» » » মহাপ্রস্থান

বর্ণাকার

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

মামা সমগ্র
উপন্যাস

মহাপ্রস্থান

এক

এখন দু’জনকেই সামলানো দায়। মাসিমা শ্বশুরবাড়িতে। দুই মামার পোয়া বারো। যখন যা প্রাণ চাইছে, তাই করছেন। আজ ভোর চারটেয় ঘুম ভাঙছে, তো কাল দশটায়। রোজ রাত বারোটার আগে কারো খাওয়ার ইচ্ছেই করে না। তারপর রাত দুটো-আড়াইটে পর্যন্ত গজর গজর। চোরেরা এই বাড়িটাকে তাদের লিস্ট থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছে।

দু’জনের এখন খুব ভাব। মাসিমা যখন ছিলেন, তখন কথায় কথায় লেগে যেত। এখন একেবারে হরি-হর আত্মা। এ বলছে মেজো, তো ও বলছে বড়। পরামর্শ ছাড়া কোনও কাজই হয় না। বাড়িতে যিনি রান্না করেন, বামুনদি, তিনি যদি জিগ্যেস করেন, বড়দা, আজ কী রান্না হবে! বড়দা অমনি বললেন, দাঁড়াও মেজোকে জিগ্যেস করি। এইবার বড়তে, মেজোতে আধঘণ্টা শলা-পরামর্শ হবে। দু’জনেরই পছন্দের খাবারের বিরাট লিস্ট হবে, দশ-বারোটা পদ। তারপরে দেখা যাবে, খাওয়ার সময় দু’জনেই বেপাত্তা। মেজো কলেজ স্ট্রিটের পুরনো বইয়ের দোকানে সিন্ধু সভ্যতার ইতিহাসে মশগুল। বড় ডাক্তার, তিনি কোনও গোপ্পে গুরি বাড়ি, নাড়ি টিপে, মাছ ধরার গল্প করেই যাচ্ছেন, করেই যাচ্ছেন। ঘড়ি, সময়, দিন রাত, এ-সবের কোনও তোয়াক্কা নেই।

মেজোমামা যদি একবার ক্রশওয়ার্ড নিয়ে বসেন, হয়ে গেল। পাশে তিনখানা ডিকশনারি। বড়মামা যদি মেডিকেল জার্নাল নিয়ে বসেন, রাত কাবার।

মাসিমা থাকলে, এই সব চলত না। এতটা বাড়াবাড়ি তিনি সহ্য করতেন না। কাগজপত্র ছোড়াছুড়ি করে, চিৎকার-চেঁচামেচি করে, আলো নিবিয়ে দু’জনকেই মশারির মধ্যে। সবশেষে বলতেন, দেখি, কে ফার্স্ট হয়। মানে, কে আগে ঘুমোয়, বড় না ছোট। মেজোমামাই ফার্স্ট হতেন। বালিশে মাথা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাপরের মতো শ্বাস-প্রশ্বাস। বড়মামা সহজে ঘুমোতে পারেন না। এপাশ, ওপাশ, চিৎ, উপুড়। আমি বড়মামার পাশেই শুই। সবশেষে আমার সঙ্গে দুষ্টুমি। এই কাতুকুতু দিচ্ছেন। এই চিমটি কাটছেন। শেষে বিরক্ত হয়ে আমাকে বলতে হত, মাসিমাকে ডাকব?

মাসিমার ভয়ে বড়মামা লক্ষ্মীছেলের মতো ঘুমিয়ে পড়তেন।

এখন মাসিমা তো নেই। কাকে ডাকব শাসন করার জন্যে। বল্গাহীন উৎপাত রাত ঠিক একটা। আমাদের খাওয়া শেষ হল। পাড়ার লোকের এখন মাঝরাত্তির। খাওয়া মানে যে-সে খাওয়া নয়। চর্বচষ্য-লেহ্যপেয়। দু’জনেই এখন দোতলার দক্ষিণের বারান্দায়। ইজি চেয়ারে একটু বিশ্রাম করছেন। সামনে গাছ-পালা, ফাঁকা মাঠ, দূরে একটা ঝিল। ঝিলের কিছুটা দূরে রেল লাইনে। একটা ট্রান্সমিশান টাওয়ার। মাথার ওপর লাল আলো। আরও দূরে একটা বড় ফ্যাকট্রি—অন্নপূর্ণা রোলিং মিল। দিন রাত কাজ হয়। দক্ষিণের বাতাসে শব্দ ভেসে আসছে। লোহার রড তৈরির ঝড়াং ঝড়াং শব্দ। যে-সব নক্ষত্রমণ্ডলী আকাশের মাথায় ছিল, তারা সব পশ্চিমে ঢলতে শুরু করেছে। আমিও একপাশে বসে বসে ঢুলছিলুম।

হঠাৎ কানে এল বড়মামা বলছেন, ‘কাজটা ঠিক হচ্ছে না।’

মেজোমামা গম্ভীর গলায় অভিভাবকের মতো বললেন, ‘ঠিক করে করার চেষ্টা কর।’

বড়মামা জিগ্যেস করলেন, ‘কোন কাজের কথা বলছি বল তো।’

