» » » গুপ্তধনের সন্ধানে

বর্ণাকার

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

মামা সমগ্র
উপন্যাস

গুপ্তধনের সন্ধানে

রাত তখন কটা হবে কে জানে। চারপাশে ছটফট করছে চাঁদের আলো। হু হু করে বাতাস বইছে। দক্ষিণের জানলায় লতিয়ে ওঠা জুঁই গাছ দুলে দুলে উঠছে। বড়মামা বলছেন, ‘ওঠ ওঠ, উঠে পড় শিগগির। ভীষণ ব্যাপার।’ বিছানায় উঠে বসলুম। ঘুমের ঘোর তখনও কাটেনি। ঘরে তখনও নীল আলো জ্বলছে।

একই বিছানায় বড়মামা গ্যাঁট হয়ে বসে আছেন। বুকের ওপর আড়া-আড়ি পড়ে আছে মোটা সাদা পইতে। নীল আলোয় আরও সাদা দেখাচ্ছে। এক ঝলক চাঁদের আলো নাইলনের মশারি গলে বিছানায় আমাদের পাশে শুতে এসেছিল।

চোখ রগড়াতে রগড়াতে জিগ্যেস করলুম, ‘কী হয়েছে বড়মামা? চোর এসেছে?’

‘আরে না রে না, চোর আসবে কোন দুঃখে। ছ’টা ছ’রকমের কুকুর ছ’দিকে পাহারা দিচ্ছে। এলে চোরের নাম ভুলিয়ে দেবে।’

‘তবে?’

‘স্বপ্ন দেখেছি রে বোকা। ভীষণ এক স্বপ্ন।’

‘বাঘ?’

‘বাঘ নয়। গুপ্তধন।’

‘কোথাকার গুপ্তধন? আফ্রিকার?’

‘আজ্ঞে না, এই বাড়িতে। রাশি রাশি গুপ্তধন। নে ওঠ, উঠে পড়।’

‘আজই উদ্ধার করবেন?’

‘একদম বকবক করবি না। ভুলে যাবার আগে স্বপ্নটাকে আবার তৈরি করতে হবে।’

‘স্বপ্ন আবার তৈরি করা যায় নাকি?’

‘আবার প্রশ্ন?’

‘বাঃ, আপনিই তো সেদিন বললেন, প্রণিপাতে পরিপ্রশ্নেন সেবয়া।’

‘মূর্খ, সেটা হল ধর্মশিক্ষার সময়। বেদবেদান্তের বেলায়। এখন যা বলি তাই কর।’

বড়মামা মশারি তুলে মেঝেতে নামলেন। পেয়ারের কুকুর লাকি সোফার ওপর ঘুমোচ্ছিল, সেও অমনি তড়াক করে লাফিয়ে নেমে পড়ে অ্যায়সা গা ঝাড়া দিল, তাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে উলটে পড়ে গেল। আবার সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ল। ছোট্ট একটা ডন মেরে নিল। ভেবেছে ভোর হয়েছে। ভোর হতে এখনও অনেক দেরি। সবে রাত পৌনে তিনটে।

বড়মামা ইজিচেয়ার পাতলেন।

‘ইজিচেয়ার কী হবে বড়মামা?’

‘স্বপ্নে ছিল।’

‘এই যে বললেন গুপ্তধন ছিল।’

‘চুপ। একটাও কথা নয়। স্বপ্ন ভুল হয়ে যাবে। যা বলি মুখ বুজে করে যাও। এই আমি ইজিচেয়ারে বসলুম।’

বড়মামা যেই বসলেন, লাকি কোলে উঠে পড়ল। নামাতে গেলুম, বড়মামা বললেন, ‘থাক থাক, আমার স্বপ্নে ছিল। তুমি ওই দরজার সামনে দাঁড়াও।’

নির্দেশ পালন করতেই বড়মামা বললেন, ‘ভেরি গুড, তুমি হলে মা লক্ষ্মী। তা হলে এই হল গিয়ে তোমার স্বপ্নের ফার্স্ট পার্ট। আমি ইজিচেয়ারে বসে লাকির গায়ে হাত বুলোচ্ছি। বেশ, এই আমি হাত বুলোলুম। দরজার কাছটা হঠাৎ আলোয় আলোকময় হয়ে উঠল। চমকে তাকাতেই তোমাকে দেখলুম।’

‘আমাকে?’

‘আহা, তোমাকে কেন দেখব? দেখলুম মা লক্ষ্মীকে। দরজার সামনে ঝলমল করছেন। তুমি কি ঝলমল করছ? ম্যাড়ম্যাড় করছ। জিগ্যেস করলুম, ‘মা, আপনি কে? উত্তর দিন।’

‘বাবা সুধাংশু, আমি মা লক্ষ্মী, আমাকে চিনতে পারছ না?’

‘ভেরি গুড। ভেরি গুড। অবিকল মা লক্ষ্মী আমাকে এই কথা বলেছিলেন।’

‘তুই কী করে জানলি?’

‘তা জানি না।’

‘মনে হয় মা তোর ওপর ভর করেছেন। আচ্ছা, এরপর মা কী বললেন বল তো?’

‘আমাকে চিনতে পারলে না বাবা সুধাংশু। আমাকে তুমি ঠাকুরঘরের পটে রোজই দেখ। তোমার সাধনায় আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। কী বর চাও বলো?’

‘আঃ ভেরি গুড, ভেরি গুড। ঠিকই প্রায় বলেছ, তবে শেষটায় একটু গণ্ডগোল করে ফেলেছ। মা রেগে বললেন, ‘ব্যাটা আমাকে তুই চিনবি কী করে? কাজের সময় কাজি, কাজ ফুরোলেই পাজি। গাড়ি কেনার সময় রোজ আমার পটের সামনে দাঁড়িয়ে মাথা ঠুকতে, মা আরও চারটি রুগি এনে দাও, রুগি এনে দাও। মায়ের প্রাণ। সন্তান চাইছে রুগি। ফেরাই কী করে। ঝাঁক-ঝাঁক প্যাঁচা ছেড়ে দিলুম। ফসল খেয়ে ফাঁক করে দিলে। রেশনে পচা চাল এল। খেয়ে সব কাত। তোর রুগি বেড়ে গেল। এখন আর আমাকে চিনবে কেন?’

‘আমি অমনি দুম করে লাকিকে কোল থেকে নামিয়ে দিলুম।’

বড়মামা সত্যি সত্যিই লাকিকে কোল থেকে নামিয়ে দিলেন। ইজিচেয়ারে মানুষ একবার ঢুকলে সহজে শরীর বের করতে পারে না। ওঠার সময় হাঁচরপাঁচর করতে হয়। বড়মামা কোনও রকমে উঠে দাঁড়ালেন। দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, ‘আমি তখন মাকে বললুম, মা, পায়ের ধুলো দাও মা, এ দীনের অপরাধ তুমি মার্জনা করো মা। এমনি ভাবে নিচু হয়ে মায়ের পায়ের ধুলো নিতে গেলুম।’

বড়মামা ঝুঁকে পড়ে আমার পায়ের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন।

‘আপনি আমার পায়ের ধুলো নেবেন নাকি?’

সামনে ঝুঁকে থাকা অবস্থাতেই বড়মামা বললেন, ‘ধ্যার বোকা, ধুলো নেবার আগেই তো মা অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তুইও অদৃশ্য হয়ে যা।’

‘আমি কী করে অদৃশ্য হব? আমি কি স্বপ্ন?’

‘গাধা। তুই দরজা খুলে ছাদে চলে যা। চট করে যা। কতক্ষণ নিচু হয়ে থাকব? কোমর টনটন করছে।’

‘কতদূরে যাব বড়মামা?’

‘দরজার পাশে লুকিয়ে থাকবে।’

নির্দেশমতো ছাদের দরজা খুলে পাশে জুঁইগাছের কাছে গা-ঢাকা দিয়ে রইলুম। লুকিয়ে লুকিয়ে উঁকি মেরে দেখছি, বড়মামা সামনে আর একটু ঝুকে পড়েই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘এ কী মা, তুমি গেলে কোথায়? মা, মা!’

আড়াল থেকে আমি বললুম, ‘এই যে আমি এইখানে বাবা সুধাংশু।’

স্কুলের থিয়েটারের ডায়ালগ আজ খুব কাজে লেগে যাচ্ছে। বড়মামা কিন্তু ঘর থেকে তেড়ে বেরিয়ে এলেন, ‘কে তোকে উত্তর দিতে বলেছে! স্বপ্নে মা কি আমায় উত্তর দিয়েছিলেন? মা তো অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন।’

বড়মামা রেগে গিয়ে গজগজ করতে লাগলেন। আমি কী করে জানব? স্বপ্ন কি আমি দেখেছি, না মামা দেখেছেন। আগে থেকে রিহার্সাল দেওয়া না থাকলে অভিনয়ে গোলমাল তো হবেই।

বড়মামা বললেন, ‘এইরকম উলটোপালটা করলে স্বপ্ন তৈরি করা যায় না। বারে বারে তুই আমার ভাব নষ্ট করে দিচ্ছিস। দু’একটা উত্তর শুনে ভেবেছিলুম তোর ওপর মা বোধহয় ভর করেছেন। এখন দেখছি সব বোগাস।’

ধমক খেয়ে জুঁইগাছের পাশে মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। ঠিক আছে। নিজের থেকে আর কিছু করব না। এবার যা বলবেন তাই করব।

বড়মামা দরজার বাইরে চোখ বুজিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, আমি ছাদে এই জায়গাটায় এসে দাঁড়ালুম, হ্যাঁ দাঁড়ালুম। তারপর কী হল। মা অদৃশ্য হয়েছেন। চাঁদের আলোয় ফিনিক ফুটছে। কেউ কোত্থাও নেই। ভীষণ ভয় করছে। হঠাৎ এই যে, ওই তো ওইখানে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি দেখতে পেলুম। স্পষ্ট দেখলুম। চাঁদের আলোয় মা আমার ঝমঝম করে উঠলেন। কিন্তু কোনদিকে?

বড়মামা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কোনদিকে বল তো? স্বপ্নে যে দিক ঠিক থাকে না। সব কিছু কেমন যেন খাপছাড়া হয়ে ছড়িয়ে থাকে।’

একটু আগে ধমক খেয়েছি। অভিমান হয়েছে। আমি বললুম, ‘আপনার স্বপ্ন আমি কেমন করে বলব?’

‘রাগ করছিস কেন? একটু সাহায্য কর না। গুপ্তধন পেয়ে গেলে হিমালয়ে গিয়ে একটা পাহাড় কিনব। বরফ-ঢাকা পাহাড়। সেই পাহাড়ে টানেল কেটে একটা আধুনিক গুহা বানাব। সেই গুহায় সবকিছু থাকবে। রেডিও, রেকর্ড প্লেয়ার, টিভি, লাইব্রেরী, গরম জল, ঠান্ডা জল, একটা হেলিপ্যাড, হেলিকপটার। আমেরিকা থেকে ইঞ্জিনিয়ার আনিয়ে জেমস বণ্ড ছবির কায়দায় সব তৈরি করাব। একটু সাহায্য কর না রে। পেয়ে গেলে তোর আর আমার দুজনেরই বরাত ফিরে যাবে। তোর এই ঘ্যানর ঘ্যানর পড়া আর আমার ওই রোজ ছুঁচ ফোটানো, সব ছেড়ে মনের আনন্দে হিমালয়ে গিয়ে উঠব। চমরিগাইয়ের দুধ চিনি দিয়ে মেরে ঘন করে পাথরের বাটিতে ঢেলে বরফের গর্তের মধ্যে রেখে দোব। জমে আইসক্রিম। রোজ আমরা কাপ কাপ আইসক্রিম খাব। পাহাড়ের গা বেয়ে কাবুল ফেরিঅলারা হেঁকে যাবে, হিং চাই সুর্মা। সঙ্গে সঙ্গে দশ কেজি বারো কেজি আখরোট, কিশমিশ, খুবানি, মনাক্কা, বাদাম কিনে নোব। আইসক্রিমে একবারে গিজগিজে করে দোব। বল না রে কোনদিকে! এদিকে না ওদিকে?’

‘আচ্ছা, মা লক্ষ্মী যেদিকে দাঁড়িয়েছিলেন, সেদিকে আর কিছু কি ছিল? পেছনে, সামনে পাশে, মাথার ওপর?’

