মাথার নিচে হাত রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে বনহুর। পাশে বসে নুরী ওর মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ বনহুরের আংগুলে দৃষ্টি চলে যায় তার। আনন্দধ্বনি করে ওঠে নূরীহুর, ও আংটি তুমি কোথায় পেলে?

হাতখানা সরিয়ে নিয়ে বলেন বনহুর-উছ ওটা আংটি নয়।

তবে কী?

ওটা প্রীতির দান।

প্রীতির দান। কে দিয়েছে? কেন দিয়েছে?

নূরী, সব জানতে চেয়ো না।

আমাকে বলতে তোমার এত আপত্তি কেন হুর। বল ও আংটি তুমি কোথায় পেলে?

হেসে বলে বনহুর রাগ করবে না তো?

রাগ। মোটেই না! বল তুমি ঐ আংটি কার নিকট থেকে কেড়ে নিয়েছ?

কেড়ে নেইনি পরিয়ে দিয়েছে।

মিথ্যা কথা, দস্যু বনহুরের আংগুলে কেউ আংটি পরিয়ে দেবে এত বড় সাহস কার আছে। সত্যি করে বল এ আংটি কোথায় পেলে?

একটি মেয়ে আমাকে উপহার দিয়েছে। ঠাট্টা কর না হুর।

ঠাট্টা নয় নূরী। উঠে বসলো বনহুর। আংগুলের আংটিটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে।

নূরীর মুখমণ্ডল পরিবর্তন দেখা দেয়। গম্ভীর গলায় বলে—হুর কে সে। রানী যে তোমার আংগুলো আংটি পরিয়ে দিতে পারে?

বনহুর উঠে দাঁড়ায়—সব কথা বলা যায় না নুরী।

নূরী আর কোন প্রশ্ন করে না। ধীরে ধীরে উঠে নিজের কক্ষের দিকে চলে যায়। অভিমানে ভরে ওঠে তার মন…একথা কি সত্য? বনহুরকে অন্য কোন নারী আংটি পরিয়ে দিতে পারে? না না, সে সবই সইতে পারে কিন্তু নতুন একঠক করে বল, ঘাবড়ে গেলে সইতে পারিনি বনহুরকে অন্য কোন মেয়ে ভালবাসবে, এ সহ্য করতে পারবে না। বনহুর যে তার, ওকে ছাড়া নূরী কাউকে বুঝে না। সে জীবনে এ একটিমাত্র পুরুষকেই চিনে এসেছে। সে হচ্ছে তার জীবনের একমাত্র সাথী। আর ভাবতে পারে না নুরী। বনহুর মিথ্যে কথা বলেছে না-না কোন নারী দস্যু বনহুরকে ভালবাসতে পারে না। সবাই তার নামে আঁতকে ওঠে। হৃদকম্প শুরু হয় তাদের কিন্তু বনহুরকে যদি একবার কোন নারী স্বচক্ষে দেখে সে কিছুতেই ভালো না বেসে পারবে না। ওর মধ্যে এমন একটি আকর্ষণ আছে যার কাছে সবাই পরাজিত হবে। সত্য কি তবে ওকে কোন নারী….না না, তা হতে পারে না। বনহুর তার। তাকে কোন নারী তার কাঝ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না…ছুটে যায় নূরী বনহুরের কক্ষে।

বনহুর নতুন একড্রেসে সজ্জিত হচ্ছিল। নূরী ছুটে গিয়ে চেপে ধরে ওর জামার আস্তিন-বনহুর ঠিক করে বল, তুমি যা বললে তা সত্যি? হেসে ওঠে বনহুর-এরই মধ্যে এত ঘাবড়ে গেলে নূরী?

না না, আমাকে তুমি সত্যি করে বল? হুর, আমি সব সইতে পারি কিন্তু তোমাকে হারাতে পারি না… বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে নূরীর কষ্ঠ ঝর ঝর করে ঝরে পড়ে অশ্রুধারা।

বনহুর আংগুল দিয়ে নূরীর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে অয়ধা মন খারাপ কর না নূরী।

বনহুর, বল তুমি যা বললে, সব মিথ্যে?

নূরী, তুমি আমার ওপর বিশ্বাস হারিও না? আমার কাছে তোমার কোন অমর্যাদা হবে না।

বনহুরের বুকে মাথা রেখে বলে নূরী–হুর, তুমি আমার!

বনহুর নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন হয়তো তার মনে আর একটি মুখ ভেসে উঠেছে।

বনহুর নূরীকে লক্ষ্য করে বলেও নূরী, বল তাজকে প্রস্তুত করতে।

নূরী বেরিয়ে যায়।

একটু পরে ফিরে আসে—তাজ তৈরি আছে হুর।

বনহুর নূরীর রক্তিম গণ্ডে আংগুল দিয়ে মৃদু আঘাত করে হেসে বলে–চললাম নূরী।

নূরী শুধু ঘাড় কাৎ করে সম্মতি জানাল।

টানা বারান্দা বেয়ে এগিয়ে যায় বনহুর। তারপর দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বিকট আকার ব্যাঘ্র মূর্তির মুখগহ্বরে পা দিয়ে চাপ দেয়। সঙ্গে সঙ্গে একটা দরজা বেরিয়ে আসে তার সম্মুখে। বনহুর বাইরে বেরিয়ে আসতেই দুজন লোক তাজকে এনে হাজির করে বনহুর একলাফে চড়ে বসে তাজের পিঠে। তাজ উলকাবেগে ছুটতে শুরু করে।

বনের শেষ প্রান্তে গিয়ে তাজের পিঠ থেকে নেমে পড়ে বনহুর। তারপর তাজের পিঠে হাত বুলিয়ে বলে বাড়ি ফিরে যা তাজ।

এবার বনহুর কিছুটা এগিয়ে যায়।

ওপাশে রাস্তার উপরে একটি মোটরকার অপেক্ষা করছে। ড্রাইভার বনহুরকে দেখতে পেয়েই গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির দরজা খুলে ধরে।

