রুমাহরণ
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
চক্রায়ুধ ঈশানবর্মা নামক জনৈক নাগরিকের ঘৃণিত জীবন-কাহিনী লিপিবদ্ধ করিয়াছি। দিগ্বিজয়ী চন্দ্রবর্মা পাটলিপুত্রের প্রাসাদভূমির এক প্রান্তে এক অর্ধশুষ্ক কূপমধ্যে তাহাকে নিক্ষেপ করিয়াছিলেন। কূপের মুখ ঘনসন্নিবিষ্ট লৌহজাল দ্বারা আঁটিয়া বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। এই কূপের দুর্গন্ধ পঙ্কে আ-কটি নিমজ্জিত হইয়া, ভেক-সরীসৃপ-পরিবৃত হইয়া আমার অন্তিম তিন মাস কাটিয়াছিল।
জয়ন্তী নাম্নী পুরীর এক দাসী চণ্ডালহস্তে শূকর মাংস আনিয়া প্রত্যহ সন্ধ্যায় আমার জন্য কূপে ফেলিয়া দিয়া যাইত। এই জয়ন্তীর নিকট আমি রাজা-অবরোধের অনেক কথা শুনিতে পাইতাম। জয়ন্তী সোমদত্তার সহচরী কিঙ্করী ছিল; সে সোমদত্তার মনের অনেক কথা জানিত, অনেক কথা অনুমান করিয়াছিল। সে কূপমুখে বসিয়া সোমদত্তার কাহিনী বলিত, আমি নিম্নে অন্ধকারে কীটদংশনবিক্ষত অর্ধগলিত দেহে দাঁড়াইয়া উৎকর্ণ হইয়া তাহা শুনিতাম।
একদিন জয়ন্তীকে বলিয়াছিলাম, “জয়ন্তী, আমাকে উদ্ধার করিবে? আমার বহু গুপ্তধন মাটিতে প্রোথিত আছে, যদি মুক্তি পাই, তোমাকে দশ হাজার স্বর্ণদীনার দিব। তোমাকে আর চেটীবৃত্তি করিতে হইবে না।”
ভীতা জয়ন্তী আমাকে গালি দিয়া পলায়ন করিয়াছিল, আর আসে নাই। অনন্তর চণ্ডাল একাকী আসিয়া মাংস দিয়া যাইত।
আমি একাকী এই জীবন্ত নরকে বসিয়া থাকিতাম আর ভাবিতাম। কি ভাবিতাম, তাহা বলিবার এ স্থান নহে। তবে সোমদত্তা আমার চিন্তার অধিকাংশ স্থান জুড়িয়া থাকিত। ভাবিতাম, সোমদত্তার মনে যদি ইহাই ছিল, তবে সে আমার নিকট আত্মসমর্পণ করিল কেন? যদি চন্দ্রগুপ্তকে এত ভালোবাসিত, তবে সে বিশ্বাসঘাতিনী না হইয়া আত্মঘাতিনী হইল না কেন? রমণীর হৃদয়ের রহস্য কে বলিবে? তখন এ প্রশ্নের কোন উত্তর পাই নাই।
কিন্তু আজ বহু জীবনের পরপারে বসিয়া মনে হয়, যেন সোমদত্তার চরিত্র কিছু কিছু বুঝিয়াছি। সোমদত্তা গুপ্তচর রূপে রাজ-অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া ক্রমে চন্দ্রগুপ্তকে সমস্ত মনপ্রাণ ঢালিয়া ভালোবাসিয়াছিল। কুমারদেবী চন্দ্রগুপ্তকে অবজ্ঞার চক্ষে দেখিতেন, ইহা সে সহ্য করিতে পারিত না। তাই সে সংকল্প করিয়াছিল, চন্দ্রবর্মাকে দুর্গ অধিকারে সাহায্য করিয়া পরে স্বামীর জন্য পাটলিপুত্র ভিক্ষা মাগিয়া লইবে; কুমারদেবীর প্রভাব অস্তমিত হইবে, চন্দ্রগুপ্ত সত্যই রাজা হইবেন এবং সেই সঙ্গে সোমদত্তাও স্বামীসোহাগিনী হইয়া পট্টমহিষীর আসন গ্রহণ করিবে।
আমার দুরন্ত লালসা যখন তাহার গোপন সংকল্পের উপর খড়্গের মতো পড়িয়া উহা খণ্ডবিখণ্ড করিয়া দিল, তখন তাহার মনের কি অবস্থা হইল সহজেই অনুমেয়। নিজের স্বামীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারিণী হীন গুপ্তচর বলিয়া কোন্ রমণী ধরা পড়িতে চাহে? সোমদত্তা দেখিল, ধরা পড়িলে স্বামীর অতুল ভালোবাসা সে হারাইবে; সে যে চন্দ্রগুপ্তকেই রাজ্য ফিরিয়া দিবার মানসে চক্রান্ত করিয়াছে, এ কথা চন্দ্রগুপ্ত বুঝিবে না, নীচ বিশ্বাসঘাতিনী বলিয়া ঘৃণাভরে তাহাকে পরিত্যাগ করিবে। এদিকে চক্রায়ুধের হস্তেও নিস্তার নাই, ইচ্ছায় হউক অনিচ্ছায় হউক, ধর্মনাশ নিশ্চিত। এরূপ অবস্থায় অসহায় জালবদ্ধা কুরঙ্গিণী কি করিবে?
অপরিমেয় ভালোবাসার যূপে সোমদত্তা সতীধর্ম বিসর্জন দিল। ভাবিল, আমার তো চরম সর্বনাশ হইয়াছে, কিন্তু এই মর্মভেদী লজ্জার কাহিনী স্বামীকে জানিতে দিব না। এখন আমার যাহা হয় হউক, তারপর যে জীবন ধ্বংস করিয়াছে, তাহাকে যমালয়ে পাঠাইয়া নিজেও নরকে যাইব। কিন্তু স্বামীকে কিছু জানিতে দিব না।
ইহাই সোমদত্তার আত্মবিসর্জনের অন্তরতম ইতিহাস।
কিন্তু আর না, সোমদত্তার কথা এইখানেই শেষ করিব। এই নারীর কথা স্মরণে ষোল শত বৎসর পরে আজও আমার মন মাতাল হইয়া উঠে। জানি, সোমদত্তার মতো নারীকে বিধাতা আমার জন্য সৃষ্টি করেন না— সে দেবভোগ্যা। জন্মজন্মান্তরের ইতিহাস খুঁজিয়া এমন একটিও নারী দেখিতে পাই নাই, যাহার সহিত সোমদত্তার তুলনা করিব। আর কখনও এমন দেখিব কি না জানি না।
আমি বিশ্বাস করি, জন্মান্তরের পরিচিত লোকের সহিত ইহজন্মে সাক্ষাৎ হয়। সোমদত্তার সহিত যদি আবার আমার সাক্ষাৎ হয়, জানি, তাহাকে দেখিবামাত্র চিনিতে পারিব। নূতন দেহের ছদ্মবেশ তাহাকে আমার চক্ষু হইতে লুকাইয়া রাখিতে পরিবে না।
কিন্তু সে-ও কি আমাকে চিনিতে পরিবে? ললাটে কি স্মৃতির ভ্রূকুটি দেখা দিবে? অধরে সেই অন্তিমকালের অপরিসীম ঘৃণা স্ফুরিত হইয়া উঠিবে? জানি না! জানি না!
পূর্বে বলিয়াছি যে, আমি বিশ্বাস করি, জন্মান্তরের পরিচিত লোকের সঙ্গে ইহজন্মে সাক্ষাৎ হয়। আপনি তাহার মুখের পানে অবাক্ হইয়া কিছুক্ষণ তাকাইয়া থাকেন, চিনি-চিনি করিয়াও চিনিতে পারেন না। মনে করেন, পূর্বে কোথাও দেখিয়া থাকিবেন। এই পূর্বে যে কোথায় এবং কত দিন আগে, আপনি তাহা জানেন না; আমি জানি। ভগবান আমাকে এই অদ্ভুত শক্তি দিয়াছেন। তাহাকে দেখিবামাত্র আমার মনের অন্ধকার চিত্রশালায় চিত্রের ছায়াবাজি আরম্ভ হইয়া যায়। যে কাহিনীর কোনও সাক্ষী নাই, সেই কাহিনীর পুনরাভিনয় চলিতে থাকে। আমি তখন আর এই ক্ষুদ্র আমি থাকি না, মহাকালের অনিরুদ্ধ স্রোতঃপথে চিরন্তন যাত্রীর মতো ভাসিয়া চলি। সে যাত্রা কবে আরম্ভ হইয়াছিল জানি না, কত দিন ধরিয়া চলিবে তাহাও ভবিষ্যের কুজ্ঝটিকায় প্রচ্ছন্ন। তবে ইহা জানি যে, এই যাত্রা শুরু হইতে শেষ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন অব্যাহত। মাঝে মাঝে মহাকালের নৃত্যের ছন্দে যতি পড়িয়াছে মাত্র— সমাপ্তির ‘সম’ কখনও পড়িবে কি না এবং পড়িলেও কবে পড়িবে, তাহা বোধ করি বিধাতারও অজ্ঞেয়।
মহেঞ্জোদাড়োর নগর ও মিশরের পিরামিড যখন মানুষের কল্পনায় আসে নাই, তখনও আমি জীবিত ছিলাম। এই আধুনিক সভ্যতা কয় দিনের? মানুষ লোহা ব্যবহার করিতে শিখিল কবে? কে শিখাইল? প্রত্নতাত্ত্বিকেরা পরশুমুণ্ড পরীক্ষা করিয়া এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজিতেছেন, কিন্তু উত্তর পাইতেছেন না। আমি বলিতে পারি, কবে লোহার অস্ত্র ভারতে প্রথম প্রচারিত হইয়াছিল। কিন্তু সন-তারিখ দিয়া বলিতে পারিব না। সন-তারিখ তখনও তৈয়ার হয় নাই। তখন আমরা কাঁচা মাংস খাইতাম।
চারিদিকে পাহাড়ের গণ্ডি দিয়া ঘেরা একটি দেশ, মাঝখানে গোলাকৃতি সুবৃহৎ উপত্যকা। ‘যজ্ঞিবাড়ি’তে কাঠের পরাতের উপর ময়দা স্তূপীকৃত করিয়া ঘি ঢালিবার সময় তাহার মাঝখানে যেমন নামাল করিয়া দেয়, আমাদের পর্বতবলয়িত উপত্যকাটি ছিল তাহারই একটি সুবিরাট সংস্করণ। আবার বিধাতা মাঝে মাঝে আকাশ হইতে প্রচুর ঘৃতও ঢালিয়া দিতেন; তখন ঘোলাটে রাঙা জলে উপত্যকা কানায় কানায় ভরিয়া উঠিত। পাহাড়ের অঙ্গ বহিয়া শত নির্ঝরিণী সগর্জনে নামিয়া আসিয়া সেই হ্রদ পুষ্ট করিত। আবার বর্ষাপগমে জল শুকাইত, কতক গিরিরন্ধ পথে বাহির হইয়া যাইত; তখন অগভীর জলের কিনারায় একপ্রকার দীর্ঘ ঘাস জন্মিত। ঘাসের শীর্ষে ছোট ছোট দানা ফলিয়া ক্রমে সুবর্ণবর্ণ ধারণ করিত। এই গুচ্ছ গুচ্ছ দানা কতক ঝরিয়া জলে পড়িত, কতক উত্তর হইতে ঝাঁকে ঝাঁকে হংস আসিয়া খাইত। সে সময় জলের উপরিভাগ অসংখ্য পক্ষীতে শ্বেতবর্ণ ধারণ করিত এবং তাহাদের কলধ্বনিতে দিবা-রাত্রি সমভাবে নিনাদিত হইতে থাকিত। শীতের সময় উচ্চ পাহাড়গুলার শিখরে শিখরে তুলার মতো তুষারপাত হইত। আমরা তখন মৃগ, বানর, ভল্লুকের চর্ম গাত্রাবরণ রূপে পরিধান করিতাম। গিরিকন্দরে তুষার-শীতল বাতাস প্রবেশ করিয়া অস্থি পর্যন্ত কাঁপাইয়া দিত। পাহাড়ে শুষ্ক তরুর ঘর্ষণে অগ্নি জ্বলিতে দেখিয়াছিলাম বটে, কিন্তু অগ্নি তৈয়ার করিতে তখনও শিখি নাই। অগ্নিকে বড় ভয় করিতাম।
