» » » সব ভালো যার শেষ ভালো

বর্ণাকার

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

মামা সমগ্র
উপন্যাস

সব ভালো যার শেষ ভালো

গাড়িটা বেশ আসছিল সাঁই-সাঁই করে। ফুরফুরে বাতাস। পেছনের আসনে বড়মামা, মাসিমা আর আমি। সামনে মেজোমামা। গাড়ি চালাচ্ছেন শরৎকাকা। সাদা রঙের অ্যামবাসাডার। বেশ পালিশটালিশ করা। ভেতরের সিটও খুব সুন্দর। আমরা সকালে দুর্গাপুর থেকে বেরিয়ে শান্তিনিকেতন গিয়েছিলুম। সেখানে সব দেখেটেখে, গেস্টহাউসে পেটঠাসা খেয়ে আমরা পানাগড় হয়ে কলকাতা যাব। কিছুই নয় নিছক ভ্রমণ। কোনও কাজ নেই। ছুটির আনন্দ। গাড়িটা শরৎকাকুর। দুর্গাপুরে শরৎকাকুর ছেলে বড় ইঞ্জিনিয়ার। ছবি মতো একটা বাংলোয় থাকেন। বাগান-ঘেরা। বড়-বড় গোলাপ। আগের দিনটা আমাদের টেরিফিক কেটেছে। গান, গল্প, খাওয়া, বেড়ানো। আরও একদিন থাকলে হত। সে আর হল না। মেজোমামার কলেজ, মাসিমার স্কুল, বড়মামার প্র্যাকটিস। বড়মামাকে দেখতে না পেলে রুগিরা চিন্তায় পড়ে, গেল, গেল শব্দ। কিছু ওষুধপাগল, ডাক্তারপাগল লোক আছে বটে! পৃথিবীতে যেন খাবার আর কিছু নেই, ওষুধ খেয়ে বেঁচে থাকা!

শান্তিনিকেতন থেকে বেরোবার পরই বড়মামার অন্য ভাব। ফার্স্ট যে কথাটা বললেন, সেটা হল, ‘আমারও ইচ্ছে ছিল শান্তিনিকেতনের মতো একটা কিছু করব। জীবনটাকে উৎসর্গ করে দোব দেশের কাজ। একটা দাগ রেখে যাব। স্বামীজির কথা আমার মনে আছে, বিমল একটা দাগ রেখে যা। ডাক্তার হয়ে জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল। লিভার-পিলে টিপে-টিপেই লাইফ ফুরিয়ে গেল। সারাজীবন শুধু কী মাপলুম? না ব্লাডপেশার। আর লোকে আমাকে কি দেখিয়ে গেল? না জিভ। থার্ড ক্লাস, ওয়ার্থলেস।’

মেজোমামা বললেন, ‘স্বামীজিকে তুমি দেখেছ?’

‘না, আমি কী করে দেখব? আমি তখন কোথায়?’

‘এই যে বললে, স্বামীজি তোমাকে বলে গেছেন, বিমল একটা দাগ রেখে যা।’

‘আমাকে বলেছিলেন, আমার স্কুলের হেডমাস্টারমশাই বলাইবাবু। তাঁকে আমি স্বামীজির মতোই শ্রদ্ধা করতুম। তাঁর বলা মানেই স্বামীজির বলা। এতে তোমার এত গাত্রদাহ হচ্ছে কেন?’

‘না, এমনভাবে বললে যেন স্বামীজির পাশে-পাশে ঘুরতে তুমি। একটু মিস রিপ্রেজেন্টশান অব ফ্যাক্টর হল তো। লোকে তোমায় মিথ্যেবাদী ভাবুক এটা আমি চাই না।’

বড়মামা রেগে গেলেন, ‘থাক তোমাকে আর আমার ভাবনা ভাবতে হবে না। ছেলেবেলা থেকেই স্বামীজি আমার পাশে-পাশে আছেন। আমি তাঁর কথা, তাঁর আদেশ সবসময় শুনতে পাই। আমি তাঁকে দেখতে পাই। আমি তাতে মজে আছি।’

‘আর কী কথা তিনি তোমাকে বলেছেন?’

‘জীবে সেবা করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। তাই তো আমি ডাক্তার হয়েছি। শিবজ্ঞানে জীবসেবা করছি।’

‘যাক, এই দুটোই তোমার স্টক। আর কিছু জানো বলে মনে হয় না। ওই শুনে-শুনে যদ্দূর হয়।’

মাসিমা বললেন, ‘মেজদার এই এক বিশ্রী স্বভাব। মানুষকে খোঁচা মারা।’

শরৎকাকু বললেন, ‘চলুক না, বেশ খেলিয়ে হচ্ছে। দেখাই যাক না, কোথাকার জল কোথায় গড়ায়!’

বড়মামা বললেন, ‘ও হল মানুষ কাঠঠোকরা। মানুষকে ঠুকরে আনন্দ পায়। আমি আর কথাই বলব না। আমি এখন গান গাইব।’

মেজোমামা বললেন, ‘মরেছে! তুমি আবার ওই চেষ্টা করবে!’

‘রবীন্দ্রনাথ আমাকে ভীষণ ইনস্পায়ার করেছেন।’

মেজোমামা বললেন, ‘সেরেছে।’

বড়মামা জানালার বাইরে তাকিয়ে নিজের মনেই গাইতে লাগলেন, ‘আজ ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার। পরানসখা বন্ধু হে আমার।’

মেজোমামা বললেন, ‘আমি ডাইরেক্ট কিছু বলতে চাই না, তবে তোমরা সুধীজনেরা একটু প্রতিবাদ জানাতে পারো, সুর যাই হোক, রবীন্দ্রনাথের বাণীকে বিকৃত করা হচ্ছে। ইনলাস্ট, ইনসাল্ট টু দ্যাট গ্রেট পোয়েট।’

বড়মামা গান থামিয়ে সরাসরি মেজোমামাকে প্রশ্ন করলেন, ‘কোনখানটা বিকৃত করা হয়েছে?’

মেজোমামা বললেন, ‘প্রথমেই হোঁচট। আজ নয়, আজি। আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার।’

‘আজ আর ”আজি”তে কী তফাত!’

‘ঠিক বাজ আর বাজিতে যে তফাত।’

‘এটা কোনও উত্তর হল! গানটার ইংরেজি অনুবাদ করলে কী হত! টুডে, ইন দিস স্টর্মি নাইট ইয়োর ভিজিট, মাই ফ্রেন্ড অব ফ্রেন্ডস ও মাই বিলাভেড!’

‘শোনো, আজ আর আজির তফাত বোঝার ক্ষমতা থাকলে, তুমি নিজেই রবীন্দ্রনাথ হতে পারতে। জনে-জনে সূচ ফুটিয়ে জীবন কাটাতে হত না!’

মাসিমা বললেন, ‘মেজদা, আজ তুমি বড়দাকে ভয়ঙ্কর আক্রমণ করছ। কেন বলো তো! কারণটা কী?’

মেজোমামা বললেন, ‘কাল ও আমাকে একটার বেশি দুটো ফিশফ্রাই খেতে দেয়নি। পাঁচজনের সামনে আমার ভুঁড়ি তুলে অপমান করেছে’!

‘সে তো তোমার ভালোর জন্যেই। কী রেটে তুমি মোটা হচ্ছ সেটা খেয়াল করেছ?’

বড়মামা বললেন, ‘ছেড়ে দে কুসি। এ এমন একটা কাল পড়েছে, কারও ভালো করতে গেছ কি মরেছ। ও আরও মোটা হোক, পিপে হয়ে যাক। আমি আর রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইব না। বহুত ফ্যাচাং। অনেক আইনকানুন। পান থেকে চুন খসার উপায় নেই। আমি শ্যামাসঙ্গীত করি।’

মাসিমা বললেন, ‘তোমাকে গান গাইতেই হবে বড়দা? চুপচাপ বোসো না। বাইরের দৃশ্য দ্যাখো না। অশান্তি করে লাভ আছে?’

বড়মামা কী বুঝলেন কে জানে। চুপ করে গেলেন। হু হু করে গাড়ি ছুটছে। বেলা পড়ে আসছে। ঘণ্টা চারেক লাগবে কলকাতা পৌঁছতে। মেজোমামা বিশাল বড় একটা হাই তুলে বললেন, ‘এক কাপ চা হলে মন্দ হত না।’

শরৎকাকু বললেন, ‘হবে, হবে। চা হবে। লোক্যালিটি আসুক। এখন তো চারপাশে জঙ্গল। আগে এই জঙ্গল ছিল আরও ঘন। সব কেটেকুটে ফাঁক করে দিয়েছে। দুর্গাপুর হওয়ার আগে এই জঙ্গল ছিল ভীষণ ভয়ের। ডাকাতের জঙ্গল। এখনও সে ভয় আছে। গাছের গুঁড়ি গড়িয়ে দিয়ে গাড়ি থামিয়ে ডাকাতি করে। এই এলাকাটা বেলাবেলি পেরিয়ে যাওয়াই ভালো।’

হঠাৎ বড়মামা চিল চিৎকারে গান ধরলেন, ‘শ্যামা মা কি আমার কালো।’

সবাই একসঙ্গে হইহই করে উঠলেন, ‘এ কী, এ কী, বলা নেই, কওয়া নেই।’

বড়মামা পরের লাইন আর পড়তে পারলেন না। থেমে গিয়ে বললেন, ‘জায়গাটা তেমন ভালো নয়, তাই একটু মায়ের নাম করার ইচ্ছে হল। এতেও তোমাদের আপত্তি।’

মাসিমা বললেন, ‘তুমি মনে-মনে নাম করো না। তোমার এই বাজখাঁই চিৎকারে মা তো সিংহাসন থেকে উলটে পড়ে যাবেন। হার্টফেল করবেন। আজ ছেড়ে দাও না।’

মাসিমার কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, গাড়িটা একটা গর্তে পড়ে লাফিয়ে উঠল। তারপর কটকট শব্দ করে আরও দশ-বারো হাত গিয়ে ঠনঠন শব্দ করে থেমে পড়ল। শরৎকাকু বললেন, ‘যাঃ, সর্বনাশ হয়ে গেল।’

বড়মামা বললেন, ‘কীরকম সর্বনাশ! টায়ার গেল?’

‘টায়ার গেলে তো ভাবনার কিছু ছিল না। অ্যাকসেল গেছে!’

‘সে আবার কী? জীবনে নাম শুনিনি।’

‘যেটা চাকাটাকে ঘোরায় সেইটাই গেছে।’

মেজোমামা বললেন, ‘এখন কী হবে!’

শরৎকাকু বললেন, ‘রিয়েল প্রবলেম। জায়গাটা ভালো নয়। সঙ্গে মহিলা। কাছাকাছি লোক্যালিটি নেই। মহাসমস্যায় পড়া গেল। একটু নামুন সবাই, গাড়িটাকে ঠেলে সাইড করি আগে।’

আমরা সবাই নেমে গাড়িটাকে ঠেলার চেষ্টা করলুম। ভয়ঙ্কর শব্দ।

বড়মামা বললেন, ‘কী হৃদয়বিদারক শব্দ! এটা মানুষ হলে এখনই মেরামত করে দিতুম। এ অনেকটা লেগ ইনজুরির মতো।’

গাড়িটাকে ঠেলেঠুলে একেবারে পথের ধারে করে দেওয়া হল। দু’পাশে ঝিমঝিম জঙ্গল। লম্বা-লম্বা গাছ। জঙ্গলের পেছনে কী আছে বোঝার উপায় নেই। ঝিন-ঝিন করে ঝিঁঝিঁ ডাকছে। এপাশ-ওপাশ দিয়ে তাগড়া-তাগড়া লরি গাঁ-গাঁ করে চলে যাচ্ছে। আমাদের দেখেও দেখছে না।

বড়মামা হাত-পা খেলিয়ে বললেন, ‘তা বেশ, মন্দ হল না। এও এক অ্যাডভেঞ্চার। এই জঙ্গলে শিকার-টিকার পাওয়া যায়? ওয়াইল্ড অ্যানিম্যাল? এলিফ্যান্ট, রাইনো! সঙ্গে একটা বন্দুক থাকলে ভালো হতো!’

শরৎকাকু বড়মামার কথায় পাত্তা দিয়ে দিয়ে মেজোমামাকে বললেন, ‘আপনারা এখানে থাকুন। আমি একটা গাড়ি ধরে পানাগড়ে ব্যাক করি। সেখান থেকে মিস্ত্রি আর স্পেয়ার্স নিয়ে আসি। সময় লাগবে। ডোন্ট গেট নার্ভাস।’

মেজোমামা বললেন, ‘আমিও যাই আপনার সঙ্গে।’

বড়মামা বললেন, ‘তা তো যাবেই ভাই! তোমাকে যে আমি চিনি। চিনি গো, চিনি গো, চিনি ওগো বিদেশিনী।’

বড়মামা এখনও শান্তিনিকেতনের মেজাজে। রবীন্দ্রনাথেই রয়েছেন। চিনি গো চিনির সুরটা হয়েছে। বড়মামার গলায় সুর আছে, তবে গলাটা একটু ভারী। দইয়ের মতো, মালাইয়ের মতো।

মেজোমামা বললেন, ‘কী চেনো। কতটা চেনো?’

‘বিপদে চম্পট দেওয়াই তোমার চিরকালের স্বভাব। আমাদের ফেলে রেখে তোমাকে তো পালাতেই হবে ভাই। তোমার বীরত্ব আমাদের জানা আছে।’

‘শরৎদাকে তো আমি একা ছাড়তে পারে না। আমার একটা দায়িত্ব আছে।’

‘সে দায়িত্বটা তো আমিও পালন করতে পারি ভাই!’

‘তুমি?’

