» » দ্বিতীয় কিস্তি

বর্ণাকার

প্রচেত গুপ্ত

একটু পরে রোদ উঠবে

এগার

অপকারীর বিপদ আসে যেচে, পরোপকারীর বিপদ আসে নেচে।

এই প্রবাদ কোনও সত্যি প্রবাদ নয়, মেঘবতীর বানানো। বরের জন্য বানিয়েছে। এর মানে হল, কারও অপকার করলে বিপদ নিজে থেকেই ডেকে আনা হয়, কিন্তু কারও উপকার করলে উপকারীর কাছে বিপদ আসে নাচতে নাচতে।

বিপদ কেমন নাচতে নাচতে আসে সেদিন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল মেঘবতী। বরের পাগলামির জন্য আর একটু হলে পুলিশ ধরে থানায় নিয়ে যাচ্ছিল। অহেতুক কারণে কাঁদতে ভালোবাসলেও, কঠিন পরিস্থিতিতে মেঘবতী কখনও কান্নাকাটি করে না। নার্ভাস হয় না। অন্য যে-কোনও মেয়ে এই ঝামেলায় পড়লে আগে ‘ভ্যাঁ’ করে কেঁদে ফেলত। মেঘবতী সেদিন ঠাণ্ডা মাথায় ঝামেলা সামলেছে।

ঘটনা ছিল এরকম—

রাস্তায় ঢাউস সুটকেস হাতে ‘অসহায়’ বৃদ্ধ মানুষকে দেখে ‘প্রাণ কেঁদে উঠেছিল’ জ্যোতিষ্কর। আহারে, মানুষটা নিশ্চয় সমস্যায় পড়েছে! হয়তো ট্যাক্সির ভাড়া পকেটে নেই। এদিকে অতবড় সুটকেস নিয়ে বাসেও উঠতে পারছেন না। অন্তত খানিকটা পথ গাড়িতে এগিয়ে দিলে উপকার হবে। এই ভেবে রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে হাসি হাসি মুখে এগিয়ে গিয়েছিল জ্যোতিষ্ক। বুঝতে পারেনি, একটু পরে গাড়ি থেকে মেঘবতীও নেমে এসেছে। পিছনে চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখছে। সম্ভবত, তার স্বামী ভদ্রলোকটি বাড়াবাড়ি কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন, সেটা আরও একবার নতুন করে জানবার কৌতূহল হয়েছিল।

‘নমস্কার, আপনাকে আমি অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছি।’

বৃদ্ধ থমকে দাঁড়ান। জ্যোতিষ্কর দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে বলেন, ‘কে আপনি?’

জ্যোতিষ্ক নাটকীয়ভাবে বলে, ‘কেউ নই। একজন পাসারবাই। পথচলতি মানুষ বলতে পারেন।’

বৃদ্ধ সন্দেহ ভরা গলায় বলেন, ‘আমাকে লক্ষ করছেন মানে!’

জ্যোতিষ্ক হেসে হাত তুলে বলল, ‘টেনশনের কিছু নেই মেসোমশাই। আপনাকে আমি আর আমার স্ত্রী গাড়ি থেকে লক্ষ করছিলাম। মনে হল, নিশ্চয় আপনি কোনও সমস্যায় পড়েছেন। তাই গাড়ি থেকে নেমে আপনার কাছে এসেছি। মে আই হেল্প ইউ?’

বৃদ্ধ এবার অবাক হয়ে, চোখ বড় করে বললেন, ‘আমি সমস্যায় পড়েছি! কীসের সমস্যা?’

জ্যোতিষ্ক বলল, ‘মেসোমশাই, আপনি লজ্জা পাবেন না। এত বড় একটা সুটকেস নিয়ে ট্যাক্সির জন্য ছোটাছুটি করছেন, এটা একটা সমস্যা নয়?’

বৃদ্ধ চোখ কপালে তুলে বললেন, ‘ট্যাক্সি! ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করতে যাব কেন!’

এবার জ্যোতিষ্কর অবাক হওয়ার পালা।

‘তবে কি বাস? এই সুটকেস নিয়ে বাসে উঠবেন কী করে? রাতের দিকে বাস কমে যায়। তাই ভিড় থাকে খুব।’

বৃদ্ধ তেড়েফুঁড়ে বললেন, ‘বাসে উঠব, কে বলল আপনাকে?’