আমাদের এই উপত্যকা কোথায়, ভারতের পূর্বে কি পশ্চিমে, উত্তরে কি দক্ষিণে, তাহা আমার ধারণা নাই। ভারতবর্ষের সীমানার মধ্যে কি না, তাহাও বলিতে পারি না। উপত্যকার কিনারায় পাহাড়ের গুহাগুলির মধ্যে আমরা একটা জাতি বাস করিতাম; পর্বতচক্রের বাহিরে কখনও যাই নাই, সেখানে কি আছে তাহাও জানিতাম না। আমাদের জগৎ এই গিরিচক্রের মধ্যেই নিবদ্ধ ছিল। পাহাড়ে বানর, ভল্লুক, ছাগ, মৃগ প্রভৃতি নানাবিধ পশু বাস করিত, আমরা তাহাই মারিয়া খাইতাম; ময়ূরজাতীয় এক প্রকার পক্ষী পাওয়া যাইত, তাহার মাংস অতি কোমল ও সুস্বাদু ছিল। তাহার পুচ্ছ দিয়া আমাদের নারীরা শিরোভূষণ করিত। গাছের ফলমূলও কিছু কিছু পাইতাম, কিন্তু তাহা যৎসামান্য; পশুমাংসই ছিল আমাদের প্রধান আহার্য।
চেহারাও আহারের অনুরূপ ছিল। মাথায় ও মুখে বড় বড় জটাকৃতি চুল, রোমশ কপিশ-বর্ণ দেহ, বাহু জানু পর্যন্ত লম্বিত। দেহ নিতান্ত খর্ব না হইলেও প্রস্থের দিকেই তাহার প্রসার বেশি। এরূপ আকৃতির মানুষ আজকালও মাঝে মাঝে দু’-একটা চোখে পড়ে, কিন্তু জামা-কাপড়ের আড়ালে স্বরূপ সহসা ধরা পড়ে না। তখন আমাদের জামা-কাপড়ের বালাই ছিল না, প্রসাধনের প্রধান উপকরণ ছিল পশুচর্ম। তাহাও গ্রীষ্মকালে বর্জন করিতাম, সামান্য একটু কটিবাস থাকিত।
আমাদের নারীরা ছিল আমাদের যোগ্য সহচরী—তাম্রবর্ণা, কৃশাঙ্গী, ক্ষীণকটি, কঠিনস্তনী। নখ ও দন্তের সাহায্যে তাহারা অন্য পুরুষের নিকট হইতে আত্মরক্ষা করিত। স্তন্যপায়ী শিশুকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া অন্যহস্তে প্রস্তরফলকাগ্র বর্ষা পঞ্চাশহস্ত দূরস্থ মৃগের প্রতি নিক্ষেপ করিতে পারিত। সন্ধ্যার প্রাক্কালে ইহারা যখন গুহাদ্বরে বসিয়া পক্ব লোহিত ফলের কর্ণাভরণ দুলাইয়া মৃদুগুঞ্জনে গান করিত, তখন তাহাদের তীব্রোজ্জ্বল কালো চোখে বিষাদের ছায়া নামিয়া আসিত। আমরা প্রস্তরপিণ্ডের অন্তরালে লুকাইয়া নিস্পন্দবক্ষে শুনিতাম— বুকের মধ্যে নামহীন আকাঙ্ক্ষা জাগিয়া উঠিত!
এই সব নারীর জন্য আমরা যুদ্ধ করিতাম, হিংস্র শ্বাপদের মতো পরস্পর লড়িতাম। ইহারা দূরে দাঁড়াইয়া দেখিত। যুদ্ধের অবসানে বিজয়ী আসিয়া তাহাদের হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া যাইত। আমাদের জাতির মধ্যে নারীর সংখ্যা কমিয়া গিয়াছিল…
কিন্তু গোড়া হইতে আরম্ভ করাই ভালো! কি করিয়া এই অর্ধপশু জীবনের স্মৃতি জাগরূক হইল, পূর্বে তাহাই বলিব।
পূজার ছুটিতে হিমাচল অঞ্চলে বেড়াইতে গিয়াছিলাম। রেলের চাকরিতে আর কোনও সুখ না থাক, ঐটুকু আছে— বিনা খরচে সারা ভারতবর্ষটা ঘুরিয়া আসা যায়। আমি হিমালয়ের কোন্ দিকে গিয়াছিলাম, তাহা বলিবার প্রয়োজন নাই,—তবে সেটা দার্জিলিং কিংবা সিমলা পাহাড় নহে। যেখানে গিয়াছিলাম সে স্থান আরও নির্জন ও দুরধিগম্য; রেলের শেষ সীমা ছাড়াইয়া আরও দশ-বারো মাইল রিক্শ কিংবা ঘোড়ায় যাইতে হয়।
হিমালয়ের নৈসর্গিক বর্ণনা করিয়া উত্ত্যক্ত পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাইব না; সচরাচর আশ্বিনমাসে পাহাড়ের অবস্থা যেমন হইয়া থাকে, তাহার অধিক কিছু নহে। গিরিক্রোড়ের এই ক্ষুদ্র জনবিরল শহরটি এমনভাবে তৈয়ারি যে, মানুষের হাতের কাজ খুব কমই চোখে পড়ে। যে পথটি সর্পিল গতিতে কখনও উঁচু কখনও নিচু হইয়া শহরটিকে নাগপাশে বাঁধিয়া রাখিয়ছে, পাইন্ গাছের শ্রেণীর দ্বারা তাহা এমনই আচ্ছন্ন যে, তাহার শীর্ণ দেহটি সহসা চোখেই পড়ে না। ছোট ছোট পাথরের বাড়িগুলি পাহাড়ের অঙ্গে মিশিয়া আছে। মাঝে মাঝে পাইনের জঙ্গল, তাহার মধ্যে পাথরের টুকরা বসাইয়া মানুষের বিশ্রামের স্থান করা আছে। রাত্রিকালে ক্বচিৎ ফেউয়ের ডাক শুনা যায়। শীত চমৎকার উপভোগ্য।
সেদিন পাইন্ গাছের মাথায় চাঁদ উঠিয়াছিল। আধখানা চাঁদ, কিন্তু তাহারই আলোয় বনস্থলী উদ্ভাসিত হইয়াছিল। আমি একাকী পাইন্ বনের মধ্যে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলাম। গায়ে ওভারকোট ছিল, মাথায় একটা অদ্ভুত আকৃতির পশমের টুপি পরিয়াছিলাম। এ দেশের পাহাড়ীরা এইরকম টুপি তৈয়ারি করিয়া বিক্রয় করে। চাঁদের আলোয় আমার দেহের যে ছায়াটা মাটিতে পড়িয়াছিল, তাহা দেখিয়া আমারই হাসি পাইতেছিল। ঠিক একটি জংলী শিকারীর চেহারা,—হাতে একটা ধনুক কিংবা বর্শা থাকিলে আর কোনও তফাত থাকিত না।
এখানে আসিয়া অবধি কোনও বাঙালীর মুখ দেখি নাই, অন্য জাতীয় লোকের সঙ্গেও বিশেষ পরিচয় হয় নাই, তাই একাকী ঘুরিতেছিলাম। বাহিরের শীতশিহরিত তন্দ্রাচ্ছন্ন প্রকৃতি আমাকে গভীর রাত্রিতে ঘর হইতে টানিয়া বাহির করিয়াছিল। এই প্রকৃতির পানে চাহিয়া চাহিয়া আমার মনে হইতেছিল, এ-দৃশ্য যেন ইহজগতের নহে, কিংবা যেন কোন্ অতীত যুগ হইতে ছিঁড়িয়া আনিয়া অর্ধ-ঘুমন্ত দৃশ্যটাকে কেহ এখানে ফেলিয়া দিয়া গিয়াছে। বর্তমান পৃথিবীর সঙ্গে ইহার কোনও যোগ নাই, চন্দ্রাস্ত হইলেই অস্পষ্ট স্বপ্নের মতো ইহা শূন্যে মিলাইয়া যাইবে।
এ বন রাত্রিকালে খুব নিরাপদ নহে জানিতাম, ফেউয়ের ডাকও স্বকর্ণে শুনিয়াছি; কিন্তু তবু এক অদৃশ্য মায়া আমাকে ধরিয়া রাখিয়াছিল। কিছুক্ষণ এদিক্-ওদিক্ ঘুরিয়া বেড়াইবার পর একটি গাছের ছায়ায় পাথরের বেদীর উপর বসিয়া পড়িলাম। নিস্তব্ধ রাত্রি। মাঝে মাঝে মৃদু বাতাসে গাছের পাতা অল্প নড়িতেছে; দু’-একটা ফল বৃন্তচ্যুত হইয়া টুপটাপ করিয়া মাটিতে পড়িতেছে। ইহা ছাড়া জগতে আর শব্দ নাই।
আমি ভিন্ন এ-বনে আরও কেহ আছে। বনভূমির উপর আলো ও ছায়ার যে ছক পাতা রহিয়াছে, তাহার উপর একটি নিঃশব্দে সঞ্চরমাণ শুভ্রমূর্তি মাঝে মাঝে চোখে পড়িতেছে। মূর্তি কখনও তরুচ্ছায়ার অন্ধকারে মিলাইয়া যাইতেছিল, কখনও অবাস্তব কল্পনার মতো চন্দ্রালোক-কুহেলি ভিতর দিয়া চলিয়া যাইতেছিল। ক্রমে একটি ক্ষীণ তন্দ্রামধুর কণ্ঠস্বর কানে আসিতে লাগিল,— ঐ ছায়ামূর্তি গান করিতেছে। গানের কথাগুলি ধরা গেল না, কিন্তু সুরটি পরিচিত, যেন পূর্বে কোথায় শুনিয়াছি। ঘুম-পাড়ানী ছড়ার মতো সুর, কিন্তু প্রাণের সমস্ত তন্ত্রী চির-পরিচয়ের আনন্দে ঝংকৃত করিয়া তুলে।
গান ক্রমশ নিকটবর্তী হইতে লাগিল। এই গান যতই কাছে আসিতে লাগিল, আমার শরীরের স্নায়ুমণ্ডলেও এক অপূর্ব ব্যাপার ঘটিতে আরম্ভ করিল। সে অবস্থা বর্ণনা করি এমন সাধ্য আমার নাই। সে কি তীব্র অনুভূতি! আনন্দের কোন্ উদ্দামতম অবস্থায় মানুষের শরীরে এমন ব্যাপার ঘটিতে পারে জানি না, কিন্তু মনে হইল, দেহের স্নায়ুগুলা এবার অসহ্য হর্ষবেগে ছিঁড়িয়া-খুঁড়িয়া একাকার হইয়া যাইবে। — যে গান গাহিতেছিল, সে নারী এবং যে ভাষায় গান গাহিতেছিল তাহা বাংলা; কিন্তু সে জন্য নহে। আমার সমস্ত অন্তরাত্মা যে সংক্ষুব্ধ সমুদ্রের মতো আলোড়িত হইয়া উঠিয়াছিল, তাহার অন্য কারণ ছিল। এই গান এই কণ্ঠে গীত হইতে আমি পূর্বে শুনিয়াছি— বহুবার শুনিয়াছি। ইহার প্রত্যেকটি শব্দ আমার কাছে পুরাতন। কিন্তু তফাত এই যে, যে-ভাষায় এ গান পূর্বে শুনিয়াছিলাম, তাহা বাংলাভাষা নহে। সে ভাষা ভুলিয়া গিয়াছি, কিন্তু গান ভুলি নাই! কোথায় অন্তরের কোন্ নির্জন কন্দরে এতকাল লুকাইয়া ছিল, শুনিবামাত্র প্রতিধ্বনির মতো জাগিয়া উঠিল। গানের কথাগুলি বাংলায় রূপান্তরিত হইয়া অসংযুক্ত ছড়ার মতো প্রতীয়মান হয়, কিন্তু একদিন উহারই ছন্দে আমার বুকের রক্ত নৃত্য করিয়া উঠিত। গানের কথাগুলি এইরূপ :
বনের চিতা মেরেছে মোর স্বামী
ধারালো তীর হেনে!
