চৌদ্দ

ভবানীপুরের সেই সুশিক্ষিতা পাত্রীটিকে পাত্রস্থ করিবার চেষ্টা পুনরায় আরম্ভ হইল, শুধু বিভা এবার স্বামীর আন্তরিক বিরাগের ভয়ে তাহাতে প্রকাশ্যে যোগ দিতে পারিল না, কিন্তু প্রচ্ছন্ন সহানুভূতি নানা প্রকারে দেখাইতে বিরত রহিল না। কন্যাপক্ষ হইতে অনুরুদ্ধ হইয়া ক্ষেত্রমোহন একদিন সোজাসুজি প্রশ্ন করিল শৈলেশ অস্বীকার করিয়া সহজভাবেই কহিল, জীবনের অধিকাংশই ত গত হয়ে গেল ক্ষেত্র, বাকি কটা দিনের জন্যে আর নতুন ঝঞ্ঝাট মাথায় নিতে ভরসা হয় না। সোমেন আছে, বরঞ্চ আশীর্বাদ কর তোমরা, সে বেঁচে থাক—এ সবে আমার আর কাজ নেই।

মানুষের অকপট কথাটা বুঝা যায়, ক্ষেত্রমোহন মনে মনে আজ বেদনা বোধ করিলেন। ইহার পর হইতে তিনি আদালতের ফেরত প্রায়ই আসিতে লাগিলেন।

গৃহে গৃহিণী নাই, সন্তান নাই, গোটা তিনেক চাকরে মিলিয়া সংসার চালাইতেছে—দেখিতে দেখিতে সমস্ত বাড়িটা এমনি বিশৃঙ্খলা ছন্নছাড়া মূর্তি ধারণ করিল যে, ক্লেশ অনুভব না করিয়া পারা যায় না। প্রায় মাসাধিককাল পরে সে সেই কথারই পুনরুত্থাপন করিয়া কহিল, তুমি ত মনের ভাব আমার জান শৈলেশ, কিন্তু কেউ একজন বাড়িতে না থাকলে বাঁচা কঠিন। বিশেষ বুড়ো বয়সে—

উমা আজ উপস্থিত ছিল, সে বলিল, বুড়ো বয়সের এখনো ঢের দেরি, এবং তার ঢের আগেই বৌদি এসে হাজির হবেন। রাগ করে মানুষে আর কতকাল বাপের বাড়ি থাকে? এই বলিয়া সে একবার দাদার মুখের প্রতি ও একবার শৈলেশের মুখের প্রতি চাহিল, কিন্তু দুজনের কেহই জবাব দিল না। বিশেষতঃ শৈলেশের মুখ যেন সহসা মেঘাচ্ছন্ন হইয়া উঠিল। কিন্তু উমা চাহিয়াই আছে দেখিয়া সে কিছুক্ষণ পরে শুধু ঘাড় নাড়িয়া কহিল। না, তিনি আর আসবেন না।

উমা অত্যন্ত অবিশ্বাসে জোর করিয়া বলিল, আসবেন না? নিশ্চয় আসবেন। হয়ত এই মাসের মধ্যেই এসে পড়তে পারেন। হাঁ দাদা, পারেন না?

ফিরিয়া আসা যে কত কঠিন দাদা তাহা জানিতেন। যাইবার পূর্বে শৈলেশের মুখের প্রত্যেক কথাটি তাহার বুকে গাঁথা হইয়াছিল, ঊষা কোনদিন যে সে-সকল বিস্মৃত হইতে পারিবে, তিনি ভাবিতেও পারিতেন না। বধূর প্রতি শৈলেশের পিতা অপরিসীম অবিচার করিয়াছে, ফিরিয়া আসার পরে বিভা ঈর্ষাবশে বহুবিধ অপমান করিয়াছে এবং তাহার চূড়ান্ত করিয়াছে শৈলেশ নিজে তাহার যাবার দিনটিতে। তথাপি হিন্দু নারীর শিক্ষা ও সংস্কার, বিশেষ ঊষার মধুর চরিত্রের সহিত মিলাইয়া তাহার স্বামীগৃহ ত্যাগ করিয়া যাওয়াটা ক্ষেত্রমোহন কিছুতেই অনুমোদন করিতে পারিতেন না।

