ইসলামের যুদ্ধ-বিধান

আঁ-হযরত (সা)-এর পথ-নির্দেশ

আঁ-হযরত (সা) যুদ্ধভিযানে প্রেরণের পূর্বে অধিনায়ক ও অধীনস্থ ফৌজকে তাকওয়া ও আল্লাহ ভীতির উপদেশ দান করতেন। তাদেরকে বলতেন:

১. আল্লাহ্‌র নাম নিয়ে অগ্রসর হও এবং যারা কাফির—আল্লাহ্‌র সঙ্গে কুফরী করে, আল্লাহ্‌র রাস্তায় তাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর।

২. যুদ্ধে কারুর সঙ্গে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করবে না।

৩. যুদ্ধলব্ধ সম্পদের খেয়ানত করবে না।

৪. লাশ বিকৃত করবে না অর্থাৎ যুদ্ধে আহত কিংবা নিহতদের নাক, কান ইত্যাদি কাটবে না।

৫. কোন বৃদ্ধ, শিশু, নারী কিংবা অক্ষম পুরুষকে হত্যা করবে না।

৬. যুদ্ধের আগে শত্রুর সামনে এই তিনটি শর্ত পেশ করবে:

ক. ‘ইসলাম কবুল কর।’ যদি তারা ইসলাম কবুল করে তবে তাদের উপর হাত উঠাবে না।

খ. যদি তারা জিয্‌য়া প্রদানের মাধ্যমে আনুগত্য স্বীকার করে তাহলে তাদের জীবন ও সম্পদের বেলায় কোন রকমের বাড়াবাড়ি কিংবা সীমা লঙ্ঘন করবে না।

গ. যদি তারা উল্লিখিত শর্তাদি মেনে নিতে অস্বীকার করে তাহলে আল্লাহ্‌র সাহায্য প্রার্থনা করে যুদ্ধ কর।

৭. কথা বলার ক্ষেত্রে ন্যায়নীতি অনুসরণ কর।

৮. যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার কর।

৯. শত্রু যদি অস্ত্র সমর্পণ করে এবং মুখ কিংবা অঙ্গভঙ্গী সহকারে নিরাপত্তা-প্রার্থী হয়, তাহলে তাদের উপর হাত উঠাবার আর কোন অধিকার তোমাদের থাকবে না।

১০. বিজয়ের নেশায় কিংবা ক্রোধের বশবর্তী হয়ে সীমা অতিক্রম করবে না।

খুলাফা-ই-রাশিদীন উল্লিখিত নির্দেশাবলী অত্যন্ত কঠোরভাবে মেনে চলেছেন এবং অন্যদেরকেও তা মেনে চলতে বাধ্য করেছেন।

নাজরানবাসীদের সঙ্গে কৃত চুক্তিপত্র

এখন আমরা সেই সন্ধিপত্র আপনাদের কাছে পেশ করছি যা নাজরানবাসীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে আঁ-হযরত (সা) মঞ্জুর করেছিলেন।

“নাজরানের খৃস্টান অধিবাসী এবং তাদের প্রতিবেশীরা (যারা খৃস্টানদের সঙ্গে উক্ত এলাকায় বসবাস করত) আল্লাহ্‌র আশ্রয় নিল এবং আল্লাহ্‌র রসূল মুহাম্মদ (সা) তাদের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। তাদের জীবন, বিত্ত-সম্পদ, জায়গা-জমি-স্থাবর হোক কিংবা অস্থাবর, উট ও অন্যান্য প্রাণীকুল, তাদের দূত, ধর্মীয় চিহ্নাদি যেখানে যে অবস্থায় আছে ঠিক সে অবস্থায়ই রক্ষা করা হবে। তাদের কোন অধিকার ক্ষুণ্ন করা হবে না কিংবা কোন ধর্মীয় চিহ্নের পরিবর্তন সাধন করা যাবে না। তাদের কোন ধর্মযাজককে তাদের পদ থেকে অপসারণ করা হবে না, গির্জার কোন সেবায়েতকেও তার কাজ থেকে সরানো যাবে না। তার আওতায় যা কিছু আছে, তা বেশীই হোক কিংবা কমই হোক, ছিনিয়ে নেওয়া যাবে না। জাহিলিয়া যুগের কোন হত্যা কিংবা প্রতিজ্ঞার ব্যাপারে তাদের কোন যিম্মাদারী নেই। সামরিক বিভাগে যোগদান করতে তাদেরকে বাধ্য করা যাবে না। কোন শত্রু বাহিনীকে তাদের ভূমি নষ্ট কিংবা ধ্বংস করতে দেওয়া হবে না (অর্থাৎ বহিঃশত্রুর হাত থেকেও তাদের রক্ষা করা হবে)। যদি এক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে অধিকারের দাবী উত্থাপন করে তাহলে উভয়ের মাঝে ন্যায় ও সুবিচারের ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করা হবে। নাজরানবাসী অত্যাচারী হবে না, অত্যাচারিতও হবে না। এক ব্যক্তির অপরাধের জন্য অন্য ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদান করা হবে না। এই সন্ধিপত্রে যা কিছু আছে তার জন্য আল্লাহ্‌র জামানত এবং রসূল (সা)-এর যিম্মাদারী রইল যতদিন পর্যন্ত আল্লাহর হুকুম আসে এবং তারা এর শুভাকাঙ্ক্ষী থাকে এবং চুক্তিপত্রে লিখিত শর্তসমূহ পালন করে।”

হযরত আবূ বকর (রা)-এর নির্দেশসমূহ

হযরত আবূ বকর (রা) জিহাদের জন্য যখন সেনাবাহিনী প্রেরণ করতেন, তখন সেনাবাহিনীর অধিনায়ককে নিম্নোক্ত নির্দেশাদি প্রদান করতেন:

১. নারী, শিশু ও বৃদ্ধকে হত্যা করবে না।

২. লাশ বিকৃত করবে না।

৩. পাদ্রী বা ধর্মযাজককে উৎপীড়ন করবে না এবং তাদের মঠ ও উপাসনালয় ধ্বংস করবে না কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত করবে না।

৪. ফলবান বৃক্ষ কাটবে না, শস্যক্ষেত জ্বালাবে না।

৫. জনবসতি ধ্বংস করবে না।

৬. পশুপাল ধ্বংস করবে না।

৭. প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবে।

৮. যারা আনুগত্য স্বীকার করবে—তাদের জানমালকে ঠিক সেরূপ সম্ভ্রমের চোখে দেখবে যেরূপ একজন মুসলমানের জান মালকে দেখা হয়।

৯. যুদ্ধলব্ধ সম্পদের খেয়ানত করবে না।

১০. যুদ্ধে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে না।

দেবলবাসীদের জন্য হাবীব বিন মাসলামার প্রতিজ্ঞাপত্ৰ

এখন আমরা সেই সুলেহনামা (সন্ধিপত্র) লিপিবদ্ধ করছি যা দেবলবাসীদের জন্য হাবীব বিন মাসলামা লিখেছিলেন।

“হাবীব বিন মাসলামা এবং দেবলবাসীদের মধ্যে—চাই তারা খৃস্টান হোক, অগ্নি উপাসক হোক অথবা য়াহুদী, উপস্থিত হোক কিংবা অনুপস্থিত—এ প্রতিজ্ঞাপত্র সাধারণভাবে প্রযোজ্য। আমি তোমাদেরকে নিরাপত্তা প্রদান করছি। তোমাদের জীবন, সম্পদ, আত্মীয়-পরিজন, উপাসনালয় এবং তোমাদের শহর প্রাচীরের জন্য এ নিরাপত্তা দেওয়া হ’ল। তোমরা ততদিন পর্যন্ত নিরাপদ, যতদিন পর্যন্ত এ প্রতিজ্ঞায় অটল থাকবে এবং জিয্‌য়া ও রাজস্ব আদায় করতে থাকবে।”

এতদসত্ত্বেও কয়েকজন ঐতিহাসিক এবং কর্নেল হেগও মুহাম্মদ বিন কাসিম সম্পর্কে লিখেছেন যে, তিনি হিন্দী ফৌজের অস্ত্র সমর্পণের পরও হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালান, হিন্দুদের মন্দির ভূপাতিত করেন, মহিলাদেরকে অসম্মান করেন ইত্যাদি। অথচ এটা প্রকৃত সত্যের অপলাপ ছাড়া কিছু নয়। মজার ব্যাপার এই যে, এই কর্নেল হেগই তাঁর পুস্তকের অন্যত্র বলেছেন, “মুহাম্মদ বিন কাসিম ইসলামী রেওয়াজ ও বিধান উপেক্ষা করে হিন্দুদের প্রতি ধর্মীয় সহমর্মিতা ও উদার সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেন এবং তাদের সঙ্গে কোমল আচরণ করেন।”

উক্ত পুস্তকে কর্নেল হেগ এ মর্মে খলীফা হারুন-অর-রশীদকেও বিদ্রূপ করেছেন যে, তিনি তাঁর পুত্র আল-মামুনকে খুরাসান, তাবিলিস্তান, কাবুলিস্তান, সিন্ধু এবং হিন্দুস্তান এলাকা দান হিসাবে প্রদান করেন। অথচ (তাঁর ধারণা মুতাবিক) হিন্দুস্তান হারুন-অর-রশীদের সাম্রাজ্যের অন্তর্গত কখনোই হয়নি। মুহাম্মদ বিন কাসিম তা জয়ই করেননি। খলীফা তদীয় পুত্রকে এমন কিছু দান করেন, যা তাঁর ছিল না। কিন্তু কর্নেল হেগ ভুলে গেছেন যে, রাজা দাহির সিন্ধু নদের পূর্ব প্রান্তের এলাকাকে হিন্দ্ নামে ডাকতেন। অতএব আরব ঐতিহাসিকগণও একে হিন্দুস্তান নামেই অভিহিত করেছেন।

হযরত আলী (রা)-এর দিক-নির্দেশনা

হযরত ‘আলী (রা)-এর একটি চিঠি থেকে খুলাফায়ে রাশিদীনের আমলে প্রচলিত ইসলামী হুকুমতের শাসন-শৃঙ্খলা সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায়। হযরত ‘আলী (রা) আল্লাহ্‌র রসূলের খলীফা হিসাবে কতটা স্থির-মস্তিষ্ক এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কিরূপ যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন তা এই চিঠি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়।

হযরত ‘আলী (রা)-এর চিঠি উদ্ধৃত করবার পূর্বে আমরা স্পষ্ট করে দিতে চাই যে, এর দ্বারা আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি?