চামড়া তাহার আমায় দেবে এনে
পারবো গায়ে আমি।
আমার চুলে বিনিয়ে দেব, ওরে,
তার ধনুকের ছিলা,
স্বামী আমার, — নিটোল দেহ তার
কঠিন যেন শিলা!
গায়িকা আরও কাছে আসিতে লাগিল। আমি দাঁড়াইয়া উঠিয়া রোমাঞ্চিত-দেহে প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম। ওঃ, কত কল্পান্ত পরে সে ফিরিয়া আসিল! আমার প্রিয়া— আমার সঙ্গিনী— আমার রুমা! এত দিন কি তাহারই প্রতীক্ষায় নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করিতেছিলাম?
যে তরুচ্ছায়ার নিম্নে আমি দাঁড়াইয়াছিলাম, সে গাহিতে গাহিতে ঠিক সেই ছায়ার কিনারায় আসিয়া দাঁড়াইল। আমাকে সে দেখিতে পায় নাই, চাঁদের দিকে চোখ তুলিয়া গাহিল,—
স্বামী আমার,— নিটোল দেহ তার
কঠিন যেন শিলা!
তাহার উন্নমিত মুখের পানে চাহিয়া আর আমার হৃদয় ধৈর্য মানিল না। আমি বাঘের মতো লাফাইয়া গিয়া তাহার হাত ধরিলাম। কথা বলিতে গেলাম, কিন্তু সহসা কিছুই বলিতে পারিলাম না। যে ভাষায় কথা বলিতে চাই, সে ভাষার একটা শব্দও স্মরণ নাই। অবশেষে অতি কষ্টে যেন অর্ধজ্ঞাত বিদেশী ভাষায় কথা কহিতেছি, এমনই ভাবে বাংলায় বলিলাম, “তুমি রুমা— আমার রুমা!”
তাহার গান থামিয়া গিয়াছিল, সে ভয়-বিস্ফারিত নয়নে চাহিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল, “কে? কে?”
তাহার মুখের অত্যন্ত কাছে মুখ লইয়া গিয়া বলিলাম, “আমি, আমি! রুমা, চিনতে পারছ না?”
সভয় ব্যাকুল-কণ্ঠে সে বলিল, “না। কে তুমি? তোমাকে আমি চিনি না। হাত ছেড়ে দাও!”
জলবিম্ব যেমন তরঙ্গ-আঘাতে ভাঙিয়া যায়, তেমনই এক মুহূর্তে আমার মোহ-বুদ্বুদ ভাঙিয়া গেল। প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খাইয়া বর্তমান জগতে ফিরিয়া আসিলাম। তাহার হাত ছাড়িয়া দিয়া লজ্জিত অপ্রতিভভাবে বলিলাম, “মাপ করুন। আমার ভুল হয়েছিল।”
রুমা চিত্রার্পিতার মতো স্থির অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে চাহিয়া রহিল। আমিও তাহার পানে চাহিলাম। এই আমার সেই রুমা! পরিধানে সাদা শালের শাড়ি, আর একটি ত্রিকোণ শুভ্র শাল স্কন্ধ বেষ্টন করিয়া বুকের উপর ব্রুচ দিয়া আটা, পায়ে সাদা চামড়ার জুতা। মস্তক অনাবৃত, কালো কেশের রাশি কুণ্ডলিত আকারে গ্রীবামূলে লুটাইতেছে। মুখখানি কুমুদের মতো ধবধবে সাদা, বয়স বোধ করি আঠারো-উনিশের বেশি নহে— একটি তরুণী রূপসী শিক্ষিতা বাঙালী মেয়ে!
কিন্তু না, এ আমার সেই রুমা! যাহাকে আমি তাহার স্বজাতির ভিতর হইতে কাড়িয়া আনিয়াছিলাম, যে আমার সন্তান গর্ভে ধারণ করিয়াছিল, এ সেই রুমা! আজি ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া সে আমার কাছে আসিল? আমাকে সে চিনিতে পারিল না?
আমার গলার পেশীগুলি সংকুচিত হইয়া শ্বাসরোধের উপক্রম করিল। আমি রুদ্ধস্বরে আবার বলিয়া উঠিলাম, “রুমা, চিনতে পারছ না?”
রুমা স্বপ্নাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল, মোহাবিষ্ট স্বরে কহিল, “আমার নাম রমা।”
“না— না— না, তুমি রুমা! আমার রুমা! মনে নেই, গুহার মধ্যে আমরা থাকতুম, ওপরে পাহাড়, নীচে উপত্যকা? তুমি গান গাইতে— যে গান এখনই গাইছিলে, সেই গান গাইতে, মনে নেই?”
রুমার দুই চক্ষু আরও তন্দ্রাতুর হইয়া আসিল। ঠোঁট দুটি একটু নড়িল, বলিল, “মনে পড়ে না—কবে— কোথায়…”
মাথার টুপিটি অধীরভাবে খুলিয়া ফেলিয়া আমি ব্যগ্রস্বরে কহিতে লাগিলাম, “মনে পড়ে না? সেই উপত্যকায় তোমরা একদল যাযাবর এসেছিলে, তোমাদের সঙ্গে ঘোড়া উট ছিল, তোমরা আগুন জ্বেলে মাংস সিদ্ধ করে খেতে। হ্রদের জলে যে লম্বা ঘাস জন্মাতো, তার শস্য থেকে চাল তৈরি করতে তুমিই যে আমায় শিখিয়েছিলে। ভেড়ার লোম থেকে কাপড় বোনবার কৌশল যে আমি তোমার কাছ থেকেই শিখেছিলুম! মনে পড়ে না? একদিন অন্ধকার রাত্রিতে আমরা তোমাদের আক্রমণ করলুম! তোমার দলের সব পুরুষ মরে গেল! তোমাকে নিয়ে আমি যখন পালাচ্ছিলুম, তুমি লোহার ছুরি দিয়ে আমার কপালে ঠিক এইখানে মারলে!”
কপালের দিকেই রুমা একদৃষ্টে তাকাইয়া ছিল। আমার মনে ছিল না যে, কপালের ঠিক ঐ স্থানটিতেই আমার একটা রক্তবর্ণ জড়ুল আছে। কপালে হাত পড়িতেই স্মরণ হইল, নিজেই চমকিয়া উঠিলাম। বহু পূর্বজন্মে যেখানে রুমার ছুরিকাঘাতে ক্ষত হইয়াছিল, প্রকৃতির দুর্জ্ঞেয় বিধানে ইহজন্মে তাহা রক্তবর্ণ জড়ুলরূপ ধরিয়া দেখা দিয়াছে! রুমা সেই চিহ্নটার দিকে নির্নিমেষনেত্রে চাহিয়া হঠাৎ চিৎকার করিয়া আমার বুকের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িল, “গাক্কা! গাক্কা!”
গাক্কা! হাঁ, ঐ বিকট শব্দটাই তখন আমার নাম ছিল। বজ্রকঠিন বন্ধনে তাহাকে বুকের ভিতর চাপিয়া লইলাম, বলিলাম, “হ্যাঁ, গাক্কা— তোমার গাক্কা। চিনতে পেরেছ, রুমা! ওঃ, আমার জন্মজন্মান্তরের রুমা!”
