পরের সপ্তাহেই আবার মরিচঝাঁপি যাব ঠিক করেছিলাম, কিন্তু হেডমাস্টারের রিটায়ার করার সময় অনেক টুকিটাকি কাজ আর নিয়মমাফিক অনুষ্ঠান থাকে–সেই সবের মধ্যে আটকে গেলাম আমি। অবশেষে সব ঝামেলা মিটল, সরকারিভাবে শেষ হয়ে গেল আমার কর্মজীবন।
কয়েকদিন পর আমার পড়ার ঘরে এসে কড়া নাড়ল হরেন। “সার!”
“কুমিরমারির বাজারে গিয়েছিলাম,” ও বলল। “সেখানে কুসুমের সঙ্গে দেখা। ও কিছুতেই ছাড়বে না, বলল ওকে এখানে নিয়ে আসতে হবে।”
“এখানে!” প্রায় চমকে উঠলাম আমি। “এই লুসিবাড়িতে? কেন?”
“ও মাসিমার সঙ্গে দেখা করবে। মরিচঝাঁপির লোকেরা মাসিমার সাহায্য চায়।”
সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম আমি। এটাও স্থানীয় সমর্থন জোগাড়ের জন্য উদ্বাস্তুদের চেষ্টার অঙ্গ। তবে এই ক্ষেত্রে ওদের চেষ্টায় কোনও ফল হবে বলে মনে হল না আমার।
“হরেন, তুমি কুসুমকে বারণ করতে পারতে,” বললাম আমি। “নীলিমার সঙ্গে দেখা করে ওদের কোনও লাভ হবে না।”
“বলেছিলাম সার। কিন্তু ও কিছুতেই ছাড়বে না।”
“ও কোথায় এখন?”
“নীচে সার। মাসিমার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু আপনার কাছে কাকে নিয়ে এসেছি দেখুন।” একপাশে সরে দাঁড়াল হরেন, আর আমি দেখলাম এতক্ষণ ধরে ওর আড়ালে লুকিয়ে দাঁড়িয়েছিল ফকির।
“আমাকে একবার বাজারে যেতে হবে। ওকে তাই আপনার কাছে রেখে গেলাম।” পাঁচ বছরের ছেলেটাকে আমার কাছে বসিয়ে রেখে একদৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে গেল ও।
এতদিন মাস্টারি করতে করতে একাধিক বাচ্চার সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করতে হয় সেটাই জেনেছি, কিন্তু নিজের কোনও সন্তান না থাকায়, শুধুমাত্র একজন শিশুর সাথে কথা বলার অভ্যাস আমার ছিল না। এখন একজোড়া পাঁচ বছর বয়সি খোলা চোখের নজরের সামনে বসে আমি যা যা বলব ভেবে রেখেছিলাম সবই ভুলে গেলাম।
প্রায় আতঙ্কে ছেলেটাকে নিয়ে ছাদের ধারে গেলাম আমি। সামনে রায়মঙ্গলের মোহনার দিকে দেখিয়ে বললাম, “দেখো কমরেড, সামনে চোখ মেলে তাকাও, বলো আমাকে কী দেখতে পাচ্ছ।”
মনে হল আমি কী জানতে চাইছি সেটা নিজেকেই ও মনে মনে জিজ্ঞেস করছিল। খানিক এদিক ওদিক তাকিয়ে অবশেষে বলল, “বাঁধ দেখতে পাচ্ছি সার।”
“বাঁধ দেখতে পাচ্ছ? তা তো বটেই, বাঁধই তো দেখা যাচ্ছে।”
এই উত্তর আমি আদৌ আশা করিনি, কিন্তু খুবই স্বস্তি পেলাম মনে মনে জবাবটা পেয়ে। কারণ এই ভাটির দেশে বাঁধ শুধু যে মানুষের প্রাণরক্ষা করে তা তো নয়, বাঁধই তো আমাদের ইতিহাসের ভাড়ারঘর, অঙ্কের আকর, গল্পের খনি। এই বাঁধ যতক্ষণ আমার চোখের সামনে আছে, আমি জানি আমার কথা বলার বিষয়ের কোনও অভাব হবে না।
“ঠিক আছে কমরেড, চালিয়ে যাও। আবার দেখো, খুব ভাল করে দেখো। দেখি তো খুঁজে বের করতে পারো কিনা কোন কোন জায়গায় বাঁধটা সারাই করা হয়েছে। প্রত্যেকটা জায়গার জন্য আমি একটা করে গল্প বলব তোমাকে।”
হাত তুলে একটা জায়গার দিকে ইশারা করল ফকির। “ওইখানটায় কী হয়েছিল সার?”