জ্যোতিষ্ক থতমত খেয়ে বলল, ‘ট্যাক্সি, বাস কিছুই নয়! রিকশা খুঁজছেন? রিকশায় বাড়ি ফিরবেন? এই বড় রাস্তায় কি রিকশা পাবেন? তাও আবার এত রাতে… গলিটলিতে ঢুকে যদি…।’

বৃদ্ধ গম্ভীর গলায় বললেন, ‘ট্যাক্সি, বাস, রিকশা আমার কিছুই লাগবে না। আমার ছেলে এখনই গাড়ি নিয়ে আসছে। আমি এগিয়ে গিয়ে সেটাই দেখছি। ছোটাছুটি কিছু করিনি। আপনি ভুল বুঝেছেন।’

জ্যোতিষ্ক থমকে যায়। তাহলে সমস্যা নয়! স্মার্ট হাসবার চেষ্টা করে সে। মাথা চুলকে, আমতা আমতা করে বলল, ‘ও হো, আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম, আপনি প্রবলেমে পড়েছেন। সরি মেসোমশাই।’

বৃদ্ধ হাত নেড়ে তাড়াবার ভঙ্গিতে বললেন, ‘এবার তো বুঝেছেন, তাহলে যান। নিজের কাজ করুন গিয়ে। আর আমাকে মেসোমশাই ডাকছেন কেন? আমি তো আপনার মেসোমশাই নই।’

জ্যোতিষ্ক দু পা এগিয়ে গিয়ে গদগদ ভঙ্গিতে বলল, ‘সরি স্যার… আপনি বরং সুটকেসটা আমাকে দিন। অত ভারী জিনিস…যতক্ষণ না আপনার ছেলের গাড়ি আসে আমি ওটা ক্যারি করছি। নো প্রবলেম। দিন আমাকে।’

কথা শেষে জ্যোতিষ্ক হাত বাড়ায়। বৃদ্ধ চমকে ওঠেন। আঁতকে ওঠেন বলা যায়। লাফ দিয়ে পিছিয়ে যান কয়েক পা। ধড়ফড় করে বলে ওঠেন, ‘না না, আপনি আমার সুটকেসে হাত দেবেন না। মোটে হাত দেবেন না। খুব খারাপ হয়ে যাবে।’

জ্যোতিষ্ক অবাক হয়ে বলে, ‘কেন স্যার, এনি প্রবলেম?’

বৃদ্ধ চিৎকার করে বলেন, ‘এ কী কথা। আপনি আমার সুটকেস চাইছেন কেন? আমি পুলিশ ডাকব…।’

জ্যোতিষ্ক বলে, ‘পুলিশ! পুলিশ ডাকবেন কেন? সমস্যা কী?’

কথার ফাঁকেই একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায়। জানলার কাচ নামিয়ে কেউ একজন ডাকল, ‘বাবা, চলে এসো।’

বৃদ্ধ যেন হাতে স্বর্গ পেলেন। বাসস্টপ থেকে লাফ মেরে রাস্তায় নামেন। হাঁপাতে হাঁপাতে বলেন, ‘ভলু…ভলু…তাড়াতাড়ি দরজা খোল ভলু…লোকটা আমার সুটকেস কেড়ে নিতে চাইছে…ছিনতাই…।’

‘ভলু’র দামি, বিদেশি গাড়ির দরজা খুলে যায়। আতঙ্কিত বৃদ্ধ নিমেষে সুটকেস সমেত সেঁধিয়ে যান ভিতরে। হতভম্ব জ্যোতিষ্ককে ফেলে গাড়ি চলে যায় ভুস করে। মেঘবতী এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার স্বামীর পাশে এসে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘হল তো?’

বউয়ের গলা শুনে জ্যোতিষ্ক একটু চমকে যায়। নিজেকে সামলে, পাশ ফিরে বলে, ‘তুমি! কী হল মেঘ?’

মেঘবতী চাপা গলায় বলল, ‘শিক্ষা হল না? আমি তো সেই কারণেই গাড়ি থেকে নেমে এসেছি। পরোপকরের লেসন তোমার কেমন হয় দেখব বলে।’

জ্যোতিষ্ক অবাক হয়ে বলল, ‘কীসের শিক্ষা!’

