মৃৎপ্রদীপ

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রাণিতত্ত্ববিৎ পণ্ডিতেরা মাটি খুঁড়িয়া অধুনালুপ্ত প্রাগৈতিহাসিক জীবের যে সকল অস্থি-কঙ্কাল বাহির করেন, তাহাতে রক্তমাংস সংযোগ করিয়া তাহার জীবিতকালের বাস্তব মূর্তিটি তৈয়ারি করিতে গিয়া অনেক সময় তাঁহাদিগকে নিছক কল্পনার আশ্রয় লইতে হয়। ফলে যে মূর্তি সৃষ্টি হয়, সত্যের সহিত তাহার সাদৃশ্য আছে কি না এবং থাকিলেও তাহা কতদূর, সে সম্বন্ধে মতভেদ ও বিবাদ-বিসংবাদ কিছুতেই শেষ হয় না।

আমাদের দেশের ইতিহাসও কতকটা ঐ ভূ-প্রোথিত অতিকায় জন্তুর মতো। যদি বা বহু ক্লেশে সমগ্র কঙ্কালটুকু পাওয়া যায়, তাহাতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা হওয়া দূরের কথা, তাহার সজীব চেহারাখানা যে কেমন ছিল তাহা আংশিকভাবে প্রতিপন্ন হইবার পূর্বেই বড় বড় পণ্ডিতেরা অত্যন্ত তেরিয়া হইয়া এমন মারামারি কাটাকাটি শুরু করিয়া দেন যে, রথি-মহারথী ভিন্ন অন্য লোকের সে কুরুক্ষেত্রের দিকে চক্ষু ফিরাইবার আর সাহস থাকে না। এবং যুদ্ধের অবসানে শেষ পর্যন্ত সেই কঙ্কালের বিভিন্ন হাড় কয়খানাই রণাঙ্গনে ইতস্তত পড়িয়া থাকিতে দেখা যায়।

তাই, যখনই আমাদের জন্মভূমির এই কঙ্কালসার ইতিহাসখানা আমার চোখে পড়ে তখনই মনে হয়, ইহা হইতে আসল বস্তুটির ধারণা করিয়া লওয়া সাধারণ লোকের পক্ষে কত না দুরূহ ব্যাপার। যে মৃৎপ্রদীপের কাহিনী লিখিতে বসিয়াছি, তাহারই কথা ধরি না কেন। প্রাচীন পাটলিপুত্রের যে সামান্য ধ্বংসাবশেষ খনন করিয়া বাহির করা হইয়াছে, তাহারই চারিপাশে স্বপ্নাবিষ্টের মতো ঘুরিতে ঘুরিতে জঞ্জাল-স্তূপের মধ্যে এই মৃৎপ্রদীপটি কুড়াইয়া পাইয়াছিলাম। নিতান্ত একেলে সাধারণ মাটির প্রদীপের মতোই তাহার চেহারা, ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়া প্রায় কাগজের মতো পাতলা হইয়া গিয়াছে। কিন্তু এতকাল পরেও তাহার মুখের কাছটিতে একটুখানি পোড়া দাগ লাগিয়া আছে। এই নোনাধরা জীর্ণ বিশেষত্ববর্জিত প্রদীপটি দেখিয়া কে ভাবিতে পারে যে, উহার মুখের ঐ কালির দাগটুকু একদিন ইতিহাসের একটি পৃষ্ঠাকে একেবারে কালো করিয়া দিয়াছিল এবং উহারই ঊর্ধ্বোত্থিত ক্ষুদ্র শিখার বহ্নিতে একটা রাজ্য পুড়িয়া ছারখার হইয়া গিয়াছিল।

অনুসন্ধিৎসু ঐতিহাসিকেরা বোধ করি অবহেলা করিয়া এই তুচ্ছ প্রদীপটা ফেলিয়া দিয়াছিলেন, মিউজিয়ামে স্থান দেন নাই। আমি সযত্নে কুড়াইয়া আনিয়া সন্ধ্যার পর আমার নির্জন ঘরে মধুমিশ্রিত গব্য ঘৃত দিয়া উহা জ্বালিলাম। কতদিন পরে এ প্রদীপ আবার জ্বলিল? পুরাবৃত্তের কোন্‌ মসীলিপ্ত অধ্যায়কে আলোকিত করিল? বিজ্ঞ পুরাতত্ত্ববিৎ পণ্ডিতেরা তাহা কোথা হইতে জানিবেন? উহার অঙ্গে তো তাম্রশাসন-শিলালিপি লটকানো নাই! সে কেবল আমার, — এই জাতিস্মরের মস্তিষ্কের মধ্যে দুরপনেয় কলঙ্কের কালিমা দিয়া মুদ্রিত হইয়া আছে।

প্রদীপ জ্বলিলে যখন ঘরের দ্বার বন্ধ করিয়া বসিলাম, তখন নিমেষমধ্যে এক অদ্ভূত ইন্দ্রজাল ঘটিয়া গেল। স্তম্ভিত কাল যেন অতীতের সঙ্গী এই প্রদীপটাকে আবার জ্বলিয়া উঠিতে দেখিয়া বিস্মিত দৃষ্টিতে পিছু ফিরিয়া তাকাইয়া রহিল। এই পাটলিপুত্র নগর মন্ত্রবলে পরিবর্তিত হইয়া কবেকার এক অখ্যাত মগধেশ্বরের মহাস্থানীয় রাজধানীতে পরিণত হইল। আর আমার মাথার মধ্যে যে স্মৃতিপুত্তলিগুলি এতক্ষণ স্বপ্নের মতো ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল, তাহারা সজীব হইয়া আমার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। প্রত্যেকটি ক্ষুদ্র ঘটনা— কত নগণ্য অনাবশ্যক কথা— এই বর্তিকার আলোকে দীপ্তিমান জীবন্ত স্পষ্ট হইয়া উঠিল। আমার সম্মুখ হইতে বর্তমান মুছিয়া একাকার হইয়া গেল, কেবল অতীতের বহুদূর জন্মান্তরের স্মৃতি ভাস্বর হইয়া জ্বলিতে লাগিল।

সেই প্রদীপ সম্মুখে ধরিয়া তাহারই আলোতে আজ এই কাহিনী লিখিতেছি।

আজি হইতে ষোল শতাব্দী আগেকার কথা।

ক্ষুদ্র ভূস্বামী ঘটোৎকচগুপ্তের পুত্র চন্দ্রগুপ্ত লিচ্ছবি রাজবংশে বিবাহ করিয়া শ্যালককুলের বাহুবলে পাটলিপুত্র দখল করিয়া রাজা হইলেন। রাজা হইলেন বটে, কিন্তু নামে মাত্র। পট্টমহাদেবী লিচ্ছবিদুহিতা কুমারদেবীর দুর্ধর্ষ প্রতাপে চন্দ্রগুপ্ত মাথা তুলিতে পারিলেন না। রাজমুদ্রায় রাজার মূর্তির সহিত মহাদেবীর মূর্তি ও লিচ্ছবিকুলের নাম উৎকীর্ণ হইতে লাগিল। রাজার নামে রানী স্বেচ্ছামত রাজ্যশাসন করিতে লাগিলেন। রাজা একবার নিজ আজ্ঞা প্রচার করিতে গিয়া দেখিলেন, তাঁহার আজ্ঞা কেহ মানে না। চন্দ্রগুপ্ত বীরপুরুষ ছিলেন, তাঁহার আত্মাভিমানে আঘাত লাগিল; কিন্তু কিছুই করিতে পারিলেন না। নিষ্ফল ক্রোধে শক্তিশালী শ্যালককুলের প্রতি বক্রদৃষ্টিপাত করিয়া তিনি মৃগয়া, সুরা ও দ্যুতক্রীড়ায় মনোনিবেশ করিলেন।

প্রজাদের তাহাতে বিশেষ আপত্তি ছিল না। রাজা বা রানী যিনিই রাজত্ব করুন, তাহাদের কিছু আসে যায় না। মহামারী, দুর্ভিক্ষ অথবা যুদ্ধের হাঙ্গামা না থাকিলেই তাহারা সন্তুষ্ট। কান্ববংশ লুপ্ত হইবার পর বহুবর্ষব্যাপী যুদ্ধ-বিগ্রহ অন্তর্বিবাদে দেশ অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছিল। প্রকাণ্ড মগধ সাম্রাজ্য বিষ্ণুচক্রে ছিন্ন সতীদেহের ন্যায় খণ্ড খণ্ড হইয়া বহু ক্ষুদ্র রাজ্যের সমষ্টিতে দাঁড়াইয়াছিল। ক্ষুদ্র রাজারা ক্ষুদ্র কারণে পরস্পর কলহ করিয়া প্রজার দুর্গতি বাড়াইয়া তুলিয়াছিলেন। এই সময় চন্দ্রগুপ্ত পাটলিপুত্র ও তাহার পারিপার্শ্বিক ভূখণ্ড অধিকার করিয়া কিছু শান্তি আনয়ন করিয়াছিলেন। শান্তিতে জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতে পাইয়া প্রজারা তৃপ্ত ছিল, রাজা বা রানী— কে প্রকৃতপক্ষে রাজ্যশাসন করিতেছেন, তাহা দেখিবার তাহাদের প্রয়োজন ছিল না।

যাহা হউক, তরুণী পট্টমহিষী একমাত্র শিশুপুত্র সমুদ্রগুপ্তকে ক্রোড়ে লইয়া রাজ-অবরোধ হইতে প্রজাশাসন করিতেছেন, দেশে নিরুপদ্রব শান্তিশৃঙ্খলা বিরাজ করিতেছে, এমন সময় একদিন শরৎকালের নির্মল প্রভাতে মহারাজ চন্দ্রগুপ্ত নগরোপকণ্ঠের বনমধ্যে মৃগয়া করিতে গেলেন। মহারাজ মৃগয়ায় যাইবেন, সুতরাং পূর্ব হইতে বনমধ্যে বস্ত্রাবাস ছাউনি পড়িল। কারুকার্যখচিত রক্তবর্ণের পট্টবাস সকল অকালপ্রফুল্ল কিংশুকগুচ্ছের ন্যায় বনস্থলী আলোকিত করিল। কিঙ্করী, নর্তকী, তাম্বূলিক, সংবাহক, সূপকার, নহাপিত প্রভৃতি বহুবিধ দাসদাসী কর্ম-কোলাহলে ও আনন্দ কলরবে কাননলক্ষ্মীর বিশ্রব্ধ শান্তি ভঙ্গ করিয়া দিল। তারপর যথাসময়ে পরিষদ-পরিবেষ্টিত হইয়া সুরারুণনেত্র মগধেশ্বর মৃগয়াস্থলে উপস্থিত হইলেন।

প্রভাতে দ্যূতক্রীড়া ও তিত্তিরি-যুদ্ধ দর্শন করিয়া চন্দ্রগুপ্ত আনন্দে কালহরণ করিলেন। দ্বিপ্রহরে পানভোজনের পর অন্য সকলকে শিবিরে রাখিয়া মাত্র চারিজন বয়স্য সঙ্গে মহারাজ অশ্বারোহণে অরণ্যমধ্যে প্রবেশ করিলেন। বয়স্যরা সকলেই মহারাজের সমবয়স্ক যুবা, সকলেই সমান লম্পট ও উচ্ছৃঙ্খল। চাটুমিশ্রিত ব্যঙ্গ-পরিহাস করিতে করিতে তাহারা মহারাজের সঙ্গে চলিল।