১. আমরা আমাদের অতীত ভুলে গেছি। আমাদের মহান মুসলিম খলীফাগণ তাঁদের আমীর-উমারা এবং জনসাধারণের কাছ থেকে কি আশা পোষণ করতেন এবং কেন করতেন তা আমাদের অবশ্যই জানা উচিত।

২. খুলাফায়ে রাশিদীনের যুগের পর হুকুমতের রঙ এবং রাষ্ট্রীয় ও সরকারী দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়। খলীফা একজন স্বেচ্ছাচারী সম্রাটে পরিণত হন। আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই জোয়ার-ভাটা কেন?

৩. এটা কি সম্ভব নয় যে, উল্লিখিত অবস্থা ও কারণগুলো সম্পর্কে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে আমরা আমাদের ঐ সব দুর্বলতা নিয়ন্ত্রণ করব, যেগুলোর ব্যাপারে আমরা বিতৃষ্ণ এবং যা চীৎকার করে করে বলছে, ‘এমনটি যদি না কর তাহলে বহু বিপদ, যা তোমাদেরকে ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে—পরবর্তীকালে প্রতিরোধ করা কঠিন হয়ে পড়বে।

৪. আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কোন জাতি যখন অবনতি ও অধঃপতনের দিকে যেতে থাকে তখন তাদের গতি হয় দ্রুততর এবং তারা লাঞ্ছনার গভীরে পৌঁছেও সজাগ হয় না; বরং মন্দের পাঁকে অসহায়ভাবে নিমজ্জিত হতে থাকে। ধ্বংসের এ ধারা ততক্ষণ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে, যতক্ষণ না সেই জাতির মধ্যে এমন কিছু নেতা বা পথপ্রদর্শক জন্ম নেন, যারা তাদেরকে পুনরায় অহংবোধ ও ব্যক্তিসত্তার দিকে টেনে নিয়ে যান।

খলীফা ‘আবদুল মালিক ও তাঁর পুত্র ওয়ালীদের যুগে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ, মুহাম্মদ বিন কাসিম, কুতায়বা বিন মুসলিম, মুসা বিন নুসায়র এবং খোদ খলীফা ‘আবদুল মালিক এবং ওয়ালীদ ছিলেন এমন ব্যক্তিত্ব, যাঁরা মুসলমানদের মধ্যে পুনরায় প্রাণ স্পন্দন সৃষ্টি করেন এবং জিহাদের গুরুত্বকে আবার নতুন করে সর্ব সমক্ষে তুলে ধরেন।

৫. এই চিঠির প্রতিটি শব্দ মূলত অত্যন্ত অর্থপূর্ণ এবং আমাদের জন্য আলোক-বর্তিকাস্বরূপ। কতই না ভাল হ’ত যদি হযরত ‘আলী (রা)-এর এই চিঠির মর্মানুযায়ী বনু উমায়্যা তাদের শাসনকালকে ঢেলে সাজাত।

যা-হোক, হযরত ‘আলী (রা)-এর সেই চিঠি—যা তিনি আল্লাহ্‌র রসূলের খলীফা হিসাবে মিসরের তৎকালীন গভর্নর মালিক আশতারকে লিখেছিলেন, আমরা এখানে উদ্ধৃত করছি।

“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম,

আস্‌সালামু ‘আলায়কুম,

“জেনে রাখ হে মালিক! আমি তোমাকে এমন একটি দেশের শাসক করে পাঠাচ্ছি, যারা অতীতে ন্যায়নীতি ও জুলুম-দুর্নীতি— উভয় স্তরই অতিক্রম করে এসেছে। লোকে তোমার কার্যকলাপকে সেভাবে পরীক্ষা করবে, যেভাবে তুমি নিজে তোমার পূর্বেকার লোকদের কার্যকলাপ পরীক্ষা করে থাক এবং সেভাবে তারা তোমার সম্পর্কে একটা রায় কায়েম করবে, যেভাবে তুমি তাদের সম্পর্কে কায়েম করে থাক। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, জনসাধারণ কেবল সেসব শাসক ও কর্মচারীকে ভাল জানে যারা সৎকাজ করে। আর জনসাধারণ কর্তৃক প্রদত্ত রায় হ’ল—তোমার কার্যকলাপ ভাল কি মন্দ তারই মাপকাঠি। সেজন্য সবচেয়ে মূল্যবান যে সম্পদ তুমি আশা করতে পার, তা হ’ল সৎকর্ম। স্বীয় প্রবৃত্তিকে সংযত রাখ, নিষিদ্ধ বস্তুর হাত থেকে বেঁচে থাক। কেননা কেবল পরহেজগারী অবলম্বন করেই ভাল ও মন্দের মধ্যে তুমি পার্থক্য নিরূপণ করতে পার।

জনসাধারণের প্রতি ভালবাসা

“তুমি তোমার অন্তরে জনসাধারণের প্রতি ভালবাসার প্রেরণা লালন কর এবং একে লোকদের প্রতি দয়া ও সহৃদয়তার মাধ্যম বানাও। তাদের সঙ্গে পশুর মত আচরণ কর না এবং তাদের ধন-সম্পদের উপর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত ক’র না। মনে রেখ, জনসাধারণের মধ্যে দু’ধরনের লোক রয়েছে : হয় তারা তোমার ঈমানী ও দীনী ভাই অথবা (আল্লাহ্‌র বান্দা হিসাবে) তোমারই মত মানুষ (যদিও তারা ভিন্নধর্মী) আর মানুষ হিসাবে নিশ্চয়ই তারাও তোমার ভাই। তাদের ভেতর দুর্বলতা যেমন থাকবে—তেমনি থাকবে ভুলত্রুটি ঘটবারও আশঙ্কা। কতক মানুষ অপরাধী হবে। তুমি তাদেরকে ক্ষমা করবে যেমন তুমি চাও আল্লাহ্ তোমাকে ক্ষমা করুন। মনে রেখ, শাসক হিসাবে তুমি যেমন তাদের উপর রয়েছ—তেমনি তোমার উপর এবং আমাদের সকলের উপর রয়েছেন আল্লাহ্—যিনি তোমাকে এজন্য গভর্নর পদে নিযুক্তি দিয়েছেন যাতে তুমি তোমার অধীনস্থ লোকদের দেখাশুনা করতে পার এবং পূরণ করতে পার তাদের প্রয়োজন। তাদের জন্য তুমি যা করবে তারই ভিত্তিতে তোমার (সবকিছুকে) বিচার করা হবে।

আল্লাহ্-ভীতি

“আল্লাহ্‌র মুকাবিলায় নিজকে দাঁড় করিও না। কেননা আল্লাহ্‌র ক্রোধাগ্নি থেকে নিজেকে বাঁচাতে তুমি সমর্থ নও, আর তুমি তাঁর রহম, করম ও ক্ষমার গণ্ডী থেকে বাইরে বেরিয়ে যাবার ক্ষমতাও রাখ না। কাউকে ক্ষমা করার জন্য আফসোস ক’র না। আর কাউকে যদি শাস্তি দিতেই হয় তজ্জন্য উল্লসিত কিংবা পুলকিত বোধ ক’র না। নিজের ক্রোধকে উদ্দীপ্ত হবার সুযোগ দিও না; কেননা এর দ্বারা উপকার লাভের কোনই সম্ভাবনা নেই।

“আমি তোমাদের মালিক ও শাসক এবং এজন্য তোমাদেরকে আমার নির্দেশের সামনে মাথা নত করতে হবে—এমন কথা কখনো বল না। এটা তোমার আত্মাকে কলুষিত ও তোমার ঈমানকে দুর্বল করে দেবে এবং সারাদেশে অশান্তি ও অরাজকতার সৃষ্টি করবে। ক্ষমতা ও শাসন কর্তৃত্ব তোমার ভিতর গর্বের সৃষ্টি করতে পারে। তাই নিজের ভেতর যখনই গর্ব ও অহংকারের এতটুকু আলামত দেখতে পাবে তখনি গোটা সৃষ্টিজগতের বুকে আল্লাহ্‌র অপার শান ও কুদরতের দিকে দৃষ্টিপাত করবে। দেখবে এই সৃষ্টিজগতে তোমার এতটুকু কর্তৃত্বও নেই। এই আচরণ তোমার ভ্রষ্ট মেধাকে ভারসাম্য দান করবে এবং তোমাকে শান্তি ও তৃপ্তি দেবে। মনে রেখ, আর সাবধান থেকো। কখনই নিজেকে আল্লাহ্‌র মহান শান ও মর্যাদার সামনে দাঁড় করাবে না এবং তাঁর ন্যায় সার্বভৌমত্বের অনুকরণও করতে যাবে না। কেননা যারাই আল্লাহ্‌র সঙ্গে বিদ্রোহাত্মক আচরণ করেছে এবং যারাই মানুষের উপর জুলুম ও নিপীড়ন চালিয়েছে আল্লাহ্, তাদেরই ধ্বংস করে ছেড়েছেন।

