একটি সূর্যাস্ত

বিকেল ফুরিয়ে এসেছে। সূর্য ঢলে পড়েছে বিদ্যার মোহনায়। পিয়া ঠিক করল কানাইয়ের আমন্ত্রণের সুযোগটা নেবে একবার গেস্ট হাউসের ছাদে উঠে পড়ার ঘরের দরজায় গিয়ে কড়া নাড়ল ও।

“কে?” চোখ পিটপিট করতে করতে এসে দরজাটা খুলল কানাই। মনে হল একটা ঘোর থেকে যেন জেগে উঠেছে।

“ডিস্টার্ব করলাম?”

“না না, সেরকম কিছু না।”

“ভাবলাম একটু সূর্যাস্ত দেখি ছাদ থেকে।”

“গুড আইডিয়া–ভালই করেছেন চলে এসে।” হাতের বাঁধানো খাতাটা রেখে দিয়ে, পিয়ার সঙ্গে ছাদের পাঁচিলের ধারে এসে দাঁড়াল কানাই। শেষ বেলার সূর্যের আলোয় দূরে আকাশ আর মোহনায় তখন আগুন লেগেছে।

“অসাধারণ, তাই না?” জিজ্ঞেস করল কানাই।

“সত্যিই অসাধারণ।”

লুসিবাড়ির দ্রষ্টব্যগুলি এক এক করে পিয়াকে দেখাতে লাগল কানাই–ময়দান, হ্যামিলটনের কুঠি, হাসপাতাল, আরও এটা ওটা। দেখানো যখন শেষ হল ততক্ষণে ঘুরে ছাদের উলটোদিকটায় চলে এসেছে ওরা–সকালে যে রাস্তা ধরে গিয়েছিল, সেটার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। হাসপাতালের স্টাফ কোয়ার্টার্সগুলি সামনে চোখে পড়ছে। পিয়া বুঝতে পারল দু’জনেই ওরা ফকিরের বাড়ির ঘটনার কথা ভাবছে।

“কাজগুলো যে সব ঠিকঠাক হয়েছে আজকে, ভেবেই বেশ ভাল লাগছে আমার,” পিয়া বলল।

“সব ঠিকঠাক হয়েছে মনে হয় আপনার?”

“হ্যাঁ, মনে হয়,” বলল পিয়া। “অন্তত ফকির তো আবার যেতে রাজি হয়েছে। শুরুতে আমার বেশ সন্দেহই ছিল ও যাবে কিনা।”

“সত্যি কথা বলতে কী, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কী ভাবা উচিত,” কানাই বলল। “এমন অদ্ভুত গোমড়া টাইপের ছেলে, কখন কী করবে বোঝা কঠিন।”

“কিন্তু বিশ্বাস করুন, যখন নৌকোয় থাকে তখন ও একেবারে অন্য মানুষ।”

“আপনি ঠিক জানেন, আপনার কোনও অসুবিধা হবে না ওর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে?”

জিজ্ঞেস করল কানাই। “বেশ কয়েকটা দিনের মামলা কিন্তু।”

“হ্যাঁ, জানি।” পিয়া বুঝতে পারছিল ফকিরের বিষয়ে কানাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে গেলেই অদ্ভুত একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষত সকালের সেই নীরব ভর্ৎসনার ব্যাপারটা এখনও ভুলতে পারেনি কানাই। পিয়া আস্তে আস্তে বলল, “আমাকে ফকিরের মায়ের কথা বলুন না। কেমন মানুষ ছিলেন উনি?”

একটু ভাবল কানাই। “ফকির একদম ওর মায়ের চেহারাটা পেয়েছে,” বলল অবশেষে। “কিন্তু আর কোনও মিল খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কুসুম ছিল টগবগে স্বভাবের মেয়ে, সবসময় হাসত, মজা করত। ফকিরের মতো একটুও নয়।”

“কী হয়েছিল ওনার?”

