এটা লাগবে। এই পায়ের ছাপগুলো যার, তাকে খুঁজে পাওয়া যায় কিনা সেটা একবার দেখবি না?”

পেশার অভ্যেস হল গিয়ে কঁঠালের আঠা। এই অস্বস্তিকর পরিবেশেও তাই লক্ষ না করে পারল না কানাই–ওকে আপনি ছেড়ে তুই বলতে শুরু করেছে ফকির। এতক্ষণ ও-ই ফকিরকে তুই বলে সম্বোধন করছিল, কিন্তু দ্বীপে পা দেওয়ার পর হঠাৎই যেন উলটে গেছে কর্তৃত্বের সব হিসাব কেতাব।

সামনে বাদাবনের জটপাকানো দুর্ভেদ্য দেওয়াল। সেদিকে তাকিয়ে কানাইয়ের মনে হল এর ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করাটা নিছক পাগলামি হবে। ফকিরের হাত থেকে দা-টা ফসকে যেতে পারে, যে-কোনও সময়ে যা খুশি হয়ে যেতে পারে। অকারণে এতটা ঝুঁকি নেওয়া আদৌ বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

“না ফকির, আর এই খেলা আমি খেলতে চাই না তোর সঙ্গে। এবার আমাকে ভটভটিতে নিয়ে চল,” কানাই বলল।

“কেন রে?” ফকির হেসে উঠল। “ভয় কেন পাচ্ছিস? বলেছি না, এখানে তোর মতো লোকের ভয় পাওয়ার কিছু নেই?”

কাদার মধ্যে এগিয়ে গেল কানাই। মুখ ফিরিয়ে চেঁচিয়ে বলল, “বন্ধ কর তোর উলটোপালটা বুকনি। তুই কচি খোকা হতে পারিস, কিন্তু আমি–”

হঠাৎ কানাইয়ের মনে হল পায়ের নীচে যেন জ্যান্ত হয়ে উঠেছে মাটি, টেনে ধরতে চাইছে ওর গোড়ালি। নীচে তাকিয়ে দেখল দড়ির মতো কী যেন জড়িয়ে ধরেছে দু’পায়ের গোড়ালিতে। বুঝতে পারল শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। টাল সামলানোর জন্যে মাটির ওপর পা ঘষড়ে একটু এগোতে গেল, কিন্তু মনে হল পা দুটো যেন বশে নেই। পড়ে যাওয়াটা আটকানোর জন্যে আর কোনও চেষ্টা করার আগেই থকথকে ভিজে কাদা সপাটে আছড়ে পড়ল মুখের ওপর।

পড়ে যাওয়ার পর প্রথমটায় নড়াচড়ার ক্ষমতা একেবারে লোপ পেয়ে গেল কানাইয়ের। মনে হল কেউ যেন ওর শরীরটাকে একটা ছাঁচ তৈরি করার প্লাস্টারের গামলার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। মুখ তুলে তাকানোর চেষ্টা করতে গিয়ে দেখল চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না, সানগ্লাসের ওপর কাদা লেপ্টে গিয়ে কানামাছি খেলার পট্টির মতো হয়ে গেছে সেটা। হাতের পেছন দিক দিয়ে মুখ থেকে খানিক কাদা চেঁছে ফেলে মাথার ঝাঁকুনিতে খুলে ফেলে দিল সানগ্লাসটা। চোখের সামনে সেটা আস্তে আস্তে ডুবে গেল কাদার মধ্যে। কাঁধের ওপর ফকিরের হাতের ছোঁয়া লাগতে এক ঝটকায় সরিয়ে দিল হাতটাকে। তারপর পায়ে চাপ দিয়ে নিজে নিজে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল। কিন্তু তলতলে মসৃণ কাদা শরীরটাকে চোষকের মতো টেনে ধরল, তার টান ছাড়িয়ে কিছুতেই উঠতে পারল না কানাই।

মুখ তুলে দেখল ফকির হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে। “আগেই বলেছিলাম, সাবধান হতে।”

হঠাৎ যেন রক্ত চড়ে গেল কানাইয়ের মাথায়। স্রোতের মতো মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল অশ্রাব্য গালাগাল : “শালা বাঞ্চোৎ, শুয়োরের বাচ্চা।”