হক্‌কুল ইবাদ (বান্দার অধিকার)

“স্বীর্য কার্যকলাপ দ্বারা হক্‌কুল্লাহ্‌র এবং হক্‌কুল-’ইবাদের প্রতি সম্মান দেখাবে। স্বীয় সঙ্গী-সাথী ও আত্মীয়-স্বজনকেও এর শিক্ষা দেবে। এ না করলে তুমি নিজের প্রতি ও মানবতার প্রতি অবিচার করবে এবং আল্লাহ্ ও গোটা মানব সমাজ তোমার দুশমনে পরিণত হবে। যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌কে দুশমন বানায় তার আশ্রয় কোথাও নেই; তাকে আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বলে ততক্ষণ গণ্য করা হবে, যতক্ষণ না সে তওবা করে এবং আল্লাহ্‌র নিকট ক্ষমাপ্রার্থী হয়। কোন কিছুই মানুষকে আল্লাহ্‌র বরকত থেকে ততটা বঞ্চিত করে না আল্লাহ্‌র রোষাগ্নি ও ক্রোধবহ্নিকে ততটা প্রলম্বিত করে না যতটা করে জুলুম। আর তা এজন্য যে, আল্লাহ জুলুমের ফরিয়াদ এবং জালিম ও অত্যাচারীকে পাকড়াও করবার জন্য প্রস্তুত থাকেন।

সাধারণ জনগণ

“রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক কাজে ইনসাফ ও সুবিচার কর, একে নিজের জন্য বাধ্যতামূলক করে নাও। জনগণের সন্তুষ্টি অর্জন কর, কেননা জনগণের অতৃপ্তি ও অসন্তোষ সংখ্যালঘিষ্ঠ সুবিধা- ভোগী ও বিত্তশালী লোকদের তৃপ্তি ও সন্তোষকে নষ্ট করে দেয়। পক্ষান্তরে বিত্তশালী লোকের অতৃপ্তি ও অসন্তোষ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের প্রাচুর্যের মধ্যে অনায়াসে হারিয়ে যায়। মনে রেখ, মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী শ্রেণী বিপদ ও সংকটকালে তোমার ডাকে সাড়া দেবে না। তারা ন্যায়নীতি ও ইনসাফের রাস্তা এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করবে এবং নিজেদের প্রাপ্যের চেয়ে অনেক বেশী চাইবে। তাদের সঙ্গে যে সদয় আচরণ করেছ এবং তাদেরকে যে অনুগ্রহ করেছ সেজন্য তারা তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে না। জনসাধারণই যে কোন দেশ ও রাষ্ট্রের এবং যে কোন মিল্লাত ও মযহাবের স্থিতি ও শক্তির কেন্দ্রবিন্দু। তারাই শত্রুর সাথে যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করে। অতএব সাধারণ গণ-মানুষের কাছাকাছি অবস্থান করবে এবং তাদের কল্যাণের প্রতি সর্বাধিক মনোযাগ দেবে।

সাধারণ দোষত্রুটিগুলি উপেক্ষা কর

“এমন সব ব্যক্তিকে দূরে রাখবে যারা অপরের দোষ-ত্রুটি ও ছিদ্রান্বেষণে সদাব্যস্ত। সাধারণ মানুষ কিন্তু মানবীয় দুর্বলতা থেকে মুক্ত নয়। তাই শাসন কর্তৃত্বে সমাসীন ব্যক্তির জন্য সেসব উপেক্ষা করা অবশ্য কর্তব্য। অন্যের যে ত্রুটি বা দুর্বলতা গোপনীয় রয়েছে তা দিবালোকে টেনে এনো না; বরং যা প্রকাশ পেয়েছে তা দূর করার চেষ্টা কর। আল্লাহ্‌ই অদৃশ্য বিষয়াদি সম্পর্কে জ্ঞাত এবং সেগুলোর ব্যবস্থাপনা তাঁরই হাতে। জনগণের দুর্বলতাগুলো যথাসম্ভব উপেক্ষা কর তাহলে আল্লাহ তোমার সেই সব দুর্বলতা ঢেকে দেবেন, যা জনগণের দৃষ্টি থেকে আড়ালে রাখতে তুমি চিন্তিত। জনগণ ও সরকারের মাঝে বিরাজিত ঘৃণার গ্রন্থিগুলো খুলে দিও না এবং ঐ সমস্ত কারণ দূরীভূত করো, যা উভয়ের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত তিক্ততার সৃষ্টি করতে পারে। নিজেকে এমন সব কার্যকলাপ থেকে নিরাপদ রাখো যা তোমার জন্য শোভনীয় কিংবা সমীচীন নয়। যদি কেউ তোমার নিকট কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করে তাহলে সেগুলোর প্রমাণ সংগ্রহ করতে তুমি তাড়াহুড়োর আশ্রয় নিও না। কেননা চোগলখোররা বন্ধুর ছদ্মবেশেই অন্যকে ধোকা দেয়।

উপদেষ্টা নির্বাচন

“কোন কৃপণকে কখনও তোমার উপদেষ্টা করো না। কেননা সে তোমার ঔদার্য ও দানশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং তোমাকে দারিদ্র্যের ভীতি প্রদর্শন করবে। ভীরু ও কাপুরুষের পরামর্শও নেবে না। কেননা সে তোমার অটুট সংকল্প ছিনিয়ে নিতে চাইবে (অর্থাৎ তোমাকে সংকল্পচ্যুত করবে)। লোভী ব্যক্তির মতামতও নেবে না, কেননা সে তোমার ভেতর লোভের সঞ্চার করবে এবং তোমাকে একজন অত্যাচারী শাসকে পরিণত করবে। কার্পণ্য, ভীরুতা এবং লোভ মানুষকে আল্লাহ্ উপর তাওয়াক্কুল করা থেকে বিরত রাখে।

“নিকৃষ্টতম মন্ত্রণাদাতা তারাই, যারা কোন জালিম ও অত্যাচারী শাসকের উপদেষ্টা ও মন্ত্রণাদাতা হিসাবে কাজ করেছে এবং তাদের সকল অন্যায় ও অপকর্মকে সমর্থন করেছে। কখনই এমন সব লোককে পরামর্শদাতা করবে না, যারা জালিমদের সহযোগী ছিল এবং তাদের অনাচার ও অত্যাচারে শরীক ছিল। তুমি এমন লোককে পরামর্শদাতা কর, যে প্রজ্ঞাবান ও দূরদর্শী, পাপাচার ও অন্যায়-অপকর্ম থেকে মুক্ত এবং যে কোন জালিমের জুলুমে কিংবা কোন পাপীর পাপকর্মে কখনো সাহায্য বা সহযোগিতা করেনি। এ সমস্ত লোক কখনো তোমার বোঝা হয়ে দাঁড়াবে না বরং সর্বদা তোমার শক্তি ও সংহতির উৎস হিসাবে কাজ করবে। এরাই হবে তোমার সত্যিকারের বন্ধু ও দোস্ত। এ ধরনের লোককে তোমার ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে বন্ধু হিসাবে গণ্য করবে। এদের ভেতর আবার অগ্রাধিকার দেবে তাদেরকেই, যারা স্বভাবতই সততার পূজারী। সততার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করবে—এজন্য তোমাকে যত বেশী মূল্যই দিতে হোক না কেন কিংবা তোমার ধৈর্যের পক্ষে তা যতই প্রাণান্তকর হোক না কেন।

ভাল-মন্দের পার্থক্য

“নেককার ও আল্লাহ্-ভীরু লোকদেরকে তোমার নৈকট্য দেবে। যে কোন বিষয় তাদের সামনে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরবে। তারা যেন কখনো তোমায় তোষামোদ না করে এবং তুমি যা করনি সে বিষয়ে চাটুকারিতার আশ্রয় না নেয়। কেননা তোষামোদ ও চাটুকারিতা বিনয়ী ও নম্র মানুষের মধ্যেও অহংকারের সৃষ্টি করে। ভাল ও মন্দের সাথে একই আচরণ করবে না। এটা ভাল মানুষকে ভাল কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখবে এবং মন্দ লোককে মন্দ কাজে আরো উৎসাহিত করবে। যার যেমন কর্ম তাকে তেমন প্রতিদান দেবে। মনে রেখ—কল্যাণ, ন্যায়, সুবিচার এবং সেবার দ্বারা শাসক ও শাসিতের মাঝে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের সৃষ্টি হয়। লোকের ভেতর তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী ও কল্যাণকামী তৈরী কর। কেননা তাদের কল্যাণ কামনাই তোমাকে বিপদ-আপদ ও সমস্যা-সংকটের হাত থেকে বাঁচাতে পারে। তাদের কল্যাণ কামনার বিনিময় হবে তোমার উপর তাদের আস্থা বৃদ্ধি আর অকল্যাণ ও অসদাচরণের বিনিময় হবে তোমার প্রতি শত্রুতা।

