মামা সমগ্রউপন্যাস
এক
আগরওয়াল টাইটেল দেখলেই বুঝে নিতে হবে বড়লোক। বিজয় আগরওয়াল বিপুল বড়লোক। ঘাবড়ে দেওয়ার মতো বড়লোক। বড়লোকদের একটা পরিচিত ইতিহাস থাকতেই হবে। প্রথমে তাঁরা বিশ্রী রকমের গরিব অবস্থায় জীবন শুরু করেন। তারপর নানারকমের কাণ্ডকারখানা করে একদিন কোটিপতি হয়ে যান। কেউ আর তখন তাঁকে ঠেকাতে পারে না।
একটা টিনের চালায় বিজয় আগরওয়াল গোলদারি দোকান দিয়েছিলেন। একপাশে গম ভাঙানোর কল। তখন তাঁর বাবা জীবিত। খটখটে, খড়খড়ে মধ্যবয়সি একজন মানুষ। অসম্ভব পরিশ্রমী। বড় বড় গমের বস্তা নিজেই পিঠে করে দোকানের ভেতর নিয়ে চলেছেন। বাঙালিবাবুরা ভাবতেই পারবেন না। একদিকে কলে গম ভেঙে দিচ্ছে, আবার পরক্ষণেই দোকানের টাটে বসে ডাল ওজন করছেন। পেছন দিকে গোয়াল। বিরাট একটা মোষ। প্রচুর দুধ। পাড়ার চায়ের দোকানে দুধ সাপ্লাই করেন। সেও একটা আয়। বিজয় সেই সময় দেশে। বড় হচ্ছে। যেই একটু শক্তপোক্ত হল, চলে এল বাবাকে সাহায্য করতে। মোষের সংখ্যা বেড়ে গেল। দোকানের পাশে আর একটা দোকান হল। মাটির গণেশ থেকে শ্বেতপাথরের গণেশ।
এইরকম সব হতেই থাকল আর বিজয় বড় হতে লাগল। শুধু বড় নয় বড়লোক। ছোটখাটো ব্যবসা গুটিয়ে ফেলে কলকারখানা শুরু করে দিল। বিজয়ের বাবা বেশ বুড়ো হয়েই মারা গেলেন। দেখে গেলেন ছেলে শিল্পপতি হয়েছে। এই বিজয় আগরওয়ালের ডাক্তার আমার বড়মামা। অনেক রকমের অসুখের মালিক। সুগার, হার্ট, পেট, কোমর, হাঁটু। বাইরে থেকে বোঝায় উপায় নেই। চমৎকার দেখতে। হিরো। ইচ্ছে করলে সিনেমায় নামতে পারতেন।
মানুষের বয়েস তো বাড়বেই। ও কিছু করার নেই। সহপাঠী বন্ধু প্রতাপ আমাকে একদিন আমতলায় বসে বলেছিল,
আমি বড় হয়ে ‘বয়স-বিজ্ঞানী’ হব।’
‘সেটা কী?’
‘জেরিয়েট্রিসিয়ান।’
আমাদের পাশে চুমকি বসেছিল। তার ধান্দা আম। দুম করে উলটে পড়ে গেল। প্রতাপ মাঝে মাঝেই এইরকম শক্ত শক্ত কী সব বলে। সাতদিন আগে বলেছিল অ্যাস্ট্রোনট হবে। তার আগে বলেছিল, অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট হবে। তারও আগে—অরনিথোলজিস্ট। বাঘ যেমন জঙ্গলে থাকে চুমকি সেইরকম আমবাগানে। আর আমবাগানে এলেই প্রতাপ তার ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। প্রতাপ ভবিষ্যতে কী হবে সে সম্পর্কে চুমকির স্পষ্ট ধারণা হল তুই হবি বীর হনুমান। একটাই সুবিধে প্রতাপের শরীরে রাগ নেই। বড় বড় চোখে সকলের দিকে তাকায়। কোনও কিছুই গায়ে মাখে না। সাইকেলে সারা পাড় ঘুরে বেড়ায়। কারুর বিপদে সবার আগে প্রতাপই ছুটে যায়। প্রতাপের আর এক নাম মুশকিল আসান। বাবা প্রতাপের এই গুণের জন্য বিজয়বাবু তাকে খুব ভালোবাসেন। বলেছেন, আমার ছেলেপুলে নেই, তুমিই আমার ছেলে। প্রতাপদের সাবেক আমলের বাড়িটা নড়বড় করছে। একপাশটা বটগাছের কন্ট্রোলে। পেছনে জমিটা ছোটখাটো অরণ্য। সাপ-খোপের আড্ডা। প্রতাপের যখন বোটানিস্ট হওয়ার ইচ্ছে করে তখনই অরণ্যে গিয়ে রিসার্চ করে। একবার গোখরো সাপ ফণা তুলেছিল, প্রতাপ সাপটাকে স্ট্রেট মুখের উপর বলে দিয়েছিল, আমার সঙ্গে ইয়ারকি মারতে এসো না। এই ঘটনার পর প্রতার দিনকতক বলতে লাগল, আমি টক্সিকোলজিস্ট হব। পৃথিবীর বিষ নিয়ে গবেষণা করব। ‘ব্ল্যাকউইডোর’ কলোনি তৈরি করব। ভয়ঙ্কর বিষাক্ত মাকড়সা।