এই কথা মনে করিয়া তাঁহার যখনই কষ্ট হইত, তখনই এই বলিয়া তিনি আপনাকে আপনি সান্ত্বনা দিতেন যে, ঊষা নিজের প্রতি অনাদর অবহেলা সহিয়াছিল, কিন্তু স্বামী যখন তাহার ধর্মাচরণে ঘা দিল, সে আঘাত সে সহিল না। বোধ করি এইজন্যই বহুদিন পরে একদিন যখন তাহার স্বামীগৃহে ডাক পড়িল, তখন এতটুকু দ্বিধা, এতটুকু অভিমান করে নাই, নিঃশব্দে এবং নির্বিচারে ফিরিয়া আসিয়াছিল। হিন্দু রমণীর এই ধর্মাচরণ বস্তুটির সহিত সংস্কারমুক্ত ও আলোকপ্রাপ্ত ক্ষেত্রমোহনের বিশেষ পরিচয় ছিল না। এখন নিজের বাড়ির সঙ্গে তুলনা করিয়া আর-একজনের বিশ্বাসের দৃঢ়তা ও আপনাকে বঞ্চিত করিবার শক্তি দেখিয়া তাঁহার নিজেদের সমস্ত সমাজটাকেই যেন ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ মনে হইত। তিনি মনে মনে বলিতেন, এতখানি সত্যিকার তেজ ত আমাদের কোন মেয়ের মধ্যেই নাই। তাঁহার আশঙ্কা হইত, বুঝি এই সত্যকারের ধর্ম-বস্তুটাই তাহাদের মধ্য হইতে নির্বাসিত হইয়া গেছে। যে বিশ্বাস আপনাকে পীড়িত করিতে পিছাইয়া দাঁড়ায় না, শ্রদ্ধার গভীরতা যাহার দুঃখ ও ত্যাগের মধ্যে দিয়া আপনাকে যাচাই করিয়া লয়, এ বিশ্বাস কই বিভার? কই উমার? আরও সে ত অনেককেই জানে, কিন্তু কোথায় ইহার তুলনা? ইহারই অনুভূতি একদিকে সঙ্কোচ ও আর-একদিকে ভক্তিতে তাঁহার সমস্ত অন্তর যেন পরিপূর্ণ করিয়া দিতে থাকিত। কারণ, এই কয়টা দিনের মধ্যেই স্বামীকে যে ঊষা কতখানি ভালবাসিয়াছিল এ কথা ত তাঁহার অবিদিত ছিল না। আবার পরক্ষণেই যখন মনে হইত, সমস্ত ভাসিয়া গিয়া এত বড় কাণ্ড ঘটিল কিনা শুধু একজন মুসলমান ভৃত্য লইয়া—যে আচার সে পালন করে না, বাটীর মধ্যে তাহারই পুনঃ প্রচলন একেবারে তাহাকে বাড়ি ছাড়া করিয়া দিল। অপরে যাই কেন না করুক, কিন্তু বৌঠাকরুনকে স্মরণ করিয়া ইহারই সঙ্কীর্ণ তুচ্ছতায় এই লোকটি যেন একেবারে বিস্ময় ও ক্ষোভে অভিভূত হইয়া পড়িলেন।

উমা প্রশ্ন করিয়া মুখপানে চাহিয়াই ছিল, জবাব না পাইয়া আশ্চর্য হইয়া কহিল, হাঁ দাদা, বললে না?

কি রে?

উমা কহিল, বেশ! আমি বলছিলুম বৌদি হয়ত এই মাসেই ফিরে আসতে পারেন। তোমার মনে হয় না দাদা?

ভগিনীর প্রশ্নটাকে এড়াইয়া গিয়া ক্ষেত্রমোহন কহিলেন, যদি ধরাই যায় তিনি আসবেন না—বহুকাল তাঁর না এসেই কাটছিল, বাকীটাও না এসে কাটতে পারে, কিন্তু তাই বলে কি অন্য উপায় নেই? আমি সেই কথাই বলচি।

উমা ঠিক বুঝিল না, সে নিরুত্তরে চাহিয়া রহিল।

শৈলেশ তাহার বিস্মিত মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিল, তাঁর ফিরে আসা আমি সঙ্গত মনে করিনে উমা। তিনি আমার বিবাহিতা স্ত্রী, কিন্তু সহধর্মিণী তাঁকে আমি বলতে পারিনে।

ঊষার বিরুদ্ধে এই অভদ্র ইঙ্গিতে ক্ষেত্রমোহন মনে মনে বিরক্ত হইলেন। কহিলেন, ধর্মই নেই আমাদের, তা আবার সহধর্মিণী! ওসব উচ্চাঙ্গের আলোচনায় কাজ নেই ভাই, আমি সংসার চালাবার মত একটা ব্যবস্থার প্রস্তাব করচি।

শৈলেশ গভীর বিস্ময়ে কহিল, ধর্ম নেই আমাদের?

ক্ষেত্রমোহন বলিলেন, কোন্‌খানে আছে দেখাও? রোজগার করি, খাইদাই থাকি, ব্যস। আমাদের সহধর্মিণী না হলেও চলে। তখনকার লোকের ছিল শ্রাদ্ধ-শান্তি, পূজো-পাঠ, ব্রত-নিয়ম, ধর্ম নিয়েই তারা মেতে থাকত, তাদের ছিল সহধর্মিণীর প্রয়োজন। আমাদের অত বায়নাক্কা কিসের?

শৈলেশ মর্মাহত হইয়া কহিল, সহধর্মিণীর তাই? শ্রাদ্ধ-শান্তি, পূজো-পাঠ—

কথা তাহার শেষ হইল না, ক্ষেত্রমোহন বলিয়া উঠিলেন, তাই ভাই তাই, তা ছাড়া আর কিচ্ছু নয়। তুমিও হিঁদু, আমিও হিঁদু—without offence পুজোও করিনে, মন্দিরেও যাইনে, কেষ্ট-বিষ্টুকে ধরে খোঁচাখুঁচি করার কু-অভ্যাসও আমাদের নেই—মেয়েরা ত আরও harmless, আমরা সহজ মানুষ—লোক ভাল। কি হবে ভাই আমাদের অত বড় পাঁচ-সাতটা অক্ষরের সহধর্মিণী নিয়ে, ছোট্ট একটু স্ত্রী হলেই আমাদের খাসা চলে যাবে। তুমি ভাই দয়া করে একটু রাজী হও—ভবানীপুরের ওঁরা ভারী ধরেচেন—তোমার বোনটিরও ভয়ানক ইচ্ছে, কথাটা রাখ শৈলেশ।

শৈলেশ মুখ অন্ধকার করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, তুমি আমাকে বিদ্রূপ কোরচ, ক্ষেত্র!

ব্যাপার দেখিয়া উমা শশব্যস্ত হইয়া উঠিল। ক্ষেত্রমোহন ভীত হইয়া বার বার করিয়া বলিতে লাগিলেন, না ভাই শৈলেশ, না। যদি ও রকম কিছু করেও থাকি, তোমার চেয়ে আমাকেই আমি বেশি করেচি।

শৈলেশ প্রতিবাদ করিল না, কেবল, স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।