পরিশিষ্ট

মুহাম্মদ বিন কাসিম এবং পাশ্চাত্যের প্রতিরক্ষা পর্যবেক্ষক

আমরা এই সংক্ষিপ্তসার আপনাদের সামনে এজন্য পেশ করছি, যাতে আমরা এবং আপনারা উল্লিখিত শিক্ষা থেকে ভালভাবে এবং পরিপূর্ণরূপে উপকৃত হতে পারি।

যেসব বন্ধু সমর-বিজ্ঞানে (Military Science) দৃঢ় সংকল্প মুজাহিদের ভূমিকা পালনে আগ্রহী—তারা যেন মুহাম্মদ বিন কাসিমের কার্যাবলী এবং প্রতিরক্ষা কৌশল (Strategy) ও সমরক্ষেত্রে ব্যুহ রচনার কলা-কৌশল (War tactics)-এর মূলনীতিগুলো ভালভাবে হৃদয়পটে গেঁথে নিতে পারেন। এতে তাঁরা ইসলামী বিশ্বের সত্যিকার মুজাহিদরূপে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে নিতে পারবেন।

আমরা নিম্নোদ্ধৃত মূলনীতিগুলো সার-সংক্ষেপ হিসাবে প্রতিরক্ষা পর্যবেক্ষকদের ঐসব নির্দেশাদি থেকে গ্রহণ করেছি, যে সব নির্দেশ ১৯৩৯-৪৫ ঈসায়ীর যুদ্ধ থেকে শুরু করে মাঝে মাঝে বিরতি সহ বিভিন্ন সময়ে লণ্ডনের যুদ্ধ অফিস (War Office) থেকে আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছিল। এগুলো গভীরভাবে অধ্যয়ন করলে আপনার সামনে ইসলামী প্রতিরক্ষা শাস্ত্রের মূলনীতিগুলোর মর্যাদা আলোকোদ্ভাসিত হয়ে উঠবে এবং আপনি জানতে পারবেন যে, ইসলামের প্রতিরক্ষা নীতিগুলো ১৯৩৯-৪৫ ঈসায়ীতে এবং পরবর্তীতেও অনড় ও অটল রয়েছে এবং এখনও আছে। আপনি এও বুঝতে পারবেন যে, মুহাম্মদ বিন কাসিম আঁ-হযরত (সা) অনুসৃত প্রতিরক্ষা কৌশলের মূলনীতিগুলোর ভক্ত ও অনুরক্ত ছাত্র ছিলেন বলেই এত অল্প বয়সে এতবড় নামকরা বিজয়ী জেনারেল হতে পেরেছিলেন।

সাধারণ সমর নীতি (General Principles of War)

আমরা আশা করি, মুহাম্মদ বিন কাসিমের প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত ইতিহাস পড়বার পর আপনার সামনে সুস্পষ্টরূপে প্ৰতিভাত হয়ে গেছে যে, কোন জাতিগোষ্ঠীর বিজয়ী কিংবা বিজিত জাতিতে পরিণত হওয়া তার সেনাবাহিনীর মধ্যে কতিপয় জরুরী ও অপরিহার্য গুণাবলী থাকা কিংবা না থাকার উপরই নির্ভরশীল। যেমন—

১. ফৌজের সিপাহ্‌সালার এবং তার অধীনস্থ সেনানায়কদের মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে সঠিকভাবে সৈন্য পরিচালনা করবার মত গুণ আছে কি না।

২. ফৌজের ভেতর লড়াই করবার যোগ্যতা ও দৃঢ় সংকল্প আছে কি না।

৩. ফৌজেকে উন্নতমানের ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে কি না।

৪. ফৌজের ভেতর আইন-শৃঙ্খলাগত এমন কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে কিনা, যা যুদ্ধক্ষেত্রের কঠিন মুহূর্তে দুর্বলতার কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে।

৫. ফৌজের সমরাস্ত্র তার প্রতিপক্ষের অনুপাতে মানসম্মত এবং নির্ভরযোগ্য কি না।

৬. ফৌজের অফিসার ও সৈনিকবৃন্দ অস্ত্র-শস্ত্র সঠিক ও কার্যকরভাবে ব্যবহার করার যোগ্যতা রাখে কি না।

অধিনায়কত্ব (Leadership)

