» » প্রথম কিস্তি

বর্ণাকার

প্রচেত গুপ্ত

একটু পরে রোদ উঠবে

এক

খুব বেশি হলে পনেরো সেকেন্ড। তার থেকেও কম হতে পারে। গুনে গুনে ক’টা কথা। একবার পেটের কাছে চুলকুনি আর একটু চোঁয়া ঢেকুর। তাও পুরো ঢেকুর নয়, আধখানা ঢেকুর। সেই ঢেকুর গলার কাছ পর্যন্ত এসে থমকে গেছে। এই কর্মকাণ্ডে সব মিলিয়ে কত সময় লাগবার কথা? তারপরেই আবার নরমাল। যে কে সেই। যেমন ছিলেন তেমন।

বিমলকান্তি সেন ভুরু কোঁচকালেন। এটা কী ঘটল! আদৌ কি কিছু ঘটল? নিশ্চয় নয়। একটা ভুল মাত্র। সাধারণ ভুল নয়, হাবিজাবি ভুল। বিমলকান্তি সেনের ভুরু আরও কুঁচকে গেল। তিনি একজন সিরিয়াস মানুষ। জীবনে হাবিজাবি ভুল তিনি বরদাস্ত করেন না। পনেরো সেকেন্ডের জন্য হলেও নয়। তিনি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন।

‘প্রহ্লাদ, টাকা কবে লাগবে?’

প্রহ্লাদ গদগদ গলায় বলল, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্যার।’

‘কত তাড়াতাড়ি?’

প্রহ্লাদ হাত কচলে বলল, ‘ওই তো স্যার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’

প্রহ্লাদ ‘সেন এন্ড অ্যাসোসিয়েটস’ কোম্পানির একজন কর্মচারী। গোড়াতে বিমলকান্তিবাবু তার এই মাঝবয়সি কর্মচারীটির মুখ চিনতে পারলেও, নাম মনে করতে পারেননি। আজকাল এটা হচ্ছে। বয়েসের লক্ষণ। বাষট্টি বছর কম বয়স নয়।  বিজ্ঞান নানা ধরনের ওষুধবিষুধ আবিষ্কার করায় মানুষের আয়ু বেড়ে গেছে। সকলেই বলে, বাষট্টি বছর এখন কিছু নয়। বাষট্টি কেন? বাহাত্তর, বিরাশিও কিছু নয়। বিমলকান্তিবাবু তা মনে করেন না। তিনি মনে করেন, বেশি বয়স অবশ্যই ‘কিছু’। ওষুধবিষুধ হল চাবুকের মতো। হাঁপিয়ে পড়া ঘোড়াকেও ছোটায়। ঘোড়া যত জোরেই ছুটুক, আসলে সে ক্লান্ত। ছোটায় তার কোনও আনন্দ নেই। একটা সময় নিজের কোম্পানির একশো কুড়িজন কর্মীকেই নামে চিনতেন বিমলকান্তিবাবু। শুধু নামে নয়, কে কোন পোস্টে আছে তাও বলে দিতে পারতেন। এখন পারেন না। কাজে কি আনন্দ কমে যাচ্ছে? চাবুকের শাসনে ছুটতে হয় তাই ছুটছেন? কে জানে!

খানিক আগে প্রহ্লাদ যখন ঘরে ঢোকে, তখনও একই ব্যাপার হয়েছে। মুখটুকু শুধু চিনতে পেরেছিলেন। এই লোককে অফিসে দেখেছেন। কিন্তু কোথায় মনে পড়েনি। প্রহ্লাদ নিজেই নাম, ডিপার্টমেন্ট আর পোস্ট বলল।

‘স্যার, এবার কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?’

বিমলকান্তিবাবু বিরক্ত হলেন, এ আবার কেমন প্রশ্ন? এই লোক কি তার পরীক্ষা নিচ্ছে? প্রশ্নের জবাব দিলেন না। কঠিন গলায় বললেন, ‘যা বলবার দ্রুত বলবে। আমার হাতে সময় নেই।’

খানিকটা রাগের কারণেই লোকটার ডিপার্টমেন্ট, পোস্ট পরক্ষণেই ভুলে গেলেন বিমলকান্তি। শুধু মনে রাখলেন আহামরি কিছু নয়, ছোটখাটো কোনও একটা কাজ করে। ক্লার্ক, টাইপিস্ট ধরনের। লোকটার দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে একধরনের কুঁজো ভাব। বিমলকান্তি দ্রুত মনে করবার চেষ্টা করলেন, তার এই কর্মচারীটি কি সবসময়ই কুঁজো? নাকি অনুগ্রহ নিতে এসেছে বলে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়েছে? দ্বিতীয়টাই হবে। মাঝে মাঝে হাতও কচলাচ্ছে। এক বগলে ছাতা, অন্য বগলে ব্যাগ নিয়ে হাত কচলানো কঠিন কাজ। যারা ছোটখাটো কাজ করে, তাদের এই ধরনের নানা কঠিন কাজ সামলাতে হয়।

‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বলে কোনও দিন হয় না। কত তাড়াতাড়ি দরকার সেটা বলো।’

মালিকের কথায় উৎসাহ ডবল হয়ে যায় প্রহ্লাদের। সে বলে, ‘এই সপ্তাহের মধ্যে পেলে সবথেকে ভালো হয় স্যার। ইতিমধ্যেই দশদিন দেরি করে ফেলেছি। পরের ইনস্টলমেন্ট দু’মাস পর। তিন নম্বরটা নেবে পুজোর মুখে মুখে। তার মধ্যে স্যার আমি অবশ্যই একটা ব্যবস্থা করে ফেলব। দেশের জমিটা বিক্রিবাটা হয়ে যাবে। জ্ঞাতিদের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করে দিয়েছি। অনেকটা ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কেবল ছোটকাকা গোল পাকাচ্ছে। তাও স্যার আপন ছোটকাকা নয়। বাবার খুড়তুতো ভাই। মামলাবাজ লোক।’

বিমলকান্তিবাবু চোখের সামনে থেকে খবরের কাগজ সরালেন। ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘এত কথা বলছ কেন? আমি কি এসব জানতে চেয়েছি?’