‘দাঁড়া, ভেবে দেখি। হ্যাঁ, মাথার ওপর এ্যাসবেসটাসের চালের একটা অংশ চাঁদের আলোয় ঝলমল করছিল তারই ছায়া পড়েছিল মায়ের মুখে।’

‘ব্যস, আর বলতে হবে না। পেয়ে গেছি। ওই যে ওই জায়গাটায়। ঠাকুরঘরের পাশে তুলসীগাছের টবের কাছে।’

‘উঃ তোর মাথা বটে। ঠিক বলেছিস। আচ্ছা, ওখানে গিয়ে একবার দাঁড়া তো! দূর থেকে দেখি।’

‘বড়মামা, আপনি এত সব করছেন কেন? মা লক্ষ্মী কী বললেন, সেইটা মনে পড়লেই তো হয়ে গেল।’

‘অ্যায়, ওই জন্যেই তোর ওপর রাগ হয়ে যায়। তুই কখনও গাধা কখনও পণ্ডিত। মা লক্ষ্মী ছাদে দাঁড়িয়ে বললেন, এদিকে আয়।’

‘কাছে গেলুম। বললেন, তোদের বাড়িতে গুপ্তধন আছে।’

আমি বললুম, ‘কোথায় আছে মা?’

‘হাসি-হাসি মুখে যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন তার পাশের দেয়ালে হাত রেখে বললেন, এই লিখে দিলুম।’

‘কী লিখলেন মনে আছে?’

‘মনে হয়, মনে হয়—’

‘মনে করুন, মনে করার চেষ্টা করুন।’

‘মনে হয়, মনে হয়—’ বড়মামা ঘাড় চুলকোতে লাগলেন। ‘মনে হয় লিখলেন, ক, খ, গ, ঘ। ওই জায়গায় চল তো, দেখি সত্যিই কিছু লেখা আছে কিনা!’

আমরা দু’জনে ঠাকুরঘরের কাছে গেলুম। ছাদে যেন দুধের মতো চাঁদের আলোর ধারা বইছে। ঠাকুরঘরের দেয়ালে অনেকদিন আগে বালির কাজ করা হয়েছিল। বছরখানেক হল রঙ পড়েছে। দেয়ালে কোথাও কোনও লেখা নজরে পড়ল না। বড় ইচ্ছে ছিল মা লক্ষ্মীর হাতের লেখা দেখব।

বড়মামা ভীষণ হতাশ হয়ে বললেন, ‘কী হল বল তো? জায়গাটা মনে হয় ঠিক হল না।’

‘স্বপ্ন কি আর সত্যি হয় বড়মামা, তা হলে পরীক্ষার আগে স্বপ্নে যেসব প্রশ্ন দেখি তার একটাও অন্তত আসত।’

বড়মামা আবার রেগে গেলেন, ‘তুমি ঘোড়ার ডিম জানো। লিঙ্কন স্বপ্ন দেখে মারা গিয়েছিলেন।’

‘হ্যাঁ, কোথায় যেন পড়েছি।’

‘পড়েছ যখন তখন অবিশ্বাস করছ কেন? ইংল্যাণ্ডে জে ডব্লু ডান নামের এক ভদ্রলোক ছিলেন, জানো কি?’

‘আজ্ঞে না।’

‘তাহলে স্বপ্নকে অবিশ্বাস করছ কেন?’

‘তিনি কে ছিলেন?’

‘একজন ইনজিনিয়ার। যা-তা নয়, উড়োজাহাজের ইনজিনিয়ার, বিজ্ঞানী। তিনি একদিন স্বপ্ন দেখলেন তাঁর হাতঘড়িটা রাত সাড়ে চারটের সময় বন্ধ হয়ে গেছে। পরের দিন সকালে উঠে দেখলেন, সত্যিই তাই—ঘড়ি সাড়ে চারটে বেজে অচল হয়ে আছে। কী বুঝলে, তোমার কিছু বলার আছে?’

‘আজ্ঞে না।’

‘সেই ডানসায়েব আর-একদিন স্বপ্ন দেখলেন, পৃথিবীর কোথাও একটা আগ্নেয়গিরি জেগে উঠেছে, শত শত লোক লাভাস্রোতে পুড়ে মারা গেছে। মৃতের সংখ্যা চার হাজার। তিনি স্বপ্নে খবরের কাগজের হেডলাইনও পড়ে ফেলেছিলেন। পরের দিন কাগজ খুলেই চমকে উঠলেন, প্রথম পাতার খবর বড় বড় অক্ষরে হেডলাইন, মার্টিনিতে অগ্ন্যুদ্গার, মৃত চার হাজার। পরের দিন আবার ভ্রম সংশোধন—মৃত চার নয়, চল্লিশ হাজার। তার মানে স্বপ্নে কাগজ পড়ার সময় ডান চল্লিশকে চার হাজার পড়েছেন, শূন্যের গোলমাল। কিছু বলার আছে?’

‘আজ্ঞে না।’

‘তা হলে?’

‘তা হলে আমার কী মনে হচ্ছে জানেন, কিছু কিছু লেখা আছে যা জলে ভেজালে তবেই পড়া যায়। মা লক্ষ্মী মনে হয় সেই রকম কোনও কালি ব্যবহার করেছেন। দেয়ালটাকে জলে ভেজালে তবেই পড়া যাবে।’

‘আঃ, সাংঘাতিক বলেছিস। তোর মাথাটা আমি বাঁধিয়ে রেখে দোব।’

ঘড়াস করে একটা শব্দ হল। বড়মামা চমকে উঠলেন। ছাদের ও-মাথায় মেজোমামার ঘর। দরজার ছিটকিনি খুলে বাইরে এলেন। ঘরে আলো জ্বলছে। বড়মামা ঠোঁটে আঙ্গুল রাখলেন, মানে একটাও কথা নয়। মেজোমামা কবি মানুষ। দু’পাশে দু-হাত মেলে চাঁদের আলো ধরছেন। সাবান মাখার মতো গায়ে মাখছেন। বড়মামা বললেন, ‘গুঁড়ি মেরে মেরে ঘরে চলো। দেখতে না পায়।’

মেজোমামা বলছেন, ‘কে, কে ওখানে?’

আর কে! আমরা ঘরে ঢুকে দরজা দিয়ে দিয়েছি। লাকিটা তিন লাফে ঘরে এসে নিজের জায়গায় শুয়ে পড়েছে।

সকাল বেলায় চায়ের টেবিল।

আমার মেজোমামা সব সময় ফিটফাট। চোখে ইয়া মোটা পুরু ফ্রেমের চশমা। দু’পায়ের মাঝে চটির ওপর পাখার মতো ছড়িয়ে পড়ে আছে দিশি ধুতির কোঁচা। সামনে বোতাম লাগানো, হাফ হাতা, গোলগলা গেঞ্জি। ধবধব করছে সাদা। পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল।

মেজোমামা চেয়ারে এসে বসেছেন। কোলের ওপর খবরের কাগজ। মুখ তোলার অবসর নেই। টেবিলে কাপ ডিশ চামচ এসে গেছে। চিনির পাত্র, দুধের পাত্র এসে গেছে, চা এল বলে। বড়মামার দেখা নেই। অন্যদিন বড়মামাই আগে এসে বসেন, আর দানা দানা চিনি খান। আমি জানতুম আজ আসতে একটু দেরি হবে। আমি এখন বড়মামার গুপ্তচর হয়ে বসে আছি। মেজোমামার গতিবিধির দিকে নজর রাখছি। নড়াচড়া কি ওঠার চেষ্টা করলেই যে-কোনও একটা পড়ার প্রশ্ন করব। এই ঘরে মেজোমামাকে যেমন করেই হোক আটকে রাখতে হবে। বড়মামা এখন দেয়াল জল দিয়ে ভিজোচ্ছেন। সত্যিই যদি ক, খ, গ, ঘ লেখা ফুটে ওঠে, তা হলে আজ রাত থেকেই শুরু হয়ে যাবে গুপ্তধন খোঁজার কাজ।

মেজোমামা কাগজ থেকে মুখ তুলে এদিক-ওদিক তাকালেন। খুবই সন্দেহজনক। হঠাৎ না উঠে পড়েন! মাসিমা কী করছেন। চা এসে গেলে বাঁচা যায়। কড়া নিয়ম। পাঁচ মিনিট ভিজবেই। মেজোমামা উঠে দাঁড়ালেন।

‘কী হল মেজোমামা?’

‘চায়ের এখনও দেরি আছে মনে হচ্ছে। যাই, আর একটা কাজ ততক্ষণ সেরে আসি।’

‘না, না, দেরি নেই। এখুনি আসবে।’

‘কী করে জানলে? চা তো তুমি কর না, চা করে কুসি।’

‘মেজোমামা, একটা জিনিস আমার খুব খারাপ লাগে।’

‘কী জিনিস?’

‘বসুন বলছি।’

‘আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই শুনব। তুমি বলো।’

‘এই বড়মামা, প্রায়ই আপনার কবিতা নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করেন।’

‘কী বলে?’

ব্যস ওষুধ ধরে গেছে। মেজোমামা বসে পড়লেন, ‘কী, বলে কী?’

‘বলেন, রবীন্দ্রনাথের পর কবিতা লেখার চেষ্টা করাটাই অন্যায়। কিছুই হয় না, শুধু শুধু পণ্ডশ্রম। গোরুর জাবরকাটার মতো।’

‘আচ্ছা, তাই নাকি? উনি এবার ডাক্তারি ছেড়ে কাব্যসমালোচক হলেন। এর নাম কী জান? অনধিকারচর্চা। শুনবে তা হলে আমার একটা কবিতা! কাল সারারাত ধরে লিখেছি। দাঁড়াও, খাতাটা নিয়ে আসি।’

মরেছে রে! এইবার আমি কী করি! মেজোমামা চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছেন।

‘মেজোমামা, আপনি বসুন, খাতা আমি নিয়ে আসছি।’

‘তুমি খুঁজেই পাবে না। সে আমি এক গোপন জায়গায় রেখে এসেছি।’

‘আমাকে বলে দিন, ঠিক নিয়ে আসব। আপনি আবার ওপরে উঠবেন, আবার নীচে নামবেন, কী দরকার!’

‘কেন, আমি কি বুড়ো হয়ে গেছি? গোটা দুয়েক চুল পাকলে মানুষ বুড়ো হয়ে যায়! ঘোড়ার ডাক্তারের ওসব কথায় কান দিও না, পরকাল ঝরঝরে হয়ে যাবে।’

আর বোধহয় মেজোমামাকে আটকানো গেল না, দরজার কাছে চলে গেছেন। বড়মামার এজেণ্ট হিসেবে একেবারে ফেল করেছি। যাক ভগবান বাঁচালেন। বড়মামা আসছেন। এবার মেজোমামা যেখানে খুশি যেতে পারেন। মেজোমামা বড়মামার পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে মুখের দিকে তাকিয়ে ফুঃ করে একটা শব্দ করলেন। বড়মামা তেমন খেয়াল করলেন না। নিজেই আনন্দেই মশগুল। ঘরে ঢুকে বললেন, ‘পেয়ে গেছি, একেবারে স্পষ্ট। স্বপ্ন আমার কোনও দিন মিথ্যে হয়নি, সেই ছেলেবেলা থেকে, স্বপ্ন দেখলুম মাসিমার সিকেতে পুলিপিঠে ঝুলছে। স্পষ্ট স্বপ্ন, যেন কড়িকাঠ থেকে টিকটিকি হয়ে ঝুলতে ঝুলতে দেখছি। স্কুল থেকে ফেরার পথে গিয়ে দেখি, ঠিক তাই।’

‘কালির লেখা বড়মামা?’

‘মা লক্ষ্মী কালি কোথায় পাবেন। প্লাস্টারে সব চুলের মতো ফাটল ধরেছে। অলৌকিক ফাটল। যেই জল পড়ল অমনি স্পষ্ট ফুটে উঠল, ক, খ, গ, ঘ। কাউকে বলবি না। টপ সিক্রেট।’

‘মেজোমামাকে আটকাতে পারছিলুম না, তাই আপনার নাম করে রাগিয়ে এতক্ষণ ধরে রেখেছিলুম। এইমাত্র হাতছাড়া হয়ে পালালেন। এখুনি আসছেন কবিতা শোনাতে।’

‘উঃ, সর্বনাশ করেছে। এর চেয়ে ছেড়ে দেওয়াই ভালো ছিল রে। কী বলেছিস?’