প্রধান সেনাপতির নেতৃত্বদানের ক্ষমতা তাঁর ব্যক্তিগত মানবীয় বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে থাকে। তবে তাঁর উপর তাঁর অধীনস্থ সেনানায়কদের আস্থা থাকা অপরিহার্য। আর এই নির্ভরতা ও আস্থা ক্রয়যোগ্য জিনিস নয়। একজন অধিনায়ক এই আস্থা ও নির্ভরতা তখনই লাভ করতে পারেন যখন তাঁর অধীনস্থ সেনানায়কগণ তাঁর যোগ্যতা, ন্যায়পরায়ণতা, সংবেদনশীলতা, সংকল্প ও ইচ্ছাশক্তি, স্থৈর্য ও সংহতি, সাহসিকতা, মানবতা, ভয়-ভীতিশূন্যতা প্রভৃতি গুণকে গভীরভাবে পরখ করে তবে তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে। যদি তারা তাঁকে নিজ দায়িত্ব পালনে গাফলতি করতে দেখে কিংবা নিজের উপর নিজের আস্থা থাকার ক্ষেত্রে শিথিল দেখতে পায় তাহলে তাঁর উপর তাদের আস্থাও শিথিল হয়ে পড়ে।

অধিনায়ক নিজের উপর কেবল তখনই আস্থা স্থাপন করতে পারেন, যখন তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যূহ রচনার কলাকৌশল তথা প্রতিরক্ষার মূলনীতিগুলো ভালভাবে আয়ত্ত করে নিতে সক্ষম হন। এসব মূলনীতি অদৃশ্য জগত থেকে জানা যাবে না; বরং প্রতিটি অধিনায়কের জন্য অপরিহার্য যে, যদি তিনি সেসব মূলনীতি যুদ্ধক্ষেত্রে শেখার সুযোগ না পেয়ে থাকেন তাহলে প্রতিরক্ষা ইতিহাস ও প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত ভূগোল অধ্যয়ন করে যেন তা ভালভাবে শিখে নেন। সৌভাগ্যবশত তিনি যদি যুদ্ধক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকেন, তাহলে শান্তিকালীন সময়ে পুস্তক পাঠের মাধ্যমে সে অভিজ্ঞতাকে যেন আরো ধারালো করে তোলেন। এমনটি করলে তিনি প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত মূলনীতিগুলো সঠিকভাবে প্রয়োগ করার পদ্ধতি শিখে যাবেন। যুদ্ধক্ষেত্র অধিনায়কের জন্য একটি পরীক্ষাস্থল। এই পরীক্ষায়, নেপোলিয়নের ভাষায়, কেবল তিনিই কৃতকার্য হতে পারেন, যিনি তার প্রতিরক্ষাগত যোগ্যতাকে গভীর অধ্যয়ন-অভিজ্ঞতা এবং চিন্তা-ভাবনা দ্বারা শানিত করে রাখেন। নেপোলিয়ন বলেছেন, “যুদ্ধক্ষেত্রে আমার সাফল্যের গোপন রহস্য কোন দৈববাণীর ফল নয়; বরং আমার সাফল্যের রহস্য এই যে, প্রতিটি যুদ্ধের পূর্বেই আমি সে বিষয়টির প্রতিটি দিক গভীরভাবে ভেবে দেখি। যদি কোন বিষয় আমার অভিজ্ঞতায় না থাকে তাহলে আমি প্রতিরক্ষার ইতিহাস থেকে সে ব্যাপারে সাহায্য গ্রহণ করে থাকি।”

অধ্যয়ন এবং গভীর চিন্তা-ভাবনা থেকে একটি বিশেষ পন্থায় অধিনায়কের ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনার জগত গড়ে ওঠে। এর কারণ এই যে, তিনি কেবল স্বীয় ফৌজের নেতৃত্ব দানের জন্য কৌশল উদ্ভাবন করেন না বরং সেই সাথে স্বীয় শত্রুর বৈশিষ্ট্য ও ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলোর সঠিক তুলনামূলক বিচার করে একটি কার্যকর প্রতিরক্ষা পরিকল্পনাও তৈরী করেন। চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণাকে সুশৃঙ্খল রূপদান প্রতিটি অধিনায়কের জন্য অপরিহার্য। আর এ কাজ কেবল সুবিন্যস্তভাবেই আঞ্জাম দেওয়া যেতে পারে। প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার সহজ ও কার্যকর বাস্তবায়ন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং অধ্যয়নের উপরই নির্ভরশীল।