কতক্ষণ এইভাবে কাটিল, বলিতে পারি না। এক সময় সযত্নে তাহার মুখখানি বুকের উপর হইতে তুলিয়া ধরিয়া দেখিলাম,— রুমা মূর্ছা গিয়াছে।
তিত্তিকে লইয়া হুড়ার সহিত আমার যুদ্ধ অনিবার্য হইয়া উঠিয়াছিল। তিত্তিকে আমি ভালোবাসিতাম না, তাহাকে দেখিলে আমার বুকের রক্ত গরম হইয়া উঠিত না। কিন্তু সে ছিল আমাদের জাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠা যুবতী, — সুন্দরী-কুলের রানী। আর আমি ছিলাম যুবকদের মধ্যে প্রধান, আমার সমকক্ষ কেহ ছিল না। সুতরাং তিত্তিকে যে আমি গ্রহণ করিব এ বিষয়ে কাহারও মনে কোনও সন্দেহ ছিল না— আমারও ছিল না।
আমাদের গোষ্ঠীর মধ্যে নারীর সংখ্যা কমিয়া গিয়াছিল। আমরা জোয়ান ছিলাম প্রায় দুই শত, কিন্তু গ্রহণযোগ্য যুবতী ছিল মাত্র পঞ্চাশটি। তাই নারী লইয়া যুবকদের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ আরম্ভ হইয়া গিয়াছিল। আমাদের ডাইনী বুড়ি রিক্খা তাহার গুহার সম্মুখের উঁচু পাথরের উপর পা ছাড়াইয়া বসিয়া দুলিয়া দুলিয়া সমস্ত দিন গান করিত—
“আমাদের দেশে মেয়ে নেই! আমাদের ছেলেদের সঙ্গিনী নেই! এ জাত মরবে— এ জাত মরবে! হে পাহাড়ের দেবতা, বর্ষার স্রোতে যেমন পোকা ভেসে আসে, তেমনই অসংখ্য মেয়ে পাঠাও। এ জাত মরবে! মেয়ে নেই— মেয়ে নেই!…”
রিক্খার দন্তহীন মুখের স্খলিত কথাগুলি গুহার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হইয়া অশরীরী দৈববাণীর মতো বাতাসে ঘুরিয়া বেড়াইত।
সঙ্গিনীর জন্য সকলে পরস্পর লড়াই করিত বটে, কিন্তু তিত্তির দেহে কেহ হস্তক্ষেপ করিতে সাহস করে নাই। দূর হইতে লোলুপ ক্ষুধার্ত দৃষ্টিতে চাহিয়া সকলে সরিয়া যাইত। তিত্তির রূপ দেখিবার মতো বস্তু ছিল। উজ্জ্বল নব-পল্লবের মতো বর্ণ, কালো হরিণের মতো চোখ, কঠিন নিটোল যৌবনোদ্ভিন্ন দেহ— ন্যগ্রোধপরিমণ্ডলা! তাহার প্রকৃতিও ছিল অতিশয় চপল। সে নির্জন পাহাড়ের মধ্যে গিয়া তরুবেষ্টিত কুঞ্জের মাঝখানে আপন মনে নৃত্য করিত। নৃত্য করিতে করিতে তাহার অজিন শিথিল হইয়া খসিয়া পড়িত, কিন্তু তাহার নৃত্য থামিত না। বৃক্ষগুল্মের অন্তরাল হইতে অদৃশ্য চক্ষু তাহার নিরাবরণ দেহ বিদ্ধ করিত। কিন্তু তিত্তি দেখিয়াও দেখিত না— শুধু নিজ মনে অল্প অল্প হাসিত। সে ছিল কুহকময়ী চিরন্তনী নারী।
আমার মন ছিল শিকারের দিকে, তাই আমি তিত্তির চপলতা ও স্বৈরাচার গ্রাহ্য করিতাম না। কিন্তু ক্রমে আমারও অসহ্য হইয়া উঠিল। তাহার কারণ হুড়া। হুড়া ছিল আমারই মতো একজন যুবক, কিন্তু সে অন্যান্য যুবকদের মতো আমাকে ভয় করিত না। সে অত্যন্ত হিংস্র ও ক্রূরপ্রকৃতির ছিল, তাই শক্তিতে আমার সমকক্ষ না হইলেও আমি তাহাকে মনে মনে সম্ভ্রম করিয়া চালিতাম। সেও আমাকে ঘাঁটাইত না, যথাসম্ভব এড়াইয়া চলিত। কিন্তু তিত্তিকে লইয়া সে এমন ব্যবহার আরম্ভ করিল যে, আমার অহংকারে ভীষণ আঘাত লাগিল। সে নিঃসংকোচ তিত্তির পাশে গিয়া বসিত, তাহার হাত ধরিয়া টানাটানি করিত, চুল ধরিয়া টানিত, তাহার কান হইতে পাকা বদরী ফলের অবতংস দাঁত দিয়া খুলিয়া খাইয়া ফেলিত। তিত্তিও হাসিত, মারিত, ঠেলিয়া ফেলিয়া দিত, কিন্তু সত্যিকার ক্রোধ প্রকাশ করিয়া হুড়াকে নিরুৎসাহ করিত না।
এইরূপে হুড়ার সহিত আমার লড়াই অনিবার্য হইয়া পড়িয়াছিল।
সেদিন প্রকাণ্ড একটা বরাহের পিছনে পিছনে বহু ঊর্ধ্বে পাহাড়ের প্রায় চূড়ার কাছে আসিয়া পড়িয়াছিলাম। হাতে তীরধনুক ছিল। কিন্তু বরাহটাকে মারিতে পারিলাম না। সোজা যাইতে যাইতে সহসা সে একটা বিবরের মধ্যে অন্তর্হিত হইল। হতাশ হইয়া ফিরিতেছি, এমন সময় চোখে পড়িল, নীচে কিছুদূরে একটি সমতল পাথরের উপর দু’টি মানুষ পরস্পরের অত্যন্ত কাছাকাছি বসিয়া আছে। স্থানটি এমনই সুরক্ষিত যে, উপর হইতে ছাড়া অন্য কোন দিক্ হইতে দেখা যায় না। মানুষ দু’টির একটি স্ত্রী, অন্যটি পুরুষ। ইহারা কে, চিনিতে বিলম্ব হইল না— তিত্তি এবং হুড়া! তিত্তির মাথা হুড়ার স্কন্ধের উপর ন্যস্ত, হুড়ার একটা হাত তিত্তির কোমর জড়াইয়া আছে। দুইজনে মৃদুকণ্ঠে হাসিতেছে ও গল্প করিতেছে।
আমি সাবধানে পিঠ হইতে হরিণের শিঙের তীরটি বাছিয়া লইলাম। এটি আমার সবচেয়ে ভালো তীর, আগাগোড়া হরিণের শিং দিয়া তৈয়ারি, যেমন ধারালো তেমনই ঋজু। এ তীরের লক্ষ্য কখনও ব্যর্থ হয় না। আজ তিত্তি ও হুড়াকে এক তীরে গাঁথিয়া ফেলিব।
ধনুকে তীর সংযোগ করিয়াছি, এমন সময় তিত্তি মুখ ফিরাইয়া উপর দিকে চাহিল। পরক্ষণেই অস্ফুট চিৎকার করিয়া সে বিদ্যুদ্বেগে উঠিয়া একটা প্রস্তরখণ্ডের পিছনে লুকাইল। হুড়াও সঙ্গে সঙ্গে উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল, আমাকে দেখিয়া সে হিংস্র জন্তুর মতো দাঁত বাহির করিল; গর্জন করিয়া কহিল, “গাক্কা, তুই চলে যা, আমার কাছে আসিস্ না। আমি তোকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবো!”
আমি ধনুঃশর ফেলিয়া নীচে নামিয়া গেলাম, হুড়ার সম্মুখে দাঁড়াইয়া গর্বিতভাবে বলিলাম, “হুড়া, তুই পালিয়ে যা! আর যদি কখনও তিত্তির গায়ে হাত দিবি, তোর হাত-পা মুচড়ে ভেঙে পাহাড়ের ডগা থেকে ফেলে দেব। পাহাড়ের ফাঁকে মরে পড়ে থাকবি, শকুনি তোর পচা মাংস ছিঁড়ে খাবে।”
হুড়ার চোখ দু’টা রক্তবর্ণ হইয়া ঘুরিতে লাগিল, সে দন্ত কড়মড় করিয়া বলিল, “গাক্কা, তিত্তি আমার! সে তোকে চায় না, আমাকে চায়। তুই যদি তার দিকে তাকাস্, তোর চোখ উপড়ে নেব। কেন এখানে এসেছিস্, চলে যা! তিত্তি আমার, তিত্তি আমার!” — বলিয়া ক্রোধান্ধ হুড়া নিজের বক্ষে সজোরে চপেটাঘাত করিতে লাগিল।
আমি বলিলাম, “তুই তিত্তিকে আমার কাছ থেকে চুরি করে নিয়েছিস্। যদি পারিস্ কেড়ে নে; — আয়, লড়াই কর্!”
হুড়া দ্বিতীয় আহ্বানের অপেক্ষা করিল না, বন্য শূকরের মতো আমাকে আক্রমণ করিল।
তখন সেই চত্বরের ন্যায় সমতল ভূমির উপর ঘোর যুদ্ধ বাধিল। দুইটি ভল্লুক সহসা ক্ষিপ্ত হইয়া গেলে যেভাবে যুদ্ধ করে, আমরাও সেইভাবে যুদ্ধ করিলাম। সেই আদিম যুদ্ধ, যখন নখ-দন্ত ভিন্ন অন্য অস্ত্র প্রয়োজন হইত না। হুড়া কামড়াইয়া আমার দেহ ক্ষতবিক্ষত করিয়া দিল, সর্বাঙ্গ দিয়া রক্ত ঝরিতে লাগিল। কিন্তু পূর্বেই বলিয়াছি, শক্তিতে সে আমার সমকক্ষ ছিল না। আমি ধীরে ধীরে তাহাকে নিস্তেজ করিয়া আনিলাম। তারপর তাহাকে মাটিতে ফেলিয়া তাহার পিঠের উপর চড়িয়া বসিলাম।
নিকটেই একখণ্ড পাথর পড়িয়াছিল। দুই হাতে সেটা তুলিয়া লইয়া হুড়ার মাথা গুঁড়া করিয়া দিবার জন্য ঊর্ধ্বে তুলিয়াছি, হঠাৎ বিকট চিৎকার করিয়া রাক্ষসীর মতো তিত্তি আমার ঘাড়ের উপর লাফাইয়া পড়িল। দুই হাতের আঙুল আমার চোখের মধ্যে পুরিয়া দিয়া প্রখর দন্তে আমার একটা কান কামড়াইয়া ধরিল।
বিস্ময়ে, যন্ত্রণায় আমি হুড়াকে ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইলাম, তিত্তি কিন্তু গিরটিটির মতো আমার পিঠ আঁকড়াইয়া রহিল। চোখ ছাড়িয়া দিয়া গলা জড়াইয়া ধরিল, কিন্তু কান ছাড়িল না। ওদিকে হুড়াও ছাড়া পাইয়া সম্মুখ হইতে আক্রমণ করিল। দুইজনের মধ্যে পড়িয়া আমার অবস্থা শোচনীয় হইয়া উঠিল।
তিত্তিকে পিঠ হইতে ঝাড়িয়া ফেলিবার চেষ্টা করিলাম, কিন্তু বৃথা চেষ্টা। হাত-পা দিয়া সে এমনভাবে জড়াইয়া ধরিয়াছে যে, সে নাগপাশ হইতে মুক্ত হওয়া একেবারে অসম্ভব। তাহার উপর কান কামড়াইয়া আছে, ছাড়ে না। এদিকে হুড়া আমার পরিত্যক্ত প্রস্তরখণ্ডটা তুলিয়া লইয়া আমারই মস্তক চূর্ণ করিবার উদ্যোগ করিতেছে। আমার আর সহ্য হইল না, রণে ভঙ্গ দিলাম। রাক্ষসীটাকে পিঠে করিয়াই পলাইতে আরম্ভ করিলাম।
অসমতল পাহাড়ের উপর একটা উলঙ্গ উন্মত্ত ডাকিনীকে পিঠে লইয়া দৌড়ানো সহজ কথা নহে। কিন্তু কিছুদূর গিয়া সে আপনা হইতেই আমাকে ছাড়িয়া দিল। আমার কর্ণ ত্যাগ করিয়া পিঠ হইতে পিছলাইয়া নামিয়া পড়িল। আমি আর ফিরিয়া তাকাইলাম না। পিছনে তিত্তি চিৎকার করিয়া হাসিয়া করতালি দিয়া নাচিতে লাগিল। —
“গাক্কা ভীতু, গাক্কা কাপুরুষ। গাক্কা মরদ নয়! সে কোন্ সাহসে তিত্তিকে পেতে চায়? তিত্তি হুড়ার বৌ! হুড়া তিত্তিকে গাক্কার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে, তিত্তির ভয়ে গাক্কা পালিয়েছে। গাক্কা ভীতু! গাক্কাকে দেখে সবাই হাসবে। গাক্কা আর মানুষের কাছে মুখ দেখাবে না। গাক্কা কাপুরুষ! গাক্কা মরদ নয়!”— তিত্তির এই তীব্র শ্লেষ রক্তাক্ত কর্ণে শুনিতে শুনিতে আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে পলাইলাম।