বনহুর ড্রাইভ আসনে উঠে বসতেই ড্রাইভার তার পাশে বসে। বনহুর এবার গাড়িতে স্টার্ট দেয়।

অতি দক্ষতার সঙ্গে গাড়ি চালাচ্ছিল বনহুর। চোখে আজ তার এক নতুন উন্মাদনা।

ঘাটের অদূরে পাশাপাশি কয়েকখানা ছোট বড় নৌকা বাধা রয়েছে। ওদিকের একখানা বড় নৌকা বেশ পরিপাটি করে সাজানো, কয়েকজন মাঝি। বৈঠা হাতে বসে রয়েছে। একজন বলিষ্ঠ মাঝি দাঁড় ধরে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার মাথায় পাগড়ী দিয়ে তার মুখের খানিকটা অংশ ঢাকা। চোখেমুখে একটা শয়তানী ভাব উপচে পড়ছে। কিন্তু লোকটা পাগড়ী দিয়ে নিজের মুখটাকে এমনভাবে আড়াল করে রেখেছে, যাতে কেউ তার মুখ সহজে দেখতে না পায়। অন্যান্য মাঝির মাথাতেও এক একটা গামছা বাঁধা। কারও বা মাথায় একখণ্ড কাপড় জড়ানো, যেমন মাঝিদের হয়।

এই নৌকাখানাই মনিরাদের জন্য ভাড়া করা হয়েছে, দাড়ীর বেশে যে লোকটা পাগড়ীর আড়ালে মুখটা লুকাতে চেষ্টা করছে, তবে সে ব্যক্তি অন্য কেউ নয়—শয়তান নাথুরাম এবং অন্যান্য মাঝির বেশে তারাই অনুচরবর্গ।

অল্পক্ষণেই একদল বান্ধবীসহ মনিরার গাড়ি এসে দাঁড়ালো ঘাটের অদূরে। গাড়ি রেখে নেমে ছিল সবাই। চৌধুরী সাহেব এবং সরকার সাহেব উভয়ে এসেছেন তাদের সঙ্গে। সরকার সাহেব আংগুল দিয়ে বড় নৌকাখানা দেখিয়ে দিয়ে বলেন—চৌধুরী সাহেব, ঐ নৌকাখানা আমি মা মণিদের জন্য ভাড়া করেছি।

চৌধুরী সাহেব নৌকা দেখে খুশি হলেন হেসে বলেন—বেশ, বেশ সুন্দর নৌকাখানা তো! বেশ বড়সড়ও সরকার সাহেব। আপনি কিন্তু ওদের সঙ্গেই থাকবেন।

জি হ্যাঁ আমি মা-মনিদের সঙ্গেই যাচ্ছি। কথাটা বলেন বৃদ্ধ সরকার সাহেব।

মনিরা হাত উঠিয়ে ডাকে—এই মাঝি নৌকা নিয়ে এসো।

মাঝিগণ ব্যস্ত হয়ে নৌকা এগিয়ে আনতে লাগলো। নৌকাখানা খুব বড় হওয়ার একেবারে ঘাটের নিকটে পৌঁছল না, মাঝিরা একটা তক্তা ঘাট আর নৌকায় পেতে দিল।

মেয়েদের আনন্দ আর ধরে না। সবাই এক এক করে তক্তা খানার ওপর দিয়ে নৌকায় গিয়ে পৌঁছল। মনিরা কিন্তু খুব ভয় হচ্ছিল সে বারবার, তক্তাখানায় পা রেখে পা সরিয়ে নেয়। চৌধুরী সাহেব এবং বৃদ্ধ সরকার সাহেব মনিরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কেমন করে মনিরা নৌকায় যাবে? অন্যান্য মেয়েরা নৌকায় পৌঁছে হাসাহাসি শুরু করলো। মনিরার অবস্থা দেখে এ ওর গায়ে ঢলে পড়তে লাগলো। কেউ বলেন—মনিরা এত ভীতু। কেউ বলেন-আয় আমার হাত ধরে পার হয়ে আয় মনি। কেউ বলেন–মাঝিদের একজন পার করে নাও না।

মনিরা নিরুপায় হয়ে তাকাচ্ছে মামাজানের মুখের দিকে।

চৌধুরী সাহেব বলে উঠেন, ও মাঝি, ওকে হাত ধরে পার করে নাও, দেখ পড়ে না যায়।

একজন মাঝি এগিয়ে আসতেই অন্য একজন মাঝি তাকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই এগিয়ে এসে মনিরার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল।

মনিরা সঙ্কুচিতভাবে হাতখানা এগিয়ে দিল ওর দিকে। মাঝি মনিরার হাত চেপে ধরে নির্বিঘ্নে পার করে নিল। কিন্তু মনিরা নিজের হাতে কেমন যেন একটা মৃদু চাপ অনুভব করলো। মনে মনে ভীষণ রাগ হলো মনির। মাঝির হাত থেকে হাতখানা টেনে নিয়ে নৌকায় একপাশে গিয়ে দাঁড়ালো।

মেয়েরা মুখ টিপে হাসলো। একজন মনিরার কাছে মুখ নিয়ে বলেন, মাঝিটার তোর জন্য বড় দরদ।

যা, যত সব ইয়ে।

সরকার সাহেব নৌকায় উঠে বসতেই নৌকা ছেড়ে দিল মাঝিরা।

চৌধুরী সাহেব ঘাট থেকে হাত তুলে বলেন, বেশি রাত করো না মনিরা।

মনিরাও হাত নেড়ে বলল, বেশি রাত করবো না মামুজান, তুমি বাড়ি যাও।

নৌকায় বসে মেয়েদের সোক আনন্দ। কেউ বা গান গাইতে শুরু করলো, কেউ বা হাসি আর গল্পে মেতে রইল। কেউ বা মাঝিদের হাত থেকে বৈঠা নিয়ে পানি টানতে শুরু করলো।