যুদ্ধের মূলনীতি (Principle of War)

প্রতিরক্ষা ইতিহাস থেকে এটা পরিষ্কাররূপে প্রতিভাত যে, সফল ও কৃতি অধিনায়কদের বিজয় কতিপয় মূলনীতির কাছে আত্মসমর্পণের উপর নয় বরং সেগুলোকে জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্রয়োগ করার উপরই নির্ভর করে।

এসব মূলনীতি প্রতিবারের ঘটনার নিরিখে নির্ধারিত হয়ে থাকে। অভিজ্ঞতা এবং প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত ইতিহাস অধ্যয়নের ভিত্তিতে একজন যোগ্য ও সচেতন জেনারেল ঐসব ঘটনা থেকে প্রত্যেক বারই কার্যকর ও ফলপ্রসূ দিক-নির্দেশনা পেয়ে থাকেন এবং সেই অনুযায়ী প্রতিরক্ষানীতি সঠিক পন্থায় প্রয়োগ করে থাকেন। নিম্নে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতির উল্লেখ করা গেল।

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হাসিল (Maintenance of Object)

প্রতিটি অধিনায়ক—চাই তিনি বিশাল বাহিনীর অধিনায়ক হোন কিংবা ক্ষুদ্র কোম্পানীর সেনানায়ক, তাঁর সর্বপ্রথম দায়িত্ব ও কর্তব্য হ’ল, তিনি তাঁর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে সঠিকভাবে অনুধাবন করার পর কোন কারণেই তা হাসিল করা থেকে সরে আসবেন না, বরং অটুট সংকল্প ও সংহতির সঙ্গে তা হাসিল করার জন্য কোশেশ করবেন।

সমাবেশ (Concentration)

সৈন্য সমাবেশের পেছনে প্রতিরক্ষা নীতির দিক দিয়ে উদ্দেশ্য থাকে এই যে, সিপাহ্‌সালার তাঁর ফৌজের বড় বড় অংশগুলোকে যুদ্ধক্ষেত্রের সেই নির্ধারিত স্থানে এবং নির্ধারিত সময়ে একত্র করবেন, যেখানে এবং যে সময়ে তিনি শত্রুর উপর পরিপূর্ণ বিজয় লাভের আশা করেন।

কেবল মানুষের সংখ্যাশক্তি নয়, বরং নীতি, সমরাস্ত্র, রসদ-সম্ভার, সরকারী বাহিনী, রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রভৃতিও সৈন্য সমাবেশের অন্তর্ভুক্ত।

অন্য কথায়, এ শক্তির সবটুকুই জেনারেল তাঁর শত্রুর বিরুদ্ধে সেই স্থানে একত্র করবেন, যেখানে তাঁর শত্রুর পরাজয় নিশ্চিত।

প্রতিরক্ষাগত সংকোচন (Economy of Force) ও আক্রমণ এবং সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব ও সৈনাপত্য সম্পর্কে যিনি অভিজ্ঞ, তিনি প্রতিরক্ষাগত উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে সামনে রেখে তা অর্জনের জন্য ছোট ছোট প্লাটুন ও কোম্পানীকে শত্রু ফৌজের বিরুদ্ধে লড়িয়ে থাকেন এবং অবশিষ্ট ফৌজকে রিজার্ভ ফোর্স হিসাবে সংরক্ষিত রাখেন। এটা ঠিক সেরূপ—যেরূপ প্রতিটি মানুষ যৌবনের উপার্জন থেকে কিছু অংশ বার্ধক্য, অসুস্থাবস্থা অথবা দৈব দুর্ঘটনার জন্য বাঁচিয়ে রাখেন।

শত্রুকে পরাভূত ও পর্যদস্ত করবার জন্য তার উপর সর্বাগ্রে হামলা করতে হবে। শত্রু প্রথমে হামলা করলে তার সাহস ও মনোবল বেড়ে যায় এবং সে ধারণা করে বসে যে, দুশমনের উপর নিজ পরিকল্পনা মাফিক সঠিক সময়ে ও নির্ধারিত জায়গায় সে কার্যকর আঘাত হানতে পেরেছে।

আত্মরক্ষা নীতির উপর আমল করলে যুদ্ধে জয়লাভ করা যায় না। আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ দীর্ঘকাল চালাতে থাকলে সাধারণত ফৌজের ভেতর হীনমন্যতার সৃষ্টি হয়।

অতর্কিত আক্রমণ (Surprise)

আক্রমণকারী সিপাহ সালারের জন্য চূড়ান্ত ফলাফল লাভের ক্ষেত্রে অতর্কিত আক্রমণ একটি মোক্ষম অস্ত্র। এ ধরনের আক্রমণে শত্রুর মনোবল ও ধ্যান-ধারণার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় এবং স্বল্প প্রাণহানির দ্বারাই শত্রুকে পরাভূত ও পর্যুদস্ত করা যায়।

হেফাজত (Security)

যতক্ষণ পর্যন্ত সিপাহ্‌সালার উপযোগী নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন না করেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি শত্রুর উপর অতর্কিত হামলা চালাতে পারেন না কিংবা তার হাত থেকে আত্মরক্ষা ও করতে পারেন না।

অতএব দুশমনকে পরাজিত করবার জন্য নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করা খুবই জরুরী, যাতে করে শত্রুর অসতর্কতার সুযোগে তাকে পাকড়াও করে একেবারে ধ্বংস করে দেওয়া যায়।

পারস্পরিক সহযোগিতা (Co-operation)

যতক্ষণ না ফৌজের সকল সেনানায়ক, অতঃপর অধিনায়ক, অতঃপর রাষ্ট্রের মন্ত্রীবর্গ জনসাধারণের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতার বন্ধনে আবদ্ধ হবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত শত্রুর বিরুদ্ধে পরিপূর্ণ জয়লাভ সম্ভব নয়। যেমন মোটরের চাকা যতক্ষণ পর্যন্ত সচল ও সক্রিয় না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত কেবল মোটরের ইঞ্জিন ঐ গাড়ীকে উদ্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাতে পারে না।

চলাচল ও গতিবিধির যোগ্যতা (Mobility)

যে ফৌজের চলাচল ও গতিবিধি তার প্রতিপক্ষের তুলনায় শ্ৰেষ্ঠতর, সে ফৌজ তার দুশমনের প্রতিটি সামরিক চালকে ব্যর্থ করে দিতে পারে।

এখন আপনি উপরোল্লিখিত মূলনীতিগুলোকে মুহাম্মদ বিন কাসিমের কর্মপন্থা ও কর্মপদ্ধতির সঙ্গে তুলনা করলে পরিষ্কার দেখতে পাবেন সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে তিনি সবগুলো মূলনীতিকেই কার্যকরী করেছেন।

তবে তিনি সবকিছুই একাকী করেন নি; বরং একজন পারদর্শী তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে বিভিন্ন কাজ বিভিন্ন জনের উপর সোপর্দ করেছেন। অতঃপর সবাই মিলে একাত্ম হয়ে গোটা কাজটি সম্পন্ন করেছেন। যেহেতু সেনানায়কবৃন্দ ছাড়াও গোটা ফৌজের উপর তাঁর পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা ছিল, তাই তাঁর বাহিনী ছোট হওয়া সত্ত্বেও বিশাল শত্রু বাহিনীকে পরাভূত করতে পেরেছে।

অন্য কথায়, মুহাম্মদ বিন কাসিম আমাদেরকে শিখিয়ে দেন যে, যে অধিনায়ক আক্রমণ ব্যুহ রচনার কৌশল সম্পর্কে অভিজ্ঞ এবং যিনি কেবল নিজের উপরই আস্থা রাখেন না, বরং আপন সেনানায়কবৃন্দ ও গোটা ফৌজের উপরও আস্থা রাখেন, তিনি যখন দূরদর্শিতার সঙ্গে পরিকল্পনা করেন, অতঃপর দৃঢ়সংকল্প হয়ে তা অনুসরণ করেন এবং স্বীয় পরিকল্পনার গোপন রহস্য শত্রু থেকে প্রচ্ছন্ন রেখে নির্ধারিত স্থানে এবং নির্ধারিত সময়ে স্বীয় ফৌজের সাহায্যে একই সঙ্গে সংঘবদ্ধ অতর্কিত হামলা চালান, সাধারণত সাফল্য তাঁর পদ চুম্বন করেই থাকে।

প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা (Plan)

মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধুনদ পার হবার পরিকল্পনা অত্যন্ত সহজ, সরল ও কার্যকর পদ্ধতিতে তৈরী করেছিলেন। তিনি পূর্বাহ্নে দুশমনের মনে নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মান যে, তিনি এমন জায়গা দিয়ে সিন্ধু পার হবেন, যেখানে পানি কম। সেজন্য রাজা দাহিরের ফৌজ অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সে সব জায়গারই হেফাজত করতে থাকে। কিন্তু ইবন কাসিম সিন্ধুনদের বিভিন্ন জায়গা সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়ে শেষাবধি গভীর পানির একটি জায়গা নির্দিষ্ট করে নেন। তারপর অত্যন্ত প্রচ্ছন্নভাবে নৌকা তৈরী করেন। নৌকা তৈরী হয়ে গেলে সেগুলো একত্রে বেঁধে দেন। অতঃপর এক রাতেই পুল তৈরী করে গোটা সেনাবাহিনী সমেত সিন্ধু পার হন। রাজা দাহির বিষয়টি তখন জানতে পারেন, যখন আরব ফৌজ তার উপর অতর্কিত হামলা চালিয়েছে—অর্থাৎ মুহাম্মদ বিন কাসিম প্রথমে এই মর্মে তাঁর লক্ষ্য স্থির করেন যে, তিনি রাজার ফৌজের সঙ্গে সংঘর্ষে অবতীর্ণ হয়ে তাকে পরাজিত করবেন। অতঃপর আনুষঙ্গিক অবস্থা অর্থাৎ সিন্ধু পার হবার রাস্তা, সেখানকার জমি, রাজা দাহিরের রক্ষক ফৌজ প্রভৃতির সঠিক পরিমাপ করে সম্মুখপানে অগ্রসর হন।

রাজা দাহির যখন রাজা গোপীর অধীনে একটি বিশাল সেনাবাহিনী সিন্ধুনদের পারে পাঠিয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিমের পশ্চাদ্দেশে বিদ্রোহ ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালান এবং সেই সঙ্গে রাজা বেট-এর বিরুদ্ধে অপর একটি বাহিনী পাঠান তখন মুহাম্মদ বিন কাসিম স্বীয় লক্ষ্য হাসিল অর্থাৎ সিন্ধুনদের অপর পারে গিয়ে রাজা দাহিরকে পরাজিত করার লক্ষ্যে স্বীয় ফৌজের সর্বোত্তম পরিমাপের সামরিক গতিবিধির যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে প্রথমে পশ্চাদ্দেশের বিপদ দূরীভূত করেন। রাজা গোপীর বিরুদ্ধে তিনি নিজেই তাঁর ফৌজের একটি বড় অংশ নিয়ে অগ্রসর হন। সেই সাথে অশ্বারোহী বাহিনীর কয়েকটি কোম্পানী বিভিন্ন স্থানে—যেখানে বিপদ খুবই প্রকট আকারে দেখা দেওয়ার আশংকা ছিল— বিদ্যুৎ গতিতে পাঠিয়ে দেন। ফৌজের বিশাল অংশের সঙ্গে ঐ সব কোম্পানীর পরিপূর্ণ যোগাযোগ ছিল। যেহেতু সেনানায়কবৃন্দের উপর সিপাহ্‌সালারের এবং সিপাহ্‌সালারের উপর সেনানায়কদের আস্থা ছিল, তাই রাজা গোপীর সেনাবাহিনী কোনরূপ লড়াই ব্যতিরেকেই ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। এর পর মুহাম্মদ বিন কাসিম তাঁর সামরিক গতিবিধিকে স্বীয় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাদির মাধ্যমে এমনই গোপন রাখেন যে, যখন তিনি তাঁর ফৌজ নিয়ে রাজা জয়চাঁদ এবং তাঁর সহযোগী রাজা রাসেলের দিকে অগ্রসর হন, তখন তারা উভয়েই এই আকস্মিক হামলায় পর্যুদস্ত হয়ে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে।

মুহাম্মদ বিন কাসিম, আলেকজাণ্ডার এবং নেপোলিয়ন

যোগ্যতার দিক দিয়ে উপরোল্লিখিত তিনজন জেনারেলকে আমরা একই কাতারে দেখতে পাই। তিনজনই নিজ নিজ শাস্ত্ৰে অভিজ্ঞ, নির্ভীক, দৃঢ় সংকল্পের অধিকারী এবং বীর অধিনায়ক ছিলেন। ভয় তাঁদের কাছে ঘেষতেই পারত না।