মেজোমামা যাত্রার দলের নায়কের মতো হেসে উঠলেন বনজঙ্গল কাঁপিয়ে।

শরৎকাকু একটু বিরক্ত হয়েই বললেন, ‘সবসময় ছেলেমানুষি ভালো লাগে না। উই আর ইন ট্রাবল!’

একটা ট্রাক পানাগড়ের দিকে যাচ্ছিল, সেইটা ধরে শরৎকাকু আর মেজোমামা চলে গেলেন। একে বলে পথের বন্ধুত্ব। হাইওয়েতে গাড়ি বিকল হলে এক চালক আর-এক চালককে খুব সাহায্য করেন। এইটাই নাকি পথের অলিখিত নিয়ম। ওঁরা চলে যেতেই বড়মামা হা হা করে হেসে উঠলেন।

মাসিমা জিগ্যেস করলেন, ‘দানবের মতো হেসে ওঠার কারণটা কী?’

বড়মামা বললেন, ‘এটা মানবীয় হাসি। কারণ হল, মোটাটা কীভাবে গাড়িতে উঠল দেখলি! একে ওই মালাই মালপো খাওয়া ভুঁড়ি, তার ওপর ধুতি, পাঞ্জাবি, উঁচু পাদানি, হাঁচোড় পাঁচোড়, যেন শিম্পাঞ্জি। দোল খাচ্ছে গাছের ডাল ধরে।’

মাসিমা বললেন, ‘মেজদাকে তুমি সব সময় অমন কেন করো বলো তো?’

বড়মামা একগাল হেসে বললেন, ‘ওটা আমাদের ছেলেবেলার শত্রুতা কুসি। ও তুই বুঝবি না। ওইটাই আমাদের ভালোবাসা। বাবা বলতেন, ষাঁড়ের লড়াই। এমন একটা দিন ছিল না, যেদিন ওতে-আমাতে মারামারি না হত! সব মারামারিতে অবশ্য আমারই হার হত। একদিন ও আমাকে ঠেলে গোবরের গাদায় ফেলে দিয়েছিল। আর তাই তো আমি গোরু এত ভালোবাসি। গোরু আমার ফ্রেন্ড।’

‘গোরু ফ্রেন্ড না হলে এমন গোরুর মতো বুদ্ধি হয়। একটা ভাঙা গাড়ি নিয়ে বেড়াতে বেরোল! এইবার বোঝো ঠ্যালা। পড়ে থাকো জঙ্গলে!’

‘জঙ্গল-জঙ্গল করিসনি তো। এমন করছিস যেন আফ্রিকার জঙ্গলে পড়ে আছিস! জঙ্গল কাকে বলে জানিস? বাঘ থাকবে, সিংহ থাকবে, হাতি থাকবে, হায়েনা থাকবে, গণ্ডার থাকবে, থাকবে অজগর সাপ। দিনের বেলাতেও মনে হবে রাতের মতো ঘুটঘুটে অন্ধকার। একে জঙ্গল বলে না কুসি, এ একটা বড়সড় বাগান। ঠিক-ঠিক জঙ্গলে তোকে একবার নিয়ে যাব—তানজানিয়া, কিলিমাঞ্জারো। জঙ্গল দেখতে হলে আফ্রিকা। দাঁড়া তোর পাসপোর্টটা আগে করাই।’

সূর্য পশ্চিমে নেমে গেছে। গাছের জটলার ওপাশে আকাশ সোনালি-লাল! চিলতে-চিলতে দেখা যাচ্ছে। সেই আকাশের গায়ে গাছের পাতা ঝুলকালো রঙের ঝালরের মতো ঝুলছে। জায়গাটা বেশ ভালোই লাগছে। শেষ বেলার পাখি টিটির-টিটির করে ডাকছে। হঠাৎ একটা শেয়াল জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের দেখে লজ্জায় আবার জঙ্গলে ঢুকে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে বড়মামার মনে পড়ে গেল তাঁর অ্যালসেশিয়ানের কথা। তিনটে অ্যালসেশিয়ান। তার মধ্যে একটার নাম, নেকটাই। নেকটাই বড়মামার সবচেয়ে আদরের।

বড়মামা বললেন, ‘দেখলি, ঠিক নেকটাইয়ের মতো দেখতে। শেয়ালকে পোষ মানাতে পারলেই অ্যালসেশিয়ান। প্রায় একই রকম। কেবল অ্যালসেশিয়ান সাইজে একটু বড়।’

মাসিমা বললেন, ‘ঠিক বলেছ, বাঘকে পোষ মানাতে পারলেই মামা।’

বড়মামা পায়চারি করছিলেন। ওধার থেকে এধারে এসে বললেন, ‘কথাটা অবশ্য মন্দ বলিসনি। আমার তো মাঝে-মাঝে নিজেকে বাঘই মনে হয়, শৌর্যে, বীর্যে। তোরা সব ভয়ে কুঁকড়ে গেছিস, আর আমাকে দ্যাখ, ঠিক যেন মনে হচ্ছে, বাবু নিজের বাগানে সন্ধেবেলা আদ্দির পাঞ্জাবি গায়ে আতর-টাতর মেখে হাওয়া খাচ্ছে। কোনও ভয় নেই। এর পর অন্ধকার আরও ঘুটঘুটে হবে। জঙ্গলে খট্টাশ বেরোবে। ঝাঁক-ঝাঁক প্যাঁচা আর বাদুড়। বাদুড়দের মধ্যে দু-একটা ভ্যাম্পায়ারও থাকতে পারে। আর ভূত তো আছেই। গাবগাছ যখন আছে ভূত তখন থাকবেই। শ্যাওড়াগাছে পেতনি একেবারে মাস্ট। থাকবেই থাকবে। শাস্ত্রে আছে—কালিকাপুরাণে।’

‘শাস্ত্রটাস্ত্র তোমার খুব পড়া আছে, তাই না বড়দা?’

‘এসব আমার পূর্বজন্মের জ্ঞান। আমি তো জাতিস্মর!’

মাসিমা বললেন, ‘পূর্বজন্মে তুমি কী ছিলে?’

‘আমার একটা সার্কাস ছিল, সেই সার্কাসে আমি ছিলুম রিং-মাস্টার। বাঘ, সিংহর খেলা দেখাতুম।’

‘এইরকম মনে হওয়ার কারণ?’

‘এ আবার কী? কারণ টারনের কথা কেন আসছে! যা ছিলুম, তা ছিলুম। যা ছিলুম, তার আবার কারণ কী! এই যে এ-জন্মে আমি ডাক্তার, এর কোনও কারণ আছে। ডাক্তার তাই ডাক্তার! জাতিস্মর জিনিসটা তুই জানিস না। ওর মধ্যে কোনও কল্পনা নেই। একেবারে খাঁটি সত্য। যারা জাতিস্মর হয়, তারা চোখ বুজলেই পূর্বজন্ম দেখতে পায়, একেবারে ছবির মতো। আগের জন্ম, তার আগের জন্ম, তার আগের জন্ম, তার আগের জন্ম।’

মাসিমা বললেন, ‘হয়েছে, হয়েছে। একেবারে গাছে গিয়ে শেষ। ডাল ধরে ঝুলছ।’

বড়মামা বললেন, ‘না, একেবারে বানর পর্যন্ত যাওয়া যায় না। সে বহুজন্ম আগের ব্যাপার। চেষ্টা করেছি, পারিনি, তবে ছেলেবেলায় বানরের মতো দুষ্টুমি করে দেখেছি, জিনিসটা বেশ আছে। একেবারে ভুলে যাইনি।’

বড়মামা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘কুসি, তোরা দু’জনে কিছুক্ষণ একলা থাকতে পারবি?’

মাসিমা বললেন, ‘তার মানে?’

‘জানিস তো আমার সব সময় বাঁধা। একঘণ্টা আগে আমার চা খাওয়ার সময় চলে গেছে। আর তো দেরি করা যায় না। আমি এইবার চায়ের সন্ধানে বেরোব।’

‘এখানে চা? এই জঙ্গলে?’

‘দ্যাখ কুসি, উদ্যোগী মানুষের কোনও কিছুর অভাব হয় না। সে মরুভূমিতেও আইসক্রিম জোগাড় করতে পারে। আমার ধারণা, জঙ্গলটা ভেদ করে ওপাশে যেতে পারলেই একটা বাজার পাব। সেখানে চায়ের দোকান, কচুরি, জিলিপি, পান, বিড়ি, সিগারেট সব পাওয়া যাবে।’

‘তা তুমি এই অন্ধকারে, এই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাবে?’

‘হ্যাঁ, এ তো আমার কাছে কিছুই নয়। তিন জন্ম আগে আমি ডক্টর ডেভিড লিভিংস্টোনের সঙ্গী ছিলুম রে কুসি। আফ্রিকা অভিযানে গিয়েছিলুম—ডার্কেস্ট আফ্রিকা। আমার কাছে এটা জাস্ট একটা আগাছার জঙ্গল। টকটক করে যাব, আর টকটক করে আসব। আসার সময় তোদের জন্যে ফ্রাক্সে করে চান আনব আর গরম কচুরি!’

‘ফ্লাক্স কোথায় পাবে?’

‘কেন, ফ্লাক্স একটা কিনে নোব।’

‘তার মানে ওখানে তোমার জন্যে সবকিছু রেডি করা আছে!’

‘আমার মন বলছে।’

মাসিমা হাসিমুখে বললেন, ‘বেশ, যাও তা হলে! চা একটু বেশি করে এনো, আর কচুরিও, সারাটা রাত তো ওইতেই চালাতে হবে। তুমি কোন দিকের জঙ্গল ভেদ করবে? ডানদিকের না বাঁ দিকের? আগে ম্যাপটা ঠিক করে নাও!’

‘ম্যাপ! এর আবার ম্যাপ কী! যে-কোনও একদিকে গেলেই হল!’

‘তাই নাকি? তবে জেনেশুনে যাওয়াটাই ভালো! কোথায় যাচ্ছ সেটা জানবে না!’

‘বাঁ দিকে কী?’

‘কালনা, কাটোয়া।’

‘ডান দিকে?’

‘বীরভূম।’

‘তা হলে বাঁ দিকে যাওয়াই ভালো। বীরভূমে কী পাব!’

‘বেশ, তা হলে বাঁ দিকেই যাও। আমরা গাড়িতে গিয়ে বসি।’

বড়মামা বললেন, ‘দরজা লক করে, জানলার কাচ তুলে বসবি। ডাকাত, বদমাশ লোক, যেই আসুক, পাত্তা দিবি না।’

‘তোমার কোনও ভাবনা নেই। তুমি যাও।’

‘আমি যাব আর আসব।’

‘ঠিক আছে, যাও। আমাদেরও ভেতরটা চা-চা করছে।’

‘আমি যাব আর আসব। গরম-গরম কচুরি আর চা।’

‘হ্যাঁ গরম-গরম, আর দেরি না করে যাও।’

‘এই তো আমি যাব আর আসব। জঙ্গলটা আর কত চওড়া হবে, মাইলখানেক! প্লেন রাস্তায় আমি দশ মিনিটে মাইল করি। এটা কুড়ি মিনিট লাগুক।’

‘তুমি তিরিশই নাও না। তার মানে যেতে-আসতে দু’ঘণ্টা।’

‘বেশ, তাই হোক। দু’ঘণ্টাই হোক।’

‘যদি ধর, তিন মাইল হয়।’

‘তা হলে তিন ঘণ্টা।’

‘কতটা হবে না জেনে, তোদের একলা ছেড়ে যাই কী করে!’

‘তা হলে আর গিয়ে কাজ নেই, কেমন?’

‘যাওয়াটা আমার কাছে কিছুই নয়। আমাকে আমার হেডমাস্টারমশাই স্কুল থেকেই শিখিয়ে এসেছেন, জীবনমৃত্যু পায়ের ভৃত্য চিত্ত ভাবনাহীন।’

বনজঙ্গল কাঁপিয়ে বিকট শব্দে একটা মোটরসাইকেল আসছে। হেডলাইটের আলোয় ছোট-ছোট পোকার নৃত্য। বড়মামা তাড়াতাড়ি আরও পাশে সরে গিয়ে বললেন, ‘এই রে, ডাকাত!’

বড়মামা পারলে জঙ্গলেই ঢুকে পড়েন। মাসিমা তেমন ভয় পেয়েছেন বলে মনে হল না। আমি ভয়ে কাঠ হয়ে আছি। মোটরসাইকেলটা তেড়ে আসছে, বিকট শব্দে। মনে-মনে প্ল্যান ভাঁজছি, কী করা যায়! সত্যিই যদি ডাকাত হয়। মোটর সাইকেলটা তীরবেগে বেরিয়ে গেল।

বড়মামা নাচতে-নাচতে বললেন, ‘বাঁচ গিয়া, বাঁচ গিয়া।’

নাচ বন্ধ হয়ে গেল। কথাও আটকে গেল। মোটর সাইকেলটা ঘুরে আসছে।

বড়মামা কোনওরকমে বললেন, ‘রান।’

মাসিমা এক দাবড়ানি দিলেন, ‘চুপ করে দাঁড়াও। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’

মোটরসাইকেলটা আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। সুন্দর চেহারার এক ভদ্রলোক। ইঞ্জিনটা ভুটভুট করছে। ভদ্রলোকের একটা পা রাস্তায়, আর-একটা পা প্যাডেলে। গাড়িটা একটু হেলে আছে। ভদ্রলোক কিছু বলার আগেই বড়মামা বললেন, ‘বিশ্বাস করুন ভাই, আমাদের কাছে কিছুই নেই।’

ভদ্রলোকের কপালে কিছু চুল ঝুলে ছিল, হাত দিয়ে সরাতে-সরাতে বললেন, ‘আমি তো কিছু চাই না।’

বড়মামা বললেন, ‘আপনাদের কি কিছু চাইতে হয়, আপনারা তো কেড়ে নেন।’

ভদ্রলোক হা-হা করে হেসে বললেন, ‘আমাকে কী ভেবেছেন?’