“আচ্ছা, ওইখানটায়। কুড়ি বছর আগে ওই জায়গায় বাঁধটা ভেঙেছিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, ঝড়েও ভাঙেনি, কন্যাতেও ভাঙেনি। একটা লোক গিয়ে ওখানে বাঁধটা কেটে দিয়েছিল। কেন জানো? এক পড়শির সঙ্গে ওর ঝগড়া হয়েছিল, সেইজন্য। রাতের অন্ধকারে চুপিচুপি গিয়ে বাঁধের ওই জায়গাটায় ও একটা গর্ত করে রেখে এল। ভাবল ওখান দিয়ে নোনা জল ঢুকে পড়শির খেতটা ডুবিয়ে দেবে। কিন্তু এটা ওর মাথায় আসেনি যে বাঁধ কেটে ও নিজেরও একই ক্ষতি করছে। তাই ওদের দু’জনের কেউই আর এখন এখানে থাকে না কারণ নোনা জল ঢোকার পর দশ বছর পর্যন্ত আর কিছু চাষ করা যায়নি ওই জায়গার জমিতে।”
“আর ওখানটায় সার? ওখানে কী হয়েছিল?”
“ওই জায়গার গল্পটা শুরু হয়েছিল একবার জোয়ারের সময়। কোটাল গোনে জল খুব বেড়ে গিয়েছিল সেবার, তারপরে ওখান দিয়ে উপছে এসে ঢুকেছিল গাঁয়ে। তখন বাঁধ সারাইয়ের ঠিকাদারি যাকে দেওয়া হল সে ছিল তখনকার গ্রামপ্রধানের শালা। সে তো বলল এমন করে সারিয়ে দেবে যে জীবনে আর জল ঢুকবে না ওখান দিয়ে। কিন্তু পরে দেখা গেল ও জায়গায় যত মাটি ফেলার পয়সা তাকে দেওয়া হয়েছিল তার মাত্র অর্ধেক পয়সার মাটি ফেলেছে। বাকি পয়সাটা অন্যসব শালাদের সঙ্গে ভাগ করে খেয়ে ফেলেছে।”
“আর ওই জায়গাটায় সার?”
ভাল গল্প বলিয়েদেরও মাঝে মাঝে থামতে জানতে হয়। জানতে হয় কখনও কখনও বিচক্ষণতার দাম সাহসের চেয়ে অনেক বেশি। “ওই জায়গাটার বিষয়ে কমরেড খুব বেশি কিছু আমি তোমাকে বলতে পারব না। ওখানে যারা থাকে তাদের দেখতে পাচ্ছ, ওই যে বাঁধের ধার ঘেঁষে পরপর ঘরগুলোতে? এখন ব্যাপার হল গিয়ে একবার ওই লোকগুলো একটা ভুল দলকে ভোট দিয়ে ফেলেছিল। ফলে অন্য আরেক পার্টি যখন ক্ষমতায় এল, তারা ঠিক করল শোধ নিতে হবে। সেই শোধ নেওয়ার জন্য ওরা কী করল? না, ওই জায়গায় বাঁধের গায়ে একটা গর্ত করে রেখে দিল। রাজনীতি যারা করে তারা এইরকমই হয়, তবে এই নিয়ে আর বেশি কথা না বলাই ভাল–এই বিষয়টা আমাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে খুব একটা ভাল নাও হতে পারে। তার চেয়ে বরং ওই জায়গাটা দেখো, ওই যে, আমি আঙুল দিয়ে য়ে জায়গাটা দেখাচ্ছি, ওইখানটা।”
যে জায়গাটার দিকে আমি ইশারা করলাম তিরিশের দশকের এক ঝড়ে সেখানে প্রায় কিলোমিটারখানেক বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে গিয়েছিল।
“একবার কল্পনা করো ফকির, কী কঠিন জীবন ছিল তোমার পূর্বপুরুষদের,” বললাম আমি। “ওরা তখন মাত্রই এসেছে এই ভাটির দেশে, নতুন এসে বসত করেছে এই দ্বীপে। বছরের পর বছর ধরে নদীর সাথে লড়াই করে আস্তে আস্তে এই বাঁধের ভিতটা সবে বানিয়েছে। বহু পরিশ্রমে কয়েক মুঠো ধান আর আলুপটলও ফলাতে পেরেছে। বছরের পর বছর খুঁটির ওপর বাসা বানিয়ে থাকার পর অবশেষে নেমে আসতে পেরেছে মাটিতে। সমান জমিতে কয়েকটা বস্তি ঝুপড়ি বানাতে পেরেছে। এই সবকিছুই কিন্তু ওই বাঁধের কল্যাণে। এবার কল্পনা করো সেই ভয়াবহ রাতের কথা। ঝড় যখন এল তখন সবে কোটাল লেগেছে; ভাবো একবার, সেই চাল-উড়ে যাওয়া ঘরে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে বসে ওরা দেখছে জল বাড়ছে, বাড়ছে… এত বছরের পরিশ্রমে নদীকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য যে বালি আর মাটি জড়ো করেছিল ওরা, চোখের সামনে তার ওপর এসে আছড়ে আছড়ে পড়ছে ঢেউ। ভাবো একবার, কীরকম লাগছিল ওরা যখন দেখল মাটি গলিয়ে হু হু করে ঢুকে আসছে জোয়ারের জল, তাড়া করে আসছে পেছন পেছন, পালিয়ে বাঁচার কোনও উপায়ই নেই। আমি তোমাকে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি দোস্ত, সেদিন এই নদীর সামনে দাঁড়িয়ে ওই দৃশ্য দেখার চেয়ে বাঘের মুখে গিয়ে দাঁড়াতে বললেও রাজি হয়ে যেত ওদের যে কেউ।”
“আরও ঝড় হয়েছিল সার?”