মৃগ-অন্বেষণে বিচরণ করিতে করিতে প্রায় দিবা তৃতীয় প্রহরে এক ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনীর কূলে সহসা তাঁহাদের গতিরোধ হইল। সর্বাগ্রে মহারাজ দেখিলেন, তটিনীর উচ্চ তটের উপর ছিন্নমৃণাল কুমুদিনীর মতো এক নারীমূর্তি পড়িয়া আছে। দেহে বস্ত্র কিংবা আভরণ কিছুই নাই— সম্পূর্ণ নগ্ন। কণ্ঠে, প্রকোষ্ঠে, কর্ণে অল্প রক্ত চিহ্ন। দেখিলে বুঝা যায়, দস্যুতে ইহার সর্বস্ব লুণ্ঠন করিয়া পলাইয়াছে।

রাজা ত্বরিতপদে অশ্ব হইতে নামিয়া রমণীমূর্তির নিকটে গেলেন। নির্নিমেষ নেত্রে তাহার নগ্ন দেহ-লাবণ্যের দিকে চাহিয়া রহিলেন। নারীর বয়স ষোড়শ কি সপ্তদশের অধিক হইবে না। নবোদ্ভিন্ন যৌবনের পরিপূর্ণ বিকশিত রূপ; রাজা দুই চক্ষু ভরিয়া পান করিতে লাগিলেন। তাহার পর নতজানু হইয়া সন্তর্পণে বক্ষে হস্তার্পণ করিয়া দেখিলেন— প্রাণ আছে, দ্রুত হৃৎস্পন্দন অনুভূত হইতেছে।

বয়স্য চারিজন ইতিমধ্যে রাজার পশ্চাতে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল ও লুব্ধদৃষ্টিতে সংজ্ঞাহীনার অনাবৃত সৌন্দর্য নিরীক্ষণ করিতেছিল। সহসা রাজা তাহাদের দিকে ফিরিয়া কহিলেন, “এ নারী কাহার?”

রাজার আরক্ত মুখমণ্ডল ও চক্ষুর ভাব দেখিয়া বয়স্যগণ পরিহাস করিতে সাহসী হইল না। একজন কুণ্ঠাজড়িত কণ্ঠে বলিল, “রাজ্যের সকল নর-নারীই মহারাজের।”

মহারাজ বোধ করি অন্য কিছু ভাবিয়া এই প্রশ্ন করিয়াছিলেন, কিন্তু এইরূপ উত্তর পাইয়া তিনি প্রদীপ্ত দৃষ্টিতে দ্বিতীয় বয়স্যের দিকে ফিরিলেন। পুনরায় প্রশ্ন করিলেন, “এ নারী কাহার?”

মন বুঝিয়া বয়স্য বলিল, “মহারাজের।”

তৃতীয় বয়স্যের দিকে ফিরিয়া চন্দ্রগুপ্ত জিজ্ঞাসু নেত্রে চাহিলেন।

কিন্তু তৃতীয় বয়স্য— সে অন্তরের দুর্দম লালসা গোপন করিতে পারিল না— ঈষৎ হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, “দস্যু-উপদ্রুতা নারী শ্রীমৎ মগধেশ্বরের ভোগ্যা নয়। এই নারীদেহটা মহারাজা অধমকে দান করুন।”

বারুণী-কষায়িত নেত্র কিছুক্ষণ তাহার মুখের উপর স্থাপন করিয়া মহারাজ উচ্চহাস্য করিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “বিট, স্বর্গের পারিজাত লইয়া তুই কি করিবি? এ নারী আমার”— এই বলিয়া উষ্ণীষ খুলিয়া সূক্ষ্ম বস্ত্রজালে রমণীর সবার্ঙ্গ ঢাকিয়া দিলেন।

লুব্ধ বয়স্য তখনও আশা ছাড়ে নাই— রূপসীর প্রতি সতৃষ্ণ একটা কটাক্ষ হানিয়া বলিল, “কিন্তু মহারাজ, এ অনুচিত। পট্টমহাদেবী শুনিলে…”

বিদ্যুৎস্পৃষ্টের ন্যায় রাজা ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। কর্কশ কণ্ঠে কহিলেন, “পট্টমহাদেবী? রে পীঠমর্দ, পট্টমহাদেবী আমার ভর্ত্রী নয়, আমি তার ভর্তা— বুঝিলি? এ রাজ্য আমার, এ নারী আমার— পট্টমহাদেবীর নয়।”

এই আকস্মিক উগ্র ক্রোধে বয়স্যগণ ভয়ে নিশ্চল বাক্‌শূন্য হইয়া গেল। চন্দ্রগুপ্ত নিজেকে কিঞ্চিৎ সংযত করিয়া কহিলেন, “এই নারীকে আমি মহিষীরূপে গ্রহণ করিলাম। বয়স্যগণ, মহাদেবীকে প্রণাম কর।”

যন্ত্রচালিতবৎ বয়স্যগণ প্রণাম করিল।

তখন সেই সংজ্ঞাহীন দেহ সন্তর্পণে বক্ষে তুলিয়া মহারাজ অশ্বারোহণে শিবিরে ফিরিয়া চলিলেন। মূর্ছিতার অবেণীবদ্ধ মুক্ত কুন্তল কৃষ্ণ ধূমকেতুর মতো পশ্চাতে উড়িতে উড়িতে চলিল।

শিবিরে ফিরিয়া সংজ্ঞালাভ করিবার পর রমণী যে পরিচয় দিল তাহা এইরূপ—

তাহার নাম সোমদত্তা। সে শ্রাবস্তীর এক শ্রেষ্ঠীর কন্যা, পিতার সহিত চম্পাদেশে যাইতেছিল, পথে আটবিক দস্যু কর্তৃক অপহৃতা হয়। তাহার পিতাকে দস্যুরা মারিয়া ফেলে। অতঃপর দস্যুপতি তাহার রূপযৌবন দেখিয়া তাহাকে আত্মসাৎ করিতে মনস্থ করে। অন্য দস্যুগণ তাহাতে ঘোরতর আপত্তি করিল। ফলে তাহারা পরস্পরের সহিত বিবাদ-বিসংবাদ আরম্ভ করিল এবং একে অন্যের পশ্চাদ্ধাবন করিতে গিয়া, যাহাকে লইয়া কলহ তাহাকেই অরক্ষিত ফেলিয়া গেল। যাইবার সময় একজন চতুর দস্যু, পাছে সোমদত্তা কোথাও পলায়ন করে, এই ভয়ে তাহার বস্ত্র কাড়িয়া লইয়া তাহাকে অজ্ঞান করিয়া রাখিয়া যায়।

যথাকলে চন্দ্রগুপ্ত সোমদত্তাকে দোলায় তুলিয়া নগরে লইয়া গেলেন। শাস্ত্রমত বিবাহ হইল কি না জানা গেল না, যদি বা হইয়া থাকে তাহা গান্ধর্ব কিংবা পৈশাচ-জাতীয়। যাহা হউক, দাসীসহচরীপরিবৃতা সোমদত্তা রাজপুরীর পুরন্ধ্রী হইয়া বাস করিতে লাগিল। তাহার অবস্থানের জন্য মহারাজ একটি স্বতন্ত্র মহল নির্দেশ করিয়া দিলেন।

কুমারদেবী রাজার এই দুষ্মন্ত-উপাখ্যান শুনিলেন, কিন্তু ঘৃণাভরে কোনও কথা বলিলেন না। বিশেষত, সেকালের রাজাদের পক্ষে ইহা এমন কিছু গর্হিত কার্য ছিল না। একাধিক পত্নী ও উপপত্নী সকল রাজ-অন্তঃপুরেই স্থান পাইত। এমন কি, প্রকাশ্য বেশ্যাকে বিবাহ করাও রাজন্যসমাজে অপ্রচলিত ছিল না। কুমারদেবী অবিচলিত নিষ্ঠার সহিত পুত্রকে সম্মুখে রাখিয়া রাজকার্য পরিচালনা করিতে লাগিলেন। মহারাজ চন্দ্রগুপ্ত মধুভাণ্ডের নিকট ষট্‌পদের মতো সোমদত্তার পদপ্রান্তে পড়িয়া রহিলেন।

এইরূপে ছয় মাস কাটিল।

তারপর একদিন চূত-মধুক-সুগন্ধি বসন্তকালের প্রারম্ভে জলস্থল অন্ধকার করিয়া পঙ্গপালের মতো এক বিরাট বাহিনী দেশ ছাইয়া ফেলিল। ইতিহাসে এই ঘটনার উল্লেখমাত্র আছে। পুষ্করণা নামক মরুরাজ্যের অধিপতি চন্দ্রবর্মা দিগ্বিজয় যাত্রার পথে মগধ আক্রমণ করিলেন। হীনবীর্য মগধ বিনা যুদ্ধে অধিকৃত হইল। কিন্তু চন্দ্রবর্মা যাহা সংকল্প করিয়াছিলেন তাহা এত সহজে সিদ্ধ হইল না, — তিনি পাটলিপুত্রে জয়স্কন্ধাবার স্থাপন করিতে পারিলেন না। তাঁহার বিশাল সেনা-সমুদ্রের মধ্যস্থলে পাটলিপুত্র দুর্গ দশ লৌহদ্বারে ইন্দ্রকীলক আঁটিয়া দিয়া ক্ষুদ্র পাষাণদ্বীপের মতো জাগিয়া রহিল।

মগধেশ্বর তখন সোমদত্তার গজদন্ত পালঙ্কে শুইয়া ঘুমাইতেছিলেন; প্রহরিণীর মুখে এই বার্তা শুনিয়া শয্যায় উঠিয়া বসিলেন। তাঁহার বহুকাললুপ্ত ক্ষত্রতেজ নিমেষের জন্য জাগ্রত হইয়া উঠিল, কক্ষের চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, “আমার বর্ম?”— বলিয়াই তাঁহার কুমারদেবীর কথা স্মরণ হইল, মুখের দীপ্তি নিবিয়া গেল। ক্ষীণ শ্লেষের হাসি হাসিয়া বলিলেন, “আক্রমণ করিয়াছে তা আমি কি করিব। পট্টমহাদেবীর কাছে যাও।”— বলিয়া পুনশ্চ শয্যায় শয়ন করিলেন।

সোমদত্তা প্রাসাদচূঁড়া হইতে দ্রুত চঞ্চলপদে নামিয়া আসিয়া দেখিল, রাজা পূর্ববৎ নিশ্চিন্তে ঘুমাইতেছেন। তাহার শিখরতুল্য দশনে বিদ্যুতের ন্যায় হাসি হাসিয়া গেল। রাজার মস্তকে মৃদু করস্পর্শ করিয়া অস্ফুটস্বরে কহিল, “ঘুমাও বীরশ্রেষ্ঠ! ঘুমাও!”

