দুপুরের দিকে জল যখন বাড়তে শুরু করল, পিয়া লক্ষ করল আগের মতো অত ঘন ঘন আর দেখা যাচ্ছে না ডলফিনগুলোকে। ডেটাশিটটা এক ঝলক দেখে নিঃসন্দেহ হল ও জোয়ার আসার সাথে সাথে মনে হচ্ছে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে ওরা।
সকালের দিকটায় পিয়া কাজ করছিল ঝড়ের গতিতে। ওর ধারণা ছিল এটা একটা ভেসে বেড়ানো শুশুকের দল, আপাতত এখানে আছে, কিন্তু যে-কোনও সময়ে চলে যাবে নজরের বাইরে। কিন্তু এতক্ষণ ধরে প্রাণীগুলোর হাবভাব লক্ষ করে বিশেষ কোনও গন্তব্য ওদের আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। বরঞ্চ বোধ হচ্ছে শুধু এই জায়গাটুকুতেই ঘোরাঘুরি করে ভাটার সময়টা কাটিয়ে দিতে চাইছিল ওরা। জল যেই বাড়তে শুরু করেছে, এখন আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে এখান থেকে। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না মাথামুণ্ডু, নিজের মনেই বলল পিয়া। এই ডলফিনদের সম্পর্কে ওর যেটুকু জানা আছে এদের ব্যবহার তো একেবারেই খাপ খাচ্ছে না তার সঙ্গে।
সাধারণত দুটো উপজাতিতে ভাগ করা যায় এই ওর্কায়েলা ডলফিনদের। একটা জাত ভালবাসে সমুদ্র উপকূল অঞ্চলের লোনা জল, আর অন্যটা নদীনালা বা মিষ্টি জলে থাকতে পছন্দ করে। দু’দলের মধ্যে শারীরিক গঠনগত কোনও তফাত নেই, তফাত শুধু বাসস্থান নির্বাচনে। এই দু’জাতের মধ্যে সমুদ্র উপকূলবর্তী ডলফিনদেরই দেখা যায় বেশি। দক্ষিণ এশিয়া এবং উত্তর অস্ট্রেলিয়া অঞ্চলে বেশ কয়েক হাজার এ ধরনের ডলফিন আছে বলে জানা গেছে। অন্য দিকে মিষ্টি জলের ওর্কায়েলারা সংখ্যায় অনেক কম–ক্রমশ আরও কমে আসছে। এশিয়ার কোনও কোনও অঞ্চলের নদীতে এদের আর কয়েকশো মাত্র অবশিষ্ট আছে। উপকূলীয় প্রজাতির ডলফিনরা সাধারণত বেশিক্ষণ এক জায়গায় থাকে না, সমুদ্রের তীর বরাবর ভেসে ভেসে বেড়ায়। কিন্তু মিঠে জলের প্রজাতির প্রাণীগুলি নিজেদের নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যেই থাকতে পছন্দ করে। খুব বৃষ্টির সময় নদীর জল বেড়ে গেলে মাঝে মাঝে শিকারের পেছন পেছন খানিকটা দূরে কোনও খাল বা নালা, এমনকী ধানক্ষেতের মধ্যে পর্যন্ত চলে আসতে দেখা গেছে এদের। কিন্তু শুখা মরশুমে জল কমে এলে ফের এরা ফিরে যায় সেই নিজেদের নির্দিষ্ট জায়গাতে। অনেক সময় ভূপ্রাকৃতিক কারণে বা নদীর স্রোতের হেরফেরে নদীর নীচে গভীর পুকুরের মতো খাতের সৃষ্টি হয়। সাধারণত ওই পুকুর’-গুলোতে থাকতে পছন্দ করে মিষ্টি জলের ডলফিনরা। কম্বোডিয়াতে কাজ করার সময় নম পেন থেকে লাওস সীমান্ত পর্যন্ত মেকং নদী বরাবর এরকম অনেকগুলি ‘পুকুর’-এর সন্ধান পেয়েছিল পিয়া। তখন দেখেছিল বছরের পর বছর ধরে একই ডলফিন একই নির্দিষ্ট ‘পুকুরে’ বার বার ফিরে আসছে। কিন্তু প্রতি বছরই ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শত শত কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে ভাটির দিকে চলে যেত ওরা। একবার তো লাওস সীমান্ত অঞ্চলের একটা ডলফিন নম পেনের কাছাকাছি গিয়ে একটা মাছ-ধরা জালে জড়িয়ে মারা পড়ল।