“আরও অনেকবার ঝড় এসেছে ফকির, অনেকবার। দেখো ওই জায়গাটার দিকে তাকিয়ে দেখো,” নদীর পাড়ে দ্বীপের একটা জায়গার দিকে দেখালাম আমি। দেখে মনে হয় যেন বিশাল কোনও দানব কোনওদিন লুসিবাড়ির নদীতীরের ওই জায়গা থেকে একটা টুকরো কামড়ে ছিঁড়ে নিয়েছে। “দেখো। ১৯৭০ সালের ঝড়ে এই কাণ্ড হয়েছিল। বিশাল ভাঙন ধরেছিল–দ্বীপের চার একর জমি ওখান থেকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিল নদী। মুহূর্তের মধ্যে মাঠ ঘাট গাছপালা বাড়িঘর সবসুদ্ধ চলে গেল জলের তলায়।”
“সবচেয়ে বড় ঝড় ছিল ওটা?”
“না কমরেড, না। সবচেয়ে বড় ঝড় যেটাকে বলা হয়, সে হয়েছিল আমারও জন্মের আগে। এখানে লোকজন এসে বসত শুরু করারও অনেক আগে।”
“কবে সার?”
“সে ঝড় হয়েছিল ১৭৩৭ সালে। তার তিরিশ বছর আগে ঔরঙ্গজেব বাদশা মারা গেছেন, সারা দেশ জুড়ে নানা গোলমাল। কলকাতা শহরের সবে জন্ম হয়েছে। গোলমালের সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা এসে আস্তে আস্তে উঁকিয়ে বসছে। এই গোটা পুবদেশে তখন কলকাতা তাদের প্রধান বন্দর।”
“তারপর কী হল সার?”
“সে ঝড় হয়েছিল অক্টোবর মাসে। ওই সময়টাতেই বেশি ঝড় হয়–অক্টোবর আর নভেম্বর। সে ঝড়ের ঘা এসে লাগার আগেই বিশাল এক ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল এই ভাটির দেশে। বারো মিটার উঁচু সেই জলের দেওয়াল এসে ভেঙে পড়ল এখানে। কত বড় ঢেউ বুঝতে পারছ? ওইরকম একটা ঢেউ যদি এখন আসে, তা হলে তোমার দ্বীপ তো বটেই, আমাদের এই দ্বীপেও সবকিছু জলের তলায় চলে যাবে। এই ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে থাকলেও ডুবে যাব আমরা।”
“না।”
“হ্যাঁ, কমরেড, হ্যাঁ। কলকাতার কিছু ইংরেজ তখন এইসব মাপজোক করে সমস্ত লিখে রেখে দিয়েছিল। এতদূর পর্যন্ত জল উঠেছিল যে হাজার হাজার জন্তু জানোয়ার মারা পড়েছিল তাতে। সেই মরা জানোয়ারগুলো জলের টানে নদীর উজান বরাবর বহু দূর পর্যন্ত ভেসে গিয়েছিল। অনেক জায়গায় ডাঙার ভেতরে পর্যন্ত চলে গিয়েছিল সেইসব জীবজন্তুর লাশ। এমনকী নদী থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে ধানজমিতে, গ্রামের পুকুরের মধ্যে মরা বাঘ আর গণ্ডারের দেহ পাওয়া গিয়েছিল সেই ঝড়ের পরে। মাঠের পর মাঠ ছেয়ে গিয়েছিল মরা পাখির পালকে। আর সেই ঢেউ যখন এই ভাটির দেশের ওপর দিয়ে কলকাতার দিকে ধেয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময় আরও একটা ঘটনা ঘটল–এক অকল্পনীয় ঘটনা।”
“কী ঘটল সার? কী ঘটল?”
