সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
মামা সমগ্রউপন্যাস
একদা এক বাঘের গলায়
এক
মেজোমামা আর মাসিমা পেছনের আসনে। আমি সামনে বড়মামার পাশে। গাড়ি চলেছে। বড়মামার হাত বেশ তৈরি হয়ে গেছে। এই সেদিন গাড়ি থেকে ‘এল’ প্লেটটা খোলার অনুমতি মিলেছে।
‘বাঃ তোমার হাত তো বেশ তৈরি হয়ে গেছে হে।’
মেজোমামা পেছন থেকে নাকিসুরে বললেন। সুর নাকি হবার কারণ আছে। মেজোমামা পুরীতে বেড়াতে গিয়েছিলেন একা একা। হঠাৎ টেলিগ্রাম এল, ‘কাম শার্প। ব্রাদার ইল’। বড়মামা ছুটলেন, সঙ্গে গেলেন কম্পাউন্ডার দাদা। পরের পরের দিন ফিরে এলেন মেজোমামাকে নিয়ে। খুব কাহিল অবস্থা মেজোমামার। কোমরভাঙা দ হয়ে গাড়ি থেকে নেমে এলেন। মুখে লেগে আছে করুণ বীরের হাসি। কারুর বারণ না শুনে সমুদ্রে চান করতে নেমেছিলেন। ঢেউ এসে তালগোল পাকিয়ে দিয়েছে। ডুবেই যেতেন। চ্যাম্পিয়ান সাঁতারু পিনাকী রুদ্র সেই সময় পুরীতেই ছিলেন। সমুদ্রে চান করছিলেন সুইমিং কস্ট্যুম পরে। মেজোমামার নড়া ধরে ডাঙ্গায় তুলে এনেছিলেন। তুলতে তুলতেই নোনা জল খেয়ে মেজোমামার ভুঁড়িটি গণেশঠাকুরের মতো হয়ে গিয়েছিল। সেই নোনাজলের চুবুনিতে সুর নাকি হয়ে গেছে। বড়মামা বলেছেন, ‘সারতেও পারে, না-ও সারতে পারে।’
মেজোমামা বললেন, ‘আহা, হাত আর দুটো পা তোমার বেড়ে সুরে বলছে, যেন কনসার্ট।’
মাসিমা বললেন, ‘অ্যাতো আস্তে চালাচ্ছে কেন? এর চেয়ে বেশি স্পিড দেওয়া যায় না?’
মেজোমামা বললেন, ‘গাড়িটা বৃদ্ধ হয়েছে তো, তাই ধীরে ধীরে চলছে। সেকেন্ড-হ্যান্ড গাড়ি। চলছে যে এই না কত! না, না, ধড়ফড় করে দরকার নেই, তুমি ধীরেই চলো। খরগোশও গন্তব্যে পৌঁছোবে, কচ্ছপও গন্তব্যে পৌঁছোবে। একদিন আগে আর পরে।’
আড়চোখে বড়মামার দিকে তাকালুম। রাগে মুখ লাল হয়ে উঠেছে। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘খরগোশ পৌঁছোতে পারেনি, কচ্ছপই পৌঁছেছিল। স্লো অ্যান্ড স্টেডি উইনস দি রেস।’
মাসিমা বললেন, ‘পেছন থেকে অন্য সব গাড়ি হুশ হুশ করে চলে যাচ্ছে। যাবার সময় আমাদের দিকে তাকাতে তাকাতে যাচ্ছে। হাসছে। আমার ভীষণ অপমান লাগছে।’
‘তুমি চোখ বুজে থাকো। চোখ খুলো না। চিড়িয়াখানা এলে আমি বলে দোব।’ মেজোমামা মুচকি হেসে বললেন।
‘দাদা, তোমার ভয় করছে বুঝি?’ মাসিমা ভালোমানুষের মতো বড়মামাকে প্রশ্ন করলেন।
বড়মামা বললেন, ‘একটা অ্যাকসিডেন্ট হোক, এই বোধহয় চাইছিস কুসি!’
মেজোমামা বললেন, ‘সে-ভয় নেই বড়দা। তুমি তো একপাশ দিয়ে হেঁটে-হেঁটে চলেছ। তোমার মার নেই। অ্যাকসিডেন্ট হবে কী করে? একে বলে ওয়াকিং-স্পিডে গাড়ি চালানো।’
বড়মামা শাঁত করে গাড়িটাকে রাস্তার বাঁ পাশে গাছতলায় দাঁড় করিয়ে দিলেন। মাসিমা জিগ্যেস করলেন, ‘কী হল, গাড়ির জলতেষ্টা পেয়েছে?’