‘সেই রবীন্দ্রনাথ আর এখনকার কালের কবিতা।’

‘অন্যায় কি বলেছিস? হেঁকে বল। মাইক নিয়ে বল।’

চা নিয়ে মাসিমা, খাতা নিয়ে মেজোমামা প্রায় একই সঙ্গে ঢুকলেন। মেজোমামা খাতা খুলে পড়তে শুরু করলেন—

দিন শেষ হলে রাত আসে

রাত শেষ হলে দিন আসে

আকাশের চাকা অহরহ

ঘুরেই চলেছে, ঘুরছে॥

বড়মামা কাপের গায়ে চামচে দিয়ে টাং করে একটা শব্দ করে বললেন, ‘আহা, অহো!’ তারপর নিজেই চারটে লাইন বানিয়ে ফেললেন—

জল জমলে মশা বাড়ে

মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া

কুইনিন খেলে জ্বর ছাড়ে

বড় হয়ে ওঠে পিলে॥

মেজোমামা বললেন, ‘ওটা একটা কবিতা হল?’

‘তোমারটা যদি হয়ে থাকে, আমারটাও হয়েছে, পরিষ্কার মানে, নিখুঁত অন্ত্যমিল।’

‘আর আমারটা?’

‘তোমারটা পাগলের প্রলাপ ভাই। বিকারের রুগির প্রলাপ, অনেকটা এই রকম—

চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে

ভূতেরা বেগার খেটে মরে

হাত ঘুরলে নাড়ু পাবে

নইলে নাড়ু কোথায় পাবে॥’

মাসিমা বললেন, ‘মরেছে, সাতসকালেই শুম্ভনিশুম্ভ শুরু হল। পয়সা থাকলে দুটোকেই আমি হস্টেলে পাঠিয়ে দিতুম।’

মেজোমামা বললেন, ‘দ্যাখো দাদা, সমালোচনা মানে ব্যঙ্গ করা নয়। কবিতার তুমি কী বোঝ হে! পরের চারটে লাইন শুনলে তোমার সন্ন্যাসী হয়ে যেতে ইচ্ছে করবে—

জাঁতায় পড়েছে মানুষ

অহঙ্কারের ফানুস

জীবনের চাপে চোখ ঠেলে আসে

মরণ মরে না তবু॥

বড়মামা বললেন, ‘অহো, অহো, হৃদয়ের চাপ সহিতে পারি না, বুক ফেটে ভেঙে যায় মা।’

মাসিমা রেগে গিয়ে বললেন, ‘তোমাদের তর্জা থামাবে, নয়তো ওই দরজা আছে।’

মাসিমার কথায় কাজ হল। দুজনের ঠোঁটই চায়ের কাপের দিকে নেমে এল। মাসিমার কাছে দুজনেই জব্দ।

মেজোমামা কয়েক চুমুক চা খেলেন। দু-জানলার বাইরে রোদের দিকে তাকালেন, তারপর হঠাৎ এক সময় বলে উঠলেন, ‘আমার আর কোনও সন্দেহ নেই।’ বড়মামা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘বাঃ, এই তো আমার লক্ষ্মী ছেলে, এতদিনে বুঝলে তাহলে, কবিতা লেখা সহজ কাজ নয়।’

মেজোমামা বড়মামার কথা কানেই তুললেন না, আপন মনেই বলে চলেছেন, ‘এতদিনে, আমি নিঃসন্দেহ, এ বাড়িতে ভূত আছে।’

বড়মামা বললেন, ‘অবশ্যই আছে। আমি বহুবার দেখেছি।’

আমার কানের কাছে মুখ এগিয়ে এনে ফিসফিস করে বললেন, ‘খুব ভয় দেখিয়ে দি, আমাদের কাজের সুবিধে হবে। গুপ্তধনের কাজ খুব গোপনে করতে হয়, আমি বইয়ে পড়েছি। ওর চেহারাটা দেখেছিস, ঠিক ভিলেনের মতো। লাস্ট মোমেন্টে গুপ্তধন নিয়ে সরে পড়তে পারে। তুই আমাকে সাপোর্ট করে যা।’

মেজোমামা বললেন, ‘ছাদ বড় ডেনজারাস জায়গা বড়দা। সব বাড়ির ছাদেই একটা না একটা কিছু থাকে। গুলি গড়ায়, বল চলে বেড়ায়, পায়ের শব্দ শোনা যায়, ধুপধাপ আওয়াজ হয়। বাড়িতে ওই জন্যে ছাদ রাখতে নেই।’

বড়মামা হাসতে হাসতে বললেন, ‘বললি বটে। ছাদ ছাড়া বাড়ি হয়!’

‘কেন হবে না, ঢালু ছাদ কর, টিনের চাল কর, খড়ের চাল কর, যাতে ভূতের পা স্লিপ করে।’

‘ভূতের আবার পা হয় নাকি!’

‘নিশ্চয় হয়, তা না হলে শব্দ করে কী করে! মাঝ-রাতে লোহার বল নিয়ে খেলে কী করে! কাল রাতে আমি এক জোড়া ভূত দেখেছি। অবিকল মানুষের মতো চেহারা, কেবল সামান্য একটু কুঁজো। কিছু মনে কোরো না বড়দা, ভূতের চেহারার সঙ্গে তোমাদের চেহারার অদ্ভুত মিল আছে। আমি কাল বড় ভূত, ছোট ভূত একসঙ্গে দেখেছি। তবে এও দেখলুম, ভূত মানুষকে ভীষণ ভয় পায়। আমাকে দেখে কুঁজো হয়ে ভূতজোড়া পালাল। পুরোহিতমশাইকে ডেকে একটু শান্তি স্বস্ত্যয়ন করতে হবে। তিলপড়া, সরষেপড়া, জলপড়া।’

শেষ চুমুক চা খেয়ে মেজোমামা চেয়ার ছেড়ে উঠে গটগট করে চলে গেলেন।

বড়মামা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার বলো তো, ঠিক ধরতে পারলুম না হে! এ যেন সেই, তুমি যাও ডালে ডালে, আমি যাই পাতায় পাতায় গোছের চরিত্র। সাবধান! স্বপ্নের কথা কেউ যেন জানতে না পারে, বুঝলে।’

বড়মামা নিজের জন্যে আর এক কাপ চা তৈরি করলেন।

মোক্ষদা এসে বললে, ‘তিনজন রুগি এসে বসে আছে যে গো! বলছে, ছিরিয়াছ কেছ।’

বড়মামা উদাস সুরে বললেন, ‘হ্যাঁঃ, সবই সিরিয়াস।’

ঠাকুরঘরের দেয়ালের প্লাস্টার জলে ভেজালে, চুল-চুল কাটা বেড়ালের নখের আঁচড়ের মতো ফুটে উঠেছে। ভালো করে তাকালে, সত্যিই ক, খ, গ, ঘ চিনে নিতে অসুবিধে হয় না। বড়মামাকে মজা করে বলেছিলুম, এখন নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছি। স্বপ্ন তাহলে সত্যি। মা লক্ষ্মীর সঙ্গে সব সময় এত বড় একটা সাদা প্যাঁচা ঘোরে। প্যাঁচার বড় বড় নখ আছে। সেই নখের লেখা। মামারা একসময় জমিদার ছিলেন। জমিদারবাড়িতে, রাজবাড়িতে গুপ্তধন থাকে, আমি বইয়ে পড়েছি।

দেখি, মা যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন, সেখানে পায়ের ছাপ পড়েছে কি না! নিচু হতেই চকচকে কী একটা নজরে পড়ল। কী রে বাবা! আরে এ যে দেখছি সোনার দুল। মায়ের কান থেকে খুলে পড়ে গেছে। থানায় গিয়ে জমা দেওয়া উচিত। ছেলেবেলা থেকে পড়ে আসছি, পরের দ্রব্য কুড়াইয়া পাইলেও গ্রহণ করা উচিত নয়। এখন আমার কাছে থাক, বড়মামা কলে গেছেন। ফিরে এলে পরামর্শ করে যা হয় কিছু করা যাবে।

বেলা দুটো নাগাদ বড়মামা ফিরে এলেন। আশ্বিনের রোদে মুখ-চোখ লাল জবাফুল। এক হাতে ডাক্তারি ব্যাগ, আর-এক হাতে খানচারেক ঘুড়ি। মাসিমা বললেন, ‘তুমি কি ভিজিটের বদলে টাকা ফেলে ঘুড়ি নিয়ে এলে? অবশ্য গ্রামের ডাক্তার লাউ, কুমড়ো, কাঁচকলা ভিজিট পায়। ভালোই করেছ।’

অন্যসময় হলে বড়মামাতে মাসিমাতে লেগে যেত। আজ বড়মামার মুখে দেবতার হাসি।

কোনওরকমে খাওয়াদাওয়া সেরে বড়মামা ঘরে এসেই দরজা দিলেন। অন্যদিন এই সময়ে একটু শুয়ে পড়েন, আজ মেঝেতে বাবু হয়ে বসলেন। আমি বড়মামার ইজিচেয়ারে আরাম করে বসে, জানলায় ঠ্যাং তুলে দিয়ে, ট্রেজার আইল্যান্ড পড়ছিলুম।

বড়মামা বললেন, ‘আয়, নেমে আয়। আমাদের এখন অনেক কাজ। অনেক মাথা খাটাতে হবে। ক খ গ ঘ-র উদ্ধার করতে হবে। মা একটা সংকেতে রেখে গেছেন। সেই সংকেত উদ্ধার করতে হবে। অনেক ভেবে একটা কোড উদ্ধার করেছি।’

‘কোনটা?’

‘ঘ। ঘ-এ ঘুড়ি। চারখানা ঘুড়ি কিনে এনেছি।’

‘ঘুড়ির সঙ্গে গুপ্তধনের কী সম্পর্ক!’

‘উঃ, তোর মতো অশিক্ষিত আমি খুব কম দেখেছি। একটু যদি লেখাপড়া করতিস! রবীন্দ্রনাথের গুপ্তধন, হেমেন্দ্রকুমার রায়ের যকের ধন।’

‘আজ্ঞে পড়েছি। ওসবই তো আমি পড়ি।’

‘তাই যদি পড় বাছা, তাহলে বোঝ না কেন, গুপ্তধনের আগে সঙ্কেত, পরে একজন কুচক্রী শয়তান, তারপর এক রাউন্ড ফাইট, তারপর গুপ্তধন। মনে পড়ে গুপ্তধন গল্পে সন্ন্যাসী হরিহরকে যে তুলট কাগজ দিয়েছিলেন, তাতে কী লেখা ছিল?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। এতবার পড়েছি একেবারে মুখস্থ—

পায়ে ধরে সাধা।

রা নাহি দেয় রাধা॥

শেষে দিল রা,

পাগোল ছাড়ো পা।

তেঁতুল-বটের কোলে

দক্ষিণে যাও চলে॥

ঈশান কোণে ঈশানী

কহে দিলাম নিশানী॥’

‘বাঃ! ফাস্টক্লাস। এই ধাঁধা ভেঙে মৃত্যুঞ্জয় কী পেল?’

‘আজ্ঞে ধারাগোল, একটা গ্রামের নাম।’

‘ভেরি গুড। বুঝলি, রবীন্দ্রনাথ ইজ রবীন্দ্রনাথ। এসো, তাহলে আমাদের সংকেতের অর্থটা উদ্ধার করে ফেলার চেষ্টা করি। ক। ক মানে কী?’

‘ক মানে ক।’

‘তোমার মাথা, ওইজন্যে রাগ ধরে। ক দিয়ে কী কী হয়, কী কী শব্দ, গবেট!’

‘আজ্ঞে, কালি, কলম, কাজল, কমলা, কয়লা, কলস, কেবল, কলা, কদম, কমল, কুসুম, কালা, কিল, কুল, কাঁটা, কাদা।’

বড়মামা দাঁতমুখ খিঁচিয়ে উঠলেন, ‘বড় ডেঁপো হয়ে গেছ।’

‘বাঃ, ক-দিয়ে যা যা মনে আসছে বলছি। এই তো বললেন, ক দিয়ে যে শব্দ হয় বলতে।’

‘ওভাবে হবে না। অভিধান আনো।’

‘মেজোমামার ঘরে।’

‘ঘরে আছে?’

‘না কলেজে।’

‘নিয়ে এসো। আনার সময় দেখে আসবে, কী ভাবে রাখা ছিল। ফেস ডাউন অর ফেস আপ, রাখার সময় সেইভাবে রেখে আসতে হবে, যেন ধরতে না পারে। বুঝলে?’