বিজয়বাবু প্রতাপ বলতে পারেন না। বলেন, পরতাপ? পণ্ডিতমশাই বললেন, ‘বিজয়ের উচ্চারণটাই ঠিক, পরের তাপ, অর্থাৎ পরতাপ যে হরণ করে।’ বিজয়বাবু বললেন, ‘পরতাপ তোমাদের বাড়িটা এবার আমি সারাই করিয়ে দেব।’ প্রতাপ বলল, ‘কক্ষনো নয়। আপনি যেমন লড়াই করে বড় হয়েছেন, আমিও সেইরকম হব। আমি ফুটপাথে গামছা আর কাটা কাপড় বিক্রি করব।’
পুজোর সময় নতুন জামা-প্যান্ট হয়। নিজের জন্যে দুটো জামা, দুটো প্যান্ট রেখে বাকি সব বিলিয়ে দেয়। এই নিয়ে বাড়িতে রাগারাগি। প্রতাপ বলে, ‘কী আশ্চর্য! আমাকে তোমরা যখন দিয়েছ, তখন ওসব আমার জিনিস, আমি এখন যাকে খুশি তাকে দিতে পারি।’ প্রতাপের খুব ইচ্ছে মাঝারি উচ্চতার একটা পাহাড় কিনবে উত্তর ভারতে। চূড়ায় একটা শক্তিশালী টেলিস্কোপ বসাবে। সারা রাত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবে। বিলিতি ম্যাগাজিনে পড়েছে, রাতের আকাশে অনেক কিছু ঘুরে বেড়ায়। অনেক কিছু নেমে আসে মাটিতে। সত্যি সত্যি পুষ্পবৃষ্টি হয়। চুমকি সঙ্গে সঙ্গে বললে, ‘তা হয়, তবে কি এক গেলাস সিদ্ধি খেতে হবে তার আগে। বিজয়া দশমীর দিন রাতে কাকিমা খেয়েছিল, তারপর দেখল কি, হাত-পা ছড়িয়ে মহাদেব দুম করে আকাশ থেকে টিনের চালে এসে পড়লেন। তারপর বাবা, বাবা বলে সারা রাত কান্না।’
প্রতাপ তো রাগতে জানে না। হাসতে হাসতে বললে, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোকে এসব বিশ্বাস করতে হবে না। আমিও করি না। আমি বইয়ে পড়েছি। যেদিন দেখব সেদিন বিশ্বাস করব।’ চুমকি বললে, ‘তোমাকে রাগাচ্ছিলুম। জানো তো, আকাশে মুখ দেখা যায়, যিশুর মুখ, শ্রীকৃষ্ণের মুখ। আমি নিজে দেখেছি। বেতলার জঙ্গলে বেড়াতে গিয়েছিলুম। গভীর রাতে আকাশের গায়ে। সেই থেকে লোভ বেড়ে গেছে। রাত্তিরে সময় পেলেই আকাশ দেখি। পাহাড়টা তাড়াতাড়ি কিনে ফ্যালো।’
প্রতাপ কোথা থেকে শুনে এসেছে বিলেতে মানুষের বয়েস বাড়লেও চেহারায় বয়েস বোঝা যাবে না। কায়দা বেরিয়ে গেছে। পাখির ডাক শুনতে শুনতে রোজ ষোলোটা কাঁচালঙ্কা খেতে হবে। বেশিরভাগ কথা গানের সুরে বলতে পারলে ভালো হয়। আয়নায় কখনও মুখ দেখবে না। বিজয়বাবু ছাতু খান আচার আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে। আয়নায় মুখ দেখেন না। টেলিফোনে কথা বলেন গানের সুরে।
তা, সে যে যা করছে করুক। চুমকি কচি কলাপাতায় মুড়ে বাড়ি থেকে তেঁতুলের টক-মিষ্টি-ঝাল আচার এনেছে। প্রতার জিগ্যেস করলে, ‘নিশ্চয়ই চোরাই মাল!’