বড়মামা বললেন, ‘ডাকাত!’

‘কী করে বুঝলেন?’

‘এই যে মোটরসাইকেল, তারপর যেতে-যেতে ফিরে এলেন, তারপর শুনেছি এটা ডাকাতের জঙ্গল।’

‘ডাকাত দেখেছেন কখনও!’

‘ছেলেবেলায় বইয়ের মলাটে ছবি দেখেছি।’

‘সেই ছবির সঙ্গে মিলছে!’

বড়মামা আমতা-আমতা করে বললেন, ‘না, ঠিক মিলছে না, তবে আধুনিক ডাকাতদের তো সব অন্যরকম দেখতে হয়েছে। সেকালের ডাকাতদের রণপা ছিল, একালে মোটর, মোটরসাইকেল। জিনস, জ্যাকেট, রিভলভার। এইসব আমি শুনেছি। দেখিনি কোনওদিন।’

ভদ্রলোক সাইকেলের ইঞ্জিন বন্ধ করে বললেন, ‘এখানে আর কিছুক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে আপনাদের সেই অভিজ্ঞতাই হবে। আপনাদের প্রবলেমটা কী?’

‘গাড়ির অ্যাকসেল ভেঙে গেছে।’

‘ব্যস, তা হলে তো হয়েই গেছে। কী ব্যবস্থা নিয়েছেন?’

‘দু’জন ট্রাক ধরে পানাগড়ে গেছেন মিস্ত্রি আনতে।’

‘তার মানে রাত কাবার। ভোরের আগে কিছু হচ্ছে না। মিস্ত্রি এলেও রাতের অন্ধকারে কিছু করতে পারবে না।’

বড়মামা ছেলেমানুষের মতো বললেন, ‘তা হলে আমরা কী করব?’

‘সেইজন্যেই তো ঘুরে এলুম। আপনারা আমার সঙ্গে যাবেন।’

বড়মামা বেশ মিষ্টি গলায় বললেন, ‘ভাই! আপনার সঙ্গে কোনও আইনেডটিটি কার্ড আছে!’

‘না। সাধারণ মানুষের ওসব থাকে না।’

‘আচ্ছা, ব্যাঙ্কের পাশ-বই!’

‘সে তো আমার ডেরায়। আমার সঙ্গে আছে আমার এই বাহনের লাইসেন্স। দেখবেন?’

‘না না, দেখাতে হবে না। থাকলেই হল। ওইটাই তো আইডেনটিটি।’

‘তার মানে গাড়ির পরিচয়েই আমার পরিচয়। মানুষ হিসেবে আমি সন্দেহজনক।’

বড়মামা ফস করে বললেন, ‘তা তো বটেই!’

ভদ্রলোক বললেন, ‘তা হলে থাকুন সারারাত এখানে পড়ে! সঙ্গে আবার মহিলা! এটা কালুর এলাকা। লরি, বাস আটকে লুটপাট করে। ভালোই হবে। নতুন অভিজ্ঞতা।’

মাসিমার মাথা বড়মামার চেয়ে অনেক পাকা। সহজে রাগেন না। মাসিমা বললেন, ‘রাগারাগি করবেন না। আমরা তো খুব ভয় পেয়ে আছি, তাই আপনাকেও আমরা ভয় পাচ্ছি। আপনার পরিচয়টা একটু বলবেন ভাই!’

ভদ্রলোক বললেন, ‘আমার নাম অপরেশ চট্টোপাধ্যায়। এখানে আমার একটা আশ্রম আছে। ধর্মের আশ্রম নয়, কাজের আশ্রম। গ্রামে-গ্রামে গিয়ে আমরা মানুষের সেবা করি। আমার নিজের বাড়ি উত্তরপাড়ায়। আমার বাবা ছিলেন বিশাল বড় ডাক্তার। আমিও ডাক্তার।’

বড়মামা লাফিয়ে উঠলেন, ‘আরে, আমিও তো ডাক্তার।’

ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি তো ভিতু নই, সাবধানী। অচেনা জায়গা, অন্ধকার, সাবধান হওয়াটা কি খারাপ! আপনি হলে কী করতেন?’

বড়মামার কথা শেষ না হতেই, তিনখানা মোটরসাইকেল দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে পানাগড়ের দিকে চলে গেল। অপরেশবাবু বললেন, ‘বেরিয়ে পড়েছে। কালু শেখের দল।’

বড়মামা বললেন, ‘কী হবে এখন?’

‘কিছুই হবে না। আপনারা আমার সঙ্গে যাবেন।’

‘আর গাড়িটা!’

‘আমার দুই তাগড়াই চেলাকে পাঠিয়ে দেব। তারা পাহারা দেবে।’

‘আর, আমরা আপনার সঙ্গে যাব কী করে, হেঁটে-হেঁটে?’

‘না, আমি আমার গাড়িটা আনতে যাচ্ছি। আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। তবে এইভাবে রাস্তার পাশে দাঁড়াবেন না। একটু গা-ঢাকা দিয়ে থাকুন। খারাপ হাওয়া বইতে শুরু করেছে।’

হঠাৎ আমাদের বাঁ দিকের জঙ্গলের বেশ কিছুটা ভেতরে একটা জোরালো আলো বারকতক জ্বলেই নিভে গেল। অনেকটা সার্চ লাইটের আলোর মতো।

বড়মামা বললেন, ‘বিয়েবাড়ির আলো, তাই না? এখন সানাই বাজবে।’

অপরেশবাবু বললেন, ‘ধরেছেন ঠিক। তবে সানাইটা একটু অন্যরকম হবে। কালুর দলবল সিগন্যাল দিয়ে বসকে জানিয়ে দিল, আমরা এসে গেছি। শিকার এলেই অ্যাকশন শুরু হবে।’

বড়মামা বললেন, ‘এইবার কিন্তু আমি বেশ ভয় পেয়ে যাচ্ছি।’

‘একটু আড়ালে থাকুন, আমি যাব, আসব। বেশি দূর নয়।’

ভদ্রলোক মোটরবাইকে স্টার্ট দিয়ে ঝড়ের বেগে পানাগড়ের দিকে ছুটলেন। আমরা দাঁড়িয়ে রইলুম অসহায়ের মতো। ঘোর অন্ধকার। ঢ্যালা-ঢ্যালা জোনাকি জঙ্গলে গাছের ফাঁকে-ফাঁকে ভাসছে। উঠছে, পড়ছে যেন, ‘চোর, চোর’ খেলছে। আমাদের শহরে এমন দেখা যায় না।

বড়মামা বললেন, ‘চল, আমরা গাড়ির আক্তালে লুকিয়ে বসে থাকি। কেউ এলে দেখতে পাবে না।’

মাসিমা বললেন, ‘তোমার যদি এতই ভয়, তুমি গাড়ির তলায় ঢুকে যাও।’

বড়মামা বললেন, ‘বুঝিস না কেন? আমরা শত্রুপুরীতে দাঁড়িয়ে আছি অসহায়ের মতো। জোড়া-জোড়া চোখ আমাদের ওপর নজর রেখেছে। আমার প্রাণের ভয় নেই, আমার হল মান-সম্মানের ভয়। একদল এসে বলবে, সব দিয়ে যাও, আমাদের অমনিই সব দিয়ে দিতে হবে। কী অপমান।’

তাজা-তাজা গাড়ি আমাদের সামনে দিয়ে হইহই করে বেরিয়ে যাচ্ছে, আর আমরা দাঁড়িয়ে আছি বোকার মতো, কিছুই করতে পারছি না।

বড়মামা বললেন, ‘কী করব! তা হলে একটা গান গাই, বিপদে মোরে রক্ষা করো…’

মাসিমা বললেন, ‘আর যাই করো দয়া করে হেঁড়ে গলা ছেড়ো না ভাই। যে যেখানে আছে ছুটে আসবে।’

হঠাৎ মনে হল একতাল অন্ধকার এগিয়ে আসছে! কী রে বাবা। ভূত নাকি। সেটা কাছে এল। কালো আলখাল্লা পরা একজন ফকির। হাতে তার কালো চামর। আরও কাছে আসতে মনে হল তার চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলছে ধকধক করে।

বড়মামা আমার কানে-কানে বললেন, ‘এ আবার কে রে? আসল না নকল?’

আমি ফিসফিস করে বললুম, ‘তার মানে?’

‘মানে? হয়তো ধর শের শাহর আমলে কেউ গাড়ি চাপা পড়েছিল, সে এখনও ভূত হয়ে ঘুরছে। লোক নেই জন নেই, এ হঠাৎ কোথা থেকে চলে এল? হাঁটাটা দেখলি! যেন ভেসে-ভেসে চলে এল!’

ফকির আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে খুকখুক করে তিনবার কাশলেন; তারপর প্রশ্ন করলেন, ‘বাবা সকল, তরমুজের হাট কোন দিকে?’

বড়মামা প্রশ্নটা শুনে ভীষণ পুলকিত হলেন। ফকির যেন তাঁর কত আপনজন! আর প্রশ্নটাও কত মনের মতো। রাত আটটা। চারপাশে জঙ্গল। ভাঙা মোটরগাড়ি। কালো আলখাল্লা, লম্বা চুল, বুক-ভর্তি দাড়ি। জিগ্যেস করছে, তরমুজের হাটের কথা।

বড়মামাও অদ্ভুত পালটা প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি কবিতা লেখেন?’

ফকির চামরের বাতাস মেরে, মহানন্দে বললেন, ‘এ বাবাটা আমার হাঁড়ির খবর জানে রে। তিন-তিনবার মুশায়েরা চ্যাম্পিয়ান আমি। তিনখানা মেডেল আছে আমার। আমার সঙ্গে যাবে। জজসাহেবের হুকুম।’

‘এর জন্যে জজসায়েবের কী প্রয়োজন আছে। এ তো আমার মগজে আসছে না। মেডেল তিনটে গলায় ঝুলিয়ে কবরে শুয়ে পড়বেন।’

‘আরে, মেডেল কি যে-সে মেডেল, তিন ভরি সোনা! বাদশার ফরমান ভুলে গেলে বাবা! সোনা মাটির তলায় পোঁতার হুকুম নেই। সঙ্গে-সঙ্গে শূলে চড়িয়ে দেবে। আচ্ছা, সেটা তো আমার ব্যাপার, তুমি মাথা ঘামাচ্ছ কেন? মেরে দেওয়ার তাল! আমাকে কোথায় গোর দেবে, তোমাকে জানাবে না কি! তুমি আমার একটা বয়েৎ শোনো, দিল শরিফ হয়ে যাবে। শোনো, মন দিয়ে শোনো, খুশবু কাঁহাসে আতি হ্যায়, মুঝে মালুম নেহি। শেরকি চলন ক্যায়সা হ্যায়, সমঝমে আতি নেহি। ওয়া ওয়া, ইয়া আল্লা! বলো, ওয়া ওয়া বলো। এঃ, এ কি বাবা তরিকা জানে না। শের শুনলে ওয়া, ওয়া বলতে হয়। এ যে দেখি বোকা রে বাপ।’

বড়মামা আর আমি দু’জনে একই সঙ্গে ওয়া, ওয়া করে উঠলুম।

ফকির বললেন, ‘তা হলে এইবার দাও।’

বড়মামা বললেন ‘ক’ টাকা দোব?’

ফকির বললেন, ‘তোবা, তোবা! টাকায় কি শেরের ঋণ শোধ হয় মানিক? তুমি জবাব দাও।’

বড়মামা সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, ‘মুশকিলমে গিরা হায় হাকিম। না জানে কাঁহা মেরা সাকিন!’

ফকির বললেন, ‘তোফা, তোফা, বহত খুঁ বহত খুঁ। যাঁহা হ্যায় আল্লা/ওহি তেরা মহল্লা…’

বড়মামা বললেন, ‘আমার ঋণ বিলকুল শোধ’। আর আমি পারব না, আমার প্রতিভা ফুরিয়ে গেছে।’

ফকির বললেন, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, এতেই হবে।’

একটা সাদা গাড়ি এসে দাঁড়াল আমাদের সামনে। পেছনের দরজা খুলে নেমে এল সাঙ্ঘাতিক চেহারার দুটি ছেলে। ড্রাইভারের সিট থেকে অপরেশবাবু বললেন, ‘উঠে পড়ুন, উঠে পড়ুন। ওরা গাড়ি পাহারা দেবে।’

ত্রিসীমানায় সেই ফকিরকে দেখা গেল না। কর্পূরের মতো উবে গেছে। গাড়িতে বসে বড়মামা বললেন, ‘আশ্চর্য! লোকটা ভূতের মতো ভ্যানিশ করে গেল!’

অপরেশবাবু বললেন, ‘কে বলুন তো?’

‘একজন ফকির!’

‘ফকির! কালো আলখাল্লা পরা, হাতে কালো চামর?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বিলকুল ঠিক।’

অপরেশবাবু হা-হা করে হেসে উঠলেন, ‘ভাগ্য ভালো, বেঁচে গেছেন। ওই তো কালু শেখ। হাতের চামরটা হল মারাত্মক এক অস্ত্র। আর ওই জোব্বার পকেটে-পকেটে আছে গুলি-গোলা।’

বড়মামা ‘বলেন কী?’ বলে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো হলেন।

অপরেশবাবু বললেন, ‘সত্যি আপনারা কী বোকা! আমাকে কেমন বিশ্বাস করে ফেললেন! আমার পরিচয়-টরিচয় কিছু না জেনেই কেমন আমার ফাঁদে পা দিলেন!’

বড়মামা সোজা হয়ে বসে বললেন, ‘তার মানে?’