এদিকে প্রহরিণী পট্টমহাদেবীকে গিয়া সংবাদ দিল। কুমারদেবী তখন ষষ্ঠবর্ষীয় কুমার সমুদ্রগুপ্তকে শিক্ষা দিতেছিলেন : “পুত্র, তুমি লিচ্ছবিকুলের দৌহিত্র, এ কথা কখনও ভুলিও না। পাটলিপুত্র তোমার পাদপীঠ মাত্র। ভরতের মতো, মৌর্য চন্দ্রগুপ্তের মতো, চণ্ডাশোকের মতো এই সমুদ্রবেষ্টিত বসুন্ধরা তোমার সাম্রাজ্য, — এ কথা স্মরণ রাখিও। তুমি বাহুবলে গুর্জর হইতে সমতট, হিমাদ্রি হইতে অনার্য পাণ্ড্য-দেশ পর্যন্ত পদানত করিবে। তোমার যজ্ঞীয় অশ্ব উত্তরাপথে ও দাক্ষিণাপথে, আর্যাবর্তে ও দাক্ষিণাত্যে সমান অপ্রতিহত হইবে।”

বালক রত্নখচিত ক্রীড়াকন্দুক হস্তে লইয়া গভীরমুখে মাতার কথা শুনিতেছিল।

এমন সময় প্রতিহারিণীর মুখে ভয়ংকর সংবাদ শুনিয়া মহাদেবীর মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল; ক্ষণকাল নিশ্চল হইয়া বসিয়া রহিলেন। একবার ইচ্ছা হইল জিজ্ঞাসা করেন, আর্যপুত্র কোথায়। কিন্তু সে ইচ্ছা নিরোধ করিয়া বলিলেন, “শীঘ্র কঞ্চুকীকে মহামাত্যের কাছে পাঠাও— এখনি তাঁহাকে আমার সম্মুখে উপস্থিত করুক। দুর্গের দ্বার সকল রুদ্ধ হউক। বিনা যুদ্ধে মহাস্থানীয় শত্রুর হস্তে সমর্পণ করিব না।”

মহাদেবীর আদেশের প্রয়োজন ছিল না, মহাসচিব ও সান্ধিবিগ্রহিক পূর্বেই দুর্গদ্বার রোধ করিয়াছিলেন। প্রাকারে প্রাকারে ভল্লহস্তে সতর্ক প্রহরী ঘুরিতেছিল, সিংহদ্বারগুলির উপরে বৃহৎ কটাহে তৈল উত্তপ্ত হইতেছিল। লৌহজালিকে সর্বাঙ্গ আচ্ছাদিত করিয়া স্নায়ুজ্যাযুক্ত ধনুহস্তে ধানুকিগণ ইন্দ্রকোষে লুক্কায়িত থাকিয়া পরিখা-পারস্থিত শত্রুর উপর বিষ-বিদূষিত শর নিক্ষেপ করিতেছিল। প্রাকারের হস্তিনখমধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকিয়া সেনানীগণ শত্রুর গতিবিধি লক্ষ্য করিতেছিল। বুভুক্ষিত কুম্ভীরদল পরিখার কমলবনের মধ্যে খাদ্যান্বেষণে ইতস্তত সঞ্চরণ করিয়া ফিরিতেছিল। বাহিরে শত্রুসৈন্য মাঝে মাঝে একযোগে দুর্গদ্বার আক্রমণ করিতেছিল। তখন মকরমুখ হইতে প্রচণ্ডবেগে তপ্ত— তৈল বর্ষিত হইতেছিল। আক্রমণকারীরা হতাহত সহচরদিগকে দুর্গদ্বারে ফেলিয়া ভগ্নোদ্যমে ফিরিয়া যাইতেছিল।

পূর্ণ একদিন এইভাবে যুদ্ধ হইল। চন্দ্রবর্মা রণহস্তীর দ্বারা দুর্গদ্বার ভাঙিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু সে চেষ্টাও বিফল হইল। সর্বাঙ্গে বাণবিদ্ধ হস্তী মাহুতকে ফেলিয়া দিয়া আর্তনাদ করিতে করিতে পলায়ন করিল। চন্দ্রবর্মা দেখিলেন, যুদ্ধ করিয়া দুর্গজয় সহজ নহে।

তখন তাঁহার সৈন্য যুদ্ধে ক্ষান্ত দিয়া দুর্গ বেষ্টন করিয়া বসিল। ক্রোশের পর ক্রোশ, যোজনের পর যোজন ব্যাপ্ত করিয়া তাহাদের শিবির পড়িল। নদীতে কাতারে কাতারে তরণী আসিয়া দুর্গ-প্রাকারের বাহিরে গণ্ডি রচনা করিল। পাটলিপুত্রে পিপীলিকারও আগম-নিগমের পথ রহিল না।

ভিতরে মহামাত্য কুমারদেবীকে গিয়া সংবাদ দিলেন, “আশু ভয়ের কারণ নাই। কিন্তু বর্বর চন্দ্রবর্মা আমাদের অনাহারে শুকাইয়া মারিবার চেষ্টা করিতেছে। দেখা যাক্‌, কতদূর কি হয়।”

দিগ্বিজয়ী রণপণ্ডিত চন্দ্রবর্মার উদ্দেশ্য কিন্তু দুই প্রকার ছিল। ক্ষুদ্র দুর্বল পাটলিপুত্র অচিরাৎ দখল করিতে তিনি বড় ব্যগ্র ছিলেন না। হইলে ভালো, না হইলেও বিশেষ ক্ষতি নাই; আপাতত মগধের অন্যত্র জয়স্কন্ধাবার স্থাপন করিলেই চলিবে। কিন্তু তাঁহার স্থল-সৈন্য বহুদূর পথ যুদ্ধ করিতে করিতে আসিয়া পরিশ্রান্ত— তাহাদের কিছুদিন বিশ্রামের প্রয়োজন। তাই তিনি তাঁহার নৌবহর নোঙ্গর ফেলিল। দুর্গাবরোধ ও শ্রান্তি অপনোদন একসঙ্গে চলিল।

দুর্গ অবরোধের পঞ্চম দিবসে মহামাত্য আসিয়া রাণীকে জানাইলেন যে, দুর্গের খাদ্যভার কমিতে আরম্ভ করিয়াছে— শীঘ্র ইহার কিছু বিধি-ব্যবস্থা করা আবশ্যক।

মন্ত্রীর সহিত কুমারদেবী বহুক্ষণ পরামর্শ করিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, “গোপনে খাদ্য আনিবার কোনও পথ কি নাই?”

সচিব বলিলেন, “হয়তো আছে, কিন্তু আমরা জানি না। নদীপথে খাদ্য আনা যাইতে পারিত, কিন্তু সে পথও বন্ধ। দুবৃত্ত চন্দ্রবর্মা নৌকা দিয়া ব্যূহ সাজাইয়া রাখিয়াছে।”

“তবে এখন উপায়?”

“একমাত্র উপায় আছে।”

তারপর আরও অনেকক্ষণ পরামর্শ চলিল।

শেষে মহামাত্য বিদায় লইলে পর কুমারদেবী অলক্ষিতে প্রাসাদশীর্ষে উঠিলেন। অঞ্চলের ভিতর হইতে রক্তচক্ষু ধূম্রবর্ণ দূত-পারাবত বাহির করিয়া আকাশে উড়াইয়া দিলেন। পারাবত দুইবার প্রাসাদ পরিক্রমণ করিয়া উত্তরাভিমুখে ধাবিত হইল। যতক্ষণ দেখা যায়, কুমারদেবী আকাশের সেই কৃষ্ণবিন্দুর দিকে তাকাইয়া রহিলেন, তারপর নিশ্বাস ফেলিয়া ধীরে ধীরে নামিয়া আসিলেন।

অতঃপর আরও আট দিন কাটিল। চন্দ্রবর্মা কোনও প্রকার যুদ্ধোদ্যম না করিয়া কেবলমাত্র পথরোধ করিয়া বসিয়া রহিলেন। ক্রমে দুর্গে খাদ্যদ্রব্য দুর্মূল্য হইতে আরম্ভ করিল। নাগরিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিল।

এইরূপে আশায় আশঙ্কায় আরও একপক্ষ অতীত হইল। ফাল্গুন নিঃশেষ হইয়া আসিল।

একটা কথা বলিতে ভুলিয়াছি। সেই বিট— সেই পীঠমর্দ, যে সোমদত্তার অনাবৃত যৌবনশ্রী দেখিয়া উন্মত্ত হইয়াছিল, সে আমি। তখন আমার নাম ছিল, চক্রায়ুধ ঈশানবর্মা। ঘটোৎকচগুপ্তের ন্যায় আমার পিতাও একজন পরাক্রান্ত ভূস্বামী ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর আমি স্বাধীন হইয়া রাজধানীতে রাজার সাহচর্যে নাগরিক-বৃত্তি অবলম্বন করিয়া ঐশ্বর্যে বিলাসে কালযাপন করিতেছিলাম।

তীব্র আসবপান করিলে যে বিচারহীন বিবেকহীন মত্ততা জন্মে, সোমদত্তাকে দেখিয়া আমার সেই মত্ততা জন্মিয়াছিল। অবশ্য, বিবেকবুদ্ধি তৎপূর্বেই যে আমার অত্যন্ত অধিক ছিল তাহা নহে। চিরদিন আমার চিত্ত বল্গাশূন্য অশ্বের মতো শাসনে অনভ্যস্ত। কোনও বস্তু আত্মসাৎ করিতে— তা সে নারীই হউক বা ধনরত্নই হউক— নিজের ঐহিক সুবিধা ও সামর্থ্য ভিন্ন কোনও নিষেধ কখনও স্বীকার করি নাই। গুরুলঘুজ্ঞান কদাপি আমার বাসনার সামগ্রীকে দুষ্প্রাপ্য করিয়া তুলে নাই। যখন যাহা অভিলাষ করিয়াছি, ছলে-বলে যেমন করিয়া পারি তাহা গ্রহণ করিয়াছি।

চন্দ্রগুপ্ত যখন সোমদত্তাকে শ্যেনপক্ষীর মতো আমার চক্ষুর সম্মুখ হইতে ছোঁ মারিয়া লইয়া গেল, তখন বাধাপ্রাপ্ত প্রতিহত বাসনা দুর্বার আক্রোশে আমার বক্ষের মধ্যে গর্জন করিতে লাগিল। চন্দ্রগুপ্ত রাজা, আমি তাহার নর্মসহচর— বয়স্য; কিন্তু তথাপি কোনও দিন তাহাকে আমা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বা যোগ্যতর ভাবিতে পারি নাই। শ্যালকপ্রসাদে সে রাজা হইয়াছে; সুযোগ ঘটিলে আমিও কি হইতে পারিতাম না? বাহুবলে, রণশিক্ষায়, নীতিকৌশলে, বংশগরিমায় আমি তাহার অপেক্ষা কোনও অংশে ন্যূন নহি। তবে কোন্‌ অধিকারে সে আমার ঈপ্সিত বস্তু কাড়িয়া লইল?

