পাপ

সাম্যের গান গাই!–

যত পাপী তাপী সব মোর বোন, সব হয় মোর ভাই।

এ পাপ-মুলুকে পাপ করেনিকো কে আছে পুরুষ-নারী?

আমরা ত ছার;–পাপে পঙ্কিল পাপীদের কাণ্ডারি!

তেত্রিশ কোটি দেবতার পাপে স্বর্গ সে টলমল,

দেবতার পাপ-পথ দিয়া পশে স্বর্গে অসুর দল!

আদম হইতে শুরু করে এই নজরুল তক সবে

কম-বেশি করে পাপের ছুরিতে পুণ্যে করেছে জবেহ্‌।

বিশ্ব পাপস্থান

অর্ধেক এর ভগবান, আর অর্ধেক শয়তান্‌!

ধর্মান্ধরা শোনো,

অন্যের পাপ গনিবার আগে নিজেদের পাপ গোনো!

পাপের পঙ্কে পুণ্য-পদ্ম, ফুলে ফুলে হেথা পাপ!

সুন্দর এই ধরা-ভরা শুধু বঞ্চনা অভিশাপ।

এদের এড়াতে না পারিয়া যত অবতার আদি কেহ

পুণ্যে দিলেন আত্মা ও প্রাণ, পাপেরে দিলেন দেহ।

বন্ধু, কহিনি মিছে,

ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব হতে ধরে ক্রমে নেমে এসো নীচে,–

মানুষের কথা ছেড়ে দাও, যত ধ্যানী মুনি ঋষি যোগী

আত্মা তাঁদের ত্যাগী তপস্বী, দেহ তাঁহাদের ভোগী!

এ-দুনিয়া পাপশালা,

ধর্ম-গাধার পৃষ্ঠে এখানে শূণ্য-ছালা!

হেথা সবে সম পাপী,

আপন পাপের বাটখারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপি!

জবাবদিহির কেন এত ঘটা যদি দেবতাই হও,

টুপি পরে টিকি রেখে সদা বলো যেন তুমি পাপী নও।

পাপী নও যদি কেন এ ভড়ং, ট্রেডমার্কার ধুম?

পুলিশী পোশাক পরিয়া হয়েছ পাপের আসামী গুম্!

বন্ধু, একটা মজার গল্প শোনো,

একদা অপাপ ফেরেশ‌্তা সব স্বর্গ-সভায় কোনো

এই আলোচনা করিতে আছিল বিধির নিয়মে দুষি –

দিন রাত নাই এত পূজা করি, এত করে তাঁরে তুষি,

তবু তিনি যেন খুশি নন – তাঁর যত স্নেহ দয়া ঝরে

পাপ-আসক্ত কাদা ও মাটির মানুষ-জাতিরই পরে!

শুনিলেন সব অন্তর্যামী, হাসিয়া সবারে কন,—

মলিন ধুলার সন্তান ওরা বড় দুর্বল মন,

ফুলে ফুলে সেথা ভুলের বেদনা-নয়নে , অধরে শাপ,

চন্দনে সেথা কামনার জ্বালা, চাঁদে চুম্বন-তাপ!

সেথা কামিনীর নয়নে কাজল, শ্রোনিতে চন্দ্রহার,

চরণে লাক্ষা, ঠোঁটে তাম্বুল, দেখে মরে আছে মার!

প্রহরী সেখানে চোখা চোখ নিয়ে সুন্দর শয়তান,

বুকে বুকে সেথা বাঁকা ফুল-ধনু, চোখে চোখে ফুল-বাণ।

দেবদূত সব বলে, ‘প্রভু, মোরা দেখিব কেমন ধরা,

কেমনে সেখানে ফুল ফোটে যার শিয়রে মৃত্যু-জরা!’

কহিলেন বিভু-‘তোমাদের মাঝে শ্রেষ্ঠ যে দুইজন

যাক্‌ পৃথিবীতে, দেখুক কি ঘোর ধরণির প্রলোভন!’

‘হারুত’ ‘মারুত’ ফেরেশতাদের গৌরব রবি-শশী

ধরার ধুলার অংশী হইল মানবের গৃহে পশি।

কায়ায় কায়ায় মায়া বুলে হেথা ছায়ায় ছায়ায় ফাঁদ,

কমল-দিঘিতে সাতশো হয়েছে এই আকাশের চাঁদ!

শব্দ গন্ধ বর্ণ হেথায় পেতেছে অরূপ-ফাঁসী,

ঘাটে ঘাটে হেথা ঘট-ভরা হাসি, মাঠে মাঠে কাঁদে বাঁশী!

দুদিনে আতশি ফেরেশতা প্রাণ- ভিজিল মাটির রসে,

শফরী-চোখের চটুল চাতুরী বুকে দাগ কেটে বসে।

ঘাঘরী ঝলকি গাগরী ছলকি নাগরী ‘জোহরা’ যায় –

স্বর্গের দূত মজিল সে রূপে, বিকাইল রাঙা পায়!

অধর-আনার-রসে ডুবে গেল দোজখের নার-ভীতি

মাটির সোরাহি মস্তানা হল আঙ্গুরি-খুনে তিতি!

কোথা ভেসে গেল সংযম-বাঁধ, বারণের বেড়া টুটে,

প্রাণ ভরে পিয়ে মাটির মদিরা ওষ্ঠ-পুষ্প-পুটে।

বেহেশ্‌তে সব ফেরেশ্‌তাদের বিধাতা কহেন হাসি–

‘হারুত মারুতে কি করেছে দেখো ধরণি সর্বনাশী!’

নয়না এখানে যাদু জানে সখা এক আঁখি-ইশারায়

লক্ষ যুগের মহা-তপস্যা কোথায় উবিয়া যায়।

সুন্দর বসুমতী

চিরযৌবনা, দেবতা ইহার শিব নয়–কাম রতি!