লুকিয়ে থাকা আদিম কোনও প্রবৃত্তির আগ্নেয়গিরি থেকে লাভাস্রোতের মতো বের হয়ে এল শব্দগুলো; যে উৎস থেকে সে স্রোতের উৎসারণ, কানাই নিজে কখনওই তার অস্তিত্ব স্বীকার করবে না : দাসের প্রতি প্রভুর সন্দেহ, জাত্যভিমান, গ্রামের মানুষের প্রতি শহুরে মানুষের অবিশ্বাস আর গ্রামের প্রতি শহরের বিদ্বেষ। কান্নাইয়ের ধারণা ছিল অতীতের এই সব তলানি থেকে নিজেকে মুক্ত করে ফেলেছে ও, কিন্তু যে উগ্রতায় এখন তার উৎক্ষেপণ ঘটল তাতে স্পষ্ট বোঝা গেল মুক্তি তো ঘটেইনি, তার বদলে আসলে আরও গাঢ় হয়ে জমে উঠেছে সে বিষ, জমাট বেঁধে পরিণত হয়েছে মারাত্মক বিস্ফোরকে।

কানাই নিজেও বহু বার দেখেছে এরকম, যখন ওর মক্কেলরা মেজাজ হারিয়ে ফেলেছে, প্রচণ্ড রাগের বশে লঙ্ঘন করে গেছে ব্যক্তিসত্তার সীমা, ক্রোধে আত্মহারা হয়ে ইংরেজিতে যাকে বলে ‘বিসাইড দেমসেলভস’, সেরকম হয়ে গেছে–আক্ষরিক ভাবেই। শব্দগুলোর অর্থটা একেবারে খাপে খাপে মিলে যেতে দেখেছে কানাই এই সব ক্ষেত্রে : আবেগের তীব্রতা যেন তাদের গায়ের চামড়ার শরীরী সীমা ছাপিয়ে উপচে পড়েছে বাইরে। এবং কারণ যাই হোক না কেন, প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তাদের ক্রোধের লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে কানাই : দোভাষী কানাই, সংবাদবাহক কানাই, লিপিকর কানাই। দুর্বোধ্যতার খরস্রোতে ওই তাদের ভাসিয়ে রেখেছে রক্ষাকর্তা হয়ে, ফলে তাদের মনে হয়েছে চারপাশের সব কিছুর অর্থহীনতা যেন কানাইয়েরই ত্রুটি, কারণ তাদের সামনে ও-ই এক এবং একমাত্র বস্তু যার কোনও একটা নাম আছে। কানাই তখন নিজেকে বুঝিয়েছে যে এই ক্রোধোদগীরণের অধ্যায়গুলি প্রোফেশনাল হ্যাঁজার্ড ছাড়া কিছু নয়, সব পেশার সঙ্গেই যেমন কিছু কিছু অসুবিধা কি ঝঞ্ঝাট জড়িয়ে থাকে সেরকম; এর মধ্যে ব্যক্তিগত আক্রোশের কিছু নেই, পেশার খাতিরেই শুধু দুজ্ঞেয় জীবনের হয়ে মাঝে মাঝে প্রক্সি দেওয়ার কাজ করতে হচ্ছে ওকে। তবুও, এই ঘটনার সম্পূর্ণ কার্যকারণ জানা থাকা সত্ত্বেও, কিছুতেই এখন নিজের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা কটুবাক্যের স্রোত রোধ করতে পারল না কানাই। কাদা থেকে উঠতে সাহায্য করার জন্য ফকির যখন হাত বাড়িয়ে দিল, এক ঝাঁপটায় ও সরিয়ে দিল হাতটাকে: “যা শুয়োরের বাচ্চা, বেরিয়ে যা এখান থেকে!”

“ঠিক আছে,” ফকির বলল, “তাই হোক তা হলে।”