মনিরা কিন্তু গম্ভীর হয়ে রয়েছে। কারণ মাঝিটার আচরণ এখনও তার মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কি অসভ্য ঐ মাঝিটা, একটা ছোটলোকের বাচ্চা। কেউ যে ওর হাতে হাত রাখে তাই ভাগ্য। সে কিনা তার হাতে চাপ দিল! ছিঃ বড় লজ্জার কথা, মনিরা সকলের অলক্ষ্যে একবার মাঝিটার দিকে বিষনজরে তাকায়, মাঝিটা যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি বিনিময় হতেই মনিরা রাগে অধর দংশন করলো এবং তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল সে।

হাসলো মাঝিটা। দাঁড়ের ছপ ছপ শব্দের সঙ্গে তার মুখ থেকে একটি শব্দ বেরিয়ে মিলিয়ে গেল শুনা গেল না কিছু।

সাথীরা ধরে ফেললো তাকে একটা গান শুনাতে হবে। মনিরা কিছুতেই গাইবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে গাইতেই হলো।

বান্ধবীদের জেদে তার কোন আপত্তিই টিকলো না। মনিরার গানের সুর আর দাঁড়ের ঝুপঝাপ শব্দ মিলে এক মোহময় পরিবেশের সৃষ্টি হলো। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ, ঢেউয়ের বুকে দোল খেয়ে যেন এগিয়ে চলেছে।

গোটা নৌকায় বিরাজ করছে এক অপরিসীম আনন্দ। বৃদ্ধ সরকার সাহেবও মেয়েদের সঙ্গে আনন্দে মাতোয়ারা। মনিরার গানের সুরের তালে তালে মাথা দোলাচ্ছেন তিনি।

হাসি গল্প আর আনন্দের মধ্যে নৌকাখানা যে অনেক দূরে এসে পড়েছে। সেদিকে খেয়াল নেই কারো।

আকাশে পূর্ণচন্দ্র। সমত ঝিনাইদা নদীটা যেন আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে। উঠেছে। যেদিকে তাকানো যায় শুধু আলোর বন্যা।

মনিরা বলে ওঠে-সরকার চাচা এবার নৌকা ফেরাতে বলুন। সরকার সাহেবও বলে উঠলেন—তাইতো, অনেক দূরে এসে পড়েছি আমরা। মাঝি এবার তোমার নৌকা ফেরাও।

মাঝিরা হঠাৎ কেমন যেন ব্যস্ত হয়ে ছিল। নৌকাখানা যেমন চলছিল তেমনি এগুতে লাগলো বরং গতি আরও বেড়ে গেছে। মনিরা বলে ওঠে, মাঝি নৌকা ফেরাও।

কিন্তু কই তারা যেমন দাঁড় টানছিল, তেমনি নির্বিকারভাবে কাজ করে চলেছে। নৌকা ফেরাবার কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।

অদূরে দেখা গেল ঝিনাইদার বাঁক। সবাই লক্ষ্য করলো বাকের মুখে একখানা বজরা বাধা রয়েছে। বজরায় কোন আলো নেই।

জ্যোস্নার আলোতে বজরাখানাকে একটি ভাসমান কুটিরের মত মনে হলো।

এমন সময় নৌকার পেছনে শুনা গেল চাপা একটি কণ্ঠস্বর সব মনে, আছে তো?

অপর একটি চাপাক—আছে হুজুর।

পূর্বের কণ্ঠ মেয়েটিকে ঠিকভাবে চিনে রেখেছিস?

হ্যাঁ, হুজর….।

দাঁড়ের শব্দে কথার আওয়াজগুলো মেয়েদের বা সরকার সাহেবের কানে যায় না।

হঠাৎ দেখা যায় বজরার দিক থেকে একখানা ছিপনৌকা তর তর করে এদিকে এগিয়ে আসছে।

মাঝিদের ভাবসাব লক্ষ্য করে মেয়েরা আশঙ্কিত হয়ে পড়ে। বৃদ্ধ সরকার সাহেব বারবার বলতে থাকে মাঝি, নৌকা ফেরাও মাঝি নৌকা ফেরাও–

কিন্তু মাঝিরা সে কথা কানেও নেয় না।

মেয়েরা ভয়ার্তস্বরে এটা সো বলারলি শুরু করলো। কেউ বা কেঁদেই ফেললো।

সরকার বলেন-মাঝি, তোমরা জানো না এ নৌকায় কার ভাগনী আছে? শিগগির নৌকা ফেরাও।

ঠিক সে মুহূর্তে দাড়ী-মাঝি সরকার সাহেবের বুকের কাছে রিভলভার চেপে ধরে গর্জে ওঠে——জানি এবং তার জন্যই আমরা নৌকা বেয়ে এতদূর এসেছি। যদি প্রাণে বাঁচতে চাও, তবে সবাই চুপ করে থাক। চৌধুরী সাহেবের ভাগনী মনিরাকে আমাদের চাই।

ভীষণভাবে শিউরে উঠলো মনিরা। এবার সে বুঝতে পারলো মাঝিদের মনোভাব। কিন্তু মুখে ভয়ের ভাব না এনে বলেন—খুবতো আস্পর্ধা তোমাদের দেখছি। মনিরাকে নেওয়া যত সহজ মনে করছে তত সহজ নয়। শিগগির নৌকা ফেরাও, নচেৎ আমরা সবাই মিলে চিৎকার করবো!

শয়তান নাথুরাম হেসে ওঠে হাঃ হাঃ হাঃ চিৎকার করবে? এই নির্জন নদীবক্ষে কে শুনবে তোমাদের কণ্ঠস্বর?