অন্য তিন জন রাজপ্রসাদলোভী চাটুকার, যাহারা সেদিন আমার নিগ্রহ দেখিয়াছিল, তাহারা আমার ক্রোধ ও অন্তর্দাহে ইন্ধন নিক্ষেপ করিতে লাগিল, তামাশা-বিদ্রূপ-ইঙ্গিতের গোপন দংশনে আমাকে জর্জরিত করিয়া তুলিল। একদিন, চন্দ্রগুপ্ত তখনও সভায় আগমন করেন নাই, সভাস্থ পারিষদবর্গের মধ্যে নিম্নকণ্ঠে বাক্যালাপ হাস্য-পরিহাস চলিতেছিল, এমন সময় সিদ্ধাপাল আমাকে লক্ষ্য করিয়া অপেক্ষাকৃত উচ্চকণ্ঠে বলিল, “চক্রায়ুধ, দেখ তো এই রত্নটি কেমন, কোশলের কোনও শ্রেষ্টী মহারাজকে উপহার দিয়াছে। মহারাজ বলিয়াছেন, রত্নটি যদি অনাবিদ্ধ হয় তাহা হইলে স্বয়ং রাখিবেন, নচেৎ তোমাকে উহা দান করিবেন। দেখ তো, রত্নটি বজ্রসমুৎকীর্ণ কি না।”— বলিয়া একটি ক্ষুদ্র অতি নিকৃষ্টজাতীয় মণি আমার সম্মুখে তুলিয়া ধরিল।

সভারূঢ় ব্যক্তিগণ এই কদর্য ইঙ্গিতে কেহ দাঁত বাহির করিয়া, কেহ বা নিঃশব্দে হাসিল। সিংহাসনের পার্শ্বে চামরবাহিনী কিঙ্করীগণ মুখে অঞ্চল দিয়া পরস্পরের প্রতি সকৌতুকে কটাক্ষ হানিল। আমি লজ্জায় মরিয়া গেলাম।

ক্রমে আমার কথা পাটলিপুত্র নগরের কাহারও অবিদিত রহিল না। আমি কোনও গোষ্ঠীসমবায় বা সমাপানকে পদার্পণ করিবামাত্র চোখে চোখে কটাক্ষে কটাক্ষে গুপ্ত ইঙ্গিতের স্রোত বহিয়া যাইত। রাজসভায় রাজা আমাকে দেখিয়া ভ্রূকুটি করিতে লাগিলেন। অতঃপর আমাকে রাজসভা ছাড়িতে হইল, লোক-সমাজও দুঃসহ হইয়া উঠিল। নিজ হর্ম্যতলে একাকী বসিয়া অন্তরের অগ্নিতে অহরহ দগ্ধ হইতে লাগিলাম।

এই সময় সমুদ্রোচ্ছ্বাসতুল্য অভিযান পাটলিপুত্রের দুর্গতটে আসিয়া প্রহত হইল। আমি ক্ষত্রিয়, যুদ্ধের সময় আমার ডাক পড়িল। মহাবলাধিকৃত বিরোধবর্মা আমাকে শতরক্ষীর অধিনায়ক করিয়া গৌতম-দ্বার নামক দুর্গের পশ্চিম তোরণ রক্ষার ভার দিলেন।

কৃষ্ণপক্ষের চন্দ্রহীন রাত্রি। আমি অভ্যাসমত প্রাকারের উপর একাকী পদচারণ করিতেছিলাম। অবসন্ন বসন্তের শেষ চম্পা চারিদিকে তীব্র বাস বিকীর্ণ করিতেছিল।

বাহিরে শত্রুশিবিরে দীপসকল প্রায় নিবিয়া গিয়াছে— দূরে দূরে দুই একটা জ্বলিতেছে। নিম্নে পরিখার জল স্থির কৃষ্ণদর্পণের মতো পড়িয়া আছে, তাহাতে আকাশস্থ নক্ষত্রপুঞ্জের প্রতিবিম্ব পড়িয়াছে। নগরের মধ্যে শব্দ নাই, আলোক নাই, গৃহে গৃহে দ্বার রুদ্ধ, দীপ নির্বাপিত। রাজপথও আলোকহীন। তামসী রাত্রির গহন অন্ধকার যেন বিরাট পক্ষ দিয়া চরাচর আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে।

পাটলিপুত্র সুপ্ত, অরাতি-সৈন্যও সুপ্ত। কিন্তু নগরদ্বারের প্রহরীরা জাগ্রত। তোরণের উপর নিঃশব্দে রক্ষীগণ প্রহরা দিতেছে। প্রাকারের উপর স্থানে স্থানে সতর্ক রক্ষী নিশ্চলভাবে দণ্ডায়মান। শত্রু পাছে অন্ধকারে গা ঢাকিয়া অতর্কিতে প্রাকার-লঙ্ঘনের চেষ্টা করে, এইজন্য রাত্রিতে পাহারা দ্বিগুণ সাবধান থাকে।

রাজপুরী হইতে বেহাগ-রাগিণীতে মধ্যরাত্রি বিজ্ঞাপিত হইল। সঙ্গে সঙ্গে পাটলিপুত্রের দশ দ্বারের প্রহরী দুন্দুভি বাজাইয়া উচ্চ-কণ্ঠে প্রহর হাঁকিল। নৈশ নীরবতা ক্ষণকালের জন্য বিক্ষুব্ধ করিয়া এই উচ্চরোল ক্রমে ক্রমে মিলাইয়া গেল; নগরী যেন শত্রুকে জানাইয়া দিলে— “সাবধান! আমি জাগিয়া আছি!”

একাকী পদচারণা করিতে করিতে নানা চিন্তা মনে উদয় হইতেছিল। কিসের জন্য এই রাত্রি দ্বিপ্রহরে নিদ্রা ত্যাগ করিয়া নিশাচরের মতো ঘুরিয়া বেড়াইতেছি? পাটলিপুত্র দুর্গ রক্ষা করিয়া আমার লাভ কি? যাহার রাজ্য, সে তো কামিনীর কণ্ঠলগ্ন হইয়া সুখে নিদ্রা যাইতেছে। পাটলিপুত্র যদি চন্দ্রবর্মা অধিকার করে, তবে কাহার কি ক্ষতি? দুর্গের মধ্যে অন্নাভাবের সঙ্গে সঙ্গে রোগ দেখা দিয়াছে, মানুষ না খাইয়া মরিতে আরম্ভ করিয়াছে। বাহির হইতে খাদ্য আনয়নের উপায় নাই। শুধু রাত্রির অন্ধকারে লুকাইয়া জালিকেরা নদী হইতে প্রত্যহ কিছু কিছু মৎস্য সংগ্রহ করিতেছে। কিন্তু তাহাই বা কতটুকু?— নগরীর ক্ষুধা তাহাতে মিটে না। এভাবে আর কত দিন চলিবে? অবশেষে একদিন বশ্যতা স্বীকার করিতেই হইবে; তবে অনর্থক এ ক্লেশভোগ কেন? সমগ্র দেশ যখন চন্দ্রবর্মার চরণে আত্ম-সমর্পণ করিয়াছে, তখন পাটলিপুত্র নগর একা কয়দিন টিকিয়া থাকিবে?

চন্দ্রগুপ্ত যদি রাজ্যাধিকারের যোগ্য হইত, তবে সে নিজে আসিয়া নিজের রাজ্য রক্ষা করিত। আমি কেন এই অপদার্থ রাজার রাজ্যরক্ষায় সাহায্য করিতেছি? সে আমার কি করিয়াছে? আমার মুখের গ্রাস কাড়িয়া লইয়াছে, আমাকে জগতের সম্মুখে হাস্যাস্পদ করিয়াছে। সোমদত্তা! সেই দেবভোগ্যা অপ্সরা! বুঝি পুরুষের লালসা-পরিতৃপ্তির জন্যই তাহার অনুপম দেহ সৃষ্ট হইয়াছিল! তাহাকে না পাইলে আমার এই অনির্বাণ তৃষ্ণা মিটিবে কি?— সে এখন চন্দ্রগুপ্তের অঙ্কশায়িনী। চন্দ্রগুপ্ত কি তাহাকে বিবাহ করিয়াছে? করুক না করুক, সোমদত্তাকে আমার চাই; যেমন করিয়া পারি, যে উপায়ে পারি, সোমদত্তাকে আমি কাড়িয়া লইব। পারিব না? নারীর মন কত দিন এক পুরুষে আসক্ত থাকিবে? তখন চন্দ্রগুপ্ত! তোমাকে জগতের কাছে হাস্যাস্পদ করিব। সেই আমার লাঞ্ছনার যোগ্য প্রতিশোধ হইবে।

এই সর্বগ্রাসী চিন্তা মনকে এমনই আচ্ছন্ন করিয়াছিল যে, অজ্ঞাতসারে গোতম-দ্বার হইতে অনেকটা দূরে আসিয়া পড়িয়াছিলাম। প্রাকারের এই অংশ রাত্রিকালে স্বভাবতই অতিশয় নির্জন। এই স্থানের দুর্গ-প্রাচীর এতই দুরধিগম্য যে, প্রহরী-স্থাপনেরও প্রয়োজন হয় নাই।

ইতস্তত দৃষ্টিপাত করিতে করিতে ফিরিব ভাবিতেছি, এমন সময় সহসা চোখে পড়িল, সম্মুখে কিছুদূরে প্রাকারের প্রান্তস্থিত এক কণ্টকগুল্মের অন্তরালে দীপ জ্বলিতেছে। পাছে বাহির হইতে শত্রু দুর্গ-প্রাচীরে আরোহণ করে, এজন্য প্রাচীরগাত্রে সর্বত্র কাঁটাগাছ রোপিত থাকিত। কখনও কখনও এই সকল কাঁটাগাছ প্রাকারশীর্ষ ছাড়াইয়া মাথা তুলিত। সেইরূপ দুইটি ঘন-পল্লবিত কণ্টকতরুর মধ্যস্থিত ঝোপের ভিতর প্রদীপ জ্বলিতেছে দেখিলাম। প্রদীপ কখনও উঠিতেছে, কখনও মণ্ডলাকারে আবর্তিত হইতেছে। কেহ যেন একান্তে দাঁড়াইয়া কোনও অদৃশ্য দেবতার আরতি করিতেছে।

পাদুকা খুলিয়া ফেলিয়া নিঃশব্দে কটি হইতে তরবারি বাহির করিয়া হস্তে লইলাম। তারপর অতি সন্তর্পণে সেই সঞ্চরমাণ দীপশিখার দিকে অগ্রসর হইলাম।

কণ্টকগুল্মের মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, তন্মধ্যে এক নারী দাঁড়াইয়া পরিখার অপর পারে অনন্য স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া আছে। এবং প্রদীপ ইতস্তত আন্দোলিত করিতেছে। পশ্চাৎ হইতে তাহার মুখ সম্পূর্ণ দেখিতে পাইলাম না, শুধু চোখে পড়িল, তাহার নবমল্লিকাবেষ্টিত কুণ্ডলিত কবরীভার, তন্মধ্যে দুইটি পদ্মরাগমণি সর্পচক্ষুর মতো জ্বলিতেছে। বুঝিতে বিলম্ব হইল না, এ রমণী গুপ্তচর; আলোকের ইঙ্গিতে শত্রুর নিকট সংবাদ প্রেরণ করিতেছে।

লঘুহস্তে তাহার স্কন্ধ স্পর্শ করিলাম। সশব্দ নিশ্বাস টানিয়া বিদ্যুদ্বেগে রমণী ফিরিয়া দাঁড়াইল। তখন তাহারই হস্তধৃত মৃৎপ্রদীপের আলোকে তাহাকে চিনিলাম।

সোমদত্তা!