‘আচার সব সময় চোরাই। আচার তৈরি হয় চুরি করার জন্যেই।’ ভাগাভাগি হল। সমান তিন ভাগ। আচারের সঙ্গে কাবলি ছোলা ভাজা। বললুম, ‘জিনিসটা ধরে রাখ। ছুট্টে একটা জিনিস আনি।’
ভুজাওয়ালার দোকানে ছোলা ভাজছে। একদম গরম। ফাটা ফাটা। এসে দেখলুম প্রতাপ আচার পাহারা দিচ্ছে। চুমকি বাগানের শেষ মাথায় আম খুঁজছে। আমাকে দেখে ছুটতে ছুটতে এলে।
‘আমগুলো তোমাদের চেয়েও অসভ্য। পড়তে শেখেনি।’
‘নিরক্ষর।’
‘কাল থেকে প্রথমভাগ পড়া। অ-এ অজগর আসছে তেড়ে। আ-এ আমটি খাব পেড়ে।
প্রতাপ বললে, ‘ফ্যানটাসটিক। আচারটা কে বানিয়েছে রে?’
সুইস করে শব্দ করে চুমকি বললে, ‘ঠাম্মা!’
‘রোজ দুপুরে পারবি ম্যানেজ করতে?’
‘দেখি।’
হনহন করে হরিদা আসছে। সবসময় ব্যস্ত। ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে। হরিদার পেছন পেছন আসছে বিরাট বাঘা। তেল চুকচুকে পালিশ করা বাদামি রং। বেশ একটু আদুরে আদুরে ভাব। হরিদা রোজ সাবান মাখিয়ে চান করায়। বাঘার আলাদা তোয়ালে, পাউডার, চিরুনি, শ্যাম্পু, থালা, বাটি। আলাদা আয়না। বাঘা মুখ দেখে। বাঘার একটাই ভাষা—ঘেউ। বেশ অহঙ্কারী। অন্য কোনও কুকুরের সঙ্গে মেশে না। জানলার ধারে ছোট খাটে বাঘার বিছানা, বালিশ, মশারি। প্রথম প্রথম বেড়ালের ওপর প্রচণ্ড বিদ্বেষ ছিল। হরিদা একদিন এইরকম উপদেশ দিল—দ্যাখ বাঘা, বেড়াল হল মা ষষ্ঠীর জীব। স্বভাব চরিত্রের ছোটখাটো দোষ থাকতেই পারে। সে তোমারও আছে, আমারও আছে। দেখো, বন্ধুত্ব একটা বড় কথা। সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব। কে ক’দিন বাঁচে! আজ আছে কাল নেই।
হরিদা মিলিটারি মেজাজে বললে, ‘বাঃ বাঃ, লেখা নেই পড়া নেই, কেমন সব বসে আছে? ভগবান! তুমি দেখো। এই যে, চলো সব বড়দা ডাকছে। নীচে নেমে বসে আছে। একটু পরেই কে যেন আসবে! কি খাচ্ছিস রে তোরা?’ চুমকির একটা চোখ আধবোজা, আচারের আমেজ। বললে, ‘খাবে একটু? এই নাও, চেটে চেটে, টকাস টকাস শব্দ করে খাও।’
হরিদা মোহিত, ‘বাঃ বাঃ। মুখটা ছেড়ে গেল। কত দিন পরে তেঁতুলের আচার!’
‘আর একটু চলবে?’
‘চালালেই চলবে।’
বাঘা ভুকভুক করে দুবার শব্দ করল। জিভটা ঝুলছে সামনে।
মাঝে মাঝে ভেতরে গুটিয়ে নিয়ে ঢোঁক গিলছে।
হরিদা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললে, ‘পরেরবার মানুষ হয়ে জন্মাবি, তখন এদের সঙ্গে বসে দুপুরবেলায় এইসব বাজে-বাজে জিনিস খাবি।’
চুমকি বললে, ‘বাঃ ভাই! আমার ভাগের আদ্দেকটা চেটেপুটে খেয়ে বলে কিনা বাজে জিনিস!’