অভিধান নিয়ে ফিরে এলুম। বড়মামা বললেন, ‘ক-এর এলাকায় ঝট করে একটা পাতা উলটে ফেল। কী পেলি?’

‘আজ্ঞে করকচ, করকচি, করকর, করকা, করগ্রহ, করঙ্ক, করঙ্গ, করঞ্জা।’

‘ফেলে দে, ফেলে দে। কিস্যু নেই ওতে। হোপলেস, হোপলেস। আবার খোল। মুড়ে ঝপাস করে খোল। কী পেলি?’

‘আজ্ঞে, কোঁ, কোঁক, কোঁকড়া, কোঁড়, কোঁত, কোঁৎকা।’

‘ধ্যাত, তোমার হাতে ভালো কিছু উঠবে না। তখনই সাবধান করেছিলুম, অত মুরগির ডিম খেও না, গলা দিয়ে কোঁকর কোঁ-ই বেরোবে। দাও, আমার হাতে দাও। তোমার হাত নষ্ট হয়ে গেছে।’

বড়মামা অভিধান নিয়ে ঝট করে একটা জায়গা খুললেন।

‘কী পেলেন বড়মামা?’

করুণ মুখে বড়মামা বললেন, ‘বীভৎস! কল্পী, কল্প্য, কল্পষ, কল্মা, কশ, কশা, কশাড়, কশিদা। ফেলে দে, ফেলে দে। এভাবে হবে না। এইসময় বেশ মাথাঅলা একজন কাউকে পেলে বেশ হত। ক-তেই এই অবস্থা! এখনও খ আছে, গ আছে, ঘ আছে। আচ্ছা শোন।’

‘বলুন।’

‘গুপ্তধন তো তোর আমার একার হতে পারে না। করালীরও ভাগ আছে।’

‘করালী কে?’

‘যকের ধন পড়িসনি?’

‘হ্যাঁ।’

তাহলে আবার বোকার মতো প্রশ্ন করছিস কেন, করালী কে? এ কেসে করালী হয়ে দাঁড়াবে মেজো। প্রথম থেকেই সে পথ মেরে দিতে হবে।’

‘বুঝেছি।’

‘কী বুঝেছিস?’

‘আমরা করালী হয়ে যাব। উলটো রথের মতো, উলটো যকের ধন লেখা হবে। মেজোমামার মাথা ভালো। মেজোমামাকে আমরা দলে টেনে নোব। লাস্ট মোমেন্টে সিন্দুকটা যখন—’

‘সিন্দুক নয়, চেন-বাঁধা পেতলের ঘড়া, স্বপ্নে আমি সেইরকম দেখেছি।’

‘আচ্ছা, তাই হোক, সিন্দুকের বদলে যেই ঘড়া বেরোবে, আমরা করালী হয়ে যাব।’

বাইরে গাড়ি থামার শব্দ হল। মেজোমামা ফিরলেন।

বড়মামার এক রুগি বড়মামাকে খুব সুন্দর বিস্কুট-রঙের একটা টি-সেট প্রেজেন্ট করেছে। ভদ্রলাকের মেয়ে সেলাই করতে করতে পাখিছুঁচ খেয়ে ফেলেছিল। বাঁচার আশাই ছিল না। ছুঁচ রক্তে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কখনও পেটে খোঁচা মারে, কখনও বুকে খোঁচা মারে। বড়মামা কীভাবে যেন বাঁচিয়ে দিলেন। মনে হয়, ম্যাগনেট খাইয়েছিলেন।

বড়মামা ছোটখাটো একটা টি-পার্টি দিয়েছেন। মেজোমামা আর মাসিমা নিয়ন্ত্রিত। সেই বিস্কুট-রঙের টি-সেটের আজ উদ্বোধন হল। চায়ের সঙ্গে বিস্কুট আর চানাচুর আছে। এক চুমুক চা খেয়ে বড়মামা বললেন, ‘বন্ধুগণ, আজ তোমাদের জন্যে একটি সুসংবাদ আছে।’

মেজোমামা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলেন, ‘বন্ধুগণ কী, বন্ধুগণ? তুমি কি নির্বাচনী সভা ডেকেছ?’

বড়মামা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘শত্রুগণ!’

মেজোমামা লাফিয়ে উঠলেন, ‘শত্রুগণ! আমি প্রতিবাদে চা-সভা পরিত্যাগ করছি।’

‘ও, তুমি দেখি শাঁখের করাত! যেতেও কাট, আসতেও কাট। বন্ধুগণও পছন্দ নয়, শত্রুগণও পছন্দ নয়, তাহলে তোমরা আমার কে? বলে দাও।’

‘কেন, ভ্রাতা আর ভগিনী বলা যায় না, ব্রাদার অ্যান্ড সিসটার!’

মাসিমা বললেন, ‘সত্যিই, তোমরা দুজনে একেবারে বিগড়ে গেছ। তোমাদের সংশোধনী স্কুলে দিতে না পারলে মানুষ হবার আশা নেই।’

বড়মামার কানে কানে বললুম, ‘করছেন কী? এখন মেজোমামাকে চটাচ্ছেন কেন? আমাদের মাথাটা চাই। তারপর তো করালী হবই।’

বড়মামা বললেন, ‘ইস, একদম ভুলে গেছি। দাঁড়া, সামলে নিচ্ছি। আমার প্রাণের ভ্রাতা, আমার প্রাণের ভগিনী!’

মাসিমা বললেন, ‘না না, তোমার মতলব ভালো নয়। সেবারের মতো আবার বাইরে যাবার তালে আছ। আমার ঘাড়ে যত কুকুর, বেড়াল, গোরু, মোষ। ওসব আর আমি সামলাতে পারব না।’

‘বৎসে, স্থিরোভব। তোমাদের এখন আমি যে সংবাদ দোব, তা শুনলে তোমরা দুজনেই তাথৈ তাথৈ করে নৃত্য করবে। আমি এই বাড়িতে অবশেষে গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছি। আমাদের কোনও এক পূর্বপুরুষদের সঞ্চিত রত্নভাণ্ডার।’

মেজোমামা হুঁ হুঁ, হুঁ হুঁ করে গলার এক অদ্ভুত শব্দ করলেন।

বড়মামা বললেন, ‘এর মানে?’

মেজোমামা এবার পা নাচাতে নাচাতে সেইরকম শব্দ করলেন।

বড়মামা বললেন, ‘অবিশ্বাস করছিস?’

মেজোমামা এবার নিজেকে ভাঙলেন, ‘আমিও পেয়েছি বিগ ব্রাদার!’

‘তার মানে?’

‘মানে খুব সহজ, ক খ গ ঘ।’

বড়মামা চমকে উঠলেন। মুখ দেখে মনে হল চোপসানো বেলুন। আমার দিকে বড়-বড় চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘বিশ্বাসঘাতক! তুমি ডবল এজেন্ট হয়ে বসে আছ!’

‘যাব্বা, যত দোষ নন্দ ঘোষ। আমি কিছুই জানি না বড়মামা। মেজোমামাকে আমি কিছুই বলিনি।’

‘তাহলে জানল কী করে?’

‘তা আমি জানি না, মেজোমামাকে জিগ্যেস করুন।’

মেজোমামা বললেন, ‘তুমি যেভাবে জেনেছ, আমিও সেইভাবে জেনেছি। একই স্বপ্ন দু’জনে, একই সময়ে দেখেছি।’

‘তা কখনও হয়!’

‘এই তো হয়েছে।’

‘তুমি ক খ গ ঘ-এর রহস্য উদ্ধার করতে পেরেছ?’

‘তুমি পেরেছ?’

‘না।’

‘আমিও পারিনি।’

‘এসো তাহলে, হাত মেলাও।’

‘মেলাও।’

মাসিমা চেয়ার ঠেলে উঠতে উঠতে বললেন, ‘নাও, এবার আর এক পাগলামি শুরু হল। বিরাশি সালে গুপ্তধন! লোকে শুনলে হাসবে।’

মাসিমা ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। দুই মামা বসলেন, রহস্য-সমাধানে।

বড়মামা বললেন, ‘তাহলে ক দিয়ে শুরু করা যাক।’

‘হ্যাঁ, ক। ক হল এই বাড়ির এমন একটা অংশ যার প্রথম অক্ষর ক। ক এই চৌহদ্দির মধ্যেই আছে, বাইরে কোথাও নেই। নাও, এইবার খুঁজে বের করো। পরিধি অনেক ছোট হয়ে এল কেমন?’

‘উঃ, তোর মাথা বটে! নাঃ, কবিতাটা তুই ভালোই লিখিস!’

‘বলছ! পরে আবার মত পালটাবে না তো?’

‘নেভার।’

‘ভাগনে, ক দিয়ে কী কী আছে, আমরা বলে যাই, তুমি লিখে যাও।’

বড়মামা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘কলাঝাড়।’

‘রাইট, কলাঝাড়। এবার লেখো, কয়লার ঘর।’

‘রাইট, কয়লার ঘর, লেখো কলতলা।’

‘ঠিক, কলতলা। তারপর?’

‘তারপর? আর তো কিছু নেই।’

‘আচ্ছা, এবার তাহলে খ-এ এসো। এই তিনটে জায়গার কাছাকাছি খ কোথায় আছে?’

আমি বললুম, ‘কেন? কলতলার পাশেই রয়েছে খড়ের ঘর।’

দু’মামাই লাফিয়ে উঠলেন, ব্রিলিয়েন্ট, ব্রিলিয়েন্ট, এ ছেলে শার্লক হোমস হবে।

মেজোমামা বললেন, ‘আর কিছু দরকার নেই, বাকিটা জলবৎ তরলং, কলতলায় খড়ে ছাওয়া গোরুর ঘর, ক খ গ ঘ। পেয়ে গেছি বড়া, আর ভাবনা নেই। নাও চা বলো। মিউজিক, মিউজিক লাগাও।’

বড়মামা চেয়ারের পেছনে শরীর ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘ওই জন্যেই বলে, ইউনাইটেড উই স্ট্যাণ্ড, ডিভাইডেড উই ফল।’

বড়মামা একই সঙ্গে রেকর্ডপ্লেয়ারে চাপালেন সেতার আর টেপ-রেকর্ডারে চাপালেন সানাই। মেজোমামা প্রশ্ন করলেন, ‘এটা কী হল?’

‘কেন? ফার্স্টক্লাস যুগলবন্দী।’

‘ও, যুগলবন্দী! যেমন তুমি আর আমি! তাহলে তুমি হলে ওই সানাই, আমি হলুম সুললিত সেতার।’

‘তা কেন, তুই হলি সানাই। প্যাঁ করে পোঁ ধরে আছিস, একটু কর্কশ।’

‘আমি কর্কশ, আর তুমি হলে মধুর, নিজের সম্বন্ধে তোমার কী উচ্চ ধারণা তাই না!’

‘জানিস আমি ডাক্তার! জীবনদান করি।’

‘জানো আমি অধ্যাপক। আমি জ্ঞান দান করি বলেই তুমি ডাক্তার।’

‘তোর জ্ঞানে মানুষ গোরুর ডাক্তার হয়।’

‘তুমি কি নিজেকে তার চেয়ে বড় কিছু ভাবো?’

মাসিমা গট গট করে ঘরে ঢুকলেন। ঢুকেই বললেন, ‘তোমরা দু’জনেই বেরোও, বেরিয়ে যাও। যে যার ঘরে গিয়ে দরজা দিয়ে বোসো।’

বড়মামা বললেন, ‘আমি তো আমার ঘরেই রয়েছি রে কুসি!’

পুরোহিতমশাই কাঠের চৌকির ওপর বসে কাঁসার গেলাসে চা পান করেছে। পরনে পট্টবস্ত্র, গলার চাদর। মনে হল এইমাত্র পুজো সেরে উঠে এলেন। এক চুমুক চা খেয়ে, জিবে আর দাঁতে একটু চুকচুক শব্দ করে বললেন, ‘কী বললে ডাক্তার, কী প্রতিষ্ঠা করবে?’

‘আজ্ঞে, মা লক্ষ্মীর কানের দুল।’

‘অ্যাঁ, সে আবার কী। লোকে মন্দির প্রতিষ্ঠা করে, পুষ্করিণী প্রতিষ্ঠা করে, দেবদেবী প্রতিষ্ঠা করে, তুমি কী প্রতিষ্ঠা করবে বললে?’