কম্পিত দীপশিখার আলোক তাহার ত্রাসবিবৃত মুখের উপর পড়িল। চক্ষুর সুবৃহৎ কৃষ্ণতারকা আরও বৃহৎ দেখাইল। মুহূর্তের জন্য আমার মনে সন্দেহ জন্মিল, এ কি সত্যই সোমদত্তা, না আমার দৃষ্টিবিভ্রম? যে চিন্তা অহরহ আমার অন্তরকে গ্রাস করিয়া আছে, সেই চিন্তার বস্তু কি মূর্তি ধরিয়া সম্মুখে দাঁড়াইল? কিন্তু এ ভ্রম অল্পকালের জন্য, আকস্মিক আঘাতে বিপন্ন বুদ্ধি পরক্ষণেই ফিরিয়া আসিল। দেখিলাম, সোমদত্তার হস্তে প্রদীপ থরথর করিয়া কাঁপিতেছে, এখনই পড়িয়া নিবিয়া যাইবে। আমি তরবারি কোষবদ্ধ করিয়া তাহার হাত হইতে প্রদীপ লইলাম,— তাহার মুখের সম্মুখে তুলিয়া ধরিয়া মৃদুহাস্যে বলিলাম, “এ কি! পরমভট্টারিকা মহাদেবী সোমদত্তা!”

সোমদত্তা ভয়সূচক অস্ফুটধ্বনি করিয়া নিজ বক্ষে হস্তার্পণ করিল। পরক্ষণেই ছুরির একটা ঝলক এবং সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষ্ণাগ্র অস্ত্র আমার বস্ত্রাবৃত লৌহজালিকের ব্যবধানপথে বক্ষের চর্ম স্পর্শ করিল। ভিতরে লৌহজালিকা না থকিলে সোমদত্তার হস্তে সেদিন আমার প্রাণ যাইত। আমি ক্ষিপ্রহস্তে ছুরিকা কাড়িয়া লইয়া নিজ কটিতে রাখিলাম, তারপর সবলে দুই বাহু দিয়া তাহাকে বক্ষে চাপিয়া ধরিলাম। তাহার কর্ণে কহিলাম, “সোমদত্তা, কুহকিনী, আজ তোমাকে পাইয়াছি!”

তৈলপ্রদীপ মাটিতে পড়িয়া নিবিয়া গেল।

জালবদ্ধা ব্যাঘ্রীর মতো সোমদত্তা আমার বাহুমধ্যে যুদ্ধ করিতে লাগিল, নখ দিয়া আমার মুখ ছিঁড়িয়া দিল। আমি আরও জোরে তাহাকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া বলিলাম, “ভালো, ভালো। তোমার নখর-ক্ষত কাল চন্দ্রগুপ্তকে দেখাইব।”

সহসা সোমদত্তার দেহ শিথিল হইয়া এলাইয়া পড়িল; অন্ধকারে ভাবিলাম, বুঝি মূর্ছা গিয়াছে। তারপর তাহার দ্রুত কম্পনে ও কণ্ঠোত্থিত নিরুদ্ধ শব্দে বুঝিলাম, মূর্ছা নহে— সোমদত্তা কাঁদিতেছে। কাঁদুক— কামিনীর ক্রন্দন আমার জীবনে এই প্রথম নহে। প্রথম প্রথম এমনই কাঁদে বটে। আমি তাহাকে কাঁদিতে দিলাম।

কিছুক্ষণ ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিবার পর সোমদত্তা সোজা হইয়া দাঁড়াইল; অশ্রুবিকৃত কণ্ঠে কহিল, “তুমি কে? কেন আমাকে ধরিয়াছ? শীঘ্র ছাড়িয়া দাও!”

আমি আলিঙ্গন শিথিল করিলাম না, বলিলাম, “আমি কে শুনিবে? আমি চক্রায়ুধ ঈশানবর্মা—তোমার চন্দ্রগুপ্তের বয়স্য, উপস্থিত দুর্গ-তোরণের রক্ষক। আরও অধিক পরিচয় চাও তো বলি, আমি সোমদত্তার রূপের মধুকর। যেদিন তটিনীতটে অচেতন হইয়া পড়িয়াছিলে, ছলনাময়ী, সেইদিন হইতে তোমার রূপযৌবনের আরাধনা করিতেছে!”

অনুভব করিলাম, সোমদত্তা শিহরিয়া উঠিল। আমি বলিলাম, “চিনিয়াছ দেখিতেছি! হাঁ, আমি সেই বিট, যে স্বর্গের পারিজাত দেখিয়া লুব্ধ হইয়াছিল।”

সোমদত্তা কহিল, “পাপিষ্ট, আমাকে ছাড়িয়া দাও, নচেৎ রাজ-আদেশে তোমার মুণ্ড যাইবে।”

আমি হাসিয়া বলিলাম, “পাপিষ্টা, তোমাকে ছাড়িব না। ছাড়িয়া দিলে তোমার পট্টমহাদেবীর আদেশে আমার মুণ্ড যাইতে পারে। তুমি নিশীথ সময়ে রাজপুরী ছাড়িয়া কি জন্য বাহিরে আসিয়াছ? প্রাকারের নিভৃত স্থানে প্রদীপ লইয়া কি করিতেছিল?”

কিছুক্ষন স্তব্ধ থাকিয়া সোমদত্ত উত্তর করিল, “আমি রাজার অনুমতি লইয়া পুরীর বাহিরে আসিয়াছি।”

ব্যঙ্গ করিয়া বলিলাম, “চন্দ্রগুপ্ত বোধ করি তোমাকে শত্রুর নিকটে সংকেত প্রেরণ করিবার জন্য পাঠাইয়াছে?”

সোমদত্তা আবার শিহরিল। বলিল, “আমি বৌদ্ধ সেবাশ্রমে আর্তের চিকিৎসা করিতে প্রত্যহ আসি— রাজার অনুমতি আছে। আজিও আসিয়াছি।”

“প্রাকারের উপর এতক্ষণ কোন্‌ আর্তের চিকিৎসা করিতেছিলে?”

“প্রাকারের উপর আহত কেহ আছে কি না দেখিতে আসিয়াছিলাম।”

“ভালো, আজ রাত্রিতে আমার নিকট বন্দিনী থাক, কাল চন্দ্রগুপ্তকে এই কথা বলিও। প্রহরী ডাকি?”

সোমদত্তা নীরব, মুখে কথা নাই।

আমি পুনরায় কহিলাম, “কি বল? প্রহরী ডাকি?”

অবরুদ্ধ কণ্ঠে সোমদত্তা কহিল, “তুমি যাহা চাও দিব— আমাকে ছাড়িয়া দাও।”

আমি বলিলাম, “যাহা চাই, তাহা এখন জোর করিয়া লইব। তোমার দানের অপেক্ষা রাখি না।”

ভীত অস্পষ্ট কণ্ঠে সে জিজ্ঞাসা করিল, “কি চাও?”

“তোমাকে।”

সোমদত্তা পুনরায় আমার আলিঙ্গন-মুক্ত হইবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতে লাগিল। শেষে বিফল হইয়া আমার বক্ষের উপর সবলে করাঘাত করিতে করিতে বলিতে লাগিল, “আমাকে ছাড়িয়া দাও! ছাড়িয়া দাও! ছাড়িয়া দাও! আমি রাজমহিষী, আমার উপর অত্যাচার করিলে তুমি শূলে যাইবে।”

আমি বলিলাম, “তুমি চন্দ্রবর্মার চর, — রাজাকে রূপের কুহকে ভুলাইয়া রাজঅন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়াছ। শূল তো দূরের কথা, তোমার উপর অত্যাচার করিলে কুমারদেবী আমাকে পুরস্কৃত করিবেন। মনে রাখিও, তুমি তাঁর সপত্নী।”

সোমদত্তা কাঁদিয়া উঠিল, “দয়া কর, আমি রাজার স্ত্রী।”

“তুমি গুপ্তচর।”

তখন সোমদত্তা আমার বক্ষের উপর নিঃসহায়ে মাথা রাখিয়া কাঁদিতে লাগিল। এত কাঁদিল যে, বোধ করি পাষাণও দ্রব হইয়া যাইত। কিন্তু আমি লোভে নিষ্ঠুর— তাহার অশ্রু আমাকে দ্রব করিতে পারিল না।

কাঁদিতে কাঁদিতে সোমদত্তা জিজ্ঞাসা করিল, “দয়া করিবে না?”

আমি বলিলাম, “এইটুক দয়া করিতে পারি, আমি যাহা চাই তাহা স্বেচ্ছায় যদি দাও, তবে চন্দ্রগুপ্ত কিছু জানিবে না।”

ব্যাকুল হইয়া সোমদত্তা কহিল, “আমি সেরূপ স্ত্রীলোক নহি। চন্দ্রগুপ্ত আমার স্বামী, আমি তাঁহাকে ভালবাসি। শুন, আমি চন্দ্রবর্মার গুপ্তচর এ কথা সত্য, তাঁহারই কার্যসিদ্ধির জন্য মগধে আসিয়াছিলাম। কিন্তু তখন জানিতাম না— ভালবাসার স্বাদ পাই নাই। আজ আমি স্বামীর রাজ্য পরের হস্তে তুলিয়া দিবার যত্ন করিতেছি, কেন করিতেছি তাহা তুমি বুঝিবে না। কিন্তু স্বরূপ বলিতেছি, আমি তাঁহাকে ভালবাসি, আমার চোখে তিনি ভিন্ন অন্য পুরুষ নাই। তুমি আমাকে দয়া কর, মুক্তি দাও। আমি শপথ করিতেছি, চন্দ্রবর্মা পাটলিপুত্র অধিকার করিলে আমি তোমাকে কাশী, কোশল, চম্পা, গৌড়— যে রাজ্য চাও তাহার সিংহাসনে বসাইব। চন্দ্রবর্মা আমাকে স্নেহ করেন, আমার যাচ্ঞা কখনো নিষ্ফল হইবে না।”

“কিন্তু চন্দ্রবর্মা যদি পাটলিপুত্র অধিকার করিতে না পারেন?”

“এমন কখনো হইতে পারে না।”

“বুঝিলাম। কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, তুমি যদি চন্দ্রগুপ্তকে সত্যই ভালবাস, তবে তাহার সর্বনাশ করিতেছ কেন?”

কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া সোমদত্তা বলিল, “চন্দ্রবর্মা আমার পিতা।”

ঘোর বিস্ময়ে কহিলাম, “তুমি চন্দ্রবর্মার কন্যা?”

অধোমুখে সোমদত্তা কহিল, “হাঁ, কিন্তু বারাঙ্গনার গর্ভজাতা।”

“বুঝিয়াছি।”

“তুমি নরাধম, কিছু বুঝ নাই। আমি শৈশব হইতে রাজ-অন্তঃপুরে পালিত।”

“ভালো, তাহাও বুঝিলাম। বুঝিলাম যে, পিতার জন্য তুমি স্বামীর সর্বনাশ করিতে প্রস্তুত। কিন্তু আমার কথাও তুমি বুঝিয়া লও। আমি গৌড় চাহি না, চম্পা চাহি না, কাশী-কোশল কিছুই চাহি না— আমি তোমাকে চাই। অস্বীকার করিলে কোনও ফল হইবে না— উপরন্তু চন্দ্রগুপ্ত তোমার এই অভিসার-কথা জানিতে পরিবে।”

সোমদত্তা কম্পিতস্বরে কহিল, “ইচ্ছা হয়, আমাকে হত্যা করিয়া ঐ পরিখার জলে ফেলিয়া দাও, আমি কোনও কথা কহিব না। কিন্তু মহারাজকে এ কথা বলিও না। পুরুষের মন সর্বদা সন্দিগ্ধ, তিনি আমার প্রকৃত অভিপ্রায় বুঝিবেন না, আমাকে অবিশ্বাস করিবেন। স্বীকার কর, বলিবে না?”