প্রহ্লাদ আরও জোরে হাত কচলে বলল, ‘ভুল হয়ে গেছে স্যার। আর বলব না।’

বিমলকান্তিবাবু একটু চুপ করে থাকলেন। কিছু ভাবলেন। বললেন, ‘এত দেরি করে টাকা জোগাড়ে নেমেছ কেন?’

বগলে ছাতা ধরা অবস্থাতেই প্রহ্লাদ ডান হাত দিয়ে পেটের পাশটা খসখস করে একপ্রস্থ চুলকে নিল। বলল, ‘আগেই ব্যবস্থা করে ফেলেছিলাম স্যার। আমার ভায়রাভাই দেবে ঠিক ছিল। পাকা কথা হয়েছিল। দুদিন আগে টাকা আনতে গেলাম, বললে এখন হবে না। ব্যবসায় লস যাচ্ছে। অর্ডার ক্যানসেল হয়েছে। মিছে কথা। ওর অর্ডারের কাজকারবারই নেই স্যার। দুটো লরি, তিনটে ম্যাটাডর আছে। ভাড়া খাটায়। তার অর্ডার কী হবে? আমিও বলে ফেললাম। তোমার আবার অর্ডার কীসের হে? গাড়ি ভাড়া দাও। মিছে কথা বলছ কেন? ভায়রাভাই বলল, ওই একই হল। ভাড়ার বাজার ডাউন যাচ্ছে। আমার ভায়রাভাই স্যার মানুষ খারাপ নয়। শালিটাই যত গণ্ডগোলের। স্বামীকে আটকেছে। বোন হলেও আমার বউকে হিংসে করে। মেয়েতে মেয়েতে হিংসে বেশি।’

বিমলকান্তিবাবু হাত তুলে বললেন, ‘আঃ, আবার বেশি কথা বলছ।’

প্রহ্লাদ আরও খানিকটা কুঁজো হয়ে বাঁ-হাতে কান ছুঁয়ে বলল, ‘ভুল হয়ে গেছে। আর বলব না।’

কথাটা বলে একটা ঢেঁকুরের মতো তুলল প্রহ্লাদ। ঢেঁকুর না হেঁচকি? মাঝপথে কেমন থমকে গেল। সে যাক গে। বিমলকান্তিবাবু বিরক্তির সঙ্গে অবাক হচ্ছেন। অফিসে কাজ করে, অথচ এই লোক মালিকের স্বভাবচরিত্রের খবর রাখে না? তিনি অতিরিক্ত কথা পছন্দ করেন না, একজন সিরিয়াস মানুষ সে বিষয়ে কি এই লোকের কিছু জানা নেই! এই লোকের ডিপার্টমেন্টের মাথায় কে?

বিমলকান্তিবাবু বুঝতে পারলেন, তার বিরক্তি বাড়ছে। সকালবেলা বিরক্তি বাড়া ভালো কথা নয়।

সিরিয়াস মানুষ হয় দু’প্রকার। ভক্ত সিরিয়াস এবং বিরক্ত সিরিয়াস। ভক্ত সিরিয়াস মানুষরা সিরিয়াস ভাবের ভক্ত হয়। ভাবে বিভোরও বলা যায়। সিরিয়াস ধর্মে মেতে থাকে। চারপাশে কে কী করল, তা নিয়ে মোটে মাথা ঘামায় না। নিজের মতো করে কাজ করে। জটিল ক্যালকুলাস সলভ করা এবং ঘর ঝাঁট দেওয়া, দুটোতেই সমান মনোযোগ দেয়। এতে কাজ যে সবসময় ঠিক হয়, এমন নয়। অতিরিক্ত ক্যাজুয়াল ভঙ্গি যেমন খারাপ, অতিরিক্ত সিরিয়াস ভঙ্গিও গোলমাল করে। কাজের সূক্ষ্ম গুণাবলি নষ্ট হয়ে যায়। তা হোক। ভক্ত সিরিয়াসরা সে কথা মানে না। কাজ সূক্ষ্ম না মোটা এটা তাদের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়। সিরিয়াস ভাবের প্রতি ভক্তিটাই আসল। অন্যদিকে, দ্বিতীয় ধরনের সিরিয়াস মানুষে ঝামেলা বেশি। এরা বিরক্ত সিরিয়াস। নিজে সদা বিরক্ত। আবার অন্যকেও বিরক্ত করে। এদের বিশ্বাস, শুধু নিজে সিরিয়াস হলে চলবে না, চারপাশের সবাইকে সিরিয়াস হতে হবে। সিরিয়াস নয় বলেই মানবজাতির এই দুর্দশা। হাসি-ঠাট্টা, তরল কথা, লঘু আচরণ এই মানুষরা মোটে সহ্য করতে পারে না। তাদের কাছে এসব ‘ছ্যাবলামি’ ছাড়া কিছুই নয়। মানুষের জন্ম ছ্যাবলামি করবার জন্য হয়নি। মানুষের জন্ম হয়েছে দায়িত্ব পালন করবার জন্য। জীবনে অবাস্তবতা এবং কল্পনার কোনও স্থান নেই। ও সব অলস ও ফাঁকিবাজদের বিষয়। দায়িত্ব এড়ানোর ফন্দি।

