» » বিবাহ-পৰ্ব

বর্ণাকার

বিবাহ-পৰ্ব
প্রথম পরিচ্ছেদ

আজ ২৫ শে ভাদ্র, বৃহস্পতিবার। আনোয়ারাকে দেখিবার ও তাঁহার বিবাহের লগ্নপত্রাদি স্থির করিবার জন্য আবুল কাসেম তালুকদার, জব্বার আলি খাঁ প্রমুখ ২০/২৫ জন ভদ্রলোক লইয়া আজিমুল্লা ভূইঞা সাহেবের বাড়িতে আসিয়াছে। ভ্রাতুষ্পুত্রের বিবাহোপলক্ষে লোকজন আসিয়াছে, তাই গোলাপজান আজ পরমানন্দে তাহাদের নাস্তার আয়োজনে ব্যস্ত। এই সময় তাহার আদেশে একজন দাসী কূপের পারে পানি আনিতে গিয়াছিল, কিন্তু পূর্ণ কলসী উত্তোলন কালে হঠাৎ দড়ি ছিঁড়িয়া তাহা কূপ মধ্যে ডুবিয়া গেল, দাসী অপ্রতিভ হইয়া কূপের পাশে দাঁড়াইয়া রহিল। এ ঘটনা অল্প সময়েই রাষ্ট্র হইয়া পড়িল।

এই বিবাহে আনোয়ারার দাদিমার সম্পূর্ণ অমত পূর্ব হইতেই ছিল। অর্থ লোলুপ ভূঁইঞা সাহেব জননীর পায়ে ধরিয়া অনেক অনুনয়-বিনয় করিয়া তাঁহার মত গ্রহণের চেষ্টা করেন; শেষে অসমর্থ হইয়া বলেন, “মা, তুমি এ বিবাহে মত না দিলে আমাকে আর মধুপুরে দেখিতে পাইবে না।” একমাত্র পুত্র, তাই মায়ের প্রাণ পুত্রের কথায় শিহরিয়া উঠিল। তিনি ভাবিলেন, পুত্র হয় আত্মহত্যা করিবে, না হয় দেশান্তরে চলিয়া যাইবে। পুত্রস্নেহাকর্ষণে তখন বৃদ্ধার পৌত্রী বাৎসল্য শিথিল হইয়া পড়িল। তিনি এই বিবাহ সম্বন্ধে অন্য কোন বাধা-বিঘ্ন না দিয়া মিয়মনা হইয়া রহিলেন। এক্ষণে উপস্থিত দুর্ঘটনায় পুত্রকে ডাকিয়া কহিলেন, “খোরশেদ! শুভক্ষণে কুয়ার কলসী ডুবিল, সুতরাং এ বিবাহে আর কিছুতেই তোমার মঙ্গল নাই। এখনও বলিতেছি, এই বিবাহদানে নিরস্ত হও।” মায়ের কথায় পুত্রের মনে অমঙ্গলের ছায়া পড়িল বটে; কিন্তু তিনি স্ত্রী ও সম্বন্ধীর মনস্তুষ্টির জন্য ও অর্থলোভে কহিলেন, “মা, তোমাদের ও-সব মেয়েলী কথার কোন মূল্য নাই। দড়ি ছিঁড়িয়া কুপে কি আর কখনও কলসী ডুবে না?”