অন্য মেয়েরা সবাই পাথরের মূর্তির মত স্তব্ধ হয়ে গেছে। কারও মুখে কথা নেই। মনে-প্রাণে সবাই খোদাকে স্মরণ করতে থাকে। ভয়ে সকলের মুখ বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে।

সরকার সাহেব বৃদ্ধ, তবু হার মানলেন না, চিৎকার করে বলেন–শয়তান, তোমাদের চক্রান্ত আগে বুঝতে পারলে তোমাদেরকে পুলিশে ধরিয়ে দিতাম।

হুঙ্কার ছাড়ে নাথুরাম—তা যখন পারনি তখন বুড়ো বয়সে পৈতি জানটা নষ্ট কর না। সুবোধ বালকের মত নিশ্চপ বসে থাক।

নিরস্ত্র সরকার সাহেব শুধু চিৎকার করে শাসাতে লাগলেন, তাছাড়া আর কিইবা করবেন তিনি! এতগুলো দস্যুর সঙ্গে পেরে ওঠা তার পক্ষে মুশকিল।

মেয়েদের মধ্যে একটা হুলস্থুল শুরু হয়েছে। কেউ কাঁদছে, কেউ-বা চিল্কার করছে। কেউ বা বলছে—এটা দস্যু বনহুরের নৌকা। সে মনিরাকে

চুরি করার জন্য এই ফন্দি এটেছে।

মেয়েরা তো বনহুরের নামে কাপতে শুরু করলো! সেকি ভীষণ অবস্থা।

ছিপ নৌকাখানা একেবারে নিকটে পৌঁছে গেছে।

দু’জন বলিষ্ঠ লোক মনিরাকে জাপটে ধরলো। বাধা দিতে গেল সরকার সাহেব, সঙ্গে সঙ্গে একটা বলিষ্ঠ লোক তার নাকে ঘুষি বসিয়ে দিল। সরকার সাহেব ঘুরপাক খেয়ে পড়ে গেল নৌকায়।

লোক দু’জন মনিরাকে শূন্যে উঠিয়ে নিল, তারপর লাফিয়ে ছিল ছিপ নৌকাখানায়। সঙ্গে সঙ্গে অন্য মাঝিগণও ছিপ নৌকায় লাফিয়ে পড়তে লাগলো।

ওদিকে মনিরার বান্ধবীগণ ভীষণ আর্তনাদ শুরু করে দিয়েছে। বাঁচাও! বাঁচাও! দস্যু বনহুর আমাদের সর্বনাশ করলো, আমাদের মেরে ফেললো। বাঁচাও বাঁচাও…..

মনিরাকে ছিপ নৌকায় উঠিয়ে নিয়ে দ্রুত এগিয়ে চললো দস্যুগণ বজরাখানার দিকে। মনিরাও তীব্রকণ্ঠে চিৎকার করছে—বাঁচাও বাঁচাও…

মাঝি-বেশি শয়তানের অনুচরের দল ছিপ নৌকায় দাঁড় টেনে চলেছে। ওদিকে মনিরার বান্ধবীও আহত সরকার সাহেবকে নিয়ে বড় নৌকাখানা আপন মনে এদিকে ভেসে চললো।

ছিপ নৌকাখানা প্রায় বজরার নিকটবর্তী হয়েছে, এমন সময় সে মাঝি। যে মনিরাকে তক্তা পার করে নিতে গিয়ে তার হাতে মৃদু চাপ দিয়েছিল, সে হাতের বৈঠা নিয়ে প্রচণ্ডভাবে আক্রমণ করে। অন্য মাঝিদের ছিপ নৌকাখানা ভীষণ একটা ঘুরপাক খেয়ে গেল।

আচমকা এই বিপদের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না শয়তান নাথুরাম, সে রিভলভার উদ্যত করে গর্জে উঠলো কে তুই?

মনিরা জ্যোস্নার আলোতে লক্ষ্য করলো, এ সে মাঝি কিছু পূর্বেও যে মাঝিকে সে মনে মনে অভিসম্পাত করছিল। এক্ষণে মনিরার হৃদয় কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে, কে এ মাঝি যার প্রাণে এত দয়া? নিশ্চয়ই তাকে বাঁচানোর জন্যেই মাঝিটির এত প্রচেষ্টা।

নাথুরাম মাঝিটার বক্ষ লক্ষ্য করে রিভলভার উদ্যত করে ধরতেই মাঝিটা চট করে সরে দাঁড়ালো, নাথুরামের রিভলভার নিস্তব্ধ নদীবক্ষে গর্জে উঠলো—শুড়ম।

মাঝিটা নাথুরামকে পুনরায় রিভলভার উদ্যত করতে না দিয়ে ভীষণভবে আক্রমণ করলো। নাথুরাম টাল সামলাতে না পেরে ছিপ নৌকাখানার মধ্যে পড়ে গেল। মাঝি তার হাত থেকে রিভলভারটা কেড়ে নিয়ে ফেলে দিল নদীবক্ষে।

ততক্ষণে অন্য শয়তানগুলো আক্রমণ করে মাঝিটাকে। চলে ভীষণ ধস্তাধস্তি।

ছোট্ট ছিপ নৌকাখানার উপরে সেকি তুমুল অবস্থা। ভয়ে মনিরার অবস্থা মরিয়া হয়ে উঠলো। এভাবে নৌকা ভ্রমণের জন্য নিজকে ধিক্কার দিতে লাগলো!