লক্ষ করবার মতো বিষয় হল, দু’ধরনের সিরিয়াস মানুষের ভঙ্গিও দু’ধরনের। ভক্ত সিরিয়াসদের ভঙ্গি গদগদ। ‘আমি সব কাজ কত সিরিয়াসভাবে করছি’ তার জন্য গদগদ। আর বিরক্ত সিরিয়াসরা হল গোমড়ামুখো। সবাই কেন তার ইচ্ছেমতো ‘সিরিয়াস’ নয়, সেই কারণে গোমড়ামুখো।

বিমলকান্তিবাবু একজন বিরক্ত সিরিয়াস মানুষ। যত বয়স বাড়ছে, তার এই ভাব বাড়ছে। তিনি গম্ভীর থাকা পছন্দ করেন। ঠান্ডা গলায় ধমক দেন। কারণে দেন, অকারণেও দেন। অকারণ ধমক বেশি কাজের বলে মনে করেন। এতে আগাম সতর্ক করবার সুযোগ থাকে। গৃহকর্তার এই উদ্ভট স্বভাবে বাড়ির সদস্যদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। তারা বিরক্ত। শুধু তার একানব্বই বছরের পিতা কমলকান্তি সেন এবং বাইশ বছরের ছোট মেয়ে বারিধারা তার স্বভাব এবং মেজাজকে আমল দেয় না।

কর্মক্ষেত্রেও তাই। বিমলকান্তিবাবুর এই সিরিয়াস বাই কর্মচারীদের তটস্থ করে রেখেছে। অফিসে, ওয়ার্কশপে কোনওরকম আলগা ভাব তিনি বরদাস্ত করেন না। তার মত হল, কাজ ভুল না ঠিক সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা, কাজে সিরিয়াস ভাব আছে কিনা। কেউ যদি মন দিয়ে ভুল কাজ করে, তিনি রাগ করেন না। তার বিশ্বাস জন্মায়, এই লোক নিজেকে সংশোধন করতে পারবে। কিন্তু হেলাফেলায় করা ঠিক কাজে কোনও ভরসা নেই। যে-কোনও সময় গোলমাল করবে। একমাস পরে ফাইলে গোলমাল বা তিনমাস পরে প্রাোডাকশনে খুঁত ধরা পড়বে। শুধু কাজে নয়, ছুটিতেও ‘সেন এন্ড অ্যাসোসিয়েটস’-এর মালিক সিরিয়াস। একবার অ্যাকাউন্টসের ঋত্বিক বিরাট বিপদে পড়েছিল। সে বারোদিনের ছুটি নিয়ে, দশদিনের মাথায় কাজে জয়েন করে। খবর পেয়ে বিমলকান্তিবাবু তাকে ঘরে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। বিপদের কথা কেউ আঁচ করতে পারেনি। বরং উলটো ভেবেছিল। ভেবেছিল ঋত্বিক মালিকের পিঠ চাপড়ানি পাবে।

ঋত্বিক ঘরে ঢোকবার পর বিমলকান্তি সহজ গলায় জিগ্যেস করেছিলেন, ‘বেড়াতে গিয়েছিলে?’

ঋত্বিক গদগদভাবে বলে, ‘হ্যাঁ, স্যার। ফ্যামিলি নিয়ে সিমলা, মানালি গিয়েছিলাম।’

বিমলকান্তিবাবু আরও সহজভাবে বললেন, ‘কেমন বেড়ালে? ওয়েদার ভালো পেয়েছ?’

গম্ভীর বসের হালকা ভঙ্গিতে ঋত্বিক উত্তেজিত বোধ করেছিল।

‘ওয়েদার ভালো পেয়েছি স্যার। একদিন বরফও পেয়েছি। আমার মেয়ে তো বরফ দেখে পাগল।’

বিমলকান্তিবাবু বললেন, ‘এই সময় তো ওদিকটায় বরফ পাওয়ার কথা নয়। তোমার আইস লাক ভালো দেখছি ঋত্বিক।’

ঋত্বিক দাঁত বের করে হাসে। বলে, ‘আপনার আশীর্বাদ স্যার।’

বিমলকান্তিবাবু বললেন, ‘তুমি তো বারোদিন ছুটি নিয়েছিলে।’

ঋত্বিক সাহস পেল। বলল, ‘দশদিনের ট্যুর ছিল স্যার। তারপরেও দুটো দিন এক্সট্রা রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম, বাড়ি ফিরে রেস্ট নেব। জার্নির তো একটা ধকল থাকে। তাছাড়া চেনা-পরিচিতদের সঙ্গে বেড়ানোর গল্প করব। ফটো দেখাব। বেড়ানোর এটাও একটা পার্ট। সেই কারণে দুদিন।’

‘ভালো করেছিলে, ঠিক করেছিলে। তাহলে আজ এলে কেন?’