‘মানে! ধরুন আমি কালু!’

মাসিমা হঠাৎ ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন, ‘টুটুল, কথা না বাড়িয়ে গাড়ি চালাও। অনেকক্ষণ তোমার নাটক সহ্য করেছি।’

অপরেশবাবু পেছন দিকে তাকাতে পারছেন না গাড়ি চালাচ্ছেন বলে, কিন্তু চমকে যে উঠেছেন সেটুকু বোঝা গেল, কারণ গাড়িটা হোঁচট খেলে একবার। আমরাও চমকে উঠেছি। মাসিমা এঁকে চেনেন। কীভাবে! এতক্ষণ বা বলেননি কেন?

অপরেশবাবু বললেন, ‘আপনি আমাকে চেনেন। আশ্চর্য!’

মাসিমা বললেন, ‘মারব এক থাপ্পড়। আমাকে আবার আপনি বলা হচ্ছে। আমাদের কলেজের দিন সব ভুলে মেরে দিলি! এখন খুব বড়লোক হয়েছিস, তাই না। কী করে তুই ডাক্তার হলি আমার অবাক লাগছে!’

অপরেশবাবু গাড়িটাকে রাস্তার বাঁ দিকে দাঁড় করিয়ে, ভেতরের আলোটা জ্বাললেন, তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে মাসিমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আরে। তুই কুসি না! বোকা, এতক্ষণ পরে চিনতে পারলি!’

মাসিমা বললেন, ‘জানোয়ার! তুইও তো আমাকে চিনতে পারিসনি!’

‘তোর চেহারা বদলেছে, আগের চেয়ে অনেক সুন্দরী হয়েছিস!’

‘তুই তো একটা গুণ্ডার মতো হয়েছিস!’

বড়মামা একবার-দু’বার কাশলেন।

অপরেশবাবু বললেন, ‘বড়দা, কাশার মতো কিছু হয়নি। কুসির সঙ্গে কলেজে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। কুসি, তুই বিয়ে করেছিস?’

‘ওসবের মধ্যে আমি নেই। দুটো বুড়ো ছেলের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে। একজনের পঞ্চাশ, আর একজনের পঁয়তাল্লিশ। এখনও মানুষ হল না। তুই করেছিস?’

‘ধুর, ওসব ভাবার সময়ই হল না! বেশ আছি জানিস!’

বড়মামা নিজের মনেই বললেন, ‘বেশ থাকাচ্ছি!’

অপরেশবাবু বললেন, ‘কিছু বললেন?’

বড়মামা বললেন, ‘না, তেমন কিছু নয় অনেক বেলা হয়ে গেল, এই আর কি!’

অপরেশবাবু বললেন, ‘না, না, বেশি বেলা হয়নি। মাত্র সাড়ে আট।’

বড়মামা বললেন, ‘তোমরা তোমাদের পুরনো দিনের কথা বলো, আমার শুনতে বেশ লাগছে। তুমি বললুম বলে আবার রেগে যেয়ো না! কুসির বন্ধুকে আপনি বলতে পারছি না!’

‘কে বলতে বলেছিল!’

‘ভয়ে বলছিলুম। সবাই জানে, আমি ভীষণ ভিতু। সেই ছেলেবেলায় আমি একবার ভূত দেখেছিলুম, সেই থেকেই আমার ভীষণ ভয়। মানুষকে ভাবি ভূত, ভূতকে ভাবি মানুষ। তফাত করতে পারি না।’

‘একটা জিনিস জানা থাকলে আপনার এই সমস্যা আর থাকত না। জেনে রাখুন মানুষের ছায়া পড়ে, ভূতের কোনও ছায়া পড়ে না। ভূতের ভেতর দিয়ে আলো চলে যায়। ভূত হল ট্রান্সপারেন্ট।’

‘তুমি মিলিয়ে দেখেছ?’

‘আপনিও মিলিয়ে নিতে পারেন।’

‘কীভাবে? এই মুহূর্তে আমি একটা ভূত পাব কোথা থেকে!’

‘কেন, আমি।’

‘এই, আবার তোমার ভয় দেখানো শুরু হল! কেন এত যন্ত্রণা দিচ্ছ অপরেশ?’

অপরেশবাবু হাসতে লাগলেন। আমি বললুম, ‘ভূত নাকি সুরে কথা বলে, আপনি তো তা বলছেন না!’

‘আমি! আমি যে ন্যাজাল ড্রপস নিই রেগুলার।’

গাড়ি হঠাৎ বাঁ দিকের একটা সরুপথে ঢুকে পড়ল। দু’পাশে বিশাল শূন্য প্রান্তর। বড়-বড় গাছ আর নেই বললেই চলে। চাষের খেত। বাতাসের ঝটরপটর শব্দ। লোকজন কোথায়! রাস্তাও তেমন সমতল নয়। গাড়ি লাফাচ্ছে, ঝাঁপাচ্ছে।

মাসিমা বললেন, ‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস বল তো!’

‘আর-একটু ধৈর্য ধর, দেখতে পাবি।’

সত্যিই, দেখার মতো জায়গায় গাড়ি ঢুকল। বহুকালের পুরনো একটা জমিদারবাড়ি। প্রথমেই পড়ল দু’পাশে দুটো ভাঙা থাম। সেকালের গেট। অতীত ঐশ্বর্যের সাক্ষী। এখন শুধুই স্মৃতি। মোরাম ফেলা পথের ওপর দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল কচরমচর শব্দে। থামল গিয়ে বিশাল সেই বাড়িটার সামনে। দোতলা; কিন্তু পেল্লায় বড়। এপাশ থেকে ওপাশে ঘুরে চলে গেছে। জোর একটা আলো জ্বলছে সামনে। আমরা সবাই নেমে পড়লুম।

অপরেশবাবু আগে-আগে যাচ্ছেন, আমরা তাঁর পেছনে।

হঠাৎ বড়মামা উল্লাসে নৃত্য করে উঠলেন, ‘পড়েছে, পড়েছে। ছায়া তো পড়েছে।’

অপরেশবাবু বললেন, ‘আপনি কি আমাকে সত্যিই ভূত ভেবেছিলেন!’

‘বলা তো যায় না ভাই! যা দিনকাল পড়েছে, কখন যে কী ঘটে! একটা কিছু হলেই হল। একালে সবই সত্যি। এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়, সব সত্যি, সব সত্যি।’

বিশাল বড়-বড় সিঁড়ি। এত চওড়া যে, পাশাপাশি তিনজন লোক আরামে শুতে পারে। পরিষ্কার তকতক করছে। একটা এত বড় আর এত চওড়া যে জনসভা করা যায়। হঠাৎ কোথা থেকে ষণ্ডামার্কা একজন লোক বেরিয়ে এল। যতটা চওড়া ততটা লম্বা নয়, বেঁটে গুটগুটে।

অপরেশবাবু বললেন, ‘এই যে স্যান্ডো, তোমার অতিথিরা সব এসে গেছেন! সেবা করতে হবে যে!’

স্যান্ডো উত্তরে অদ্ভুত একটা শব্দ করল।

অপরেশবাবু বলেন, ‘এ এক অদ্ভুত জীব। বোধ আছে, ভাষা নেই। গভীর হৃদয়ের মালিক। তীব্র অনুভূতি। আমার লাগলে ও কাঁদে। অন্যের জন্যে জীবন দিতে পারে। দুঃসাহসী কাজে ওর জুড়ি নেই কোনও। আবার ভীষণ শিল্পবোধ। ওর হাতের কাজ দেখলে অবাক হয়ে যাবেন আপনারা। ভাষা নেই বলে এর জাত বোঝার উপায় নেই, বাঙালি কি বিহারি। স্যান্ডো একজন মানুষ। এ পারফেক্ট ম্যান। আমার সংগ্রহের একটা শ্রেষ্ঠ রত্ন।’

মাসিমা বললেন, ‘এরকম আরও আছে নাকি?’

‘অবশ্যই। একটু পরেই তোকে এক বৃদ্ধ দেখাব, তার বয়স বলতে পারলে আমি হাজার টাকা বাজি হেরে যাব।’

বিশাল একটা হলঘর, তার পাশের সরু ঘর পেরিয়ে আমরা সবুজ ঘাসে ঢাকা বিশাল একটা উঠোনে এসে পড়লুম। যেন সবুজ কার্পেটে মোড়া। আমরা জুতো-টুতো খুলে সেই নরম গালচের ওপর নেমে পড়লুম। ঠিক মাঝখানে একটা সাদা ল্যাম্পপোস্ট জোরালো আলোয় চারপাশ ফটফট করছে।

মাসিমা বললেন, ‘টুটুল, তুই যে একটা স্বপ্ন তৈরি করেছিস রে! এমন ঘাস তো আগে দেখিনি কখনও!’

‘একে বলে মেকসিকান গ্রাস। একেবারে পুরু কার্পেটের মতো। স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্ন দুটোই আছে পাশাপাশি। ভয়ঙ্কর চরিত্রের কিছু মানুষও আছে।’

‘তাদের কেন রেখেছিস?’

‘গবেষণার জন্যে। আমার বিষয়টা জানিস তো। চরিত্র আর ওষুধ। মানে চরিত্রের ওপর ওষুধের কোনও প্রভাব আছে কি না!’

বড়মামা বললেন, ‘সে তো আছেই। এ আর নতুন করে গবেষণা করতে হবে কেন? তুমি সময় নষ্ট করছ।’

‘না, বড়দা, সময় নষ্ট নয়। কিছু ওষুধের সাইড এফেক্টে মানুষের আচার-আচরণ পালটায়, আবার ওষুধ বন্ধ করলেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। আমার গবেষণা তা নয়। আমি চিরদিনের মতো মানুষের চরিত্র পালটে দিতে চাই। যেমন ধরুন, বাঘের মতো যার স্বভাব, তাকে আমি হরিণের মতো করে দিতে চাই।’

বড়মামা বললেন, ‘ধুস, অসম্ভব ব্যাপার। এ পৃথিবীতে কোথাও কেউ পারেনি কখনও। একমাত্র ধর্মই পারে মানুষের স্বভাব পালটাতে, পারে মানুষের নিজের চেষ্টা আর সাধনা। শিক্ষা আর সঙ্গও বদলে দিতে পারে চরিত্র। পারে কর্ম। ওষুধ কী করবে অপরেশ? বাজে কাজে সময় নষ্ট কোরো না। অন্য অনেক বড় কাজ পড়ে আছে।’

অপরেশবাবু বললেন, ‘আপনি আর পাঁচটা বছর অপেক্ষা করুন। আমেরিকায় আমার আবিষ্কার জেলখানায় কয়েদিদের ওপর প্রয়োগ করা হচ্ছে। ফল খুব একটা নিরাশ হওয়ার মতো নয়।’

মাসিমা বললেন, ‘তোমাদের ডাক্তারি আলোচনা বন্ধ করো। আমাদের বিরক্তি লাগছে।’

আমরা সেই ঘাসের কার্পেটের ওপর বসে পড়লুম। স্যান্ডো আসছে। হাতে একটা ট্রে, তার ওপর ঝকঝকে কাচের গেলাস। টলটলে জল। স্যান্ডো ট্রেটা নামিয়ে রেখে একটা শব্দ করল। হাতের ভঙ্গি। মুখে অদ্ভুত হাসি। বলতে চাইছে, খেয়ে নাও।

ঠান্ডা শরবত। অদ্ভুত একটা গন্ধ। আগে যত শরবত খেয়েছি, এরকম গন্ধ পাইনি।

মাসিমা বললেন, ‘গন্ধটা কীসের রে!’

অপরেশবাবু বললেন, ‘একটা হার্ব। হিমালয়ের খুব উঁচুতে হয়। এখানে আমি বরফে রেখে চাষ করি।’

‘খেলে কিছু হবে না তো!’

‘খারাপ কিছু হবে না, ভালোই হবে। মনে অদ্ভুত একটা শান্তির ভাব আসবে। রক্ত ঠান্ডা হবে। রাতে ভালো-ভালো স্বপ্ন দেখবি। নীল সরোবর, সাদা রাজহাঁস, রুপোলি চাঁদ, সোনার রঙের পাখি।’

‘তোর মাথাটা আগের চেয়ে অনেক খারাপ হয়েছে রে। আগে অল্প পাগল ছিলিস, এখন বদ্ধ পাগল।’

অপরেশবাবু বললেন, ‘এখনও তো পুরোটা দেখিসনি। আরও রাত বাড়ুক, দেখবি পাগলামি কাকে বলে!’

বড়মামা বললেন, ‘তার আগেই আমরা পালাব।’

‘কোথায় পালাবেন! আপনারা এখন আমার হাতের মুঠোয়।’

বড়মামা বললেন, ‘আবার ভয় দেখাচ্ছ!’

‘আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? আর পনেরো মিনিট পরে আপনার কোনও ভয় থাকবে না। আপনার শরবতে আমি ফর্মুলা ফাইভ দিয়ে দিয়েছি।’

এই সময় কোথাও কাঁসরঘণ্টা বেজে উঠল। পূজারতির শব্দ।

মাসিমা বললেন, ‘মন্দির আছে বুঝি কাছাকাছি!’

‘কাছাকাছি মানে ছাতে। যাবি নাকি!’

জমিদারবাড়ির রাজকীয় সিঁড়ি ঘুরে-ঘুরে ওপরে উঠছে। সে এক দেখার জিনিস!

মাসিমা বললেন, ‘বাড়িটা কার ছিল রে!’

