স্বপ্ন

বাইরে ঝড়ের গর্জন থামার কোনও লক্ষণ নেই। বোঝা গেল সে রাতে আর লুসিবাড়ি ফেরা সম্ভব নয়।

“সার,” একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অবশেষে বলল হরেন, “মনে হচ্ছে কুসুমের ঘরের মেঝেতেই আজকের রাতটা কাটাতে হবে আমাদের।”

“যা ভাল বোঝ,” বললাম আমি। “তুমি যা ঠিক করবে তাই হবে।”

খানিক পরে ভাত চাপাল কুসুম। ফকির ক’টা ট্যাংরা মাছ ধরে এনেছিল, তাই দিয়ে ঝোল রাঁধল। খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে ঘরের একপাশে হরেন আর আমার জন্য মাদুর পেতে দিল, আর নিজে ফকিরকে নিয়ে শুল আরেক কোনায়। অনেক রাতে, ঝড় তখন থেমে গেছে, একবার দরজা খোলার আওয়াজ কানে এল। বুঝলাম হরেন বেরোল, নৌকোটা ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে আসতে। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়লাম, বিকারগ্রস্ত জ্বরো রোগীর মতো সে ঘুম, একটা ঘোরের মধ্যে যেন ছটফট করতে লাগলাম।

“সার”–কুসুমের গলা শুনতে পেলাম। অন্ধকারে মুখ দেখা যাচ্ছে না। “শরীর খারাপ লাগছে?”

“না তো। কিছু তো হয়নি। কেন রে?”

“না, আপনি ঘুমের মধ্যে চেঁচিয়ে উঠলেন একবার, তাই ভাবলাম।”

কুসুম আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে টের পেলাম। চোখে জল এল আমার। “ওসব বুড়ো মানুষের রাতের বেলার ভয়,” অবশেষে বললাম আমি। “এখন ঠিক আছি রে। যা, ছেলের কাছে যা। ঘুমো গিয়ে।”

সকালবেলা উঠে দেখি আকাশে এক ছিটে মেঘ নেই কোথাও। এরকম একটা ঝড়ের পরে তাই হয় সাধারণত। ঝকঝকে রোদে ধুয়ে যাচ্ছে গোটা দ্বীপ আর নদী। কুসুমের ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি কাছাকাছি আরও কয়েকটা এরকম কুঁড়ে রয়েছে। হেঁটে হেঁটে খানিকটা দূর পর্যন্ত গেলাম, দেখলাম বনবাদাড় সাফ করা মাঠের ওপর আরও অনেক ঘর কয়েকটা কুঁড়ে, কিছু গুমটি, বস্তি মতো কয়েকটা। যেরকম হয় এ ধরনের ঘর এই ভাটির দেশে বাঁশ, দরমা আর মাটি দিয়ে তৈরি। কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করলাম: ঘরগুলো কিন্তু যেখানে সেখানে ইচ্ছে মতো বানানো হয়নি।

কী আশা করেছিলাম আমি? নোংরার মধ্যে এলোমেলো ভাবে কিছু মানুষ কোনওরকমে একসঙ্গে গাদাগাদি করে বাস করছে? ‘রিফিউজি’ শব্দটার অর্থ তো সেরকমই হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু যা দেখলাম তার সঙ্গে আমার কল্পনার কোনও মিলই নেই। রাস্তাঘাট এর মধ্যেই বানানো হয়ে গেছে; বাঁধ–দ্বীপজীবনের নিরাপত্তায় যার প্রধান ভূমিকা–তাও তৈরি হয়েছে; জমি ভাগ ভাগ করে বেড়া দিয়ে ঘেরা হয়ে গেছে; বেড়ার ওপর শুকোচ্ছে মাছধরা জাল। মহিলা পুরুষ সবাই যার যার ঘরের সামনে বসে বসে জাল সারাই করছে অথবা টোপ গাঁথছে কঁকড়া ধরার সুতোয়।