ঋত্বিক বুঝতে পারল, পিঠ চাপড়ানির সময় এসেছে। বলল, ‘স্যার, সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হল, অহেতুক বাড়িতে শুয়ে-বসে ছুটি কাটিয়ে লাভ কী? তার থেকে অফিসে দুদিন আগেই জয়েন করে ফেলি। কাজ অনেকটা জমে গেছে…।’

এরপর বিমলকান্তি সোজা হয়ে বসলেন। একটু চুপ করে, টেবিলে রাখা পেনসিল তুলে নাড়াচাড়া করতে করতে ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘ভালো করেছ। কিন্তু তোমার সামনে এখন দুটো অপশন ঋত্বিক। এক, তুমি এখনই বাড়ি চলে যেতে পারো। জার্নির ধকল সারিয়ে, আত্মীয়-বন্ধুদের বেড়ানোর গল্প করে, বরফের ফটো দেখিয়ে দুদিন ছুটি কাটিয়ে তারপর ফিরে আসবে। প্রমাণ করবে, তুমি যে ছুটি নিয়েছিলে সে ব্যাপারে তুমি সিরিয়াস। দুটো ছুটির দিন কোনও হেলাফেলার বিষয় নয়। আর দু’নম্বর অপশন হল, তুমি টেবিলে গিয়ে কাজ করো, কিন্তু তোমার বারোদিনের ছুটি আমি আমার বিশেষ ক্ষমতাবলে বাতিল করে দিচ্ছি। এতে তোমার পাওনা ছুটি নষ্ট হবে। মাইনে পর্যন্ত কাটা যেতে পারে।

ঋত্বিকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। সে কি ঠিক শুনল? এই মানুষটা কি পাগল?

বিমলকান্তিবাবু নীচু গলায় বললেন, ‘আমার কাছে কাজটা যেমন সিরিয়াস, ছুটিটাও তেমন। আশা করি, আমার কর্মচারীদের কাছেও তাই হবে। এখন যাও। যে অপশনটা তোমার পছন্দ, সেটা বেছে নাও।’

শুকনো মুখে ঋত্বিক ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল।

বিমলকান্তিবাবু একতলার ড্রইংরুমে বসে আছেন। হাতে খবরের কাগজ। কাগজটা তুলে মুখ ঢাকলেন। তার বিস্ময় ভাব যেন বাইরে থেকে বোঝা না যায়। এখন সকাল আটটা বেজে কুড়ি মিনিট। পুবদিকের জানলা দিয়ে ঘরে আলো আসছে। তবে আলোর জোর কম। আকাশে সম্ভবত মেঘ রয়েছে। বাড়িতে অফিস বা ওয়ার্কশপের কারও সঙ্গে দেখা করা বিমলকান্তি পছন্দ করেন না। তারপরেও করতে হয়। বাধ্য হয়ে করতে হয়। কোম্পানির ট্র্যাডিশন বজায় রাখতে হয়। একসময় ঠাকুরদা করতেন। তার থিওরি ছিল, ‘ব্যবসার বাইরেও কর্মচারীদের ব্যক্তিগত প্রয়োজন-অপ্রয়োজন থাকতে পারে। সেসব কাজের জায়গায় না শোনাই ভালো।’ বিমলকান্তি এই থিওরি মানেন না। তার বাবাও মানতেন না। কিন্তু তিনিও দেখা করেছেন। তবে দিন কমেছে। ঠাকুরদা সপ্তাহে তিন করতেন। বাবা সেটা নামিয়ে দুদিনে আনেন। বিমলকান্তিবাবু দেখা করেন মাত্র একদিন। বুধবার। সকালে একঘণ্টা। আজ বুধবার নয়, বৃহস্পতিবার। তবু প্রহ্লাদ এসেছে। ভবানী গেট থেকে এসে খবর দিল।

‘বললাম, দেখা হবে না। পরের বুধবার এসো। তারপরেও যেতে চায় না। বলছে, খুব দরকার। পরের বুধবার পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাবে না।’

বিমলকান্তিবাবু একবার ভাবলেন, তাড়িয়ে দিতে বলবেন। ভবানী ভালো দারোয়ান। লোক কীভাবে তাড়াতে হয় সে জানে। তারপরেও থমকে গেলেন। বললেন, ‘ঠিক আছে, পাঠিয়ে দাও।’ সম্ভবত এটা বয়েস বাড়বার লক্ষণ। সিদ্ধান্তে অনিশ্চয়তা। ভবানী চলে যাওয়ায় বিমলকান্তি নিজের ওপরই বিরক্ত হলেন। এটা ঠিক নয়। সিদ্ধান্তে অনিশ্চয়তা মানে কাজ ভালো লাগছে না। তিনি কি ক্লান্ত?

খাটো ধুতি, কলার দেওয়া হাফহাতা শার্ট পরা প্রহ্লাদ এসে হাজির হল মিনিট দুয়েকের মধ্যে। নিজের পরিচয় দিতে বিমলকান্তিবাবু রাগী গলায় বললেন, ‘যা বলবার দ্রুত বলবে। আমার হাতে সময় নেই।’

এর অল্প কিছু পরেই ঘটনাটা ঘটল। যা হয়তো আদৌ ঘটেনি। হয়তো কেন? অবশ্যই ঘটেনি। এরকম কিছু কখনও ঘটতে পারে না। একটা ভুল। মনের ভুল। বিমলকান্তি সেনের খচখচানি যাচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে, ভুলটা ভয়ঙ্কর! সত্যি তাই। ভয়ঙ্কর।