নারী-চরিত্র কে বুঝিবে? কহিলাম, “উত্তম, বলিব না। কিন্তু আমার পুরস্কার?”

সোমদত্তা নীরব।

আবার জিজ্ঞাসা করিলাম, “আমার পুরস্কার?”

তথাপি সোমদত্তা মৌন।

আমি তখন ক্ষিপ্ত। নির্মম পীড়নে তাহার দেহলতা বিমথিত করিয়া অধরে চুম্বন করিলাম।

বলিলাম, “সোমদত্তা, তোমার রূপের আগুনে আজ আপনাকে আহুতি দিলাম।”

সোমদত্তা যেন মর্মতন্তু ছিঁড়িয়া কথা কহিল, “শুধু তুমি নহ, তুমি, আমি, চন্দ্রগুপ্ত, মগধ— সব এই আগুনে পুড়িয়া ছাই হইবে!”

নগরের কেন্দ্রস্থলে প্রায় পাদক্রোশ ভূমির উপর মগধের প্রাচীন রাজপুরী। এই পাদক্রোশ ভূমি উচ্চ পাষাণ-প্রাচীর বেষ্টিত। পূর্বদিকে প্রশস্ত রাজপথের উপর কারুকার্যশোভিত উচ্চ পাষাণ-তোরণ। এই তোরণ উত্তীর্ণ হইয়া প্রথমেই বহুস্তম্ভযুক্ত বিচিত্র দ্বিতল মন্ত্রগৃহ। তাহার পশ্চাতে মহলের পর মহল, প্রাসাদের পর প্রাসাদ,—কোনটি কোষাগার, কোনটি অলংকারগৃহ, কোনটি দেবগৃহ, কোনটি চিত্রভবন। মধ্যে কুঞ্জবেষ্টিত কমল-সরোবর— তাহাতে সারস মরাল প্রভৃতি পক্ষী ও বহুবর্ণের মৎস্য ক্রীড়া করিতেছে।

সকলের পশ্চাতে শীর্ণ অথচ জলপূর্ণ পরিখার গণ্ডিনিবদ্ধ মগধেশ্বরের অন্তঃপুর। সেতু পার হইয়া অন্তঃপুরে প্রবেশ করিতে হয়। সেতুমুখে কঞ্চুকীসেনা অহোরাত্র পাহারা দিতেছে। ভিতরে সুন্দর কারুশিল্পমণ্ডিত উচ্চশীর্ষ সৌধ সকল পরস্পর সংলগ্ন হইয়া যেন ইন্দ্রভুবন রচনা করিয়াছে। এখানে সকল গৃহই ত্রিতল, প্রথম তল শ্বেত-প্রস্তরে রচিত, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তল দারুনির্মিত।

এই পুরী চন্দ্রগুপ্তের নির্মিত নহে, মৌর্যকালীন প্রাচীন রাজভবন। রাজ্যজয়ের সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্রগুপ্ত ইহা অধিকার করিয়াছিলেন। অধিকার করিয়াই রাজপুরীর যাহা সারবস্তু সেই মোহনগৃহ সন্ধান করিয়াছিলেন, কিন্তু বহু চেষ্টাতেও তাহা আবিষ্কার করিতে পারেন নাই। মোহনগৃহ রাজভবনের একটি গোপন কক্ষ, দেখিতে অন্যান্য সাধারণ কক্ষের মতোই, কিন্তু ইহার প্রাচীর ও হর্ম্যতলে নানা গুপ্তদ্বার থাকিত। সেই গুপ্তদ্বার দিয়া ভূ-নিম্নস্থ সুড়ঙ্গপথে পুরীর বাহিরে যাওয়া যাইত; এমন কি ঘোর বিপদ-আপদের সময় দুর্গের বাহিরে পলায়ন করাও চলিত। এই মোহনগৃহ প্রত্যেক রাজপুরীর একটি অপরিহার্য অঙ্গ ছিল; স্বয়ং রাজা এবং পট্টমহিষী ভিন্ন ইহার সন্ধান আর কাহারও জানা থাকিত না। মৃত্যুকালে রাজা পুত্রকে বলিয়া যাইতেন।

এই রাজপ্রাসাদে পূর্ববর্ণিত ঘটনার পরদিন প্রভাতে আমি কিছু গোপন অভিসন্ধি লইয়া উপস্থিত হইলাম। সম্মুখেই মন্ত্রগৃহ,— বহুজনাকীর্ণ। সচিব, সভাসদ্‌, সেনানী, শ্রেষ্ঠী, বয়স্য, বিদূষক— সকলেই উপস্থিত; সকলের মুখেই দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠার চিহ্ন। চারিদিক্ হইতে তাহাদের মৃদুজল্পিত গুঞ্জনধ্বনি উঠিতেছে। সভার কেন্দ্রস্থলে রত্নসিংহাসনে বসিয়া কেবল মহারাজ চন্দ্রগুপ্ত নির্লিপ্ত নির্বিকার। আমি সভায় প্রবেশ করিতে চন্দ্রগুপ্ত একবার চক্ষু তুলিয়া আমার দিকে চাহিল— মোহাচ্ছন্ন স্বপ্নাবিষ্ট ভাব— যেন কিছুতেই আসে যায় না। আমি সম্ভ্রম দেখাইয়া অবনত মস্তকে প্রণাম করিলাম, চন্দ্রগুপ্ত ঈষৎ বিরক্তিসূচক ভ্রূকুটি করিয়া মুখ ফিরাইয়া লইল। আমার হাসি আসিল, মনে মনে বলিলাম, “চন্দ্রগুপ্ত! যদি জানিতে!…”

রাজ-সম্মুখ হইতে অপসৃত হইয়া ইতস্তত ঘুরিতে ঘুরিতে এক স্তম্ভের আড়ালে সন্নিধাতার সহিত দেখা হইল। সর্বদা রাজ-সন্নিধানে থাকিয়া তাঁহার পরিচর্যা করা সন্নিধাতার কার্য। নানা কারণে এই সন্নিধাতার সহিত আমার কিছু প্রণয় ছিল; অনেকবার রাজপ্রাসাদের অনেক গূঢ় সংবাদ তাহার নিকট হইতে পাইয়াছি। তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “বল্লভ, খবর কি?”

বল্লভ বলিল, “নূতন খবর কিছুই নাই। মহারাজ আজ পত্রচ্ছেদ্যকালে বলিতেছিলেন যে, মোহনগৃহের সন্ধান জানা থাকিলে এ পাপ রাজ্য ছাড়িয়া চলিয়া যাইতেন।”

আমি বলিলাম, “সংসারে এত বৈরাগ্য কেন?”

বল্লভ চোখ টিপিয়া মৃদুস্বরে কহিল, “সংসারের সকল বস্তুতে নয়!— সে যাক্‌, তোমায় বহুদিন দেখি নাই, সভায় আস না কেন?”

আমি বলিলাম, “দিনরাত গোতম-দ্বারে পাহারা— সময় পাই না। — বিরোধবর্মা কোথায় বলিতে পার? সভায় তো তাঁহাকে দেখিতেছি না।”

বল্লভ বলিল, “মহাবলাধিকৃত উপরে আছেন, সান্ধিবিগ্রহিকের সঙ্গে কি পরামর্শ হইতেছে।”

“আমারও কিছু পরামর্শ আছে”— বলিয়া সোপান অতিবাহিত করিয়া আমি উপরে গেলাম।

বিরোধবর্মা তখন গুপ্তসদস্যগৃহে বসিয়া সান্ধিবিগ্রহিকের সহিত চুপিচুপি কথা কহিতেছিলেন। আমাকে দেখিয়া উভয়ে জিজ্ঞাসু নেত্রে আমার দিকে চাহিলেন। আমি কোনও প্রকার ভণিতা না করিয়া বলিলাম, “এরূপভাবে কতদিন চলিবে? দুর্গে খাদ্য নাই, পানীয় নাই; এক দীনারের কমে আঢ়ক পরিমাণ মাধ্বী পাওয়া যায় না। ঘরে ঘরে লোক না খাইয়া মরিতে আরম্ভ করিয়াছে। যুদ্ধে মরিত কোনও কথা ছিল না; কিন্তু শত্রুকে বিতাড়িত করিবার কোনও চেষ্টাই নাই। কেবলমাত্র দুর্গদ্বার রুদ্ধ করিয়া বসিয়া থাকিলে কি ফল দর্শিবে? নাগরিকগণ নানা কথা বলিতেছে— দুর্গরক্ষীরাও সন্তুষ্ট নয়।”

সান্ধিবিগ্রহিক জিজ্ঞাসা করিলেন, “তাহারা কি বলে?”

আমি বলিলাম, “কাল সন্ধ্যায় চণ্ডপালের মদিরাগৃহে গিয়াছিলাম। সেখানে শুনিলাম, অনেকেই বলাবলি করিতেছে— চন্দ্রবর্মার দিগ্বিজয়ী সেনার বিরুদ্ধে শূন্য উদর লইয়া দুর্গরক্ষার চেষ্টা পণ্ডশ্রম মাত্র। দুর্গ একদিন তাহারা অধিকার করিবেই, সুতরাং বাধা না দিয়া নির্বিবাদে আসিতে দেওয়াই সুবুদ্ধি— তাহাতে তাহাদের নিকট সদ্‌ব্যবহার প্রত্যাশা করা যাইতে পারে।”

সান্ধিবিগ্রহিক ও মহাবলাধিকৃত দৃষ্টি-বিনিময় করিলেন। বিরোধবর্মা কহিলেন, “চন্দ্রবর্মা পাটলিপুত্র অধিকার করিতে পরিবে না, তাহার দিগ্বিজয়যাত্রা এইখানেই শেষ হইবে।”

আমি বলিলাম, “কিন্তু—”

বাধা দিয়া বিরোধবর্মা বলিলেন, “ইহার মধ্যে কিন্তু নাই। জানিয়া রাখ, আজ হইতে দশ দিনের মধ্যে দিগ্বিজয়ী চন্দ্রবর্মা লাঙ্গুল উচ্চে তুলিয়া মগধ হইতে পলায়ন করিবে। ইচ্ছা হয়, তুমি তার পশ্চাদ্ধাবন করিও।

ভিতরে কিছু কথা আছে বুঝিলাম। কি কথা জানিবার জন্য পুনশ্চ বলিলাম, “কেমন করিয়া এই অঘটন সম্ভব হইবে জানি না। দশ দিনের মধ্যে নগর শ্মশানে পরিণত হইবে। তখন চন্দ্রবর্মা রহিল কি পলাইল, কে দেখিতে যাইবে?”