কী শৃঙ্খলা! কী পরিশ্রম! তাও মাত্রই কয়েক সপ্তাহ হল এরা এখানে এসেছে। দৃশ্যগুলি মনে গেঁথে নিতে নিতে একটা অদ্ভুত, মাতাল-করা উত্তেজনা এল আমার মধ্যে: হঠাৎ আবিষ্কার করলাম নতুন একটা কিছু জন্ম নিচ্ছে আমার চোখের সামনে, যা আগে কেউ কখনও দেখেনি। মনে হল নিশ্চয়ই ঠিক একই অনুভূতি হয়েছিল হ্যামিলটনের লঞ্চের ডেকে দাঁড়িয়ে বাদাবন সাফ করা দেখতে দেখতে। কিন্তু এই মরিচঝাঁপিতে যা হচ্ছে তার সঙ্গে হ্যামিলটনের কাজের একটা মূলগত ফারাক আছে; এটা কোনও একজন মানুষের ভাবনা নয়। যারা এখানে বসত করতে এসেছে এ তাদেরই নিজেদের স্বপ্ন, সেই স্বপ্নকেই বাস্তব করে তুলছে তারা।

আমার চলা থেমে গেল। বৃষ্টিভেজা রাস্তার ওপর এক জায়গায় ছাতায় ভর দিয়ে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি, আমার কোঁচকানো ধুতি অল্প অল্প উড়তে লাগল সকালের ফুরফুরে বাতাসে। মনে হল আমার ভেতরে যেন একটা পরিবর্তন আসছে। কী বিস্ময়কর, আমি–বই মুখে করে সারা জীবন কাটানো একজন ইস্কুল মাস্টার আমার জীবদ্দশায় এরকম একটা ঘটনা দেখে যাচ্ছি যা কোনও শিক্ষিত বা ক্ষমতাবান মানুষের কল্পনাপ্রসূত নয়, শিক্ষা আর ক্ষমতা যাদের নেই তাদেরই নিজস্ব স্বপ্নের বাস্তবায়ন প্রত্যক্ষ করছি আমি!

মনে হল আমার শিরায় শিরায় যেন নতুন প্রাণ ফিরে আসছে। ছাতা ফেলে দিলাম হাত থেকে, বুক চিতিয়ে দাঁড়ালাম রোদ আর হাওয়ার মুখোমুখি। মনে হল যে শূন্যতাকে এত দিন দু’হাতে আঁকড়ে ছিলাম আমি, এক রাত্রে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি দূরে।

ভীষণ উত্তেজিত অবস্থায় আবার ফিরে গেলাম কুসুমের ঘরে। আমার চেহারা দেখে ঘাবড়ে গেল ও। বলল, “কী হয়েছে সার? আপনার জামা কাপড়ে কাদা লাগা, মুখটা লাল হয়ে গেছে… আপনার ছাতাটা কোথায় গেল?”

“সেসব কথা ছাড় এখন,” অধৈর্য লাগছিল আমার, “আগে বল, কে আছে এ সবের দায়িত্বে? কোনও কমিটি তৈরি হয়েছে? নেতা-টেতা কেউ আছে?”

“সে তো আছেই। কেন বলুন তো?”

“তাদের সঙ্গে আমি দেখা করব।”

“কেন সার?”

“কারণ, এখানে যা হচ্ছে তাতে আমিও কিছু করতে চাই, সাহায্য করতে চাই যে রকম পারি।”

“সে আপনি চাইলে করবেন। আমি না বলার কে?”