“সে অনেক লম্বা গল্প,” জবাব দিল কানাই। “সবটা আমি জানিও না। এটুকু শুধু বলতে পারি, পুলিশের সঙ্গে একটা গণ্ডগোলে মারা গিয়েছিল ও।”

ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে গেল পিয়া। “কী করে?”

“একদল রিফিউজি এখানকার একটা দ্বীপ দখল করে বসেছিল–ও-ও তাদের সঙ্গে ছিল। কিন্তু সে জমির মালিকানা ছিল সরকারের। ফলে গোলমাল বাধল, আর বহু লোক মারা গেল। ঘটনাটা ঘটেছিল ১৯৭৯ সালে ফকিরের বয়স তখন খুব বেশি হলে পাঁচ কি ছয়। ওর মা মারা যাওয়ার পরে হরেন নস্কর ওকে এনে মানুষ করে। হরেনই ওর বাবার মতো।”

“মানে ফকিরের জন্ম এখানে নয়?”

“না। ওর জন্ম হয়েছিল বিহারে,” বলল কানাই। “ওর বাবা-মা ওখানে থাকত তখন। তারপর ওর বাবা মারা যাওয়ার পর ওর মা ওকে নিয়ে এখানে চলে আসে।”

পিয়ার মনে পড়ল কল্পনায় ফকিরের পরিবারের কীরকম ছবি দেখেছিল ও–কীরকম দেখেছিল ওর বাবা-মা-র চেহারা, অনেক ভাইবোন। নিজের অন্তদৃষ্টির অভাবে নিজেরই খুব লজ্জা লাগল ওর। “এই একটা ব্যাপারে তা হলে ফকির আর আমার একটু মিল আছে,” বলল পিয়া।

“কী ব্যাপারে।”

“মাকে ছাড়া বড় হয়ে ওঠা।”

“আপনারও কি ছোটবেলায় মা মারা গিয়েছিলেন?” জিজ্ঞেস করল কানাই।

“ওর মতো অতটা ছোট ছিলাম না। আমার বারো বছর বয়সে মারা যান, আমার মা। ক্যানসার হয়েছিল। আমার অবশ্য মনে হয় তার অনেক আগে থেকেই মাকে হারিয়েছিলাম আমি,” পিয়া বলল।

“কেন?”

“কারণ আমাদের থেকে–মানে আমার বাবা আর আমার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল মা। ডিপ্রেশনে ভুগত। আর যত দিন গেছে অসুখটা বাড়তেই থেকেছে।”

“আপনার নিশ্চয়ই খুব কষ্টে কেটেছে সেই সময়টা?”

“মায়ের থেকে বেশি নয়,” পিয়া বলল। “মা কেমন ছিল জানেন, খানিকটা যেন অর্কিডের মতো, দুর্বল অথচ সুন্দর, অনেক অনেক লোকের যত্ন আর ভালবাসার ওপর নির্ভরশীল। মা যে ধরনের মানুষ ছিল, তাতে বাড়ি থেকে এতটা দূরে না গেলেই পারত। আমেরিকায় তো মা-র কিছুই ছিল না–বন্ধুবান্ধব না, কাজের লোকজন না, চাকরি না, নিজস্ব কোনও জীবনই ছিল না। ওদিকে বাবা ছিল যাকে বলে এক্কেবারে খাঁটি প্রবাসী–উদ্যমী, পরিশ্রমী, সফল মানুষ। নিজের কেরিয়ার নিয়েই ব্যস্ত সবসময়। আর আমি ব্যস্ত আমার স্বাভাবিক ছেলেমানুষি খেলাধুলো পড়াশোনা নিয়ে। আমার মনে হয় একটা হতাশার মধ্যে আস্তে আস্তে তলিয়ে যেতে শুরু করেছিল মা। তারপর একটা সময় এসে নিজেই হাল ছেড়ে দিয়েছিল।”

ওর হাতের ওপর হাত রেখে একটু চাপ দিল কানাই। “খুব খারাপ লাগছে আমার।”