বড়মামা হাতজোড় করে বললেন, ‘আপনারা দয়া করে নেমে যান। পেছনে বসে বসে আরাম করে কাছা ধরে টানা চলবে না, চলবে না। যেখানে একতা নেই, সেখানে গতিও নেই। ইউনাইটেড উইস্ট্যান্ড, ডিভাইডেড উই ফল। সেই পতনই এইবার হবে, দয়া করে আপনারা দুজনে নেমে যান।’
মেজোমামা বললেন, ‘কী হবে রে কুসি। বড়বাবু যে খেপে গেছে।’
‘তুমি কান ধরে ক্ষমা চাও মেজদা। বলো, আর করব না। অন্যায় হয়ে গেছে।’
‘আমি একা কেন? যত দোষ নন্দ ঘোষ। তুইও কিছু কম যাস না। তুইও ক্ষমা চা।’
‘আমার সঙ্গে বড়দার অন্য সম্পর্ক, স্নেহের সম্পর্ক। তুমি মেজদা চিরটাকাল সুযোগ পেলেই বড়দাকে খোঁচা মারো।’
বড়মামা বললেন, ‘তোমরা কেউই কম যাও না। মিটমিটে শয়তান। গাড়িটা কেনার আগে তুই কুসি সবচেয়ে বিরোধিতা করেছিলিস। ঠ্যালাগাড়ি, ছ্যাকরাগাড়ি, যার পাঁঠা সেই বুঝুক, এই সব অনেক চ্যাটাং চ্যাটাং বুলি ঝেড়েছিলে। একে রামে রক্ষে নেই, দোসর লক্ষ্মণ। মেজো তখন তালে তাল বাজিয়ে গিয়েছিল। তোমাদের আমি হাড়ে-হাড়ে চিনি। সব এক-একটি ধানি-লঙ্কা।’
দুজনে একই সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘বড়দা, আমাদের ক্ষমা করে দাও। তোমার দয়ার শরীর। সাক্ষাৎ মহাদেব। বাবা ভোলানাথ মাইনাস জটাজুট। ক্ষমা করে দাও প্রভু!’
‘না, সম্ভব নয়। এ তো ক্ষমা চাওয়া নয়, এ এক ধরনের ব্যঙ্গ।’
মাসিমা বললেন, ‘তুমি আর-একবার আমাদের চানস দিয়ে দ্যাখো বড়দা, এবার আমরা একেবারে চুপচাপ থাকব।’
‘চুপ করে থাকলেই হবে! ভেতরে সব ব্যঙ্গবিদ্রূপ পুষে রাখবে, বাইরেটা সব সাজানো-গোছানো, চকচকে, চমৎকার। ওতে আমি আর ভুলছি না ভাই। তোমরা নেমে ট্যাকসি-ম্যাকসি ধরে বাড়ি চলে যাও। আমি আর আমার ভাগনে, পৃথিবীতে দ্বিতীয় আর কেউ নেই।’
‘কেন, তোমার ঈশ্বর!’
‘আঃ, চুপ করো না মেজদা। তোমার স্বভাবটা বড় বিশ্রী হয়ে যাচ্ছে।’
‘ক্ষমা চাইলে যে-মানুষ ক্ষমা করতে জানে না, সে কেমন মানুষ?’
বড়মামা বললেন, ‘বনমানুষ। তোমরা হলে সব শহর-মানুষ, আমি একটা শিমপাঞ্জি।’
‘শুধু শুধু তোমরা কেন ঝগড়া করছ বলো তো। দিন-দিন তোমাদের বয়েস বাড়ছে না কমছে? বড়দা, তুমি স্টার্ট দেবে কি-না বলো, এবার কিন্তু আমি নিজ-মূর্তি ধরব। লোক জড়ো হয়ে যাবে। ভালো হবে?’
আড়চোখে মাসিমার দিকে তাকিয়ে বড়মামা গাড়িতে স্টার্ট দিলেন। চিউয়িংগাম খাবার মতো মুখ নড়ছে। তার মানে কিছু একটা বলতে চান। না বলতে পেরে চিবিয়ে গিলে ফেলছেন। এবার সব চুপচাপ। কারুর মুখে কোনও কথা নেই। মেজোমামা হুঁহুঁ করে গানের সুর ভাঁজছেন। গানটা আমার চেনা। বিশেষ সুবিধের গান নয়। বাণীটা বড়মামার চেনা হলে গাড়ি আবার থেমে পড়ত।আমার আশেপাশের সেরা রেস্টুরেন্ট
মেজোমামার হুঁহুঁ ক্রমশ জোরদার হচ্ছে। ভাব এসে গেছে। বড়মামা মেজোমমাকে চাপা দেবার জন্যে কার-স্টিরিওর দিকে হাত বাড়ালেন। মেজোমামা গান থামিয়ে বললেন, ‘তুমি কি টেপ চালাচ্ছ? তাহলে কীর্তন নয়, ইংরিজি কিছু চালাও।’
মাসিমা বললেন, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত নেই?’
আমি বললুম, ‘বড়মামা, আধুনিক আছে?’