মা একান্ত ক্ষুব্ধ হইয়া আর কোন দ্বিরক্তি করিলেন না।

এদিকে ষোড়শোপচারে পাত্রপক্ষকে নাশতা খাওয়ান হইল। আহারান্তে তাহারা পান- তামাক ধ্বংস ও নানাবিধ গল্প-গুজবে প্রবৃত্ত হইলেন। বিবাহ সম্বন্ধে কথাবার্তাও ২/১ জন ফুসফাস ইশারা-ইঙ্গিতে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষে কহিতে লাগিলেন। কিন্তু কাল কাহারও মুখাপেক্ষী নহে, তাহার অপরিবর্তিত নিয়মে সূর্য মধ্যগমন ত্যাগ করিয়া ক্রমে পশ্চিম দিকে হেলিয়া পড়িল। এই সময় ধীরে ধীরে উত্তর-পশ্চিম আকাশ-প্রান্তে গাঢ় মেঘের সঞ্চার হইল, তৎসঙ্গে গগনের বিশাল বক্ষ হইতে গুড় ম গুড় ম ধ্বনি হইতে লাগিল, বাতাস অল্পে অল্পে বহিয়া ক্রমশ প্রবলবেগ ধারণ করিল, শেষে ঝাঞ্ঝাবাতের সৃষ্টি করিয়া দিল। বৃষ্টিপাত আরম্ভ হইল; কিন্তু গর্জন যেরূপ হইল বর্ষণ সেরূপ হইল না। ঝঞ্ঝাবাতে সুযোগ পাইয়া লঘু সূক্ষ্ম বারিধারা আছড়াইয়া আছড়াইয়া দিগন্তে ছড়াইতে লাগিল। সঘন-বিকশিত বিদ্যুৎ-বিভায় লোক-লোচনের অশান্তি ঘটাইয়া তুলিল। দুর্বিসহ যন্ত্রনায় নারকীয় চিৎকারের ন্যায় আকাশ ভেদ করিয়া থাকিয়া থাকিয় চড়ু চড়ু কড়ু কড়ু শব্দ হইতে লাগিল। লোকে মনে করিল এইবার বুঝি মাথায় বাজ পড়ে। দুর্যোগ থামিল না; বৃষ্টি, বায়ু ও বিদ্যুৎ মিলিয়া মিশিয়া প্রকৃতিকে ক্রমশ অস্থির করিয়া তুলিল। গাছপালা তরণী-আরহী প্রভৃতি উলট পালট খাইতে লাগিল। সহসা একটা বজ্ৰ ভূঞা সাহেবের বাড়ির উপর পড়িল! ভীষণ অশণিপাতে বাটীস্থ সকলের কানে তালা লাগিল। আনোয়ারা তাহার দাদিমাকে জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিয়া উঠিল, ভূইঞা সাহেবের অন্তরাত্মা শুকাইয়া গেল; তিনি সভয়ে তথাপি সকলকে কহিলেন, “ভয় নাই। ‘ পরক্ষণে দেখা গেল, তাঁহার গো-শালার চালে আগুন ধরিয়াছে। নিমন্ত্রিত ভদ্রলোকেরা আগুন নিভাইতে যাইয়া দেখিলেন, ভূঞা সাহেবের পালের প্রধান গরুটি মরিয়া গিয়াছে, পাশের আরও ২/১ টি গরু ও একটি ছোট রাখাল বালক আধপোড়া হইয়া মৃতবৎ অজ্ঞান রহিয়াছে। এই রাখাল-বালকটি বৃষ্টির প্রারম্ভে গো-শালায় গরু দিয়া বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় সেখানেই বসিয়াছিল। পলকে প্রলয়কাণ্ড ঘটিয়া গেল, ভদ্রলোকেরা তাড়াতাড়ি ঘরের আগুন নিভাইয়া ফেলিলেন। সকলে বালকটিকে সেবা-শুশ্রূষা করিয়া বহু কষ্টে কথঞ্চিৎ সুস্থ করিলেন। সৌভাগ্যবশত বৃষ্টি হওয়ায় ভূঞা সাহেবের অন্যান্য ঘরগুলি আগুনের হাত হইতে বাঁচিয়া গেল।

শুভ বিবাহের প্রস্তাবদিনে উপর্যুপরি দুইটি অশুভজনক ঘটনা ঘটিল দেখিয়া ভূঞা সাহেব কেমন যেন হতবুদ্ধি হইয়া পড়িলেন, বিবাহ দেওয়ার দৃঢ়সংঙ্কল্প শিথিল হইয়া আসিল; সন্দেহের গাঢ় ছায়ায় তাঁহার অর্থলুব্ধ হৃদয় সমাছন্ন হইল। তিনি একান্ত বিমর্ষ-চিত্তে মায়ের নিকট উপস্থিত হইলেন। পুত্রকে দেখিয়া মা কহিলেন, খোরশেদ! তুমি আমার কথা শুনিতেছ না, এ বিবাহে তোমার সর্বনাশ হইবে।” ভূঞা সাহেব কহিলেন, “মা সর্বনাশের আর বাকি কি? আমার দারগা (গরুর নাম) মরায় আমি দশদিক অন্ধকার দেখিতেছি। সেই গোধনই আমার ঘরে বকরত আনিয়াছিল।” এই বলিয়া ভূঞা সাহেব বালকের ন্যায় চোখের পানি মুছিতে লাগিলেন। মা নিজ অঞ্চলে পুত্রের চোখ মুছিয়া দিয়া কহিলেন, “বাবা, সাবধান হও, তোমার পিতা বলিতেন—’নীচ বংশে কন্যা আনিলে যত দোষ না হয়, নীচ ঘরে মেয়ে বিবাহ দেওয়ায় তাহা অপেক্ষা বেশি দোষ।’ তোমার পিতার উপদেশ স্মরণ করিয়া চল; বিবাহের কথা আর মুখেও আনিও না, আমি দেখিয়া শুনিয়া সত্বরই ভাল ঘরে ভাল বরে— আমার আনারকে সমর্পণ করিতেছি। ভূঞা সাহেব মাতার কথায় অনেকটা আশ্বস্ত হইলেন।

এদিকে প্রকৃতি শান্ত হইল। পাত্রপক্ষকে কোন প্রকারে আহার করান হইল। তাঁহার ভূইঞা সাহেবের বিমর্ষভাব দেখিয়া ও আকস্মিক দুর্ঘটনার বিষয় চিন্তা করিয়া বিবাহের প্রসঙ্গ উত্থাপন করা তখন যুক্তিযুক্ত মনে করিলেন না। সকলে ভগ্নমনোরথ হইয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন। প্রকারান্তরে বিবাহ ভাঙ্গিয়া গেল, ভূইঞা সাহেব হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিলেন, আনোয়ারার দাদিমা বিবাহভঙ্গে উপস্থিত বিপদেও খোদাতায়ালার নিকট শোকর-গোজারী করিতে লাগিলেন। গোলাপজান বড় আশায় নিরাশ হইল।