“বিরাট এক ভুমিকম্প হল কলকাতায়।”
“সত্যি সত্যি?”
“সত্যি, দোস্ত। একেবারে খাঁটি সত্যি। সেই জন্যেই আরও এই ঝড়ের কথা মনে আছে লোকের। কোনও কোনও বৈজ্ঞানিকের ধারণা যে ঝড় আর ভূমিকম্পের মধ্যে কোনও একটা রহস্যজনক সম্পর্ক আছে। কিন্তু এই প্রথম দুটোই একসঙ্গে ঘটতে দেখা গেল।”
“তারপরে কী হল সার?”
“মুহূর্তের মধ্যে হাজার হাজার বাড়ি ধসে পড়ল কলকাতায়। ইংরেজদের প্রাসাদ থেকে শুরু করে এমনি সাধারণ বাড়ি, কুঁড়েঘর, কিছুই রেহাই পেল না। ইংরেজদের যে গির্জা ছিল, তার চুড়োটা টুকরো টুকরো হয়ে এসে পড়ল মাটিতে। লোকে বলে শহরের একটা বাড়িরও নাকি চারটে গোটা দেওয়াল অক্ষত ছিল না। সেতু-টেতু সব উড়ে চলে গেল, জাহাজঘাটাগুলো জলের তোড়ে কোথায় ভেসে গেল, গুদামের ধানচাল কিচ্ছু বাকি রইল না, বারুদখানার বারুদও হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। দেশ-বিদেশের ছোটবড় জাহাজ সব নোঙর করা ছিল তখন নদীতে। তার মধ্যে ইংরেজদেরও দুটো জাহাজ ছিল–পাঁচশো টনের জাহাজ একেকটা। সেই জাহাজগুলোকে জল থেকে তুলে উড়িয়ে নিয়ে গেল ঝড়ে, গাছপালা ঘরবাড়ির ওপর দিয়ে উড়ে নদী থেকে আধ কিলোমিটার দূরে গিয়ে পড়ল সেগুলো। বিশাল বিশাল সব বজরা কাগজের ঘুড়ির মতো লাট খেতে খেতে উড়ে গেল। শোনা যায় সবসুদ্ধ কুড়ি হাজার জাহাজ, নৌকো, বজরা আর ডিঙি নষ্ট হয়েছিল ওই একদিনে। যেগুলো টিকে ছিল, সেগুলি নিয়েও অদ্ভুত সব ঘটনার কথা শোনা যেতে লাগল।”
“কীরকম ঘটনা সার?”
“একটা ফরাসি জাহাজ ঝড়ের তোড়ে পাড়ের ওপর অনেকটা দূর পর্যন্ত উঠে গিয়েছিল। কিন্তু জাহাজের মালপত্র সব নষ্ট হয়নি। ঝড়ের পরদিন, জাহাজের নাবিকদের মধ্যে যে ক’জন বেঁচেছিল তারা মাঠের মধ্যে দেখতে গেল–ওই ধ্বংসাবশেষ থেকে যদি কিছু উদ্ধার করা যায়। একজন মাল্লাকে পাঠানো হল জাহাজের খোলের ভেতর কী কী অক্ষত আছে গিয়ে দেখে আসতে। তারপর বেশ খানিকক্ষণ কেটে গেল, কিন্তু লোকটা আর বেরোয় না। বাইরে যারা ছিল, তারা চেঁচিয়ে ডাকাডাকি করতে লাগল, কিন্তু কোনও সাড়া নেই। তখন আরেকজন লোককে পাঠানো হল। খোলের ভেতরে ঢুকে যাওয়ার পর তার কাছ থেকেও কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। তারপর আরও একটা লোক গেল, কিন্তু সেই একই ব্যাপার। বাইরে যারা ছিল তারা তখন খুব ভয় পেয়ে গেল। কেউ আর খোলের মধ্যে ঢুকতে রাজি হয় না। শেষে একটা আগুন জ্বালানো হল–অন্ধকার খোলের ভিতরে কী ব্যাপারটা হচ্ছে সেটা দেখার জন্য। আগুন যখন দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করল, সেই আলোয় দেখা গেল খোলের ভেতরটা জলে টইটম্বুর, আর তার মধ্যে সাঁতরে বেড়াচ্ছে এক প্রকাণ্ড কুমির। ওই তিনটে লোককে সেটাই মেরে ফেলেছে।
“এটা কিন্তু বানানো গল্প নয় কমরেড, এক্কেবারে খাঁটি সত্যি ঘটনা। এই সমস্ত বিবরণ লেখা নথিপত্র যত্ন করে রাখা আছে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে, যেখানে বসে দাস ক্যাপিটাল লিখেছিলেন মার্ক্স সাহেব।”
“ওরকম ঝড় তো আর হবে না, তাই না সার?”
