ভ্রমণ-নেশার মায়ার খেলা যুগ যুগ ধরেই মানুষের ভেতরে বাস করে এসেছে। পালামৌ গল্পে লেখক সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এমনই এক মায়ার বাঁধনে বাঁধা পড়ার অভিজ্ঞতা শুনিয়েছেন। যদিও এই ভ্রমণকাহিনী যতটা না কাহিনী, তার চেয়ে মানবিক উপাখ্যানের গল্প হিসেবেই ধরা দিবে পাঠকের হৃদয়ে।
পালামৌ সর্বপ্রথম ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় প্রমথনাথ বসু ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়। মোট ছয় কিস্তিতে প্রকাশিত এই লেখা পরবর্তীতে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়।
বইটি খানিকটা ভ্রমণকাহিনী, খানিকটা স্মৃতিচারণমূলক লেখা। সদ্য ঘটা ভ্রমণের না, অর্ধবিস্মৃত যৌবনের স্মৃতি বৃদ্ধবয়সের পরিণত চোখে আবার দেখে লেখা। এই বইয়ের সমালোচনা লেখার বড় সমস্যা হচ্ছে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন একবার। মোটামুটি বইটার মান সম্পর্কে ভালো ধারণা তার সমালোচনাতেই পাওয়া যাবে।
ছোট একটি বই পাঠকের জানাশোনার কয়েকটা জানলা একসাথে খুলে দিলো। লেখার ধরণে তিনি বঙ্কিমের চেয়ে অনেক স্বচ্ছল, রসবোধ এবং কবিত্বেও কমতি নেই। বইটা থেকে বেশকিছু জায়গা হয়ত উদ্ধৃতি দেওয়া যেত তবে তার মেধা ও প্রজ্ঞা এবং তার সাথে লেখার স্বচ্ছলতা বোঝাতে নীচে একটু উদ্ধৃতি দিলাম। এখানে ‘পট’-কে আমরা দৃশ্যকল্প বলতে পারি—
“কোন পটের বন্ধনী কী, তাহা নির্ণয় করা অতি কঠিন; যিনি তাহা করিতে পারেন, তিনিই কবি। তিনিই কেবল একটি কথা বলিয়া পটের সকল অংশ দেখাইতে পারেন, রূপ গন্ধ স্পর্শ সকল অনুভব করাইতে পারেন। অন্য সকলে অক্ষম, তাহারা শত কথা বলিয়াও পটের শতাংশ দেখাইতে পারে না।”
বন-জঙ্গল, পাহাড়, পশু-পাখি অপরূপ প্রকৃতির এমন বর্ণনা সত্যি মনোমুগ্ধকর, একদম প্রকৃতির কাছে নিয়ে যায়। কোন কিছুই বিস্তারিত বলেন নি কিন্তু ভালোলাগাটুকু দিয়েই পাঠকমনকে আকর্ষণ করতে পেরেছেন লেখক সঞ্জীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
কিছু কিছু জায়গার লেখকের প্রকৃতির বর্ণনা এবং সেটাকে জীবনের নানান কোণ থেকে মিলিয়ে দেখাতে পারা— রীতিমতো দুর্দান্ত! যেমন, এক জায়গায় রুক্ষ মৃত্তিকাশূন্য পাথরের ফাঁকে বেড়ে উঠা অশ্বত্থগাছ দেখে উনি লিখেছেন,—
“তখন মনে হইয়াছিল, অশ্বত্থবৃক্ষ বড় রসিক, এই নীরস পাষাণ হইতেও রস গ্রহণ করিতেছে। কিছু কাল পরে আর একদিন এই অশ্বত্থগাছ আমার মনে পড়িয়াছিল, তখন ভাবিয়াছিলাম বৃক্ষটি বড় শোষক, ইহার নিকট নীরস পাষাণেরও নিস্তার নাই। এখন বোধহয় অশ্বত্থগাছটি আপন অবস্থানুরূপ কার্য্য করিতেছে; সকল বৃক্ষই যে বাঙ্গালার রসপূর্ণ কোমল ভূমিতে জন্মগ্রহণ করিয়া বিনা কষ্টে কাল যাপন করিবে, এমত সম্ভব নহে। যাহার ভাগ্যে কঠিন পাষাণ, পাষাণই তাহার অবলম্বন।”
সাহিত্যরসিকদের মাঝে এই বইকে নিয়ে একধরনের মুগ্ধতার আঁচ টের পাওয়া যায়, বলা হয়ে থাকে, এটা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সফল ভ্রমণ কাহিনী।