সেই দিন, সূর্য যখন উপত্যকার ওপারে পাহাড়ের আড়ালে ঢাকা পড়িল, তখন আমি চুপি চুপি নিজের গুহা হইতে পাথরের ফলকযুক্ত বর্শাটি লইয়া গোষ্ঠী পরিত্যাগ করিলাম। তিত্তিকে হারাইয়া আমার দুঃখ হয় নাই, কিন্তু গ্রামের সকলে, যাহারা এত কাল আমাকে ভয় করিয়া চলিত, তাহারা আমার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া উপহাস করিবে, তিত্তি করতালি দিয়া হাসিবে, ইহা সহ্য করা অপেক্ষা গোষ্ঠী ত্যাগ করাই শ্রেয়ঃ। উপত্যকার পরপারে ঐ যেখানে সূর্য ঢাকা পড়িল, ওখানে একটি ছোট গুহা আছে, একদিন শিকার করিতে গিয়া উহা আবিষ্কার করিয়াছিলাম। গুহার পাশ দিয়া একটি সরু ঝরনা নামিয়াছে, তাহার জল চাকভাঙা মধুর মতো মিষ্ট। ওদিকে শিকারও বেশি পাওয়া যায়। এদিক হইতে তাড়া খাইয়া প্রায় সকল জন্তুই ওদিকে গিয়া জমা হয়, সুতরাং ঐখানে গিয়া বাস করিব।
গ্রাম ছাড়িয়া যখন চলিয়া আসিতেছি, তখন শুনিতে পাইলাম, বুড়ি ডাইনী রিক্খা তাহার চাতালে বসিয়া গাহিতেছে—
“মেয়ে নেই! মেয়ে নেই! আমাদের ছেলেরা নিজেদের মধ্যে লড়াই করে মরছে। এ জাত বাঁচবে না। হে পাহাড়ের দেবতা, মেয়ে পাঠাও…”
উপত্যকা পার হইয়া ওদিকের পাহাড়ে পৌঁছিতে মধ্যরাত্রি অতীত হইয়া গেল। আকাশে চাঁদ ছিল। চাঁদটা ক্রমে ভরাট হইয়া আসিতেছে, দুই-তিন দিনের মধ্যেই নিটোল আকার ধারণ করিবে। এখন শরৎকাল, আকাশে মেঘ সাদা ও হাল্কা হইয়াছে, আর বৃষ্টি পড়ে না। উপত্যকার মাঝখানে হ্রদ,—ঠিক মাঝখানে নহে, একটু পশ্চিম দিক্ ঘেঁষিয়া, — তাহার কিনারায় লম্বা লম্বা ঘাস জন্মিয়াছে। ঘাসের আগায় শীষ গজাইয়া হেলিয়া পড়িয়াছে। আর কিছু দিন পরে ঐ শীষ পীতবর্ণ হইলে উত্তর হইতে পাখিরা আসিতে আরম্ভ করিবে।
হ্রদের ধার দিয়া যাইতে যাইতে দেখিলাম, হরিণের দল জল পান করিয়া চলিয়া গেল। তাহাদের মসৃণ গায়ে চাঁদের আলো চকচক করিয়া উঠিল। ক্রমে যেখানে আমার ক্ষীণা ঝরনাটি হ্রদের সঙ্গে মিশিয়াছে, সেইখানে আসিয়া পড়িলাম। এদিকে হ্রদের জল প্রায় পাহাড়ের কোল পর্যন্ত আসিয়া পড়িয়াছে, মধ্যে ব্যবধান পঞ্চাশ হাতের বেশি নহে। সম্মুখেই পাহাড়ের জঙ্ঘার একটা খাঁজের মধ্যে আমার গুহা। আমি ঝরনার পাশ দিয়া উঠিয়া যখন আমার নূতন গৃহের সম্মুখে পৌঁছিলাম, তখন চাঁদের অপরিপুষ্ট চক্রটি গুহার পিছনে উচ্চ পাহাড়ের অন্তরালে লুকাইল।
নূতন গৃহে নূতন আবেষ্টনীর মধ্যে আমি একাকী মনের আনন্দে বাস করিতে লাগিলাম। কাহারও সহিত দেখা হয় না— হরিণের অন্বেষণেও এদিকে কেহ আসে না। তাহার প্রধান কারণ, পাহাড়-দেবতার করাল মুখের এত কাছে কেহ আসিতে সাহস করে না। আমাদের জাতির মধ্যে এই চক্রাকৃতি পর্বতশ্রেণী একটি অতিকায় অজগর বলিয়া পরিচিত ছিল, এই অজগরই আমাদের পর্বত-দেবতা। পর্বত-দেবতার মুখ ছিল দংষ্ট্রাবহুল অন্ধকার একটা গহ্বর। বস্তুত, দূর হইতে দেখিলে মনে হইত, যেন শল্কাবৃত বিশাল একটা সরীসৃপ কুণ্ডলিত হইয়া তাহার ব্যাদিত মুখটা মাটির উপর রাখিয়া শুইয়া আছে। প্রাণান্তেও কেহ এই গহ্বরমুখের কাছে আসিত না।
গ্রীষ্মের অবসানে যখন আকাশে মেঘ আসিয়া গর্জন করিত, তখন আমাদের পাহাড়-দেবতাও গর্জন করিতেন। উপত্যকা জলে ভরিয়া উঠিলে তৃষ্ণার্ত দেবতা ঐ মুখ দিয়া জল শুষিয়া লাইতেন। আমাদের গোষ্ঠী হইতে বর্ষা-ঋতুর প্রাক্কালে দেবতার প্রীত্যর্থে জীবন্ত জীবজন্তু উৎসর্গ করা হইত। দেবতার মুখের নিকটে কেহ যাইতে সাহসী হইত না— দূর হইতে দেবতাকে উদ্দেশ করিয়া জন্তুগুলা ছাড়িয়া দিত। জন্তুগুলাও দেবতার ক্ষুধিত নিশ্বাসের আকর্ষণে ছুটিয়া গিয়া তাঁহার মুখে প্রবেশ করিত। দেবতা প্রীত হইয়া তাহাদিগকে ভোজন করিতেন।
দেবতার এই ভোজনরহস্য কেবল আমি ধরিয়া ফেলিয়াছিলাম; কিন্তু কাহাকেও বলি নাই। আমি দেখিয়ছিলাম, জন্তুগুলা কিছুকাল পরে দেবতার মুখ হইতে অক্ষতদেহে বাহির হইয়া আসে এবং স্বচ্ছন্দে বিচরণ করিতে করিতে পাহাড়ে ফিরিয়া যায়। পর্বত-দেবতার মুখ যে প্রকৃতপক্ষে একটা বড় গহ্বর ভিন্ন আর কিছুই নহে, তাহা আমি বেশ বুঝিয়াছিলাম, তাই তাহার নিকট যাইতে আমার ভয় করিত না। একবার কৌতূহলী হইয়া উহার ভিতরেও প্রবেশ করিয়াছিলাম, কিন্তু গহ্বরের মুখ প্রশস্ত হইলেও উহার ভিতরটা অত্যন্ত অন্ধকার, এজন্য বেশিদূর অগ্রসর হইতে পারি নাই। কিন্তু রন্ধ্র যে বহুদূর বিস্তৃত, তাহা বুঝিতে পারিয়াছিলাম।
এই পাহাড়-দেবতার মুখ আমার গুহা হইতে প্রায় তিন শত হাত দূরে উত্তরে পর্বতের সানুদেশে অবস্থিত। এ-প্রান্তে দেবতার ভয়ে কেহ আসে না, অথচ এদিকে শিকারের যত সুবিধা, অন্য দিকে তত নহে। রাত্রিতে ঝরনা ও হ্রদের মোহনায় লুকাইয়া থাকিলে যত ইচ্ছা শিকার পাওয়া যায়— শিকারের জন্য পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরিয়া বেড়াইতে হয় না। আমার গুহাটি এমনই চমৎকার যে, অত্যন্ত কাছে আসিলেও ইহাকে গুহা বলিয়া চেনা যায় না। গুহার মুখটি ছোট— লতাপাতা দিয়া ঢাকা; কিন্তু ভিতরটি বেশ সুপ্রসর। ছাদ উঁচু— দাঁড়াইলে মাথা ঠেকে না; মেঝেটি একটি আস্ত সমতল পাথর দিয়া তৈয়ারি। তাহার উপর লম্বাভাবে শুইয়া রন্ধ্রপথে মুখ বাড়াইলে সমস্ত উপত্যকাটি চোখের নীচে বিছাইয়া পড়ে। শীতের সময় একটা পাথর দিয়া স্বচ্ছন্দে গুহামুখ বন্ধ করিয়া দেওয়া যায়, ঠাণ্ডা বাতাস প্রবেশ করিতে পারে না। তাহা ছাড়া রাত্রিকালে হিংস্র জন্তুর অতর্কিত আক্রমণও এই উপায়ে প্রতিরোধ করা যায়।
এইখানে নিঃসঙ্গ শান্তিতে আমার কয়েকদিন কাটিয়া গেল। আকাশের চাঁদ নিটোল পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়া আবার ক্ষীণ হইতে হইতে একদিন মিলাইয়া গেল। হ্রদের কিনারায় লম্বা ঘাসের শস্য পাকিয়া রং ধরিতে আরম্ভ করিল। পাখির ঝাঁক একে একে আসিয়া হ্রদের জলে পড়িতে লাগিল; তাহাদের মিলিত কণ্ঠের কলধ্বনি আমার নিশীথ নিদ্রাকে মধুর করিয়া তুলিল।
একদিন অপরাহ্ণে, আমার গুহার পাশে ঝরনা যেখানে পাহাড়ের এক ধাপ হইতে আর এক ধাপে লাফাইয়া পড়িয়াছে, সেই পৈঠার উপর বসিয়া আমি একটা নূতন ধনুক নির্মাণ করিতেছিলাম। দুই দিন আগে একটা হরিণ মারিয়াছিলাম, তাহারই অন্ত্রে ধনুকের ছিলা করিব বলিয়া জলে ধুইয়া পরিষ্কার করিয়া রাখিয়াছিলাম। পাহাড়ে একপ্রকার মোটা বেত জন্মায়, তাহাতে খুব ভালো ধনুক হয়, সেই বেত একটা ভাঙিয়া আনিয়া শুকাইয়া রাখিয়াছিলাম। উপস্থিত আমার বর্শার ধারালো পাথরের ফলা দিয়া তাহারই দুই দিকে গুণ লাগাইবার খাঁজ কাটিতেছিলাম। অস্তমান সূর্যের আলো আমার ঝরনার জলে রক্ত মাখাইয়া দিয়াছিল; নীচে হ্রদের জলে পাখিগুলি ডাকাডাকি করিতেছিল। ঝরনার চূর্ণ জলকণা নীচের ধাপ হইতে বাষ্পাকারে উঠিয়া অত্যন্ত মিঠাভাবে আমার অনাবৃত অঙ্গে লাগিতেছিল। মুখ নত করিয়া আমি আপন মনে ধনুকে গুণ-সংযোগে নিযুক্ত ছিলাম।
হঠাৎ একটা অশ্রুতপূর্ব চিঁহি-চিঁহি শব্দে চোখ তুলিয়া উপত্যকার দিকে চাহিতেই বিস্ময়ে একেবারে নিম্পন্দ হইয়া গেলাম। এ কি! দেখিলাম, পাহাড়-দেবতার মুখবিবর হইতে পিপীলিকা-শ্রেণীর মতো একজাতীয় অদ্ভুত মানুষ ও ততোধিক অদ্ভুত জন্তু বাহির হইতেছে। এরূপ মানুষ ও এরূপ জন্তু জীবনে কখনও দেখি নাই।
আগন্তুকগণ বহু নিম্নে উপত্যকায় ছিল, অতদূর হইতে আমাকে দেখিতে পাইবার কোনও সম্ভাবনা ছিল না। তথাপি আমি সন্তর্পণে বুকে হাঁটিয়া ঝরনার তীর হইতে আমার গুহায় ফিরিয়া আসিয়া লুকাইলাম। গুহার মধ্যে লুকাইয়া দ্বারপথে মুখ বাড়াইয়া নবাগতদিগকে দেখিতে লাগিলাম।
মানুষ হইলেও ইহারা যে আমার সগোত্র নহে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। বাহিরের কোনও অজ্ঞাত জগৎ হইতে রন্ধ্রপথে আমাদের রাজ্যে প্রবেশ করিয়াছে, তাহাও অস্পষ্টভাবে অনুভব করিলাম। কিন্তু যেখান হইতেই আসুক, এমন আশ্চর্য চেহারা ও বেশভূষা যে হইতে পারে তাহা কখনও কল্পনা করি নাই। জন্তুদের কথা পরে বলিব, প্রথমে মানুষগুলার কথা বলি। এই মানুষগুলার গায়ের রং আমাদের মতো মধুপিঙ্গল বর্ণ নহে— ধবধবে সাদা। ইহাদের চুল সূর্যাস্তের বর্ণচ্ছটার ন্যায় উজ্জ্বল, দেহ অতিশয় দীর্ঘ ও সুগঠিত। পশুচর্মের পরিবর্তে ইহাদের দেহ একপ্রকার শ্বেতবস্ত্রে আচ্ছাদিত। ইহারা সংখ্যায় সর্বসুদ্ধ প্রায় একশত জন ছিল, তাহার মধ্যে অর্ধেক নারী। নারীগণও পুরুষদের মতো উজ্জ্বল কেশযুক্ত ও দীর্ঘাকৃতি। তাহারা বস্ত্র দ্বারা বক্ষোদেশ আচ্ছাদিত করিয়া রাখিয়াছে। পুরুষদের হাতে ধনুর্বাণ ও ভল্ল আছে, ভল্লের ফলা সূর্যের আলোয় ঝকমক করিতেছে। বর্শার ফলা এমন ঝকমক করিতে পূর্বে কখনও দেখি নাই।