সুন্দরবনে এসে পিয়া ভেবেছিল এখানে যদি কোনও ওর্কায়েলা দেখতে পায় সেটা নিশ্চয়ই উপকূলীয় প্রজাতির হবে। সেটাই স্বাভাবিক মনে হয়েছিল, কারণ এখানকার নদী-খাড়িগুলির জল যথেষ্ট লোনা। কিন্তু আজকে যে অভিজ্ঞতা হল তার পর তো মনে হচ্ছে ভুল ভেবেছিল ও। এগুলো যদি উপকূলীয় প্রজাতির ডলফিনই হয় তা হলে নদীর মধ্যের এই পুকুরে এরকম দল বেঁধে ঘোরাঘুরি করছে কেন। ওদের স্বভাব তো এরকম নয়–শুধু মিষ্টি জলের ডলফিনরাই এরকম করে। কিন্তু সে ডলফিন তো এখানে এত লোনা জলে থাকার কথা নয়। আর তা ছাড়া নদীর ডলফিনরা এরকম হঠাৎ করে দুপুরবেলা তাদের ‘পুকুর’ ছেড়ে উধাও হয়ে যায় না। পুরো একটা ঋতু তারা সেখানে কাটায়। তা হলে কী ধরনের প্রাণী এগুলো? আর এদের এরকম অদ্ভুত ব্যবহারের মানেটাই বা কী?
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা নতুন চিন্তা মাথায় এল পিয়ার। আচ্ছা, এরকম কি হতে পারে যে মেকং-এর ডলফিনরা যেটা বছরে একবার করে, এই সুন্দরবনের শুশুকেরা সেটাই করে প্রতিদিন দু’বার করে? হতেই পারে যে এই ভাটির দেশের পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার জন্য এই নতুন উপায় বের করেছে এরা? মেকং ডলফিনদের বার্ষিক জীবনছন্দকে এখানকার প্রাত্যহিক জোয়ার-ভাটার চক্রের সঙ্গে মিলিয়ে এক এক দিনের হিসেবে সংক্ষিপ্ত করে নিয়েছে এই শুশুকগুলো?
পিয়া বুঝতে পারছিল যদি কোনওভাবে বিষয়টা ও প্রমাণ করতে পারে, তা হলে একটা আশ্চর্য নিটোল নতুন তত্ত্ব খাড়া করা যাবে; স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বিশৃঙ্খল অভ্যাসের জগতে সেটা হবে এক বিরল সৌন্দর্যের প্রতীক। তবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল এই লুপ্তপ্রায় প্রজাতির সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও সে তত্ত্বের বিশাল ভূমিকা থাকবে। এই বিশেষ দহগুলোকে এবং এই ডলফিনদের যাতায়াতের পথগুলোকে যদি চিহ্নিত করা যায় তা হলে সেই অঞ্চলগুলোর ওপর জোর দিয়ে পরবর্তী কালে সংরক্ষণের কাজ করা যাবে। অনেক বেশি কার্যকরী হবে সেই ব্যবস্থা। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সামান্য দু-একটা সূত্র শুধু পাওয়া গেছে। তত্ত্ব দাঁড় করাতে গেলে আরও বহু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে পিয়াকে। যেমন, কী ধরনের শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তনের ফলে এখানকার জোয়ার-ভাটার চক্রের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পেরেছে এই শুশুকরা? এদের দৈনিক জীবনছন্দটাই সেভাবে বদলে গেছে তাও ঠিক বলা যায় না, কারণ জোয়ার-ভাটার সময় এখানে প্রতিদিনই পালটে যায়। বর্ষার সময় যখন নদীতে মিষ্টি জলের পরিমাণ বেড়ে যায়, তখনই বা কী হয়? সে সময় তো জলে নুনের মাত্রা অন্য সময়ের মতো থাকে না। এই দৈনিক পরিযাণ চক্র কি তা হলে দীর্ঘতর কোনও ঋতুছন্দের মাত্রার ওপর নতুন খোদকারি?