পূর্বপুরুষদের ঐতিহ্য

“আমাদের পূর্বপুরুষদের উত্তম ঐতিহ্য অর্থাৎ ঐক্য, সংহতি ও অগ্রগতির লক্ষ্যে কাজ করাকে কখনো পরিত্যাগ করবে না এবং এমন কিছুর সূত্রপাত কিংবা সূচনা করবে না যা তাদের ঐতিহ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা বিনষ্ট করে। উত্তম ঐতিহ্যের প্রতিষ্ঠাকারীরা তাদের পুরস্কার পেয়ে গেছেন। ঐ সব ঐতিহ্য যদি আহত কিংবা বিনষ্ট হয় তাহলে তোমরাই তার জন্য দায়ী হবে। হামেশা জ্ঞানী-গুণী ও দূরদর্শী ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা দ্বারা লাভবান হবার চেষ্টা কর এবং রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি ও কার্যক্রম পরিচালনায় তাদের থেকে বারবার পরামর্শ নিতে চেষ্টা কর। এতে করে তুমি রাষ্ট্রে শান্তি ও কল্যাণের আবহাওয়া বহাল রাখতে পারবে, যা তোমার পূর্ববর্তিগণ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।

জনগণের বিভিন্ন শ্রেণী

“মনে রেখ, জনগণ বিভিন্ন শ্রেণীর সমষ্টি এবং এদের একের উন্নতি অন্যের উন্নতির উপর নির্ভরশীল। তাই এক শ্রেণী অন্য শ্রেণী থেকে সম্পর্কহীন হয়ে থাকতে পারে না। আমাদের ফৌজ—যা আল্লাহ্‌র সৈনিকদের নিয়ে গঠিত, আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসকবৃন্দ, তাদের দফতরসমূহ, আমাদের বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থাপনা, বিচারকবৃন্দ, আমাদের রাজস্ব বিভাগ এবং অন্যান্য শাখার কর্মচারীবৃন্দ—এককথায়, বিভিন্ন বিভাগ ও বিভিন্ন শ্রেণীর লোক নিয়েই আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা সংগঠিত ও পরিচালিত। জনগণের ভেতর মুসলিম নাগরিক এবং যিম্মী প্রজা রয়েছে। এদের ভেতর ব্যবসায়ী, শিল্পী, কারিগর, কর্মী, বেকার, ধনী, দরিদ্র প্রভৃতি শ্রেণীর মানুষ রয়েছে। আল্লাহ পাক এদের সবার জন্যই আলাদা আলাদা অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং ঐশী-গ্রন্থে তা সুরক্ষিত করে রেখেছেন।

“আল্লাহ্‌র অনুগ্রহে সেনাবাহিনী জনগণের নিরাপত্তা বিধানে একটি দুর্গের ভূমিকা পালন করে। সাম্রাজ্যের শান-শওকত ও মর্যাদা রক্ষা করে তারাই। ধর্মের সম্ভ্রম তারা বজায় রাখে এবং রাষ্ট্রের শান্তি ও নিরাপত্তা তারাই বহাল রাখে। সেনাবাহিনী ব্যতিরেকে যেমন একটি দেশ চলতে পারে না, তেমনি রাষ্ট্রের সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া একটি সেনাবাহিনীও টিকতে পারে না। আমাদের সৈনিকেরা শত্রুর মুকাবিলায় শক্তিশালী প্রমাণিত হয়েছে। কেননা আল্লাহ্ পাক তাদেরকে স্বয়ং নিজেদের জন্যই যুদ্ধ করবার সৌভাগ্য দান করেছেন (অর্থাৎ তারা এমন কোন ভাড়াটে সেনাবাহিনী নয়, যাদেরকে অন্যের স্বার্থ রক্ষার্থে যুদ্ধ করতে হয়)। কিন্তু তাদেরকে নিজেদের সমস্ত প্রয়োজন নিজেদেরই পূরণ করতে হয়, আর সেজন্যই তারা রাষ্ট্রীয় রাজস্ব খাত থেকে প্রদত্ত বেতনের মুখাপেক্ষী। সৈনিক এবং সেনাবাহিনী বহির্ভূত সাধারণ শ্রেণীর আপামর মানুষ যারা রাজস্ব প্রদান করে থাকে, এতদুভয়ের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা প্রয়োজনীয়। বিচার বিভাগীয় এবং ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত অফিসারবৃন্দ এবং তাদের কর্মচারীকুলের মধ্যেও সহযোগিতা প্রয়োজন। কাযী দেওয়ানী ও ফৌজদারী বিধিকে প্রয়োগ করে থাকেন। অর্থ ও রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীবৃন্দ রাজস্ব সংগ্রহ করেন। প্রশাসনিক বিভাগ তার নিয়োজিত অফিসার ও কর্মচারীর সাহায্যে নাগরিক জীবনের শৃঙ্খলা রক্ষা করেন। এরপর আছে বণিককুল, যারা রাষ্ট্রের আমদানী বৃদ্ধি করেন। এরাই বাজার ও ব্যবসা-কেন্দ্র পরিচালনা করেন এবং এরা (চাইলে) অন্যদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশী হক্‌কুল-’ইবাদ আদায় করতে পারেন। এ ছাড়া গরীব ও প্রয়োজন মুখাপেক্ষী অভাবী ও দরিদ্র শ্রেণীর লোকও রয়েছে। এদের লালন-পালন করা অন্যান্য শ্রেণীর জন্য ফরয (বাধ্যতামূলক কর্তব্য)। আল্লাহ্‌ প্রতিটি লোককেই খেদমত করবার উপযোগী মওকা দিয়েছেন। সব লোকের অধিকার রয়েছে রাষ্ট্রের উপর। জনকল্যাণকে সামনে রেখে এদের জন্য প্রয়োজনীয় কৰ্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। এটি এমন একটি বাধ্যতামূলক দায়িত্ব, যা কোন শাসকই পরিপূর্ণরূপে পালন করতে পারেন না—যতক্ষণ না তিনি এ ক্ষেত্রে নিজের অন্তর থেকে উৎসাহ-অনুপ্রেরণা পান এবং আল্লাহ্‌র নিকট সাহায্যপ্রার্থী হন। এটা তার পক্ষেই সম্ভব, যিনি এই অবশ্যকরণীয় ও পালনীয় দায়িত্বটি নিজের কাঁধে উঠিয়ে নিতে পারেন এবং তা পালন করতে গিয়ে যে সব কষ্ট ও অসুবিধা দেখা দেবে তা ধৈর্যের সাথে মুকাবিলা করার মত সৎসাহসের অধিকারী হন।

“ফৌজে ঐ সব লোকের মঙ্গল ও স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের দিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখবে, যারা তোমার মতে আল্লাহ্ এবং তাঁর রসূল (সা)-এর উপর গভীরভাবে বিশ্বাসী, যারা ক্রোধের মুহূর্তে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে ঠাণ্ডা মাথায় অভিযোগ শ্রবণ করতে পারেন, যারা দুর্বলকে সাহায্য এবং শক্তিশালীকে পরাভূত করতে পারেন এবং যারা যে কোন পরিস্থিতিতে বিচলিত কিংবা উত্তপ্ত হন না।

“যে সব পরিবার খ্যাতি, বিশ্বস্ততা এবং গৌরবোজ্জ্বল অতীতের অধিকারী—তাদেরকে নৈকট্য দান করবে এবং সাহসী বীর, সত্যবাদী, দানশীল এবং উত্তম স্বভাববিশিষ্ট লোকদেরকে নিজের দিকে টেনে নেবে। কেননা এসব লোকই সমাজ ও রাষ্ট্রের সৌন্দর্য।

জনগণের সঙ্গে সদাচরণ

“লোকের সঙ্গে ঠিক সেরূপ ব্যবহার করবে—যেরূপ ব্যবহার তুমি তোমার শিশু সন্তানের সাথে করে থাক। যদি তাদের উপর কোন অনুগ্রহ করে থাক তাহলে সেজন্য তাদেরকে খোটা দিও না। এমত আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি জনসাধারণকে তোমার প্রতি কল্যাণকামী করে তুলবে। তাদের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর প্রয়োজনের প্রতি মনোযোগ দেবে। তুমি তাদেরকে সাধারণভাবে যে সাহায্য প্রদান করেছ, সেটাকে যথেষ্ট মনে ক’র না। কেননা সময় বিশেষে তাদের একটি মামুলী প্রয়োজনের দিকে মনোযোগ দিলেও তাদের জীবন আরাম ও প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। নিশ্চিত জেনে রেখ, এসব লোক তোমাকে প্রয়োজন মুহূর্তে কখনো ভুলে যাবে না।