বুঝতে পারলাম আমাদের এইসব নদীর খিদে কতটা হতে পারে সেটা আঁচ করার চেষ্টা করছে ফকির। ওর ছোট্ট মনটাকে শান্তি দিতে পারলে খুশি হতাম, কিন্তু সেরকম ছলনা করতে মন চাইল না। “সে কথা বলা যায় না বন্ধু। সত্যি কথা বলতে কী, ওরকম আবার ঘটবে। ঘটবেই। প্রচণ্ড ঝড় আসবে, ফুঁসে উঠবে নদী, ভাসিয়ে নিয়ে যাবে বাঁধ। এ শুধু সময়ের অপেক্ষা।”
“কী করে জানলেন সার?” মিনমিন করে জিজ্ঞেস করল ফকির।
“দেখো দোস্ত, সামনের দিকে চেয়ে দেখো। দেখো কত দুর্বল, পলকা আমাদের এই বাঁধ। এবার তার ওপারে জলের দিকে দেখো–দেখো কী বিপুল তার বিস্তার, কেমন ধীর শান্তভাবে বয়ে চলেছে। শুধু তাকিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবে, আজ হোক কি কাল হোক, এই লড়াইয়ে নদীরই জয় হবে একদিন। কিন্তু শুধু চোখে দেখে যদি বিশ্বাস না হয়, তা হলে তোমাকে ভরসা করতে হবে তোমার কানের ওপর।”
“আমার কান?”
“হ্যাঁ। এসো আমার সঙ্গে।”
সিঁড়ি দিয়ে নেমে মাঠের ওপারে চললাম আমরা। লোকজন নিশ্চয়ই টেরিয়ে টেরিয়ে দেখছিল আমাদের দিকে এক লতপতে ধুতি পরে আমি চলেছি, রোদ আটকানোর জন্য ছাতা খুলে ধরেছি মাথায়, আর ছোট্ট ফকির ছেঁড়া হাফপ্যান্ট পরে আমার পায়ে পায়ে দৌড়ে চলেছে। সোজা বাঁধের কাছে গিয়ে আমার বাঁ কানটা মাটিতে চেপে ধরলাম আমি। “বাঁধের ওপর কান পাতো, তারপর মন দিয়ে শোনো। দেখি বুঝতে পারো কি না কী হচ্ছে।”
খানিক পরে ফকির বলল, “একটা আঁচড় কাটার শব্দ শুনতে পাচ্ছি সার। খুব আস্তে আস্তে হচ্ছে শব্দটা।”
“কিন্তু কীসের ওই শব্দটা?”
আরও খানিকক্ষণ কান পেতে শুনল ফকির। তারপর একটা হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ওর মুখ। “কাঁকড়া, তাই না সার?”
“ঠিক ধরেছ ফকির। সবাই শুনতে পায় না ওই আওয়াজ, কিন্তু তুমি পেলে। অগুন্তি কাঁকড়া দিনরাত কুরে কুরে গর্ত করে চলেছে আমাদের এই বাঁধের ভেতর। এখন ভাবো এইসব কাঁকড়া আর জোয়ার, বাতাস আর ঝড়ের রাক্ষুসে খিদের সঙ্গে কতদিন পাল্লা দিতে পারবে আমাদের এই ঠুনকো মাটির বাঁধ? আর যখন এই বাঁধ ভেঙে যাবে তখন কার কাছে গিয়ে দাঁড়াব আমরা, কমরেড?”
“কার কাছে, সার?”
“কার কাছে? দেবদূতরাও না, মানুষও না, কেউই আমাদের ডাক শুনতে পাবে না সেদিন। আর জন্তু জানোয়ারদের কথা যদি বলো, তারাও শুনবে না আমাদের কথা।”
“কেন শুনবে না সার?”
“কারণটা কবি লিখে গেছেন, ফকির। কারণ ওই পশুরাও
‘জেনে গেছে, এই
ব্যাখ্যাত জগতে নেই আমাদের স্বাচ্ছন্দ্য বা
স্থিতিবোধ।”