সামান্য একটি ছিপ নৌকা এভাবে কতক্ষণ টিকতে পারে। বিশাল নদীবক্ষে ছিপ নৌকাখানা মোচার খোলার মত দুলতে লাগলো। মনিরা ভয়কম্পিত বক্ষে দেখছে এই বুঝি ছিপ নৌকাখানা ডুবে যায়। মনে প্রাণে সে মাঝিটার কামনা করছে। কি আশ্চর্য ওর সঙ্গে এতগুলো শয়তান পেরে উঠছে না। মাঝিটা এক একটা প্রচণ্ড ঘুষিতে নাথুরামের অনুচরগণকে নদীবক্ষে নিক্ষেপ করতে লাগলো। কিন্তু নাথুরাম হটার বান্দা নয়, সে প্রাণপণে মাঝিটাকে কাবু করার চেষ্টা করতে লাগলো।

হঠাৎ ছিপ নৌকাখানা একপাশে কাৎ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তলিয়ে গেল নদীবক্ষে।

কোথায় গেল মনিরা কোথায় বা নাথুরাম আর শয়তান মাঝিদের দল। . যে যেদিকে পারলে সাঁতার কেটে প্রাণ বাঁচাতে চেষ্টা করলো।

মনিরা তলিয়ে যাচ্ছে। সে সাঁতার কাটতে পারে না। বাঁচার কোন উপায় নেই তার। ঢক ঢক করে কিছুটা পানি খেয়ে ফেললো সে। এই ছিল তার অদৃষ্টে। হায় কেন সে আজ নৌকা ভ্রমণে বেরিয়েছিল। মৃত্যকালে একবার মনে ছিল মনিরের কথা। আর ওর মুখখানা দেখতে পেল না মনিরা। তবু বাঁচার জন্য মনিরা হাত-পা ছুঁড়ে আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলো।

হঠাৎ মনিরা অনুভব করলো কেউ যেন তাকে ধরে ফেলেছে। মনিরা তখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। একটা একটা খড়-কুটোও তখন তার কাছে অতি বড় সম্পদ। সে কিছু না ভেবে আঁকড়ে ধরলো শত্রু কিংবা মিত্র ভাবার সময় তখন তার নেই।

মনিরা যখন চোখ মেলে তাকালো তখন একটা উজ্জ্বল আলো তার সামনে ছড়িয়ে ছিল। উঠে বসতে গেল অমনি একটা বলিষ্ঠ বাহ তাকে শুইয়ে দিল।

মনিরা চমকে ফিরে তাকালো সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ আপত কণ্ঠে অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো-মনির।

হাসলো বনহুর, কোন জবাব দিল না।

মনিরা আনন্দের আবেগে বনহুরের গলা জড়িয়ে ধরলো। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে—তুমি! এ যে আমি কল্পনাও করতে পারিনি। মনির, কি করে আমি তোমার পাশে এলাম। বল, বল মনির?

হেসে বলেন বনহুর—সে মাঝি তোমাকে আমার নিকটে পৌঁছে দিয়েছে, যে নাবিককে তুমি মনে মনে অভিসম্পাত করেছিলে।

মনিরার চোখে একরাশ বিস্ময় ঝরে পড়ে, অবাক হয়ে বলে–মনির তুমি কি করে জানলে আমি সে মাঝিকে গালমন্দ দিয়েছিলাম সে মাঝিই বলেছে।

মনিরা আরও অবাক হয়ে বলে–সে কি করে আমার মনের কথা বলবে? জান মনির, সত্যি আমি তাকে অসভ্য বলে মনে মনে গালমন্দ দিয়েছিলাম। কিন্তু সে না হলে হায় কি যে হত। শয়তান দস্যু দল আমাকে হত্যা করতো।

গম্ভীর কণ্ঠে বলে বনহুর হত্যা করতো না একথা সত্য তোমাকে তারা . হরণ করে এক শয়তানের হাতে সমর্পণ করতো–

উঃ কি সর্বনেশে কথা! মনির, সে মাঝি তোমার কে?

কি তার পরিচয়?

সে আমার বন্ধু।

বন্ধু? মনির আমার হয়ে তুমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে দিও। বেচারা আমাকে কত কষ্ট করে বাঁচিয়েছে।

নাহলে তুমি এখন শয়তান মুরাদের হাতে গিয়ে…

অস্ফুট ধ্বনি করে ওঠে মনিরা–মুরাদ।

হ্যাঁ, সে মুরাদ তোমাকে হস্তগত করার জন্য অবিরত ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। শুধু তাই নয়, হাজার হাজার টাকা সে পানির মত খরচ করেছে।

দাঁতে দাঁত পিষে বলে মনিরা—পাষণ্ড শয়তান….মনির, তোমার মাঝি বন্ধু কত মহৎ।

হ্যাঁ মনিরা, গরীব বলে কখনও কাউকে তুচ্ছজ্ঞান করা উচিত নয়, বা অবহেলা করা ঠিক নয়। তাই বলে সবাইকে বিশ্বাস করাও ঠিক নয়।

মনিরা বনহুরের জামার বোতাম নিয়ে নড়াচড়া করতে করতে বলে–আমি কি জানতাম ওটা ডাকাতের নৌকা। ভাগ্যিস মাঝিটা ছিল, সত্যি তার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। এক্ষণি তাকে যদি পেতাম…

কি করতে?

হাত ধরে মাফ চেয়ে নিতাম।

বনহুর মনিরার হাতের কাছে হাতখানা বাড়িয়ে দেয়—সে মাঝি তোমার সামনে উপস্থিত মনিরা নাও মাফ চেয়ে নাও।

মনিরার চোখে বিস্ময়, মুখে ফুটে ওঠে স্মিত হাসির রেখা, বলে ওঠে সে—তাই বল। হ্যাঁ, এবার বুঝেছি সব। তাই তো বলি, কোন সে মাঝি যার এত বীরত্ব।

কই মাফ চেয়ে নিলে না আমার কাছে।

মনিরা বনহুরের বুকে মাথা রেখে চিবুকে মৃদু টোকা দিয়ে বলে–তুমিই এবার আমার নিকটে মাফ চেয়ে নাও। কারণ, একটি যুবতীর হাতে চাপ দেওয়া কম দোষণীয় নয়।

বনহুর আর মনিরা মিলে হাসতে থাকে। বনহুর বলেন—মনিরা, এখানে বেশিক্ষণ থাকা তোমার পক্ষে ঠিক নয়। বল এবার তোমাকে কিভাবে পৌঁছে দেওয়া যায়?

মনিরা চারদিকে তাকিয়ে বলে—এখন আমি কোথায় মনির?

