চার
সাত দিনের ছুটি, কিন্তু প্রায় সপ্তাহ-দুই এলাহাবাদে কাটাইয়া হঠাৎ একদিন দুপুরবেলা শৈলেশ্বর আসিয়া বাটীতে প্রবেশ করিল। সম্মুখের নীচে বারান্দায় বসিয়া সোমেন কতকগুলো কাঠি, রঙ-বেরঙের কাগজ, আঠা, দড়ি ইত্যাদি লইয়া অতিশয় ব্যস্ত ছিল, পিতার আগমন প্রথমে সে লক্ষ্য করে নাই, কিন্তু দেখিবামাত্র সংবর্ধনা করিল, এবং লজ্জিত আড়ষ্টভাবে পায়ের কাছে ঢিপ করিয়া প্রণাম করিল। গুরুজনদিগকে প্রণাম করার ব্যাপারে এখনও সে পটুত্ব লাভ করে নাই, তাহার মুখ দেখিয়াই তাহা বুঝা গেল। খুব মন্দ না লাগিলেও শৈলেশ বিস্মিত হইল। কিন্তু ঐ কাগজ-কাঠি-আঠা প্রভৃতির প্রতি দৃষ্টি পড়িতেই বলিয়া উঠিল, ও-সব তোমার কি হচ্চে সোমেন?
সোমেন রহস্যটা এককথায় ফাঁস করিল না, বলিল, তুমি বল ত বাবা, ও কি?
বাবা বলিলেন, আমি কি করে জানব?
ছেলে হাততালি দিয়া মহা আনন্দে কহিল, আকাশ-প্রদীপ।
আকাশ-প্রদীপ! আকাশ-প্রদীপ কি হবে?
ইহার অদ্ভুত বিবরণ সোমেন আজ সকালেই শিখিয়াছে, কহিল, আজ সংক্রান্তি, কাল সন্ধ্যাবেলায় উই উঁচুতে বাঁশ বেঁধে টাঙ্গাতে হবে বাবা! মা বলেন, আমার ঠাকুরদ্দারা যাঁরা স্বর্গে আছেন, তাঁদের আলো দেখাতে হয়। তাঁরা আশীর্বাদ করেন।
শৈলেশের মেজাজ গরম হইয়াই ছিল, টান মারিয়া পা দিয়া সমস্ত ফেলিয়া ধমক দিয়া কহিল, আশীর্বাদ করেন! যত সমস্ত কুসংস্কার—যা পড় গে যা বলচি।
তাহার এত সাধের আকাশ-প্রদীপ ছত্রাকার হইয়া পড়ায় সোমেন কাঁদ-কাঁদ হইয়া উঠিল। উপরে কোথা হইতে অত্যন্ত মিষ্টকণ্ঠের ডাক আসিল, বাবা সোমেন, কাল বাজার থেকে আমি আরও ভাল একটা আকাশ-প্রদীপ তোমাকে কিনে আনিয়ে দেব, তুমি আমার কাছে এস।
সোমেন চোখ মুছিতে মুছিতে উপরে চলিয়া গেল। শৈলেশ কোন দিকে দৃষ্টিপাত না করিয়া গম্ভীর বিরক্তমুখে তাহার পড়িবার ঘরে গিয়া প্রবেশ করিল। পরক্ষণেই ছোট্ট ঘণ্টার শব্দ হইল—টুন্ টুন্ টুন্ টুন্, কেহ সাড়া দিল না।
আবদুল!
আবদুল আসিল না।
গিরিধারী? গিরিধারী!
গিরিধারীর পরিবর্তে বাঙ্গালী চাকর গোকুল গিয়া পর্দার ফাঁক দিয়া মুখ বাড়াইয়া কহিল, আজ্ঞে—
শৈলেশ ভয়ানক ধমক দিয়া উঠিল, আজ্ঞে? ব্যাটারা মরেচিস?
গোকুল বলিল, আজ্ঞে না।
আজ্ঞে না? আবদুল কৈ?
গোকুল কহিল, মা তাকে ছুটি দিয়েছেন, সে বাড়ি গেছে।
ছুটি দিয়েচেন! বাড়ি গেছে! গিরিধারী কোথা গেল?
গোকুল জানাইল, সেও ছুটি পাইয়া দেশে চলিয়া গেছে।
শৈলেশ স্তম্ভিত হইয়া কহিল, বাড়িতে কি লোকজন কেউ আর নেই নাকি?