পুরোহিতমশাইয়ের যথেষ্ট বয়েস হয়েছে, তাই মনে হয় এক কথা একশোবার বললে তবেই বুঝতে পারেন। বড়মামা আবার বললেন, ‘আজ্ঞে, মা লক্ষ্মীর কানের দুল।’

‘ও বস্তু তুমি পেলে কোথায়?’

‘আজ্ঞে, আমি পেয়েছি। অলৌকিক উপায়ে পেয়েছি। সবই আমার মায়ের দয়া।’

‘যাক, সে আমার জানার দরকার নেই। কোথায় প্রতিষ্ঠা করবে?’

‘আমাদের ঠাকুরঘরে।’

‘বেশ দেখি, ওই পাঁজিটা আমার হাতের কাছে এগিয়ে দাও।’

আমি পাঁজিটা এগিয়ে দিলুম। পাতার পর পাতা উলটে এক জায়গায় এসে তাঁর চোখ স্থির হল। সামনে ঝুঁকে পড়ে বিড়বিড় করে কী পড়লেন, তারপর বললেন, ‘হ্যাঁ, কাল সকালেই একটা দিন আছে। ন’টা পনেরো গতে সকাল বারোটা এক।’

বড়মামা বললেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, কালই হোক, খুব ভালো সময়।’

‘তাহলে আমি একটা ফর্দ করে দি।’

প্রায় এক ফুট লম্বা একটা ফর্দ হাতে আমরা দু’জন সেই পবিত্র ধাম ছেড়ে রাস্তায় নেমে এলুম। রহমতুল্লার রিকশা অপেক্ষা করছিল। দু’জনে উঠে বসলুম। বড়মামা ফর্দ পড়তে গিয়ে প্রথমেই হোঁচট খেলেন, ‘একটি স্বর্ণ-সিংহাসন, স্বর্ণ-সিংহাসন মানে সোনার সিংহাসন, তাই না?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘সে তো প্রচণ্ড দাম হবে রে!’

‘তাতে কী হয়েছে বড়মামা, গুপ্তধন ধরুন পাওয়াই হয়ে গেছে, মায়ের দুল প্রতিষ্ঠার পরই তো আমরা গোয়ালের মেঝে খুঁড়তে শুরু করব, তারপর ট্যাং করে একটা আওয়াজ। শাবল গিয়ে লাগবে ঘড়ার কানায়। গুপ্তধন মানে কী বড়মামা?’

সাঁই সাঁই করে রিকশা ছুটছে। বাতাসে বড়মামার চুল উড়ছে। আমার দিকে অবাক হয়ে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, ‘যাব্বাবা, সাতকাণ্ড রামায়ণ পড়ে শেষে এই প্রশ্ন?’

‘না, তা নয়, আমি বলছি, সে-যুগের টাকা বেরুলে তো কোনও কাজে লাগবে না, এ যুগে অচল। মোহর বেরুলে, মেজোমামা বললেন, গভরনমেন্ট গুপ্তধন আইন অনুসারে নিয়ে নেবে।’

‘মেজো? আবার তুই সেই অপোজিশন ক্যাম্পে চলে গেছিস? মেজো আমার এনিমি। স্বপ্নটপ্ন সব বাজে, তুই-ই তাহলে মেজোকে বলেছিলিস?’

‘সত্যি বলছি, আমি বলিনি। মা লক্ষ্মী সেদিন দু’কপি স্বপ্ন তৈরি করে, এক কপি আপনার ঘুমে, আর এক কপি মেজোমামার ঘুমে ছেড়ে দিয়েছিলেন।’

রিকশা থেকে বাড়ির সামনে নেমে বড়মামা বললেন, ‘আর কতক্ষণ বা সময় আছে, আটটার সময় চেম্বারে বসতে হবে, এদিকে এই আধহাত ফর্দ, কে সামলাবে!’

‘আমি আর মাসিমা সোদপুর থেকে করে আনি।’

‘ওই যে স্বর্ণ-সিংহাসন, বউবাজার ছাড়া পাচ্ছ কোথায়?’

‘বড়মামা!’

ডাকটা মনে হয় বেশ জোরে হল। উত্তেজনা আর চেপে রাখতে পারছি না।

বড়মামা বললেন, ‘কী রে? অমন করছিস কেন?’

অদ্ভুত একটা কথা মনে হল। ভেতর থেকে কে যেন বলে দিল, ওই গুপ্তধনের ঘড়ায় একটা সোনার সিংহাসন আছেই আছে। সেই সিংহাসনে মায়ের কানের দুল বসাবেন। ব্যস, আর ভাবনা নেই। আগে গুপ্তধন উদ্ধার, তারপর দুল প্রতিষ্ঠা।’

সামনেই মাসিমা। বেশ রাগ-রাগভাবে বললেন, ‘গিয়েছিলে কোথায়? থেকে থেকে যাও কোথায়? মাণিকের বাবার এখন-তখন অবস্থা! বেচারা সেই থেকে বসে আছে মুখ শুকিয়ে।’

বড়মামা মাসিমার খুব কাছে গিয়ে, ফিসফিস করে বললেন, ‘নব্বইয়ের আগে বুড়ো মরবে না, একশোতেও যেতে পারে। হাঁপানির রুগি সহজে মরে না।’

‘তাহলেও একটা রিলিফ তো দিতে পারা যায়। দাঁড়াও, আমার ফাইনাল ইয়ার, একবার পাশ করে বেরুতে দাও, তোমার সব রুগি কেড়ে নোব।’

বড়মামা কম্পাউন্ডারকে নির্দেশ দিয়ে, মাণিকের বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। একটা ইনজেকশন, আবার মাসখানেক ঠিক থাকবেন বৃদ্ধ।

মাসিমা চা এনেছেন। বড়মামা চা খেয়ে চান করে সাদা প্যান্টের ওপর বুক খোলা টি-শার্ট পরে চেম্বার আলো করে চিকিৎসায় বসবেন। তখন বড়মামার অন্যরূপ। তখন কারুর একটার বেশি দুটো কথা বলার সাহস হবে না। তখন মেজোমামা, মাসিমা সকলেই ভয় পাবেন।

বড়মামা মধুর স্বরে ডাকলেন, ‘কুসি!’

মাসিমা বললেন, ‘আবার কী হল? তোমার গলা শুনেই মনে হচ্ছে, কিছু গোলমেলে ব্যাপার।’

‘বোস না, একটু বোস না, সব সময় অমন ধানিপটকার মেজাজে ঘুরিস কেন?’

‘কী, বলো?’

মাসিমা বড়মামার চেয়ারের হাতলে বসলেন। বড় মধুর দৃশ্য। আমার মা-ও নেই, বোনও নেই। আমার আমি ছাড়া কেউ নেই।

বড়মামা বললেন, ‘বুঝলি কুসি, কাল এ-পরিবারের একটা দিনের মতো দিন, ডে অব অল ডেজ।’

‘কেন? কাল আবার কী হল? পক্ষীরাজ কিনছ নাকি?’

মুখে রহস্য মেখে বড়মামা বললেন, ‘আমি একটা দুর্লভ জিনিস পেয়েছি। তার দাম? পৃথিবীকে গ্রহজগতের নিলামে চাপালেও হবে না। দুর্লভ, সুদুর্লভ, মহাদুর্লভ!’

‘আঃ, বিশেষণ থামিয়ে দয়া করে বলো না, জিনিসটা কী?’

‘মা লক্ষ্মীর কানের দুল।’

‘তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, ডিসটেমপারড হয়ে গেছ। কালই চলো সাইকিয়াট্রিস্ট ডক্টর গাঙ্গুলির কাছে।’

‘চেঁচাচ্ছিস কেন? ঘটনাটা শোন না। যে রাতে স্বপ্নে দেখলুম, ছাদে ঠাকুরঘরের পাশে মা লক্ষ্মী ইশারায় আমাকে ডাকছেন, তার পরের দিন সকালে বুড়ো দেখে কি, কী একটা চকচক করছে সেই জায়গাটায়। পড়ে আছে এক পাশে। ব্যাপারটা কী হয়েছে বুঝলি? মা হলে কী হবে, মহিলা তো, অনেকটা তোর মতোই। দেবলোক থেকে নরলোকে আসার পথে, তাড়াহুড়োয় আংটা ঠিকমতো লাগানো হয়নি, খুস করে খুলে পড়ে গেছে।’

‘কই দেখি, জিনিসটা কোথায়?’

‘আমি আর হাত দোব না, রাস্তার কাপড়, চায়ের হাত, ওই আলমারিটা খুললে, কাঁচের একটা ট্রের মধ্যে আছে।’

মাসিমা উঠে গিয়ে আলমারি খুললেন। দুলটা দু’আঙ্গুলে দোলাতে দোলাতে আমাদের কাছে এলেন, তারপর নিজের ডান কানে পরে নিয়ে বললেন, ‘থ্যাঙ্ক ইউ, তুমি ঠিক বলেছ বড়দা, আমি মা লক্ষ্মীর মতোই কেয়ারলেস। বুড়ো, তোকে আইসক্রিম খাওয়াব। থ্যাঙ্ক ইউ বড়দা।’ মাসিমা চলে গেলেন।

মেজোমামা বললেন, ‘তোমার সঙ্গে আমি হাত মিলিয়েছিলুম, সে কথা আমি অস্বীকার করছি না। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল, নেতা কে হবে? সব কাজেরই একটা মেথড আছে। আমি খুঁড়তে শুরু করলুম উত্তরে, তুমি শুরু করলে দক্ষিণে, তা তো হয় না! এ একটা বিরাট কাজ। অনেকটা প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের মতো! মহেঞ্জোদারো-হারপপার ক্ষুদ্র সংস্করণ। তাই আমি আমাকে নেতা নির্বাচিত করলুম। তুমি আমাকে কখনোই যা করতে না, কারণ তোমার মধ্যে সে উদারতা নেই। তোমার এখনও জমিদারি মেজাজ যায়নি, তোমার মধ্যে কোনও দিন আমি গণতান্ত্রিক নেতার সন্ধান পাইনি। তুমি যেন কাইজার উইলহেলম, তুমি যেন জার নিকোলাস ওয়ান, তুমি যেন লর্ড চেম্বারলেন—’

‘আমি তো তোকেই নেতা করতে চেয়েছিলুম, তার আগেই তুই নরম গরম, গরম গরম কত কী বলে গেলি। এর থেকেই বোঝা যায় তুই আমাকে একেবারেই ভালোবাসিস না।’

‘ভালোবাসি না? এই তোমার ধারণা? তা হলে শুনে রাখো, আমার প্রথম কবিতার বই তোমাকেই উৎসর্গ করেছি। কি লিখেছি জানো উৎসর্গপত্রে, আমার পিতৃপ্রতিম বড়দাকে।’

‘তাই নাকি, তা হলে ভাই ভাই, ঠাঁই ঠাঁই কথাটা ঠিক নয়।’

‘সে এখন তুমি বুঝবে।’

‘পাড়ার লোকে কী বলে জানিস, দুটি ভাই যেন রাম-লক্ষ্মণ।’

মাসিমা বললেন, ‘গিন্নিবান্নিরা কী বলে জানো, সীতা কোথায়?’

‘তোদের ওই এক কথা!’

মেজোমামা বললেন, ‘শোনো বড়দা, ও সব কথা ছাড়ো, কাজের কথায় এসো। টিমটা আমি ঠিক করে ফেলেছি, আলোকসম্পাতে বুড়ো, মঞ্চসজ্জায় কুসি, রাত্রির প্রথম যামে শাবলে আমি, ঝুড়িতে তুমি, দ্বিতীয় যামে ঝুড়িতে আমি, শাবলে তুমি।’

মাসিমা জিগ্যেস করলেন, ‘মঞ্চসজ্জাটা কী জিনিস?’

‘এই যেমন ধর চা দিলি, মাঝে মাঝে কফি সাপ্লাই করলি, কোকোও করে দিতে পারিস। লাইট স্ন্যাকস। হাতের কাছে জল, তোয়ালে, ফার্স্ট এড। মানে তোর ওপর খুব একটা চাপ পড়বে না, তবে ব্যবস্থাপনা বেশ ভালো হওয়া চাই।’

‘তোমাদের এই পাগলামি ক’রাতে চলবে?’

‘বলতে পারছি না। তদ্দিন চলবে যদ্দিন না ঠং করে একটা আওয়াজ হচ্ছে।’

‘স্বপ্ন নিয়ে এই বাড়াবাড়ি ঠিক হবে?’