অনেক দিন আগে পড়া একটা স্টাডির কথা মনে পড়ল পিয়ার। তাতে দেখা গিয়েছিল গোটা ইয়োরোপ মহাদেশে যত প্রজাতির মাছ আছে তার চেয়ে অনেক বেশি প্রজাতির মাছ দেখতে পাওয়া যায় এই সুন্দরবনে। সেখানে বলা হয়েছিল এত বিচিত্র জাতের জলজ প্রাণী এখানে পাওয়া যাওয়ার কারণ হল এখানকার জলের প্রকৃতির বিভিন্নতা। গাঙ্গেয় বদ্বীপের এই বিশেষ অঞ্চলটিতে নদী এবং সাগরের জল সর্বত্র সমান ভাবে এসে মেশে না। বরং বলা যায় সুন্দরবনের নদী-খাড়িতে এই দুই জলস্রোত পরস্পরের মধ্যে ঢুকে আসে–কোনও কোনও জায়গায় মিষ্টি জলের স্রোত নদী বা খাঁড়ির একেবারে নীচের মাটি বরাবর বয়ে চলে; ফলে হাজারো বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয় তোনাভাব এবং পলির মাত্রায়, তৈরি হয় শত শত বিভিন্ন জৈবক্ষেত্র। এই অণুজীবমণ্ডলগুলি তাদের নিজের নিজের গতিতে কতকটা বেলুনের মতো ভেসে বেড়ায় জলের মধ্যে। অবিরাম তারা জায়গা বদলায়, কখনও চলে যায় মাঝনদীতে, আবার ফিরে আসে তীরের কাছাকাছি। কোনও কোনও সময় সমুদ্রের মধ্যেও অনেকদূর পর্যন্ত এগুলো ভেসে চলে যায়, আবার কখনও নদী-খাঁড়ি বেয়ে উজান ঠেলে চলে আসে অনেক ভেতরে। এই প্রতিটি বেলুন হল একেকটি ভাসমান জীবগোলক, তাতে ঠাসা থাকে তার নিজস্ব প্রাণী ও উদ্ভিদজগৎ। আর জলের মধ্যে দিয়ে যখন এরা ভেসে চলে, পেছন পেছন সারে সারে চলতে থাকে শিকারি প্রাণীর দল। এই বিভিন্ন পরিবেশমণ্ডলের অস্তিত্বের জন্যই বিশালকায় কুমির থেকে শুরু করে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মাছ পর্যন্ত বিভিন্ন মাপের জলজ প্রাণীদের নিয়ে বৈচিত্র্যময় এক বিশাল জীবজগতের সৃষ্টি হয়েছে এই সুন্দরবনে।
এখন এই নৌকোর ওপর বসে এই সমস্ত কিছুর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ আর সম্পর্কের কথা ভাবতে ভাবতে মনের মধ্যে একের পর এক এত সব সম্ভাবনার দরজা খুলে যেতে লাগল যে মাথা ধাঁধিয়ে গেল পিয়ার; চোখ বন্ধ করে ফেলল ও হাতের সামনে অজস্র সূত্র, কত কিছু করতে হবে এখন, বহু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে; কাজ চালানোর মতো শিখে নিতে হবে অনেকগুলি বিষয়–হাইড্রলিক্স, সেডিমেন্টেশন জিওলজি, ওয়াটার কেমিস্ট্রি, ক্লাইমেটোলজি; একটা ঋতু-ভিত্তিক গণনা করতে হবে এখানকার ডলফিনদের, ওদের যাতায়াতের পথের ম্যাপ তৈরি করতে হবে, গ্রান্টের জন্য কাঠখড় পোড়াতে হবে, নানা রকম পারমিট আর পারমিশনের জন্য দরখাস্ত করতে হবে; কোনও কূল কিনারা নেই কাজের। ওকে সুন্দরবনে পাঠানো হয়েছে মাত্র দু’সপ্তাহ সময় দিয়ে, ছোট একটা সার্ভে করার জন্য। বাজেটও খুবই কম। কিন্তু যেসব প্রশ্ন এখন মাথায় ঘুরছে তার উত্তর খুঁজে বের করা তো এক দু’সপ্তাহের কাজ নয়, বছরের পর বছর সময় দিতে হবে, কয়েক দশক লাগলেও আশ্চর্য হবে না পিয়া। নদীনালায় ঘুরে ঘুরে ফিল্ড রিসার্চই করতে হতে পারে পনেরো-কুড়ি বছর ধরে। এই প্রজেক্ট শেষ করতে গেলে সে সময়টা অন্তত দিতে হবে ওকে। এমনকী, বলা যায় না, হয়তো সারা জীবন ধরেও কাজ করে যেতে হতে পারে।