মেঘবতী ক্রোধ ও বিস্ময় মেশানো গলায় বলল, ‘এর পরেও বলছ কীসের শিক্ষা! রাস্তার একজন অপরিচিত কে না কে, একটা বুড়ো, তোমাকে ছিনতাইবাজ বলে চলে গেল। তার পরেও বলছ কীসের শিক্ষা! তোমার লজ্জা করছে না? পরোপকার করতে গেলে কীভাবে অপমানিত হতে হয়, এখনও বুঝতে পারছ না?’

জ্যোতিষ্ক হেসে বলল, ‘দুর এসব ছোটখাটো মান-অপমান গায়ে মাখলে চলে? বৃদ্ধ মানুষটি যে আসলে কোনও সমস্যায় পড়েননি, এটাই তো আনন্দের কথা মেঘ। আমরা ভুল ভেবেছিলাম জেনে ভালো লাগছে। আমি আশা করব, এভাবে বার বার আমাদের ভুল ভাঙুক। চলো এবার ফেরা যাক। রাত হতে চলল। খিদে পাচ্ছে। আজ ডিনারে স্পেশাল আইটেম কী?’

মেঘবতী বলল, ‘আচ্ছা মানুষ তো তুমি? এতবড় অপমানের পর নির্বিকারভাবে বলছ ডিনার কী!’

জ্যোতিষ্ক ‘হো হো’ আওয়াজে হেসে উঠল। মেঘবতী বলল, ‘চুপ করো। একদম চুপ করো। এরপর থেকে তুমি যখন মাঝরাস্তায় গাড়ি থামিয়ে কাউকে উপকার করতে যাবে, দয়া করে আমাকে একটু আগে জানাবে।’

জ্যোতিষ্ক মুচকি হেসে বলল, ‘কেন? তুমি কী করবে?’

মেঘবতী বলল, ‘গাড়ি থেকে নেমে একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি চলে যাব। কেউ আমার হাজবেন্ডকে ছিনতাইবাজ বলবে আর আমি দাঁড়িয়ে থেকে সেটা শুনব, এটা টু মাচ। আমি মেনে নিতে পারছি না। আজ ছিনতাইবাজ বলছে, কাল চোর বলবে, পরশু ডাকাত বলবে।’

জ্যোতিষ্ক হাসতে হাসতে গাড়ির দরজা খুলল। আর তখনই সামনে পথ আটকে একটা পুলিশ জিপ এসে থামে। টহলদার পুলিশের জিপ। টক করে একজন উর্দি পরা অফিসার ধরনের যুবক এগিয়ে এল।

‘এই যে মিস্টার এক মিনিট দাঁড়াবেন।’

জ্যোতিষ্ক ভুরু কুঁচকে বলল, ‘আমাকে বলছেন! কী হয়েছে?’

পুলিশ অফিসার বলল, ‘হয়নি কিছু। আপনাদের নামে একটা কমপ্লেইন পেলাম, সেটাই ভেরিভাই করতে এসেছি।’

মেঘবতী বিড়বিড় করে বলল, ‘কমপ্লেইন! আমাদের নামে!’

ততক্ষণে অফিসার গাড়ির পাশে চলে এসেছে। হেসে বলল, ‘হ্যাঁ ম্যাডাম। সিরিয়াস কমপ্লেইন। মোড়ে ডিউটি দিচ্ছিলাম, এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক আর তার ছেলে গাড়ি থামিয়ে বলে গেল আপনারা নাকি তাদের সুটকেস কেড়ে নিতে গিয়েছিলেন।’

মেঘবতীর কান, মাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। তারা ছিনতাই করছে! এ কী কথা! মনে হল, শরীর কাঁপছে। গাড়ির দরজা ধরে কোনও রকমে নিজেকে সামলাল সে। বলল, ‘আপনি এসব কী বলছেন অফিসার! আমরা কেন সুটকেস কেড়ে নিতে যাব।’

অফিসার ছেলেটি বলল, ‘আমরা কিছু বলিনি। বৃদ্ধ ভদ্রলোক বলেছেন। এবার বলুন, আপনারা কারা এবং এত রাতে এখানে গাড়ি থামিয়ে কী করছেন?’