বিরোধবর্মা কহিলেন, “খাদ্যের আয়োজন হইয়াছে, কল্য হইতে সকলে প্রচুর খাদ্য পাইবে।”

আমি বিস্মিতভাবে তাঁহার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিলাম। ইচ্ছা হইল জিজ্ঞাসা করি, কিভাবে কোথা হইতে খাদ্য আসিবে! কিন্তু প্রশ্ন করা সুবিবেচনা হইবে না বুঝিয়া বলিলাম, “কিন্তু খাদ্য পাইলেই কি চন্দ্রবর্মাকে বিতাড়িত করা যাইবে?”

বিরোধবর্মা বলিলেন, “বলিয়াছি, দশ দিনের মধ্যে চন্দ্রবর্মাকে তাড়াইব।”

“কিন্তু এই দশ দিন প্রজাদের কি বলিয়া বুঝাইয়া রাখিবেন? প্রজা ও রক্ষিসৈন্য মিলিয়া যদি মাৎস্যন্যায় করে?”

“মাৎস্যন্যায়!”— বিরোধবর্মা গর্জিয়া উঠিলেন, “চক্রায়ুধ, যে যোদ্ধা শত্রুকে দুর্গ-সমর্পণের কথা চিন্তা করিবে তাহাকে শূলে দিব, যে প্রজা মাৎস্যন্যায়ের কথা উচ্চারণ করিবে তাহাকে হাত-পা বাঁধিয়া পরিখার কুম্ভীরের মুখে ফেলিয়া দিব। মাৎস্যন্যায়!— এখনো আমি বাঁচিয়া আছি।” ঈষৎ শান্ত হইয়া বলিলেন, “তুমি যাও, যে জিজ্ঞাসা করিবে, তাহাকে বলিও অন্তরীক্ষপথে বার্তা আসিয়াছে, চন্দ্রবর্মার উচ্ছেদ হইতে আর অধিক বিলম্ব নাই।”

অন্তরীক্ষ-পথে! আমি উঠিলাম। উভয়কে প্রণাম করিয়া বাহির হইতেছি, সান্ধিবিগ্রহিক আমাকে ফিরিয়া ডাকিলেন। ধীরে ধীরে কহিলেন, “চক্রায়ুধ! যাহা শুনিলে, তাহা হইতে যদি কিছু অনুমান করিয়া থাক, তাহা নিজ অন্তরে রাখিও। মন্ত্রভেদে রাজ্যের সর্বনাশ হয়।”

“যথা আজ্ঞা”— বলিয়া মনে মনে হাসিয়া আমি বিদায় লইলাম।

সেই রাত্রিতে মধ্যযাম ঘোষিত হইবার পর সোমদত্তা আবার আসিল। গতরাত্রির সংকেতস্থানে আমি পূর্ব হইতেই উপস্থিত ছিলাম, প্রদীপ হস্তে ধরিয়া ভুবনমোহিনীর ন্যায় আমার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। আমি দুই বাহু প্রসারিত করিয়া তাহাকে বুকে টানিয়া লইলাম। সোমদত্তা ভুবনমোহন হাসি হাসিয়া আমার আলিঙ্গনে আত্ম-সমর্পণ করিল।

এক রাত্রির মধ্যে কি পরিবর্তন! নারীর মন এমনই বটে— কাল যে ধর্মের জন্য যুদ্ধ করিতেছিল, আজ সে নাগরের প্রেমে পাগল! আমি এমন অনেক দেখিয়াছি, তাই বিস্মিত হইলাম না। স্ত্রীজাতি যখন দেখে কুল গিয়াছে, তখন প্রাণপণে নাগরকে ধরিয়া থাকে; দু’কূল হারাইয়া ইতোনষ্ট স্ততোভ্রষ্ট হইতে চাহে না।

আমি বলিলাম, “সোমদত্তা, চন্দ্রগুপ্ত ভিন্ন অন্য পুরুষ পৃথিবীতে আছে কি?”

সোমদত্তা দুই মৃণালভুজে আমার কুণ্ঠবেষ্টন করিয়া মুখের অত্যন্ত নিকটে মুখ আনিয়া মৃদু সলজ্জ স্বরে কহিল, “আগে জানিতাম না, এখন বুঝিয়াছি, তুমি ভিন্ন জগতে অন্য পুরুষ নাই।”

সোমদত্তার কথা, তাহার স্পর্শ, তাহার দেহসৌরভ আমার সর্বাঙ্গ ঘিরিয়া হর্ষের প্লাবন আনিয়া দিল। অনির্বচনীয় সুখের মাদকতা মস্তিষ্ককে যেন অবশ করিয়া ফেলিল। সৃষ্টির আরম্ভ হইতে এমনই বুঝি নারী পুরুষকে বশ করিয়া রাখিয়াছে!

আমি বলিলাম, “সোমদত্তা, প্রিয়তমে, তোমাকে আমি সমগ্রভাবে, অনন্যভাবেই চাই। রাত্রিতে চোরের মতো লুকাইয়া এই ক্ষণিকের মিলন— ইহাতে আমার হৃদয় পূর্ণ হইতেছে না।”

সোমদত্তা আমার স্কন্ধে মস্তক রাখিয়া দীর্ঘশ্বাস মোচন করিয়া বলিল, “তাহা কি করিয়া হইবে, প্রাণাধিক? আমি যে রাজপুরীর পুরন্ধ্রী— চন্দ্রগুপ্তের বনিতা।”

বহুক্ষণ দুইজনে নীরব রহিলাম। সোমদত্তার মতো নারীকে যে পায় নাই, সে জানে না, তাহার জন্য পুরুষের মনে কি তীব্র— কি দুর্বার আকাঙ্ক্ষা জাগিতে পারে। আমিও যতদিন তাহাকে দূর হইতে কামনা করিয়াছিলাম, ততদিন তাহার এই দুর্নিবার শক্তি অনুভব করি নাই। সোমদত্তাকে লাভ করিবার বাসনা অপেক্ষা তাহাকে একান্তে নিজস্ব করিয়া ভোগ করিবার আকাঙ্ক্ষা শতগুণ প্রবল! তাহার মধ্যে এমন একটা আকর্ষণ আছে, যাহা তাহার অলৌকিক যৌবনশ্রীরও অতীত, যাহা ভোগে অবসাদ আসে না, ঘৃতাহুতির ন্যায় কামনার অগ্নিকে আরও বাড়াইয়া তুলে। সোমদত্তার ন্যায় নারীর জন্য পুরুষ ইহকাল পরকাল অকাতরে বিসর্জন করিতে পারে, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়, সৃষ্টি রসাতলে পাঠাইতে তিলমাত্র দ্বিধা করে না।

“শত্রুর নিকট কাল কি সংকেত পাঠাইতেছিলে?”

সোমদত্তা আমার স্কন্ধ হইতে মস্তক তুলিল। আমার মুখের উপর দুই চক্ষু পাতিয়া যেন অন্তরের অন্তস্তল পর্যন্ত অন্বেষণ করিয়া লইল। সেখানে কি দেখিল জানি না, বলিল, “দুর্গের দুই একটা কথা জানাইতেছিলাম।”

“তাহা না বলিলেও বুঝিয়াছি। কি কথা?”

“নগরে খাদ্য নাই, এই সংবাদ দিতেছিলাম।”

আমি বলিলাম, “ভুল সংবাদ দিয়াছ— কাল প্রভাত হইতে নগরে আর অন্নাভাব থাকিবে না।”

সোমদত্তা চমকিত হইয়া বলিল, “সে কি! কোথা হইতে খাদ্য আসিবে?”

আমি বলিলাম, “তাহা জানি না! বোধ হয় কোনও সুড়ঙ্গ আবিষ্কৃত হইয়াছে। সেই পথে বাহির হইতে খাদ্যাদি আসিবে।”

“সুড়ঙ্গ? কোথায় সুড়ঙ্গ?”

“তাহা কি করিয়া জানিব? এ আমার অনুমান মাত্র। কিন্তু নিশ্চিত বলিতেছি, নগরে আর দুর্ভিক্ষ থাকিবে না, সে আয়োজন হইয়াছে। শুধু তাই নয়, শীঘ্রই চন্দ্রবর্মা বাহির হইতে আক্রান্ত হইবেন— বোধ হয় বৈশালী হইতে সৈন্য আসিতেছে।”

“সত্য বলিতেছ? আমাকে প্রতারণা করিতেছ না?”

“সত্য বলিতেছি, আজ বিরোধবর্মার মুখে এ কথা শুনিয়াছি।”

সোমদত্তা ললাটে করাঘাত করিল; বলিল, “হায়! কাল এ কথা শুনি নাই কেন? শুনিলে প্রাণ দিতাম, তবু…”

সোমদত্তা বিদ্যুদগ্নিপূর্ণ দুই চক্ষু আমার দিকে ফিরাইল। দীর্ঘকাল মৌন থাকিয়া শেষে বলিল, “যাহা হইবার হইয়াছে, ললাট-লিখন কে খণ্ডাইবে? বেশ্যা-কন্যার বুঝি ইহাই প্রাক্তন!”

আমি বাহু দ্বারা তাহার কটিবেষ্টন করিয়া সোহাগে গদ্‌গদ স্বরে বলিলাম, “সোমদত্তা, প্রেয়সী, কেন বৃথা খেদ করিতেছ? তুমি আমার। চক্রায়ুধ ঈশানবর্মা তোমার জন্য অগ্নিতে প্রবেশ করিবে, জলে ঝাঁপ দিবে। চন্দ্রগুপ্তের কাল পূর্ণ হইয়াছে, তোমার জন্য আমি তার সর্বনাশ করিব।”

“তুমিও চন্দ্রগুপ্তের সর্বনাশ করিবে?”

“করিব। তুমি পার, আর আমি পারি না? চন্দ্রগুপ্ত আমার কে?”

“সখা!”

“সখা নয়। আমি তার প্রমোদের সহচর, স্তাবক সভাসদ্‌, বিট-বিদূষক মাত্র। চন্দ্রগুপ্ত একদিন আমার মুখের গ্রাস কড়িয়া লইয়াছিল, আমিও লইয়াছি। যার অঙ্কলক্ষ্মীকে কাড়িয়া লইয়াছি, তার সঙ্গে আবার সখ্য কিসের? এখন আমরা দু’জনে মিলিয়া তার উচ্ছেদ করিব।”

কিছুক্ষণ নির্বাক্‌ থাকিয়া সোমদত্তা প্রশ্ন করিল, “কি করিতে চাও?”

“শুন বলিতেছি। প্রভাতে বিরোধবর্মার মুখে যাহা শুনিয়াছি তাহা হইতে অনুমান হয় যে, আজ হইতে দশ দিনের মধ্যে লিচ্ছবিদেশ হইতে পাটলিপুত্রের সাহায্যার্থে সৈন্য আসিবে— পারাবত-মুখে এই সংবাদ আসিয়াছে। চন্দ্রবর্মা যদি পাটলিপুত্র অধিকার করিতে চান, তবে তৎপূর্বেই করিতে হইবে, লিচ্ছবিরা আসিয়া পড়িলে আর তাহা সুসাধ্য হইবে না। তখন নিজের প্রাণ লইয়া টানাটানি পড়িয়া যাইবে। এদিকে নগরের খাদ্যাভাবও ঘুচিয়াছে, সুতরাং বাহুবলে এই দশ দিনের মধ্যে দুর্গ জয় করা অসম্ভব। এরূপ ক্ষেত্রে উপায় কি?”