কানাইয়ের কথার সুরের মধ্যে এমন কিছু একটা ছিল যেটা খুব অবাক করল পিয়াকে। ওকে সবসময় মনে হয়েছে ভীষণ আত্মকেন্দ্রিক, অন্যদের ব্যাপার নিয়ে কখনওই মাথা ঘামায় না। কিন্তু এখন ওর গলায় যে সহানুভূতির সুর সেটা তো আন্তরিক বলেই মনে হল।

একটু হেসে পিয়া বলল, “ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। আপনি বলছেন আমার জন্য আপনার খারাপ লাগছে, কিন্তু ফকিরের জন্য তো আপনার বিশেষ সহানুভূতি আছে বলে মনে হচ্ছে না। অথচ আপনি ওর মাকে চিনতেন। কেন বলুন তো?”

কথাটা শুনে শক্ত হয়ে গেল কানাইয়ের চোয়াল, তারপর একটু বাঁকা সুরে হেসে উঠল ও। বলল, “ফকিরের কথা যদি বলেন, তা হলে আমি বলব আমার সহানুভূতি ওর বউয়ের জন্যই বেশি।”

“তার মানে?”

“আজ সকালে ময়নার জন্য একটুও খারাপ লাগেনি আপনার?” জিজ্ঞেস করল কানাই। “একবার ভাবুন তো, ওরকম একটা লোকের সঙ্গে জীবন কাটানো কীরকম কঠিন ব্যাপার। তার ওপরে রুটিরুজি বলুন, মাথার ওপরে একটা ছাদ বলুন, সেসব কথাও তো ওকেই ভাবতে হয়। কী অবস্থা থেকে ও উঠে এসেছে কল্পনা করুন একবার ওর জাতপাতের সমস্যা, ওর বাড়ির পরিবেশ তার মধ্যে থেকেও যে আজকের দুনিয়ায় বেঁচে থাকার জন্য কী করা দরকার সেটা মাথা খাঁটিয়ে বের করেছে ও, সেই ব্যাপারটা প্রশংসাজনক নয়? আর শুধু যেনতেনভাবে বেঁচে থাকা নয়, ভালভাবে বাঁচতে চায় ও, নিজেকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।”

মাথা নাড়ল পিয়া। “বুঝেছি।” এতক্ষণে ও উপলব্ধি করল, কানাইয়ের পক্ষে এই লুসিবাড়ির মতো জায়গায় এসে ময়নার মতো একজন মেয়ের দেখা পাওয়াটা খুবই ভরসার কথা–নিজের জীবনে যে পথ কানাই বেছে নিয়েছে, ময়নার গোটা অস্তিত্বটা ওর কাছে যেন সেই পথেরই যৌক্তিকতা প্রমাণ করছে। কানাইয়ের পক্ষে বিশ্বাস করা খুবই জরুরি যে ওর নিজস্ব মূল্যবোধগুলো আসলে সমদর্শী, সংস্কারমুক্ত, গুণবাদী। ও মনে মনে ভাবতে পারলে ভরসা পাবে যে, “আমি নিজের জন্য যা চাই অন্য সকলের আশা-আকাঙ্ক্ষার সাথে তার আসলে কোনও তফাত নেই। বড়লোক গরিবলোক নির্বিশেষে যে কারওই সামান্য একটু উদ্যম আছে, একটু ক্ষমতা আছে, সে-ই চায় এই পৃথিবীতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে–ময়নাই তার জ্বলন্ত প্রমাণ।” পিয়া বুঝতে পারল, যে আয়নায় কানাই নিজেকে দেখছে, ফকিরের মতো মানুষ সেখানে গাড়ির রিয়ারভিউ মিররের ওপর একটা ছায়া ছাড়া কিছু নয়, দ্রুত মিলিয়ে যাওয়া একটা উপস্থিতি মাত্র, চির-অতীত লুসিবাড়ি থেকে উঠে আসা ভূতের মতো। কিন্তু এটাও আন্দাজ করতে পারে পিয়া যে কানাই যে দেশে বাস করছে, সমস্ত নতুনত্ব এবং কর্মচাঞ্চল্য সত্ত্বেও এরকম অসংখ্য অদেখা ছায়াশরীরের উপস্থিতি সেখানে কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না, যত জোরেই চিৎকার করা যাক না কেন, তাদের ফিসফিসে কণ্ঠস্বর পুরোপুরি চাপা দেওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়।

“আপনি সত্যিই ময়নাকে পছন্দ করেন, তাই না?” পিয়া জিজ্ঞেস করল।

“ঠিক কথাটা যদি জানতে চান, তা হলে বলব ওকে শ্রদ্ধা করি আমি,” জবাব দিল কানাই।

“সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু ফকিরের জায়গা থেকে যদি দেখেন, তা হলে ওর চেহারাটা হয়তো একটু অন্যরকম দেখাবে।”

“কী বলতে চাইছেন আপনি?”

“নিজেকে জিজ্ঞেস করেই দেখুন না,” বলল পিয়া। “ও যদি আপনার স্ত্রী হত তা হলে কেমন লাগত আপনার?”

হো হো করে হেসে উঠল কানাই। তারপর আবার যখন কথা বলতে শুরু করল তখন ওর গলার সুরের চটুলতায় দাঁতে দাঁত ঘষল পিয়া। “ময়না যে ধরনের মেয়ে তাতে ওর সঙ্গে ছোটখাটো একটা এক্সাইটিং সম্পর্কের কথা ভাবা চলতে পারে,” বলল কানাই। “মানে যাকে আমরা বলতাম ফ্লিং। কিন্তু তার থেকে বেশি কিছু নয়। সেরকম ক্ষেত্রে আপনার মতো কোনও মহিলাই আমার বেশি পছন্দের।”

হাতটা তুলে কানের দুলে আস্তে আস্তে আঙুল বোলাল পিয়া, খানিকটা যেন ভরসা পাওয়ার জন্য। তারপর একটু সতর্ক হাসি হেসে বলল, “আপনি কি ফ্লার্ট করছেন আমার

সঙ্গে, কানাই?”

“কী মনে হয়?” একগাল হেসে কানাই পালটা প্রশ্ন করল।

“আমার অভ্যেস চলে গেছে,” বলল পিয়া।

“তা হলে তো সে ব্যাপারে কিছু করা উচিত আমাদের, তাই না?”

নীচের থেকে ভেসে আসা একটা চিৎকারে কথা থেমে গেল ওর। “কানাইবাবু!”

পাঁচিলের ওপর থেকে ঝুঁকে ওরা দেখল নীচের রাস্তার ওপর ফকির দাঁড়িয়ে রয়েছে। পিয়াকে দেখতে পেয়ে চোখ নামাল ও, মাটিতে পা ঘষতে লাগল আস্তে আস্তে। তারপর কানাইয়ের উদ্দেশ্যে দু’-একটা কী কথা বলেই হঠাৎ ঘুরে বাঁধের দিকে হেঁটে চলে গেল।

“কী বলল ও?” জিজ্ঞেস করল পিয়া।

“আপনাকে জানিয়ে দিতে বলল যে হরেন নস্কর কালকে ওর ভটভটি নিয়ে এখানে আসবে। আপনি গিয়ে দেখে নিতে পারেন। আর যদি মনে হয় ওটায় কাজ হবে, তা হলে পরশু সকালে রওয়ানা হয়ে যেতে পারেন, কানাই বলল।

“চমৎকার,” বলে উঠল পিয়া। “আমি বরং গিয়ে আমার জিনিসপত্রগুলি গুছিয়ে গাছিয়ে নিই।”

পিয়া লক্ষ করল মাঝপথে বাধা পড়ায় ও নিজে যতটা খুশি হয়েছে, ঠিক ততটাই বিরক্ত হয়েছে কানাই। ভুরুটা একটু কুঁচকে ও বলল, “আমারও মনে হয় এবার গিয়ে মেসোর খাতাটা নিয়ে বসা উচিত।”