‘তুই জানিস, স্বপ্নে গ্লুকোজের ঠিক ফর্মুলা পাওয়া গিয়েছিল? মলিকিউলের গঠন? স্বপ্নে কত কী পাওয়া গেছে জানিস। কবিতায় পড়িসনি? স্বপ্নে কুললক্ষ্মী এসে মাইকেলকে বলেছিলেন, বাছা, ইংরিজি নয়, বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা করো।’

মাসিমা বললেন, ‘তোমাদের দেখে আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে সাধকপ্রেমিকের সেই গানটা গাই, হতেছে পাগলের মেলা খেপাতে খেপিতে মিলে। শুধু খেপি শব্দটা পালটে খেপা বসাতে হবে।’

মাসিমা চলে গেলেন। সামনে পরীক্ষা। খুব পড়ার চাপ। এর ওপর গুপ্তধনের উৎপাত। মেজোমামা বললেন, ‘বড়দা, গুপ্তধন খুঁড়ে বের করার আগে একটা প্ল্যান তৈরি করতে হয়। তোমার কাছে গোয়ালঘরের নকশা আছে?’

‘গোয়ালের আবার নকশা? কে কবে তৈরি করে গোরু রেখেছিল সেই থেকে চলে আসছে।’

‘তা হলে আমাদের ফার্স্ট কাজ হবে গোয়ালের একটা ডিটেলস তৈরি করা। তুমি গোয়ালে কোনওদিন ঢুকেছ?’

‘কতবার।’

‘আমি একবারও ঢুকিনি। বিশ্রী বোটকা গন্ধ—’

‘তা কেন ঢুকবে? তুমি হলে ভাই সুখের পায়রা। দুধ খাবে, দধি খাবে, গন্ধটি সহ্য করবে না।’

‘সে হল গিয়ে যার যেমন বরাত। আচ্ছা গোয়ালটার আগাপাশতলা কি তুমি দেখেছ ভালো করে? কোথায় কী আছে না-আছে?’

‘সেই গোয়েন্দার চোখে কোনও দিন দেখা হয়নি। আরে ম্যান, গোরু আগে না গোয়াল আগে!’

‘শোনো, কাল আর্লি মর্নিং-এ আমরা গোয়াল সার্ভে করতে যাব। ইতিমধ্যে সার্ভে কীভাবে করতে হয় আমি পড়ে রাখছি।’

‘শুনেছি থিওডোলাইট না কী সব যেন লাগে।’

‘ধুর, অত সবের দরকার নেই। আসল কথা হল খুঁড়ে যাও। একটা কবিতার প্রথম দুটো লাইন লিখে ভীষণ আটকে গেছি, পরের দুটো লাইন পেয়ে গেলে এই ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাতুম এখুনি।’

‘বল না, লাইন দুটো বল না, আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করি।’

‘ভাবটা খুব দার্শনিক ধরনের, বুঝলে—

রাতের আকাশে শুকতারা জ্বলে
গাঁয়ের শ্মশানে চিতা।’

‘বাঃ এ যে দেখছি একেবারে শেষের কবিতা। তুমি এটাকে এখন কোথায় নিয়ে যেতে চাইছ?’

‘আর একটা লাইন টপকে দিয়ে, এমন একটা লাইনে শেষে করতে হবে, যার শেষ শব্দ চিতার সঙ্গে মিলে যাবে।’

‘তার মানে চিতার সঙ্গে মেলাতে হবে? ছাইয়ের তা হলে চলবে না!’

‘না, ছাই-ফাই চলবে না। সেইটাই তো সমস্যা রে দাদা।’

‘চিতার সঙ্গে কী মেলে? মিতা। চিতাই মোদের মিতা।’

‘কোন যুগে পড়ে আছ তুমি? এইট্টি টুতে তুমি অমন একটা লাইন ভাবতে পারলে?’

‘দাঁড়া দাঁড়া, এসে গেছে, একেবারে আলট্রা মডার্ন লাইন, শোন তাহলে, পুরোটা কী দাঁড়াচ্ছে,

রাতের আকাশে শুকতারা জ্বলে
গাঁয়ের শ্মশানে চিতা
তোমার আমার ভুঁড়ি বেড়ে চলে
মাপিতে পারে না ফিতা॥

‘বল কেমন হল?’

‘একসেলেন্ট, একসেলেন্ট!’

‘অর্থটা কী মারাত্মক হল জানিস? মৃত্যুতেই মানুষের শেষ। হবেই হবে, তবু আমরা গাণ্ডেপিণ্ডে গিলে ভুঁড়ি বাগিয়ে চলেছি।’

‘কামাল কর দিয়া ম্যান। মানুষের কান মলে ছেড়ে দিয়েছ।’

মেজোমামা নিজের ঘরে চলে গেলেন। বড়মামা বললেন, ‘লোকটাকে এখনও ঠিক চিনতে পারলুম না।’

‘কার কথা বলছেন বড়মামা?’

‘তোমার ওই মেজোমামা।’

‘মেজোমামাকে লোক বলছেন?’

‘কেন, ও লোক নয়?’

‘হ্যাঁ, লোক, তবে ভদ্রলোক বললে ভালো হয়।’

‘আরে রাখ, নিজের ছোট ভাই আবার ভদ্রলোক? তোকে আরও কয়েকদিন গুপ্তচরবৃত্তি করতে হবে। প্রফেসারকে বিশ্বাস নেই। সব না বানচাল করে দেয়!’

‘উনি তো ঘরে ঢুকে দরজা দিয়ে দিলেন।’

‘জানলা তো খোলা আছে।’

‘তা আছে!’

ছাদের দিকে জানলায় পাতলা পর্দা ঝুলছে। ঘরে শেড লাগানো টেবল ল্যাম্প ঝুলছে। ঝুলছে কেন? এ বাড়ির সবই অদ্ভুত। টেবিলে ল্যাম্প রাখার জায়গা নেই। অসাধারণ উপায়ে সেটাকে দেওয়ালের হুকের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে।

মেজোমামা টেবিলে একবার করে তাল বাজাচ্ছেন আর খাতায় একটু একটু লিখছেন। বীরেরা তাল ঠুকে যুদ্ধ করে, ইনি তাল ঠুকে লিখছেন। বড় বড় লোকের বড় বড় ব্যাপার। আমার খুব মজা লাগছে। আড়াল থেকে মানুষকে নজরে রাখলে অনেক কিছু জানা যায়। যেমন লেখার তাল আছে। পেনসিল শুধু ছোটরাই চিবোয় না। বড়রা বড় জিনিস চিবোয়, যার দাম আরও বেশি, পার্কার কলম। লিখতে গেলে মাঝে মাঝে মাথা চুলকোতে হয়। এদিকে-ওদিকে তাকাতে হয় বোকার মতো। মাথায় ভালো কিছু এসে গেলে শরীর আর মাথা দোলাতে হয়।

মেজোমামাকে দেখতে দেখতে মনে হচ্ছে, কবিতা লেখা ভীষণ কঠিন কাজ। এক সময় তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। ঘরে একটা স্টিল আলমারি রয়েছে। আলমারিটা খুললেন। লোহার পাল্লা ঝনঝন করে উঠল। মেজোমামা নিচু হয়ে একেবারে তলার খোপ থেকে কী একটা বের করে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। হাতে একটা পুরনো খাতা। ফিতে দিয়ে বাঁধা।

টেবিল ল্যাম্পের তলায় খাতাটা ফেললেন। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে পাঁপড় ভাজার মতো হয়ে গেছে। মেজোমামা খাতার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। ওপাশে খট করে একটা শব্দ হতেই চমকে উঠলেন। খাতাটাকে লুকোবার চেষ্টা করলেন।

তার মানে? এ খাতা তেমন নিরীহ খাতা নয়। ওর পাতায় পাতায় অবশ্যই কোনও গুপ্ত তথ্য আছে? গুপ্তধনের পেছনে এই রকম সব গোপন দলিল থাকে। খবরটা আমার ‘বস’-কে দিতে হচ্ছে। বড়মামাকে বস বলতে বেশ মজা লাগল!

বড়মামা সব শুনে বললেন, ‘অ্যাঁ, বলিস কী, খুব পুরনো খাতা! অনেকটা ডায়েরির মতো! তা হলে কি, তাহলে কি—’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, তা হলে সেই।’

‘তার মানে, কী সেই?’

‘সেই বইয়ে যেমন পড়ি, ওর মধ্যে কোনও রহস্য আছে, কবিতা নেই।’

‘ঠিক বলেছিস। কবিতা হল একটা মুখোশ। ও মনে হয় কোনওভাবে আমাদের পূর্বপুরুষ প্রসন্নকুমারের ডায়েরিটা খুঁজে পেয়েছে। তখন সারা বাংলায় বর্গির হাঙ্গামা চলছে। যার যা ধনসম্পদ সব পুঁতে রাখছে মাটির তলায় গোপন জায়গায়। ডায়েরিতে লিখে রাখছেন সন্ধানের নির্দেশ নিজের জন্যে, উত্তরপুরুষের জন্যে। শুনেছি প্রসন্নকুমারের অনেক কিছু ছিল।’

‘তিনি কে ছিলেন বড়মামা?’

‘দাঁড়া, শুনে বলি, প্রপ্রপ্রপিতামহ। দেখ তো ঠিক হল কি না? পিতার পিতা—পিতামহ, তস্য পিতা—প্রপিতমাহ, তস্য পিতা—প্রপ্রপিতামহ, তস্য পিতা—প্রপ্রপ্রপিতামহ, ক’পুরুষ হল বল তো?’

বাবা! এ যে দেখি আর এক গুপ্তধন!

রাতে মেজোমামা ঘোষণা করলেন, ‘আজ আর আমি খাব না। নো মিল। পেটের টিউনিং ঠিক নেই। একদিন অফ করে দি।’

মাসিমার ডাকে ঘরের ভেতর থেকেই বললেন। দরজা খুললেন না। মাসিমার পাশে দাঁড়িয়ে বড়মামা বললেন, ‘কী হচ্ছে বলো? একটু ওষুধ দিয়ে দি।’

‘না, না, ওষুধ কী হবে? কথায় কথায় ওষুধ! নাসে, মাসে উপবাসে।’

‘আরে দূর, কারটা কার ঘাড়ে চাপাচ্ছ? ওতে জ্বর সারে, পেটের জন্যে দাওয়াই লাগে। হজমি, অথবা অ্যান্টাসিড।’

মেজোমামা বললেন, ‘মুড়ি আর ভুঁড়ি।’

বড়মামা বললেন, ‘আঃ, আবার ভুল বললে! ওটা হল শরীরের যোগাযোগের কথা। পেটের সঙ্গে মাথা, মাথার সঙ্গে পেটের যোগ।’

মেজোমামা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আঃ, ডোন্ট ডিস্টার্ব।’

আমরা খাবার টেবিলে বসতেই বড়মামা বললেন, ‘একেই বলে, বিষয় বিষ, বুঝলি কুসি। আধ ঘণ্টার মধ্যেই ছেলেটার স্বভাব কী রকম পালটে গেল! চোখে পড়ার মতো।’

মাসিমা বললেন, ‘খাচ্ছ খাও, তোমাকে আর কারুর সমালোচনা করতে হবে না। বিষয়ের কী দেখলে তুমি?’

‘অ্যাঁ, বলিস কি! প্রসন্নকুমার কত লক্ষ কত কোটি টাকা মাটির তলায় পুঁতে রেখে গেছেন, তার ধারণা আছে!’

‘হঠাৎ সেই পূর্বপুরুষকে ধরে টানাটানি কেন? তিনি ছিলেন সাধক মানুষ। সমাধি পেয়েছিলেন। সমাধির ওপর সেই বুড়ো বকুলে আজও ফুল ফোটে। পাঁজিতে জন্মদিন, মৃত্যুদিন লেখা হয়। কত বড় বৈষ্ণব ছিলেন তিনি!’

‘তাঁর ঐশ্বর্যের সীমা-পরিসীমা ছিল না, বর্গির হাঙ্গামার সময় সব পুঁতে ফেলেছিলেন মাটিতে।’

‘আজ্ঞে না, সব দান করে দিয়েছিলেন।’

‘আজ্ঞে না, পুঁতে রেখেছিলেন।’

‘তর্ক না করে, তাঁর জীবনীটা পড়ে দেখ।’

‘কোথায় পাব?’