বিমলকান্তিবাবু মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলেন।

গণ্ডারদের মধ্যে সঙ্গীতপ্রেমের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে গানের মধ্যে বাদ্যযন্ত্রের প্রতি তাদের আকর্ষণ বেশি। তানজানিয়ার ওকারু হুনাই গণ্ডার গবেষণাকেন্দ্রে দীর্ঘ বাইশ বছর পরীক্ষার পর পশুবিজ্ঞানীরা এই চমকপ্রদ তথ্যটি জানতে পেরেছেন। পরীক্ষা বলছে, বাদ্যযন্ত্র যদি বাঁশি জাতীয় কিছু হয়, তাহলে সবথেকে ভালো। বাঁশির সুর শুনলে গণ্ডাররা থমকে দাঁড়াচ্ছে। কান খাড়া করছে। অল্প অল্প লেজও নাড়ছে। গণ্ডারের লেজ অতি সংক্ষিপ্ত, তবু নাড়ছে। কোনও কোনও সময় তারিফ করবার ভঙ্গিতে তাদের মাথা দোলাতেও দেখা গেছে। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। মাঝপথে বাঁশি থেমে গেলে গণ্ডাররা বিরক্ত হচ্ছে। রেগে যাচ্ছে। একখানা শিং বাগিয়ে পা দিয়ে মাটি খোঁড়ে। ফোঁস ফোঁস আওয়াজে নিঃশ্বাস ফেলে। তখন ফের বাজনা শুনিয়ে শান্ত করতে হয়।

তানজানিয়া সরকার বিরাট খুশি। গবেষণার পিছনে অর্থ বরাদ্দ দ্বিগুণ করে দিয়েছে। প্রজেক্টের নাম হয়েছে, ‘রাইনো মিউজিক’। ‘রাইনো মিউজিক’ প্রজেক্টে এবার বাঁশি ছাড়া অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের প্রতি গণ্ডারদের অনুরাগ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। বিশেষ করে তারের বাজনা। প্রাথমিকভাবে লক্ষ করা গেছে, জগঝম্প সঙ্গীতের থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি গণ্ডারদের ঝোঁক বেশি। প্রজেক্টের মাথায় আছেন পশু বিজ্ঞানী হার্ড কিমোলাই। গণ্ডারেরর সঙ্গীতপ্রেম আবিষ্কারের কারণে তিনি নাকি যে-কোনও সময় নোবেল পুরস্কার পেয়ে যেতে পারেন। তিনি বলেছেন, গণ্ডারের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে এখনই কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা ঠিক হবে না। গণ্ডারকে নিয়ে যাবতীয় গবেষণা ধৈর্যের বিষয়। বিভিন্ন স্তরের চামড়া এবং চর্বি ভেদ করে অনুভূতিকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছোতে হয়। সময় লাগাটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে, এই গবেষণার প্রতিবাদে তানজানিয়ায় বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য, যে দেশের মানুষ না খেতে পেয়ে দুর্ভিক্ষে মারা যায়, সেই দেশে গণ্ডারের সঙ্গীতপ্রেমের পিছনে সরকারের অর্থ ব্যয় অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। এ জিনিস মানা যায় না। আশার কথা, সরকার কড়া হাতে বিক্ষোভ দমন করছে।হেডফোনের সেরা অফার

প্রহ্লাদ আসবার আগে বিমলকান্তিবাবু গণ্ডার বিষয়ক এই খবর পড়ছিলেন। ইন্টারেস্টিং খবর। যদিও খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে ভিতরের পাতায়, কোণের দিকে। চট করে চোখে পড়ে না। বিমলকান্তিবাবু খেয়াল করে দেখেছেন, খবরের কাগজগুলো আজকাল ইন্টারেস্টিং খবর গুরুত্বহীনভাবে প্রকাশ করে। এটা সিরিয়াস ভাবের অভাব। মানুষ এতদিন দাবি করে এসেছে, প্রাণীজগতে শুধু তারাই সূক্ষ্ম বোধবুদ্ধি, অনুভূতির অধিকারী। গণ্ডারের বাঁশিপ্রেম সেই দাবি নস্যাৎ করবে। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়?

খবরটা দ্বিতীয়বার পড়বার জন্য বিমলকান্তিবাবু তৈরি হচ্ছিলেন। এই ধরনের খবর একবার পড়লে হয় না, দুবার পড়তে হয়।

দু’বার পড়া হল না। তখনই ভবানী গেট থেকে প্রহ্লাদকে নিয়ে এসেছে।

‘স্যার, মাপ করবেন, আজ আপনি দেখা করেন না, কিন্তু আমার বিষয়টা আর্জেন্ট।’

বিমলকান্তিবাবু আবার বিরক্ত হলেন। এই লোক তো সবদিকে গোলমাল করে। এক নম্বর, বুধবারের বদলে আজ এসেছে। দু’নম্বর, তাকে চেনা গেছে কিনা তাই নিয়ে প্রায় কৈফিয়ত তলব করেছে। এখন আবার বলেছে, তার ব্যাপারটা আর্জেন্ট। যেন বাকি যারা তার সঙ্গে দেখা করে তাদের ব্যাপার এখন হলেও হয়, না হলেও হয়। এই লোককে কি জোর ধমক দেওয়া উচিত নয়? নিজেকে সামলালেন বিমলকান্তি। সকালবেলা মেজাজ গরম করে লাভ নেই। মেজাজ গরমের জন্য সারাদিন পড়ে আছে। তিনি খবরের কাগজের পাতা উলটোতে উলটোতে ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘কেন আর্জেন্ট?’

