আলোড়ন

হঠাৎ দপদপ করতে করতে নিভে গেল টেবিলের ওপরের আলোটা। তখনও মেসোর ঘরে বসে একমনে লেখাটা পড়ছিল কানাই। একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে খানিকক্ষণ বসে রইল চুপ করে। বাইরে জেনারেটারের ধকধক শব্দটা কমতে কমতে মিলিয়ে গেল। একটা নিঝুম ভাব মেঘের মতো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে গেল গোটা দ্বীপটার ওপর। কানাই যেন শুনতে পাচ্ছিল তার এগিয়ে আসা, ভাবছিল নিস্তব্ধতার প্রসঙ্গে ইংরেজিতে কেন যে ‘ফল’ বা ‘ডিসেন্ড’ শব্দগুলো ব্যবহার করা হয় কে জানে–শুনতে লাগে যেন ওপর থেকে নেমে আসা পর্দা কি ছুরি। জেনারেটার বন্ধ হওয়ার পর যে নৈঃশব্দ্য এখন অনুভব করছে কানাই, তার মধ্যে পড়ে যাওয়া কি থিতিয়ে পড়ার ভাব তো নেই। বরং কুয়াশা কি মেঘের সঙ্গেই তার মিল বেশি–যেন দূর থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এল গুঁড়ি মেরে, কিছু শব্দকে ঢেকে দিল তার চাদরে, কিছু শব্দকে আবার স্পষ্ট করে তুলল–ঝিঁঝিপোকার ডাক, দূরের কোনও রেডিয়ো থেকে ভেসে আসা একটা গানের টুকরো, হঠাৎ একটা পাচার কর্কশ চিৎকার। প্রত্যেকটা শব্দই শোনা গেল সামান্য দু-এক মুহূর্তের জন্য, তারপরেই যেন আবার ঝাপসা হয়ে ঢাকা, পড়ে গেল কুয়াশায়। এরকমভাবেই হঠাৎ একটা অচেনা শব্দ কানে এল কানাইয়ের, খুব সামান্য সময়ের জন্য, তারপরেই মিলিয়ে গেল শব্দটা। প্রতিধ্বনির মতো বহু দূর থেকে জলের ওপর দিয়ে ভেসে আসা সে আওয়াজ হয়তো শোনাই যেত না জেনারেটার চালু থাকলে। তা সত্ত্বেও সে শব্দের মধ্যে নগ্ন দাপট, শক্তি এবং হিংস্রতার ভয়ংকর প্রকাশ বুঝতে এতটুকু অসুবিধা হল না। ছোট্ট একটু আওয়াজ, কিন্তু তাতেই যেন মুহূর্তের জন্য নিথর হয়ে গেল সমস্ত দ্বীপ, অন্যসব শব্দ যেন থেমে গেল হঠাৎ। আর তারপরেই শুরু হয়ে গেল কানে তালা-ধরানো শোরগোল–সবচেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছিল কুকুরগুলোর পাগলের মতো চিৎকার।

দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে ছাদে বেরিয়ে এল কানাই। আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করল কখন ফের বদলে গেছে চারপাশের রূপ। যেন কোনও মহাকাব্য লেখকের কলমের আঁচড়ে। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। দিনের বেলা যে ছবি দেখেছিল, জ্যোৎস্নায় ধুয়ে গিয়ে এখন যেন তার রুপোলি নেগেটিভটুকু রয়ে গেছে চোখের সামনে। আবছা আঁধারে ঢাকা দ্বীপগুলোকেই এখন মনে হচ্ছে টলটলে দিঘি, আর গোটা নদীর বিস্তার জুড়ে যেন পড়ে রয়েছে বিশাল এক চকচকে ধাতুর পাত।

“কানাইবাবু?”

ঘুরে তাকিয়ে কানাই দেখল মাথায় ঘোমটা দেওয়া এক ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।

“ময়না?”

“হ্যাঁ।”

“শুনতে পেয়েছ?” বলতে-না-বলতেই আবার সেই আওয়াজ–একইরকম অস্পষ্ট প্রতিধ্বনি, খানিকটা যেন বহু দূর থেকে ভেসে আসা কোনও রেলগাড়ির শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে সারা দ্বীপ জুড়ে ফের শুরু হয়ে গেল কুকুরদের কোরাস, যেন শব্দটা আবার হবে বলে এতক্ষণ অপেক্ষা করে ছিল ওরা।

“এটা কি…” বলতে শুরু করেই কানাই দেখল কেমন যেন কুঁকড়ে গেল ময়না। থেমে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “নামটা বলতে নেই, না?”