‘মেজদার কাছে পাবে। মেজদা রিসার্চ করছে, বৈষ্ণব আন্দোলন ও প্রসন্নকুমার।’

খাওয়া শেষ হল। বড়মামা মেজোমামার ঘরে গিয়ে টুকটুক করে টোকা মারলেন। ভেতর থেকে কেমন যেন একটা গলা ভেসে এল, ‘এখন আমাকে বিরক্ত না করলেই সুখী হব।’

বড়মামা বললেন, ‘কার গলা বল তো! ডক্টর জেকিলের, না মিস্টার হাইডের?’

‘কারুর গলাই যে আমি শুনিনি বড়মামা!’

‘তোর কল্পনাশক্তি বড় কম। না দেখলে না শুনলে তোর মাথায় কিছু আসে না। পরী কেউ কোনও দিন দেখেছে! ছবি এঁকেছে। নিয়মিত গলা কেউ শুনেছে! যাত্রায়, থিয়েটারে সেই না-শোনা গলাই অনুকরণ করেছে। শ্রীকৃষ্ণ যে কম্বুকণ্ঠে কথা বলতেন, মানুষ শুনে জানেনি, জেনে শুনেছে।’

আমরা আমাদের ঘরে ফিরে এলুম। গুপ্তধন নিয়ে আর মাথা ঘামাতে ভালো লাগছে না। বড়মামা মোটা একটা ডাক্তারি বই নিয়ে বসেছেন। বড়মামার এই এক গুণ দেখেছি, কোনও কিছুতে একবার ডুবে গেলে আর জ্ঞান থাকে না। আমারও একটা গুণ আছে। একবার ঘুমিয়ে পড়লে আর জ্ঞান থাকে না। কোথায় কোন জগতে যে চলে যাই।

মনে হয় গভীর রাত। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। বড়মামা ঠেলছেন। ঠেলতে ঠেলতে প্রায় খাটের ধারে এনে ফেলেছেন। শরীরের একটা অংশ ঝুলে পড়েছে। চাঁদের আলোয় চারপাশ ফুটিফাটা।

‘ওঠ, ওঠ, উঠে পড়।’

‘অ্যাঁ, কী হল বড়মামা, আবার স্বপ্ন?’

‘ধ্যাত, এবার দুঃস্বপ্ন। শিগগির নীচের বাগানে চল। আমার মনে হচ্ছে, মেজো গোয়ালে গিয়ে ঢুকেছে। গোরুটা যেন ভেও করে ঢেঁকুর তুলল।’

এই অসময়ে আমার আর নীচে নামতে ইচ্ছে করছে না। বড়মামাকে থামাবার জন্যে বললুম, ‘দুপুরে চরতে বেরিয়েছিল। মনে হয় খুব গুরুপাক খাওয়া হয়ে গেছে, তাই বদহজম হয়েছে।’

‘হ্যাঁ রে ব্যাটা গোবদ্যি, তুই সব জেনে বসে আছিস! গোরু কি মানুষ, যে বদহজম হবে। ফাঁকিবাজ। চল, নীচে চল। আমার একা যেতে ভীষণ ভয় করছে।’

উঠতেই হল। দু’জনেরই ভীষণ ভয়। বড়মামা যদি আমাকে একা ফেলে রেখে চলে যান, থাকতে পারব না। বাগানে নেমে অবাক হয়ে গেলুম। আমরা যখন ঘুমোচ্ছিলুম, সেই ফাঁকে কত ফুল ফুটছে। চারপাশে সাদা হয়ে আছে। গোয়ালঘর জমাট অন্ধকারের মতো দাঁড়িয়ে আছে একপাশে। কেউ কোথাও নেই। গোরুর নিশ্বাস পড়ছে ফোঁস ফোঁস করে।

বড়মামা বললেন, ‘এই নে টর্চ। গোয়ালের ভেতরটা একবার দেখে আয় তো, কেউ আছে কি না!’

‘ওরেবাবা, আমি পারব না বড়মামা, কামড়ে দেবে।’

‘কে কামড়াবে?’

‘গোরু।’

‘গোরু কামড়ে দেবে?’ বড়মামা হোহো করে হেসে উঠলেন, ‘কোন বইয়ে পড়েছিস, গোরু কামরায়!’

‘আপনি যাচ্ছেন না কেন বড়মামা!’

‘সত্যি কথা বলব? ছোটদের মিথ্যে বলতে নেই। আমারও একটু ভয়-ভয় লাগছে রে! বলা যায় না, যদি কিছু থাকে!’

‘কী আর থাকবে?’

‘তোমার মেজোমামা থাকতে পারে।’

‘পারে কেন, আছে। তবে গোয়ালে নেই। আছে এই কাঁঠালতলায়।’

বাজ পড়লে মানুষ কেমন চমকে ওঠে, আমরা দু’জনে ঠিক সেই রকম চমকে উঠলুম। মেজোমামার গলা। বড়মামা বললেন, ‘বিশ্বাসঘাতক।’

‘কে, তুমি না আমি?’

‘তুমি।’

‘যদি বলি তুমি। তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো না বলেই নীচে নেমে এসেছ, আমার গতিবিধির ওপর চোখ রাখার জন্যে।’

‘সে তো কিছু ভুল করিনি।’

‘ভুল অবশ্যই করেছ। তুমি পরীক্ষায় ফেল করেছ। গোল্লা পেয়েছ। আমার পাতা ফাঁদে পা দিয়েছ।’

‘ফাঁদ মানে?’

‘ফাঁদ মানে ট্র্যাপ। তুমি আমাকে কতটা বিশ্বাস করো দেখার জন্যে নীচে নেমে এসে একটু শব্দ-টব্দ করেছিলুম। যা ভেবেছিলুম তাই। সুড়সুড় করে নেমে এলে। বড়দা একেই বলে বিষয় বিষ।’

‘এত বড় একটা কথা বললি, বিষয় বিষ! যাঃ, তোকেই দিয়ে দিলুম। তোকে স্বপ্ন দিলুম, গুপ্তধন দিয়ে দিলুম, সব দিয়ে দিলুম, এমনকী আমার কৌতূহলটা পর্যন্ত দিয়ে দিলুম। সব তোর।’

বড়মামা হাত চেপে ধরে বললেন, ‘চল, ওপরে চল। আমরা এখন মুক্ত পুরুষ।’

মেজোমামা বললেন, ‘স্টপ। এদিকে এসো। দুজনেই এগিয়ে এসো।’

এতক্ষণ মেজোমামার গলাই শুনছিলুম। চোখে দেখা যাচ্ছিল না। অন্ধকারে আলোর খেলা চলছে। গাছের পাতা রূপকথার রূপোর পাতার মতো ঝিলমিল করছে! সবচেয়ে সুন্দর হয়ে সেজে উঠেছে তাল, সুপুরি, খেজুর আর নারকেল গাছ।

বড়মামা বললেন, ‘অন্ধকারে, তুমি আছ কোথায়?’

কাঁঠাল গাছের তলায়, একটা ছায়া দুলে উঠল, স্বর ভেসে এল, ‘খুব কাছেই। এটাও তোমার একটা শিক্ষা হল।’

‘কী শিক্ষা?’

‘হৃদয়ে অন্ধকার জমে থাকলে মানুষ চেনা যায় না দাদা। মানুষ চিনতে হলে আলো জ্বালতে হয়। হৃদয়ের আলো। কাঁঠালতলায় এসো, খবর আছে।’

আমরা দু’জনে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলুম। চাঁদের আলোয় পাতার ছায়া পড়ে, সে যেন আর এক স্বপ্ন! দূরে ফাঁকা মাঠে ঝলমল করছে আলো। তাকালেই মনে হচ্ছে, এক্ষুনি পক্ষীরাজ নেমে আসবে। পিঠে রাজপুত্র। কাঁঠালতলায় একটা বড় পাথর পড়ে ছিল, তার ওপর মেজোমামা বসে আছেন, দু’হাঁটুতে হাত রেখে আরাম করে। আমরা গিয়ে দাঁড়াতেই বললেন, ‘টর্চ জ্বেলে অন্ধকারকে বিরক্ত কোরো না। দু’জনে বোসো। ওই যে আরও দুটো পাথর রয়েছে।’

বড়মামা ভয়ে ভয়ে বললেন, ‘তুমি আমাদের নিয়ে কী করতে চাইছ? আমরা দু’জনেই কিন্তু নিরস্ত্র!’

‘আমিও তাই!’

‘তোমার গলাটা কেমন যেন ভিলেনের মতো শোনাচ্ছে, অনেকটা করালীচরণের মতো।’

‘তুমি করালীচরণের গলা শুনেছ?’

‘ঠিক শুনিনি; কিন্তু সেই ছেলেবেলা থেকে কানের কাছে ভাসছে।’

‘হৃদয়ের শব্দ শুনতে পাওনি, তাই কানের কাছে করালী।’

‘বলো কী, রোজ আমি স্টেথো ফেলে ডজন-ডজন হৃদয়ের শব্দ শুনি!’

‘সে-সব অসুস্থ হৃদয়। নিজের হৃদয়ের আসল শব্দ শোনার চেষ্টা করো। বড় অন্ধকার, বড় বেসুরো। বোসো, বোসো।’

আমরা বসলুম, দুজনে, দুটো পাথরে। সত্যিই মেজোমামাকে কেমন যেন অন্যরকম মনে হচ্ছে। রহস্যময়। মেজোমামা বললেন, ‘আচ্ছা দাদা, ক-এ কী হয়?’

‘ক-এ কলতলা।’

‘ক-এ কাঁঠালতলা হলে আপত্তি আছে?’

‘না। তবে তুমি বলেছিলে কলতলা।’

‘আচ্ছা দাদা, খ-এ যদি খড়ের বদলে খরগোশের গর্ত হয়, তোমার আপত্তি হবে?’

‘না, হতে পারে।’

‘তা হলে ক খ গ ঘ যদি এইরকম হয়, কাঁঠালতলায় খরগোশের গর্তে খড়গ, তা হলে কেমন হয়!’

‘কিন্তু গোয়ালে তা হলে কী হবে?’

‘গোয়ালটা গোরুকে ছেড়ে দাও। অবোধ জীবটিকে শান্তিতে, মশার কামড়ে থাকতে দাও।’

‘বেশ, তাই হোক।’

‘দেখি টর্চটা দাও।’

মেজোমামা বড়মামার হাত থেকে টর্চ দিলেন, ‘নাও, এইবার দ্যাখো।’

মেজোমামা টর্চের বোতাম টিপলেন। আলোয় রেখায় কিছু দূরে একটা গর্ত দেখা গেল।

‘দাদা! কী দেখছ, এই সেই গর্ত!’

‘কিন্তু খরগোশ আসে কোথা থেকে?’

‘খরগোশ আসার তো দরকার নেই। এই রহস্যে গর্তটাই বড় কথা, খরগোশটা নয়।’

‘তা হলে?’

‘আর প্রশ্ন নয়, গর্ত ইজ এ ক্লিয়ার প্রূফ অব আওয়ার গুপ্তধন। লেট আস স্টার্ট।’

‘রাতের বেলায় গর্তে খোঁড়াখুঁড়ি না করাই ভালো। বলা যায় না, সাপখোপের ব্যাপার থাকতে পারে।’

‘দেখ দাদা, ভয় পেলে মানুষের কিছু হয় না। সাহস চাই, সাহস। তুমি টর্চটা ধরো, আমি শাবল চালাই। আমার সে সাহস আছে।’

‘কাল সকালে করলে হত না ভাই!’

‘সকালে? গুপ্তধন কেউ কোনও দিন সকালে, সবার সামনে খোঁজে? গুপ্তধন গোপনে রাতের অন্ধকারে অনুসন্ধানের জিনিস। বিপদের ঝুঁকি থাকবে, বাধা থাকবে, ভয় থাকবে, মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকবে। এ তো আর ময়রার দোকানের মোয়া নয়। অতএব আজই। এখনই। জয় মা!’

মেজোমামা নিচু হয়ে পায়ের কাছ থেকে যে জিনিসটা তুলে নিলেন, সেটি একটি বড় সাইজের শাবল। চাঁদের আলোয় শাবল হাতে মেজোমামা। কেমন যেন দেখাচ্ছে! গুপ্তধন সত্যিই কি আছে? দিনের বেলায় বিশ্বাস হয় না। রাতের বেলায় ভাবলে গা ছমছম করে।

মেজোমামা বললেন, ‘বলো, ওঁ বাস্তু পুরুষায় নমঃ।’

আমরা বললুম, ‘ওঁ বাস্তু পুরুষায় নমঃ।’

একটা প্যাঁচা ডাকল। প্যাঁচার ডাক নিশ্চয়ই শুভলক্ষণ। মা লক্ষ্মীর বাহন বার-তিনেক চ্যাঁ-চ্যাঁ করে ডাকল। সেই ডাকের সঙ্গে ডাক মিলিয়ে মেজোমামা ডাকলেন—জয় মা। তারপর গর্তে মারলেন শাবলের খোঁচা। খোঁচা মারার সঙ্গে সঙ্গে ঝম করে একটা শব্দ হল।

মেজোমামা সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে পিছিয়ে এলেন। বড়মামাকে বললেন, ‘শুনলে, কিছু শুনতে পেলে?’