মহান আলেকজাণ্ডার

সৌভাগ্যবশত আলেকজাণ্ডারের নিকট তাঁর পিতা ফিলিপ সর্বোত্তমভাবে শিক্ষিত একটি ফৌজ এবং ধনসম্পদে পরিপূর্ণ একটি রাজকোষ রেখে গিয়েছিলেন। সম্রাট ফিলিপের মৃত্যুর পর তাঁর জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত ছিল এবং তাদের অন্তর ছিল দেশপ্রেমে ভরপুর। আলেকজাণ্ডারের সাথে দার্শনিক শ্রেষ্ঠ এ্যারিস্টটলের মত পরামর্শদাতাও ছিলেন। গ্রীকদের মনোবলও ছিল বিরাট। কিন্তু শেষাবধি অনেকগুলো বিজয়ের পর আলেকজাণ্ডারের ফৌজ তাঁর প্রভুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। আলেকজাণ্ডারকে পাশ্চাত্য বিশ্ব ‘মহান আলেকজাণ্ডার’ উপাধি দিয়েছে বটে, তবে এমন একজন জেনারেল—যিনি তাঁর ফৌজকে বিদ্রোহ ও অবাধ্যতা থেকে সরিয়ে রাখতে অক্ষম—তিনি কি করে ‘মহান অধিনায়ক’ উপাধি পেতে পারেন, তা অবশ্যই বিবেচনাসাপেক্ষ।

হতভাগ্য নেপোলিয়ন

নেপোলিয়ন আলেকজাণ্ডারের চাইতে বেশী প্রশংসা পাবার যোগ্য। কেননা উত্তরাধিকারসূত্রে না তিনি অর্থবিত্ত পেয়েছিলেন, না পেয়েছিলেন সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত ফৌজ। তাঁর জাতিও সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খল ছিল না। তবে তাদের মধ্যে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম জাতি হবার মত আবেগ ও উদ্দীপনা বিদ্যমান ছিল। আর সেজন্য নেপোলিয়ন অল্প সময়ের মধ্যে একটি সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত ফৌজ তৈরী করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

এই ফৌজের মাধ্যমে বিজয়ের পরিধি বিস্তৃত হবার সাথে সাথে সমগ্র জাতি সম্পদশালী হয়ে ওঠে। ফলে তাদের মধ্যে আরামপ্রিয়তা দেখা দেয়। এমনকি স্বয়ং নেপোলিয়নও বিলাসপরায়ণ ও আরামপ্রিয় ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হন। তাঁর এই আচরণ অধীনস্থ লোকদেরকে তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট ও বিরক্ত করে তোলে! আস্তে আস্তে অধিনায়কবৃন্দ এবং তাদের সৈনিকেরাও প্রবৃত্তির গোলামে পরিণত হয়। তারা তাদের প্রবৃত্তিজাত কামনা-বাসনা পূরণের নিমিত্তে লুটপাট এবং অন্যান্য দুষ্কর্মে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। ফলে নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী স্বাভাবিক-ভাবেই দুর্বল হয়ে পড়ে।

নেপোলিয়ন দিগ্বিজয়ী তৈমুরকে অনুকরণ করতে গিয়ে রাশিয়া আক্রমণ করেন এবং মস্কো পর্যন্ত রাশিয়ানদেরকে তাড়িয়ে নিয়ে যান। কিন্তু প্রাকৃতিক দুশমন—সর্দি ও বরফপাত—তাঁর আরামপ্রিয় ফৌজের কাল হয়ে দাঁড়ায়। ৭৫ বছরের বৃদ্ধ তৈমুর বরফ-গুলীর তীব্রতা সহ্য করতে পেরেছিলেন, কিন্তু যুবক নেপোলিয়ন ও তাঁর ফৌজ তা সহ্য করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হন।

সেজন্য আমরা নেপোলিয়নকে ‘মহান শ্রেষ্ঠ অধিনায়ক’ হিসাবে মেনে নিতে পাশ্চাত্য বিশ্বের সঙ্গে একমত নই।

মহান বিজয়ী মুহাম্মদ বিন কাসিম

এবার মুহাম্মদ বিন কাসিমকে দেখুন। তিনি মাত্র কয়েক হাজার মুজাহিদ, যারা বিভিন্ন কারণে জিহাদ পরিচালনার অনেকগুলো সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিল—সঙ্গে নিয়ে জিহাদে বের হয়েছিলেন। মুহাম্মদ বিন কাসিম সেই যুগে অধিনায়ক হন—যখন ইসলামী বিশ্ব ছিল একটি বিরাট বিপ্লবের শিকার। মুসলিম খলীফা খুবই কষ্টের সঙ্গে তাঁর দেশবাসীকে সঠিক পথে এনেছিলেন বটে, তবে সঠিক অর্থে শান্তি-শৃঙ্খলা তখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

মুহাম্মদ বিন কাসিম বিভিন্ন স্থান এবং বিভিন্ন গোত্র থেকে মুজাহিদ সংগ্রহ করেন। তিনি তাদেরকে কেবল সামরিক প্রশিক্ষণ‍ই দেন নি—বরং সঠিক অর্থে তাদেরকে মুজাহিদরূপে গড়ে তুলেছিলেন। আর তাও করেছিলেন মাত্র কয়েক মাসের ভেতর। তাঁর নিকট টাকা-পয়সা ছিল সীমিত। ছোট একটি বাহিনী নিয়ে দূর-দূরান্তরে যাত্রা। শত্রু দেশের বাসিন্দারাও ছিল তাঁর কট্টর শত্রু। কেননা তারা মুসলমানদেরকে ম্লেচ্ছ ও অপবিত্র জ্ঞান করত। এতদ্‌সত্ত্বেও এই মহান জেনারেল কেবলমাত্র একজন বিজেতা ভূমিকাই পালন করেন নি—বরং আঁ হযরত (সা)-এর সত্যিকার শাগরিদ হিসাবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি দুশমনকে কেবল নৈতিক ও পার্থিব দিক দিয়েই পরাজিত করেন নি, বরং মানসিক দিক দিয়েও পরাজিত করে তাদেরকে আপন করে নিয়েছিলেন। তাঁর সংশ্রবে এসে সিন্ধুর অনেক অধিবাসী নিজে থেকেই মুসলমান হয়ে যায়। এভাবে ইসলামের সাথে তাদের চিরন্তন সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের ছায়াতলে তারা দলে দলে আশ্রয় নেয়। এ কারণেই আমরা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে বিশ্বের মহান শ্রেষ্ঠ অধিনায়কদের মধ্যে গণ্য করি। বিজয় তাঁকে আত্মগর্বী ও উদ্ধত স্বেচ্ছাচারীতে পরিণত করতে পারেনি, সম্পদ তাঁকে বৈষয়িক করে তুলতে পারেনি, প্রবৃত্তি তাঁর উপর শাসন চালাতে পরে নি; বরং বিজয় যতই তাঁর পদচুম্বন করেছে, ঈমান ও আমলের দিকে দিয়ে তিনি ততই উন্নতির স্বর্ণশিখরে আরোহণ করেছেন এবং একজন নজীরবিহীন মু’মিন হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শেষাবধি তিনি দুর্ভাগ্যজনক পরীক্ষার সম্মুখীন হলেন। কিন্তু যখন তাঁকে বন্দী করা হ’ল এবং নিজের মৃত্যু সম্পর্কে তিনি স্থির নিশ্চিত হয়ে গেলেন—এমন মৃত্যু যা ছিল বিনা দোষে এবং অকারণে—তখনো এই মর্দে মুজাহিদ তাঁর এতটুকু অসন্তোষ প্রকাশ করেন নি, অভিযোগের একটি বাক্যও তাঁর মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয় নি; বরং এরূপ ক্ষেত্রেও তিনি তাঁর বিরোধীদের উদ্দেশ্যে নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললেন:

“লোকে আমাকে নষ্ট করে দিল। কোন্ যুবককে নষ্ট করল? সেই যুবককে যে তাদের বিপদের দিনে কাজে লেগেছিল এবং সীমান্তের দৃঢ়তা বিধানে যে ছিল উপযোগী।”

ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজিউন।

দুশমন

বি. দ্র. : উপরের চিত্রটি বর্তমান পুস্তকের ৫২ পৃষ্ঠার “ছাউনী এবং পদ্ধতি” শিরোনামের অধীনে ১ম প্যারার নীচে যাবার কথা ছিল। ব্লকটি যথাস্থানে দিতে না পারায় আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। পাঠক আমাদের এই অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি ক্ষমা করবেন বলে আশা করি। — অনুবাদক!