কুসুম আমাকে জানাল যে গোটা দ্বীপটাকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রত্যেকটা ভাগের দায়িত্বে আছে কিছু লোক, তারাই সমস্ত ঠিক করছে কী করা হবে না হবে, জরুরি যা যা দরকার তারাই তার ব্যবস্থা করছে।

“তোদের ভাগটার মূল দায়িত্বে যে আছে তার কাছে নিয়ে চল আমাকে,” বললাম আমি। কুসুম পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল আমাকে, খানিক দূরে একটা কুঁড়ের দরজায়।

নেতাটি দেখলাম বেশ বুদ্ধিমান, কর্মঠ লোক, আদৌ কোনও স্বপ্নের জগতের বাসিন্দা নয়। কেউ এসে খামখা সময় নষ্ট করলে তাকে পাত্তা দেওয়ার মানুষ সে নয়। স্বল্পবাক, কিন্তু হাবেভাবে এমন একটা আত্মবিশ্বাসের ছাপ, যেন ও জানে যে সাফল্য হাতের নাগালের মধ্যে প্রায়। খুবই ব্যস্ত ছিল সে, কিন্তু যখন শুনল আমি একটা স্কুলের হেডমাস্টার–যদিও অবসর নেওয়ার সময় এসে গেছে প্রায় আমাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে সব দেখাল। নতুন বানানো রাস্তা ধরে হেঁটে গেলাম আমরা, আমাকে দেখাতে দেখাতে নিয়ে গেল কী কী কাজ ওরা করেছে আসার পর থেকে এই কয় সপ্তাহে। মুগ্ধ হয়ে গেলাম আমি, কাজের বহর দেখে শুধু নয়, তার পেছনে যে সংগঠন, যে প্রতিষ্ঠান–কত যত্ন নিয়ে তা গড়ে তোলা হয়েছে, তাই দেখেও। দ্বীপে নিজেদের একটা সরকার তৈরি করে ফেলেছে এরা, জনগণনাও হয়েছে–এর মধ্যেই মরিচঝাঁপির লোকসংখ্যা ত্রিশ হাজার ছাড়িয়ে গেছে, আরও অনেক মানুষের জন্য এখনও জায়গা রয়ে গেছে। গোটা দ্বীপটাকে পাঁচটা ভাগে ভাগ করা হয়েছে, প্রতিটি পরিবারের জন্য বরাদ্দ হয়েছে পাঁচ একর করে জমি। আরও একটা ব্যাপারে ওদের বিচক্ষণতার পরিচয় পেলাম–ওরা বুঝেছে যে আশেপাশের প্রতিবেশী দ্বীপগুলির সহায়তা না পেলে এই বিশাল পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা সম্ভব নয়। দ্বীপের চারভাগের এক ভাগ তাই রেখে দেওয়া হয়েছে ভাটির দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের জন্য। এর মধ্যেই বেশ কয়েকশো পরিবার চলে এসেছে। সেখানেও।

দ্বীপ পরিক্রমার শেষে আমার গাইডের দু’হাত জড়িয়ে ধরলাম আমি: “ভবিষ্যৎ আপনাদেরই পক্ষে, কমরেড।”

একটু হাসল লোকটি। বলল, “আপনাদের সকলের সাহায্য ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়।”

বোঝা গেল ও মনে মনে চিন্তা করছে কীভাবে কাজে লাগানো যায় আমাকে। বেশ ভাল লাগল আমার ব্যাপারটা। মনে হল ভাল লক্ষণ এটা–বাস্তববাদী চিন্তা।

“আমি সাহায্য করতে প্রস্তুত,” বললাম আমি। “বলুন, কীভাবে কাজে লাগতে পারি আপনাদের।”

“সেটা কয়েকটা জিনিসের ওপর নির্ভর করছে,” ও বলল। “যেমন ধরুন, এখন আমাদের কাছে সবচেয়ে জরুরি হল জনমত তৈরি করা, সরকারের ওপর কোনও ভাবে চাপ সৃষ্টি করা, যাতে আমাদের নিজেদের মতো থাকতে দেওয়া হয় এখানে। এমনভাবে ওরা প্রচার করছে যেন এ জায়গাটাকে ধ্বংস করে ফেলছি আমরা; যাতে লোকে ভাবে যে আমরা কিছু গুণ্ডা, জোর করে জমি দখল করেছি এখানে এসে। কিন্তু আমরা যে ঠিক কী করছি, কেন এসেছি এখানে, সেটা আমরা মানুষকে জানাতে চাই। আমরা চাই সত্যিটা সবাই জানুক–কী কী করেছি আমরা এখানে এই ক’দিনে, কতটা সফল হয়েছে আমাদের উদ্দেশ্য। এই ব্যাপারে কোনও সাহায্য করতে পারেন আপনি? কলকাতায় খবরের কাগজে চেনাশোনা আছে আপনার?”