বড়মামা বললেন, ‘কে যেন টাকার তোড়া নাচাল!’

‘রাইট। অ্যাবসলিউটলি কারেক্ট। দাঁড়াও, আর একটা শাবল চালাই।’

মেজোমামা নাচের ভঙ্গিতে আর একবার শাবল চালালেন, এবার ঝমঝমাঝম করে অদ্ভুত একটা শব্দ হল। শুধু শব্দ নয়, গর্তের মুখে কী একটা বেরিয়ে এসে আবার ভেতরে ঢুকে গেল।

বড়মামা বললেন, ‘বুঝলি, মনে হচ্ছে মোহরের থলে।’

মেজোমামা বললেন, ‘রাইট ইউ আর, অ্যাবসলিউটলি কারেক্ট। দাঁড়াও, বেরিয়ে আসতে ভয় পাচ্ছে। টেনে বের করে আনি।’

মেজোমামা হাঁটু গেড়ে বসে বললেন, ‘ফোকাস, ফোকাস।’

আমার হাতের টর্চ ঠিক জায়গায় গিয়ে পড়ল। মেজোমামা গর্তে শাবল চালিয়ে কিছু একটা সামনের দিকে টেনে আনতে চাইলেন। তালগোল পাকিয়ে কী একটা বেরিয়ে এল। মেজোমামা ‘ইউরেকা’ বলে চিৎকার করে উঠলেন। বড়মামা, ‘আমার স্বপ্ন, আমার স্বপ্ন’ বলে জিনিসটাকে ধরতে গেলেন।

ঝম করে একটা শব্দ হল। গুপ্তধনের চারপাশে কাঁটা উঠল খোঁচা-খোঁচা হয়ে। বড়মামা ভয়ে পিছিয়ে গেলেন।

‘কী বল তো জিনিসটা?’

মেজোমামাও সরে এসেছেন। বড়মামার পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছেন। আলোর তেজ ক্রমশই কমে আসছে। মেজোমামা বললেন, ‘পরক্যুপাইন।’

বড়মামা বললেন, ‘তার মানে শজারু।’

‘ইয়েস।’

কাঁটা-খোঁচা শজারু, নড়েও না, চড়েও না, গর্তের মুখ আগলে বসে আছে। বড়মামা বললেন, ‘এটা মনে হয় ছদ্মবেশী যক্ষ।’

মেজোমামা বললেন, ‘গুপ্তধনের মুখে অনেক বাধা থাকে, আমাদের সুবিধের জন্যে, সব বাধা, বাধার তাল হয়ে কাঁটা উঁচিয়ে সামনে বসে আছে। মায়ের কী দয়া বলো তো। বলো, জয় মা! হেঁকে বলো।’

মেজোমামা শাবল তুলে আবার যেই গর্তের দিকে এগোতে গেছেন, শজারু উলবোনা কাঁটার বলের মতো লাফিয়ে উঠল। বড়মামা একসঙ্গে বললেন, ‘জয় মা, সাবধান!’

গোলমাল বেশ ভালোই হয়েছে মনে হয়, তা না হলে মাসিমা ঘুম ভেঙে উঠে আসবেন কেন? মাসিমা এসে বললেন, ‘তোমাদের ঘুম নেই? রাতেও পাগলামি? তোমাদের জন্য এবার দেখছি বাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে। এ কী, এটা আবার কী?’

বড়মামা ভালোমানুষের মতো বললেন, ‘আমাদের গুপ্তধন।’

মাসিমা ঝুঁকে পড়লেন সামনে, ‘ও মা, এ তো সেই শজারুটা। ক’দিন হল আমাদের বাগানে এসে বাসা বেঁধেছে। ওটাকে টেনেটুনে গর্ত থেকে বের করেছ কেন? ওর বাচ্চা হয়েছে। তোমাদের কি খেয়েদেয়ে আর কোনও কাজ নেই। যাও, বাড়ি যাও।’

মেজোমামা বললেন, ‘দাদা!’

বড়মামা বললেন, ‘ভাই।’

মাসিমা বললেন, ‘হ্যাঁ, দাদা, ভাই, ভাগনে, তিনজনেই আর একটুও কথা না বাড়িয়ে সোজা যে-যার ঘরে। ভোর হয়ে আসছে। উঃ, দেখেছ, কি কাণ্ড, একেবারে শাবল-টাবল এনে মনের আনন্দে। জানে তো, কুসি এখন ঘুমোচ্ছে!’

বড়মামা বললেন, ‘মেজো, গোয়ালটা একবার উসকে দেখলে হয় না? থাকলেও থাকতে পারে। মনে আছে, কতকাল আগে আমরা পড়েছিলুম,

যেখানে দেখিবে ছাই

উড়াইয়া দেখ ভাই

মিলিলেও মিলিতে পারে

পরশপাথর।’

‘দ্যাটস রাইট, দ্যাটস রাইট।’

কাঁঠাল গাছের তলা থেকে মাসিমার গলা পাওয়া গেল, ‘মেজদা, তোমার এই সুটকেসে কী আছে? এখানে ফেলে গেলে কেন?’

‘আমার সুটকেস? আমার আবার সুটকেস আসবে কোথা থেকে? কই দেখি?’

আবার আমরা কাঁঠালতলায়। শজারু গর্তে ফিরে গেছে। মেজোমামা যে পাথরে বসেছিলেন, চাঁদ পশ্চিমে হেলে পড়ায়, সেখানে এক ঝলক আলো এসে পড়েছে। পাথরের পাশে ঝকঝক করছে ছোট্ট একটা অ্যালুমিনিয়ামের সুটকেস। এইমাত্র কেউ যেন রেখে উঠে গেছে।

মেজোমামা বললেন, ‘একটু আগেও এটা এখানে ছিল না।’

বড়মামা বললেন, ‘আর ইউ শিওর?’

‘ডেড শিওর।’

‘তা হলে এটাকে খোলা যাক। আমার মনে হয় এর মধ্যে আমাদের জন্যে স্পেশ্যাল কোনও খবর আছে। গুপ্তধন মানুষকে এইভাবেই এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় ছুটিয়ে নিয়ে যায়।’

মাসিমা সুটকেসটা তুললেন। দু’মামা একসঙ্গে জিগ্যেস করলেন, ‘কী রে, খুব ভারী! খুব ভারী?’

মাসিমা কাঠকাঠ গলায় বললেন, ‘ভেতরে চলো। মনে হচ্ছে কিছু আছে।’

রহস্য-উপন্যাসের মতো দৃশ্য। বিশাল উঠোনে এ বাড়ির কোনও পূর্ব-পুরুষ একটা বেদী তৈরি করে রেখেছিলেন। পাথর বাঁধানো। সেই বেদীতে আমরা বসে আছি। মাথার অনেক ওপরে চৌকো আকাশ। ভোর হয়ে আসছে। বেশ একটা হিম-হিম ভাব।

মেজোমামা বললেন, ‘কখন সুটকেসটা খুলবি রে কুসি?’

‘ধৈর্য ধরো।’

বড়মামা বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ধৈর্য মানুষের একটা বড় গুণ, ধৈর্য ছাড়া কিছু হয় না।’

মাথার ওপর শেষ তারাটি মিলিয়ে গেল। একটা-দুটো পাখি ডাকছে। মেজোমামা বললেন, ‘আর কতক্ষণ ধৈর্য ধরাবি কুসি?’

মাসিমা বললেন, ‘আলো ফুটুক।’

বড়মামা বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আলো আলো। আলো ছাড়া কিছু হয় না।’

পাখিদের শোরগোল পড়ে গেছে। মেজোমামা বললেন, ‘তোর ব্যাপারটা কী বল তো কুসি? এভাবে ঝুলিয়ে রাখছিস কেন বোন?’

‘তোমাদের একটু শিক্ষা হোক।’

বড়মামা বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সব বয়সই শিক্ষার বয়েস। শেখার কোনও বয়েস নেই।’

সদরে একটা শব্দ হল। এইবার একে একে সব আসতে আরম্ভ করবে। কাজের লোক। বাড়িতে শোরগোল পড়ে যাবে। সবশেষে আসবেন সাইকেল চেপে কম্পাউন্ডারবাবু। এসেই চা চা করবেন।

প্রথমেই যে এল, সে এল মোক্ষদার নাতি। ছোট্ট এতটুকু ছেলে, ফুলোফুলো গাল। চোখ ঘুম লেগে আছে। পরনে হাফ প্যান্ট, গেঞ্জি। গত বছর ছেলেটির বাবা মারা গেছেন। মাসিমাই মানুষ করছেন বলা চলে। ওষুধ, পথ্য, জামাকাপড়, অল্পস্বল্প লেখাপড়া শেখানো। সারাদিন এ বাড়িতেই থাকে। বড় শান্ত ছেলে।

মাসিমা ডাকলেন, ‘শঙ্কর, এদিকে এসো।’

মেজোমামা বললেন, ‘তোর মতলবটা কী বল তো কুসি?’

মাসিমা কথা কানে তুললেন না। শঙ্কর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। মাসিমা বললেন, ‘কান ধরো। দু’কান।’

ভালো মানুষ শঙ্কর আদেশ পালন করল। মাসিমা বললেন, ‘তুমি এটা কাল বাগানে ফেলে গিয়েছিলে?’

শঙ্কর ঘাড় নাড়ল। দুই মামা বললেন, ‘যাব্বাবা, শুধু শুধু তুই বসিয়ে রাখলি!’

দু’জনে উঠতে যাচ্ছিলেন। মাসিমা বললেন, ‘বোসো, শুধু শুধু নয়। এইবার আমি বাক্স খুলব। সত্যিই এতে গুপ্তধন আছে। এই দ্যাখো।’

ছোট একটা স্লেট, পেনসিল, আর প্রথমভাগ। মাসিমা প্রথম ভাগের পাতা খুলে ভোরের আলোয় মেলে ধরলেন। ‘নাও পড়ো। দুজনেই পড়, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে।’

দুই মামা সমস্বরে পড়লেন, ‘ক খ গ ঘ।’

‘কেমন লাগছে পড়তে?’

দু’জনেই বললেন, ‘ফাস্টক্লাস! আর একবার পড়ি। কী সুন্দর! ক খ গ ঘ। উঃ, মনে হচ্ছে শৈশব আবার ফিরে এসেছে। দাদা?’

‘ভাই।’

‘বুঝলে কিছু? কুসি কী বোঝাতে চাইল, বুঝলে?’

‘না রে ভাই।’

‘মোটা মাথা।’

‘অ্যাঁ।’

‘হ্যাঁ। কিঞ্চিৎ গবেট। গুপ্তধন হল ক খ গ ঘ। বর্ণ পরিচয়। আর লুপ্তধন, আমাদের শৈশব।’

‘আরে হ্যাঁ, তাই তো, তাই তো।’

‘তা হলে বুঝলে, মা লক্ষ্মী আসেননি। এসেছিলেন মা সরস্বতী।’

‘বীণা! হাতে তো বীণা ছিল না ভাই।’

‘তুমি গবেট। মা কি তোমাদের বাজনা শেখাতে এসেছিলেন? মা এসেছিলেন মানুষের জীবনের গুপ্তধনের সন্ধান দিতে!’

‘আর ইউ শিওর?’

‘ডেড শিওর। মায়ের হাতের বীণা, আর মায়ের পায়ের প্যাঁচা সরিয়ে নিলে, তুমি বলতে পারবে, কে লক্ষ্মী, কে সরস্বতী?’

‘না।’

‘সব এক, সব একাকার।’

‘তা হলে তুমি বলছ, জ্ঞানের সন্ধানই গুপ্তধনের সন্ধান!’

‘ইয়েস।’

‘মা সেই কথাই বলে গেলেন?’

‘ইয়েস।’

‘তা হলে কুসি, চা বানাও, আজ কী আনন্দ, কী আনন্দ!’

ভোরের আলোয় শঙ্কর দুলে দুলে আধো-আধো গলায় পড়ছে, ক খ গ ঘ।