‘বীরভূমের এক সামন্ত রাজার। আমার বাবা কিনেছিলেন এক সায়েবের কাছ থেকে। এখানে তাঁর রেশমের ব্যবসা ছিল। বেশ বিরাট কারবার। বাবা তাঁর চিকিৎসক ছিলেন। ভীষণ ভালোবাসতেন বাবাকে। সামান্য টাকায় বাড়িটা বাবাকে দিয়ে তিনি বিলেত চলে যান। এই বাড়িটার একতলার নীচে, মাটির তলায় অনেক ঘর আছে। একটা ঘর যে কয়েদখানা ছিল, দেখলেই বোঝা যায়। আর-একটা ঘরে গুমখুন করা হত, কোনও সন্দেহ নেই। পাথরের দেওয়াল। লোহার দরজা। যাকে মারা হবে তাকে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হত। জল, বাতাস, খাদ্যের অভাবে লোকটা কঙ্কাল হয়ে যেত। লোকটা যে মারা গেছে বোঝা যেত কীভাবে, যখন দেখা যেত সার দিয়ে লাল-লাল পিঁপড়ে চলেছে।’

মাসিমা ধমকে উঠলেন, ‘টুটুল! তোর ওইসব কাহিনী আমি শুনতে চাই না। আমার খারাপ লাগে। তুই এসব জানলি কেমন করে!’

‘সায়েবের একটা ডায়েরি থেকে। সায়েবের ইতিহাসে উৎসাহ ছিল। সে-যুগের সামন্ত রাজাদের অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। ডায়েরিটা বাবাকে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই হল তোমাদের অতীত! তোমাদের সভ্যতা, তোমাদের বিচার, তোমাদের বীরত্ব, কালচার!’

ফুটবল খেলার মাঠের মতো বিশাল একটা ছাত আমাদের চোখের সামনে ঝম করে উঠল। চমকে দেওয়ার মতো।

বড়লোকরা জানত বটে, কীভাবে বাঁচতে হয়। ছাতের চার কোণে চারটে নহবত। সেকালে ভোরে সানাই বাজত। রাজা দুধ-সাদা ঘোড়ায় চলে রাইডিং-এ বেরোতেন, রেশমের ওপর জরির কাজ করা আচকান পরে।

ঘরের মেঝে শ্বেতপাথরের। সামনেই বেদি। বেদির ওপর পাথরের মূর্তি। কোনও দেবতার নয়। একজন মানুষের। মুখটা ভীষণ ধারালো তরোয়ালের মতো। লম্বা-লম্বা চুল। টানা-টানা চোখ। বেশ সুঠাম চেহারা। এক বৃদ্ধ আরতি করছেন। ঘরে বসে আছে কুড়ি-পঁচিশটি ছেলে।

‘গুরুদেবের মূর্তি?’ মাসিমা প্রশ্ন করলেন।

অপরেশবাবু বললেন, ‘আমার বাবার মূর্তি। তিনিই আমার গুরু, দেবতা, যা বলিস।’

বড়মামা বললেন, ‘তোমার পিতৃভক্তির তুলনা নেই। তুমিই জীবনে উন্নতি করবে।’

যতক্ষণ না পুজো শেষ হল আমরা বসে রইলুম হাত জোড় করে। বেশ লাগছিল। আলো, ধূপের গন্ধ। ছেলেরা সমবেত ভাবে গান গাইছে। আমরা ছাতে চলে এলুম।

অপরেশবাবু বললেন, ‘বৃদ্ধ পূজারির বয়েস কত হবে বলে মনে হয়?’

মাসিমা বললেন, ‘সত্তর-আশি।’

অপরেশবাবু বললেন, ‘কুড়ি-একুশ।’

বড়মামা বললেন, ‘তাই নাকি! আরে, এ তো একটু দুর্লভ অসুখ। এক বছরে কুড়ি বছর বুড়িয়ে যাওয়া। আমার শোনাই ছিল। আজ সৌভাগ্য হল দেখার। এ তো বেশিদিন বাঁচবে না।’

অপরেশবাবু বললেন, ‘অবশ্যই না। বড়জোর আর দু’বছর। এরপর ও আর উঠতেই পারবে না। এখন যা কিছু করছে আমার ওষুধের জোরে।’

আমরা ছাতের এক মাথা থেকে আর-এক মাথায় হেঁটে গেলুম। বহু দূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছি। কোথাও কোনও ঘরবাড়ি নেই। চাষের খেত সব দিকেই চোঁচা দৌড়চ্ছে যেন। দূরে, দূরে, বহু দূরে একটা-দুটো মিটমিটে আলো। হয়তো কোনও ছোট গ্রাম। মাঝে-মাঝে গাড়ির এঞ্জিনের শব্দ। ট্রেনের বাঁশি। জায়গাটা ভীষণ ভালো, আমার কিন্তু ভয় করছে। সকলেই এখানে অসুস্থ নাকি! ছাত থেকে নীচের দিকে তাকালুম। বাড়িটার পেছন দিক এটা। সাদা একটা অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে। চৌবাচ্চার মতো কী একটা রয়েছে বাঁধানো। সেখান থেকে ভিসভিস করে নীলচে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। অদ্ভুত ধরণের ধোঁয়া। দেখলেই মনে হয় ভীষণ ঠান্ডা।

জিগ্যেস করলুম, ‘কাকু, ওটা কী! ভোমরার মতো চাপা শব্দ!’

‘ওখানে বরফ তৈরি হচ্ছে বিলু। আমার যে রোজ চাংড়া-চাংড়া বরফ লাগে। কিছু আবার পানাগড়ে সাপ্লাই দিই। কিছু রোজগার হয়!’

বড়মামা বললেন, ‘তোমার আয়টা কী, সবই তো দেখছি ব্যয়।’

‘আয় আছে। ভালোই আয় হয়। এখানে আমি এমন কিছু তৈরি করি, যা আর কোথাও তৈরি হয় না। জিনিসটা হল বিষ। পয়জন। যার এক ফোঁটায় হাজারটা লোক মারা যায়।’

বাপ রে। এ কোন জায়গায় নিয়ে এলে ভগবান! এ যে এক সাঙ্ঘাতিক লোক।

মাসিমা বললেন, ‘সব ছেড়ে, তুই এসব অদ্ভুত জিনিস নিয়ে পড়লি কেন! আমার তো শুনেই ভয় করছে।’

কাকু হেসে বললেন, ‘মাটির তলায় একটা ঘরে কিলবিল করছে সাপ। বিষাক্ত সাপ। প্রত্যেকটা সাপ থেকে সপ্তাহে একবার করে বিষ বের করা হয়। স্যান্ডো এই ব্যাপারে ভীষণ এক্সপার্ট। সাপ যেন ওর বন্ধু।’

বড়মামা বললেন, ‘বিষ তোমার কোন কাজে লাগবে?’

‘বলেন কী! বিষ থেকে কত ওষুধ তৈরি হচ্ছে। বিষ যেমন প্রাণঘাতী, তেমনই প্রাণদায়ী। আপনি তো জানেন দাদা, সব ওষুধই এক ধরনের বিষ।’

মাসিমা বললেন, ‘বকবক বন্ধ করে কিছু খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করলে হত না!’

‘ঠিক, ঠিক। আমার খেয়াল ছিল না রে কুসি। চল, চল, নীচে যাই।’

খুব সুদৃশ্য একটা ঘরে এলুম আমরা। মাঝখানে লম্বা টেবিল। পুরনো আমলের চেয়ার চারপাশে। একটা বড় অ্যাকোয়ারিয়ামে মাছ খেলা করছে। ঘরের ভেতরেও বাঁচতে পারে এমন সব বাহারি গাছের টব জায়গায়, জায়গায়। জানলায় হালকা নীল নেটের পরদা। টান-টান লাগানো, যাতে মশা না ঢুকতে পারে। কাকু ডাকলেন, ‘প্রতাপ!’

ধবধবে ফর্সা একটি ছেলে ঘরে এল। একমাথা কোঁকড়া কোঁকড়া চুল। হাসিভরা মুখ। এসেই বললে, ‘ইয়েস স্যার!’

‘শোনো, রাতে স্পেশ্যাল কিছু কোরো। দেখতেই পাচ্ছ, তিনজন গেস্ট। এখন আমাদের সামান্য কিছু দাও। ফল আর আমাদের সেই স্পেশ্যাল আইসক্রিম।’

‘কোনটা দোব?’

‘দাও, কোর্ট জেস্টারটাই দাও।’

‘অল রাইট স্যার।’

প্রতাপ চলে গেল। বড়মামা বললেন, ‘কী ফর্সা! এ দেশীয়?’

‘হ্যাঁ, বাঙালি। কিন্তু ওরও একটা সমস্যা আছে। রোদে বেরোতে পারে না। রোদ লাগালেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। ওর ত্বকের রোগ-প্রতিষোধক ক্ষমতা একেবারেই নেই। আমি নানাভাবে চেষ্টা করছি। দেখি কী হয়! মনে হয় সামান্য উন্নতি হচ্ছে। ছেলেটা কিন্তু সাঙ্ঘাতিক মেধাবী। মুখে-মুখে জটিল অঙ্ক মুহূর্তে কষে দিতে পারে। হিসেবে পাকা মাথা। ও আমার এক নম্বর সহকারী। তেমনই স্মরণ শক্তি। একটা প্রতিভা।’

মাসিমা বললেন, ‘এটা কি তোর অসুখের মিউজিয়াম?’

‘মিউজিয়াম নয়, উদ্যান। রোগোদ্যান।’

পাকা পেঁপে এল ফালাফালা করে কাটা। একেবারে লাল টুকটুকে। তেমনই মিষ্টি। এ নাকি মেক্সিকোর পেঁপে। এই বাড়ির বাগানেই ফলেছে। বড়-বড় জামরুল। এই জামরুল হল আন্দামানের। বড়মামার খুব মনখারাপ হল। বললেন, ‘ওই দুই ছোকরার কী হল কে জানে? আমরা কেমন মজা করে ফলপাকড় খাচ্ছি। একবার দেখে এলে হত ফিরেছে কি না!’

কাকু বললেন, ‘ফিরে এলেই আমরা খবর পাব। পাহারাদাররা ছুটে আসবে।’

এসে গেল সেই আইসক্রিম, যার নাম কোর্ট জেস্টার। হালকা কমলালেবু রঙের এক-একটা চার চৌকো টুকরো। যেমন সুন্দর গন্ধ, তেমনই স্বাদ। খেলেই নাচতে ইচ্ছে করবে।

মাসিমা বললেন, ‘কীভাবে তৈরি করেছে বল তো!’

‘এ আমাদের স্পেশ্যাল ফর্মুলা। খুব পুষ্টিকর। ভেষজগুণে ভরা। এতে কিছু সামুদ্রিক গাছগাছড়া আছে। রোজ একটা করে খেলে মানুষ সহজে বুড়ো হবে না। তোকে শেখাতে পারি; কিন্তু উপাদান পাবি কোথায়! এই রঙটা এসেছে সেই ভেষজ থেকে।’

‘কত কাণ্ডই তুই করেছিস টুটুল!’

‘জানিস তো এই অঞ্চলের মানুষ আমাকে ভীষণ ভয় পায়। ভাবে আমি একটা জাদুকর। লোকের উপকার করতে পারি, আবার রেগে গেলে অপকারও করতে পারি। কালু শেখও আমাকে ভয় পায়! মাঝে-মাঝে নানারকম তোফা পাঠায়। ওই অ্যাম্বুলেন্সটা শেখের দেওয়া। ওই ছেলেকে একবার কেউটে সাপে কামড়েছিল। আমি বাঁচিয়ে দিয়েছিলুম। সে এক সাঙ্ঘাতিক চিকিৎসা। নিষ্ঠুর ব্যাপার। শ’খানেক মুরগি জবাই করতে হয়েছিল।’

মাসিমা বললেন, ‘চুপ কর, শুনতে চাই না।’

বড়মামা বললেন, ‘আমার কৌতূহল হচ্ছে।’

মাসিমা বললেন, ‘পরে আড়ালে শুনে নিয়ো।’

‘কালু শেখের দান তুমি নিলে?’ বড়মামার প্রশ্ন।

‘কালু শেখ হল রবিনহুডের মতো। সে গরিবের মা-বাপ। লোকটা সত্যিই ফকির। আবার কবি। আমার এখানে একটা প্রোজেক্ট তার টাকায় চলে। মাশরুম প্ল্যান্ট। ব্যাঙের ছাতা। সস্তার প্রোটিন। চলুন, পাতালে ঘুরে আসি।’

বড়মামা সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, ‘আমি বাড়ি যাব। বাড়ির জন্যে আমার ভীষণ মন কেমন করছে।’

কাকু বললেন, ‘বড়দা, আপনার কোনও ভয় নেই। মাটির তলাটা না দেখলে আপনার অনেক কিছুই দেখা হবে না। সকালের স্থপতিরা কত বিস্ময়কর কাণ্ড করতে পারতেন সেটা দেখা উচিত আপনার। একটা জ্ঞান।

‘চলো তা হলে।’ বড়মামার কাঁদো-কাঁদো গলা।

‘বেশি দূর যেতে হবে না। এই ঘর থেকেই যাওয়া যাবে।’

কাকু উঠে ঘরের ডান পাশে গেলেন। মেঝের সঙ্গে মেলানো একটা কাঠের পাটাতন। একটা আংটা লাগানো। আমরা লক্ষ করিনি। ঢাকনাটা তুলে দেওয়ালের একটা হুকে লাগিয়ে দিলেন। একটা আলোর আভা ভেসে উঠল। উঁকি মেরে দেখলুম, ধাপ-ধাপ সিঁড়ি, ঘুরে-ঘুরে নেমে গেছে পাতালে। একটা ঠান্ডা ভাপ, ভোরের বাতাসের মতো ওপরে উঠে আসছে।

কাকু আমার পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘যাও মাস্টার, তুমি আগে নেমে যাও। দেখি তোমার সাহস কেমন।’

প্রথমে একটা ভয় এল মনে। ডিটেকটিভ উপন্যাসে পড়েছি। যেই নীচে নামব, ওপরের পাটাতনটা ফেলে দিয়ে শয়তানটা হা-হা করে অট্টহাসি হাসবে। যাও এইবার, এইখানে তিলে-তিলে শুকিয়ে মরো। ঘোর অন্ধকার। চুঁইয়ে-চুঁইয়ে জল পড়ার শব্দ। আগুনের গোলার মতো দুটো কী জ্বলছে! এগিয়ে আসছে আমার দিকে। বিশাল এক অজগর!

