সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
মামা সমগ্র
এক
এখনও আছে। এমন পরিবার এখনও আছে। বিরাট যৌথ পরিবার। পরিবার যখন বিশাল বাড়িটাও সেই অনুপাতে বৃহৎ। অতীতে এঁদের পূর্বপুরুষ এই কায়দার গৃহ তৈরি করেছিলেন। কতদিকে যে বিস্তার! এদিক, ওদিক, সেদিক। দালান, উঠান, বাগান। এ-কালের বাড়িতে একটা সিঁড়ি করতেই রেস্ত ফাঁক। এই বাড়িতে বড়য়, ছোটোয় মিলিয়ে সাতটা সিঁড়ি। প্রধান সিঁড়ি তরতরিয়ে তিনতলায় উঠে গেছে। এরপর সব শাখা-প্রশাখা, কোনওটা নীচে নেমেছে। কোনওটা প্যাঁচ মেরে হাজির হয়েছে কোনও গুপ্ত মহলে। রহস্যঘেরা একটি বাড়ি। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই।
এই বাড়িতে তিনপুরুষ ধরে হেসে খেলে জীবন কাটাচ্ছেন মিত্তিররা। পূর্বপুরুষদের একজন ছিলেন নবাব-সরকারের দেওয়ান। রমরমার শুরু সেইকাল থেকে। এই পুরুষেই আর এক মিত্তির খাগড়ায় ফেঁদে বসলেন কাঁসার ব্যাবসা। জমাটি কারবার। সারা ভারতে! এক মিত্তির ঢুকলেন গালার ব্যাবসায়। ইউরোপ, আমেরিকা পর্যন্ত দৌড়। পরিবারে ঢুকে পড়ল বিলিতি হাওয়া। তিনি আবার বিলিতি মেয়ে বিয়ে করলেন। এই বাড়ির এদিকটা দিয়ে গেলে এখনও মনে হবে বিলিতি এসেছি। কাচের ঘর। বিলিতি আসবাব, এমন কী একটা ফায়ার প্লেস। পরিত্যক্ত বাবুর্চিখানা। উঁচু বেদিতে যিশুর মূর্তি বিশাল। বড়, বড় বাতিদান। এখনও পরিচর্যা হয়। সব ঝকঝকে, তকতকে। মনে হবে, এই একটু আগে প্রার্থনা হচ্ছিল। সুর ভেসে বেড়াচ্ছে।
এরপরেই মিত্তিররা ঘুরে গেলেন শিক্ষার জগতে। সেখানেও তাঁরা অপ্রতিহত। সেই পুরুষেরই চার ভাই, এর এক বোন এক রাজত্ব করছেন। এখন তাহলে আমরা মিত্তির বাড়িতে প্রবেশ করি। সময়, সকাল ন-টা। আজ রবিবার। সব মিত্তিরই আজ বাড়িতেই। বড় মিত্তির ডাক্তার। মেজো মিত্তির অধ্যাপক। সেজো মিত্তির টেকস্টাইল ইঞ্জিনিয়ার। চতুর্থ মিত্তির ফ্যাশান ডিজাইনার। বেশিরভাগ সময় প্যারিসে থাকেন। বড় আর মেজোর পর একটি বোন। আদরের ডাক নাম কুসি। স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। বাড়ি আর ভাইদের সামলাবার জন্যে সব ছাড়তে হয়েছে। বিয়েও করা হল না। আর হবেও না। মায়ের মতো চারটে ভাইকে সামলাতে হয়। সবাই বলে একেই বলে স্যাক্রিফাইস। অতি সুন্দরী। লেখা-পড়ায় সেরা। অসম্ভব ভালো সেতার বাজায়। এক সহপাঠী ভালোবাসত। জীবন দিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিল। এমন প্রেম! শেষে বিরক্ত হয়ে বিলেত চলে গেল। এখনও মাঝে মাঝে ফোন করে। বেশি কথা বলে না। বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কুসি সেই প্রেমিককেও সামলায়। পরের জন্মে মিলন হবে। আমরা দুজনে সুইজারল্যান্ডে জন্মাব নেক্সট টাইম।
মিত্তির বাড়ির গেটটা একটা দেখবার জিনিস। অতীতের জিনিস, ঢালাই ডিজাইন। তেমনি ভারী। তেমনি বিশাল। হাতি গলে যেতে পারে। বাগানের পথ ধরে কিছুটা হাঁটতে হবে। বেশ পরিচর্যার বাগান। দুজন পার্মামেন্ট মালি আছেন। পুরনো আমলের লোক। মিত্তিরদের একটা গুণ আছে। পরকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা।ফ্যামিলি ট্যুর প্যাকেজ
ঢুকতে ঢুকতে বোঝা যাচ্ছে, বৈঠকখানায় ভীষণ একটা কাণ্ড হচ্ছে। বড় ভাই বিমলের গলা, ‘আহা, হাহা, অতটা উঁচু নয়। অতটা উঁচু নয়, আর একটু নীচে নামবে। তুই কি স্বর্গে টাঙাতে চাইছিস?’
ছবি টাঙানো হচ্ছে। টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে আছে পাড়ার ইলেকট্রিসিয়ান ডাকু। মিত্তিরদের খুব প্রিয়। দাঁড়িয়ে আছে ঊর্ধ্ব বাহু হয়ে। বেশ বড়োসড়ো মাপের একটা ছবি দু-হাতে ধরে আছে। হাইট নিয়ে গোলমাল। দেয়ালের কতটা উঁচুতে ঝুলবে। বড় আর মেজোর মতের মিল হচ্ছে না। মেজো নির্মল বললে, ”দাদা, সব ব্যাপারে বাগড়া দেওয়া তোমার একটা স্বভাব।’
‘কী রকম?’
‘ছবিটা আমরা নীচে দাঁড়িয়ে দেখব, তাই তো? ছবি দেখার জন্যে টেবিলে উঠব না? অতটা টঙে তুলে দিলে ছবি দেখবে টিকটিকি।’
‘বেশ, তুই ছবিটা কোথায় দিতে বলছিস? মেঝের কাছে? স্কার্টিং-এর উপরে?’
‘আমি পাগল নই।’
‘অর্থাৎ, আমি পাগল!’
‘পাগল ছাড়া ওই কথার এই মানে করবি না।’
‘ছবি টাঙাতে হবে না। ডাকু, তুই নেমে আয়।’
‘যা বাব্বা, আধঘণ্টা ছবি ধরে দু-হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকার পর এই ডিশিসান!’
বিমল বললে, ‘তোর টাকা পাওয়া নিয়ে কথা। টাকা নাও চলে যাও।’
‘আপনাদের সঙ্গে আমার টাকার সম্পর্ক?’
বিমল বললে, ‘আমি খুব রেগে গেছি।’
‘রাগছেন কেন? মেজদা তো যুক্তিপূর্ণ কথাই বলছেন!’
‘ওর যুক্তি ওর কাছে থাক। আমি আমার যুক্তি, আমার সুপরিপক্ক বুদ্ধিতে চলব।’
মেজোভাই অধ্যাপক নির্মল মিত্তির বললে, ‘ঠিক আছে তাই চলো, আমি চললুম। আমার সময়ের দাম আছে। দশ বান্ডিল পরীক্ষার খাতা পড়ে আছে।’
নির্মল গটগট করে দরজার দিকে এগোচ্ছিল, এমন সময় কুসি আর সেজো ভাই কমল বকবক করতে করতে বাইরে থেকে ভিতরে এল। নানা মাপের, নানা রঙের ব্যাগ নিয়ে। প্রতি রবিবার এই জুটি বাজারে যায়। মিত্তিরবাড়ির এই প্রথা। নির্মল আটকে গেল।
বিমল বললে, ‘তুই আমাকে ত্যাগ করে যাচ্ছিস যা। ফিরে এসে দেখবি, ছবির বদলে আমি ঝুলছি!’
কুসি অবাক। বেপট জায়গায় তার পড়ার টেবিলটা। দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ছ-ফুট লম্বা একটা ছেলে। কুসি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলে, ‘এ-কী প্রকাশ্য দিবালোকে কে গলায় দড়ি দিচ্ছে!’সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বই অনলাইনে কিনুন
ডাকু বললে, ‘দিদি! আধঘণ্টা, দাঁড়িয়ে আছি টেবিলে। দড়ি পেলে নিজেই ঝুলে পড়তুম।’
‘ওটার উপর কে উঠিয়েছে তোকে?’
‘বড়দা, মেজদা। এই যে ছবি, ঝোলাতে হবে। দেখো তো দিদি, কোন হাইটে ঝোলালে ঠিক হবে!’
‘ছবি? দেয়ালে? ওই সদ্য রং করা সুন্দর দেয়ালে তুই পেরেক ঠুকবি? কার হুকুমে? নেমে আয়।’
ডাকু ধাম করে লাফ মারল টেবিল থেকে।
বিমল বললে, ‘একটা ঐতিহাসিক ছবি। অতুলনীয়, অনির্বচনীয়। সূর্য অস্ত যাচ্ছে. আকাশ লাল। এক পাল সাদা গোরু বৃন্দাবনের ধুলো উড়িয়ে ঘরে ফিরছে। বংশীধারী কৃষ্ণ মুরারী চলেছেন সঙ্গে সঙ্গে। এই ছবিতে ইতিহাস, ভূগোল, ধর্ম, সংস্কৃতি সব মাখামাখি হয়ে আছে।’
কুসি বললে, ‘দেয়াল দাগরাজি করে ইতিহাস, ভূগোল কোনও কিছুই ঝোলানো যাবে না।’
‘তাহলে ছবি কিনলুম কেন?’
‘কেন কিনলে, সে তুমিই জানো। বাড়ি রং করাবার আগে তোমাদের প্রত্যেককে আমি বলেছি। যেখানে সেখানে ক্যালেন্ডার ঝুলিয়ে বাড়িটাকে পান-বিড়ির দোকান করা চলবে না। আর যেখানে ছবি ঝোলাবার ব্যবস্থা করে রাখা আছে, সেইখানেই ছবি ঝোলাতে হবে, তার বাইরে কোথাও নয়।’
‘কুসি এই দেয়ালটা একটি ছবি চাইছে।’
‘কার কাছে চাইছে? তোমার কাছে? আমার কাছে চায়নি।’
‘মেজোর কাছেও চেয়েছে।’
নির্মল সঙ্গে সঙ্গে বললে, ‘এসব ব্যাপারে আমার কোনও মত নেই। কুসির মতই আমার মত। আমি তোমার মতো ইনডিসেন্ট কাজ কখনও করি না। করবও না। যত হাতুড়ে ব্যাপার সব তোমার।’
বিমল রেগে গিয়ে বললেন, ‘হোয়াট ডু ইউ মিন? আই অ্যাম হাতুড়ে ডাক্তার? এর আগে তুই একবার গোরুর ডাক্তার বলে আমাকে জনসমক্ষে হেয় করেছিস।’
কুসি হাসতে হাসতে বললে, ‘বড়দা তোমার বাংলা অনেক ইমপ্রূফ করেছে। বিভূতিবাবুর কোচিং-এ যাচ্ছ?’
‘যাচ্ছি মানে আই অ্যাম রাইটিং অ্যান উপন্যাস। তিনটে চ্যাপটার কমপ্লিট। ধীরে ধীরে বহিতেছে মলয় বাতাস। গগনে পূর্ণ শশী। নদী সকল জল ভারে ভারাক্রান্ত…’
নির্মল বললে, ‘অসাধারণ! লক্ষ্মীর পাঁচালি আর কালিদাস পাঞ্চ।’
ডাকু মেঝেতে বসে পড়েছে। ছবিটা কোলের কাছে খাড়া। সে হঠাৎ বললে, ‘এই ইতিহাস আমি ছেড়ে দিচ্ছি, আর কতক্ষণ ধরে বসে থাকব। ভূগোল চুরমার হয়ে গেলে আমি জানি না।’
কমল বললে, ‘আমি বলি কী, ছবিটা এখন কাগজ মুড়ে রাখা হোক, পরে একটা কমিশন বসিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। আজ রবিবার, কত রকম রান্নার ব্যবস্থা! সব মাটি হয়ে যাবে!’
বিমল ভোজন রসিক। কমল ভালো চাল চেলেছে। বিমল ডাকুকে বললে, ‘যা যা ছবিটা তুই নিয়ে যা। পৃথিবীতে কত ভালো ভালো ছবি আছে। সব ছবিই কি আর টাঙানো যায়!’
ডাকু হাঁ হয়ে গেল। বিমল এইবার বোনকে জিগ্যেস করলে, ‘আজকের মেনুটা তাহলে কী করলি!’
কমল বললে, ‘আমার কাছে শোনো।’
কুসি লটরবহর নিয়ে ভিতের চলে গেল। সেখানে দুটি অসাধারণ চরিত্র আছে। মেয়েটি এই বাড়িতেই মানুষ হয়েছে। ভারি ভালো মেয়ে। তার নাম গান্ধারী। আর একজন, বিপিন। কর্তাদের আমলের। আগে বলা হতো, নায়েব। একাল বলবে, ম্যানেজার। রসিক মানুষ। সদাশিব। কুসি এদের নিয়েই এত বড় একটা সংসার ম্যানেজ করে।
বিমল বললে, ‘মেনুটা শোনার জন্যে ভিতরটা কেমন যেন উতলা হচ্ছে।’
কমল ভারী একটা সোফায় বসে পড়ল, ‘চা না হলে ঠিক মেজাজ আসছে না।’
বিমল চিৎকার করল, ‘অ্যায় কে আছিস?’
কমল বললে, ‘একেবারে বিয়ে বাড়ির মেনু। প্রথমেই হবে সেইটা, যেটা তুমি ভীষণ ভালোবাসা—ভেটকি মাছের ফিলে এনেছি। মাস্টার্ড দিয়ে ফ্রাই যা জমবে না!’
‘ফ্রাই!’ ডাক্তার আনন্দে চিৎকার করে উঠল।
গান্ধারী চা নিয়ে আসছে। ডাকু যন্ত্রপাতি ব্যাগে ভরে উঠে দাঁড়িয়েছে। গান্ধারী বললে, ‘দিদি তোমাকে ভিতরে ডাকছে।’ ব্যাগটা নামিয়ে রেখে ডাকু গটগট করে অন্দরের দিকে এগোল। অনেকটা যেতে হবে। করিডর গোটা দুয়েক বাঁক নিয়ে পৌঁছেছে ভিতর মহলে। বাগান ঘেরা, রান্নাঘর, ভাঁড়ার ঘর, খাবার ঘর। এই খাবার ঘরের নাম রাখা যেতে পারে, ‘অন্তরঙ্গ’, পারিবারিক ভোজনকক্ষ। আর একটা খাওয়ার ঘর আছে। সে খুব কেতার। কত্তাদের আমলে সায়েব-সুবোরা আসত। ইংলিশ স্টাইল। এই মহলের উত্তরদিকে কমল কায়দা করে একটা সুইমিংপুল মতো করেছে। মিত্তিররা কদাচিৎ সুইমিং করে। চারটে হাঁস সর্বক্ষণ সেখানে ভাসছে। সে এক শোভা—
ডাকুকে কুসি বললে, ‘বোস। কথা আছে।’
বড় একটা কিচেন টেবিল। কাঠের দু-পাশে দুটো লম্বা কাঠের বেঞ্চি। এই টেবিলে আনাজ-পত্র কাটা হয়। কুসির বিলিতি কায়দা। কাটাকুটি সব কিচেন নাইফে করে। ডাকুর দিকে এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে, নিজের কাপটা টেনে নিল।
এক চুমুক চা খেয়ে বললে, ‘শোন, ছবিটা কিন্তু খুব সুন্দর। বড়দার মনে দুঃখ দিতে চাই না। তুই ওই দেয়ালেই সেন্টার করে, আলোটার এক হাত নীচে ছবিটা লাগিয়ে দে। কিচ্ছু বলবি না। ঠিক আছে? আজ দুপুরে তুই এখানে খাবি। বউকে আনবি।’
বাইরের ঘরে তিন ভাই একসঙ্গে হয়েছে। মাছ ধরার গল্প হচ্ছে। বিমলের মাছ ধরার নেশা। ডাকু ইলেকট্রি ড্রিল হাতে টেবিলে উঠে পড়ল। ড্রিলের শব্দে তিন মিত্তিরের মাছ ধরা থেমে গেল।
বিমল আঁতকে উঠে বলল, ‘এ কী রে? কী করছিস তুই! কুসির দেয়াল। ছাল ছাড়িয়ে নেবে। যাঃ, দেয়ালের সর্বনাশ হয়ে গেল। এ তো ছেলে নয়, সন্ত্রাসবাদী!’
ডাকু নীরব। ঝপাঝপ ছবি ঝুলে গেল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে কুসি ঘরে ঢুকে বললে, ‘বাঁদিকটা একটু উঠবে। খুব সামান্য। অ্যায়! ঠিক আছে।’
বিমল বললে, ‘কুসি! তুই অনুমতি করেছিস?’
কুসি কোনও উত্তর দিল না। ঘর ছেড়ে চলে গেল। বিমল অভিভূত, ‘ফ্যানটাসটিক! একেবারে মায়ের মতো। আমি জন্ম, জন্ম ধরে কুসির ভাই হতে চাই। তোমরা?’
নির্মল আর কমল সমস্বরে বললে, ‘আমরাও।’
দরজার কাছে থেকে ডাকু মুখ ঘুরিয়ে বললে, ‘আমিও’।
কমল রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। রান্না করা তার হবি। বিমল আর নির্মল দুজনেই ‘ইমোশনাল’। লক্ষ করলেই দেখা যাবে দুই মিত্তিরের চোখে জল। ঘরে একজন এলেন। মিত্তির বাড়ির অবারিত দ্বার। যে কেউ যে কোনও সময় চলে আসতে পারে। ঘরে ঢুকলেন জগমোহনবাবু। নামকরা শিক্ষক ছিলেন। এখন উন্মাদ। একমাত্র কৃতী ছেলে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর থেকেই একটু একটু করে মস্তিষ্কের সুস্থতা হারালেন।
ছেলেটার মৃত্যুতে পাড়ার সবাই হায় হায় করেছিল। আজও করে। যেমন রূপ ছিল তেমনি গুণ। মৃত্যু এমন এক পূর্ণচ্ছেদ কার জীবনে কখন যে পড়বে ভগবানের কলমই জানে।
এখন বেশির ভাগ সময়ই নাটকের ডায়ালগ বলেন। ঘরে ঢুকলেন এই বলতে বলতে, ‘আওরঙ্গজেব! তোমার মাকে তুমি নিজে হাতে মারলে। ভেরি স্যাড, ভেরি স্যাড। কালমেঘ খাও, কালমেঘ। গজানন, ও গজানন পঞ্চাননকে নিয়ে গুম মেরে বসে আছ কেন? আজ খাওয়া জোটেনি? হাওয়া খাও, হাওয়া। ভোরের হাওয়া। ভোরের হাওয়ায় চোখের জল থাকে। রাতের কান্না। তারাসুন্দরীর চোখের জল। আমি জানি, সব জানি।
There is a pleasure in the pathless woods,
There is a rapture on the lonely shore
এস গজানন এক হাত দাবা হয়ে যাক। সেই জোচ্চর ভগবান, I will teach you a lesson! তুমি খুব বেড়েছ। নস্ত্রাদামুস। আকাশে ওড়াও নানা রঙের ফানুস।’
জগমোহন থপাস করে মেঝেতে বসে পড়লেন। মোটাসোটা মানুষ। সেই বলে না তপ্ত কাঞ্চন বর্ণ, গায়ের রং ঠিক সেইরকম। বসে বসে দুলছিলেন, হঠাৎ বুক ফাটা কান্না। বিমল কারো দুঃখ সহ্য করতে পারে না। তার নিজের রোগী মারা গেলে রোগীর আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে নিজেও কাঁদতে থাকে। এই সেদিন হেপাটাইটিসে একটি ছাত্রী মারা গেল, ভোজন রসিক বিমল সারাটা দিন না খেয়ে রইল। দাদার সঙ্গে পুরো পরিবারের উপবাস। গান্ধারী বললে, যে-কালে বড়দা খাবে না, সে-কালে আমি খাব! বিমল নিজের মনেই বললে, ‘এই পৃথিবীতে আর একদিনও বাঁচতে ইচ্ছে করে না!’
জগমোহনবাবুর স্ত্রী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছেন। খুব করুণ গলায় ক্ষমা চাইছেন, ‘বাবা বিমল। তোমরা খুব বিরক্ত হচ্ছ, তাই না? কী করব বলো। একার সংসার, কতদিকে চোখ রাখব। একটু ফাঁক পেলেই ছুটে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছেন।’
স্বামীর হাত ধরে ওঠাতে, ওঠাতে বলছেন, ‘চলো বাড়ি চলো। তোমার রাজহাঁস ফিরে এসেছে।’ জগমোহন অনেকক্ষণ স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘তুমি কে? কোন ইয়ার?’
রাজহাঁস বললেই জগমোহন একেবারে শান্ত, বাধ্য মানুষ। পাগলের বিশ্বাস, তাঁর ছেলে রাজহাঁস হয়ে গেছে। একদিন না একদিন ফিরে আসবেই। জগমোহন স্ত্রীর হাত ধরে ধীরে বেরিয়ে গেলেন। কোথায় কোনদিকে পা ফেলছেন, কোনও খেয়াল নেই।
বৈঠকখানায় একটা কিছু হচ্ছে। কী হচ্ছে দেখার জন্যে কুসি চলে এসেছে। প্রতিবেশী লক্ষ্মীবাবু এসেছেন। যথারীতি ধোপ দুরস্ত, পরিপাটি সাজ-পোশাক। কড়া মাড় দিয়ে ইস্তিরি করা সাদা ফতুয়া পাঞ্জাবি। ঝুলে এক সাইজ ছোট চিনে-পাজামা। একটা অ্যাম্বার রং এর কাঁধে-ঝোলা ব্যাগ। এক মাথা সাদা চুল, অবিন্যস্ত। এইটাই স্টাইল। পাড়ায় ভদ্রলোকের নাম, ভয়ের ফেরিওয়ালা। এক একদিন এক এক রকম ভয় আমদানি করেন। দেখা যাক আজ কী বেরোয় ঝুলি থেকে।
প্রথমেই খুব নাটকীয় ভঙ্গিতে বললেন, ‘ঢুকে পড়েছে।’
মুখে যতটা সম্ভব ভয় এনে বললেন, ‘ঢুকে পড়েছে। এ-পাড়াতেও এসে গেল। কাল সন্ধেবেলা একজন আমার কাছে এসেছিল। ইয়া ভুঁড়ি। চালতার মতো মুখ। বলে দিতে হয় না, দেখলেই বোঝা যায়।
আন্ডারওয়ার্লডের লোক। এ কে ফর্টি সেভেন। সেকেন্ড তিরিশটা। চালুনি-ঝাঁজরা। বলে কী মিত্তির বাড়িটা ম্যানেজ করে দিতে পারেন? আপনাকেও একটা এগারোশো স্কোয়্যার ফুট ফ্রি দিয়ে দেবো। ক্যাশ টাকাও পাবেন।’
বিমল বললে, ‘সে আবার কি?’
‘শোনো, অনেক রকম যুগের নাম শুনেছ, সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি। এইবার আর একটা যুগের নাম শোনো, ”প্রমোটার-যুগ”। একটু সাবধানে থেকো। তোমাকে তুলে নিয়ে যাওয়া খুব সহজ। হুটহাট করে এখানে সেখানে একা একা চলে যাও। কবি কবি ভাব। ঘাড় ধরে গাড়িতে তুলবে, তারপর প্যাঁচ মারবে। তোমাদের বাকি তিনটেও তো সত্যযুগের মানুষ। এটা যে কলির মনেই নেই তোমাদের। তোমরা সিকিউরিটি নিয়ে চলাফেরা করো। থানায় জানিয়ে কোনও লাভ নেই। ওদের নিয়ম হল, আগে খুন, পরে অনুসন্ধান।’
‘আপনি প্রথমেই খুনে চলে গেলেন?’
‘কি আশ্চর্য! তোমরা জেগে ঘুমোও নাকি? রোজ খবরের কাগজ খুলে কি দেখো? রক্তারক্তি। তোমাদের চারটে ভাইকে শেষ করে দিতে পারলেই মিত্তিররা ফিনিশ। আমিও বাদ যাব না।’
‘আপনি বাদ যাবেন না কেন?’
‘তোমরা অনেক কিছু পড়েছ, একটু যদি গোয়েন্দা কাহিনী পড়তে! এই দেখো, আমি বুঝিয়ে দি। ধরো, তোমরা ধরাধধড় খুন হলে। তারপর একটা ইনভেস্টিগেশন হবে। এই মেয়েটা পুলিশকে বলে দিলে, লক্ষ্মীকাকাবাবুর কাছে একজন এসেছিল। তার মানে, তোমাদের মার্ডার কেসে আমি একজন সাক্ষী। আধুনিক অপরাধীরা সাক্ষীকে খতম করে দেয়। জেমস হ্যাডলি চেজের ওই বইটা পড়ে দেখো, ‘ভালচার ইজ এ পেশেন্ট বার্ড।’
লক্ষ্মীবাবু সবার মুখ একবার দেখে নিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, ‘ভয় পেয়েছ?’ পাওয়ার কথা। তবে জেনে রাখ, এইরকম ঘটনা ঘটতেই পারে, এখনও ঘটেনি। প্রস্তুত থাকতে হবে। আমাদের ডাক্তারের শাস্ত্রে আছে, প্রিভেনশান ইজ বেটার দ্যান কিওর। মেঘ দেখলে আমরা যেমন ছাতা ব্যবহার করি, সেই রকম প্রোমোটার দেখলে কী বের করব? ভাবো, সবাই মিলে ভাবো, যাক, রবিবারের নৈবেদ্য গেল কোথায়? মিত্তির বাড়ির ফেমাস। মুড়ি, তেলে ভাজা আর চা—যত পারিস তত খা।’
‘এসে গেছে।’ গান্ধারীর গলা।
মাঝারি মাপের দুটো ধামায় মুড়ি আর গরম তেলে ভাজা। একটা ডিশে নুন, কাঁচা লঙ্কা, আদা কুচি।
দশ বারোটা খালি বাটি। মুড়ি তোলার জন্যে স্টেনলেস স্টিলের দুটো হাতা।
দুই
বড় মিত্তির বিমল এক অসাধারণ মানুষ। শিশুর মতো সরল। ডাক্তারি করার সময় রুদ্রনারায়ণ। তখন কে রুগি, কেমন রুগি, এ-সব দেখে না। তখন লড়াই। রোগের সঙ্গে বৈদ্যের লড়াই। তখন জ্ঞান, অভিজ্ঞতা আর সেবার সমন্বয়ে দীনের ভগবান। আর গভীর রাতে যোগী। বিমল সেই সময়ে কিছুক্ষণ লেখে। লেখক হওয়ার জন্য লেখে না। লেখে মনের প্রকাশের আনন্দে। কি লিখেছে দেখি। শিরোনাম ‘মান-অপমান’।
যেদিন পৃথিবীতে প্রবেশ করলুম সেইদিন থেকে শুরু হল অপমানিত হওয়ার পালা। পদে পদে অপমান। অপমান আমাদের জীবন সাথী। পারস্পরিক ব্যাপার। হয় আমি অপমান করব, না হয় কেউ আমাকে অপমান করবে। হয় আমি কারোকে কাটা কাটা বাক্যবাণে জর্জরিত করব, না হয় কেউ আমাকে করবে। পৃথিবী থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার মুহূর্তেও শরীরে লেগে থাকবে একটা জ্বালা, মনে একটা ক্ষোভ, জীবনের হাতে কী জুতো-পেটাই না খেলুম! উঠতে কোস্তা বসতে কোস্তা।
যখন অবোধ শিশু, কান্নার পর্যায়ে আছি তখন কেউ না কেউ বলছে, চেল্লাচ্ছে দেখ, কানের পোকা বের করে ছাড়বে। এই কে আছিস, দূর করে বাইরে ফেলে দিয়ে আয় জানোয়ারটাকে। ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে মা বলেছেন, কেঁদে না মরে গিলে মরো না। এই শয়তানটা আমার হাড়-মাস কালি কালি করে ছাড়ল। মাঝে মাঝে মনে হয় গলা টিপে শেষ করে দি! পুত্রের অপমান পিতাতেও সময় সময় বর্তাত, যেমন বাপ তার তেমন ছেলে। বাপ বকাসুর, ছেলে ঘটোৎকচ।
জ্ঞান হল। পড়তে বসলুম। অক্ষরের জগৎ, সংখ্যার জগৎ। একই ‘ইউ’। আমব্রেলার আগে ‘অ্যান’ ইউনিভার্সিটির আগে ‘এ’। শুরু হয়ে গেল খ্যাচাখেচি, ধস্তাধস্তি। এ, অ্যান, দ্যাট, হ্যাজ, হ্যাভ, ইজ, অ্যাম, আর। বলো, পীড়িত বানান কী লেখো, স্লেটে লেখো। আহা মানিক আমার। দ্যাখ, দ্যাখ, দুটোতেই দীর্ঘ ঈ মেরে বসে আছে। একটু বেশি পীড়া। ট্রিটমেন্ট করে পরের দীর্ঘৈটা ছাড়াতে হবে। এই, উসকো কান পাকাড়কে ইধার লাও। এই ই ঈ উ ঊ-এর ঠেলায় বাঁ কানটা ডান কানের চেয়ে দু-সুতো বড় হয়ে গেল। যতদিন না গোঁফ গজাল, ততদিন প্রহরে প্রহরে প্রহার আর নির্বিচার টানাটানি। ভূপতিত আর ভূপাতিত, কি তফাত। বল গাধা! দশসের সরু চালে কুড়ি সের মোটা চাল পাইল করে পাঁচসিকে সের দরে বিক্রি করলে লাভ কত হবে? হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে ঘুড়ি দেখলে ওদের বাঁদর সারাটা জীবন যে রিকশা টানতে হবে! এবম্বিধ তিরস্কারের পর এমন অঙ্ক কষলুম, পুত্রের বয়স পিতার চেয়ে দশ বছর বেশি হয়ে গেল। শিক্ষকমহাশয় একহাতে ডাস্টার এক হাতে বেত নিয়ে রুদ্রনৃত্য শুরু করলেন। বিনীত ভাবে যেই বলেছি, স্যার! এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন সামান্য ব্যাপার! উলটে নিলেই তো হয়, যার বয়েস বেশি সে পিতা, যার বয়সে কম সে পুত্র। সঙ্গে সঙ্গে গাধার টুপি হাতে ছুটে এল স্কুলের দারোয়ান। গাধাটার মাথায় চাপা। জিভ বের কর, কান ধর। শুরু হল স্কুল পরিক্রমা। দৃশ্য দেখে পণ্ডিতমশাই ভবিষ্যদ্বাণী করলেন, ঘোর কলি! এরপর দেখবে, মেয়ের গর্ভে মা জন্মাবে!
এরপর চাকরি। পাহাড়ের যেমন চড়াই উতরাই থাকে, মাঝে মাঝে উপত্যকা বিস্তীর্ণ। সেইরকম চাকরি জীবন হল অপমানের উপত্যকা। দশটা থেকে পাঁচটা অপমানের তাঁবুতে সার্কাসের খেলা। বড় প্রভু, মেজো, প্রভু, ছোট প্রভু, প্রভুর প্রভু, যার কাছেই যাওয়া যাক, সেই বুঝিয়ে দেবে তুমি অন্নদাস। প্রতিমুহূর্তে বোধ হবে, ওরে পেট তোর জন্যে করি আমি মাথা হেঁটে।
তুলসীদাস একটি বাস্তব পরামর্শ আমাদের জন্যে রেখে গেছেন।
তুলসী উঁহা যাইয়ে, যাঁহা আদর না করে কোই।
মান ঘাটে, মন্ মরে, রামকো স্মরণ হোই।।
হে তুলসী! যেখানে গেলে তোমাকে কেউ আদর করবে না, তুমি সব সময় সেইখানেই যাবে। কেন যাবে! সেখানে যাবে এই কারণে, উপেক্ষা আর অপমানে তোমার মন অহঙ্কার মুক্ত হবে, মরমে মরে যাবে, আর তখনই তোমার মনে জগৎ পিতার চিন্তা আসবে।
কীভাবে মানুষকে অপমান করা যায়, তারও একটা শাস্ত্র আছে।
সেটাও একটা আর্ট। গ্রাম্য মানুষ গোদা গোদা গালাগাল দেবে, আর বড় মানুষ, শিক্ষিত মানুষ, বুদ্ধিজীবি মানুষ, তাঁদের কায়দাটা অন্যরকম। সূক্ষ্ম, কিন্তু ভয়ঙ্কর। ছুরি মারলে রক্ত বেরোবে। সেরে গেলে স্মরণে থাকবে না। বাক্যের চোট সাংঘাতিক। মনে রক্তপাত। কোনও ওষুধ নেই। বাক্যের খোঁচা অতি ভয়ঙ্কর। তুলসীদাস বললেন, ‘মারে শব্দে সে।’
আর্টিস্টিক অপমানের নমুনা—
হুইস্টলার ছিলেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী। ততোধিক বিখ্যাত ছিল তাঁর মুখ। ছবি আঁকার ক্লাসে এক ছাত্রীকে প্রশ্ন করলেন,
‘তুমি নিউইয়র্ক থেকে এসেছ?’
‘ইয়েস স্যার!’
‘দেখি কি আঁকলে?’
মেয়েটি ক্যানভাস নিয়ে এগিয়ে এল। শিল্পগুরু দেখে প্রশ্ন করলেন, ‘হাতটা আঁকলে লাল রঙে, কনুইয়ের কাছে সবুজ ছায়া মারলে কোন আক্কেলে?’
‘স্যার, আমি যা দেখি, যেমন দেখি, ঠিক সেইভাবে আঁকি।’
শিল্পী বললেন, ‘বেশ বেশ, খুব ভালো, বাট মাই ডিয়ার দি শক উইল কাম হোয়েন ইউ সি হোয়াট ইউ পেন্ট। যা দ্যাখো, তাই আঁকো, অতি উত্তম কথা, তবে নিজের আঁকা ছবি যখন দেখবে তখন ভিরমি যাবে।’ ক্লাস ভর্তি ছাত্র-ছাত্রী। মেয়েটির মাথা হেঁট!
আমার নিজের অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ছে। কলেজের প্রথম দিনের প্রথম ক্লাস। অধ্যাপক সকলের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন, ‘তোমার নাম?’ নাম বললুম। ‘নিবাস?’ বললুম ‘বরাহনগর’।
অধ্যাপক রসিকতা করলেন, ‘আশা করি তোমার থেকে তোমার বন্ধুদের কোনও ভয় নেই!’ সামনের সারিতে ছাত্রীরা। তারা আমার এমত হেনস্থায় খিলখিল করে হেসে উঠল।
সঙ্গে সঙ্গে আমার উত্তর, ‘আজ্ঞে না স্যার, বরাহরা আমার তালুকের প্রজা। আমি নগরপাল মাত্র।’
জন ড্রাইডেন, আমাদের পরিচিত নামকরা কবি। ছাত্রজীবনে সকলেই পড়েছেন ড্রাইডেন। ড্রাইডেন খুব পড়ুয়া ছিলেন। তাঁর নিভৃত স্টাডিতে সারাদিন বই মুখে বসে থাকতেন। একদিন তাঁর ক্ষুব্ধ স্ত্রী আক্ষেপের সুরে বললেন, ‘লর্ড মিস্টার ড্রাইডেন, সারাদিন ওই পুরনো পুরনো বইগুলো নিয়ে অমন মশগুল হয়ে থাকো কী করে! মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে একটা বই হয়ে যাই, তাহলে খানিক তোমার সঙ্গ পাওয়া যেত!’
কবি উত্তরে বললেন, ‘বই হবে, তা বেশ ভালো কথা। একটাই অনুরোধ, বই যদি হও, তো একটা পাঁজি হোয়ো, তা হলে বছর পালটাতে পারব।’
বিখ্যাত লেখক, সমালোচক কারলাইলের কথা আমরা জানি। কারলাইলের দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না। সকলেই তা জানতেন। লাগাতার দ্বন্দ্ব। স্যামুয়েল বাটলার একদিন বলে বসলেন, ‘ঈশ্বর করুণাময়! কী ভালোই না করেছেন দু’জনের বিয়ে দিয়ে। তা না হলে চারজনের জীবন অতিষ্ঠ হতো।’
কী ভাবে! দুজনেই সমান। কারলাইল যদি আর একটি মেয়েকে বিয়ে করতেন আর শ্রীমতী কারলাইল যদি অন্য একটি পুরুষকে বিয়ে করতেন তাহলে চারজনের জীবনেরই বারোটা বেজে যেত!
স্যার থমাস বিচাম ছিলেন একজন বিখ্যাত বাদক ও সংযোজক। একটা কনসার্টের জন্যে বিভিন্ন বাদকের পরীক্ষা নিচ্ছেন। এক যুবতী চেলো বাজাচ্ছে। বিচাম তাকে একটি টুকরো বাজাতে দিয়েছেন। বিচাম লক্ষ করছেন, মেয়েটি অনেকক্ষণ লড়াই করে কিছুতেই বাগে আনতে পারছে না। যাই হোক কোনওরকমে শেষ করে মেয়েটি প্রশ্ন করল।
‘এরপর কী করব স্যার?’
বিচাম বললেন, ‘গেট ম্যারেড!’ আর কিছু করতে হবে না। বিয়ে করে ফ্যালো।
লুই দ্যা ফোরটিনথ-এর রাজত্বকালে ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের সম্পর্ক ভিতরে ভিতরে খুব তিক্ত ছিল, কারণ ধর্ম। ক্যাথলিক উগ্রতা, পোপের ক্ষমতা, ইংল্যান্ডের প্রোটেস্টান্টদের কাছে অসহ্য মনে হতো। এক ইংরেজ এসেছেন রাজদরবারে। রাজা লুই তাঁকে নিয়ে গেছেন রয়াল আর্ট গ্যালারিতে। অতিথিকে দাঁড় করিয়েছেন একটি ছবির সামনে। লুই জানতেন ছবির সামনে দাঁড়ালেই যে কোনও প্রোটেস্টান্ট বেশ একটু ধাক্কা খাবে, আর সেইটাই তাঁর উদ্দেশ্য।
রাজা বললেন, ‘এই হলেন ক্রুশবিদ্ধ যিশু। আর ডানদিকের ছবিটা হল পোপের, আর বাঁদিকেরটা আমি।’
অতিথি বললেন, ‘I humbly than you majesty for this information. আমি প্রায়ই শুনতুম, আমাদের প্রভুকে যখন ক্রুশবিদ্ধ করা হয়, তখন তাঁর দুপাশে দুটো চোর দাঁড়িয়েছিল। আমি এই ছবিটা দেখার আগে পর্যন্ত জানতুম না, সেই চোর দুটো কে, কে। এখন জানা গেল ইওর ম্যাজেস্টি। ধন্যবাদ!’
বিখ্যাত ডঃ জনসন যে কোনও কারণেই হোক নারী-বিদ্বেষী হয়ে পড়েছিলেন। সকলেই তা জানত। তিনি মনে করতেন, মেয়েরা সব মহানির্বোধ। একদিন বিরক্তিকর রকমের বাচাল এক মহিলা জনসনকে পাকড়েছে। কিছুতেই সঙ্গ ছাড়ছে না। মহিলা এক সময় প্রশ্ন করছে—
‘ডকটর, শুনেছি, আপনি না কি মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের সঙ্গ বেশি পছন্দ করেন।’ জনসন বললেন, ‘ম্যাডাম। আপনার ধারণা খুব, খুব ভুল। আমি নারীর সঙ্গ খুবই পছন্দ করি, তাদের সৌন্দর্য, প্রাণচাঞ্চল্য এবং তাদের নীরবতা। আই ভেরি মাচ লাইক দেয়ার সাইলেন্স।’
তুলসীদাসজির একটা দোঁহা আছে—
ভাটকে ভালা বোল্না চল্না বহুড়ীকে ভালা চুপ্।
ভেক্কে ভালা বর্ষাবাদর, অজ্কে ভালা ধুপ্।
যারা ভাট, তারা অনেক কথা বলবে, বহু পথ চলবে। কিন্তু বধূরা স্বল্পভাষী হবে। সেইটাই শোভন। সেইটাম কাম্য। ব্যাঙের কাছে যেমন বর্ষা, ছাগলের কাছে যেমন রোদই আনন্দের কারণ। নারীর নীরবতা অন্যতম একটি সৌন্দর্য। জনসন সেইটিই বললেন,
I like their beauty, I like their vivacity, and like their silence.
জনসন আর ডিকেনস দুজনেই খুব মজার মানুষ ছিলেন। কথা দিয়ে কামড়াতে পারতেন মোক্ষম। এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী তরুণ লেখকের পাণ্ডুলিপি ফেরত দিলেন জনসন এই মন্তব্য লিখে, your manuscript is both good and oroginal. But the part that is good is not original and the part that is original is not good. চার্লস ডিকেনসের কাছে একটি কবিতা সংকলন এল, নাম ‘Orient Pearls at Random Strung’। ঔপন্যাসিক ছোট্ট একটি চিরকুট লিখলেন কবিকে—Dear Blanchard, Too much String, Yours C.D.
কুসি বড়দার ঘর নিজের হাতে গুছোয়। প্রয়োজন হলে গান্ধারীর সাহায্য নেয়। সেই সময় কুসি দাদার লেখা পড়ে। আর তখনই তার বাবার কথা, মায়ের কথা মনে পড়ে। যেমন গাছ, তেমন তার ফল। আর মন পড়ে তার প্রেমিকের কথা। ভীরু, দুর্বল এক যুবক। কলেজ পাড়ায় সে তার বাবার কাগজ-কলম, খাতা-পেনসিলের দোকানে বসত। মায়া মাখানো দুটি চোখ। কলকাতার মতো দানবীয় শহরে এমন মায়াময় চোখ সহসা চোখে পড়ে না। ছেলেটির নাম ছিল সমুদ্র। বড় ঘরের ছেলে। বাবার হঠাৎ প্যারালিসিস। শয্যাশায়ী। সমুদ্র তার কলেজেরই ভালো ছাত্র ছিল। দু’বছরের সিনিয়ার। লেখা-পড়া ছেড়ে দোকান সামলাতে এল। মাথায় মাথায় দুটি বোন। দুজনেই ছাত্রী। ভালো ছাত্রী। সমুদ্রর কোনও অভিযোগ ছিল না। এইরকমই তো হয়। পৃথিবী তো অনিশ্চয়তা ভরা। সমুদ্র বলত ‘লাইফ ইজ এ জার্নি। কখনও পথ ভালো, কখনও দুস্তর।’
কুসি প্রথম যেদিন ওই দোকানে খাতা কিনতে গিয়েছিল, তখন দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে ছিল বহুক্ষণ, তারপর সেই ঘোর কেটে যাওয়ার পর দুজনেই হেসে ফেলেছিল। পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ। হরিহর ছত্রের মেলা। এরই মধ্যে ‘ঠিক একজন’ আছে ‘ঠিক আর একজনের’ জন্যে। সে বলে দিতে হয় না। সে চিনে নিতে হয় না; কিন্তু দেখা হওয়াটাই মুশকিল। হলেই যে ‘দুই দাঁড়ের নৌকো’ ভাসবে এমন কথা নেই। চল মুসাফির। অনন্ত জীবন পড়ে আছে। অদ্ভুত একটা ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল দুজনের। স্বামী-স্ত্রীর দেহগন্ধী ভালোবাসা নয়। সে কেমন? কাশফুল যেমন শরতের বাতাসে দোল খায়। সাদা মেঘ নেমে আসে সরোবরের নীল-সবুজ। সমুদ্রর কথা মনে পড়লেই কুসির মনে আসে রবীন্দ্রনাথের দুটি লাইন—
নানা দুঃখে চিত্তের বিক্ষেপে
যাহাদের জীবনের ভিত্তি যায় বারংবার কেঁপে,
যারা অন্যমনা, তারা শোনো,
আপনারে ভুলো না কখনো।
তিন
আজ মিত্তিরদের বৈঠকখানা—একেবারে ফুল হাউস। কয়েকদিন হল মেজর এসেছেন। সেনাবাহিনী থেকে রিটায়ার করার পর দেরাদুনে সেটল করেছেন। অনেকটা জায়গা নিয়ে অর্চার্ড অর্থাৎ ফলের বাগান। আপেল, চেরি, পিচ এইসব। বিদেশে যায়। ভারতের বিভিন্ন শহরে। মিত্তিরদের দূর-সম্পর্কের আত্মীয়। বছরে একবার, দুবার আসেন। দারুণ চেহারা। প্রায় ছ-ফুট লম্বা। সাহেবদের মতো গায়ের রং। অনেক ভাষা জানেন। তেমনি আমুদে। শরীরে রোগাবালাই নেই। অর্থের অভাব নেই। একটিমাত্র শিক্ষিতা মেয়ে। এক সাহেবকে বিয়ে করে বিলেতে থাকে। মেজর অনেক বড় বড় লড়াই করেছেন।
কফি চলছে। মেজর হঠাৎ বললেন, ‘ফাটবে কি ফাটবে না। কি বলো তো?’
সবাই সমস্বরে বললে, ‘বোমা’।
‘যে হেতু আমি বলছি, সেই হেতু, বোমা ছাড়া আর কিছু নেই আমার জীবনে! আমি বলছি পটলের দোরমার কথা।’
‘সে আবার কী?’
‘আরে ধুর এক ঘেঁয়ে পাঞ্জাবি খেতে খেতে বিরক্তি ধরে গেছে। একদিন ভাবলুম পটলের দোরমা করা যাক। পটলের পেটে পুর ঢুকিয়ে ময়দার ছিপি আটকে ছাঁকা তেলে নাড়াচাড়া করছি। গুন গুন করে গান গাইছি। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই ফটাস করে ফেটে মুখে, চোখে, বুকে। এর পরে হল কী, এক একটা কড়ায় ছাড়ি, আর দূর থেকে নাড়ি, ফাটবে কি ফাটবে না! আতঙ্ক!’
কুসি বললে, ‘টেকনিকটা আপনি ঠিক জানেন না।’
‘তা হতে পারে। তা আমি বলছিলুম, আজ লাঞ্চে দোরমা হলে কেমন হয়?’
বিমল বললে, ‘অসম্ভব ভালো হয়। এই আইটেমটা বহুদিন হয়নি।’
কুসি বললে, ‘হবে।’
মেজর বললেন, ‘জানি। তোমার ডিকশানারিতে অসম্ভব শব্দটা নেই। গান্ধারী আবার কফি নিয়ে ঢুকছে। মেজর এলে গান্ধারী আরও চনমনে হয়ে ওঠে, ‘কাপি, কাপি, কাপি।’
কুসি জিগ্যেস করলে, ‘ওদিককার খবর?’
‘সব ঠিক আছে ম্যাডাম। কেবল!’
‘কেবল কী!’
‘দুটো ডিম, পড়ে ফ্যাট।’
‘কার কর্ম?’
‘কার আবার! অপকর্মের মাস্টার আমি।’
বিমল মেজরকে জিগ্যেস করলে, ‘বেঁচে থাকতে কেমন লাগছে?’
‘ভীষণ ভালো। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে তিন-চারবার জীবনকে ছিনিয়ে আনতে পেরেছি তো, তাই জীবন আরও যেন ভালো লাগছে। সমস্যা আছে, বহু রকমের সমস্যা, বাধা-বিঘ্ন, তাতে কি হচ্ছে জানো, ড্রাইভিং স্কিল বেড়ে যাচ্ছে। জীবন হল গাড়ি চালানো। গুড ড্রাইভার সেফলি ডেস্টিনেশান পৌঁছে যায়। ডেস্টিনেশান ইজ ডেথ। গাড়ি আর চালক দুজনেই হাওয়া। আর্মিতে রেগুলেশান বুট পরতে হতো। পায়ে খানকতক মোক্ষম কড়া তৈরি হল। সেই অবস্থায় ফ্রন্টিয়ারে যুদ্ধ। কখনও আত্মরক্ষার জন্যে এক পজিশান থেকে আর এক পজিশানে ছুটছি, কখনও চার্জ করছি। তখন কোথায় কড়া, কোথায় ব্যথা। মোদ্দা কথা দুটো, দুঃখটাকে ভুলতে পারলেই সুখ, মৃত্যুটাকে ভুলতে পারলেই জীবন। আর্মির লোকরা মৃত্যুকে মৃত্যু বলে মনে করে না। একটু আগে পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, একটু পরেই মরে পড়ে গেল। আমি জানি বেঁচে থাকাটাই আমার কাজ। পৃথিবীটা বিশ্রী সুন্দর।’
নির্মল দর্শনের অধ্যাপক। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ গান্ধারী ছিটকে ঘরে ঢুকে বস্ত্রহরণ পর্বের দ্রৌপদীর মতো মেঝেতে ভেঙে পড়ল। তার পিছনেই উগ্র মূর্তি কুসি। আঙুল উঁচিয়ে কুসি গান্ধারীকে ধমকাচ্ছে, ‘ভবিষ্যতে যদি আর কোনওদিন দেখি! তুই খেতে পাস না?’
মেজর জিগ্যেস করলেন, ‘কী হল?’
কুসি রাগ সামলে গলায় বললে, ‘মেঝে থেকে চামচে দিয়ে ভাঙা ডিমের কুসুম তুলে বাটিতে রেখেছে, তাতে চুল, ময়লা, চায়ের পাতা, কী নেই! কাচ ভাঙা আর পেরেক ছাড়া। উনি সেটি ওমলেট করে খাবেন। পিশাচ! তোর শ্মশানে থাকা উচিত। মিত্তির বাড়ির ফ্রিজে কি গোটা ডিম নেই।’
এক দমে কথাগুলো বলে কুসি জোরে একটা নিশ্বাস ফেলে শান্ত হয়ে গেল। মেঝেতে বসে থাকা গান্ধারীর মাথায় হাত রেখে বললে, ‘তুই এই বাড়ির কে? জানিস আমার একটা পিঠোপিঠি বোন ছিল। তোকে আমি আমার সেই বোন বলেই মনে করি। তুই আমার সেই বোন। তুই মেঝে থেকে ডিম তুলে ওমলেট খাবি?’
গান্ধারী বললে, ‘দিদি, ওটা মেয়েদের অব্যেস। ওই যে কাল তোমার হাত থেকে তেল পড়ে গেল। তুমি আঙুল দিয়ে একটু একটু করে তুললে। মেয়েরা পড়ে গেলেই তোলে।’
‘সে তেলে রান্না হবে না গান্ধারী।’
‘হবে না কি? আমি তো রান্না করে দিয়েছি।’
‘সে কি রে?’
‘তবে! পয়সার জিনিস ফেলে দেবো নাকি?’
মেজর যখনই আসেন ওই কাচের ঘরটায় থাকতে ভালোবাসেন। এই মিত্তিরদের পূর্ব পুরুষের একজন খ্রিস্টধর্ম অবলম্বন না করলেও যিশুর ভক্ত ছিলেন। বাগানের এই দিকটায় ছোট্ট একটা উপাসনালয় তৈরি করেছিলেন, যার চূড়াটা চার্চের মতো। ভিতরটাও ঠিক সেইরকম। মেজর এই জায়গাটা খুব পছন্দ করেন। একা একা বেশ থাকা যায়। মিত্তির বাড়ির কোলাহল কানে আসে না।
শুয়ে শুয়ে ফেলে আসা জীবনের কথা ভাবছিলেন। অনেক যুদ্ধ করেছেন, যুদ্ধের কারণে অনেক মানুষ মেরেছেন। জয় করেছেন অনেক শক্ত ঘাঁটি; কিন্তু নিজের ভাগ্যকে জয় করতে পারেননি। সবচেয়ে শোচনীয় কুৎসিত পরাজয় হয়েছে নিজের অন্তরঙ্গ এক বন্ধুর কাছে। নিরীহ, ভোলেভালে, সজ্জন একটি মানুষ। বহু গুণের অধিকারী। মেজর আজও বুঝে উঠতে পারেননি, সেই মানুষটি কেমন করে তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে। এই দুনিয়ায় সবই সম্ভব।
নাম রেবেকা। মেজরের খুব পছন্দের নাম। প্রেমের বিয়ে। তরতরে মেয়ে। হাসতে, কইতে, গাইতে সবেতেই এক্সপার্ট। সাজতে? অমন সুন্দর করে নিজেকে সাজাতে কজন পারে। মেজর নিজের মনেই বললেন, ‘সামথিং রং ইন মি। যতটা সময় নজর তাকে দেওয়া উচিত ছিল দেওয়া হয়নি। মেয়েরা অভিমানী হয়। ক্ষণে ক্ষণে তাদের দেহ-মন পালটে যায়। মেয়েরা হল আকাশ।
মেজর মাঝে মাঝেই নিজেকে ধমকান, এখনও তুমি তার কথা কেন ভাবো! আর তখনই অনুভব করেন, তিনি খুব ভালোবেসে ফেলেছিলেন রেবেকাকে। আর তখনই বুঝতে পারেন, রেবেকা তাকে ভালোবাসেনি। সে এমন কিছু চেয়েছিল যা মেজর দিতে পারেননি। সেটা কী? হয়তো সঙ্গ! যাক গে। এত বড় পৃথিবী, কত লোকজন, পরিবার, হাসি-কান্না, উৎসব অন্ধকার! জীবন তো থেমে থাকার নয়! মেজর জোর গলায় অর্ডার দিলেন, ‘কম্পানি ফরোয়ার্ড মার্চ!’
সঙ্গে সঙ্গে দরজার কাছে নারীকণ্ঠ—লেফট-রাইট, লেফট-রাইট।
গান্ধারী ঘরে ঢুকে বললে, ‘চলো, তোমার ডাক পড়েছে।’
বৈঠকখানায় বিরাট ব্যাপার। ফোটোগ্রাফার কুন্তল এসেছে। সবাইকে নিয়ে একটা গ্রুপ ফোটো তোলা হবে। মিত্তির বাড়ির অ্যালবামে থাকবে। নির্মল বলে, যখন ‘রাইজ অ্যান্ড ফল অফ মিত্তির পরিবার’ লেখা হবে তখন ছবিগুলো কাজে লাগবে।
মেজর এসে দেখলেন, কুন্তল ক্যামেরার স্ট্যান্ডটা একবার এদিক, একবার ওদিক করছে। স্মার্ট ছেলে। মিত্তিররা হই হই করে আহ্বান জানাল। ‘মেজর, মেজর’।
কুন্তল একটু ফচকে আছে। সঙ্গে সঙ্গে বললে, ‘মেজরকে মাঝখানে রেখে মাইনররা যে যার জায়গা নিয়ে নেন। অ্যাডজাস্ট ইওরসেলভস। আমাদের নায়িকা কোথায় গেল? গ্রেট গান্ধারী!’ গান্ধারী মেজরের আড়ালে পড়ে গিয়েছিল। সেইখান থেকে বললে, ‘আমার দাঁড়াবার জায়গা নেই ভাই।’ মেজর তাকে টেনে সামনে আনলেন। এইবার আমরা নাটক দেখি।
ফটোগ্রাফার : একটু সরে, বড়দা একটু ডানদিকে। উ হুঁ বাঁদিকে যাচ্ছেন কেন?
বড়দা : কার ডানদিক? আমার না তোমার। শোনো নির্দেশ যখন দেবে পরিষ্কার নির্দেশ হওয়া চাই। তোমার মাথায় এক, বলছ আর এক। তোমার বলা উচিত ছিল, আপনার ডানদিক।
মেজদা : শুরু হয়ে গেল। ওরে! মুখের কাছে একটা মাইক্রোফোন ধরে দে। আরও আধঘণ্টা উচিত-অনুচিতের লেকচার হোক।
বোন (কুসি) : আধঘণ্টা হয়ে গেল। ঝড়ের এঁটোপাতার মতো, একবার ডান থেকে বাঁ, বাঁ থেকে ডান।
বড়দা : আমার মনে হচ্ছে পাশাপাশি স্ট্রেট লাইনে দাঁড়ালে ভালো হতো।
মেজদা : তোমার মুণ্ডু হতো। এত বড় একটা গ্রুপ। অর্ধচন্দ্রাকারে ঘোড়ার ক্ষুরের নালের আকারে, কাস্তের আকারে…
বড়দা : তোর মতো একটা ইডিয়েটের আকারে…
মেজদা : তোমার মতো একটা পণ্ডিত মূর্খের নির্দেশে…
ফ্ল্যাশ : আলো চমকে উঠল।
কুসি বললে, ‘যাঃ! মেরে দিলে। হেসেছি কি না মনে নেই।’
কুন্তল বললে, ‘ছবি খুব পারফেক্ট হবে। যেমনটি চেয়েছিলুম, মিত্তির বাড়ির চনমনে গ্রুপ। একটাই ভয়, মেজর সাহেবের মাথাটা আসবে কি?’
কুসি বললে, ‘সে কি? মানুষের পরিচয় তো মাথায় রে!’
‘ডোন্ট ওয়ারি। সে রকম হলে মাথাটা তুলে নিয়ে কেটে বসিয়ে দোবো।’
মেজো বললে, ‘কম্পিউটারের যুগ। সবই করা যায়, রামের মাথা শ্যামের ঘাড়ে। শ্যামের মাথা রামের ঘাড়ে।’
সবাই জায়গা মতো বসে পড়েছে। কুন্তল লটবহর গোটাচ্ছে। দুই মিত্তিরে আবার লাগল।
মেজো : বড়দা তুমি এখনও মিচকি হাসি হাসছ কেন?
বড় : অফ করতে ভুলে গেছি। ছবি তোলার সময় অন করেছিলুম। দেখবি, আলো আর হাসি, সে অন করে খুব হিসেবি না হলে অফ করতে ভুলে যায়। কুন্তল হঠাৎ তুমি ছবি তুললে কেন?
কুন্তল : লাস্ট ফিলম। এক্সপোজ করে দিলুম। এইবার রিলটা খুলে ওয়াশ করব।
মেজো : একেই বলে, উড়ো খই গোবিন্দয় নমঃ।
বড় : এই কথাটা অপমানসূচক।
মেজো : কুন্তল আমার ছাত্র ছিল। ওকে একসময়ে আমি বাঁদর, উল্লুক, গাধা, থ্রি ইন ওয়ান বলেছি। আমার সে অধিকার আছে।
বড় : কুন্তল আমার পেশেন্ট। আত্মিক আঘাত থেকে তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার। নার্ভাস টেনশানে ভুগছে। ঘুমের ওষুধ ছাড়া ঘুম আসে না।
মেজো : কেন আসে না?
কুন্তল : ভয়ে।
মেজো : ভয়ের ওষুধ ঘুমের বড়ি নয়, সাহস। কারেজ। মেজরের মতো সাহসী হও।
কুন্তল : স্যার! ও ভয় আর এ ভয়ে অনেক তফাত। অন্যের ঘুম ভেঙে যাওয়ার ভয়ে আমি ঘুমোতে পারি না।
মেজো : সে আবার কী!
কুন্তল : আজ্ঞে, আগে আমি ঘুমোতুম। আমার স্ত্রী সারারাত জেগে থাকত। চোখ গর্তে ঢুকে গেল। রোগা হয়ে গেল। হজমের গোলমাল। সবাই বললে, ফিমেল ডিজিজ। অনেক চিকিৎসা করালুম। শেষে জানা গেল ওটা মেল ডিজিজ।
মেজো : ফিমেল মেল ডিজিজ কী ব্যাপার! ফি মেলে বলেই ফিমেল ডিজিজ।
কুন্তল : স্যার! লজ্জার কথা বলব কী!
মেজো : আরে লজ্জার কী আছে, ডিজিজ বলছ কেন? ফিমেল ফিমেলে আসতে পারে মেলেও আসতে পারে। মানুষের হাতে কিছু নেই আর ছেলেপুলেদের ডিজিজ বলাটা ঠিক নয় কুন্তল। সব মানুষেই মহামানবের সম্ভাবনা।
ওই মহামানব আসে
দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
কুন্তল : স্যার! মহামানব নয় মহা-নাক। শোয়া মাত্রই আমার নাকের পাঞ্চজন্য শঙ্খ বেজে ওঠে। হরেক জানোয়ারের মিলিত ডাক। শোবার ঘরে আফ্রিকার অরণ্য। প্রতিবেশীদের কমপ্লেন। আপনার বউমা ভয়ে জানলা খোলে না।
মেজো : গাধা কোথাকার। ঘুমের ওষুধ বউকে খাওয়া, নিজে সুখে নিদ্রা যা।
কুন্তল : সেইটাই তো করছি। প্রেসক্রিপশান আমার নামে, ওষুধ খাচ্ছে মিসেস।
বড়দা : বাঃ, এই না হলে রুগি। এদের জন্যেই ডাক্তাররা পেটাই খায়।
মেজো : এক কাজ করো না দাদা, নাকটা খুলে ক্লিন করে আবার সেট করে দাও।
বড় : নাক নাকের জন্যে ডাকে না, প্রবলেমটা গলায়।
মেজ : তাহলে গলাটা কেটে দাও।
বড় : তারপর জেলে যাও, তারপর ফাঁসিতে লটকাও। আধহাত জিভ করে লাট খাও। আহা রে! আমার ভ্রাতা লক্ষ্মণ রে।
মেজো : এরা সব দাঁড়িয়ে কেন?
বড় : আমাদের শ্রুতিনাটক শোনার জন্যে।
মেজো : কর্তব্য কর্মে অবহেলা। আমাদের তো এখন টি-টাইম। (হাক) গান্ধারী!
গান্ধারী বলল, ‘চায়ের সঙ্গে সামান্য কিছু আয়োজন আছে!’
নির্মল বললে, ‘কি অয়োজন জানতে পারি!’
‘গরম গরম পাকোড়া।’
‘ফ্যান্টাস্টিক। তাড়াতাড়ি হাজির করো।’ নির্মলের আর তর সইছে না।
বিমল মেজরকে জিগ্যেস করলে, ‘কী হয়েছে আপনার? এত গম্ভীর?’
‘মাঝে মাঝে মনের যে কী হয়, ড্যাম্প লেগে যায়।’
‘যা বলেছেন। আমারও ওই এক সমস্যা। বেশ আছে, হঠাৎ কী হল!’
‘এ হল মনের স্বভাব।’
নির্মল বললে, ‘সব সময় কাজে থাকলে মন মানুষের বাগে থাকে।’
মেজর বললেন, ‘না রে ভাই। কাজের অভ্যাসে কাজ করি আমরা, তখন মনের দিকে তাকাই না। তাকালে দেখা যাবে বিষণ্ণতায় ভরা। এর কারণ, প্রতিদিনই আমরা একদিন করে মরে যাচ্ছি যে! মৃত্যুর উৎসবে বসে কত আর আনন্দ করা যায়! এই পৃথিবীতে একটাই আসল কথা—’যায়’।
‘আজ যায়, কাল যায়, শৈশব যায়, জীবন যায়।’
গান্ধারী ঢুকতে ঢুকতে বললে, ‘গরমাগরম পাকোড়া আসে।’
‘তোর মন খারাপ হয়?’ বিমল জিগ্যেস করল।
‘দিদি রাগ করলে হয়।’
‘তখন কী করিস?’
‘দিদির কাছে ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে কাঁদি।’
‘দিদি রাগ করে কেন?’
‘ওমা, এ কি! রাগ না করলে ভালোবাসা আসবে কী করে! গরম ঘিয়ে লুচি ছাড়লে তবেই না ফুলকো হবে! ঠান্ডা ঘিয়ে হয়? নাও তো! অনেক জ্ঞান হয়েছে!’
গান্ধারী গটগট করে চলে গেল। মেজর বললেন, ‘এরাই আনন্দে আছে। হায় ভগবান, না হয় কোনও আর্দশ মানুষের কাছে বেঁচে থাকাটা ফেলে দিতে পারলে সব সমস্যার সমাধান। শ্রীরামকৃষ্ণ এক জায়গায় বলছেন, আমি খাই, দাই, আর থাকি আর সব আমার মা জানেন। দেখো, অনেক লড়াই-টড়াই করে জীবনের তলানিতে এসে সার বুঝেছি, পৃথিবীটা ভগবানের। কে তিনি বোঝার চেষ্টা করে কোনও হদিস পাওয়া যাবে না। বুঝলেও তিনি আছেন, না বুঝলেও তিনি আছেন।’
চার
ভদ্রলোক বাড়ির নেমপ্লেট দেখলেন। হাঁ করে দেখলেন বৃহৎ গেটটা। বয়স্ক মানুষ। সাজপোশাক টিপ টপ। নিজের মনেই বললেন, ইয়েস দিস হাউস। বৈঠকখানা ঘরে প্রায় সবাই রয়েছে। দুর্গাপুজো এসে গেছে। প্রত্যেকবারই পাড়ার পুজো প্যান্ডেলে মিত্তিররা একটা নাটক নামায়। পরিবারের সবাই অভিনয় করে। এমন কি গান্ধারীও। বাইরের অভিনেতা মাত্র একজন। সে হল ফটোগ্রাফার কুন্তল। নাটক খুব জমে।
সেই নাটকের রিহার্সাল চলেছে। ভদ্রলোক ঢুকলেন। বিমল বললে, ‘বসে পড়ুন বসে পড়ুন।’
তখন ভীষণ কাণ্ড চলেছে। নাটকের ‘টাইটল-সং’ এর চড়ানো হচ্ছে। মিউজিক ডিরেকটার কমল। হারমোনিয়ামে বসে আছে। গানের বাণী সবাই মিলে লিখছে। প্রত্যেকে এক একটা লাইন দেবে।
বিমল বললে, ‘নে, লেখ, অনেক ভাগ্য করে মাগো জন্মেছি এই দেশে।’
নির্মল বললে, ‘কত মানুষ ঘুরে বেড়ায় কতরকম বেশে।’
কমল বললে, ‘সেই দেশেতে সবাই মিলে আবার তুমি এলে।’
কুসি বললে, ‘আমরা পরাই মালা, সাজাই ডালা ওরে দেনা প্রদীপ জ্বেলে।’
নবাগত বললেন, ‘ওয়ান্ডারফুল। তুমি ভৈরবী চড়িয়ে দাও।’
‘আমাদের অভিনয় যে রাত্তিরে!’
‘তাহলে কেদারায় বসিয়ে দাও।’
‘ফ্যানটাস্টিক! আপনি গান জানেন?’
‘কী মনে হয়?’
‘মনে হয় তাই হয়।’
বিমল জিগ্যেস করলে, ‘আপনি কে?’
ভদ্রলোক একটা সুদৃশ্য কার্ড এগিয়ে দিলেন।
বিনোদবিহারী বোস
বি. বি. এন্টারপ্রাইজ
ওয়ার্লডস নাম্বার ওয়ান কিউরিও ডিলার।।
অ্যাপয়েন্টেড বাই দি কুইন অফ ইংল্যান্ড
হেড অফিস, সেন্ট জেমস প্যালেস কোর্ট
ক্যালকাটা অফিস, ওয়ান রিজেন্ট গ্রোভ।
কার্ডটা হাতে হাতে ঘুরে অবশেষে মেজরের হাতে।
বিমল বললে, ‘আপনি তো বিরাট ব্যক্তি।’
‘নট অ্যাট অল। ভবঘুরে লোক। পুরাতত্ত্ব, ইতিহাস আমার বিষয়। পৃথিবী চষে বেড়াই। বিলেতে আমার নাম আছে। কিছু কেনার আগে মিউজিয়ামগুলো আমাকে ডেকে পাঠায়।’
‘হঠাৎ আমাদের সন্ধান পেলেন কী করে?’
‘আমাদের ঠাকুরদা ওদেশে সলিসিটার ছিলেন। তাঁর ওল্ড রেকর্ডস ঘাঁটতে ঘাঁটতে এক ডিডস পেলুম।
পড়ে দেখলুম, ওয়ান টি.সি. মিটার এসেক্সে তিন একর জমির ওপর একটা বাংলো কিনছেন। গেলুম সেখানে। একটা পরিত্যক্ত ভূতুড়ে বাড়ি। খোঁজখবর করে কেয়ারটেকারকে বের করলুম। তারা তিন পুরুষ ধরে বাড়িটা আগলাচ্ছে। সো অনেস্ট অ্যান্ড ডিউটি বাউন্ড। আমার কাছে দলিলের কপি দেখে, চাবি খুলে ভিতরে নিয়ে গেল। প্রচুর জিনিসপত্র অযত্নে পড়ে আছে। এটা-ওটা ঘাঁটতে ঘাঁটতে বহু মূল্যবান একটা জিনিস পেয়ে গেলুম। প্রায় চুরি করে নিয়ে এলুম ইন্ডিয়ায়। এক বছর ধরে গবেষণা করে যে-তথ্য পেলুম তাতে চমকে উঠতে হয়।
কারো মুখে টুঁ-শব্দ নেই। রিহার্সাল মাথায় উঠল। গান্ধারীর মুখ দেখলে মনে হবে, সে এ জগতে নেই। ভদ্রলোক বুকের কাছে হাত ঢুকিয়ে ছোট একটা ভেলভেটের কৌটো বের করলেন। সামনের সেন্টার টেবিলের উপর কৌটোটা রেখে যেই ঢাকনাটা খুলবেন, একটা জ্যোতি ঠিকরে বেরলো। সকলে সমস্বরে বলে উঠল, ‘এটা কী?’
ভদ্রলোক হাসতে হাসতে বললেন, ‘হীরে। এ রেয়ার পিস অফ ডায়মন্ড। এর নাম ‘রূপমতী’। নূরজাহানের আর্মেলেটে ছিল। ঘুরতে ঘুরতে ওদেশে চলে গিয়েছিল। আমার মনে হয়, টি.সি মিটার এটা কোনওভাবে সংগ্রহ করেছিলেন। হি ওয়াজ এ বিগম্যান। প্রিন্স দ্বারকানাথের সঙ্গে তাঁর কারবার ছিল। টি.সি. মিটারের উত্তর পুরুষ আপনারা। হীরেটা আপনাদের দিতে এসেছি। এর অনেক দাম, প্রায় এক কোটি টাকা।’
ঘর এমন নিস্তব্ধ, একটা পিন পড়লে শোনা যাবে।
বিমল বললে, ‘আপনি তো নিয়ে নিতে পারতেন! আমরা এ-সবের তো কিছুই জানি না।’
‘আমি তো চোর নই ভাই। অন্যের সম্পত্তি আত্মসাৎ করার কোনও ইচ্ছেই আমার নেই। আর একটা কথা, ওই প্রপার্টিটারও এখন অনেক দাম। ওটা সম্পর্কেও ভাবতে হবে তো! আমার সঙ্গে আপনাদের একজন চলুন। ওটার পজেসান নিয়ে নিন। আরও বহু মূল্যবান জিনিস বেরোবে।’
গান্ধারী ভাবে বিভোর হয়েছিল। হঠাৎ বলে উঠল, ‘আমার মনে হয় আপনি ভগবান। আমি কফি করে আনি।’
‘তুমি কি ভগবানকে দেখেছ?’
‘মানুষই ভগবান। এই যেমন আপনি!’
গান্ধারী বেরিয়ে গেল। সবাই হাঁ। কী কথাই বলে গেল মেয়েটা।
ডাক্তারের চেম্বার যে ছেলেটি খোলে, পাহারা দেয়, তার নাম মদন। মদন ঘরে এল।
মদন : একজন বলছে ডাক্তারবাবুর চামড়া ছাড়াবে।
বিমল : কার? আমার?
মদন : একবার চেম্বারে যাও না। তিরিশজন। কেউ কাশছে, কেউ হাঁচছে। একজন ফিলাট। একজন বললে, তোমার ডাক্তারের ঘুম ভেঙেছে?
বিমল : আমি ডাক্তারি ছেড়ে দোবো। আগে লোকে দেবতার মতো সম্মান করত। এখন? এখন হাঙর ভেবে মারতে আসে। নিতুদাকে বলো, টেবিলে যন্ত্রপাতি সব সাজাতে।
মদন : সে তুমি আর বলবে কি! আমরা সেই ভাবেই তো ম্যানেজ দিলুম এতক্ষণ। প্রথমে বুক ব্যথার যন্ত্রটা টেবিলে শুইয়ে দিলুম। বুক দেখার আলোটা জ্বালিয়ে দিলুম। হাওয়া। কিছুক্ষণ পরে জলের গামলায় তোমার আঙুল ডোবাবার জল। দু ফোঁটা ওষুধ। কিছুক্ষণ পরে পাটকরা তোয়ালে। তোমার বসার চেয়ারে ফটফটি। টেবিলে ডাস্টার ঘুরিয়েই হাওয়া। কিছুক্ষণ পর পেরেসার দেখার যন্ত্রটা। হাওয়া। কিছুক্ষণ পরে প্যাড, পেন। আর প্রত্যেকবারই মিষ্টি করে হেসে আসছেন, এই আসছেন। কাশির রুগিদের লবঙ্গ ধরিয়ে দিয়েছি।
বিমল বললে, ‘নাঃ, আমাকে এইবার উঠতেই হল। দিন-কাল সুবিধের নয়। ডাক্তাররা এখন টার্গেট। আর দিন কতক পরে দেখা যাবে রুগির চেয়ে ডাক্তার মরছে বেশি। মিঃ বোস আজকের দুপুরের খাওয়াটা আমরা একসঙ্গে খাই না!’
মিস্টার বোস বললেন, ‘অনেক কথা তো হলই না। আমি বরং একটা দিন আপনাদের সঙ্গে কাটিয়ে দিই।’
‘ওঃ হো! গ্র্যান্ড আইডিয়া। একটা দিন কেন, আপনি ফর-এভার এখানে থাকুন। আর কত ঘুরে ঘুরে বেড়াবেন?’
‘মদের নেশার মতো ঘুরে বেড়ানোটাও একটা নেশা। কথা দিচ্ছি, মাঝে মাঝে আসব।’
‘আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দি, আমাদের মেজর সাহেব। অনেক বড় বড় যুদ্ধ করেছেন। কাশ্মীরে, বাংলাদেশে, ইন্দো-পাক, ইন্দো-চায়না।’
দু-জনে হাসতে হাসতে করমর্দন করলেন। বিমল চলে গেল চেম্বারে।
মিঃ বোস বললেন, ‘এই মহামূল্য জিনিসটা তুলে রাখতে হবে।’
কুসি বললে, ‘আপনার কাছেই থাক।’
‘সে কি, তোমাদের জিনিস আমার কাছে থাকবে কেন? তুমি কে?’
মেজর বললেন, ‘ওই তো এই পরিবারের অল-ইন-অল। মিত্তিরদের বোন। আমরা ডাকি কুসি।’
‘বাঃ, বিউটিফুল নাম। আমিও কুসি বলব। কুসি তোমাদের চেস্টে তুলে রাখো। এক কোটি টাকা দাম। লন্ডনের অকশন হাউস সুথবিতে তুললে হয়তো আরও বেশি দাম পাবে। এর পিছনে যে একটা ইতিহাস আছে।’
মেজর কুসিকে বললেন, ‘মিঃ বোস সাহেব মানুষ, ওঁকে আমার দিকে নিয়ে যাই। ভালো লাগবে।’ দুজনে বেরিয়ে যাওয়ার পর, কমল বললে, ‘আমরা তো বিশ্রী রকমের বড়লোক হতে চলেছি। এ রকম হয়!’
কেন হবে না! কৌন বনেগা ক্রোড়পতি।’
কমল হারমোনিয়ামে সুর তুলতে লাগল। নির্মল গুম মেরে গেছে। বড়লোক হওয়ার সম্ভাবনায় ঘাবড়ে গেছে। কমল কেদারায় ফিট করে গাইছে—
অনেক ভাগ্য করে মাগো জন্মেছি এই দেশে,
কত মানুষ ঘুরে বেড়ায় কত রকম বেশে,
সেই দেশেতে সবাই মিলে আবার তুমি এলে,
(আমরা) পরাই মালা, সাজাই ডালা (ওরে) দেনা প্রদীপ জ্বেলে।
বোধ হয় পূর্ণিমা। চাঁদের আলোর ফিনিক ফুটছে। শরতের চাঁদ। তার আলাদা শোভা। কাচের ঘরে সবাই সমবেত। কুসি বললে, ‘সিন্দুকে হীরেটা ফেলে রেখে লাভ কি? আপনি বিক্রি করে দিন। আর এসেক্স-এর ওই প্রপার্টিটা বরং উদ্ধার করুন। মাঝে মাঝে আমরা সবাই ওখানে গিয়ে থাকব।’
মেজর বললেন, ‘বিলেতে অত বড় একটা সম্পত্তি রাখার অনেক খরচ।’
‘তাহলে ওটাকেও বিক্রি করে দিন।’
‘করা শক্ত। মিস্টার মিটার মারা গেছেন। কোনও উইল করে যাননি। ওই সম্পত্তির কোনও উত্তরাধিকারী নেই। ওটা শেষে স্টেট-প্রপার্টিই হয়ে যাবে।’
নির্মল বললে, ‘চেষ্টা করে দেখুন না।’
‘সে আমি চেষ্টা করব। একটা এফিডেবিট করে আমাকে দিন যে আপনারা তাঁর উত্তর পুরুষ।’
কমল বললে, ‘বিষয়ের কথা অনেক হল। বড়লোকও হয়ে গেছি। কয়েক কোটি টাকার মালিক। মিস্টার বোস এইবার আমরা গানে বসি, এমন চাঁদের আলোর রাত। বৃষ্টি ধোয়া, মেঘ ভাসা শরতের আকাশ।’
মেজর বললেন, ‘একটা সম্পর্কে এলে কেমন হয়! ‘মিস্টার বোস’ শুনতে আর ভালো লাগছে না।’
বিমল বললে, ‘আপনি আমাদের নতুনদা।’
‘না, আমি শরৎচন্দ্রের নতুনদা হতে চাই না।’
মেজর বললেন, ‘তাহলে আপনি আমাদের সকলের দাদা।’
‘আঃ সে ভালো। দাদা।’
‘তাহলে দাদা একটা গান।’
‘কমল! তুমি আগে একটু সুর লাগাও।’
দেখতে দেখতে তৈরি হল সুরের রাত। দাদা সকলকে অবাক করে দিয়ে গাইলেন, রবীন্দ্রনাথের গান,
আনন্দরই সাগর হতে এসেছে আজ বান।
দাঁড় ধ’রে আজ বোস রে সবাই টান রে সবাই টান।।
বোঝা যত বোঝাই করি করব রে পার দুখের তরী,
ঢেউয়ের পরে ধরব পাড়ি—যায় যদি যাক প্রাণ।।
‘আপনি তো ভীষণ ভালো গান করেন!’
‘একসময় আমাদের বাড়িতে খুব গানের চর্চা হতো। তারপর উত্তপ্ত সুখ ঢুকে শান্তি-সুখকে তাড়িয়ে দিলে। উত্তপ্ত সুখ হল, অর্থ, বিত্ত, প্রতিপত্তি, শান্ত-সুখ হল সঙ্গীত, ঈশ্বর-চিন্তা। মানুষ জ্বরে-পুড়ে বড় সুখ পায়। এই ধারণা। এসেক্সে আমার বাড়িতে একটি শিব মন্দির করেছি। প্রতিষ্ঠা করেছি ছ-ফুট উঁচু শ্বেত পাথরের শিবলিঙ্গ। বুক দিয়ে জড়িয়ে ধরি—আঃ, কি শীতল কি শান্তি, কি সুগন্ধ, কি নিস্তব্ধ সঙ্গীত।
দাদা! গান ধরে ফেললেন।
শংকর শিব ভোলানাথ মহেশ্বর!
মহাদেব দেব গঙ্গাধর হর।।
পিনাকধারী পরম ভিখারী
শ্মশানচারী শম্ভু শুভংকর।।
এক একবার এমন সুর লাগছে কাচের শার্সিও সুরের ঝংকার দিয়ে উঠেছে। বাইরে চাঁদের আলোর প্লাবন। ভিতরে সবাই পাথর। কমল, কুসি নিয়মিত সঙ্গীত চর্চা করে। ইমন রাগের অপূর্ব বিস্তার দেখে তাদের চোখে জল এসে গেছে। ঘরের চারটে দেয়ালই প্লেট গ্লাস দিয়ে তৈরি। ঝকঝকে কাচ। বাইরেটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। বকুলের বেদি। দেবদারু, পাইন, পাম, পথ চলে গেছে ঘুরে, ঘুরে। মেজর হঠাৎ ফিস ফিস করে বললেন, ‘ওকি?’
সবাই দেখল, পরনে বাঘ ছাল, হাতে ত্রিশূল, দুধের মতো রং, বিরাটকায় এক পুরুষ বাইরে পায়চারি করছেন। মাথায় পিঙ্গল জটাজাল। গান্ধারী অবাক হয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। তখন সকলে গাইছে—শংকর শিব ভোলানাথ মহেশ্বর।
মেজর বলছেন, ‘থামবেন না, তাহলে ওই রূপ অদৃশ্য হবে।’
দাদা ইমন থেকে মালকোশে চলে গেছেন। মাঝরাতের রাগ,
যোগীশ্বর ঈশ্বর বিভূতিভূষণ,
নমো নমো আশুতোষ মানস-মোহন
সকলেরই মনে হচ্ছে কিছু একটা হবে। এমন গান তো কখনও কেউ শোনে নি। সুর যেন থই থই করছে। চাঁদ অনেকটা পশ্চিমে নেমে এসেছে। পশ্চিমের কাচে সোজা এসে পড়ছে রুপালি বিচ্ছুরণ।
পরিরা হয়তো এখুনি নেমে আসবে ছোট ওই সুইমিং পুলে। কাল ভোরে যেখানে অনেক পদ্ম ফুটবে। শিশিরের কাল যে এসে গেছে। হঠাৎ বাইরেটা সাদা কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল। সেখানে বাতাসের ঘুরপাক। সাপের মতো। সে কি নৃত্য। মনে হচ্ছে মহাদেবের মুক্ত জটাজালে সাপ ঘুরছে কিলবিল করে।
হঠাৎ গান থেমে গেল। মিস্টার বোসের মুখের অদ্ভুত হাসি থমকে আছে। সারা ঘর ভরে গেছে পদ্মের গন্ধে। শেষ চাঁদের আলোয় ঘরের ভিতরটা যেন বরফের টুকরো। মিস্টার বোস পাথর হয়ে গেছেন। তিনি চলে গেছেন। বাইরের রহস্যময় কুয়াশা অদৃশ্য। দিনের ঘুম ভাঙছে। মিস্টার বোসের দেহে প্রাণ নেই। তাঁর কোলের উপর সেই হীরেটা জ্বল-জ্বল করছে। হীরের মতো মানুষটি হীরেটি রেখে চলে গেলেন। অদ্ভুত।
মিত্তির বাড়ি কয়েক দিন থম মেরে রইল। সরকার এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অনুমতি নিয়ে মিস্টার বোসকে বাগানেই সমাহিত করা হল। কলকাতার ঠিকানায় গিয়ে দেখা গেল সুদৃশ্য একটি ফ্ল্যাট। দোতলায়। বাইরে নেম-প্লেট। কিন্তু দরজা তালা বন্ধ। কেউ কোথাও নেই।
কেয়ারটেকারস অফিসে গিয়ে জানা গেল, বেশিরভাগ সময় বিলেতেই থাকেন। মাঝে-মধ্যে আসেন। একেবারে একা। লন্ডনে জানানো হল। ডেথ সার্টিফিকেটের কপি পাঠান হল। মিত্তিরবাড়ির ঠিকানা দেওয়া হল।
দিন-দশেক পরে এক বিদেশিনি এলেন। বেশি বয়েস নয়। খুব কাঁদলেন। সমাধির উপর পদ্মফুল সাজিয়ে দিলেন। জানা গেল মিস্টার বোস একজন নামকরা আর্কেওলজিস্ট। সাধক। অকাল্টিস্ট। মেয়েটি তাঁর পালিতা কন্যা। আর্কেওলজির ছাত্রী। মেয়েটির নাম ক্লারা। সে মিত্তির বাড়ির প্রেমে পড়ে গেল। কুসিকে তার ভীষণ পছন্দ। বড় মিত্তিরকেও। কুসি হল দিদি। বিমল হল দাদা। কিন্তু সে এসেছে মাত্র একমাসের ভিসা নিয়ে। যাবার সময় বলে গেল আপনাদের বিলেতের সম্পত্তি আমি উদ্ধার করে দোবো, আর আমাদের বাড়িটা তো আছেই। কুসিকে বললে, ‘দিদি, আমার কেউ নেই, তোমাকে আমার নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।’ কুসিকে বহুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রইল। কুসি সাতদিন পরার জন্যে সাতখানি শাড়ি দিয়েছে। গলার হার দিয়েছে সোনার।
মেজরও চলে গেলেন ক্লারার সঙ্গে। বিলেতে তাঁর মেয়ে থাকে। আর কদিন পরেই পুজো। বাইরের ঘরে রিহার্সাল চলছে পুরোদমে। কমল হঠাৎ বললে, ‘অসম্ভব। এবারে আমাদের নাটক বন্ধ করে দাও। আমার কান্না আসছে। মিস্টার বোসের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। রিহার্সালের প্রথম দিনেই তিনি এসেছিলেন।’
বড় মিত্তির বললে, ‘আমারও সেই এক অবস্থা। তিনি মনে ঢুকে গেছেন।’
একে একে সবাই একই কথা বললে।
কুসি বললে, ‘আমাদের একদম পালটে দিয়ে গেছেন। আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন। মিত্তিরবাড়ি এখন মহাতীর্থ। শিবক্ষেত্র।’
কমলা মালকোশে সেই অলৌকিক রাতের গানটাই ধরল, ‘শঙ্কর শিব ভোলা নাচে নাচে রে।’
পাঁচ
মিত্তিরবাড়িতে হঠাৎ যেন একটা পরিবর্তন এসে গেল। অকারণ হইচই, অকারণ গাল-গল্প কমে গেল। সবাই সিরিয়াস। মেজো মিত্তির চিরকালই একটু অন্যরকম। অধ্যাপক মানুষ। প্রচুর লেখা-পড়া করতে হয়। বড় মিত্তিরই ছিল সবচেয়ে আমুদে। তার পরিবর্তনটাই চোখে পড়ার মতো। আজকাল অনেক রাত পর্যন্ত তার ঘরে আলো জ্বলে। কুসি একদিন দেখল, বড়দা শেষ রাতে ধীর পায়ে কাচের ঘরের দিক থেকে আসছে। গভীর ভাবে মগ্ন। কুসি তাড়াতাড়ি নিজেকে লুকিয়ে ফেলেছিল। বাগানের ওই দিকটায় দিনের বেলাতেই গা ছমছম করে।
কুসি সেদিন ডাক্তারের আর একটি লেখা আবিষ্কার করল। একটা বড় প্যাডে লিখেছে। লেখাটা কাচের ঘরে নিয়ে পড়ে ফেলল।
‘মেঘ নিয়ে, জল নিয়ে, পাতা নিয়ে, রোদ নিয়ে, পাখি নিয়ে, পাখির ডাক নিয়ে, সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত নিয়ে মধ্যযুগীয় আদিখ্যেতার কাল শেষ হয়ে গেছে। আকাশ আকাশে আছে। সেখানে দিবসের দোর্দণ্ডপ্রতাপ মাতণ্ডদেব প্রখর দীপ্তিতে সব গ্রাস করে থাকেন। তাঁর ব্রেকফাস্ট হল হাফ বয়েলড চন্দ্র। লাঞ্চ হল গ্রহ নক্ষত্র। ডিনার হল অন্ধকার। রাতের আকাশ বাগানে তারাদের ফুল ফোটে, ফসল ফলে, ধুমকেতু ঝাড়ু দিয়ে সাফ হবে, ছায়াপথ যেন সেচের খাল, কোনও এক দুষ্টু ছেলে মাঝে মাঝে উল্কার পাথর ছুড়ে তারা পাড়তে যায়। শুকতারা ডাগর চোখে ভোরের আকাশে জেগে থাকে সূর্যসম্রাটের নিদ্রাভঙ্গের অপেক্ষায়। ধীরে ধীরে নদীরা সব জেগে ওঠে। হিমকূট সেজে ওঠে সোনার মুকুটে। সম্রাটের আসনের চারপাশে প্রজাপতি-বালিকারা নাচ দেখাতে আসে। পেঁচা কোটরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, রাবিশ। বাদুড় ঝুলে পড়ে নতমুখী সাধনায়। কিরণ প্লাবিত আকাশ দেখব না। হেঁটমুণ্ডে আঁধারে প্রতীক্ষা।
আকাশ আকাশে আছে, ভূমিতে আছে প্রজা। কোটি জঠরের ক্ষুধা নিবারণের ধরিত্রী উচ্চ উর্বরা। নদী সেখানে কবিতা নয়, সেচের বাহু, তৃষ্ণার জল, অকৃপণ আকাশে বর্ষণে বন্যার বিভীষিকা। বৃক্ষ সেখানে ছায়া নয়, জনপদের শত্রু। ইন্ধন অথবা ইমারতের আসবাব। পাখির জন্যে প্রস্তুত শত খাঁচা, ব্যাধের গুলি। মুরগি মানেই রোস্ট। দুমবা মানেই রেজালা।
ছাগলকে বললুম, কি সুন্দর সবুজপাতা।
ছাগল আধবোজা চোখে হুঁ হুঁ শব্দ করে বললে, ভেরি টেস্টফুল! মশ মশ করে চিবোতে লাগল।
নিমেষে পত্রশূন্য কাণ্ড।
বাঘকে বললুম, কী সুন্দর হরিণ!
বাঘ উদগ্রীব হয়ে জিগ্যেস করলে, কোথায় কোথায়! একটু দাঁত বসিয়ে টেস্ট করে আসি। সে কী যুবতি। একটু আগে বৃদ্ধ একটি বলদ সেবা করে তেমন স্বাদ পেলুম না।
ইঁদুরকে বললুম, দেখেছ জ্ঞানেশ্বরী গীতা! অপূর্ব স্বাদ!
ইঁদুর বললে, কী ভাবে খেলে! আমি কাল রাতে একবার চেষ্টা করেছিলুম। মলাট দুটো বড় শক্ত। দেখি দাঁতে শান দিয়ে আসি।
যা দেবী সর্বভূতেষ্ণু ক্ষুধারূপেণ সংস্থিতা।
যা দেবী সর্বভূতেষ্ণু তৃষ্ণারূপেণ সংস্থিতা।
আমাদের ঋষিরা উপলব্ধি করেছিলেন, সৎ, অসৎ, দয়া, হিংসা, রৌদ্রছায়ার এই পৃথিবী। শ্রীরামকৃষ্ণের উপমা অতি সুন্দর। তিনি বলছেন, ‘তাঁকে যারা পেয়েছে, তারা জানে যে তিনিই সব হয়েছেন। তখন বোধহয়—ঈশ্বর-মায়া-জীব-জগৎ। জীবজগৎসুদ্ধ তিনি। যদি একটা বেলের খোলা, শাঁস, বিচি আলাদা করা যায়, আর একজন বলে, বেলটা কত ওজনের ছিল দেখ তো, তুমি কি খোলা বিচি ফেলে শাঁসটা কেবল ওজন করবে? নাঃ ওজন করতে হলে খোলা বিচি সমস্ত ধরতে হবে। ধরলে তবে বলতে পারবে, বেলটা এত ওজনের ছিল। খোলাটা যেন জগৎ, জীবগুলি যেন বিচি। বিচারের সময় জীব আর জগৎকে অনাত্মা বলেছিল, অবস্তু বলেছিল। বিচার করবার সময় শাঁসকেই সার, খোলা আর বিচিকে অসার বলে বোধহয়। বিচার হয়ে গেলে, সমস্ত জড়িয়ে এক বলে বোধ হয়। আর বেশি হয়, যে সত্ত্বাতে শাঁস, সেই সত্ত্বা দিয়েই বেলের খোলা আর বিচি হয়েছে। বেল বুঝতে গেলে সব বুঝিয়ে খাবে।
‘অনুলোম বিলোম। ঘোলেরই মাখন, মাখনেরই ঘোল। যদি ঘোল হয়ে থাকে তো মাখনও হয়েছে। যদি মাখন হয়ে থাকে, তাহলে ঘোলও হয়েছে। আত্মা যদি থাকেন, তো অনাত্মাও আছে।
‘যাঁরই নিত্য তাঁরই লীলা। যাঁরই লীলা তাঁরই নিত্য। যিনি ঈশ্বর বলে গোচর হন, তিনিই জীবজগৎ হয়েছেন—বাপ, মা, ছেলে, প্রতিবেশী, জীবজন্তু, ভালো-মন্দ, শুচি, অশুচি সমস্ত।”
বাজারে ভীষণ গণ্ডগোল। মাছ বিক্রেতার সঙ্গে এক ভদ্রলোকের বিষম কলহ। আমরা শ্রোতা। কাটাপোনা সাতশো ওজন করিয়েছেন। বলেছেন আঁশ ছাড়াও। ফের ওজন করো। ছ’শোগ্রাম। ভদ্রলোক ছ’শোর দাম দেবেন। আমি মাছের দাম দেব, আঁশের দাম দেব কেন? কিছুতেই বুঝছেন না, মাছ আনে, মাছ আর তার আঁশ। সম্পূর্ণ একটি ব্যবস্থা। মাছ নিলে মাছের আঁশ, আঁশটে গন্ধ সবই নিতে হবে।
জগৎকারিণী শক্তির নানাভাবে, নানাদিকে প্রকাশ। চণ্ডীতে দেবতারা সেই শক্তির স্তব করেছেন, অতিসৌম্যতিরৌপ্রায়ৈ নতাস্তস্যৈ নমোনমঃ বিদ্যারূপে তিনি অতি সৌম্যা, অবিদ্যারূপে অতিরৌদ্রা। আগমশাস্ত্রে তিনি বিষ্ণুমায়া। বরাহপুরাণমতে এই বিষ্ণুমায়া মেঘ, বৃষ্টি ও শস্যের উৎপত্তির কারণ। জীবনের চেতনা তিনি। তিনি বুদ্ধি, নিদ্রা, ছায়া, শক্তি, ক্ষান্তি, জাতি, লজ্জা, শান্তি, শ্রদ্ধা, কান্তি, লক্ষ্মী, বৃত্তি, স্মৃতি, দয়া, তুষ্টি, মাতা। তিনি প্রান্তি। তিনি সবকিছু।
বর্তমানকালে অবিদ্যা মায়ার খেলা চলেছে। একটা কুয়াশা নেমেছে। কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। পথ হারিয়েছে। পৃথিবী হেলে গেছে। একটা কথাই বড় হয়েছে ধান্দা। কি চাই জানি না। মারছি গুঁতো, মারছে গুঁতো। এই গুঁতোগুঁতিতে অবশেষে মাথায় না শিং গজিয়ে যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ বললেন, ‘ভোগ থাকলেই যোগ কমে যায়। ভোগ থাকলেই আবার জ্বালা। শ্রীমদভাগবতে আছে—অবধুত চিলকে চব্বিশ গুরুর মধ্যে একজন করেছিল চিলের মুখে মাছ ছিল, তাই হাজার কাকে তাকে ঘিরে ফেললে, যেদিকে চিল মাছ মুখে যায় সেই দিকে কাকগুলো পিছনে পিছনে কা কা করতে করতে যায়। যখন চিলের মুখ থেকে মাছটা আপনি হঠাৎ পড়ে গেল তখন যত কাক মাছের দিকে গেল, চিলের দিকে আর গেল না।’
একালের মানুষকে একটা শিক্ষাই দেওয়া যায়, ভোগ করো। তুমি ভোগ করার জন্যেই এসেছ। তোমার দুটো পা। একটা ভোগ আর একটা দুর্ভোগ। হাঁটি হাঁটি পা-পা করে করবে। খেল খতম, পয়সা হজম। যে শিক্ষা তোমাকে পয়সা উপার্জনের পথ বাতলাতে পারবে না সে শিক্ষা শিক্ষাই নয়। বাড়ি, গাড়ি, লকারে সম্পদ, ক্ষমতার চেয়ার, তারপরে না হয় ছাতে উঠে একবার বললে, আহা! এমন চাঁদের আলো/মরি যদি সেও ভালো। অর্থাৎ তুমি চাঁদের আলোয় অভিভূত হওয়ায় সঙ্গতি অর্জন করেছ বেকার হাঁ করে আকাশ দেখছে কোলে পড়ে আছেন জীবনানন্দ। কবিতার এক লাইনে পুলকিত শিহরণ :
স্বপ্নের ভিতরে বুঝি—ফাল্গুনের জ্যোৎস্নার ভিতরে
দেখিলাম পলাশের বনে খেলা করে।
হরিণেরা; রুপালি চাঁদের হাত শিশিরে পাতায়;
বাতাস ঝাড়িয়ে ডানা—মুক্তা ঝরে যায়।
বাতাস ঝাড়িছে ডানা—না, বউদি ঝাড়িয়ে শাড়ি, কর্কশ কণ্ঠ। হরিণের গাত্রা চিত্রিত; কিন্তু বহুশাখ শৃঙ্গ অতিশয় কঠিন। ‘এই যে, দাদার হোটেলে টেরি বাগিয়ে বসে আছো, একটু গতর নাড়িয়ে যাও না, গ্যাসটা লিখিয়ে এসো। একটা মানুষ কতদিন একা সামলাবে! দয়া, মায়া, লজ্জা, সব গেছে নাকি!’ দুম, দুম।
আকাশের মতো উদাস দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল—বেকার যুবক সাকার দাদার সহধর্মিনীর দিকে। তাঁর হাঁকাহাঁকি, ডাকাডাকিতে গৃহ উত্তাল। তিরিশটা ইন্টাভিউতে ব্যর্থ বীর বোঝে না, ভবিষ্যৎ কোথায় :
ফুটফুটে জ্যোৎস্নারাতে পথ চেনা যায়;
দেখা যায় কয়েকটা তারা
হিম আকাশের গায়—ইঁদুর-পেঁচারা
ঘুরে যায় মাঠে-মাঠে, খুদ খেয়ে ওদের পিপাসা আজও মেটে,
পঁচিশ বছর তবু গেছে কবে কেটে!
ঝাং। বাসন পড়ার শব্দ। কাজের মহিলার সঙ্গে প্রভাতী সংকীর্তন। কাটা ঢেঁড়স, ফালা বেগুন, রং মাখা পটল সুন্দরী, চিৎপাত একটি মাছের মৃতদেহ, খবরের কাগজ-মুখে আড় হয়ে শুয়ে থাকা গৃহের সাকার কর্তা। রুক্ষ চুল, শালোয়ার কামিজ পরা তরতরিয়ে বেড়ে ওঠা বোন, যার আর এক পরিচয় চলমান দুশ্চিন্তা, দেয়ালে ঝুলে থাকা পরিবারের নাটের গুরু পিতার ধূসর চরিত্র। তারই তলায় জ্বলজ্বলে দাদা-বউদির ছবি—মুসুরির পাহাড়ে বিয়ের পর তোলা। সে চেহারা আর এ চেহারায় মিল নেই। ক্ষয়ে যাওয়া নায়িকা এখন তিরিবিরক্ত ধূমাবতী। নায়ক মধ্যভাগ সর্বস্ব একটা পুঁটলি। নবাগত শিশুটি শৈশব হারানো ভীত এক মনুষ্যশাবক মাত্র। তেল যত পুড়ছে খেলা তত জমছে না।
গোটা পৃথিবী কেমন যেন ভ্যাবাচেকা মেরে গেছে। আকাশ ভয়ে আর মুখ খোলে না, মেঘের আঁচল টেনে রাখে। মাঝেমধ্যে আঁচল সরিয়ে রোদ যখন তীর মারে, বড় তীক্ষ্ন, কর্কশ। ধুলো, আর ধোঁয়ার সবুজপাতা মরোমরো। ফুল ফোটে কোনওরকমে সুবাস হারা। মানুষের সংগ্রাম চলেছে অসংখ্যের জীবনধারণের জড়াজড়ির সঙ্গে। সুর ভুলে সব অসুর।
দেবতাদের যুগ শেষ। স্নেহ এখন তৈলে। মানুষের অদৃশ্য নিরাকার মনে জোড়া জোড়া বিষাক্ত হুল। বাক্যের দংশনে বিষাক্ত তরল, বল্লমের খোঁচা। পায়ে পা রেখে তুমুল ঝগড়া। সন্দেহ, ঘৃণা। বাপ বললে, শালা। সূক্ষ্ম নির্যাতন। একদল মৃত-মন নরনারীর উপর দিয়ে অট্টহেসে মহাকাল চলেছে। পিঠে তার শূন্যঝুলি। ‘কী দিলে তোমরা জীবনের উপহার!’ বীর কোথায়, কোথায় প্রেমিক, জ্ঞানী কোথায়, কোথায় তোমাদের শঙ্কর, শ্রীচৈতন্য, বুদ্ধ, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরাম, শ্রীরামকৃষ্ণ, জননী সারদা, স্বামী বিবেকানন্দ, বিদেশিনী নিবেদিতা।
মহাকাল ঘণ্টা বাজায়, আমরা বসে বসে বানাই ছ্যাঁচড়া। ভাবি এইটাই জীবন। নদী নদীতেই আছে, হৃদয়ে যমুনা হয়ে আসে না। যন্ত্রের ধ্বনি, শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি কানে আর আসে না। বিশ্বাসের বিশাল শবদেহের উপর বসে জীবনের বনভোজন। নীল নিদ্রায় খুলে যায় না স্বপ্নের সোনার জগৎ। কেউ কি আর প্রার্থনা করে :
বরিষধরা-মাঝে শান্তির বারি।
শুষ্ক হৃদয়ে লয়ে আছে দাঁড়াইয়ে
ঊর্ধ্বমুখে নরনারী।।
তবে সংস্কার কী সহজে মরবে! সংস্কারে আছেন কমলাকান্ত :
যখন যেরূপে মাগো রাখিবে আমারে সেই সুমঙ্গল যদি না ভুলি তোমারে।
বিভূতিভূষণ কিংবা রতন মণি-কাঞ্চন, তরুতলে বাস কিংবা রাজসিংহাসন
সম্পদে বিপদে অরণ্যে বা জন-পদে মান-অপমানে কিংবা রিপুকারাগারে।।
‘আমি ডাক্তারি করি। কতরকমের পরিবারের একেবারে অন্দরমহলে গিয়ে ঢুকতে হয়। বড়লোকদের জন্যে বড় বড় ডাক্তার নার্সিংহোম। আমি মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের ডাক্তার। আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি, এরা আর থাকবে না। তখন আমিও থাকব না। এরপর ডাক্তার ডাকার, ওষুধ কেনার পয়সা থাকবে না। পথ্য তো দূরের কথা। কুকুর, বেড়ালের মতো মানুষ মরবে। কেউ দেখার নেই। ধাপ্পা দিয়ে আর কতকাল চালানো যাবে। ক্রোধ জমছে। ক্রোধের উত্তাপ আণবিক উত্তাপের চেয়ে প্রবল। ঘূর্ণীঝড়ে, সাইক্লোনে সব যেমন মড় মড় করে ভাঙে, ঠিক সেইরকম একদিন সব দুমড়ে মুচড়ে যাবে। নটরাজের নৃত্য। পিনাকে বাজে টংকার। ফরাসি বিপ্লবের মতো একটা বিপ্লব হলে কেমন হয়। সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়। আবার, আবার। একটা চাকা। শনিকে ঘিরে আছে রহস্যময় বলয়, রিং। কাল রাতে কনফুসিয়াস পড়তে পড়তে এইটা পেলুম,
In a country well governed,
Poverty is something to be ashmed of.
In a country badly governed.
Walth is something to be ashamed of.
এইবার বিশ্বের দিকে তাকাই, সুশাসিত দেশ থেকে দারিদ্র্য লজ্জায় পালিয়েছে আমাদের এই দুঃশাসিত দেশে কলঙ্কের মতো একটি গোষ্ঠী সব সম্পদ ভোগ করছে। অপেক্ষা করা যাক। দেখা যাক কী হয়!
কুসি সবটা পড়ে অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল।
ওই রাতে খাবার ঘরে বড় মিত্তির বললে, ‘পর পর কদিন আমি ত্রিনয়ন দেখছি।’
একে, একে সকলকেই বললে, তারাও দেখছে। কেন দেখছে জানে না।
বড় মিত্তির প্রশ্ন করলে, ‘কোন দেবী তাঁর চোখের জন্যে বিখ্যাত!’
সবাই একবাক্যে বললে, ‘মা দুর্গা।’
‘চোখের দেবী মা দুর্গা। আমরা দুর্গাপুজো করব। আর মায়ের তৃতীয় নয়নে থাকবে ওই হীরেটা। বিসর্জনের সময় খুলে নেওয়া হবে। কি রে কুসি। পারবি তো!’
সবাই বললে, ‘নিশ্চয় পারব। মহাদেব এসেছেন। মা আসবেন না।’
অনেক রাত হল। কুসির ঘুম আসছে না। খোলা জানালায় উদার আকাশ। সমুদ্রের মতো। জাহাজের মতো ভেসে যাচ্ছে এক এক খণ্ডে মেঘ। তারাদের আলো ধরে। চোখ! আরও দুটি চোখ। কোন আকাশে তাকিয়ে আছে? সমুদ্র তুমি এখন কোন তটে অবিরাম ভেঙে ভেঙে পড়ছ?