সেনাপতি নির্বাচন ও এতদ্‌সম্পর্কিত বিষয়

“সেনাপতি হিসাবে তুমি এমন ব্যক্তিকে নির্বাচন করবে, যিনি আপন লোকদের সাহায্য করাকে নিজের জন্য অবশ্য কর্তব্য মনে করেন; যিনি তার অধীনস্থ লোকদের প্রয়োজন পূরণ করতে পারেন, তাদের পরিবার-পরিজনদের দেখাশোনার ব্যাপারেও প্ৰয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন। মোটকথা, তার আচার-আচরণ এমন হবে যে, গোটা সেনাবাহিনী যেন শোকে ও আনন্দে, হর্ষ ও বিষাদে তাঁকে নিজেদেরই আপন লোক হিসাবে মনে করে। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের প্রতি এই একাত্মতা তাদেরকে শত্রুর বিরুদ্ধে অধিকতর শক্তি যোগাবে। সেনাবাহিনীর সদস্যদের সাথে সর্বদা ভালবাসার সম্পর্ক কায়েম রাখবে, যাতে তারা হামেশাই তোমার প্রতি প্রীত থাকে। বাস্তব সত্য এই যে, শাসন কর্তৃত্বে সমাসীন ব্যক্তিদের প্রকৃত আনন্দ ও তৃপ্তি এখানেই যে, দেশে ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রীতি ও ভালবাসার সম্পর্ক বজায় রয়েছে। জনগণের আন্তরিকতাপূর্ণ আবেগের প্রকাশ এই প্রীতি ও ভালবাসা থেকেই ঘটে, আর শাসকদের নিরাপত্তা এর উপরই নির্ভরশীল। তোমার উপদেশ তাদের কোন উপকারেই আসবে না, যতক্ষণ না তুমি সাধারণ সৈনিক ও অফিসার উভয়ের প্রতি স্নেহশীল ও দয়াপরবশ হবে। তা হলে সরকারের কোন কর্মপন্থাই তাদের কাছে কষ্টকর ও যন্ত্রণাদায়ক মনে হবে না এবং একে বানচাল করতেও তারা পরস্পরের সহযোগী হবে না।

“তাদের প্রয়োজনসমূহ সর্বদা পূরণ করতে থাকবে এবং তাদের সেবা ও আনুগত্যের প্রশংসা করবে। এমন আচরণ বীর সৈনিকদেরকে অধিকতর বীরত্বব্যঞ্জক কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করবে এবং ভীরুদেরকেও সাহসিকতাপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণে অনুপ্রাণিত করবে।

“অন্যের আবেগের সাথে আন্তরিকভাবে শরীক হতে চেষ্টা ক’র এবং একের ভুলকে অন্যের প্রতি নিক্ষেপ ক’র না। যে পুরস্কৃত হবার উপযোগী তাকে পুরস্কার প্রদানে দ্বিধা করবে না। তুমি এমন কোন ব্যক্তিকে অনুগৃহীত করবে না, যে কোন কাজ করে না, কেবল খান্দানী মান ইযযতের আশ্রয় নিয়েই বেঁচে থাকতে চায়। কোন ব্যক্তিকে তার কৃতিত্বপূর্ণ কর্ম সম্পাদনের বিনিময়ে প্রাপ্য পুরস্কার থেকে কেবল এই অজুহাতে বঞ্চিত করবে না যে, সে সমাজের নীচু শ্রেণী থেকে এসেছে।

প্রকৃত নেতৃত্ব

“যদি কখনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে সন্দেহে নিপতিত হও তাহলে দিক-নির্দেশনার জন্য আল্লাহ্ এবং তাঁর রসূলের দিকে ধাবিত হও। আল্লাহ্ যে সমস্ত লোককে সঠিক পথে পরিচালিত করতে চান তাদের প্রতি তাঁর নির্দেশ হ’ল, ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য কর এবং ঐ ব্যক্তির আনুগত্য কর যিনি তোমাদের মধ্য থেকে শাসন কর্তৃত্বে সমাসীন হয়েছেন। যদি কখনো কোন বিষয়ে মতভেদ দেখা দেয় তবে তা আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও।’ আল্লাহ্‌র দিকে ফিরিয়ে দেওয়ার অর্থ তাঁর প্রেরিত গ্রন্থের প্রতি ফিরিয়ে দেওয়া এবং রসূলের দিকে ফিরিয়ে দেওয়ার অর্থ তাঁর হাদীছের অনুসরণ করা।

কাযীউ’ল-কুযাত (চীফ জাস্টিস) মনোনয়ন

কাযীদের মধ্য থেকে সর্বোত্তম ব্যক্তিকে কাযীউ’ল-কুযাত মনোনীত করবে। তিনি এমন ব্যক্তি হবেন, যিনি পারিবারিক চিন্তা-ভাবনা দ্বারা পীড়িত নন, যাঁকে ভয় দেখানো যায় না, যিনি কারো ধমকের ভয়ে ভীত নন, যিনি বারবার ভুল করেন না কিংবা একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করেন না, যিনি একবার সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তা থেকে সরে যান না, যিনি আত্মকেন্দ্রিক নন, যিনি সকল ঘটনার আনুপূর্বিক বিবরণ না জেনে ফয়সালা প্রদান করেন না, যিনি প্রতিটি সন্দেহমূলক বিষয়কে সতর্কতার সঙ্গে মেপে দেখেন এবং সমস্ত কথাকে গভীরভাবে ভেবে-চিন্তে তবেই ফয়াসালা দেন, যিনি উকিল কিংবা আইনজীবীর পেশকৃত সাক্ষ্য-প্রমাণের উপর জিদ করেন না, যিনি ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি গ্রন্থি ধৈর্যের সাথে পরখ করেন, যিনি স্বীয় ফয়সালার ক্ষেত্রে চূড়ান্তভাবে নিরপেক্ষ থাকেন, যাঁকে খোশামোদ পথভ্রষ্ট করতে পারে না এবং যিনি স্বীয় মর্যাদার কারণে গর্বিত নন। এমন লোক পাওয়া কিন্তু সহজ নয়। একবার এই পদের জন্য উপযুক্ত লোক পাওয়া গেলে তাকে নিযুক্তি দানের পর এমন একটা যুক্তিসঙ্গত সম্মানী প্রদান করবে, যদ্দ্বারা তিনি আরাম-আয়েশের সঙ্গে তাঁর মর্যাদা মাফিক জীবন ধারণ করতে পারেন এবং লোভ-লালসা থেকে ঊর্ধ্বে থাকতে পারেন। তুমি তোমার দরবারে তাঁকে এমন উচ্চাসন প্রদান করবে, যা পাবার কথা কেউ ভাবতেও পারে না।

অধীনস্থ কাযী মনোনয়ন

বেশ ভালভাবে অবহিত হও যে, কাযী মনোনয়নের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত রকমের সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। কেননা এটাই এমন একটা উচ্চ মর্যাদা যা লাভ করে ভাগ্যান্বেষী আত্মকেন্দ্ৰিক লোকেরা অবৈধভাবে ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা আদায়ের প্রত্যাশী হয়। অন্যান্য কর্মকর্তা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সতর্কতা অবলম্বন এবং চিন্তা-ভাবনা করে অগ্রসর হওয়া উচিত। ঐ সমস্ত কর্মকর্তাকে তাদের পদে ততক্ষণ পর্যন্ত স্থায়ী করা উচিত নয়, যতক্ষণ না তাদের শিক্ষা লাভের কাল (প্রবেশনারী পিরিয়ড) তোমার নিকট সন্তোষজনক বিবেচিত হয়। দায়িত্বপূর্ণ পদে ব্যক্তিগত সম্পর্ক কিংবা কোনরূপ প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে কখনো লোক মনোনীত করবে না। কেননা তা বেইনসাফী ও মন্দের দিকে তোমাকে টেনে নিয়ে যেতে পারে।

উচ্চপদের জন্য এমন অভিজ্ঞ লোক নির্বাচন কর, যার ঈমান শক্তিশালী এবং যিনি উচ্চ বংশজাত। এ ধরনের লোক সহজে লোভের শিকার হবে না, বরং অন্যের চিরন্তন ও স্থায়ী কল্যাণের দিকে দৃষ্টি রেখে স্বীয় দায়িত্ব পালন করে যাবে। এসব কর্মকর্তাদের বেতন বাড়িয়ে দাও, যাতে তারা নিশ্চিন্তে ও নিরুদ্বেগে জীবন যাপন করতে পারে। এতে তারা কখনো তাদের অধীনস্থ লোকদের উপার্জনের উপর নিজেদের প্রয়োজন পূরণের নিমিত্তে কোন রূপ ট্যাক্স বসাবে না এবং তোমার নির্দেশ অমান্য করার কিংবা রাষ্ট্রীয় অর্থকড়ি অহেতুক ও অযথা অপচয়ের কোন অজুহাতও তাদের থাকবে না। অতঃপর তাদের অজ্ঞাতে তাদের উপর বিশ্বস্ত, সৎ ও যোগ্য লোক তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত কর। আশা করা যায় যে, তাদের ভেতর জনকল্যাণের প্রতি সত্যিকারের আকর্ষণ সৃষ্টি হবে। কিন্তু যেই তাদের কারোর উপর অবিশ্বস্ততার অভিযোগ উত্থাপিত হবে এবং তোমার গোপন তত্ত্বাবধায়ক ও উক্ত অভিযোগের সত্যতা সমর্থন করবে, তখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে শাস্তি প্রদান কর। সে শাস্তি দৈহিক হবে এবং তা নির্দিষ্ট স্থানে ও সাধারণ্যে হতে হবে।