কাকুর হাত এসে পড়ল আমার পিঠে, ‘কী ভয় করছে!’

মাসিমা বললেন, ‘আমি আগে নামছি।’

মাসিমা আমাদের টপকে নীচে নামতে লাগলেন। পুরো দলটা সঙ্গে-সঙ্গে সচল হল। নামছি তো নামছিই। কত নীচু রে বাবা! শেষ ধাপে লম্বা এক করিডর। আলো-ঝলমলে। অনেকটা দূরে ওটা কী রে! নৌকোর মতো?

মাসিমা বললেন, ‘ওটা কী রে!’

‘নৌকো।’

‘শুকনো ডাঙায় নৌকো! পাগলের পাগলামি!’

‘এখানে পাগলের কোনও কারবার নেই। ওই মাথায় গেলে দেখবি একটা স্লুইসগেট। বহুকাল আগে এখানে একটা নদী ছিল। খুলে দিলে এইটা জলে ভরে যেত। ওই নৌকোটা অতি প্রাচীন। অনেকটা বজরার মতো। নদী আর নেই। নৌকোটা আছে। আমি বছর-বছর রঙ করাই। ভেতরে আলো ফিট করে দিয়েছি। যখন জ্বালব, দেখবি মায়ার মতো। স্বপ্নের মতো। ভেতরটা একেবারে রাজকীয়। রাজাদের কাণ্ডকারখানাই আলাদা।’

ডান দিকে পর-পর একসার ঘর। বাঁ দিকে বিশাল একটা চাতাল। থামের পর থামের মাথায় একতলার ছাত। পাথরের দেওয়ালে চুঁইয়ে জল পড়ছে টুস-টুস করে। কোথা থেকে শব্দ আসছে ঝাঁক-ঝাঁক ভীমরুল ওড়ার মতো। তলার গুমোট ভাবটা কাটানোর জন্যে চারপাশে চারটে এগজস্ট ফ্যান ঘুরছে। তারই শব্দ, বললেন কাকু।

ডান পাশের চাতালের দেওয়ালে পর-পর অনেক রিং লাগানো, বেশ উঁচুতে। ওইখানে নাকি হাত বেঁধে মানুষকে চাবকানো হত সে-যুগে। তখন আইন-আদালত বলতে বোঝাত রাজাকেই। দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। বড়মামা বললেন, ‘তোমার সেই সাপখোপের ঘরটা কোথায়!’

‘সেটা আমরা সবশেষে দেখব। বলা তো যায় না, যদি ছোবল-ফোবল মেরে দেয়! পৃথিবীর সবরকম বিষাক্ত সাপের আখড়া।’

কাকু সেই নৌকোটার সবক’টা আলো জ্বেলে দিলেন। সে যে কী সুন্দর!

মাসিমা বললেন, ‘টুটুল, তোর এই নৌকোটা আমাকে ভাড়া দে না। আমি তোর কাছে আর কিচ্ছু চাইব না।’

‘ভাড়া কেন? তুই এসে সারাজীবন থাক না। আমি একা সব দিক সামলাতে পারছি না। আমাকে একটু সাহায্য কর না। কলেজে তো খুব নেতাগিরি করতিস!’

নৌকোটায় ওঠার জন্যে সুন্দর একটা সিঁড়ি। দু’পাশে রেলিং। রেলিংয়ে দামি ঝিনুকের কারুকাজ। নৌকোটাও রেলিং দিয়ে ঘেরা। কাঠের জাফরি। সামনের পাটাতন ঝকঝকে পালিশ করা। সেখানে ছোট-ছোট গাছের টব। পাতাগুলো সব সাদা। যেন কাগজের গাছ। এ এক ধরনের আমেরিকান ক্যাকটাস। বিষাক্ত মাকড়সারা এই পাতায় বাসা বাঁধতে ভীষণ ভালোবাসে। সেই রকম মাকড়সা নাকি পাতার আড়ালে আছে। কিছু না, স্রেফ একবার হেঁটে যাবে গায়ের ওপর দিয়ে। সমস্ত জায়গাটা সবুজ হয়ে যাবে, কোনও সাড় থাকবে না।

‘এখানে মজা করে রাখার কী কারণ?’ বড়মামা রেগে গেছে।

কাকু বললেন, ‘ওইটাই তো অ্যাডভেঞ্চার। বেশ একটা ভয় ভয়, বিপদ-বিপদ ভাব। লিফটে করে এভারেস্টে ওঠা গেলে কেউ উঠত! আফ্রিকাটা একটা পার্ক হলে কোনও আকর্ষণ থাকত!’

‘তোমার ওই পোষা মাকড়সা আমাদের ভালোবেসে গায়ে এসে চড়বে না তো!’

‘সে আশঙ্কা নেই। ওরা ভীষণ লাজুক। পাতার উলটো পিঠে বাসার গভীরে আরামে শুয়ে থাকে।’

‘এরা তোমার কোন কাজে লাগবে!’

‘ওই ভেনাম থেকে অসাধারণ একটা মলম তৈরি হয়েছে। নার্ভপেনে মানুষ যখন ছটফট করছে, অসহ্য যন্ত্রণায় যখন আত্মহত্যা করার ইচ্ছে হচ্ছে, তখন লাগালেই শান্তি। ওষুধটার নাম রেখেছি গ্রিন।’

নৌকোর ঘরটা বেশ চওড়া। সবুজ কার্পেট মোড়া মেঝে। সাদা বালিশ, তাকিয়া, বসে লেখার টেবিল। হাতির দাঁতের টেবিল ল্যাম্প। কিছু বই। কী সুন্দর! মনে হল, আর কোথাও যাব না, এইখানেই থাকি। একপাশে একটা পালিশ করা ক্যাবিনেট। ঝকঝকে সোনার মতো হাতল লাগানো।

মাসিমা বললেন, ‘ওটার মধ্যে কী আছে?’

‘দেখবি?’

কাকু পাল্লাটা খুললেন। মাসিমার মতো সাহসীও ভয়ে আঁক করে উঠলেন। আমি মাসিমাকে জড়িয়ে ধরেছি। আস্ত একটা কঙ্কাল। কান পর্যন্ত দাঁত বের করা হাসি। মরে গিয়ে যেন মাথা কিনে নিয়েছে। আমার বাঁচা দেখে হ্যা-হ্যা করে হাসছে।

মাসিমা বললেন, ‘টুটুল, তোর কি কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই! এই সুন্দরের মধ্যে ওই অসুন্দরকে ভরে রেখেছিস!’

‘ম্যাডাম! কঙ্কালের চেয়ে সুন্দর কিছু আছে! নৌকো নিয়ে যায় পরপারে। জীবনের পরপার হল মৃত্যু। সবাই একদিন যাবে ভাই!’

বড়মামার সঙ্গে-সঙ্গে কবিতা এসে গেল। কঙ্কালটা দেখে তার খুব আনন্দ হয়েছে। বড়মামা বললেন, ‘একটা শের শোনো, লম্ফ ঝম্প যতই করো, ওই তো তোমার কাঠামো। তিন খাবিতেই অক্কা পাবে, ঘুচে যাবে বাঁদরামো। বলো, বলো, ওয়া, ওয়া।’

আমরা সবাই একসঙ্গে ওয়া, ওয়া করে উঠলুম। এটা সেই ফকির ঢুকিয়েছেন বড়মামার মাথায়। কাকু সেই ক্যাবিনেটের ভেতর একটা লাল আলো জ্বেলে দিলেন। ভয়ঙ্কর আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। মাসিমা বললেন, ‘টুটুল, একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে। তুই বুঝি ভয় দেখিয়ে আনন্দ পাস!’

‘কুসি, এ হল আমার দেবতা। জানিস তো একে আমি রোজ আরতি করি। আমি শক্তি পাই। আমার বিচার, বিশ্বাস সব পরিষ্কার হয়ে যায়! এইটাই তো আমার ভেতরের সংবাদ! কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাক, দেখবি প্রেমে পড়ে যাবি।’

‘ছেলেটা যে ভয় পাচ্ছে, এটা বুঝছিস না কেন?’

‘মাস্টার! তোমার ভয় করছে?’ কাকু আমার পিঠে তাঁর ভারী হাত রাখলেন।

‘একটু আরাম করে বসাই যাক না!’ বড়মামা কার্পেটে বসলেন তাকিয়া হেলান দিয়ে। ক্যাবিনেটের পাল্লা বন্ধ করে দিলেন কাকু। আমরাও বসলুম।

কাকু বললেন, ‘বাবা যখন বাড়িটা কেনেন, তখন আমরা এই পাতালের ব্যাপারে তেমন মাথা ঘামাইনি। আমি তো এখন শিশু। বাবা ভাবতেন, বড় লোকের বাড়িতে অমন আন্ডার গ্রাউন্ড গোডাউন তো কতই থাকে! আছে, থাক। কোনও দিন দেখলেই হবে। যেদিন দেখলেন সেদিন মাথা ঘুরে গেল। কী এলাহি ব্যাপার! সায়েবও বোধহয় তেমন মাথা ঘামাননি। সে এক নতুন মহাদেশ আবিষ্কারের মতো উত্তেজনা। হরেকম রকম জিনিস বেরোল। তার মধ্যে কিছু মূল্যবান। কঙ্কালটা ছিল নৌকোর মধ্যে, এই ঘরে। এককোণে বসে থাকার ভঙ্গিতে। কঙ্কালটা কোনও নারীর। বয়স, কুড়ি থেকে বাইশের মধ্যে। মনে হয়, হত্যা করা হয়েছিল। রাজা-টাজারা তো তখন এই সবই করতেন। মনে হয়, নৌকোসুদ্ধু জলে ডুবিয়ে দিয়েছিল। কে সেই নারী, কী তার নাম, কী ইতিহাস কিছু জানা যাবে না। বাবা সেই কঙ্কালকে নৌকোর খোলেই প্রতিষ্ঠা করলেন। বললেন, থাক, এই বজরার দেবী হয়ে। পরে, আমার ডাক্তারি পড়ার সময় খুব কাজে লেগে গেল!’

আমরা ভোম মেরে বসে রইলুম কিছুক্ষণ। ফুটফুটে আলোর মালায়, যেন বিয়েবাড়ির রোশনাই। বজরায় চেপে বর-বউ চলেছে। হঠাৎ মনে হল, কী কাণ্ড, মাসিমার সঙ্গে অপরেশকাকুর তো বিয়ে হতে পারে! আমি কেমন একজন সুন্দর মেসো পাব। কী মজার মানুষ! এ বাড়িটা তো বাড়ি নয়, রহস্যপুরী! ও ভগবান, সানাইটা একবার বাজিয়ে দাও ভগবান।

আমরা নৌকো থেকে নেমে, একেবারে শেষ মাথার একটা ঘরের সামনে এলুম। কাচের দরজা। মোটা প্লেট গ্লাস। দরজা খোলা যাবে না। সাপের ঘর। কাচের বাইরে থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। সাপ নয়, আর একটা ছোট্ট কাচের বাক্স। মেঝেতে সেট করা। সেটাতে একটা গর্ত। ওই গর্তের মুখে একটা ব্যাঙ রাখলে সাপ মাথা গলাবে। সঙ্গে-সঙ্গে একটা লোহার ক্যাচার দিয়ে মাথাটা চেপে ধরে, মুণ্ডুটা পাকড়াতে হবে, তারপর মাথাটা উলটে বিষদাঁত থেকে বিষটা ঢেলে নিতে হবে পাথরের বাটিতে। কঠিন কসরত। স্যান্ডো এই কাজ ভীষণ ভালো পারে। ক্ষীণ একটা শব্দ আসছে। ঝুমঝুম শব্দ। ওটা নাকি র‍্যাটল স্নেক। ওইরকম শব্দ করে। ভেতরে আর এক জাতের মারাত্মক সাপ আছে, স্যাণ্ড ভাইপার।

আমরা এইবার সেই ঘরটায় এলুম, টরচার চেম্বার। কালো স্লেটপাথরের দেওয়াল। নিশ্ছিদ্র একটা ঘর। মেঝেটা খসখসে বেলে পাথরের। ঢোকা মাত্রই মনে হল কেউ যেন গুমরে-গুমরে কাঁদছে, গোঙাচ্ছে, আর্ত চিৎকার করছে। একপাশে লোহার একটা অদ্ভুত জিনিস আড় হয়ে আছে। ওটার নাম টিকটিকি। দেখতেও বিশাল একটা টিকটিকির মতোই। জামাকাপড় খুলে মানুষটাকে উপুড় করে ওই টিকিটিকিতে বেঁধে দেওয়া হত, তারপর চালানো হত চাবুক। পেছনটা ফালাফালা হয়ে যেত। এক সময় জল, জল, করতে-করতে অজ্ঞান।

‘এই অত্যাচারের যন্ত্রটা এখানে রাখার কারণ?’ মাসিমা জানতে চাইলেন।

কাকু বললেন, ‘ইতিহাস।’

সিলিং থেকে ঝুলিয়ে পেটাবার জন্যে বড়-বড় রিং ঝুলছে। তাকাতেই ভয় করে।

কাকু বললেন, ‘এই ঘরের একটা দেওয়াল ফাঁপা। কারণটা জানা নেই। তবে ওপরে একটা গর্ত আছে মনে হয় টিকের আগুন পুরে শরীরটাকে ধীরে-ধীরে, তিলে-তিলে ঝলসানো হত।’