‘স্যার, আমার কিছু টাকা চাই।’

বিমলকান্তিবাবু চমকালেন না। ব্যক্তিগতভাবে যারা তার কাছে আসে, তারা মূলত দুটো কারণে আসে। চাকরি এবং টাকা। অফিসে-ওয়ার্কশপে ভাগ্নে, শালাকে ঢুকিয়ে দিতে হবে। অথবা মেয়ের বিয়ে, বাবার চিকিৎসা, ছেলের লেখাপড়ার জন্য টাকা লাগবে। অফিস থেকে লোন পাওয়ার ব্যবস্থা আছে। এমনকী এমারজেন্সি ফান্ডও রয়েছে। সেখানে অ্যাপ্লাই করলে হঠাৎ প্রয়োজনে সাহায্য মেলে। তার পরেও লোক আসে। যাদের নিয়মকানুনের বাইরে টাকার প্রয়োজন অথবা যারা নিয়মকানুনের জালে জড়াতে চায় না তারা এসে কাঁদুনি গায়। এখন আবার নতুন ফ্যাচাং শুরু হয়েছে। সেন অ্যাসোসিয়েটসের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, এমন লোকজনও আসতে শুরু করেছে। প্রথম প্রথম ভবানীকে দিয়ে গেট থেকেই তাড়িয়ে দিতেন বিমলকান্তি।

ভবানী কড়া গলায় বলত, ‘হবে না। স্যার শুধু কোম্পানির লোকেদের সঙ্গে দেখা করেন।’

‘ওদের ফাঁকে একবার ঢুকিয়ে দেওয়া যায় না?’

ভবানী তেড়েফুঁড়ে উঠত, ‘বলছি তো হয় না। নিয়ম নেই।’

‘তুমি ইচ্ছে করলেই নিয়ম ভাঙতে পারো ভাই। পৃথিবীর সব দারোয়ানই নিয়ম ভেঙে লোক ঢোকাতে পারে। তার জন্য আলাদা সিস্টেম থাকে।’

ভবানী কাজে কড়া হলেও বোকার দিকে মানুষ। তাকে বাড়ির দারোয়ান পদে বহাল করবার আগে বিমলকান্তি কথা বলে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন যে সে বোকা। পাহারাদার, দারোয়ানের বুদ্ধি বেশি হলে সমস্যা। বোকা এবং গোঁয়াড় প্রকৃতি তাদের প্রধান যোগ্যতা হওয়া উচিত। ‘অর্ডার নেই’ বলে বহু ‘উচিত কাজ’ তারা করবে না। চোখের সামনে যদি কেউ জলে ডুবে মারাও যায়, তারা হাত বাড়াবে না। অর্ডার নেই। বিমলকান্তিবাবু এই কারণে বোকা লোক খুঁজে বের করেছেন। ভবানী নিয়ম ভেঙে লোক ঢোকানোর সিস্টেম ধরতে পারেনি। অবাক হয়ে জানতে চায়, ‘সিস্টেম! কীসের সিস্টেম?’

‘আহা, উত্তেজিত হচ্ছ কেন? তুমি চা খেয়েছ? নাকি সকাল থেকে টুল পেতে বসে আছ? নাও ভাই, এই দশ টাকাটা রাখো। যাও, চা-কচুরি খেয়ে এসো। ততক্ষণে চট করে তোমার স্যারের সঙ্গে কথা সেরে আসি।’

দশ টাকার লোভ দেখিয়েও ভবানীকে টপকানো যায়নি। তবে শেষ পর্যন্ত বাইরের লোক আসা পুরোপুরি ঠেকাতেও পারেননি বিমলকান্তি সেন। বড়-মেজো-সেজো নানা ধরনের রেকমেন্ডেশন নিয়ে তারা হাজির হয়। গরিব দেশে রেকমেন্ডেশন হল সবথেকে ঝামেলার বিষয়। সাপের ছুঁচো গেলার মতো। না গেলা যাবে, না উগরানো যাবে। তার ওপর কোনও কোনও ছুঁচো হুমকি-ধমকিও দেয়।

‘দাদা চিঠি দিয়েছে।’

‘কারও নাম বলতে হবে না, স্যারকে গিয়ে শুধু বলো কবিরাজ বাই লেন থেকে এসেছি। ব্যস, তাহলেই হবে। কবিরাজ বাই লেনের কথা শুনলে আজও অনেকের প্যান্টে ইয়ে হয়ে যায়। দেখবে তোমার স্যার আমাকে রিসিভ করতে ছুটে না আসেন।’

ব্যবসা করতে হয়। বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখলে চলে না। পছন্দ হোক না হোক। তাছাড়া শুধু ব্যবসার কারণে নয়, সামাজিকতা বলেও একটা ব্যাপার আছে। সেটাও মানতে হয়। মণিকুন্তলাও সে কথা বলেছে। স্ত্রীর সঙ্গে তার এই বিষয়ে তর্ক হয়েছে।

‘সিরিয়াস মানুষরা সমাজেই বাস করে। জঙ্গলে করে না। জঙ্গলে যেমন অসুবিধে আছে, সমাজেও কিছু অসুবিধে থাকে। সেই অসুবিধে নিয়েই থাকতে হয়।’

বিমলকান্তিবাবু বলেছেন, ‘এর মধ্যে সমাজ বা জঙ্গলের কী প্রশ্ন ওঠে! বুধবার সকালে তো আমার সবার সঙ্গে দেখা করবার কথা নয়। আমি শুধু আমার অফিসের কারখানার লোকদের সঙ্গে দেখা করি। অন্যদিন আসুক। অফিসে আসুক।’

‘সবাই তোমার এত নিয়ম জানবে কী করে? কেউ এলে তাকে ফিরিয়ে দিতে পারো না।’

বিমলকান্তিবাবু রেগে গিয়ে বলেন, ‘অবশ্যই পারি। আমার অধিকার আছে।’

মণিকুন্তলাদেবী বলেন, ‘সমাজে বাস করতে গেলে নিজের অধিকার, ক্ষমতা নিয়ে সবসময় থাকা যায় না।’

বিমলকান্তিবাবু থামকে যান। বলেন, ‘মণিকুন্তলা, তুমি কি আমাকে জ্ঞান দিচ্ছ?’