বনহুর সোজা হয়ে বসে বলে—তুমি এখন আমার গুপ্তকক্ষে বন্দী রয়েছ।

কি বললে এটা তোমার গুপ্তকক্ষ?

হ্যাঁ, গভীর মাটির তলায় রয়েছ এখন তুমি।

এ তুমি কি বলছ!

কেন, ভয় হচ্ছে নাকি?

না।

জান মনিরা, এখানে যদি তোমাকে চিরদিন আটকে রাখি কেউ তোমার সন্ধান পাবে না। এখানে শুধু তুমি আর আমি। মনির, তোমার জন্য আমি সব ত্যাগ করতে পারবো।

বনহুর অন্যমনস্ক হয়ে যায়, কি যেন চিন্তা করতে থাকে।

মনিরা বলে—কি ভাবছো!

জবাব দেয় বনহুর—ভাবছি, তোমার মামাজান-মামীমার কথা। তারা এতক্ষণে হয়তো কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছেন।

কি বললে, আমার মামুজান আর মামীমা? তোমার কেউ নন তারা? বলেন, আব্বা আর আম্মা।

সত্য মনিরা, আব্বা আর আম্মা খুব বুঝি ভাবছেন তোমার জন্য। একদিন ঐ ঝিনাইদার বুকে হারিয়েছিল তাঁর প্রিয় পুত্র মনিরকে। আর আজ সে ঝিনাইদা হরণ করলো তাদের একমাত্র কন্যা সমতুল্যা ভাগ্নী মনিরাকে

না, আর বিলম্ব করা উচিৎ হবে না মনিরা, চলো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। বনহুর উঠে দাঁড়ালো।

মনিরাও উঠতে গেল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বসে ছিল সে।

বনহুর পুনরায় পাশে বসে বলল—এখনও অসুস্থ বোধ করছো মনিরা?

হ্যাঁ, মাথাটা এখনও ঝিম ঝিম করছে।

তবে চুপ করে কিছুক্ষণ শুয়ে থাক। আমি এক্ষুণি আসছি।

কোথায় যাবে মনির?

বিশেষ একটা দরকার আছে।

যাও! মনিরা, বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।

বনহুর বেরিয়ে যায়।

বনহুর বেরিয়ে যেতেই মনিরা উঠে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে ঘুরেফিরে দেখতে লাগলো সব। যে কক্ষে সে শুয়েছিল সেটা একটা মাঝারি রকমের ঘর। কক্ষের দেয়াল কঠিন পাথর দিয়ে তৈরি। কোন আড়ম্বর নেই সে। কক্ষে। মেঝের এক পাশে পাথর দিয়ে তৈরি একটা খাট। খাটে দুগ্ধ ফেননিভ কোমল বিছানা, যে বিছানায় সে এতক্ষণ শুয়েছিল। মনিরা বুঝতে পারল ঐ বিছানা দস্যু বনহুরের। কক্ষের একপাশে একটা পাথরের টেবিল। ‘ টেবিলে ছোটবড় কয়েকখানা রিভলবার। ওপাশের দেয়ালে ঠেস দেওয়া রয়েছে বড় বড় ভারী গোছের দুটো রাইফেল। আর একটা টেবিলে কতকগুলো সুতীক্ষ্ণধার হোরা, অবশ্য সেগুলো সব খাপের মধ্যে আটকানো। মনিরা ধীরে ধীরে সে অস্ত্রগুলোর ওপর হাত বুলিয়ে নিল। এগুলো বনহুরের ব্যবহার্য অস্ত্র। সবগুলোতে যেন তার হাতের স্পর্শ লেগে রয়েছে।

মনিরা এগুতে লাগলো, দেখতে পেল সামনে একটি দরজা তার ওপাশেই একটা সিড়ির মত আরও নিচে নেমে গেছে। মনিরা এক পা দু’পা করে এগুতে লাগলো। সিড়ির মুখে গিয়ে অবাক হলো সে, নিচে ঠিক তার পায়ের তলায় একটা হলঘরের মত প্রকাণ্ড একটা ঘর। ঘরের মধ্যে উজ্জল আলো জ্বলছে। মনিরা অবাক হয়ে দেখলো বনহুর একটি উচ্চ আসনে বসে আছে। তার সামনে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে কতকগুলো বলিষ্ঠ লোক, প্রত্যেকের হাতেই এক একটা রাইফেল। মাথায় পাগড়ী কানে বালা, হাতে বালা, গায়ে ফতুয়ার মত আটসাট জামা।

মনিরা স্তব্ধ হয়ে দেখছে লোকগুলো বনহুরের কোন আদেশের প্রতীক্ষা করছে।

কি যেন বলেন বনহুর স্পষ্ট বুঝা গেল না, ভীষণকায় লোকগুলো কুর্নিশ জানিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো, তারপর সারিবদ্ধভাবে অন্ধকার অদৃশ্য হয়ে গেল।

লোকগুলোর চেহারা দেখে মনিরার কণ্ঠনালী শুকিয়ে গিয়েছিল। ঠিক যেন একদল রাক্ষসের মধ্যে বনহুর একটি দেবমূর্তি। আশ্চর্য হলো মনিরা, এত ভয়ঙ্কর লোকগুলো বনহুরকে সিংহের মত ভয় করে।

মনিরা এই কথা ভাবছে হঠাৎ শুনতে পেল সিঁড়িতে ভারী বুটের শব্দ।

সম্বিৎ ফিরে এলো মনিরার, সে দ্রুত নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে ছিল।

বনহুর কক্ষে প্রবেশ করে মনিরার পাশে গিয়ে বসলো। মনিরা নির্বাক নয়নে তাকিয়ে রইলো বনহুরের মুখের দিকে এই সে দস্যু বনহুর যার ভয়ে গোটা দেশ প্রকম্পমান। যার নাম স্মরণ করে সবাই আতঙ্কে শিউরে ওঠে। পুলিশমহল যাকে গ্রেপ্তারের জন্য লাখ টাকা ঘোষণা করেছে সেই দস্যু বনহুর তার পাশে। তার অতি প্রিয়জন।

বনহুর হেসে বলল অমন করে কি দেখছো মনিরা?

