আমরা লক্ষ্মীছাড়ার দল
এস ভাই, পথের সাথী বন্ধুরা আমার, এস আমাদের লক্ষ্মীছাড়ার দল! আজ শনি এসেছে তোমাদের পোড়া-কপালে বাসি ছাই-এর পাণ্ডুর টিকা পরিয়ে দিতে। এস আমার লক্ষ্মীছাড়া গৃহহারা ভাইরা! আজ ঝর-ঝর বারিধারার সুরে সুরে কান্না উঠেছে–‘হায় গৃহহীন, হায় পথবাসী, হায় গতিহারা!’ এই ‘আকাশ-ভাঙা আকুল ধারার’ মাঝে নাঙ্গা শিরে আদুল গায়ে বেরিয়ে এস–বেরিয়ে এস আমার পথের সাথীরা। তোমাদের জন্য গৃহ নাই, তোমাদের জন্য দয়া নাই, করুণা নাই, এই দুর্দিনে তোমাদের ঘরে ডেকে নেবার কেউ নেই, তোমাদের ডাক দিয়েছে ঐ ঝড়-বাদলের উতল হাওয়া আর মাটির মায়ের সিক্ত কোল। তোমাদের জন্যে কোনো গৃহের বাতায়নে কালো চোখের করুণ কামনা ঝিলিক মারে না, তোমাদের অভাবে এ দুর্দিনে কারুর মন্দিরে শূন্যতার ধ্বনি বাজে না, তোমাদের অভাবে কারুর হৃদয় পীড়িত হয়ে ওঠে না। এস আমার অনাদৃত লাঞ্ছিত ভাইরা, আমরাই নতুন করে আমাদের জ্বালার জগৎ সৃষ্টি করব! শনি হবে আমাদের কপালে জয়টিকা, ‘ধূমকেতু’ হবে আমাদের রথ, মরুভূমি হবে আমাদের মাতৃক্রোড়, মৃত্যু হবে আমাদের বঁধু। এস–এস আমার লক্ষ্মীছাড়ার দল! ত্যক্ত শতমুখী আমাদের বিজয়কেতন, মড়ার মাথা আমাদের রক্তদেউল-দ্বারে মঙ্গল-ঘট, গরল আমাদের তৃষ্ণার জল, দাবানল-শিখা আমাদের মলয়বাতাস, নিদাঘ-আতপ আমাদের তৃপ্তি, জাহান্নাম আমাদের শান্তি-নিকেতন। এস আমার শনির শাপদৃপ্ত ভাইরা! আমরা জয়নাদ করব অমঙ্গল আর অভিশাপের। সদ্য পুত্রহীনা জননী আর স্বামীহারা সদ্য-বিধবার সৃষ্টি-কাঁপানো ক্রন্দন আমাদের মাধবী-উৎসবের গান, মৃত্যু-কাতর মুখের যন্ত্রণা আমাদের হাসি, আর ওই যে ঘরে ঘরে মায়ের মমতা, বোনের স্নেহ, প্রেয়সীর ভালোবাসা – ঐ আমাদের চোখের জল। ঐ যে গৃহীর শান্তি, তৃপ্তি, আনন্দ, ঐ আমাদের কান্না। ঐ তরুণ কালো চোখের দীপ্তি আমাদের শিকল, ঐ শূন্য হিয়ার ব্যথিত কামনা আমাদের কারাগার। ঐ শ্মশান-মশান-চারিণী চণ্ডী আমাদের বীণাবাদিনী। মহামারি, মারিভয়, ধ্বংস আমাদের উল্লাস। রক্ত আমাদের তিলক, রৌদ্র আমাদের করুণা। এরই মাঝে আমাদের নবসৃষ্টির অভিনব তপস্যা শুরু হবে। এস আমার রুদ্রতাপস তরুণের দল। সান্ধ্য-শ্মশান আর গোরস্থান আমাদের সান্ধ্য-সম্মিলনী, আলেয়া আমাদের সান্ধ্যপ্রদীপ, মড়া-কান্না আর পেচক-শিবাদি-রব আমাদের মঙ্গল হুলুধ্বনি। মরীচিকা আমাদের লক্ষ্য, আঘাত আমাদের আদর, মার আমাদের সোহাগ। সর্বনাশ আমাদের স্নেহ, বজ্র-মার আমাদের আলিঙ্গন। উল্কা আমাদের মালা-খসা ফুল, সাইক্লোন আমাদের প্রিয়ার এলোকেশ। সূর্যকুণ্ড আমাদের স্নানাগার, অনন্ত নরক আমাদের বিরাম-কুঞ্জ।
এই অমঙ্গল অভিশাপ আর শনির জ্বালানো রুদ্র-চুল্লির মধ্যে বসে তোমাদের নবসৃষ্টির সাধনা করতে হবে। তোমাদের এই রুদ্র তপস্যার প্রভাবে সকল নরকাগ্নি ফুল হয়ে ফুটে উঠবে, যেমন ‘ইব্রাহিমের’ পরশে ‘নমরুদের’ জাহান্নম ফুল হয়ে হেসে উঠেছিল। এস আমার অভিনব তরুণ তপস্বীর দল! তোমাদের ধ্বংসের নামে আহ্বান করছি। এস।