মাথাটা একটু তুলে ফকিরের চোখদুটো এক ঝলক দেখতে পেল কানাই; আর তারপরেই, হঠাৎ যেন মুখের কথা শুকিয়ে গেল ওর। পেশাগত জীবনে দোভাষীর কাজ করতে গিয়ে এক এক বার মুহূর্তের জন্যে কানাইয়ের মনে হয়েছে যেন ও নিজের শরীর ছেড়ে অন্য লোকের শরীরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আর প্রত্যেক বারেই যেন অদ্ভুত ভাবে বদলে গেছে ভাষা নামের যন্ত্রটার ভূমিকা। যা ছিল একটা বেড়ার মতো, একটা আড়াল-করা পর্দার মতো, সেই ভাষাই যেন হঠাৎ হয়ে গেছে স্বচ্ছ একটা আবরণ, একটা কাঁচের প্রিজম। অন্য আরেক জোড়া চোখের ভেতর দিয়ে তখন ও দেখেছে বাইরেটাকে, অন্য আরেক জনের মনের ভেতর দিয়ে জগৎটা এসে পৌঁছেছে ওর কাছে। এই অভিজ্ঞতাগুলি সব সময়েই হয়েছে খুব আকস্মিকভাবে, কোনও বারই আগে থেকে কিছু আঁচ করতে পারেনি কানাই; কোনও কার্যকারণ সম্পর্কও কিছু খুঁজে পায়নি। কেবল একটা বিষয় ছাড়া আর কোনও সাদৃশ্যের সূত্রও নেই ঘটনাগুলির মধ্যে সে সাদৃশ্য হল, এই প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই কারও না কারও সঙ্গে দোভাষী হিসেবে কাজ করছিল কানাই। এখানে যদিও ও দোভাষীর কাজ করছে না এখন, তবুও ফকিরের দিকে তাকাতেই হঠাৎ সেই অনুভূতিটা আবার ফিরে এল কানাইয়ের মনে। মনে হল যেন ওই অস্বচ্ছ ভাবলেশহীন চোখদুটোর মধ্যে দিয়ে প্রতিসারিত হয়ে যাচ্ছে ওর দৃষ্টি, আর সামনে যাকে দেখতে পাচ্ছে সে ওর নিজের চেহারা নয়, তার বদলে সেখানে রয়েছে অনেকগুলো মানুষ–যারা বাইরের পৃথিবীর প্রতিভূ, যে মানুষগুলো একদিন ছারখার করে দিয়েছিল ফকিরের গ্রাম, ওর ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল, খুন করেছিল ওর মাকে। কানাই এখানে সেই মানুষগুলোর প্রতিনিধি যাদের ওপর এক কানাকড়িও বিশ্বাস নেই ফকিরের মতো লোকেদের, এরকম মানুষের মূল্য ওদের কাছে একটা জানোয়ারের চেয়েও কম। নিজেকে এ ভাবে দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারল কানাই কী কারণে ওর মৃত্যু কামনা করতে পারে ফকির, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও বুঝতে পারল যে ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয় আসলে। ওর মৃত্যু চায় বলে ফকির ওকে এখানে নিয়ে এসেছে তা নয়, ফকির ওকে এখানে এনেছে যাচাই করার জন্যে।

হাত দিয়ে চোখের থেকে কাদা মুছল কানাই। তারপর আবার যখন তাকাল, দেখল ওর দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেছে ফকির। হঠাৎ কী মনে হতে কানাই ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে দেখার চেষ্টা করল। কাদার মধ্যে হাঁকুপাকু করে কোনওরকমে মুখটা ফেরাতেই দেখতে পেল আস্তে আস্তে নদীর মধ্যে নেমে যাচ্ছে ফকিরের ডিঙি। এখান থেকে ফকিরের মুখ দেখতে পাচ্ছিল না কানাই, ওর পিঠের দিকটা শুধু দেখা যাচ্ছিল; প্রাণপণে দাঁড় টেনে চলেছে নৌকোর পেছন দিকে বসে।

“ফকির, দাঁড়া,” চেঁচিয়ে ডাকল কানাই, “আমাকে এখানে ফেলে যাস না।”

কিন্তু দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে, একটা বাঁকের মুখ ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেছে ফকিরের ডিঙি।

ডিঙির ধাক্কায় জেগে ওঠা ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল কানাই, দেখছিল আস্তে আস্তে নদীর বুক জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে  জলের স্রোত। হঠাৎ ওর চোখে পড়ল একটা তিরতিরে দাগ, কোনাকুনি এগিয়ে আসছে জলের ওপর দিয়ে। দাগটার দিকে ভাল করে নজর করতেই পরিষ্কার বোঝা গেল জলের নীচে কিছু একটা আছে ওখানে। ঘোলা জলের আবছায়া অন্ধকারের আড়ালে সেটা সোজা এগিয়ে আসছে পাড় লক্ষ করে–কানাইয়ের দিকে।

হঠাৎ ভাটির দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা নানা মরণফঁদের কথা ভিড় করে এল কানাইয়ের মনে। লোকে বলে বাঘের হাতে পড়লে নাকি পলক ফেলতে না ফেলতে প্রাণ বের হয়ে যায়, থাবার এক ঝাঁপটে ঘাড় মটকে গিয়ে সাঙ্গ হয়ে যায় ভবলীলা। যন্ত্রণা হওয়ার কোনও সুযোগই থাকে না। অবশ্য থাবার ঘা-টা আসার আগেই নাকি প্রচণ্ড গর্জনে বাহ্যজ্ঞান লোপ পেয়ে প্রাণ হারায় মানুষ। এর মধ্যেও করুণার ছোঁয়া একটা রয়েছে, অস্বীকার করার উপায় নেই–অন্তত লোকে তো তাই ভাবে। আর সে জন্যেই তো যে মানুষগুলোকে জীবনভর বাঘের সাথে ঘর করতে হয়, তাদের কাছে বাঘ শুধু একটা জানোয়ার মাত্র নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। পরভাষী এই দুনিয়ায় বাঘই তো একমাত্র প্রাণী দুর্বলের প্রতি যার কিছুটা হলেও একটু মায়াদয়া আছে।

নাকি কুমিরের হাতে প্রাণ যাওয়ার বীভৎস যন্ত্রণার কথা জানে বলেই এরকম মনে করে ভাটির দেশের মানুষ? কানাইয়ের মনে পড়ে গেল নদীর পাড়ের কাছাকাছিই থাকতে ভালবাসে কুমিরেরা। যে গতিতে মানুষ ঘাসের ওপর দিয়ে ছুটতে পারে, কাদার ওপর তার চেয়ে বেশি গতিতে চলার ক্ষমতা রাখে এই সরীসৃপ। পায়ের পাতা চামড়ায় জোড়া আর বুক-পেট মসৃণ হওয়ার জন্যে তলতলে পাঁকের ওপর দৌড়তে কোনও অসুবিধাই হয় না ওদের। লোকে বলে শিকার নিয়ে জলের নীচে তলিয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তাকে নাকি বাঁচিয়ে রাখে কুমির। ডাঙার ওপর কাউকে মারে না এ জানোয়ার। শ্বাস প্রশ্বাস চালু থাকা অবস্থাতেই শিকারকে টেনে নিয়ে যায় জলের ভেতর। কুমিরে যাদের মারে তাদের শরীরের এতটুকু চিহ্নও পরে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।

কানাইয়ের মন থেকে আর সমস্ত চিন্তা মুছে গেল। কোনওরকমে উবু হয়ে উঠে পিছু হঠতে লাগল আস্তে আস্তে। মাটি থেকে উঠে থাকা ছুঁচলো শেকড়ে ছড়ে গেল সারা গা, কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে উঁচু পাড়ের দিকে পেছোতে থাকল কানাই। বেশ খানিকটা পিছিয়ে যাওয়ার পর কাদা কমে এল। শুলোগুলো এখানে বেশি লম্বা, সংখ্যায়ও অনেক বেশি। জলের ওপর সেই তিরতিরে দাগটা আর দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। নদী থেকে যতটা সম্ভব দূরে সরে যেতে চায় এখন ও।

খুব সাবধানে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল কানাই। এক পা সামনে এগোতেই তীব্র একটা যন্ত্রণায় প্রায় অবশ হয়ে গেল পায়ের পাতাটা। মনে হল যেন একটা পেরেকের ছুঁচোলো মুখের ওপর পা পড়েছে, কিংবা একটা ভাঙা কাঁচের টুকরো মাড়িয়ে দিয়েছে ভুল করে। পা টেনে তুলতেই চোখে পড়ল কাদার গভীর থেকে মাথা বের করে রয়েছে একটা শুলো। বর্শার মতো তীক্ষ্ণ তার ডগাটা। ঠিক তার ওপরেই পা-টা ফেলেছিল কানাই। ভাল করে তাকিয়ে দেখল চারপাশের সমস্ত জায়গাটা ভর্তি হয়ে আছে ছুচোলো শুলোয়। লুকোনো ফাঁদের মতো সব ছড়িয়ে রয়েছে চতুর্দিকে। যে শেকড়গুলো এদের জুড়ে রেখেছে, এই শ্বাসমূলগুলোকে, কাদার ওপরের স্তরের ঠিক নীচে বিছিয়ে রয়েছে সেগুলো–ফাঁদের সঙ্গে জোড়া লুকোনো সুতোর মতো।