“না,” ময়না বলল। “জোরে বলতে নেই এ নাম।”

“কোথা থেকে আসছে মনে হয় শব্দটা?”

“যে-কোনও জায়গা থেকে হতে পারে,” বলল ময়না। “আমি ঘরে বসেছিলাম, বসে বসে অপেক্ষা করছি, তখন ওটা শুনতে পেলাম। স্থির হয়ে আর বসে থাকতে পারলাম না।”

“ফকির তা হলে এখনও ফেরেনি?”

“না।”

এবার কানাই বুঝল জন্তুটার গর্জনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে ময়নার উদ্বেগের। “চিন্তা কোরো না,” ওকে প্রবোধ দেওয়ার জন্য বলল কানাই। “নিশ্চয়ই সাবধানেই আছে ফকির। কী করতে হয় না হয় সে তো ও জানে।”

“ও?” রাগ যেন ঝরে পড়ছে ময়নার গলায়। “ওকে জানলে আর এ কথা বলতেন না আপনি। সব লোকে যা করে, ও ঠিক তার উলটোটা করবে। অন্য যারা মাছ ধরতে যায়, আমার বাবা, আমার ভাইরা, প্রত্যেকে ডিঙিতে রাত কাটালে সবার নৌকো একসঙ্গে বেঁধে মাঝনদীতে গিয়ে থাকে, যাতে কিছু হলে সবাই মিলে সামাল দিতে পারে। কিন্তু ফকির তা করবে না। ও নিজের মতো কোথাও একটা গিয়ে থাকবে; চারদিকে হয়তো সেখানে একটা জনপ্রাণীও নেই।”

“কেন?”

“ও ওইরকমই, কানাইবাবু,” ময়না বলল। “নিজের বোঝ নিজে বোঝে না। একেবারে বাচ্চাদের মতো করে।”

চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে ময়নার মুখের সোনার বিন্দু তিনটে। আবার নক্ষত্রপুঞ্জের তিনটে তারার কথা মনে হল কানাইয়ের। যদিও যত্ন করে আঁচলটা টানা মাথার ওপর, কিন্তু ময়নার একদিকে একটু হেলানো মুখের অস্থির ভাবটুকু ওর মার্জিত শাড়ি পরার ঢংয়ের সঙ্গে ঠিক যাচ্ছে না, মনে হল কানাইয়ের।

“একটা কথা বলো তো ময়না,” খানিকটা যেন মজা করে ওকে খেপানোর সুরে বলল কানাই, “বিয়ের আগে তুমি চিনতে না ফকিরকে? মানে, ও কীরকম মানুষ সেটা জানতে না?”

“হ্যাঁ,” ময়না বলল। “আমি ওকে জানতাম, কানাইবাবু। ওর মা মারা যাওয়ার পর তো হরেন নস্করই ওকে মানুষ করেছে। ওদের গ্রাম আর আমাদের গ্রাম তো একেবারে পাশাপাশি।”

“আচ্ছা, তুমি তো বুদ্ধিমতী মেয়ে, ময়না,” কানাই বলল। “যদি জানতেই ও কীরকম লোক, তা হলে ওকে বিয়ে করলে কেন?”

মনে হল যেন নিজের মনেই একটু হাসল ময়না। “সে আপনি বুঝবেন না।”

ময়নার প্রত্যয়ী ভঙ্গিটা যেন বিছুটির মতো এসে লাগল কানাইয়ের গায়ে। “আমি বুঝব না?” কর্কশ শোনাল ওর গলার স্বর। “তুমি জান আমি ছয়-ছয়টা ভাষা জানি? সারা পৃথিবী ঘুরেছি আমি? আমি কেন বুঝব না?”

ঘোমটা খসে গেল ময়নার, মিষ্টি করে একটু হাসল ও কানাইয়ের দিকে তাকিয়ে। “আপনি ক’টা ভাষা জানেন তাতে কিছু আসে যায় না কানাইবাবু। আপনি তো মেয়েমানুষ নন, আর আপনি ওকে চেনেনও না। আপনি বুঝবেন না।”

হঠাৎ ফিরে চলে গেল ময়না। কানাই দাঁড়িয়ে রইল, একা।