‘জ্ঞান নয়, যেটা উচিত সেটা মনে করিয়ে দিচ্ছি। তুমি শুধু ”সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়টস”-এর মালিক নও, তার বাইরেও তোমার একটা পরিচয় আছে।’

বিমলকান্তিবাবু ভুরু কুঁচকে বলেন, ‘তার বাইরে আবার কী পরিচয়!’

মণিকুন্তলা শান্ত গলায় বলেন, ‘তুমি বিমলকান্তি সেন এটাই তোমার আসলে পরিচয়। সেখানে তোমার ক্ষমতা নয়, ব্যবহার, আচরণটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

বিমলকান্তিবাবুর রাগ বাড়ে। দাঁত কিড়মিড়িয়ে চাপা গলায় বলেন, ‘আমাকে কি একটু বেশি ছেলেমানুষ ভাবছ না মণিকুন্তলা? উপদেশ, শিক্ষা নেওয়ার মতো বয়স কি আমার এখনও আছে বলে তোমার মনে হয়? নাকি মনে হয়, ব্যবহার, আচরণ সম্পর্কে এখনও আমি কিছু শিখিনি?’

মণিকুন্তলাদেবী বললেন, ‘উপদেশ-টুপদেশ নয়, আমি যা মনে করি সেটাই বললাম। বাড়িতে সময়মতো এলে সবার সঙ্গে দেখা করাটাই উচিত।’

বিমলকান্তি রাগ সামলালেন। বললেন, ‘তা বলছি না। সে তোমার কাজ তুমি বুঝবে আমি শুধু সামাজিকতার কথাটুকু বললাম। তোমার মাঝে মাঝে গুলিয়ে যায়।’

বিমলকান্তিবাবু জীবনে যে অল্প কয়েকজনের তর্ক অ্যালাও করেন, নিজের স্ত্রী তাদের একজন। মণিকুন্তলার বুদ্ধি ও যুক্তির ওপর তার ভরসা রয়েছে। যদিও সেই ভরসা-কথা বিবাহিত জীবনের বত্রিশ বছরে কখনও তিনি প্রকাশ করেননি। স্ত্রীর কাছেও নয়। মণিকুন্তলার কলেজ শুরুতেই বিয়ে হয়ে গেছে। তারপর সংসার। সেই চাপ সামলে আর পড়া হয়নি। তার পরেও এত বোঝেন কী করে! রাগ এবং বিরক্তির প্রকাশ করেও তিনি স্ত্রীর যুক্তি শোনেন এবং কিছু ক্ষেত্রে নিজের সিদ্ধান্ত বদলও করেন। মুখে কিছু বলেন না। মণিকুন্তলাদেবীও কিছু বলেন না। তার যুক্তিতে পরাস্ত হয়ে বা মেনে নিয়ে বিমলকান্তি সেন যে সিদ্ধান্ত বদলেছেন, সেটা যেন তিনি বুঝতেও পারেননি। প্রকাশ্যে স্বামীর দাপটের সামনে চুপ করে থাকেন। তার ইচ্ছেমতো নিজে চলতে এবং সংসার চালাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু আড়ালে তর্ক করতে ছাড়েন না। বিমলকান্তি এবং মণিকুন্তলার ধারণা, তাদের তর্কের কথা বাড়ির কেউ জানে না। ঘটনা ঠিক নয়। সকলেই জানে। একজন মানুষের জীবনে এটাও একটা রহস্য। সে নানারকম ভুল জেনে নিশ্চিন্তে থাকে।

টাকার কথা বলে প্রহ্লাদ হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। যেন টাকা চাওয়াটা কোনও আনন্দের ঘটনা। বিমলকান্তিবাবুর মনে হল, এই লোকের অন্য দোষ আছে, কিন্তু ভণিতা নেই। এটা ভালো।

‘টাকা কেন লাগবে?’

প্রহ্লাদ এবার লজ্জা পেল। বলল, ‘স্যার, একটা ফ্ল্যাট নিচ্ছি। নিজের মাথা গোঁজার ঠাঁই। অনেকদিনের স্বপ্ন। বুড়ো বয়েসে এসে মেটাতে যাচ্ছি। বারুইপুর স্টেশন থেকে ভ্যানরিকশায় চল্লিশ মিনিট যেতে হবে স্যার। এখনও মাটি। মাটি থেকে বুকিং করছি বলে সস্তা। ওদিকটায় স্যার হুড়দুড় করে শহর বাড়ছে। শুনছি কয়েক বছর পর মেট্রো রেলও যাবে। তখন তো স্যার জমির দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। আমার মতো মানুষ ঝুপড়িতেও ঘর পাবে না।’

বিমলকান্তি বিরক্ত গলায় বললেন, ‘এত কথা বলছ কেন! ফ্ল্যাটের টাকার জন্য আমার কাছে এসেছ কেন? অফিসে লোনের ব্যবস্থা নেই? ব্যাঙ্কে যাও।’

প্রহ্লাদ বগলের ছাতা এবং ব্যাগ সামলেই ডান হাত দিয়ে মাথা চুলকাল।

‘স্যার, পুরো টাকা চাই না। শুধু বুকিংয়ের টাকাটুকু পেলেই এখনকার মতো হয়ে যাবে। তারপর ম্যানেজ করব। গত বছর মেয়ের বিয়ের জন্য অফিসের লোন নিয়ে ফেলেছি। মাইনে কাটছে। এখন হাতে যা পাই তাতে সংসার চলা মুশকিল। আবার যদি ব্যাঙ্কে গিয়ে গাদাখানেক টাকা কাটাই, খাব কী? তাই বলছিলাম, আপনি যদি ব্যবস্থা করে দেন…একটা বছর পর খানিকটা সামলে নিয়ে শোধ দিতে শুরু করব।’

এই লোকের আবদার বিরাট! এক বছর টাকা ফেরত দেবে না বলছে! আবদারের বহরে বিমলকান্তিবাবু হালকা মজা পেলেন। বললেন, ‘কত টাকা?’