ইহাদের সঙ্গে তিন প্রকার জন্তু রহিয়াছে। প্রথমত, একপ্রকার বিশাল অথচ শীর্ণকায় জন্তু— তাহাদের পিঙ্গলবর্ণ দেহ আশ্চর্যভাবে ঢেউখেলানো; দেহের সন্ধিগুলা যেন অত্যন্ত অযত্ন সহকারে সংযুক্ত হইয়াছে, মুখ কদাকার। পিঠের উপর প্রকাণ্ড কুঁজ। ইহাদের পৃষ্ঠে নানাপ্রকার দ্রব্য চাপানো রহিয়াছে। উদ্গ্রীবভাবে গলা বাড়াইয়া ইহারা মন্থরগতিতে চলিয়াছে। দ্বিতীয় জাতীয় জন্তু ইহাদের অপেক্ষা অনেক ছোট, তাহাদের দেহ রোমশ ও রক্তবর্ণ, আঁটসাঁট মজবুত গঠন। ইহারা দেখিতে ক্ষুদ্র বটে, কিন্তু পৃষ্ঠে বড় বড় বোঝা বহন করিয়া চলিয়াছে। উপরন্তু বহু মনুষ্য-শিশুও ইহাদের পিঠের উপর পা ঝুলাইয়া বসিয়া আছে। এই জন্তুগুলাই গুহামুখ হইতে হ্রদ দেখিয়া অদ্ভুত শব্দ করিয়াছিল।
তৃতীয় শ্রেণীর জন্তু সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র, দেখিতে কতকটা পাহাড়ী ছাগের মতো, কিন্তু ইহাদের দেহ ঘন রোমে আবৃত। এমন কি, ইহাদের রোম পেটের নীচে পর্যন্ত ঝুলিয়া পড়িয়াছে। ইহারা একসঙ্গে ঘেঁষাঘেঁষিভাবে চলিয়াছে ও মাঝে মাঝে ‘ব্যা-ব্যা’ শব্দ করিতেছে।
এই সকল জন্তুর আচরণে সর্বাপেক্ষা বিস্ময়ের বস্তু এই যে, ইহারা মানুষ দেখিয়া তিলমাত্র ভয় পাইতেছে না, বরং মানুষের সঙ্গে পরম ঘনিষ্ঠভাবে মিলিয়া মিশিয়া চলিয়াছে। মানুষ ও বন্যপশুর মধ্যে এরূপ প্রীতির সম্পর্ক স্থাপিত হইতে এই প্রথম দেখিলাম।
ইহারা স্ত্রী-পুরুষ একত্র হইয়া কিছুক্ষণ কি জল্পনা করিল, তারপর সদলবলে আমার ঝরনার মোহানার দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। বুঝিলাম, তাহারা এই স্থানেই ডেরাডাণ্ডা গাড়িবে বলিয়া মনস্থ করিয়াছে।
ক্রমে সন্ধ্যা হইয়া আসিতেছিল। দিবাশেষের নির্বাপিতপ্রায় আলোকে ইহারা ঠিক আমার গুহার নিম্নে— ঝরনার জল যেখানে পাহাড় হইতে নামিয়া স্বচ্ছ অগভীর স্রোতে উপত্যকার উপর দিয়া বহিয়া গিয়া হ্রদের জলে মিশিয়াছে, সেই স্থানে আসিয়া পশুগুলির পৃষ্ঠ হইতে ভার নামাইল। ভারমুক্ত পশুগুলি ঝরনার প্রবাহের পাশে কাতার দিয়া দাঁড়াইয়া তৃষ্ণার্তভাবে জল পান করিতে লাগিল।
ইহারা আমার এত কাছে আসিয়া পড়িয়াছিল যে, এই প্রদোষালোকেও আমি প্রত্যেকের মুখ স্পষ্ট দেখিতে পাইতেছিলাম। আমার গুহা হইতে লোষ্ট্র নিক্ষেপ করিলে বোধ করি তাহাদের মাথায় ফেলিতে পারিতাম। তাহাদের কথাবার্তাও স্পষ্ট শুনিতে পাইতেছিলাম, কিন্তু একবর্ণও বোধগম্য হইতেছিল না।
রাত্রি হইল। তখন ইহারা এক আশ্চর্য ব্যাপার করিল। একখণ্ড পাথরের সহিত আর একখণ্ড অজ্ঞাত পদার্থ ঠোকাঠুকি করিয়া স্তূপীকৃত শুষ্ক কাষ্ঠে অগ্নি সংযোগ করিল। অগ্নি জ্বলিয়া অঙ্গারে পরিণত হইলে সেই অঙ্গারে মাংস পুড়াইয়া সকলে আহার করিতে লাগিল। দগ্ধ মাংসের একপ্রকার অপূর্ব গন্ধ আমার নাসারান্ধে প্রবেশ করিয়া জিহ্বাকে লালায়িত করিয়া তুলিল।
রাত্রি গভীর হইলে ইহারা পশুগুলির দ্বারা অগ্নির চারিপাশে একটি বৃহৎ চক্রব্যূহ, রচনা করিল, তারপর সেই চক্রের ভিতর অগ্নির পাশে শয়ন করিয়া ঘুমাইয়া পড়িল। কেবল একজন লোক ধনুর্বাণ হাতে লইয়া ব্যূহের বাহিরে পরিক্রমণ করিতে লাগিল।
ইহারা ঘুমাইল বটে, কিন্তু বিস্ময়ে উত্তেজনায় আমি সমস্ত রাত্রি জাগিয়া রহিলাম। এই বিচিত্র জাতির অতি বিস্ময়কর আচার-ব্যবহার মনে মনে আলোচনা করিতে করিতে তাহাদের ক্রমশ নির্বাণোন্মুখ অগ্নির দিকে চাহিয়া রাত্রি কাটাইয়া দিলাম।
প্রাতঃকালে উঠিয়াই আগন্তুকরা কাজে লাগিয়া গেল। ইহারা অসাধারণ উদ্যমী; একদল পুরুষ উপত্যকার উপর ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বড় বড় পাথরের টুকরা গড়াইয়া আনিয়া প্রাচীর-নির্মাণে প্রবৃত্ত হইল, আর একদল ধনুর্বাণ-হস্তে শিকারের অন্বেষণে পাহাড়ে উঠিয়া গেল। অবশিষ্ট অল্পবয়স্ক বালকগণ পশুগুলাকে লইয়া উপত্যকার শষ্পাচ্ছাদিত অংশে চরাইতে লইয়া গেল। স্ত্রীলোকেরাও অলসভাবে বসিয়া রহিল না, তাহারা হ্রদের জলে নামিয়া লম্বা ঘাসের পাকা শীষগুলি কাটিয়া আনিয়া রৌদ্রে শুকাইতে লাগিল। এইরূপে মৌমাছি-পরিপূর্ণ মধুচক্রের মতো এই ক্ষুদ্র সম্প্রদায় কর্ম-প্রেরণায় চঞ্চল হইয়া উঠিল।
দেখিতে দেখিতে আমার দৃষ্টির সম্মুখে চক্রাকৃতি প্রস্তর-প্রাচীর গড়িয়া উঠিল। সন্ধ্যার পূর্বেই প্রাচীর কোমর পর্যন্ত উঁচু হইল। কেবল হ্রদের দিকে দুই হস্ত-পরিমিত স্থান নির্গমনের জন্য উন্মুক্ত রাখা হইল। সন্ধ্যার সময় শিকারীরা একটা বড় হরিণ ও দুটা শূকর মারিয়া বর্শাদণ্ডে ঝুলাইয়া লইয়া আসিল। তখন সকলে আনন্দ-কোলাহল সহকারে অগ্নি জ্বলিয়া সেই মাংস দগ্ধ করিয়া আহারের আয়োজন করিতে লাগিল।
আর একটা অভিনব ব্যাপার লক্ষ্য করিলাম। নারীগণ একপ্রকার বর্তুলাকৃতি পাত্র কক্ষে লইয়া ঝরনার তীরে আসিতেছে এবং সেই পাত্রে জল ভরিয়া পুনশ্চ কক্ষে করিয়া লইয়া যাইতেছে। ইহারা কেহই ঝরনায় মুখ ডুবাইয়া কিংবা অঞ্জলি করিয়া জল পান করে না, প্রয়োজন হইলে সেই পাত্র হইতে জল ঢালিয়া তৃষ্ণা নিবারণ করে।
আর একটা রাত্রি কাটিয়া গেল, নবাগতগণ উপনিবেশ স্থাপন করিয়া বাস করিতে লাগিল। ভাব দেখিয়া বোধ হইল, এই উপত্যকাটি তাহাদের বড়ই পছন্দ হইয়াছে, সুতরাং এ স্থান ত্যাগ করিয়া যাইবার আশু অভিপ্রায় তাহাদের নাই। আর একটা মনুষ্য জাতি যে সন্নিকটেই বাস করিতেছে, তাহা তাহারা জানিতে পারে নাই; এবং সেই জাতির এক পলাতক যুবা যে অলক্ষ্যে থাকিয়া অহরহ তাহাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করিতেছে, তাহা সন্দেহ করিবারও কোনও উপলক্ষ হয় নাই। দিনের বেলা আলো থাকিতে আমি কদাচ গুহা হইতে বাহির হইতাম না।
এইরূপে আরও দুই দিন কাটিয়া গেল। বরাহদন্তের মতো বাঁকা চাঁদ আবার পশ্চিম আকাশে দেখা দিল।
ইহাদের মধ্যে যে-সব রমণী ছিল, তাহারা সকলেই সমর্থা; বৃদ্ধা বা অকর্মণ্যা কেহ ছিল না। নারীগণ অধিকাংশই সন্তানবতী এবং কোনও-না-কোনও পুরুষের বশবর্তিনী; কিন্তু কয়েকটি আসন্নযৌবনা কিশোরী কুমারীও ছিল। ইহাদের ভিতর হইতে একটি কিশোরী প্রথম হইতেই আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল।
এই কিশোরীর নাম আমি জানিতে পারিয়াছিলাম,— রুমা। রুমা বলিয়া ডাকিলেই সে সাড়া দিত। রুমার রূপ কেমন ছিল, তাহা আমি বলিতে পারিব না। যে-চোখে দেখিলে নিরপেক্ষ রূপবিচার সম্ভব হয়, আমি তাহাকে সে-চোখে দেখি নাই। আমি তাহাকে দেখিয়াছিলাম যৌবনের চক্ষু দিয়া— লোভের চক্ষু দিয়া। আমার কাছে সে ছিল আকাশের ঐ আভুগ্ন চন্দ্রকলাটির মতো সুন্দর। তিত্তি তাহার পায়ের নখের কাছে লাগিত না।
এই রুমার চরিত্র অন্যান্য বালিকা হইতে কিছু স্বতন্ত্র ছিল। কৈশোরের গণ্ডি অতিক্রম করিয়া সে প্রায় যৌবনের প্রান্তে পদার্পণ করিয়াছিল, তাই তাহার চরিত্রে উভয় অবস্থার বিচিত্র সম্মিলন হইয়াছিল। সে অন্যান্য নারীদের সঙ্গে যথারীতি কাজ করিত বটে, কিন্তু একটু ফাঁক পাইলেই লুকাইয়া খেলা করিয়া লইত। তাহার সঙ্গিনী বা সখী কেহ ছিল না, সে একাকী খেলা করিতে ভালোবাসিত। কখনও হ্রদের জলে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া সাঁতার কাটিত, সাঁতার কাটিতে কাটিতে বহুদূর পর্যন্ত চলিয়া যাইত। তাহাকে আসিতে দেখিয়া জলে ভাসমান পাখিগুলি উড়িয়া আর একস্থানে গিয়া বসিত। সে জলে ডুব দিয়া একেবারে তাহাদের মধ্যে গিয়া মাথা তুলিত, তখন পাখিরা ভয়সূচক শব্দ করিয়া ছত্রভঙ্গ হইয়া যাইত।
কিন্তু এ খেলাও তাহার মনঃপূত হইত না। কারণ, তাহার দেখাদেখি অন্যান্য বালক-বালিকারা জলে পডিয়া সাঁতার দিতে আরম্ভ করিত। সে তখন জল হইতে উঠিয়া সিক্ত কেশজাল হইতে জলবিন্দু মোচন করিতে করিতে অন্যত্র প্রস্থান করিত।
কখনও একটু অবসর পাইলে সে চুপি চুপি কোনও পুরুষের পরিত্যক্ত ধনুর্বাণ লইয়া পাহাড়ে উঠিয়া যাইত। আমি কিছুক্ষণ তাহাকে দেখিতে পাইতাম না, তারপর আবার সে চুপি চুপি ফিরিয়া আসিত। দেখিতাম, চুলে বনফুলের গুচ্ছ পরিয়াছে, কর্ণে পক্ব ফলের দুল দুলাইয়াছে, কটিতে পুষ্পিত লতা জড়াইয়া দেহের অপূর্ব প্রসাধন করিয়াছে। ভীরু হরিণীর মতো এদিক্-ওদিক্ চাহিয়া জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখিত, তারপর ঈষৎ হাসিয়া ত্রস্ত চকিত পদে প্রস্থান করিত। আমি লক্ষ্য করিয়াছিলাম, সকলের অজ্ঞাতে একাকিনী কোনও কাজ করিতে পারিলেই সে খুশি হয়। ইহা যে তাহার বয়ঃসন্ধির একটা স্বভাবধর্ম, তাহা তখনও বুঝি নাই। কিন্তু আমার ব্যগ্র লোলুপ চক্ষু সর্বদাই তাহার পিছনে পিছনে ঘুরিতে থাকিত। এমন কি, রাত্রিকালে প্রস্তরব্যূহের মধ্যে ঠিক কোন্ স্থানটিতে সে শয়ন করিয়া ঘুমায়, তাহা পর্যন্ত আমার দৃষ্টি এড়াইতে পারে নাই!