কৃষি ও রাজস্ব বিভাগ

রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, যাতে যারা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন পূরণে রাজস্ব প্রদান করে থাকে তাদের কল্যাণ সুরক্ষিত হয়। রাজস্ব দাতাদের কল্যাণ ও প্রাচুর্যের উপরই অপরাপর শ্রেণী তথা গোটা জাতির কল্যাণ নির্ভরশীল। প্রকৃতপক্ষে রাজস্বের উপরই গোটা রাষ্ট্রের অস্তিত্ব টিকে থাকে। রাজস্বের কৃষি জমির উর্বরতার প্রতি দৃষ্টিদান ও এর সংরক্ষণ অধিক গুরুত্ববহ। জমির উপযুক্ত সংরক্ষণ ও উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি ছাড়া রাজস্বের পরিমাণ বৃদ্ধি হয় না। জমির উর্বরতা বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের ব্যাপারে কৃষককে সাহায্য না করে যে শাসক রাজস্ব চেয়ে বসেন, তিনি কৃষককুলের উপর তাদের সহ্যাতীত বোঝা চাপিয়ে থাকেন এবং দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করেন। এ ধরনের অত্যাচারী শাসকের অধীনে দেশ বেশীদিন চলতে পারে না। যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারী, অনাবৃষ্টি কিংবা অতিবৃষ্টির কারণে কিংবা ভূমির অনুর্বরতা অথবা প্লাবনের কারণে ফসল নষ্ট হয়ে যায় এবং এই প্রেক্ষিতে কৃষকরা করের পরিমাণ কমানোর জন্য আবেদন করে তাহলে তাদের আবেদন অনুযায়ী করের পরিমাপ কমিয়ে দাও, যেন তারা তাদের অবস্থা সামলে নিতে পারে। এতে রাজস্বে ঘাটতি দেখা দেবে; তুমি তার পরওয়া করবে না। কেননা রাষ্ট্রের সচ্ছলতা ও প্রাচুর্য ফিরে এলে তুমি এই ক্ষতি পুষিয়ে নেবার এবং দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এবং মান-মর্যাদা উন্নততর করার সুযোগ পাবে। তখন তুমি বিশ্বে একজন প্রশংসাধন্য ব্যক্তিতে পরিণত হবে এবং জনসাধারণ তোমার ন্যায় ও সুবিচারপূর্ণ অনুভূতির প্রশংসা করবে। এর পরিণতিতে তারা তোমার উপর যে আস্থা স্থাপন করবে তাতে তোমার এবং সমগ্র জাতির শক্তি বৃদ্ধি পাবে। তোমার বিপদের দিনে জনসাধারণই স্বেচ্ছাকৃতভাবে তোমার সাহায্যে এগিয়ে আসবে।

যত বেশী পরিমাণে চাও, যমীনে লোক বসতি স্থাপন কর। কিন্তু জমির অবস্থা উন্নয়নে যদি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না কর তাহলে তাদের মধ্যে অতৃপ্তি ও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়বে। কৃষকদের ধ্বংসের কারণ ঐসব শাসক, যারা যে কোন মূল্যে কেবল সম্পদ আহরণে ব্যস্ত থাকে এই ভয়ে যে, না-জানি কখন আবার সরকারের আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যায়। এরা সেই সমস্ত লোক—যারা উপদেশমূলক দৃষ্টান্ত এবং অতীত ঘটনাবলী থেকে কোন শিক্ষাই গ্রহণ করে না।

অফিস ব্যবস্থাপনা (সচিবালয়)

সরকারী অফিস এবং সেখানে আসীন সচিবদের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখ এবং তাদের মধ্যকার সর্বোত্তম লোকদেরকে সরকারের গোপনীয় চিঠিপত্র ও লিখিত নির্দেশাদি নির্বাহের কাজে মনোনীত কর। সর্বোত্তম লোক তারাই, যারা যোগ্য এবং পরিপূর্ণ বিশ্বস্ত, যারা কখনো তাদের পদমর্যাদার অবৈধ সুযোগ নিয়ে তোমাকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে না, নিজেদের দায়িত্ব পালনে গাফলতি কিংবা অলসতার আশ্রয় নেবে না, রাষ্ট্রীয় চুক্তিপত্রের খসড়া প্রস্তুতের ক্ষেত্রে বহিঃশক্তির প্রলোভনের শিকার হবে না, তোমার স্বার্থ অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, তোমাকে সঠিক ও যথার্থ সাহায্য করতে ব্যর্থ হবে না এবং তোমাকে চিন্তা-ভাবনা ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থেকে বাঁচাতে পারবে। স্রেফ ধারণার ভিত্তিতে লোক নির্বাচন করবে না। কেননা বাস্তবে এমন বহু লোক আছে, যারা প্রকৃতই বিশ্বস্ততা ও যোগ্য প্রশিক্ষণ থেকে বঞ্চিত, কিন্তু নিজেদের লম্বা চওড়া দাবী ও গালভরা বুলি দ্বারা শাসকের সামনে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণে সচেষ্ট থাকে। তাদেরকে উপযুক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরই কোন কাজে নিযুক্ত করা যেতে পারে। এ পরীক্ষা-নিরীক্ষা সততা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে হতে হবে। সাধারণ জনগণের মধ্য থেকে কাউকে কোন পদে নিযুক্ত করার আগে খেয়াল রাখবে, সে লোকের ভেতর প্রভাবশালী এবং ঈমানদারীর দিক দিয়েও মশহুর কিনা। এ ধরনের নির্বাচনই আল্লাহ্‌র নিকট এবং শাসকের নিকট সমভাবে পসন্দনীয়। রাষ্ট্রের প্রতিটি শাখায় এমন একজনকে প্রধান নিয়োগ করা দরকার, যাকে কোন পরিস্থিতিই পেরেশান করতে পারবে না, এমনকি বিক্ষোভ সৃষ্টিকারী লোকেরাও।

মনে রাখবে, তোমার কর্মচারী ও সচিবদের মধ্যে যে সব দুর্বলতা রয়েছে, তা তুমি দেখেও যদি না দেখার ভান কর, তাহলে তোমার আমলনামা তোমার বিরুদ্ধেই লেখা হবে।

বাণিজ্য ও শিল্প

শিল্পকর্মে এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত লোকদের জন্য উপকারী ও ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত গ্রহণ কর এবং বিজ্ঞোচিত পরামর্শ দ্বারা তাদেরকে সাহায্য কর। তাদের কতক লোক শহরে অবস্থান করে আর কতক লোক এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মালমাত্তা ও অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে ফেরী করে বেড়ায়। এভাবে তারা স্বহস্তে উপার্জিত অর্থ দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করে। শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য রাষ্ট্রীয় আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। এই পেশার সাথে জড়িত লোকেরা শান্তি ও নিরাপত্তা পসন্দ করে। বরং বলা চলে, অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কোন যোগ্যতাই তাদের নেই। দেশের প্রান্তে প্রান্তে যাও এবং এই দলটি সম্পর্কে ব্যক্তিগত জানাজানির সম্পর্ক সৃষ্টি কর। তাদেরকেও জানতে চেষ্টা কর। মনে রাখবে, এদের মধ্যেও এমন লোভী লোক রয়েছে যারা কায়কারবারে বিশ্বস্ত নয়। তারা খাদ্যশস্য, আহার্য দ্রব্য জমা করে এবং ভীষণ চড়ামূল্যে বিক্রয় করতে চেষ্টা করে।

তাদের এই আচরণ জনসাধারণের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই দুরাচারীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করা শাসকের সুনামের পক্ষে কলঙ্কস্বরূপ। খাদ্য-শস্য গুদামজাতকরণ থেকে তাদেরকে বিরত রাখবে। কেননা রসূলুল্লাহ (সা) তা করতে নিষেধ করেছেন। খেয়াল রাখবে যেন ব্যবসা-বাণিজ্য সুলভে সম্পন্ন হয়। মাপ-জোখের ক্ষেত্রে যাতে সুবিচার রক্ষিত হয়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখবে। পণ্যদ্রব্যের মূল্য এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে, যাতে ক্রেতা-বিক্রেতা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। তোমার সতর্কীকরণের পরও যদি কেউ তোমার নির্দেশ অমান্য করে এবং সম্পদ গুদামজাতকরণের মত অপরাধে লিপ্ত হয়, তাহলে যথোপযুক্ত শাস্তি দেবে।

গরীবদের অধিকার

“সতর্ক ও সাবধান হও এবং আল্লাহকে ভয় কর—যখন গরীবদের সমস্যা তোমার সামনে পেশ করা হয়। তাদের কোন বন্ধু নেই, সহায় নেই, আশ্রয় নেই। তারা বড় নিঃস্ব; তাদের মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত। তারা যুগের আবর্তন-বিবর্তনের শিকার। তাদের ভেতর এমন কিছু লোক রয়েছে, যারা নিজের ভাগ্যের সঙ্গে লড়াই না করে বরং ভাগ্যের নিকট আত্মসমর্পণ করেছে এবং শত দুঃখ-কষ্ট সত্ত্বেও কারো কাছে হাত পাতে না। আল্লাহর ওয়াস্তে এদের অধিকারের হেফাজত কর। কেননা এদের দায়িত্ব রয়েছে তোমারই উপর। বায়তুলমালের একটি অংশ তুমি এদের অবস্থার উন্নয়নে নিয়োজিত কর। তারা দূরে অথবা নিকটে যেখানেই থাকুক না কেন—তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব তোমার উপর—তোমার কোন ব্যস্ততাই যেন তাদের কল্যাণ চিন্তাকে তোমার মস্তিষ্ক থেকে দূরে সরিয়ে দিতে না পারে। কেননা তাদের অধিকার সম্পর্কে তোমার নিস্পৃহ মনোভাবের পক্ষে কোন ওযরই আল্লাহ্‌র দরবারে গৃহীত হবে না। তাদের স্বার্থকে তোমার স্বার্থ চিন্তার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে কর না এবং নিজের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির গণ্ডী থেকে তাদেরকে বহিষ্কার করে দিও না। সে সব লোককে চিনে রাখ, যারা গরীবদের ঘৃণা ও অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে এবং তাদের অবস্থা সম্পর্কে তোমাকে অনবহিত রাখে।