“কি উপায়?”

“বিশ্বাসঘাতকতা।”

“কে বিশ্বাসঘাতকতা করিবে?”

“আমি করিব। কিন্তু পরিবর্তে চন্দ্রবর্মা আমাকে কি দিবেন?”

“যাহা পাইয়াছ তাহাতে তৃপ্তি নাই?”

“না। কাল বলিয়াছিলাম বটে, রাজ্য সিংহাসন চাহি না, কিন্তু তাহা ভুল। রাজ্য না পাইলে তোমাকে পাইয়াও আমার অতৃপ্তি থাকিয়া যাইবে। তুমি রাজ-ঐশ্বর্যের স্বাদ পাইয়াছ,— অল্পে কি তোমার মন উঠিবে?”

“তা বটে, অল্পে আমার ক্ষুধা মিটিবে না!…কৃতঘ্নতার মূল্য কি চাও?”

“আমি সব স্থির করিয়াছি। তুমি দীপসংকেতে চন্দ্রবর্মাকে সমস্ত সংবাদ দাও, — জানাও যে বিশ্বাসঘাতকতা ভিন্ন দুর্গ অধিকার হইবে না। তাঁহাকে এ কথাও বল যে, একজন দ্বারপাল সেনানী দুর্গদ্বার খুলিয়া দিতে প্রস্তুত আছে, কিন্তু পুরস্কারস্বরূপ তাহাকে মগধের সিংহাসন দিতে হইবে।”

সোমদত্তা প্রস্তরমূর্তির মতো দাঁড়াইয়া রহিল; তারপর হাসিয়া উঠিল! দীপের কম্পমান আলোকে সে হাসি অদ্ভুত দেখাইল। বলিল, “বেশ, বেশ! আমিও তো ইহাই চাহিয়াছিলাম। মনে করিয়াছিলাম পিতাকে তুষ্ট করিয়া এক জনের জন্য মগধের সিংহাসন ভিক্ষা মাগিয়া লইব, এক স্পর্ধিতা দুর্বিনীতা নারীর দর্পচূর্ণ করিব। কিন্তু এই ভালো। তোমার ও আমার ষড়যন্ত্রে পিতা দুর্গ অধিকার করিবেন, তারপর তুমি সিংহাসনে বসিবে, আর আমি— আমি তোমার পট্টমহিষী হইব। এই ভালো!”— বলিয়া সোমদত্তা আবার হাসিল।

আমি বলিলাম, “চন্দ্রগুপ্তকে হত্যা করিতে হইবে। তাহাকে বাঁচিতে দিয়া কোনও লাভ নাই। পরে গণ্ডগোল বাধিতে পারে। একটা সুবিধা আছে, চন্দ্রগুপ্ত পলাইতে পরিবে না, সে মোহনগৃহের সন্ধান জানে না।”

চন্দ্রগুপ্তের প্রতি সোমদত্তার মনে কোনও মমতা আছে কি না দেখিবার জন্য এই কথা বলিয়াছিলাম। দেখিলাম, তাহার মুখে করুণার ভাব ফুটিয়া উঠিল না, বরঞ্চ মুখ ও অধরোষ্ঠ আরও কঠিনভাব ধারণ করিল। সে স্থির নিষ্করুণ দৃষ্টিতে আমার দিকে চাহিয়া রহিল। জিজ্ঞাসা করিল, “মোহনগৃহ কি?”

মোহনগৃহ কি, বুঝাইয়া দিলে সোমদত্তার মুখে কিছু উৎফুল্লতা দেখা দিল। সে আমার কণ্ঠবেষ্টন করিয়া বলিল, “প্রিয়তম, চন্দ্রগুপ্ত ও কুমারদেবী পুত্র লইয়া পলাইবে, এই কথা ভাবিয়া আমার মনে সুখ ছিল না; এখন নিশ্চিন্ত হইলাম। ভাবিও না, তোমাতে আমাতে নিরাপদে রাজ্যসুখ ভোগ করিব।”

“আর চন্দ্রগুপ্ত?”

“সে ভার আমার। আমি তার ব্যবস্থা করিব।”

ঊষার সূচনা করিয়া শীতল বায়ু আমাদের অঙ্গ স্পর্শ করিয়া গেল। পূর্বগগনে কৃষ্ণপক্ষের ক্ষয়প্রাপ্ত শশিকলা রোগপাণ্ডুর মুখ তুলিয়া চাহিল। আমি বলিলাম, “আর বিলম্বে প্রয়োজন নাই, রাত্রি শেষ হইয়া আসিতেছে, এই বেলা সংকেত পাঠাও।”

সোমদত্তা প্রদীপ লইয়া প্রাকারের প্রান্তে গিয়া দাঁড়াইল। প্রসারিত-হস্তে কিছুক্ষণ প্রদীপ ধরিয়া থাকিয়া মুখে নিশাচর পক্ষীর মতো একপ্রকার শব্দ করিল। উৎকর্ণ হইয়া শুনিলাম, পরিখার পরপার হইতে অস্পষ্ট উত্তর আসিল। তখন সোমদত্তা প্রদীপ ধীরে ধীরে সঞ্চালিত করিতে লাগিল। তাপসীর মতো আত্মসমাহিত মুখ, নিশ্চল তন্ময় চক্ষু, সোমদত্তা দীপরশ্মির সাহায্যে সমস্ত সংবাদ বাহিরে প্রেরণ করিল।

সংবাদ শেষ হইলে বাহিরের অন্ধকার হইতে আবার শব্দ আসিল— এবার পাপিয়ার উচ্চতান— শব্দ স্তরে স্তরে উঠিয়া ঊর্ধ্বে বায়ুমণ্ডলে বিলীন হইয়া গেল।

সোমদত্তা প্রদীপ নামাইয়া বলিল, “কল্য উত্তর পাইবে।”

নিশাবসানে পৌরজন নিদ্রাত্যাগ করিয়া দেখিল, নগরের হট্টে রাশি রাশি খাদ্য স্তূপীকৃত হইয়াছে। ঘৃত, তৈল, শালি-তণ্ডুল, গোধূম, চণক, শাক-সব্জী— কোনও বস্তুরই অভাব নাই। কোথা হইতে খাদ্য আসিল, কেহ জানিল না। শুধু দেখা গেল, বুদ্ধ তথ্যাগতের পাষাণময় বিহারের অভ্যন্তর হইতে এই খাদ্য-স্রোত নিঃসৃত হইতেছে। নাগরিকগণ ঊর্ধ্ব কণ্ঠে সৌগতের জয়ঘোষণা করিতে করিতে হট্টের অভিমুখে ছুটিল।

মহারাজ চন্দ্রগুপ্ত তখন মল্লগৃহের সুচিক্কণ শীতল মণি-কুট্টিমের উপর শয়ান ছিলেন, দুই জন নহাপিত সুগন্ধি তৈল দ্বারা তাঁহার হস্তপদাদি মর্দন করিয়া দিতেছিল। নাগরিকদের এই আনন্দনিনাদ তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিল; তিনি মুদিত চক্ষু ঈষন্মাত্র উন্মীলিত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “বল্লভ, কিসের চিৎকার? চন্দ্রবর্মা কি দুর্গপ্রবেশ করিল?”

সন্নিধাতা বল্লভ সুবর্ণস্থলীর উপর স্ফটিকপাত্রপূর্ণ ফলাম্লরস লইয়া অদূরে দাঁড়াইয়া ছিল— মহারাজ স্নানান্তে পান করিয়া শরীর স্নিগ্ধ করিবেন। সে বলিল, “না অজ্জ, বহুদিন পরে পৌরজন খাদ্য পাইয়াছে, তাই মহারাজের জয়-ধ্বনি করিতেছে।”

চন্দ্রগুপ্ত জিজ্ঞাসা করিলেন, “খাদ্য কোথা হইতে আসিল?”

বল্লভ সবিশেষ জানিত না, তথাপি মহারাজের কথার উত্তর দিতে হইবে; বলিল, “বিহারমধ্যে খাদ্য সঞ্চিত ছিল, ভিক্ষুগণ তাই হাই বিতরণ করিতেছেন।”

মহারাজ আর প্রশ্ন করিলেন না, পুনশ্চ চক্ষু মুদিত করিয়া কহিলেন, “ভাল, মহাদেবীকে সমাচার দাও। তিনি প্রকৃতিপুঞ্জের জন্য বড়ই ব্যাকুল হইয়াছিলেন।”

মহারাজের গূঢ় শ্লেষ বল্লভ অনুধাবন করিল না, মহাদেবী বলিতে প্রেয়সী সোমদত্তাকেই বুঝিল। “যথা আজ্ঞা!”— বলিয়া বাহিরে গেল। বাহিরে গিয়া দেখিল, অসংবৃতকুন্তলা এক তরুণী দাসী দ্রুতপদে বহির্মুখে যাইতেছে। বল্লভ ইঙ্গিত করিয়া তাহাকে কাছে ডাকিল, বলিল, “জয়ন্তী, তোমার কেশবেশ যেরূপ বিস্রস্ত, বাহিরে গেলে লোকে নিন্দা করিবে!”

জয়ন্তী মথিত-কজ্জল চক্ষু মার্জনা করিয়া কহিল, “কি প্রয়োজন তাই বল না, রসিকতার সময় নাই। আমি কাজে যাইতেছি।”

বল্লভ বলিল, “কাজ পরে করিও, এখন অন্দরে ফিরিয়া যাও।”— বলিয়া তাহার মুখে সংবাদ পাঠাইয়া দিল।

জয়ন্তী সংবাদ লইতেই আসিতেছিল, ফিরিয়া গিয়া সোমদত্তাকে সকল কথা জানাইল।

সোমদত্তা তখন শীতল হর্ম্যতলে পড়িয়া দুই বাহুর উপর মুখ রাখিয়া চিন্তা করিতেছিল। কি গহন, কি কুটিল তাহার চিন্তা, তাহা কে বলিবে? দাসীর কথা শুনিয়া সে উঠিয়া বসিল। দুই চক্ষু কালিমাবেষ্টিত হইয়া যেন আরও উজ্জ্বল আরও প্রভাময় হইয়াছে, শিশির-কালের প্রস্ফুট হিমচম্পকের ন্যায় কপোল দুইটি পাণ্ডুর। রূপের বুঝি অন্ত নাই। দাসী এই ক্লান্ত-সন্তপ্ত সৌন্দর্যের সম্মুখ হইতে বোধ করি লজ্জা পাইয়া ধীরে ধীরে সরিয়া যাইতেছিল; সোমদত্তা ডাকিল, “জয়ন্তী!”

দাসী ফিরিয়া আসিয়া সসম্ভ্রমে বলিল, “অজ্জা!”

অধোমুখে কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া সোমদত্তা বলিল, “তুই একবার বাহিরে যা। বৌদ্ধ-বিহারে গিয়া শ্রমণাচার্য ভিক্ষু অকিঞ্চনকে আমার কাছে ডাকিয়া আন্‌। বলিবি যে ভিক্ষুণী দীপান্বিতা তাঁহাকে স্মরণ করিয়াছে। আর কঞ্চুকী যদি তাