সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
মামা সমগ্রউপন্যাস
আশার আলো
এক
আমার বড় আশা। আমি বড় হয়ে বিরাট একটা চাকরি করব। লাখ টাকা মাইনে। নিজের জন্যে বেশি খরচ করব না। সকালে এক গেলাস ছাতুর শরবত খেয়ে কাজে চলে যাব। ফেরার পথে পাড়ার দোকান থেকে রুটি-তরকারি কিনে নেব। সবাই বলবে বিয়ে করো, করব না। সুধার সঙ্গে গত বছর ঝুলনের মেলায় নাগরদোলায় ঘুরপাক খেতে খেতে মোটামুটি এইরকম কথা হয়েছিল, যে যাই হই, যেখানেই থাকি, দুজনে দুজনকে ভুলব না। না, না, না।
নাগরদোলার হুসহাসে দুজনেই তখন ভয়ে মরে আছি। একজন আর একজনকে জড়িয়ে ধরে আছি। সুধার চোখ ভর্তি জল। মেয়েরা এমন এমন কাণ্ড করে। মুখে কোনও কথা নেই। মনে এমন কিছু আছে যা জল হয়ে বেরোচ্ছে। মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে তাড়াতড়ি বড় হয় তবে আমি কী করব? ভগবানের ইচ্ছে। ‘সুধার মতো মেয়ে হয় না। ওর মনটা ফুলের মতো। ও একটা প্রজাপতি।’ সব্বাই এই একই কথা বলবেন। ভালো হলেই ভালো। ও সুখী হলে আমি কেন দুঃখ পাব! আমার মনটাও কি কম বড়। আকাশের মতো। আমি কারোকে বলি না। অহঙ্কার খুব বাজে জিনিস।
আচ্ছা, সুধা যেমন আছে, যেখানে আছে থাক। আমার মাসিমার ডান হাত। মাসিমার কাছে পড়ে। সে পড়ুক, প্রত্যেক পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়াটা বাড়াবাড়ি। ও ফার্স্ট হলে আদাজল খেয়ে আমাকেও ফার্স্ট হতে হবে। একটা ছেলের আর কোনও কাজ নেই, দিনরাত খালি পড়বে। আমার পরিকল্পনাটা ছকে ফেলেছি। কয়েকটা দেশ আমাকে দেখতেই হবে। আফ্রিকা আর অ্যামাজন। সিংহর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঠাস ঠাস করে ছবি তুলব। অ্যামাজনের জঙ্গলে অ্যানাকোন্ডা আর ট্যারানটুলা। গাছের আড়ালে লুকিয়ে থেকে ক্যানিবলদের নাচ দেখব। ঘরের কোণে বসে থাকার জন্যে জন্মেছি না কি! সুধাকে বললেই, না, না করবে। ভীতুর ডিম। রাত্তির হল কি, ভূতের ভয়। সব জায়গায় ভূত। একসঙ্গে অনেক কুকুর ডাকলে হয়ে গেল। এই মেয়েকে নিয়ে আমি আফ্রিকা যাব! আমি কি ম্যাড?
আমার দ্বিতীয় পরিকল্পনা, কাঞ্জনজঙ্ঘা। ওই পাহাড়ের মাথায় আমি উঠবই উঠব। এত ভয় কীসের? হড়কে পড়ে গেলে মরে যাব। দেহটা বরফের তলায় চাপা পড়ে থাকবে। এক হাজার বছর, দু-হাজার বছর। আর একটা ইচ্ছে, সাহারা মরুভূমি। বালি আর বালি। মরীচিকা দেখব। মরীচিকার ছবি তুলব। আজ পর্যন্ত কেউ মরীচিকার ছবি তুলতে পারেনি। পরেশকাকু অতবড় ফটোগ্রাফার। জিগ্যেস করেছিলুম। বললেন, ও শুধু চোখই দেখতে পায়, ক্যামেরার লেন্সে সবই বালি। যে কারণে ভূতের ছবি তুলতে পারবে না। ভূত কি আছে? অবশ্যই আছে। পরেশকাকুদের বাড়িতে আছে। পরেশকাকুর মায়ের বেশ বড় একটা ছবি। তিনি সুন্দর একটা শাড়ি পরে সুন্দরী হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। পরেশকাকুদের ভূবনেশ্বরের বাড়িতে তোলা। রাত দুটো থেকে রাত চারটে পর্যন্ত ওই ফ্রেমের ছবিটা থাকে না। ফ্রেম থেকে বেরিয়ে যান। কোথাও বেড়াতে যান। বড়মামা বিশ্বাস করলেও, মেজোমামা বলেন, যত আজগুবি।
মেজোমামার সন্দেহটা মনে হয় ঠিক। আমি একদিন দেখতে আসব বলায়, কাকু কী ভীষণ রেগে গেলেন, ‘এ কি সিনেমা? দেখতে আসবে? আমাদের পারিবারিক ব্যাপার। এগজিবিশন না কি? দল বেঁধে দেখতে আসবে?’
বাবা রে! মেজোমামা শুনে বললেন, ‘রেগে যাওয়ার কারণটা বুঝলি? ডাহা মিথ্যে কথা। পরেশ আমার ক্লাস ফ্রেন্ড, মিথ্যে কথার মাস্টার। ওর কাছে যাওয়ার দরকারটা কী?’