খারাপ লাগল না আমার লোকটির মনোভাব; ঠিকই তো, এই পথেই তো এগোনো উচিত এখন। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে জানাতে হল, “কাগজের লোকেদের সঙ্গে চেনাশোনা ছিল এক সময়, কিন্তু এখন তো আর নেই।”

“তা হলে হোমরা-চোমরা আর কাউকে চেনেন? পুলিশের লোক, কি ফরেস্ট রেঞ্জার, বা পার্টির নেতা-টেতা কাউকে?”

“না,” বললাম আমি। “সে রকম কাউকে তো আমি চিনি না।”

একটু বিরক্ত হল লোকটি। বলল, “তা হলে আর কী করবেন আপনি আমাদের জন্য বলুন তো? কী কাজ হবে আপনাকে দিয়ে?”

সত্যিই তো। কী কাজ হবে আমাকে দিয়ে? এ জগতে কত মানুষ আছে যারা সত্যিকারের কাজের লোক, যাদের সত্যিকারের কিছু উপযোগিতা আছে। যেমন ধর নীলিমা। কিন্তু আমার মতো একজন স্কুল মাস্টার?

“একটা কাজ করতে পারি,” আমি বললাম, “আমি পড়াতে পারি।”

“পড়বেন?” মনে হল প্রাণপণে হাসি চাপার চেষ্টা করছে লোকটি। “কী পড়াবেন আপনি এখানে?”

“এই, যেখানে আপনারা এসেছেন সেই ভাটির দেশের কথা শেখাতে পারি বাচ্চাদের। আমার হাতে এখন অনেক সময় আর কিছুদিনের মধ্যেই রিটায়ার করব আমি।”

আমার বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলল লোকটি। “আমাদের বাচ্চাদের এখানে নষ্ট করার মতো সময় নেই,” ও বলল। “খাবার জোগাড়ের জন্য বাড়ির বড়দের সাহায্য করতে হয় ওদের।”

তারপর একটু ভেবে আবার বলল, “অবশ্য পড়াশোনা করতে চায় এরকম ছাত্র যদি আপনি জোগাড় করতে পারেন তা হলে আমি কেন বাধা দেব? সে আপনার ব্যাপার; পড়ান, প্রাণে চায়।”

বিজয়গর্বে ফিরে এলাম আমি কুসুমের ঘরে। কী কী কথাবার্তা হয়েছে সব বললাম ওকে। “কিন্তু এখানে কাদের পড়াবেন সার আপনি?” স্পষ্ট আশঙ্কা ওর গলায়।

“কেন?” আমি বললাম। “তোর ছেলে ফকির আছে, এরকম আরও কয়েকজনকে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। যাবে না?” একটা অনিচ্ছার ছায়া যেন দেখতে পেলাম কুসুমের মুখে। প্রায় অনুরোধের সুরে তাই বললাম, “প্রতিদিন নয় রে। সপ্তাহে হয়তো একদিন, অল্প একটু সময়ের জন্য। আমি চলে আসব লুসিবাড়ি থেকে।”

“কিন্তু সার,” বলল কুসুম, “ফকির তো লিখতে পড়তে পারে না। এখানকার বেশিরভাগ বাচ্চারই সেই একই অবস্থা। ওদের কী শেখাবেন আপনি?”

সেটা ভাবিনি আমি আগে, কিন্তু যেন ঠোঁটের ডগায় কে জুগিয়ে দিল জবাবটা। বললাম, “কুসুম, ওদের আমি স্বপ্ন দেখতে শেখাব।”