“তোমার নিয়োজিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ভেতর থেকে এমন কিছু লোক বাছাই করে নাও, যারা কোমল হৃদয়, আল্লাহ্‌ভীরু এবং যারা গরীবদের অবস্থা সম্পর্কে তোমাকে যথাযথ অবহিত রাখবে। এ সব গরীব লোকের জন্য এমন ব্যবস্থা কর যাতে কিয়ামতের দিনে আল্লাহ্‌র সামনে তোমাকে কোন ওযর পেশ করতে না হয়। কেননা এরাই তোমার সদয় ও সহানুভূতিপূর্ণ ব্যবহার পাবার বেশী হকদার। সবার প্রাপ্য অধিকার প্রদান করে আল্লাহ্‌র নিকট পুরস্কার প্রার্থী হও। তাদের ভেতর যে সব বৃদ্ধ রুযী-রোজগারের সামর্থ্য রাখে না এবং ভিক্ষাবৃত্তির দিকেও যাদের কোন প্রবৃত্তি নেই, তাদের প্রয়োজন পূরণকে তুমি তোমার পবিত্ৰ দায়িত্ব ও কর্তব্য জ্ঞান কর। এই অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পাদন সাধারণভাবে শাসকদের নিকট কষ্টকর মনে হয়। কিন্তু সেসব কর্মকর্তা ও কর্মচারী জনপ্রিয়, যারা দূর দৃষ্টিসম্পন্ন, নম্র হৃদয় ও মুত্তাকী—প্রকৃত অর্থে তারাই একাগ্রতার সঙ্গে ঐ সব দায়িত্ব পালনে ব্রতী হয়।

সাধারণ বৈঠক

কাজের ফাঁকে ফাঁকে মজলুম এবং দরিদ্র শ্রেণীর লোকের সঙ্গে সাধারণ বৈঠকে মিলিত হবে এবং ‘আল্লাহ্ তোমার সাথে আছেন’—এই অনুভূতি নিয়েই তাদের সঙ্গে খোলা মন নিয়ে কথাবার্তা বলবে। সে সময় তুমি তোমার ফৌজ, পাহারাদার, দেওয়ানী বিভাগের অফিসার, পুলিশ অথবা বার্তা সংস্থার কর্মচারী—কাউকেই কাছে থাকতে দেবে না, যাতে করে দরিদ্র শ্রেণীর লোকদের পক্ষে তাদের কোন প্রতিনিধি তাদের অভিযোগ নিঃশঙ্কচিত্তে এবং দ্বিধাহীনভাবে তোমার কাছে বলতে পারে। আমি আল্লাহ্‌র রাসূলকে বলতে শুনেছি: এমন কোন জাতি-গোষ্ঠী কিংবা দল উচ্চতর মর্যাদা লাভ করতে পারে না যাদের সবল দুর্বলের ব্যাপারে তার দায়িত্ব পালন করে না। প্রশান্তচিত্তে সহ্য কর যদি দুর্বল কোন শক্ত কথাও তোমাকে বলে ফেলে। যদি সে সহজ-সরল ভাষায় তোমার কাছে তার অবস্থা বর্ণনা করতে সক্ষম না হয় তবু বিরক্তি বোধ ক’র না। তাহলে আল্লাহ্ তোমার জন্য স্বীয় রহমত ও করুণার উৎসমুখ খুলে দেবেন। তুমি তাদের যা কিছু দিতে পার—অসংকোচে তা দিয়ে দাও। তুমি যা তাদের দিতে পার না, অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে তা তাদের জানিয়ে দাও।

“এমন কতকগুলো বিষয় আছে যেগুলোর জন্য তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। সেরেস্তার মহুরীদের অভিযোগ দূর করবার জন্য তোমার অফিসারদের কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত থাক। খেয়াল রাখবে—যেদিন তোমার নিরীক্ষণের জন্য কোন আর্জি কিংবা দরখাস্ত দাখিল করা হবে, সেদিনই যেন সে সম্পর্কিত তথ্যাদি তোমার জানা হয়ে যায়—চাই কি তোমার অফিসার মাঝখানে আড় হয়ে দাঁড়াতে যতই চেষ্টা করুক। প্রতিদিনের কাজ প্রতিদিনেই শেষ করে ফেল। কেননা আগামী দিন তোমার সামনে আরও অনেক কাজ এসে হাযির হবে।

নিয়মিত ‘ইবাদত

নিজের সর্বোত্তম মুহুর্তগুলোকে আল্লাহ্‌র সমীপে হাযির হবার জন্য নির্দিষ্ট করে রাখ, যদিও তোমার প্রতিটি মুহূর্ত সে উদ্দেশ্যেই নিবেদিত। তবে পূর্বশর্ত হ’ল, জনসাধারণের জন্য নির্ধারিত মুহূর্তগুলো অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে তাদেরই সেবায় নিয়োজিত করতে হবে। নির্ধারিত সালাত আদায়ে দিনরাত নিজেকে মশগুল রেখ এবং পরিপূর্ণ নিবেদিত-চিত্ততা হাসিল করতে যতটা সম্ভব নিজের সালাতকে ক্লান্তিকর ও একঘেয়েমী থেকে মুক্ত রাখ। যখন তুমি সালাতে ইমামতি কর তখন সালাতকে এতটা দীর্ঘ করবে না, যাতে করে জামা’আতে শরীক অন্যান্য লোকের কষ্ট হয় কিংবা মুসল্লীদের ভেতর বিরক্তিকর অনুভূতির সৃষ্টি হয়। এতে সালাতের যে গুণগত প্রভাব, তা নষ্ট হয়ে যায়। তাছাড়া জামা’আতে এমনও লোক থাকতে পারে, যারা অসুস্থ কিংবা যাদেরকে সালাত শেষে অন্যান্য জরুরী কাজে মনোনিবেশ করতে হবে।

“য়ামান যাবার নোটিশ পেয়ে আমি যখন রাসূলুল্লাহ (সা)-কে জিজ্ঞাসা করলাম: আমাকে সেখানে কিভাবে সালাতে ইমামতি করতে হবে? তখন তিনি বললেন, ‘এভাবে যেভাবে তোমাদের ভেতরকার সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিটি আদায় করে।’ ঈমানদারদের আরামের দিকে খেয়াল রাখার দৃষ্টান্ত স্থাপন কর।

সন্ধি ও চুক্তি

“উল্লিখিত বিষয়গুলো আমল করবার সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি কথা তোমার স্মৃতিতে গেঁথে নাও : নিজেকে এক মুহূর্তের জন্যও জনগণের সঙ্গে সম্পর্কহীন রাখবে না। নিজেকে জনগণের সঙ্গে সম্পর্কহীন রাখা তাদের অবস্থা সম্পর্কে নিজেকে বেখবর রাখারই নামান্তর। এটা শাসকের মনে ভুল দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয় এবং তাকে প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয়, ভুল ও বিশুদ্ধ এবং হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণের অযোগ্য করে তোলে।

“আসল কথা, তোমার ভেতর দু’টি বিষয়ের একটি থাকতেই হবে; হয় তুমি বিচারক, নয়ত অবিচারক। যদি তুমি বিচারক হও তাহলে তুমি নিজেকে লোকের সঙ্গে সম্পর্কহীন রাখবে না; বরং তাদের কথা ও অভিযোগ শুনবে এবং তাদের প্রয়োজনসমূহ পূরণ করবে। আর তুমি যদি বিচারক না হও তাহলে লোকেরাই তোমার থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে রাখবে। নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার মধ্যে কোন্ কল্যাণটা আছে বল? মোটকথা, জনগণ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা কোন ভাল কথা নয়। বিশেষ করে লোকের প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রাখা যখন তোমার একটি অপরিহার্য দায়িত্ব (ফরয)। তোমার নিয়েজিত পদাধিকারী লোকদের জুলুম, অত্যাচার ও বেইনসাফীর কথা শ্রবণ করা তোমার জন্য বিরক্তিকর হওয়া উচিত নয়। তুমি বেশ ভাল করে বুঝে নাও যে, তোমার আশেপাশে যেসব লোক রয়েছে তারা তাদের পদমর্যাদা দ্বারা অবৈধ ফায়দা লুটতে চাইবে। অন্যের প্রাপ্য তারা নিজেরা হাসিল করতে চাইবে এবং অন্যায় ও অবিচারমূলক কাজ করবে। তাদের এ ধরনের প্রবণতাকে দাবিয়ে দেওয়াকে তুমি তোমার নিয়মিত রুটিনে পরিণত কর। তুমি কোন দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিকে একখণ্ড ভূমিও দেবে না। এটা তোমাকে অন্যের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করা থেকে অনেকাংশে বিরত রাখবে। আল্লাহ্ ও তদীয় বান্দা মানুষের অসন্তুষ্টি থেকে তুমি নিজেকে বাঁচিয়ে রাখ।