বড়মামা হাত টেনে নিতে নিতে বললেন, ‘আমার কাছে কিছুই নেই।’
মেজোমামা বললেন, ‘অ, ওটা তাহলে তোমার ডামি-স্টিরিও। খোলস আছে, ভেতরে মাল নেই, ফর শো। কত কায়দাই জানো তুমি! তোমার গাড়িতে ইঞ্জিন আছে তো?’
মাসিমা বিরক্তির গলায় বললেন, ‘আঃ, মেজদা, কেন বকবক করছ। এই একটু আগে চুক্তি হল, চুপচাপ বসে থাকবে, ফ্যাচর ফ্যাচর করবে না। এরই মধ্যে ভুলে গেলে!’
বড়মামা বললেন, ‘স্বভাব কুসি, স্বভাব। স্বভাব সহজে পালটানো যায় না। দোয়েল কি কোয়েলের মতো ডাকতে পারবে? ছাগল কি ভেড়ার মতো গুঁতোতে পারবে। ঘোড়া কি হাতির মতো স্থির ধীর হতে পারবে?’
‘শুনছিস কুসি, শুনছিস? গাড়িধারী বড়লোকের বোলচাল শুনছিস?’
মাসিমা বললেন, ‘বড়দা, তুমি গাড়ি থামাও, আমি নেমে যাই। অষ্টপ্রহর গজকচ্ছপের লড়াই আমার অসহ্য লাগে।’
মেজোমামা বললেন, ‘আচ্ছা, আচ্ছা, এই আমি চুপ করছি। স্পিকটি নট। তবে আমিও বলে রাখছি, গাড়ি আমি কিনবই। নতুন গাড়ি, ধ্যাদ্ধেড়ে সেকেন্ড-হ্যান্ড নয়। তখন কিন্তু আমি এই গাড়িতে পা দোব না। এই ত্রিসীমানায় আসব না। সাধলেও না।’
‘যখন কিনবে তখন দেখা যাবে, আগেই এত আস্ফালন ভালো নয়। তোমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে, আমার জানা আছে। তোমার পাসবই তো আমার কাছে।’
‘ধার করব।’
‘কে তোমাকে ধার দেবে?’
‘ব্যাঙ্ক। ব্যাঙ্ক দেবে।’
বড়মামা হঠাৎ বললেন, ‘কে গ্যারাণ্টার হবে?’
‘কেন, তুমি। তুমি হবে। তুমি ছাড়া আমার কে আছে?’
বড়মামা হাহা করে হেসে উঠলেন, ‘এই জন্যেই তোকে আমি এত স্নেহ করি। বুদ্ধিশুদ্ধি তোর একদম পাকেনি। বুড়োখোকা।’
মাসিমা বললেন, ‘আমি বুঝি তোমার কেউ নই?’
মেজোমামা বললেন, ‘কেন অভিমান করছিস, তুই ছাড়া আমার জগৎ অন্ধকার।
ঠ্যাং ঠ্যাং, ঠ্যাং ঠ্যাং ঘণ্টা বাজিয়ে উলটো দিক থেকে একটা দমকল আসছে। বড়মামা বাঁ পাশে সরতে সরতে বললেন, ‘সেরেছে, দমকল যে রে বাবা!’
মেজোমামা বললেন, ‘ভয় পেও না বড়দা, দমকল আগুন নিবিয়ে ফিরছে। যতই ঘণ্টা বাজাক সে, তাড়া নেই। স্টিয়ারিং সোজা রাখো।’
বড়মামা শব্দ করে হেসে, গাড়িটাকে ঠেলে রাস্তায় তুললেন। ডান দিক দিয়ে ঝড়ের বেগে একটা দৈত্য-লরি বেরিয়ে গেল। বড়মামা চমকে বাঁ পাশে আমার দিকে কাত হয়ে পড়লেন। মেজোমামা পেছন থেকে বলে উঠলেন, ‘জয় ঠাকুর, প্রাণে বাঁচলে হয়।’
মাসিমা বললেন, ‘ভয় পেও না, রাখে কেষ্ট মারে কেন, মারে কেষ্ট রাখে কে?’
বড়মামা বললেন, ‘ঘাবড়াও মাত। তোমরা শুধু লরিগুলোকে একটু কনট্রোলে রাখো।’
মেজোমামা প্রশ্ন করলেন, ‘কীভাবে?’
‘পেছনে যারা আছ, তারা পেছনে তাকিয়ে থাকো। লরি এলেই আমাকে জানাবে।’
‘তোমার মাথার ওপর একটা আয়না আছে। কী জন্যে আছে?’
‘আয়না দেখে বোঝা যায় না, আসছে না যাচ্ছে। গুলিয়ে যায়।’
গাড়ি চলেছে, গুড়গুড় করে। আর কতদূর! ভীষণ ভয় করছে। বড়মামা গাড়ি চালাচ্ছেন, না কোদাল চালাচ্ছেন, বোঝা শক্ত।