প্রহ্লাদ একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘লাগবে এক লাখ বিশ হাজার। আপনি স্যার এক লাখ দিলেই হবে। বিশ হাজার স্যার বউয়ের গয়না বেচে হয়ে যাবে। বুকিং মানি নিয়েই ঝামেলায় পড়েছি। পরেরগুলো জোগাড় হয়ে যাবে। আপনি চিন্তা করবেন না।’

চিন্তা করবেন না! এই লোকের কথাবার্তা তো একেবারে ঠিক নেই। তার টাকা জোগাড় নিয়ে বিমলকান্তি সেন কেন খামোকা চিন্তা করতে যাবেন! না, অনেক হয়েছে। এবার ভবানীকে ডেকে গর্দভকে বের করে দেওয়াই ভালো। নইলে সত্যি সত্যি সকালেই মেজাজ গোলমাল হয়ে যাবে। লোকটার মাথায় হালকা গোলমাল আছে মনে হচ্ছে। ভারী পাগল ভালো। চিনতে সুবিধে হয়। হালকা পাগল নিয়েই সমস্যা। বিমলকান্তিবাবুর ইজি চেয়ারের পাশে ছোট টেবিলে ইন্টারকম রয়েছে। গেটে যোগাযোগ করা যায়। বিমলকান্তিবাবু হাত বাড়ালেন।

আর তখনই সব উলটে গেল। মুহূর্তের জন্য যেন চারপাশ দুলে উঠল। ভূমিকম্প হলে যেমন হয় অনেকটা সেরকম।

বিমলকান্তি সেনের মনে হল, তিনি বিমলকান্তি সেন নন। তিনি অন্য কেউ। আরেকটা মানুষ। যিনি সেন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের মালিক নন, একজন কর্মচারী মাত্র। অতি সামান্য কর্মচারী। বারুইপুরের কাছে ফ্ল্যাট কিনবেন। বহুদিনের স্বপ্ন স্যার নিজের বাড়ি হবে। জায়গা দেখেছে, কিন্তু ফ্ল্যাট বুকিং করবার টাকা জোগাড় হয়নি। ঘুরছেন টাকার চেষ্টায়। তার এক বগলে ছাতা, এক বগলে সস্তার ব্যাগ। তাতে টিফিন কৌটো। ‘স্যার’-এর সামনে একটু কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। পেটের কাছটা চুলকে উঠল। একটা চোঁয়া ঢেঁকুর গলার কাছ পর্যন্ত এসে থমকে গেল। ঠিক যেন প্রহ্লাদ! তিনি কি সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রহ্লাদ হয়ে যাচ্ছেন! ভয়ঙ্কর! একটা ঠান্ডা স্রোত বিমলকান্তির শিরদাঁড়া দিয়ে সরসর করে নেমে গেল। তার মাথায় কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। নিজের কথা নয়, অন্য মানুষের কথা।

বিমলকান্তি কি তাকে টাকা দেবে? সবাই বলেছে, দেবে না। আমার মনে হচ্ছে, দেবে। কড়া মানুষটার ভিতরে একটা নরম মানুষ আছে। সে অন্যের স্বপ্নকে সম্মান করবে। উনি নিশ্চিত বুঝতে পারছেন আমার স্বপ্নটা সিরিয়াস।

বুকের ভিতরটা ধুকপুক করে উঠল বিমলকান্তিবাবুর। কী হচ্ছে এসব! তিনি কি প্রহ্লাদ হয়ে গেলেন? তার মতো করে ভাবছেন!

হতে পারে না। ভুল হচ্ছে। ভয়ঙ্কর একটা ভুল হচ্ছে।

ভাবতে ভাবতেই নিমেষে সব ঠিক হয়ে গেল। খুব বেশি হলে পনেরো সেকেন্ড। যেমন দ্রুত এসেছিল, তেমন দ্রুতই চলে গেল সব। মনের ভিতর থেকে মুছে গেল। এমনকী পেট চুলকোনো, হাফ ঢেঁকুরও ভ্যানিশ! সব নরমাল। বিমলকান্তি সেন যেমন ছিলেন তেমন হয়ে গেলেন।

এর পরে আরও দু-চারটে কথা চালালেন বিমলকান্তি। ইচ্ছে করছে না। কেমন একটা অস্বস্তি। ভিতরে খচখচ করছে। এটা কেমন ভুল? একটা মানুষ আরেকটা মানুষ হয়ে যাবে কেন! যত কম সময়ের জন্যই হোক, কেন হবে? জেগে জেগে স্বপ্ন দেখলেন না তো? দুঃস্বপ্ন?

বিমলকান্তিবাবু একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘প্রহ্লাদ, তুমি অফিসে গিয়ে অ্যাপ্লিকেশন জমা দেবে। আমি বলে রাখব। দুদিন পরে টাকা পেয়ে যাবে। এখন যাও।’

প্রহ্লাদ চলে যাওয়ার পর, অনেকটা সময় চুপ করে বসে রইলেন বিমলকান্তিবাবু।