বার

স্ত্রীর সহিত বাক্যালাপ শৈলেশ বন্ধ করিল, কিন্তু ঊষা করিল না। তাহার আচরণে লেশমাত্র পরিবর্তন নাই—সাংসারিক যাবতীয় কাজকর্ম ঠিক তেমনিই সে করিয়া যাইতেছে। মুখ ফুটিয়া শৈলেশ কিছুই জিজ্ঞাসা করিতে পারে না, অথচ, সবচেয়ে মুশকিল হইল তাহার এই কথা ভাবিয়া, এ গৃহ যে-লোক চিরদিনের মত ত্যাগ করিয়া যাইতেছে সেই গৃহের প্রতি তাহার এতখানি মমতা-বোধ রহিল কি করিয়া? আজ সকালেই তাহার কানে গিয়াছে, দেয়ালের গায়ে হাত মুছিবার অপরাধে ঊষা নূতন ভৃত্যটাকে তিরস্কার করিতেছে। অভ্যাসমত কাজে ভুলভ্রান্তি তাহার নাই যদি-বা হয়, কিন্তু সর্বত্রই তাহার সতর্ক দৃষ্টিতে এতটুকু শিথিলতাও যে শৈলেশের চোখে পড়ে না! ঊষাকে ভাল করিয়া জানিবার তাহার সময় হয় নাই, তাহাকে সে সামান্যই জানিয়াছে, কিন্তু সেইটুকু জানার মধ্যেই কিন্তু এটুকু জানা তাহার হইয়া গেছে যে, যাবার সঙ্কল্প তাহার বিচলিত হইবে না। অথচ, সাধারণ মানব-চরিত্রের যতটুকু অভিজ্ঞতা এ বয়সে তাহার সঞ্চিত হইয়াছে তাহার সহিত প্রকাণ্ড গরমিল যেন এক চক্ষে হাসি ও অপর চক্ষে অশ্রুপাত করিয়া তাহার মনটাকে লইয়া অবিশ্রাম নাগরদোলায় পাক খাওয়াইয়া মারিতেছে।

ক্ষেত্রমোহন আসিয়া একবারে সোজা রান্নাঘরের দরজায় দেখা দিলেন, কহিলেন, প্রসাদ পাবার আর বিলম্ব কত বৌঠাকরুন?

ঊষা মাথার কাপড়টা আরও একটুখানি টানিয়া দিয়া হাসিমুখে কহিল, সে কথা আপনার বড় কুটুম্বটিকে জিজ্ঞাসা করে আসুন, নইলে আমার সব হয়ে গেছে।

ক্ষেত্রমোহন বলিলেন, ঠকবার পাত্রী আপনি নন, কিন্তু ঠকে গেলাম আমি নিজে। রান্নার বহর দেখে এই ভরা-পেটেও লোভ হয় বৌঠাকরুন, কিন্তু অসুখের ভয় করে। তবে, নেমন্তন্ন ক্যান্‌সেল করলে চলবে না, আর একদিন এসে খেয়ে যাবো।

ঊষা চুপ করিয়া রহিল। ক্ষেত্রমোহন বলিলেন, আপনার ছেলেটি কই?

ঊষা কহিল, আজ কি যে তার মাথায় খেয়াল এল কিছুতেই ইস্কুলে যাবে না। কোনমতে দুটি খাইয়ে এইমাত্র পাঠিয়ে দিলাম।

ক্ষেত্রমোহন বলিলেন, আপনাকে সে বড্ড ভালবাসে! একটুখানি হাসিয়া কহিলেন, ভাল কথা, আপনার সেই বাপের বাড়ি যাবার প্রস্তাবটা কি হল? বাস্তবিক বৌঠাকরুন, রাগের মাথায় আপনার মুখ দিয়েও যদি বেফাঁস কথা বার হয় ত ভরসা করবার সংসারে আর কিছু থাকে না।

ঊষা এ অভিযোগের উত্তর দিল না, নতমুখে নীরব হইয়া রহিল। তথা হইতে বাহির হইয়া ক্ষেত্রমোহন শৈলেশের পড়ার ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। শৈলেশ স্নানান্তে আয়নার সুমুখে দাঁড়াইয়া মাথা আঁচড়াইতেছিল, মুখ ফিরিয়া চাহিল।

ক্ষেত্রমোহন জিজ্ঞাসা করিলেন, কলেজ আজ বন্ধ নাকি হে?