“আত্মীয়-অনাত্মীয়ের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য না করে পরিপূর্ণ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে। তোমার আত্মীয়-বান্ধবের মধ্যে কেউ যদি কোন আইন ভঙ্গ করে তাহলে নির্ধারিত আইন অনুযায়ী তাকেও শাস্তি দাও—চাই তা তোমার ব্যক্তিসত্তার জন্য যতই কষ্টকর হোক। তোমার এই নীতি রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর প্রমাণিত হবে। যদি কখনো লোকে তোমার সম্পর্কে সন্দেহ করে যে, তুমি কোন বিষয়ে তাদের প্রতি অবিচার করেছ তাহলে সে বিষয়ে তোমার ধ্যান-ধারণা তাদের সামনে পরিষ্কার ভাষায় তুলে ধর এবং তাদের সন্দেহের অপনোদন কর। এভাবে তোমার মস্তিষ্ক ইনসাফ ও সুবিচারের রঙে রঞ্জিত হবে এবং লোকে তোমাকে ভালবাসতে থাকবে। এতে করে তাদের আস্থা অর্জনের পথ খোলাসা হবে।

নির্বিকার ও নিস্পৃহ মানসিকতা সমীচীন

“এ বিষয়ে তুমি খেয়াল রাখবে যে, দুশমনের পক্ষ থেকে আগত সন্ধির আবেদন তুমি প্রত্যাখ্যান করবে না—বরং গ্রহণ করবে। কেননা আল্লাহ্ এতে খুশী হবেন। সন্ধি ও সমঝোতা ফৌজের জন্য সন্তোষের বিষয়। তা তোমার দুশ্চিন্তাকে কম করে দেবে এবং দেশে শান্তি ও নিরাপত্তার আয়ুষ্কাল বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু খবরদার! যে মুহুর্তে সন্ধিপত্রে দস্তখত দেবে, তখন সতর্ক ও সজাগ থাকবে। কেননা কতক দুশমন প্রতিপক্ষকে শুধু ধোঁকা দেবার জন্য সন্ধির শর্তাবলী পেশ করে থাকে। মিথ্যা আশ্বাসের উপর যখন প্রতিপক্ষ নড়বার প্রস্তুতি ছেড়ে দেয় তখন সে তার উপর দ্বিতীয়বার হামলা করে। অতএব তোমাকে মাত্রাতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হবে। শত্রুর কথা বেশী মাত্রায় বিশ্বাস করা ঠিক হবে না। তবে সন্ধিপত্রের আওতাধীনে তুমি যদি কিছু যিম্মাদারী কবুল করে থাক তাহলে ঈমানদারীর সাথে তা পালন করবে। সন্ধিপত্র একটি ওয়াদা। বিশ্বস্ততার সঙ্গে তার উপর কায়েম থাকতে হবে। যদি কখনো কোন প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হও তাহলে যে কোন মূল্যে তা পালন করতে হবে। কেননা প্রতিজ্ঞা পূরণের চেয়ে উত্তম বস্তু আর নেই। অমুসলিমরাও এটা স্বীকার করে। তারাও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ফলাফল ও মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। কখনো নিজ যিম্মাদারী আদায়ের ক্ষেত্রে ওযর তালাশ করো না। কখনো প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করো না, কখনো শত্রুকে ধোঁকা দিও না। প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ আল্লাহ্‌র বিরোধিতারই শামিল। প্রকাশ্য বদকার ছাড়া অনুরূপ কাজ কেউ করে না।

“তবে এমন কোন প্রতিজ্ঞা কর না, যেখান থেকে পরবর্তীকালে সরে আসতে তোমাকে ওযর কিংবা বাহানা পেশ করতে হয়। কখনো ওয়াদা থেকে ফিরে যেও না কিংবা তা ভঙ্গও কর না। ভয় পেয়ে ওয়াদা ভঙ্গ করবার চেয়ে ধৈর্যের সঙ্গে ভাল ফলাফল ও উত্তম পরিণতির জন্য অপেক্ষা করাই শ্রেয়।

রক্তপাত

“অন্যায় রক্তপাত থেকে বিরত থাক। এর চেয়ে ক্ষতিকর জিনিস আর কিছুই হতে পারে না। সজ্ঞানে রক্তপাত রাষ্ট্রের জীবনী শক্তিকে কমিয়ে দেয়। হাশরের ময়দানে মানুষকে সর্বপ্রথম রক্তপাতজনিত অপরাধের জওয়াবদিহি করতে হবে। অতএব সতর্ক ও সাবধান হও। রক্তপাতের মাধ্যমে সরকারের শক্তি বৃদ্ধির কোশেশ কোরো না। এটা শেষতক দেশকেই ধ্বংস করবে এবং অন্যের হাতে তা তুলে দেবে। আমার এবং আমার মহান স্রষ্টার দরবারে অন্যায় প্রাণহানির কোন ওযর শোনা হবে না।

“হত্যা করা একটি অপরাধ—যার শাস্তি মৃত্যু। যদি হুকুমতের পক্ষ থেকে কোন লঘু পাপ ও অপরাধের কারণে কোন ব্যক্তিকে দৈহিক সাজা দিতে গিয়ে তার মৃত্যু হয় তাহলে ঐ মৃত ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজনের কিসাসের দাবীকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার প্রশ্ন উঠিয়ে কখনো আড়াল করে ফেল না।

শেষ হেদায়েত

“নির্ধারিত সময়ের পূর্বে কোন কাজ করবার জন্য তাড়াহুড়া কর না। আর যখন সঠিক মুহূর্ত এসে যাবে, তখন কোন কাজ মূলতবী রেখো না। জিদের বশবর্তী হয়ে কোন ভুল কাজ কর না। ভুল ধরা পড়া মাত্রই তা শুধরে নিতে আলস্যের আশ্রয় নিও না। প্রতিটি কাজ যথার্থ ও সঠিক মুহূর্তে কর এবং প্রতিটি বস্তুকেই তার উপযুক্ত স্থানে রাখ। যখন গোটা জাতি কোন মতের উপর ঐক্যবদ্ধ হয় তখন তুমি তোমার একক রায়কে তার উপর চাপিয়ে দিও না। নিজের উপর যে যিম্মাদারী অর্পিত হয় তা পালন করতে কখনো আলস্যের আশ্রয় নিও না। কেননা জাতির দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকবে তোমার প্রতি। তুমি যার সঙ্গে যে ব্যবহার করবে তার জন্য তোমাকেই জওয়াবদিহি করতে হবে। অবশ্যপালনীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে এতটুকু পৃষ্ঠপ্রদর্শন কর না। ক্রোধ সংবরণ কর এবং হাত ও মুখকে সংযত রাখ। অন্যথায় তুমি কেবল তোমার অশান্তিই বাড়াবে।

“সেসব মূলনীতির গভীর অধ্যয়ন তোমার জন্য অপরিহার্য, যেসব মূলনীতি তোমার পূর্ববর্তী শাসকদেরকে পথ প্রদর্শন করেছে। আল্লাহ্‌র কিতাবের বিধান, নবী করীম (সা)-এর নির্দেশ এবং যা কিছু আমার কর্মপন্থা থেকে লাভ করেছ—তা গভীরভাবে অনুধাবন করবে। যে পথ-নির্দেশনা আমি তোমাকে দিয়েছি এবং যার উপর আমল করবার ওয়াদা তুমি করেছ—তার উপর সুদৃঢ় থাকতে তুমি সাধ্যমত চেষ্টা করবে। আমি তোমাকে তাকীদ করছি যে, তুমি কখনো তোমার প্রবৃত্তিজাত কামনা-বাসনার সামনে ঝুঁকে পড়বে না এবং নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন থেকে পৃষ্ঠ-প্রদর্শন করবে না।

“আমি সর্বশক্তিমান স্রষ্টার কুদরত ও অসীম রহমতের আশ্রয় প্রার্থনা করছি এবং তোমাকে আমার সঙ্গে দু’আ করবার দাওয়াত জানাচ্ছি। আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে এই তওফীক দেন যেন আমরা আমাদের মর্যিকে তার মর্যির সাথে জুড়ে দিতে পারি। তিনি যেন আমাদেরকে তাঁর এবং তাঁর সৃষ্টির অভিযোগ থেকে মুক্ত থাকার যোগ্য বানিয়ে দেন। মানবতা যেন আমাদের হাড়ছাড়া না হয় এবং আমাদের পুণ্য-কর্ম যেন চিরস্থায়ী হয়। আমি আল্লাহ্ দরবারে তাঁর রহমতের পূর্ণতা দানের আবেদন জানাচ্ছি এবং দু’আ করছি যেন তিনি তোমাকে এবং আমাকে সে তওফীকই দেন এবং তাঁরই পথে শাহাদত লাভের মর্যাদা দান করেন। নিঃসন্দেহে আমাদেরকে তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।

“আমি আল্লাহর রসূল এবং রসূলের পরিবারবর্গের উপর দরূদ ও সালাম প্রেরণ করছি।”