মাসিমা প্রায় ছিটকে ঘরের বাইরে চলে গেলেন।

‘অসম্ভব! আর সহ্য করা যাচ্ছে না।’ বাইরে দাঁড়িয়ে মাসিমা বললেন।

আমরা সোজা নৌকোটা পেরিয়ে এগিয়ে গেলুম শেষ প্রান্তে। সেখানে একটা বিশাল খিলান। লোহার দরজা। দরজাটা খুলতেই একটা টানেল। বেশ কিছু দূর এগোতেই ফাঁকা মাঠ। জমিটা বেশ নীচু। পাথর ছড়ানো। শুকনো নদীর তল যেমন হয়। এগোতে-এগোতে উঁচু জমি। চাষ হয়েছে। একটা ট্রাকটর পড়ে আছে ফাঁকা মাঠে। দৈত্য ঘুমোচ্ছে। বাঁশঝাড় বাতাসে মচর-মচর শব্দ করছে। গা-ছমছমে পরিবেশ। বিশাল বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে জমাট ইতিহাসের মতো।

একটা ঘেরা জায়গার মধ্যে যেন লতাবিতান, কুঞ্জবন। আমার মনে হলেও জায়গাটা হল মৃত্যুর। ওই ঝোপটা হল বিষাক্ত আইভিলতার। কাকু একটা বক্তৃতা দেওার জন্যে তৈরি হচ্ছিলেন। লতানে গাছ; কিন্তু কোনও অবলম্বন ছাড়াই লতা মাটি ছেড়ে মাথা তুলে আকাশে চাড়া মারে। সে এক ভৌতিক কাণ্ড! পাতারও কী বাহার। এক ইঞ্চি থেকে চার ইঞ্চি লম্বা। থোকা-থোকা। ঝকঝকে পালিশ করা। মোমের মতো সাদা-সাদা ফল ধরে। লতার সর্বাঙ্গ দিয়ে সরষের তেলের মতো পদার্থ বেরোয়। ভীষণ বিষাক্ত। গায়ে লাগলেও বিপদ।

মাসিমার ধমকে বক্তৃতা বন্ধ হয়ে গেল। দেখা হল না স্পিটিং কোবরা। সাপ মানুষের চোখ তাক করে বিষ ছোড়ে পিচকিরির মতো। অন্ধ হয়ে যায় মানুষ। আফ্রিকার সাপ। সেখান থেকে আনিয়েছেন কাকু। বিশাল একটা খাঁচায় পাঁচশো তাজা কাঁকড়া বিছে খড়খড় করছে। ওরা নাকি ভোরবেলা পেছনের দাড়া আকাশের দিকে তুলে ধেই-ধেই করে একসঙ্গে নাচে। সে এক দেখার মতো দৃশ্য! সাদা-সাদা কুড়ি-বাইশটা সুন্দর বেড়াল, এখানে-ওখানে। চারটে ভিন্ন জাতের কুকুর। অকারণে পোষা নয়। কাকুর গবেষণায় সাহায্য করে। কোনও বেড়াল অসুস্থ হলে বাগানে চলে যায়। খুঁজে-খুঁজে ঘাসপাতা বের করে চিবোয়। পরের দিনই ফিট। অসুখটা কী, কী খেয়ে সেরে গেল, তারপর অনুসন্ধান। অসুখ আর ওষুধ প্রকৃতিতে পাশাপাশি আছে। খুঁজে নিতে পারলেই আরোগ্য। সাতটা বানর এক জায়গায় নাচছে শরীর দুলিয়ে-দুলিয়ে। ওদের মধ্যে একটা নাকি পাগল! দুটো বোকা গাধা, চারটে মহাশয়তান। কাকুর পরীক্ষা ওদের নিয়েও। বোকা দুটোকে চালাক করতে চান। চালাক চারটেকে আরও চালাক। পাগলটাকে করতে চান স্বাভাবিক। একেবারে মেতে আছেন। দিনে রাতেও কোনও সময় নেই। বছরে একবার-দু’বার বিদেশি সায়েবরা এখানে আসেন। বিদেশে কাকুর খুব নাম। দেশের মানুষ তেমন পাত্তা দেয় না। এক বাঙালি ভালো কিছু করলে আর-এক বাঙালির খুব কষ্ট হয়।

কাকু এইসব কথা বলতে-বলতে আমাদের দোতলায় নিয়ে এলেন। জায়গাটা ভীষণ সুন্দর। একটা বড় ঘরে শুধু বই আর বই। সবই ওষুধ আর অসুখের ওপর। আর-একটা বড় ঘরে এনে কাকু বললেন, ‘কুসি, তোরা এই ঘরটায় থাকবি। বেশ চারদিক খোলা। ঘরটার আর-এটা কী মজা বল তো!’অনলাইনে বেস্টসেলিং বই কিনুন

‘ঘরের আবার কী মজা! ঘর একটা যেমন হয়! বিশাল বড়সড় একটা ঘর।’

‘তা হলে তো মিটেই যেত ব্যাপারটা। এদিকে আয়?’

আমরা গুটিগুটি ঘরের পশ্চিমের দেওয়ালের দিকে এগিয়ে গেলুম। মেঝের কাছে দেওয়ালে গোল একটা কাঠ বসানো। অনেকটা দরজার মতোই। কাকু সেটা খুলে দিলেন। বেশ বড় গোল মতো একটা ফোকর। যে-কোনও মাপের মানুষ গলে যেতে পারে; কিন্তু যেতে হবে হামাগুড়ি দিয়ে। কাকু হামা দিয়ে আগে ঢুকলেন, পেছন-পেছন আমরা। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই দেখি ছোট মাপের আর-একটা সুন্দর ঘর। বেশ সাজানো গোছানো। অপূর্ব। দেওয়াল ঠেসানো টেবিল, একটামাত্র চেয়ার, টেবল ল্যাম্প। সেই ঘরের একপাশে একটা কাঠের আলমারি।

কাকু বললেন, ‘কুসি! ওটা কী?’

‘তুই কি শেষে আলমারিও দেখাবি!’

‘খোল না পাল্লাটা।’

মাসিমা একটানে পাল্লাটা খুললেন। ধাপধাপ সিঁড়ি সোজা উঠে গেছে ওপরে। তেমন চওড়া নয়। কষ্টেসৃষ্টে এক-একজন করে ওঠা যায়। আমরা তাই করলুম। চার চৌকো জলের ট্যাঙ্কের মতো আর-একটা ঘর। চারপাশের তিনপাশ সলিড দেওয়াল। একদিকের পুরোটাই জানালা। কাকু মেঝেতে বসে জানালাটা খুললেন। লম্বা-লম্বা গারদ লাগানো। যতদূর চোখ যায় ধু-ধু মাঠ। অন্ধকার আকাশ। জ্বলজ্বল করছে তারার দল।

কাকু বললেন, ‘পুব দিক। সকালে সূর্যের দিকে তাকিয়ে নবাব খোদাবন্দের কাছে প্রার্থনা করতেন। এই ঘরেই তাঁর বংশের একজন জহর খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। সেই ইতিহাস আমি জোগাড় করেছি। উপন্যাসের মতো। সকালে এই ঘরে আমি কিছুক্ষণ নিজের মনে বসে থাকার চেষ্টা করি। জীবনের সামনেটা-পেছনটা বেশ দেখা যায়।’

বড়মামা থেবড়ে বসে পড়লেন মেঝেতে। বললেন, ‘হয়ে গেল। আমি আর দেশে ফিরছি না। এই ফরেনেই থেকে যাব। একেবারে আমার মনের মতো জায়গা। কুকুর আছে, বেড়াল আছে, রোগ আছে, রুগি আছে। ঠাকুরঘর আছে, আছে এই ধ্যানের ঘর। আমার আর কিছুর দরকার নেই। সুখে আমার জীবনের বাকি দিনক’টা কাটিয়ে দেব। কেয়া মজা, হরদম খাও খাজা। ধেই-ধেই নাচো, প্রেমসে বাঁচো।’

আমরা আবার নানা কসরত করে সেই বড় ঘরে এসে গেলুম।

মাসিমা বললেন, ‘এইবার আমি চান করব। সমস্যা একটাই, তারপর আর এই জামাকাপড় পরতে ইচ্ছে করবে না।’

কাকু বললেন, ‘তোর সমস্যার সমাধান আমি করে দিচ্ছি। একেবারে নতুন একটা পাজামা আর একটা নতুন অ্যাপ্রণ দিচ্ছি। ফাইন ড্রেস।’

‘নিয়ে আয়। তোর কাছে এসে মেমসায়েব হয়ে যাই।’

স্যান্ডোদা এসে ইশারায় আমাকে ডাকলেন। স্যান্ডোদার হাসিটা ভারি সুন্দর। নীচে নেমে এলেম। সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠের ওপাশে একটা উঠোন। তার পাশে জল টলটলে প্রায় সুইমিং পুলের মতো একটা চৌবাচ্চা। জায়গাটা ঝলমল করছে আলোয়। দু’পাশে দুটো গ্যারাজ। একটা গ্যারাজে দুটো মোটরসাইকেল রেগেমেগে দাঁড়িয়ে আছে। আর-একটায় সাদা রঙের একটা মোটর। চারটে নতুন সাইকেল আর-এক পাশে খাড়া।

স্যান্ডোদা ইশারায় প্রশ্ন করলেন, ‘চান করবে?’ ঘাড় নাড়লুম। গরমে মরে যাচ্ছি। বৈশাখ তেতে আছে, চাটুর মতো। যখন হাওয়া দিচ্ছে, মনে হচ্ছে, আহা! এমন কাল আর হয় না! হাওয়া বন্ধ হলেই আপশোস, শীত কবে আসবে!

স্যান্ডোদা কোথায় যেন চলে গেলেন লাফাতে-লাফাতে। আমি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখছি, স্বপ্নের দেশ। জেনারেটারের ব্যবস্থা আছে নিশ্চয়, তা না হলে অন্ধকার জমানায় এত আলো আসে কী করে! স্বর্গের মতো পরিষ্কার চারপাশ। জলাধারের পাশেই গাছের ঝোপ। বিরাট আকারের সাদা-সাদা ফুল। পরে চিনতে পারলুম, পেল্লায়-পেল্লায় গন্ধরাজ।

স্যান্ডোদা তোয়ালে আর সাবান আনতে গিয়েছিলেন। পরিষ্কার একটা শর্টস। ঝপাং করে ঝাঁপ মারলুম জলে। ক্লোরিনের গন্ধ। স্যান্ডোদা ইশারায় বললেন, সাঁতার কাটো, সাঁতার। সাঁতার আমি ভালোই জানি। মামার বাড়ির দিঘিটা আমি দাপিয়ে বেড়াই। জলটা খুব ঠান্ডা। মনে হল বরফকলের বাড়তি জল এর মধ্যে চলে আসে।

হঠাৎ স্যান্ডোদা কী একটা কায়দা করলেন, চোঁ-চোঁ করে সমস্ত জল নীচের দিকে টেনে নিল। ঘুরতে-ঘুরতে, পাক খেতে-খেতে গেল পাতালে। শুকনো সুইমিংপুল। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি বোকার মতো।

স্যান্ডোদা হাততালি দিয়ে নাচছেন। চোখ বড়-বড় করে ইশারা করলেন, উঠে এসো। ঠান্ডা লাগবে। অদ্ভুত মানুষ। আমি যেন তাঁর ছেলে। গা মুছিয়ে দিচ্ছেন। পাউডার মাখিয়ে দিচ্ছেন। চুল ফিরিয়ে দিচ্ছেন। যখন ছোট ছিলুম, তখন আমার মা এইরকম করতেন। মা নেই। মা স্বর্গে। মাসিমা কড়া ধাতের।

স্যান্ডোদা আমাকে একটা খাঁচার সামনে নিয়ে এলেন। একটা বিরাট লক্ষ্মী পেঁচা। ছটফট করছে। গোল-গোল আগুন-চোখ বনবন করে ঘুরছে। স্যান্ডোদা খাঁচার দরজাটা খুলে দিলেন। এক ঝাপটা মেরে পেঁচাটা আমাদের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেল। পোষা পেঁচা। দিনের আলো ফুটলে, অন্ধকার মুছে গেলে, অন্ধ হওয়ার আগেই ঠিক ফিরে আসবে। স্যান্ডোদাকে এত ভালোবাসে, রোজ যে-কোনও একটা ফল ঠোঁটে ঝুলিয়ে নিয়ে আসবেই। সব প্রাণীই নাকি স্যান্ডোদাকে ভীষণ ভালোবাসে। পাখি এসে কাঁধে বসে গান শোনায়। বেড়াল এসে লেজ বুলিয়ে সুড়সুড়ি দেয়। বানর মাথা চুলকোয়। স্যান্ডোদার অসুখ করলে সবাই দেখতে আসে। একটা গাছ আছে, স্যান্ডোদা সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই পাতাগুলো সব ঝুলে যায়, যেন সম্মান জানাচ্ছে।

যেখানে আমরা রোজ থাকি সেখানে এসব কিছুই হয় না। ঘ্যাজোরম্যাজোর লোক, গুলতানি। ভ্যাঁ-ভ্যাঁ গাড়ি। ঝগড়া, মারামারি। ধুলো, ধোঁয়া। মাইক, সভা। সেখানে এসব গল্প। বলবে গুল মারছে ব্যাটা! বড়মামার মতো আমারও এখানে থেকে যেতে ইচ্ছে করছে। জীবজন্তুদের খাওয়াব। চাষের মাঠে কাজ করব। রোদে ভিজব। না, না, জলে ভিজব, রোদে পুড়ব।

খাওয়ার ঘরে মাসিমাকে মনে হচ্ছে, সিস্টার নিবেদিতা। ধুতি, পাঞ্জাবি পরা বড়মামা যেন জামাইবাবু। নিজেকে তো দেখতে পাচ্ছি না, কেমন দেখাচ্ছে জানি না। নিরামিষ, কিন্তু খাওয়াটা হল দারুণ। এই প্রথম রোস্টেড পোট্যাটো খেলুম। যাকে বলে আলুপোড়া। সুন্দর খেতে। ডুমুরের চপ খেলুম। টেরিফিক। খাস্তা পরোটা। খসে-খসে পড়ে যাচ্ছে। মোচার কিমাকারি ছানার ছোট-ছোট গুলি মেশানো। ফ্রুট স্যালাড। গোলাপজাম। ফলসার চাটনি।

হাত ধুতে-ধুতে বড়মামা বললেন, ‘ছেলে দুটোর জন্যে ভীষণ ভাবনা হচ্ছে। সেই কখন গেছে। এখনও কেন আসছে না। ও অপরেশ! একটা কিছু তো করতে হয়।’

‘রাত বারোটার সময় কী করবেন বড়দা!’