জ্যোতিষ্ক রাগ সামলে চাপা গলায় বলল, ‘রাতে রাস্তায় বেরোনো বারণ নাকি?’

অফিসার ঠোঁটের কোণায় মিচকে হেসে বলল, ‘না নিষেধ নয়, তবে সময়টা ভালো নয়। কদিন ধরে শহরের এদিকটায় ফ্লাইং ছিনতাই হচ্ছে। একটা গ্যাং গাড়ি নিয়ে ঘুরছে আর সুযোগ বুঝলেই এর-তার ব্যাগ, গয়নাগাঁটি কেড়ে নিয়ে চম্পট দিচ্ছে। আমরা গ্যাংটাকে ধরবার চেষ্টায় আছি।’

মেঘবতী কঠিন গলায় বলল, ‘আপনারা ভুল করছেন অফিসার। হ্যারাস করছেন।’

 অফিসার ছেলেটি আর একটু এগিয়ে এসে বলল, ‘সেটা হলেই খুশি হব ম্যাডাম। আপনাদের দেখে এবং কথাবার্তা শুনে ভদ্রলোক মনে হচ্ছে। ছিনতাইয়ের ব্যাপারটা ভুল প্রমাণিত হলে খুশি হব। যাক, সরুন, গাড়ি সার্চ করব।’

ততক্ষণে একটু একটু করে ভিড় জমতে শুরু করেছে। জ্যোতিষ্ক তেড়ে যেতে গেল। মেঘবতী দ্রুত হাতে তাকে আটকে পুলিশ অফিসারের কাছে এগিয়ে যায়। নীচু গলায় আসল ঘটনা বোঝাতে চেষ্টা করে। তাতে খুব লাভ হয় না, কিন্তু জ্যোতিষ্ক সরকারের কত বড় পদে কাজ করে সেই পরিচয় পাওয়ার পর তরুণ অফিসার থতমত খেয়ে যায়। এটাই মজা। এ দেশে পদ, অর্থাৎ চেয়ারের মহিমা অতি গুরুত্বপূর্ণ। একমাত্রও বলা যায়। ঘটনার থেকে চেয়ারের ওজন সবসময় বেশি। কী ঘটল, কেন ঘটল সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল, ঘটনা যে ঘটিয়েছে সে কোন চেয়ারে বসে? তার স্ট্যটাস কী? নড়বড়ে টুলে বসলে নেংটি ইঁদুর, সিংহাসনে বসলে সিংহ। আরও মজা হল, সিংহাসন ত্যাগ করলে সিংহ হয়ে যায় নেংটি ইঁদুর। বেচারি! যাই হোক, জ্যোতিষ্কর চাকরির কথা শুনে অফিসারের টনক নড়ল। স্যালুট ট্যালুট করে একসা কাণ্ড।

‘সরি স্যার…ভেরি সরি স্যার…আমরা ঠিক বুঝতে পারিনি…আসলে স্যার কমপ্লেইন পেলাম…আপনার মতো অন্যের সমস্যায় ব্যস্ত হয়ে ওঠা মানুষ তো আজকাল দেখা যায় না…মানুষ ভুল বোঝে…কিছু মনে করবেন না স্যার…আজকের দিনে আপনার মতো মানুষ অতি বিরল…আমি স্যার ওই বুড়োর ফোন নম্বর নিয়ে রেখেছি…থানায় গিয়েই ধরব…মিথ্যে অভিযোগের ধমক কাকে বলে দেখবে…হারামজাদা…সরি স্যর…।’