গোকুল ঘাড় নাড়িয়া বলিল, আজ্ঞে আর সবাই আছে।
তাই বা আছে কেন? যা দূর হ—
শৈলেশ্বর নিজেই তখন জুতা খুলিল, কোট খুলিয়া টেবিলের উপরেই জড় করিয়া রাখিল; আলনা হইতে কাপড় লইয়া ট্রাউজার খুলিয়া দূরের একটা চেয়ার লক্ষ্য করিয়া ছুঁড়িয়া ফেলিতে সেটা নীচে পড়িয়া লুটাইতে লাগিল; নেকটাই, কলার প্রভৃতি যেখানে সেখানে ফেলিয়া দিয়া নিজের চৌকিতে গিয়া বসিতেই ঠিক সম্মুখে টেবিলের উপর ছোট্ট একটি খাতা তাহার চোখে পড়িল—মলাটে লেখা, সংসার খরচের হিসাব। খুলিয়া দেখিল, মেয়েলি অক্ষরের চমৎকার স্পষ্ট লেখা। দৈনিক খরচের অঙ্ক—মাছ এত, শাক এত, চাল এত, ডাল এত,—হঠাৎ দ্বারের পর্দা সরানর শব্দে চকিত হইয়া দেখিল, কে একজন স্ত্রীলোক প্রবেশ করিতেছে। সে আর যেই হউক দাসী নয়, তাহা চক্ষের পলকে অনুভব করিয়া শৈলেশ হিসাবের খাতার মধ্যে একেবারে মগ্ন হইয়া গেল। যে আসিল সে তাহার পায়ের কাছে গড় হইয়া প্রণাম করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, তুমি কি এত বেলায় আবার চা খাবে না কি? কিন্তু তাহলে আর ভাত খেতে পারবে না।
ভাত খাব না!
না খাও, হাতমুখ ধুয়ে ওপরে চল। অবেলায় স্নান করে আর কাজ নেই, কিন্তু জলখাবার ঠিক করে আমি কুমুদাকে সরবৎ তৈরি করতে বলে এসেছি। চল।
এখন থাক।
ওগো আমি ঊষা—বাঘ-ভাল্লুক নই। আমার দিকে চোখ তুলে চাইলে কেউ তোমাকে ছি ছি করবে না।
শৈলেশ কহিল, আমি কি বলেচি তুমি বাঘ-ভাল্লুক?
তবে অমন করে পালিয়ে বেড়াচ্চ কেন?
আমার কাজ ছিল। তুমি বিভার সঙ্গে ঝগড়া করলে কেন?
ঊষা কহিল, ও তোমার বানানো কথা, তোমাকে সে কখ্খনো লেখেনি আমি ঝগড়া করেচি।
শৈলেশ কহিল, তুমি আবদুলকে তাড়িয়েচ কেন?
কে বলেচে তাড়িয়েচি? সে এক বছরের মাইনে পায়নি, বাড়ি যাবার জন্যে ছটফট করছিল; আমি মাইনে চুকিয়ে দিয়ে তাকে ছুটি দিয়েচি।
শৈলেশ বিস্মিত হইয়া কহিল, সমস্ত চুকিয়ে দিয়েচ? তা হলে সে আর আসবে না। গিরিধারী গেল কেন?
ঊষা কহিল, এ ত তোমার ভারি অন্যায়! চাকর-বাকরদের মাইনে না দিয়ে আটকে রাখা কেন, তাদের কি বাড়ি-ঘর-দোর নেই নাকি? আমি তাকে মাইনে দিয়ে ছেড়ে দিয়েচি।
শৈলেশ কহিল, বেশ করেচ। এইবার বশিষ্ঠমুনির আশ্রম বানিয়ে তোলো। সে হিসাবের পাতার উপরে দৃষ্টি রাখিয়াই কথা কহিতেছিল, হঠাৎ একটা বড় অঙ্ক তাহার চোখে পড়িতেই, চমকিয়া কহিল, এটা কি? চারশ’ ছ’ টাকা—
ঊষা উত্তর দিল, ও টাকাটা মুদির দোকানে দিয়েচি। এখনো বোধ করি শ’-দুই আন্দাজ বাকী রইল, বলেচি আসচে মাসে দিয়ে দেব।
শৈলেশ অবাক হইয়া বলিল, ছ-শ’ টাকা মুদির দোকানে বাকী?