তোমার আসল রূপ।

কেমন দেখছো?

অনেক সুন্দর-মনির, সত্যি তুমি আমাকে ভালবাস?

হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন মনিরা?

বল আমার মন শুনতে চাচ্ছে।

বাসি। মনিরা… অস্ফুট শব্দ করে বনহুরের বুকে মাথা রাখে মনিরা।

চলো মনিরা, এবার তোমাকে রেখে আসি।

যদি না যাই তোমার খুব অসুবিধা হবে, না।

আমার নয়, তোমার হবে।

কেন? কি করে আমার অসুবিধা হবে?

মনিরা, তুমি শিশু নও। তোমার নিরুদ্দেশ লোকনিন্দার কারণ হবে। আব্বা আম্মা তোমার জন্য লোকের কাছে মুখ দেখাতে পারবেন না। বল তো তখন তাদের কত কষ্ট হবে?

মনিরা উঠে দাঁড়ায়, তারপর বনহুরের হাত ধরে বলে–চলো।

চলতে চলতে কথা হয় দুজনের মধ্যে। মনিরা বলে—তুমি না আমার গা ছুঁয়ে শপথ করেছিলে আর দস্যুতা করবে না। পারলাম না আমার কথা রাখতে মনিরা। শয়তান নাথুরাম ভয়ঙ্কর শয়তানী শুরু করেছে।

নাথুরাম—সে আবার কে?

মাঝির ছদ্মবেশে যে তোমাকে হরণ করতে যাচ্ছিলো।

শয়তান নাথুরাম!

হ্যাঁ, সে শুধু শয়তান নয় মনিরা, সে নরপিশাচ। দেখে নিতে চাই শয়তান নাথুরামের কত বাহাদুরি! আজই খবর পেলাম জম্বুরা পর্বতের এক গুহায় তার গোপন আস্তানা রয়েছে। সেখানে নাথুরামের একটি কালি মন্দিরও আছে। মন্দিরে প্রতি অমাবস্যায় একটি কুমারী কন্যাকে বলি দেওয়া হয়।

মনিরা আর্তনাদ করে ওঠে—উঃ কি ভীষণ কাণ্ড!

শুধু তাই নয় মনিরা, সে আরও অনেক কিছু দুষ্কর্মের সঙ্গে লিপ্ত আছে। আমি ওকে দেখে নেব।

বনহুরের মনোভাব আবছা অন্ধকারে দেখতে পেল না মনিরা। কিন্তু অনুভব করলো সে মনিরার হাতের মধ্যে বনহুরের বলিষ্ট হাতখানা মুষ্টিবদ্ধ হয়ে উঠেছে।

তারপর কিছুদূর নীরবে এগুলো তারা।

এবার এক সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রবেশ করলো মনিরা আর বনহুর। বেশ অন্ধকার সুড়ঙ্গপথ। বনহুর মনিরাকে এঁটে ধরলো-মনিরা, সাবধানে আমার হাত ধরে চলবে। পা ফসকে গেলেই মৃত্যু।

মনিরা বনহুরের হাত এটে ধরে চলতে লাগলো।

চলতে চলতে হেসে বলল বনহুর-মাঝি বেচারা তোমার হাতে মৃদু চাপ দিয়েছিল বলে সে তোমার অসংখ্য অভিসম্পাত কুড়িয়েছে, আর এখন…

যাও ঠাট্টা রাখ। মনিরা বনহুরের হাতে হাত রেখে পায়ের দিকে তাকালো, সঙ্গে সঙ্গে বনহুরকে জাপটে ধরলো সে। সুড়ঙ্গ পথের আবছা অন্ধকারে দেখতে পেল, সরু একটা পথ, তার নিচেই হাত দেড়েক দূরে গভীর খাদ। শিউরে উঠলো মনিরা। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল—আমি কিন্তু কিছু দেখতে পাচ্ছি না মনির, আমাকে তুমি নিয়ে চলো।

বনহুর হেসে বলেন—বেশ, তুমি চোখ বন্ধ করো, ওয়ান, টু, থ্রীবনহুর মনিরাকে ছোট বালিকার মত দু’হাতের উপর উঠিয়ে নিল। এবার দ্রুত চলতে লাগলো সে। মনিরা দুহাতে নিজের চোখ ঢেকে চুপ করে রইলো।

সুড়ঙ্গের বাইরে এসে মনিরাকে নামিয়ে দিয়ে বলল বনহুর, চোখ যেন খুলে না, পড়ে যাবে।

মনিরা বুঝতে পারলো, এখন সে বেশ প্রশস্ত জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। চোখ মেলে আনন্দসূচক শব্দ করে উঠলো-ইস, কি সুন্দর আলো-বাতাস।

একটা মুক্ত প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছে বনহুর আর মনিরা। একি, দিন যে। তবে যে ওখানে অত আলো জ্বলছিল! বুঝতে পারলো মনিরা ওটা মটির নিচে তাই আলোর ব্যবস্থা।

মনিরা সামনে তাকাতে দেখতে পেল অদূরে একটি জমকালো অস্ত্র নিয়ে। দটি লোক দাঁড়িয়ে আছে।

বনহুর লোক দুটিকে ইংগিত করতেই অশ্ব নিয়ে এগিয়ে এলো। বনহুর এবার মনিরাকে অশ্বে উঠিয়ে নিয়ে নিজেও চড়ে বসলো। হেসে বল-এর নাম কি জান?