‘চলো না, তোমার গাড়িটা নিয়ে একবার পানাগড়ের দিকে যাই। চিন্তায় তো ঘুম আসবে না।’

‘রাস্তাটা ভালো নয় বড়দা। কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম করুন, ভোরেই বেরোব।’

‘যাই বলো, ব্যাপারটা অস্বাভাবিক।’

বিশাল বিছানায় ধপাস হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই ঘুম। ঘুমোতে ঘুমোতেই মনে হল, ঘরের মধ্যে ঘর। ঘরের মাথায় ঘর। মাসিমা আমার পাশে। বড়মামা ওপাশের বিছানায়। কে যেন কোথায় সেতার বাজাচ্ছে। পাতালে কিলবিল করছে হাজারটা সাপ। নৌকোর ভেতর কঙ্কালটা জ্যান্ত হয়েছে। নদীটা ফিরে এসেছে। সুড়ঙ্গটা জলে ভরে গেছে। খুব ভয় করছে আমার। সুইমিংপুলটা শাঁ-শাঁ করে শুকিয়ে গেল। পেঁচাটা উড়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে ঝাপটা মেরে।

কিচিরমিচির, কিচিরমিচির—কত পাখিরে বাবা! ঘুম ভেঙে গেল। পাশে মাসিমা নেই। বড়মামার বিছানা খালি। ধড়মড় করে উঠে বসলুম। দেখি বড়মামা হামাগুড়ি দিয়ে সেই রহস্যময় ঘরটা থেকে বেরিয়ে এলেন। এসেই বললেন, ‘এ-কথা তোকে আজ স্বীকার করতেই হবে, না বেড়ালে মানুষের জ্ঞান বাড়ে না। আমি দেশে ফিরেই, আমাদের বাড়ির সব দরজা খুলে ইট দিয়ে গেঁথে এইরকম ছোট-ছোট গোল-গোল গুহা টাইপের গর্ত করে দেব। সবাই যাওয়া-আসা করবে হামা দিয়ে। আর আমার ঘরের মাথার ওপর একটা জলের ট্যাঙ্কের মাপে ঘর করে, দেওয়াল আলমারির ভেতর দিয়ে সিঁড়ি চালিয়ে দেব। ভাবতে পারিস কেসটা কী দাঁড়াবে? আলমারির পাল্লা খুলে বেরিয়ে আসছে কে? না, তোর বড়মামা!’

‘মাসিমার অনুমতি নিয়ে করবেন।’

‘মাসিমা? মাসিমা বলবি, না কাকিমা, ভেবে দেখ।’

‘সে আবার কী?’

‘যে-কোনও একটা তোকে চেঞ্জ করতেই হবে। হয় অপরেশ হবে তোর মেসো, না হয় কুসি হবে তোর কাকি। এইবার তোর পছন্দ!’

বেরিয়ে যেতে-যেতে বড়মামা একটা শের ছেড়ে দিলেন,

হোতা হায় ওহি মঞ্জুর যো খোদা

খাও ভিজে ছোলা আর ডুমোডুমো আদা।।

নীচে এসে আমরা একটা চা খেলুম। তার নাম হার্বাল টি। হরেক জিনিস দিয়ে তৈরি দারুণ এক জিনিস। সুন্দর স্বাদ। বড়মামা খাচ্ছেন আর বলছেন, যেন পাখির শিস, যেন ভোরের আলো, যেন নদীর স্রোত, যেন বাতাসের শব্দ, যেন নীল আকাশ, যেন মারু বেহাগ।

গাড়ি পাহারা দিচ্ছিল যে ছেলে দুটি, তারা ফিরে এসেছে। কারও কোনও পাত্তা নেই। কাল রাতে আর কোনও ঝামেলার ঘটনা ঘটেনি। রাস্তায় কাল গাড়িও কম ছিল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা বেরিয়ে পড়লুম কাকুর গাড়িতে, সোজা পানাগড়ের দিকে। পানাগড় বাজারে যত মেরামতি দোকান ছিল, গ্যারাজ, সব খোঁজ নেওয়া হল। লম্বা, ফর্সা মতো একজন, আর-একজন বেশ দোহারা-চেহারা, উল্লেখযোগ্য হল ভুঁড়ি। পাঞ্জাবি ঠেলে বেরিয়ে আসছে ভুঁড়ি। বড়মামার আবার নিপুণ ব্যাখ্যা, শরীরের মধ্যভাগ যেন ভূমণ্ডল। যেন একটা গ্লোব, স্লিপ করে নীচে নেমে এসেছে। তবু কেউ সন্ধান দিতে পারলেন না। নাঃ, অমন একজোড়া জিনিস এ-তল্লাটে আসেনি।

বড়মামা আবার একজনের ওপর ভয়ঙ্কর রেগে গিয়ে বললেন, ‘দুটো বুড়ো ছেলে কি তা হলে উবে গেল!’

মিস্ত্রি বললেন, ‘বুড়ো ছেলেরা উবে গেল বলে আমাকে দাবড়াচ্ছেন কেন, দেব সাত নম্বর রেঞ্জ দিয়ে টাইট দিয়ে।’

পানাগড়ে আর কোথাও দেখতে বাকি রইল না। ডাক্তারখানা, জ্যোতিষ কার্যালয়, স্টেশনারি দোকান, রেশন শপ, সেলুন, বাকি রইল না কোনও কিছু। বড়মামা বললেন, ‘চোর-চোর খেলছে নাকি! ছেলেবেলায় ওই পাগলাটা এমন লুকোত, শেষে পুলিশ কি দমকল লাগিয়ে টেনে বের করতে হবে। দেখো কার চালে উঠে, কি শুকনো পাতকোয় পড়ে বসে আছে!’

বাজারের এক দোকানদার বললেন, ‘ট্রেনে কাটা পড়েনি, এটা আমি হরফ করে বলতে পারি, কারণ আমার বাড়ি স্টেশনের কাছে।’

এক ভদ্রলোক জিনিস কিনছিলেন, তিনি হঠাৎ বললেন, ‘কাল সন্ধের পর থেকে গ্রহসন্নিবেশ খুব খারাপ ছিল। আমার ছোট মেয়েটা বঁড়শি খেয়ে ফেলেছিল।’

‘তার সঙ্গে আমার ভাইয়ের নিরুদ্দেশ হওয়ার কী সম্পর্ক!’ বড়মামার উষ্ণ প্রশ্ন।

‘আছে মশাই, আছে। হয় মানুষের গলায় আটকাবে, না হয় মানুষটাই আটকে যাবে। দেখুন আপনার ভাই কোথাও আটকে বসে আছে। বয়স কত?’

বড়মামা রেগে রাস্তায় চলে গেলেন। একপাশে দাঁড়িয়ে ঠিক হল, আমরা দুর্গাপুরের দিকে এগিয়ে যাব। তাই হল। গাড়ি স্টার্ট নিল। যাচ্ছি তো যাচ্ছিই। হঠাৎ দেখা গেল একটা লরি উলটে পড়ে আছে, আমাদের বাঁ পাশে, মাঠে। কাকু, গাড়িটা স্লো করে, শেষে থামিয়ে দিলেন।

‘একবার দেখলে হয়!’ কাকু বললেন।

আমরা ভয়ে-ভয়ে নেমে পড়লুম। কেউ কোথাও নেই। ড্রাইভার, ক্লিনার। ঢাল বেয়ে মাঠে নামলুম আমরা। সব ভোঁ ভোঁ। দূর থেকে একটা ছেলে দৌড়তে-দৌড়তে এল। কাছে এসে হাঁপাচ্ছে। হাঁপাতে-হাঁপাতে বললে, ‘দু’জন লোক ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে বসে আছে।’

বড়মামা প্রশ্ন করলেন, ‘কীরকম লোক?’

‘ভদ্দরলোক। ভালো লোক।’

আমরা এবড়োখেবড়ো মাঠের ওপর দিয়ে এগিয়ে গেলুম। বেশ ঘন ঝোপ। একটু জলামতো। ঝোপের মধ্যে ভোম মেরে বসে আছেন শরৎকাকু আর মেজোমামা।

বড়মামা হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘কী হচ্ছে ওখানে? পিকনিক!’

শরৎকাকু চিঁচিঁ করে বললেন, ‘বেরোবার উপায় নেই। সম্পূর্ণ আলুথালু।’

বড়মামা আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘ব্যাপারটা কী? এক তো শুনেছিলুম মহাভারতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ হয়েছিল, একালে কি দুঃশাসনরা কিছু ভুল করল!’

মাসিমা বললেন, ‘আঃ, কী হচ্ছে দাদা! দাঁড়াও আমি একবার দেখি।’

মেজোমামা কুঁইকুঁই করে উঠলেন, ‘তুই আর এগোসনি কুসি। একেবারে অরণ্যের কোলে আছি।’

অপরেশকাকু বললেন, ‘এ অবস্থা হল কী করে!’

শরৎকাকু বললেন, ‘রিপাবলিকের পাবলিক সব নিয়ে গেছে। কিচ্ছু রাখেনি। ঘড়ি, আংটি, চেন, মানিব্যাগ, জুতো, ছাতা এভরিথিং।’

‘আপনারা এই মাঠে এলেন কী করে?’

‘আমরা কী আর ইচ্ছে করে এসেছি। লরিটাই তো নিয়ে এল। ডেলিভারি দিয়ে গেল এখানে।’

সেই ঝোপের আড়াল থেকে দু’জনে যা বললেন, তা হল, লরির ড্রাইভার একটু বেসামাল ছিল। দুটো লরিতে খুব লড়ালড়ি হচ্ছিল। এ একবার ওভারটেক করে তো ও একবার। আর মেজোমামা নাকি শাবাস-শাবাস করে খুব উত্তেজিত করছিলেন। বলছিলেন, লাগাও, লাগাও, রসগুল্লা খিলায়গা, চমচম খিলায়গা। কিছুক্ষণের মধ্যে দ্বিতীয় লরিটা ডান দিক থেকে এমন চেপে দিলে, মেজোমামাদের লরিটা টাল খেয়ে সোজা রাস্তার নীচে মাঠে। চিতপটাং। চিতপটাং অবধি মনে আছে, তারপর একটা গ্যাপ। মনে নেই। এর পর, কত রাত কে জানে, দু’জনে মাঠে পড়ে আছেন পাশাপাশি। শুধু শরীরটাই আছে, ধড়াচূড়া সব গেছে। শরৎকাকুর চোখে দামি বিলিতি ফ্রেমের চশমা ছিল, সেটা গেছে। সব ধোঁয়া-ধোঁয়া দেখছেন।

আমাদের দেখে অপরেশকাকু পানাগড় বাজার থেকে জামাকাপড়, চটি সব কিনে আনলেন। বড়মামার কী আনন্দ! বললেন, ‘মেজো, অতিচালাকের গলায় দড়ি। সুখের সন্ধানে আমাদের পথের পাশে ফেলে রেখে হাঁচোড়পাঁচোড় করে লরিতে উঠলি। ওরে! ভগবান আছেন। আমরা রাতে রাজপ্রাসাদে মখমলের বিছানায়, পেটে রাজভোগ। ওরে! গুরুজনকে রঙ্গব্যঙ্গ করলে শাস্তি পেতেই হয়।’

দু’জনে ঝোপের আড়াল থেকে সেজেগুজে বেরিয়ে এলেন। ভালো করে একটা চান দরকার। চুলে, মুখে, হাতে শুকনো মাটি, ধুলো, গাড়ির কালি।

শরৎকাকু জিগ্যেস করলেন, ‘দেবতার মতো এই ভদ্রলোকটি কে?’

বড়মামা বললেন, ‘আমাদের পরমাত্মীয়। আমাদের পরম প্রিয়জন।’

‘অর্থাৎ!’

‘অর্থাৎ! বড়মামা দু’হাত তুলে নাচতে লাগলেন,

‘কুসি যাবে শ্বশুরবাড়ি সঙ্গে যাবে কে?

ঝোপে বসে বুড়ো দুটো পাজামা পরেছে।।’

একঝাঁক শালিক পাখি মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। সেই বাচ্চাটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। একগাল হেসে বললে, ‘বাবু, দুটোকে সুন্দর দেখাচ্ছে গো!’

বড়মামা তার হাতে কুড়িটা টাকা দিয়ে বললেন, ‘গোপাল, মিষ্টি খেয়ো।’

ফেরার পথে বড়মামা বেশ উল্লাসে গান ধরলেন, ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে…।’

মেজোমামা বললেন, ‘সিনেমা বুঝি শেষ হল, জাতীয় সঙ্গীত হচ্ছে!’