বাড়ি ফিরেই মেঘবতী ঘোষণা করেছিল, পরদিনই সে তার বাবা-মায়ের কাছে চলে যাবে। খুব বেশি হলে একদিন অপেক্ষা করতে পারে। তারপর আর নয়। জ্যোতিষ্কের এই পাগলামি সে কিছুতেই মেনে নেবে না। তাকে যদি পাগলামি করতেই হয়, তাহলে একা করুক, বউ নিয়ে নয়। অন্যদিকে জ্যোতিষ্কও ঘোষণা করল, মানুষ যতই সমস্যায় পড়ুক, সে আর কখনও এভাবে রাস্তায় গাড়ি থামাবে না। মেঘবতীকে পুলিশের বিড়ম্বনায় ফেলার জন্য সে ‘সরি’। মেঘবতীর উচিত তার এই ঘোষণাকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে বাবা-মায়ের কাছে চলে যাওয়ার কথা একবার বিবেচনা করে দেখা। ঠাণ্ডা মাথায় বিবেচনা প্রয়োজন। জ্যোতিষ্ক বলল, যা ঘটেছে তার জন্য সে দায়ী নয়। বৃদ্ধ এবং পুলিশের বোঝাবুঝির দায় তার ঘাড়ে ফেলা অনুচিত। মুখে যাই বলুক এবং যতই ঝামেলা ঘাড়ে এসে পড়ুক, মেঘবতী আসলে তার স্বামীর পক্ষে। এই যুক্তি সে ফেলতে পারল না। ফলে বাবা-মায়ের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সাময়িকভাবে স্থগিত রাখল। কিন্তু দুদিন পরেই আবার এমন ঘটনা ঘটল যে, মেঘবতী সত্যি সত্যি সুটকেস গুছিয়ে চলে যায়।

সেদিন পুলিশ নয়, ঝামেলার কেন্দ্রে ছিল নারকোল। খান বারো নারকোল। তার আবার বেশিরভাগই শুকনো।

দিনটা ছিল রবিবার। টিপটিপ করে সকাল থেকে বৃষ্টি। ছুটির দিনে জ্যোতিষ্ক আস্তে ধীরে বাজারে বেরোয়। আলিস্যি লাগে। অন্যদিনের তুলনায় একটু বেলাই করে ফেলে। তার ওপর সেদিন ছিল স্যাঁতস্যাঁতে একটা দিন। বাজারে ঢোকবার অনেক আগেই দেখল, এক বালিকা প্লাস্টিক পেতে কতগুলো নারকোল নিয়ে বেজার মুখে বসে আছে। বালিকার বয়স কিছুতেই দশ-এগারোর বেশি হবে না। মাথায় একটা গামছা। গামছা দিয়ে বৃষ্টির জল আটকাতে চেষ্টা হয়েছে, লাভ হচ্ছে না। মলিন ফ্রক ভিজছে। প্রতিটা ক্রেতার দিকে বালিকা তাকিয়ে আছে অতি আগ্রহ নিয়ে। বোঝাই যাচ্ছে, তার নারকোল বিক্রি নেই। বিক্রি নেই বলে উঠতেও পারছে না। বৃষ্টিতে ভিজছে। কে জানে, হয়তো বেচারিকে তার বাড়ির লোক হুমকি দিয়ে বসিয়ে রেখেছে। জ্যোতিষ্ক সামনে দিয়ে যেতে মেয়েটি নীচু গলায় বলল, ‘নারকোল লাগবে?’

জ্যোতিষ্ক থমকে দাঁড়াল। মায়াভরা গলায় বলল, ‘নারে মা, আজ আর নারকোল লাগবে না। অন্যদিন নেব।’

মেয়েটি এবার ঝাঁঝিয়ে উঠল।

‘সবাই যদি অন্যদিন কয় আমার কী হবে? আমি এগুলান নিয়ে কী করব?’

ছাতা হাতে জ্যোতিষ্ক থমকে দাঁড়ায়। মেয়েটি বলল, ‘দাঁড়ায়ে দেখেন কী? আমি জলে ভিজি এইডা দেখেন?’

নিমেষের জন্য জ্যোতিষ্কর মনে হল, মেয়েটির চোখে জল। কান্না? নাকি দুনিয়ার প্রতি রাগ? ঘেন্না?

জ্যোতিষ্ক বারোটা নারকোল কিনে হাসিমুখে বাড়ি ফিরেছিল সেদিন। বারোটাই তাকে কিনতে হয়নি। মলিন ফ্রকের মেয়ে তাকে একটা বিনি পয়সায় দিয়েছে।

‘এইডা আপনারে ফিরি কইর‌্যা দিলাম, টাকা লাগব না।’

মেঘবতী দুপুরের একটু পরেই বাপের বাড়ি চলে গেল। নারকোল-যন্ত্রণা সে মেনে নিতে পারল না।