না।

এর নাম তাজ।

বহুদিন নিশীথ রাতে অশ্বখুরধ্বনি কর্ণগোচর হয়েছে। আজ স্বচক্ষে দেখলাম এবং তার পৃষ্ঠে আরোহণ করার সৌভাগ্য লাভ করলাম। সত্যি আজ আমি গর্বিত।

তাজ এবার উল্কা বেগে ছুটতে শুরু করলো। বনহুর মনিরাকে বা হাতে এঁটে ধরে দক্ষিণ হাতে লাগাম চেপে ধরলো।

তাজের পিঠ থেকে নেমে দাঁড়ালো বনহুর। তারপর মনিরাকে নামিয়ে বলেন—এবার কিছুটা হাঁটতে হবে, পারবে?

পারবো।

কিন্তু আমি আর যাচ্ছিনে তোমার সঙ্গে ঐ যে গাড়িখানা পথের ওপরে দেখছো ওটা আমার গাড়ি। ড্রাইভার তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেবে!

মনিরা।

বল?

আবার কখন তোমার দেখা পাব?

যখন তোমার মন আমাকে ডাকবে, দেখবে ঠিক আমি তোমার পাশে পৌঁছে গেছি। আচ্ছা এবার যাও, আল্লাহ হাফেজ।

মনিরা এগুতে লাগলো, আর বারবার ফিরে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। বনহুর তাজের লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

মনিরা গাড়িখানায় পাশে পৌঁছতেই ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুলে ধরলো। মনিরা আর একবার ঘুরে বনহুর আর তাজের দিকে ফিরে তাকিয়ে গাড়িতে চড়ে বসলো।

গাড়ি বারান্দায় পৌঁছতেই মনিরা নেমে ছুটে গেল অন্দর বাড়িতে। দেখতে পেল তার সমস্ত বান্ধবী, যারা নৌকায় ছিল সবাই চৌধুরী সাহেব আর মরিয়ম বেগমকে গত রাতের ঘটনাটা বুঝাতে চেষ্টা করেছে। বৃদ্ধ সরকার সাহেবের মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা, গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। সকলের মুখমণ্ডল বিষণ্ণ, মলিন।

চৌধুরী সাহেব আর মরিয়ম বেগমের চোখে অশ্রু, তারা অবিরত কাঁদছেন।

মনিরাকে দেখতে পেয়েই বান্ধবীরা আনন্দধ্বনি করে উঠলো। চৌধুরী সাহেব চোখের পানি মুছে এগিয়ে আসেন কোথায় গিয়েছিলে মা, কি করে ফিরে এলি? ডাকাতরা নাকি তোকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল?

মেয়েরা একসঙ্গে বলে ওঠে—দস্যু বনহুর ছাড়া কেউ নয়। তারই ঐ কাজ, কিন্তু কি করে ফিরে এলি ভাই?

চৌধুরী সাহেব বলেন—একটু সুস্থ হউক, সব শুনছি।

মনিরাকে পেয়ে মরিয়ম বেগম আনন্দে অধীর হলেন। তাড়াতাড়ি গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন—ভাল ছিলে তো, মা?

হ্যাঁ মামীমা। ভাগ্যিস এক ভদ্রলোক আমাকে ডাকাতের নৌকা থেকে বাঁচিয়ে নিয়েছিল, তাই রক্ষা। খুব ভদ্র মহৎ ব্যক্তি তিনি। খোদর অপরিসীম দয়ায় আর তার কৃপায় এ যাত্রা পরিত্রাণ পেয়েছি।

সব শুনে আশ্বস্ত হলেন চৌধুরী সাহেব। বান্ধবীরা মনিরাকে নিয়ে আনন্দে মেতে উঠলো। মরিয়ম বেগম বলেন—তোমরা বসো, আমি চানাস্তার আয়োজন করি।

চৌধুরী সাহেব উঠে দাঁড়ালেন কাল থেকে কি যে দুশ্চিন্তায় ছিলাম, যাই পুলিশ অফিসে খবরটা জানিয়ে আসি। মিঃ হারুন তার দলবল নিয়ে হয়রান পেরেশান হচ্ছেন। তারপর সরকার সাহেবকে লক্ষ্য করে বলেন, চলুন, ওদিক হয়ে ডাক্তারখানায় যাব। আপনার আরও একটি ইনজেকশন লাগবে!

সরকার সাহেবও উঠে দাঁড়ান—চলুন।

সবাই বেরিয়ে যান। বান্ধবীরা একজন বলে—ভদ্রলোক কেমন দেখতে রে মনিরা?

হেসে বলে মনিরা খুব সুন্দর। অপূর্ব।

অন্য একটি মেয়ে বলে-বয়স খুব বেশি?

না, খুব কম। তবে তিরিশের কাছাকাছি।

আর একজন বান্ধবী টিপনি কাটে—খুব বড়লোক বুঝি?

মনিরা স্বাভাবিক কষ্ঠে জবাব দেয় রাজাধিরাজ?

প্রথম বান্ধবী চাপাকণ্ঠে বলে–সে কি বিবাহিত?

না।

একসঙ্গে সবাই হর্ষধ্বনি করে ওঠে—মারহাবা! আমাদের নৌকাভ্রমণ সার্থক হয়েছে তাহলে!

একজন বলেন-মনিরার ভাগ্য বলতে হবে।

অন্যজন বলে–শুধু ভাগ্য নয়—সৌভাগ্য।

আর একজন বলে–ভদ্রলোক নিশ্চয়ই তার সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারেন।

হ্যাঁ, পারে।

আমাদের হিংসে হচ্ছে কিন্তু।

আচ্ছা তোমাদের ভাগ দেব কিছুটা করে।

তখন আর দেখাবিনে, লুকিয়ে রাখবি সবার কাছ থেকে।

না, তোদের দেখার কথা দিলাম।

এমন সময় মরিয়ম বেগম চা-নাস্তা ট্রে-সহ কক্ষে প্রবেশ করেন।

মনিরা উঠে গিয়ে মামীমার হাত থেকে চায়ের ট্রে নিয়ে নিজেই তৈরি করতে বসে।