পাখিরা যেমন খড়কুটা দিয়া গাছের ডালে বাসা তৈয়ার করে, ইহারাও তেমন গাছের ডালপালা দিয়া ব্যূহের মধ্যে একপ্রকার কোটর নির্মাণ করিতে আরম্ভ করিয়াছিল, বোধ হয় অধিক শীতের সময় উহার মধ্যে রাত্রিবাস করিবার সংকল্প ছিল। কিন্তু সেগুলির নির্মাণ তখনও শেষ হয় নাই, তাই উপস্থিত মুক্ত আকাশের তলেই শয়ন করিতেছিল।
ইহাদের আগমনের পঞ্চম দিনই বিশেষ স্মরণীয় দিন। আমার মনের মধ্যে যে অভিসন্ধি কয়েকদিন ধরিয়া ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত হইয়া উঠিতেছিল, সেইদিন মধ্যরাত্রি উত্তীর্ণ হইবার পূর্বে যে তাহা এমন অচিন্তনীয়ভাবে ফলবান হইয়া উঠিবে, তাহা কে কল্পনা করিয়াছিল? আগন্তকদের নির্ভয় অসন্দিগ্ধচিত্তে কোনও অমঙ্গলের ছায়াপাত পর্যন্ত হয় নাই। এ রাজ্যে যে অন্য মানুষ আছে, এ সন্দেহই তাহাদের মনে উদয় হয় নাই।
সেদিন দ্বিপ্রহরে পুরুষেরা সকলে নানা কার্য উপলক্ষে বাহিরে গিয়াছিল। এক দল শিকারে বাহির হইয়াছিল, আর এক দল কাষ্ঠ আহরণের জন্য পর্বতপৃষ্ঠস্থ জঙ্গলে প্রবেশ করিয়াছিল। বালকেরা পশুগুলিকে চরাইতে গিয়াছিল। নারীগণ শিশু কোলে লইয়া অর্ধ-নির্মিত দারু কোটরের ছায়ায় বিশ্রাম করিতেছিল। হ্রদের জলে সূর্যকিরণ পড়িয়া চতুর্দিকে প্রতিফলিত হইতেছিল ও জল হইতে একপ্রকার সূক্ষ্ম বাষ্প উত্থিত হইতেছিল।
আমি অভ্যাসমত গুহামুখে শয়ান হইয়া ভাবিতেছিলাম, রুমাকে যদি হাতের কাছে পাই, তাহা হইলে চুরি করি। রাত্রিতে যে-সময় উহারা ঘুমায়, সে-সময় যদি চুরি করিয়া আনিতে পারিতাম, তাহা হইলে ভালো হইত। কিন্তু একটা লোক সমস্ত রাত্রি জাগিয়া পাহারা দেয়, তাহার উপর আবার আগুন জ্বলে। লোকটাকে তীর মারিয়া নিঃশব্দে মারিয়া ফেলিতে পারি— কেহ জানিবে না; কিন্তু আগুনের আলোয় চুরি করিতে গেলেই ধরা পড়িয়া যাইব। তার চেয়ে রুমাকে কোনও সময়ে যদি একেলা পাই, — সন্ধ্যার সময় নির্জনে যদি আমার গুহার কাছে আসিয়া পড়ে, তবে তাহাকে হরণ করিয়া লইয়া পলায়ন করি। এ গুহা ছাড়িয়া তাহাকে লইয়া এমন স্থানে গিয়া লুকাইয়া থাকি যে, তাহার জাতি-গোষ্ঠীর কেহ আমাদের খুঁজিয়া পাইবে না।
সূর্যতাপে গুহার বায়ু উত্তপ্ত হইয়াছিল, আমি তৃষ্ণাবোধ করিতে লাগিলাম। পাশেই নির্ঝরিণী, গুহা হইতে বাহির হইয়া দুই পদ অগ্রসর হইলেই শীতল জল পাওয়া যায়; কিন্তু গুহার বাহিরে যাইলে পাছে নিম্নস্থ কাহারও দৃষ্টিপথে পড়িয়া যাই, এই ভয়ে ইতস্তত করিতে লাগিলাম। কিন্তু তৃষ্ণা ক্রমে প্রবলতর হইতে লাগিল, তখন সরীসৃপের মতো বুকে হাঁটিয়া বাহির হইলাম। উঠিয়া দাঁড়ানো অসম্ভব, দাঁড়াইলেই এদিকে দৃষ্টি আকৃষ্ট হইবে। আমি সন্তর্পণে চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া ঝরনার দিকে অগ্রসর হইবার উদ্যোগ করিতেছি, এমন সময় এক অপ্রত্যাশিত বাধা পাইয়া দ্রুত নিজের কোটরে ফিরিয়া আসিয়া লুকাইলাম।
ঝরনার ধার দিয়া দিয়া রুমা উপরে উঠিয়া আসিতেছে। গুহামুখের লতাপাতার আড়ালে থাকিয়া আমি স্পন্দিতবক্ষে দেখিতে লাগিলাম। সে ধাপে ধাপে লাফাইয়া যেখানে ঝরনার জল প্রপাতের মতো নীচে পড়িয়াছে, সেইখানে আসিয়া দাঁড়াইল।
পূর্বে বলিয়াছি, আমার গুহার পাশেই ঝরনার জল প্রপাতের মতো নীচে পড়িয়াছে। যেখানে এই প্রপাত সবেগে উচ্ছলিত হইয়া পতিত হইয়াছে, সেইখানে পাথরের মাঝখানে একটি গোলাকার কুণ্ড সৃষ্টি করিয়াছিল। এই নাতিগভীর গর্তটি পরিপূর্ণ করিয়া স্বচ্ছ জল আবার নীচের দিকে গড়াইয়া পড়িতেছিল। রুমা এই স্থানে আসিয়া দাঁড়াইল। একবার সতর্কভাবে চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া কক্ষ হইতে বর্তুলাকৃতি জলপাত্রটি নামাইয়া রাখিল, তারপর ধীরে ধীরে দেহের বস্ত্র উন্মোচন করিতে লাগিল।
অসন্দিগ্ধচিত্তা হরিণীর পানে অদূরবর্তী চিতাবাঘ যেরূপ লোলুপ ক্ষুধিতভাবে চাহিয়া থাকে, আমিও সেইভাবে তাহাকে দেখিতে লাগিলাম। মধ্যাহ্নের দীপ্ত সূর্যকিরণে তাহার শুভ্র যৌবনকঠিন দেহ হইতে যেন লাবণ্যের ছটা বিকীর্ণ হইতেছিল। বস্ত্র খুলিয়া ফেলিয়া সে অলসভাবে দুই বাহু তুলিয়া তাহার সোমলতার মতো উজ্জ্বল কেশজাল জড়াইতে লাগিল। তারপর শূকরদন্তের মতো বাঁকা তীক্ষ্ণাগ্র একটা ঝকঝকে অস্ত্র পরিত্যক্ত বস্ত্রের ভিতর হইতে তুলিয়া লইয়া চুলের মধ্যে গুজিয়া দিল।
এইরূপে কুণ্ডলিত কুন্তলভার সংবরণ করিয়া রুমা শিলাপট্টের উপর হইতে ঝুঁকিয়া বোধ করি জলে নিজের প্রতিবিম্ব দেখিবার চেষ্টা করিল। তারপর হর্ষসূচক একটি শব্দ করিয়া জলের মধ্যে লাফাইয়া পড়িল।
দুর্নিবার কৌতূহল ও লোভের বশবর্তী হইয়া আমি নিজের অজ্ঞাতসারেই গুহা হইতে বাহির হইয়া আসিলাম। ইহারা যেদিন প্রথম আসে সেদিন আমি যে শিলাপৈঠার উপর বসিয়া ধনুকে গুণ সংযোগ করিতেছিলাম, গিরগিটির মতো গুঁড়ি মারিয়া সেই পৈঠার উপর উপস্থিত হইলাম। ইহার দশ হাত নীচেই জলের কুণ্ড। গলা বাড়াইয়া দেখিলাম রুমা আবক্ষ জলে ডুবাইয়া বসিয়া আছে এবং নিজের ভাষায় গুনগুন করিয়া গান করিতেছে। স্বচ্ছ নির্মল জলের ভিতর হইতে তাহার দেহখানি পরিষ্কার দেখা যাইতেছে। শীকরকণাস্পৃষ্ট চূর্ণকুন্তল বেষ্টিত মুখটি প্রস্ফুট জলপুষ্পের মতো দেখাইতেছে।
নির্নিমেষ-নয়নে এই নিভৃত স্নানরতার পানে কতক্ষণ চাহিয়া রহিলাম, বলিতে পারি না। অগ্নিগর্ভ মেঘ আমার বুকের ভিতর গুরুগুরু করিতে লাগিল।
ক্রীড়াচ্ছলে দুই হাতে জল ছিটাইতে ছিটাইতে হঠাৎ এক সময় রুমা চোখ তুলিয়া চাহিল। তাহার গান ও হস্তসঞ্চালন একসঙ্গে বন্ধ হইয়া গেল। আমার বুভূক্ষু ভীষণ চক্ষুর সহিত তাহার বিস্ফারিত ভীত চক্ষু কিছুক্ষণ আবদ্ধ হইয়া রহিল। তারপর অস্ফুট চিৎকার করিয়া সে জল হইতে উঠিয়া পলাইবার চেষ্টা করিল।
এই সুযোগ! আমি আর দ্বিধা না করিয়া উপর হইতে জলে লাফাইয়া পড়িলাম। রুমা তখনও জল হইতে উঠিতে পারে নাই, জল-কন্যার মতো তাহার সিক্ত শীতল দেহ আমি দুই হাতে জড়াইয়া ধরিলাম।
কিন্তু সিক্ত পিচ্ছিলতার জন্যই তাহাকে ধরিয়া রাখিতে পারিলাম না, সে তাহার দেহটিকে সংসর্পিত বিভঙ্গিত করিয়া আমার হাত ছাড়াইয়া লইল, তারপর বিদ্যুদ্বেগে তীরে উঠিয়া এক হস্তে ভূপতিত বস্ত্র তুলিয়া লইয়া পশ্চাদ্দিকে একটা ভয়চকিত দৃষ্টি হানিয়া নিমেষমধ্যে অন্তর্হিত হইয়া গেল।