যে সমস্ত ফিল্ড বায়োলজিস্টরা স্মরণীয় কাজ করার মতো বিষয় খুঁজে পেয়েছেন যেমন কিনিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে কাজ করেছেন জেন গুডল, কুইন্সল্যান্ডের জলাভূমিতে কাজ করেছেন হেলেন মার্শ–কত সময় তাদের ঈর্ষা করেছে পিয়া। কিন্তু খুব একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই বলে ওর নিজের কপালেও একদিন এরকম কিছু জুটে যেতে পারে বলে কখনও ভাবেনি। তা সত্ত্বেও এই সুযোগ এসে গেল হাতের সামনে। এবং এরকম অকল্পনীয়ভাবে–যখন মনে হচ্ছিল কিছুই ঠিকমতো হচ্ছে না, কেবলই একের পর এক বাধা আসছে কাজে। ছোটবেলায় যেসব আশ্চর্য আবিষ্কারের গল্প পড়ে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ জন্মেছিল, সেই গল্পগুলি মনে পড়ল পিয়ার। কেমন অদ্ভুত, প্রত্যেক ক্ষেত্রেই কিন্তু অনুপ্রেরণা এসেছিল সাধারণ সব দৈনন্দিন ঘটনা থেকে যেমন আর্কিমিডিস আর তার বাথটাব, নিউটন আর সেই আপেলগাছ। অবশ্য সেসব আবিষ্কারের সাথে ওর এই কাজকে কোনওভাবেই তুলনা করা যায় না, কোনওরকম কোনও মিলও নেই কিন্তু অন্তত ও এখন বুঝতে পারছে কীভাবে হয় ব্যাপারটা, কেমন করে একটা আশ্চর্য ভাবনার ঝলক হঠাৎ মাথায় এসে যায়, আর এক মুহূর্তে ঠিক হয়ে যায় এই কাজটাই তাকে করে যেতে হবে বাকি জীবন ধরে।
বড় বৈজ্ঞানিক হবে এরকম উচ্চাশা পিয়ার কোনওদিনই ছিল না। যদিও জলচর প্রাণীদের ও ভালবাসে এবং তাদের বিষয়ে জানার আগ্রহও আছে, কিন্তু মনে মনে পিয়া ভাল করেই জানে যে শুধু সেইজন্যই ও এ কাজ করতে এসেছে তা ঠিক নয়। বাকি অনেকের মতোই ওইসব প্রাণীদের প্রতি ভালবাসা ছাড়াও ফিল্ড বায়োলজিতে ওর আকর্ষণের আরেকটা কারণ এই কাজের ইন্টেলেকচুয়াল দিক–এখানে ও নিজের মতো করে কাজ করতে পারবে, রোজ কোনও নির্দিষ্ট অফিসে হাজিরা দিতে হবে না, চেনাজানা জগতের পরিধির বাইরে বাইরে কাজ করা যাবে, এবং পরস্পরের প্রতি দায়বদ্ধ অথচ আলগা সম্পর্কের একটা নিজস্ব সমাজও থাকবে। এখন এই বিশাল কাজ যদি ও হাতে নেয়, সেই ব্যাপারগুলি হয়তো খুব একটা কিছু পালটাবে না, কারণ আপাতত বেশিরভাগ সময়টাই কাটবে সেই দরখাস্ত লেখা, গ্রান্ট জোগাড়ের চেষ্টা আর ওই রকম সব গতানুগতিক কাজে। আর শেষ পর্যন্ত যাই হোক না কেন এই গবেষণার ফলে বিজ্ঞান জগতে যে মারাত্মক কিছু তোলপাড় হয়ে যাবে তা তো নয়। কিন্তু এসব কিছু সত্ত্বেও, এভাবে নিজের ভবিষ্যৎ ঠিক করে নেওয়া বা আগামী বছরগুলিতে কী করবে সে চিন্তার দায় থেকে মুক্তি পাওয়ার মধ্যে যে কী তৃপ্তি তা কি পিয়া আগে কখনও ভাবতে পেরেছিল? আর বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন কিছু না ঘটাতে পারলেও, এটা তো ঠিক যে শেষ পর্যন্ত সফল যদি হয় পিয়া–এমনকী আংশিক ভাবেও যদি হয় তা হলেও বর্ণনামূলক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এক চমৎকার অবদান হিসেবে থেকে যাবে ওর কাজ। তাই যথেষ্ট; বেঁচে থাকার কৈফিয়ত হিসেবে অন্য কিছুর আর দরকার নেই পিয়ার। অন্তত এই পৃথিবীতে থাকার সময়টুকু ও বাজে খরচ করেছে সে অপবাদ তো কেউ দিতে পারবে না।