ঊষা হাসিয়া কহিল, হবে না? কখনো শোধ করবে না, কখনো হিসেব দেখতে চাইবে না—কাজেই দু’বছর ধরে এই টাকাটা জমিয়ে তুলেচ।
শৈলেশ এতক্ষণে মুখ তুলিয়া চাহিল, বলিল, তুমি কি এই দু’বছরের হিসেব দেখলে নাকি?
ঊষা ঘাড় নাড়িয়া বলিল, নইলে আর উপায় ছিল কি?
শৈলেশ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল, কিন্তু তাহার মুখের উপরে যে লজ্জার ছায়া পড়িতেছে, এ কথা এই পাঁচ মিনিটের পরিচয়েও ঊষার চিনিতে বাকী রহিল না, জিজ্ঞাসা করিল, কি ভাবচ বল ত?
শৈলেশ হাসিবার চেষ্টা করিয়া কহিল, ভাবচি টাকা যা ছিল, সব ত খরচ করে ফেললে, কিন্তু মাইনে পেতে পনর-ষোল দিন বাকী !
ঊষা মাথা নাড়িয়া কহিল, আমি কি ছেলেমানুষ যে, সে হিসেব আমার নেই? পনর দিন কেন, একমাসের আগেও আমি তোমার কাছে টাকা চাইতে আসব না। কিন্তু কি কাণ্ড করে রেখেচ বল ত? গোয়ালা বলছিল, তার প্রায় দেড়শ’ টাকা পাওনা। ধোপা পাবে পঞ্চাশ টাকার ওপর, আর দর্জির দোকানে যে কত পড়ে আছে, সে শুধু তারাই জানে। আমি হিসেব পাঠাতে বলে পাঠিয়েছি।
শৈলেশ অত্যন্ত ভয় পাইয়া বলিল, করেচ কি? তারা হয়ত হাজার টাকাই পাওনা বলবে—কিন্তু দেবে কোথা থেকে?
ঊষা নিশ্চিন্তমুখে কহিল, একবারেই দিতে পারব তা ত বলিনি, আমি তিন-চার মাসে শোধ করব। আর কারও কাছে ত কিছু ধার করে রাখোনি? আমাকে লুকিয়ো না।
শৈলেশ তাহার মুখের প্রতি দৃষ্টি স্থির করিয়া রাখিয়া শেষে আস্তে আস্তে বলিল, গত বৎসর গ্রীষ্মের ছুটিতে সিমলা যেতে একজনের কাছে হ্যান্ডনোটে দু’ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলাম, একটা টাকা সুদ পর্যন্ত দিতে পারিনি।
ঊষা গালে হাত দিয়া বলিল, অবাক কাণ্ড! কিন্তু পরক্ষণেই হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, তুমিও দেখচি এক বছরের আগে আর আমাকে ঋণমুক্ত হতে দেবে না। কিন্তু আর কিছু নেই ত?
শৈলেশ বলিল, বোধ হয় না। সামান্য কিছু থাকতেও পারে, কিন্তু আমি ত ভেবেচি, এ জন্মে ও আর শোধ দিতে পারব না।
ঊষা কহিল, তুমি কি সত্যিই কখনো ভাবো?
শৈলেশ বলিল, ভাবিনে? কতদিন অর্ধেক রাত্রে ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে যেন দম আটকে এসেচে। মাইনেতে কুলোয় না, প্রতি মাসেই টানাটানি হয়, কিন্তু আমকে তুমি ভুলিয়ো না। যথার্থ-ই কি আশা কর শোধ করতে পারবে?
ঊষার চোখের কোণ সহসা সজল হইয়া আসিল। যে স্বামীকে সে মাত্র অর্ধঘণ্টা পূর্বেও চিনিত না বলিলেও অত্যুক্তি হয় না, তাহারই জন্য হৃদয়ের সত্যকার বেদনা অনুভব করিল, কিন্তু হাসিয়া বলিল, তুমি বেশ মানুষ ত! সংসার করতে ধার হয়েচে, শোধ দিতে হবে না? কিন্তু এই ক-টা টাকা দিয়ে ফেলতে আমার ক-দিন লাগবে!
সকলের বড় কষ্ট হবে—
ঊষা জোর দিয়া বলিল, কারও না। তোমরা হয়ত টেরও পাবে না কোথাও কোন পরিবর্তন হয়েচে।
শৈলেশ স্থিরভাবে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। তাহার মনে হইতে লাগিল, অনেক দিনের মেঘলা আকাশের কোন্ একটা ধার দিয়ে যেন তাহার গায়ে রোদ আসিয়া পড়িয়াছে।