ব্যর্থ-মনোরথে নিজের গুহায় ফিরিয়া আসিয়া দেখিলাম, নিম্নে ভীষণ গোলযোগ বাধিয়া গিয়াছে। অসংবৃতবস্ত্রা রুমা নারীগণের মধ্যে দাঁড়াইয়া উত্তেজিতভাবে কথা কহিতেছে এবং অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া উপরদিকে দেখাইতেছে। নারীগণ সমস্বরে কলরব করিতেছে। ইতিমধ্যে একদল পুরুষ ফিরিয়া আসিল। তাহারা রুমার বিবৃতি শুনিয়া তীর-ধনুক ও বল্লম হস্তে দলবদ্ধভাবে আমার গুহার দিকে উঠিতে আরম্ভ করিল।
এই স্থানে থাকা আর নিরাপদ নহে দেখিয়া আমি গুহা ছাড়িয়া পলায়ন করিলাম। গাছপালার আড়ালে লুকাইয়া, পাহাড়ের বন্ধুর পথ ধরিয়া বহুদূর দক্ষিণে উপস্থিত হইলাম। অতঃপর এতদূর পর্যন্ত কেহ আমার অনুসরণ করিবে না বুঝিয়া এক ঝোপের মধ্যে বসিয়া চিন্তা করিতে লাগিলাম।
এইখানে বসিয়া চিন্তা করিতে করিতে হঠাৎ একটা কথা আমার মনে উদয় হইল। তীর-বিদ্ধের মতো আমি লাফাইয়া উঠিয়া দাঁড়াইলাম। — একথা এতদিন মনে হয় নাই কেন? শিরায় রক্ত নাচিয়া উঠিল, আমি দ্রুতপদে আবার চলিতে আরম্ভ করিলাম।
আমাদের গ্রামের কিনারায় আসিয়া যখন পৌঁছিলাম, তখন গোধূলি আগতপ্রায়। দূর হইতে শুনিতে পাইলাম, ডাইনী বুড়ি রিক্খা গাহিতেছে—
“রাত্রে পাহাড়-দেবতার মুখে আগুন জ্বলে। কেউ দেখে না, শুধু আমি দেখি। দেবতা কি চায়? মানুষ চায়— মানুষের তাজা রক্ত চায়! এ জাত বাঁচবে না, এ জাত মরবে! দেবতা রক্ত চায়— জোয়ানের তাজা রক্ত! কে রক্ত দেবে— কে দেবতাকে খুশি করবে! এ জাত মরবে— মেয়ে নেই! এ জাত মরবে— দেবতা রক্ত চায়! হে দেবতা, খুশি হও, তোমার মুখের আগুন নিবিয়ে দাও! মেয়ে পাঠাও, মেয়ে পাঠাও!…”
রিক্খার গুহা গ্রামের এক প্রান্তে। চুপি চুপি পিছন হইতে গিয়া তাহার কানের কাছে বলিলাম, “রিক্খা, দেবতা তোর কথা শুনেছে— মেয়ে পাঠিয়েছে!”
রিক্খা চমকিয়া ফিরিয়া বলিল, “গাক্কা! তুই ফিরে এলি? ভেবেছিলাম, দেবতা তোকে নিয়েছে— কি বললি— আমার কথা দেবতা শুনেছে?”
“হ্যাঁ, শুনেছে। দেবতা অনেক মেয়ে পাঠিয়েছে। …শোন্ রিক্খা, গাঁয়ের ছেলেদের গিয়ে বল্ যে, পাহাড়-দেবতার মুখ থেকে একপাল মানুষ বেরিয়েছে— তাদের মধ্যে অর্ধেক মেয়ে। রাত্রে উপত্যকার ওধারে যেখানে আগুন জ্বলে, সেইখানে ওরা থাকে। মেয়েদের চেহারা ঠিক ঐ চাঁদের মতো, — নীল তাদের চোখ, চুলে আলো ঠিক্রে পড়ে। আমি দেখেছি। তুই ছেলেদের বল্, যদি বৌ চায় আমার সঙ্গে আসুক। আমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবো। আমাদের গাঁয়ে যত জোয়ান আছে, সবাইকে ডাক। আজ রাত্তিরেই আমরা পুরুষগুলোকে মেরে ফেলে মেয়েদের কেড়ে নেব।”
আকাশে খণ্ডচন্দ্র তখন অস্ত গিয়াছে। আমরা প্রায় দুই শত জোয়ান অন্ধকারে গা ঢাকিয়া নিঃশব্দে আগন্তুকদের গৃহপ্রাচীরের নিকটে উপস্থিত হইলাম। প্রাচীরের মধ্যে সকলে সুপ্ত— কোথাও শব্দ নাই। ধুনির আগুন জ্বলিয়া সূক্ষ্ম ভস্ম-আবরণে ঢাকা পড়িয়াছে। তাহারই অস্ফুট আলোকে দেখিলাম, ছায়ামূর্তির মতো চারিজন প্রহরী সশস্ত্রভাবে প্রাচীরের বাহিরে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। বুঝিলাম, আজ দ্বিপ্রহরে আমাকে দেখিবার পর ইহারা সতর্কতা অবলম্বন করিয়াছে।
পূর্ব হইতেই স্থির ছিল। আমরা চারিজন তীরন্দাজ এক একটি প্রহরীকে বাছিয়া লইলাম। একসঙ্গে চারিটি ধনুকে টংকারধ্বনি হইল— অন্ধকারে চারিটি তীর ছুটিয়া গেল। আমার তীর প্রহরীর কণ্ঠে প্রবেশ করিয়া অপর দিকে ফুঁড়িয়া বাহির হইল। নিঃশব্দে প্রহরী ভূপতিত হইল। তারপর বিকট কোলাহল করিয়া সকলে প্রাচীর আক্রমণ করিল। নৈশ নিস্তব্ধতা সহসা শতধা ভিন্ন হইয়া গেল।
আমি জানিতাম ব্যূহের কোন্ দিকে রুমা শয়ন করে। আমি সেই দিকে গিয়া প্রাচীর উল্লঙ্ঘন করিয়া দেখিলাম, ভিতরে সকলে জাগিয়া উঠিয়াছে, পুরুষগণ অস্ত্র লইয়া ব্যূহ-প্রাচীরের দিকে ছুটিতেছে। একজন পুরুষ দীর্ঘ বল্লম-আঘাতে অগ্নির ভস্মাচ্ছাদন দূর করিয়া দিল, অমনই লেলিহান আরক্তচ্ছটায় দিক্ উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল।
প্রাচীর উল্লঙ্ঘন করিবার পর রুমাকে যখন দেখিতে পাইলাম, তখন সে সদ্য নিদ্রা হইতে উঠিয়া হতবুদ্ধির মতো ইতস্তত দৃষ্টিপাত করিতেছে, তাহার চারিপাশে সদ্যোত্থিত নারীগণ আর্ত-ক্রন্দন করিতেছে। আমি লাফাইয়া গিয়া রুমার উপর পড়িলাম, তাহাকে দুই হাতে তুলিয়া লইয়া কোনও দিকে ভ্রূক্ষেপ না করিয়া দৌড়িতে আরম্ভ করিলাম। কয়েক পদ যাইতে না-যাইতে দেখিলাম, একজন পুরুষ শাণিত দীর্ঘ অস্ত্র উত্তোলিত করিয়া আমার দিকে ছুটিয়া আসিতেছে। রুমাকে মাটিতে ফেলিয়া দিয়া আমি ক্ষিপ্রহস্তে মাটি হইতে একখণ্ড পাথর তুলিয়া লইয়া তাহাকে ছুঁড়িয়া মারিলাম। মস্তকে আঘাত লাগিয়া সে মৃতবৎ পড়িয়া গেল। রুমা চিৎকার করিয়া উঠিল। আমি আবার তাহাকে কাঁধে ফেলিয়া ছুটিলাম।
আমাদের দলের অন্য সকলে তখন প্রাচীর ডিঙাইয়া ভিতরে ঢুকিতেছে— ব্যূহের কেন্দ্রস্থলে ভীষণ যুদ্ধ চলিতেছে। দুই পক্ষেরই মানুষ পড়িতেছে, মরিতেছে— কেহ আহত হইয়া বিকট কাতরোক্তি করিতেছে। আমি দ্বারের নিকট উপস্থিত হইয়া দেখিলাম সেখানে জীবিত কেহ নাই, কয়েকটি রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়িয়া আছে। দ্বার অতিক্রম করিতে যাইতেছি, এমন সময় রুমা সহসা যেন মোহনিদ্রা হইতে জাগিয়া উঠিল। নিজের কেশের মধ্যে হাত দিয়া সেই উজ্জ্বল বাঁকা অস্ত্রটা বাহির করিল, তারপর ক্ষিপ্তের মতো চিৎকার করিয়া আমার কপালের পাশে সজোরে বসাইয়া দিল।
কপাল হইতে ফিন্কি দিয়া রক্ত বাহির হইতে লাগিল। আমি আবার তাহাকে মাটিতে ফেলিয়া দিলাম। তাহার হাত হইতে অস্ত্রটা কাড়িয়া লইয়া তাহাকে নির্দয়ভাবে মাটিতে চাপিয়া ধরিয়া বলিলাম, “তুই আমার বৌ! তুই আমার রুমা! এই রক্ত দিয়ে আমি তোকে আমার করে নিলাম!”— বলিয়া আমার ললাটস্রুত রক্ত হাতে করিয়া তাহার কপালে চুলে মাখাইয়া দিলাম।
ওদিকে তখন যুদ্ধ শেষ হইয়া গিয়াছে— বিপক্ষ দলের একটি পুরুষও জীবিত নাই। আমাদের দলের যাহারা বাঁচিয়া আছে, তাহারা রক্তলিপ্ত দেহে উন্মত্ত গর্জন করিয়া নারীদের অভিমুখে ছুটিয়াছে।
৫ শ্রাবণ ১৩৩৯