না। তবে প্রথম দু’ঘণ্টা ক্লাস নেই।

ক্ষেত্রমোহন নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, আচ্ছা বেশ। কিন্তু বৌঠাকরুনের বাপের বাড়ি যাবার আয়োজন কিরূপ করলে?

শৈলেশ কহিল, আয়োজন যা করবার তিনি গেলে তবে করব। শুনচি কাল তাঁর দাদা এসে নিয়ে যাবেন।

ক্ষেত্রমোহন বলিলেন, তুমি একটি ইডিয়ট। ও স্ত্রী নিয়ে তুমি পেরে উঠবে না ভাই, তার চেয়ে বরঞ্চ বদ্‌লাবদ্‌লি করে নাও, তুমিও সুখে থাকো, আমিও সুখে থাকি।

শৈলেশ অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া কহিল, বয়েস ত ঢের হল ক্ষেত্র, এইবার এই অভদ্র রসিকতাগুলো ত্যাগ কর না!

ক্ষেত্রমোহন বলিলেন, ত্যাগ কি সাধে করতে পারিনে ভাই, তোমাদের ব্যবহারে পারিনে। তিনি অত্যন্ত ব্যথা পেয়ে বললেন, বাপের বাড়ি চলে যাবো; তুমি অমনি জবাব দিলে, যাবে যাও,—আমার ভবানীপুর এখনও হাতছাড়া হয়নি। এই সমস্ত কি ব্যবহার? ভাইবোন একেবারে এক ছাঁচে ঢালা। যাক, আমি সব ভেস্তে দিয়ে এসেচি, যাওয়া-টাওয়া তাঁর হবে না। তুমি কিন্তু আর খুঁচিয়ে ঘা করো না। হঠাৎ ঘড়ির দিকে চাহিয়া চমকিয়া উঠিলেন, উঃ—ভারি বেলা হয়ে গেল, এখন চললুম, কাল সকালেই আসবো। ফিরিতে উদ্যত হইয়া সহসা গলা খাটো করিয়া কহিলেন, দিনকতক একটু বনিয়ে চল না শৈলেশ! অধ্যাপকের ঘরের মেয়ে, অনাচার সহ্য করতে পারেন না, খানাটানাগুলো দু’দিন না-ই খেলে! তাছাড়া এসব ভালও ত নয়,—খরচের দিকটাতেই চেয়ে দেখ না! আচ্ছা, চললুম ভাই, এই বলিয়া উত্তরের প্রত্যাশা না করিয়াই দ্রুতপদে বাহির হইয়া গেলেন।

শৈলেশ কিছুক্ষণ ধরিয়া স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। ক্ষেত্রমোহন কখন আসিল, কি বলিয়া, কি করিয়া হঠাৎ সমস্ত ব্যাপার উল্টাইয়া দিয়া গেল, সে ভাবিয়াই পাইল না।

বেহারা আসিয়া সংবাদ দিল খাবার দেওয়া হইয়াছে। উত্তরের ঢাকা বারান্দায় যথানিয়মে আসন পাতিয়া ঠাঁই করা। প্রতিদিনের মত বহুবিধ অন্নব্যঞ্জন পরিবেশন করিয়া অদূরে ঊষা বসিয়া আছে, শৈলেশ ঘাড় গুঁজিয়া খাইতে বসিয়া গেল। অনেকবার তাহার ইচ্ছা হইল, ক্ষেত্রর কথাটা মুখোমুখি যাচাই করিয়া লইয়া সময়োচিত মিষ্ট দুটো কথা বলিয়া যায়, কিন্তু কিছুতেই মুখ তুলিতে পারিল না, কিছুতেই এ কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারিল না। এমন কি সোমেনের ছুতা করিয়াও আলোচনা আরম্ভ করিতে পারিল না। অবশেষে খাওয়া সমাধা হইলে নিঃশব্দে উঠিয়া চলিয়া গেল।