‘যে কোনও কাজ, এনি ওয়ার্ক, ঠিক করে করা উচিত। মনে নেই, সেই কোন ছেলেবেলার আমরা পড়েছি, কেন পারিবে না তাহা ভাব একবার। পাঁচজনে পারে যাহা, তুমিও পারিবে তাহা।’ মেজোমামা হাঁউমাউ করে হাই তুললেন।

বড়মামা বললেন, ‘কিস্যু বোঝোনি। আমি বলছি, এত রাতে, এত খাওয়াটা ঠিক নয়। প্রথমত নটার মধ্যে খাওয়া উচিত।’

‘শিশুরা খাবে। বড়দের জন্যে সময় অনেকটা বাড়ানো আছে।’

‘দ্বিতীয় কথা, রাতের খাওয়া হবে লাইট। ভেরি লাইট।’

‘ইন্ডিয়ান নিয়ম। আমেরিকান নিয়ম উলটো। দিনে লাইট, রাতে হেভি। বেশ জমিয়ে গুছিয়ে, কবজি ডুবিয়ে খাওয়া।’

‘স্বাস্থ্যের তৃতীয় নিয়ম, আফটার সাপার ওয়াক এ মাইল।’

‘নিয়ম বদলে গেছে। এখন বলছে, খাওয়ার পরই অজগর হয়ে যাও। টেনে ঘুম।’

বড়মামা আক্ষেপের গলায় বললেন, ‘কিন্তু ভাই দিন দিন ভুঁড়ি বাড়ছে। এই রেটে বাড়লে, সবাই বলবে, কুমড়ো পটাশ।’

‘মোটার জন্যে তুমি স্কিপিং করতে পার।’

‘এই শরীরে স্কিপিং! একমাত্র চাঁদে গেলে আমার পক্ষে স্কিপিং সম্ভব। সেখানে গ্র্যাভিটি নেই।’

মেজোমামা বললেন, ‘খুব আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।’

‘সে তো হচ্ছেই। অকারণে এত খাওয়া। এর হাফ খেলেই আমাদের হয়ে যায়!’

‘আমি সে-ক্ষতির কথা বলছি না। আমি বলছি, সমস্ত জামা-প্যান্ট ছোট হয়ে যাচ্ছে সপ্তাহে সপ্তাহে।

‘এ তো আমারও সমস্যা। আমি প্রবলেম সলভ করে ফেলেছি।’

‘কীভাবে করলে? ইলেকট্রনিকস দিয়ে?’

‘আরে না রে বাবা। মাদ্রাজি কায়দায়। ধুতি দু-ভাঁজ করে লুঙ্গির মতো করে পরছি। ভুঁড়ি তুই কত বাড়বি বাড়।’

মেজোমামা বললেন, ‘ওটা কোনও সলিউশান হল না। আমি কি ভাবছি জান, চলো আমরা পাহাড়ে যাই, একেবারে হিমালয়ে।’

বড়মামা লাফিয়ে উঠলেন, ‘আঃ, একেবারে আমার মনের কথা। ছেলেবেলা থেকেই আমার খুব ইচ্ছে, এভারেস্টে উঠব, সাউথ কল দিয়ে।’

‘আর আমার কী ইচ্ছে জান, মহাপ্রস্থানের পথ ধরে হিমালয়ে যাব। নো বাস, নো ট্রাম।’

‘বেশ, তাহলে চলো, বেরিয়ে পড়া যাক। আমি এভারেস্ট। তুই মহাপ্রস্থান।’

আমার ঘুম ছুটে গেল। রাত দুটোর সময় এরা বলে কী। আর এদের আমি চিনি। বলা মানেই করা। আমি বললুম, ‘আমাকে একা ফেলে রেখে তোমরা চলে যাবে?’

বড়মামা বললেন, ‘তুই এটা ভাবলি কী করে? তোকে ফেলে রেখে চলে যাব! তুইও যাবি আমাদের সঙ্গে।’

‘তোমার তিনটে জার্সি গরু, দশটা দশ জাতের কুকুর, তিন খাঁচা পাখি, তাদের কে খাওয়াবে?’

বড়মামা একগাল হেসে বললেন, ‘সে কি আর আমি ভাবিনি ভাগ্নে। অনেক ভেবে মাথা থেকে প্ল্যান বার করেছি। কোনও ক্যাটারিং কোম্পানিকে বলব, তারা এসে খাইয়ে যাবে। গরুদের দেবে জাবনা, কুকুরদের মাংস, ভাত। পাখিদের দানা।’

মেজোমামা সন্দেহ প্রকাশ করলেন, ‘এরকম কোনও ক্যাটারার আছে বলে মনে হয় না।’

বড়মামা বললেন, ‘খোঁজ নেব।’ আধুনিক পৃথিবীতে সবই থাকে।’

আমি বললুম, ‘মাসিমাকে রিকোয়েস্ট করলে কেমন হয়। যদি এসে কয়েকদিন থাকেন।’

বড়মামা, মেজোমামা, দু’জনেই হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘খবরদার, খবরদার। কোনওভাবে যেন জানতে না পারে, তাহলে সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে।’