সামনেই শুরু হয়েছে বাদাবনের দুর্ভেদ্য প্রাচীর। নৌকো থেকে দেখে যেটাকে জটিল, দুর্গম মনে হচ্ছিল, সে বনকেই এখন মনে হল বিপদের আশ্রয়। এই অজস্র শুলোর মাইনফিল্ডের মধ্যে দিয়ে কোনও রকমে পথ করে সেই ঘন সবুজ জঙ্গলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল কানাই।

বাদাবনের গাছের ট্যারাব্যাঁকা সব ডালপালা এমনই লগবগে যে দু’হাতে ঠেলে সরালেও মচকে যায় না সেগুলো, ছেড়ে দিলেই চাবুকের মতো ছিটকে ফিরে আসে নিজের জায়গায়। কানাইকে যেন ঘিরে ধরল গাছগুলো, মনে হল যেন ছাল-বাকলে মোড়া শত শত হাতের আলিঙ্গনের ভেতরে এসে পড়েছে ও। গাছপালা এত ঘন যে সামনে এক মিটার দূরেও কিছু দেখতে পাচ্ছিল না কানাই। নদীটাও চোখের আড়ালে চলে গেছে। পায়ের তলায় মাটির ঢালটা না থাকলে  জলের দিকে এগোচ্ছে না তার থেকে দূরে যাচ্ছে সেটা পর্যন্ত বুঝতে পারত না কানাই। এক সময় হঠাৎ করে যেন শেষ হয়ে গেল জঙ্গলের ঘন বেড়া। সামনে ঘাসে ঢাকা ভোলা একটা জায়গা। তার এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বড় বড় কিছু গাছ আর তাল জাতীয় গাছ কয়েকটা। কানাই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। সারা শরীর কেটে ছড়ে গেছে, জামাকাপড়গুলোও ছিঁড়ে প্রায় ফালাফালা। মাছি এসে বসছে গায়ে, মাথার ওপর ভনভন করছে এক ঝাক মশা।

ফাঁকা জায়গাটার চারদিকে ভাল করে চেয়ে দেখারও সাহস হল না কানাইয়ের। এটাই সেই জায়গা তা হলে? এই যদি সেই দ্বীপ হয়, তা হলে কি এখানেই কিন্তু কীসের কথা ভাবছে কানাই? শব্দটা কিছুতেই মাথায় আসছে না। এমনকী ফকির যে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কী একটা বলেছিল সেটাও এক্কেবারে মনেই পড়ছে না। ভয়ের চোটে কানাইয়ের মনটা যেন ভাষাহীন হয়ে গেছে। যে ধ্বনি আর চিহ্নগুলো এক সঙ্গে মন আর বোধের মধ্যে জলকপাটের মতো কাজ করে হঠাৎ যেন অচল হয়ে গেছে সেগুলো। মাথার ভেতরটা শুধু ভেসে যাচ্ছে নির্ভেজাল অনুভূতির বন্যায়। যে শব্দগুলোর জন্যে ও হাতড়ে বেড়াচ্ছে, যে কথাগুলো এই প্রচণ্ড ভয়ের উৎস, আসল জিনিসটাই যেন তাদের জায়গা নিয়ে নিয়েছে এখন। সমস্যাটা শুধু, ভাষা বা শব্দ ছাড়া তাকে বোঝা যাবে না, উপলব্ধি করা যাবে না তার তাৎপর্য। এ যেন শুদ্ধ চৈতন্যের হাতে গড়া এক মূর্তি, যার উপস্থিতি এমনকী আসলের চেয়েও বহুগুণে প্রবল, অনেক বেশি অস্তিত্বময়।

কানাই চোখ খুলল। সামনে তাকাতেই দেখতে পেল ওটাকে। একেবারে ওর মুখোমুখি, একশো মিটারের মধ্যে। পেছনের পায়ের ওপর ভর দিয়ে বসে আছে, মাথা তুলে তাকিয়ে রয়েছে কানাইয়ের দিকে, জ্বলজ্বলে পাঙাশ চোখে ওকে দেখছে। শরীরের ওপরের দিকের লোমগুলো রোদের আলোয় সোনার মতো রং ধরেছে। পেটের দিকটা কিন্তু গাঢ়, কাদায় ঢাকা। আকারে বিশাল, কানাই যেরকম ভেবেছিল তার চেয়ে অনেকটাই বড়। চোখদুটো আর লেজের ডগাটা ছাড়া সারা শরীরে এতটুকু স্পন্দনের লক্ষণ নেই।

এতটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল কানাই প্রথমটায়, যে নড়াচড়া করারও শক্তি লোপ পেয়ে গিয়েছিল। একটু দম ফিরে পেয়ে কোনও রকমে উঠে বসল হাঁটুতে ভর দিয়ে, তারপর খুব ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগল ওর কাছ থেকে। জানোয়ারটার দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে পিছু হটে হটে জঙ্গলের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতে লাগল। আর পুরোটা সময় জুড়ে মোচড় খেতে থাকল প্রাণীটার লেজের ডগা। জঙ্গলের আলিঙ্গনের ভেতর ঢুকে এসে অবশেষে খাড়া হল কানাই। তারপর কাটা-খোঁচার তোয়াক্কা না করে ঘুরে দাঁড়িয়ে দু’হাতে ডালপালা সরিয়ে এগোতে লাগল। শেষ পর্যন্ত বাদাবনের দেওয়াল ভেঙে যখন নদীর ধারে পোঁছল, তখন হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল কানাই। হাতের পেছনে চোখ ঢেকে নিজেকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করল চরম আঘাতের মুহূর্তটার জন্য–যে প্রচণ্ড আঘাতে মট করে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে ঘাড়ের হাড়গুলি।

“কানাই!” চিৎকারটা শুনে মুহূর্তের জন্যে খুলে গেল চোখদুটো। এক পলক দেখতে পেল পিয়া, ফকির আর হরেন নদীর পাড় দিয়ে দৌড়ে আসছে ওর দিকে। তারপরেই ফের হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল কাদার ওপর, অন্ধকার হয়ে গেল মাথার ভেতরটা।

আবার যখন চোখ খুলল, তখন ও ডিঙির ওপর চিত হয়ে শোওয়া। দুপুরের রোদে ঝলসে যাচ্ছে আকাশ। একটা মুখের আদল খুব ধীরে ধীরে আকার নিচ্ছে চোখের সামনে। পিয়ার মুখ। আস্তে আস্তে বুঝতে পারছিল কানাই ওর কাঁধের নীচে হাত দিয়ে তুলে বসানোর চেষ্টা করছে পিয়া।

“কানাই? আর ইউ ও কে?”

“আপনি কোথায় ছিলেন পিয়া?” জবাবে বলল কানাই। “কতক্ষণ ওই দ্বীপটায় একা . একা ছিলাম আমি।”

“মাত্র দশ মিনিট আপনি একা ছিলেন ওখানে, কানাই। ফকিরকে নাকি আপনিই ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ও তো পড়িমরি করে এল আমাদের নিয়ে যেতে, আর আমরাও যত তাড়াতাড়ি পারি গিয়ে পৌঁছলাম।”

“আমি দেখেছি পিয়া। বাঘ দেখেছি আমি।” হরেন আর ফকিরও পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখতে পেয়ে বাংলায় বলল, “ওখানে ছিল। বড় শেয়াল–আমি দেখেছি।”

মাথা নাড়ল হরেন। বলল, “না কানাইবাবু, কিছু ছিল না ওখানে। আমি আর ফকির ভাল করে দেখেছি। কিছু দেখতে পাইনি। আর, যদি কিছু থাকত আপনি তা হলে আর এতক্ষণে এখানে থাকতেন না।”

“ছিল ওখানে, আমি বলছি।” এত কঁপছিল কানাইয়ের সারা গা যে কোনও রকমে কথাগুলি উচ্চারণ করতে পারল ও। শান্ত করার জন্যে এক হাতে ওর কবজিটা ধরল পিয়া। নরম গলায় বলল, “ঠিক আছে কানাই। আর ভয় নেই। আমরা সবাই তো এখন আছি। আপনার সঙ্গে।”

কানাই জবাব দেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু দাতে দাঁত লেগে যাচ্ছিল বারবার, শ্বাসটা যেন খালি খালি আটকে যাচ্ছিল গলার মধ্যে।

“কথা বলবেন না,” বলল পিয়া। “আমার ফার্স্ট এইড বক্সে ঘুমের ওষুধ আছে, লঞ্চে পৌঁছেই একটা দিয়ে দেব আপনাকে। আপনার এখন একটা ভাল বিশ্রাম দরকার। তারপর দেখবেন, ভাল লাগবে।”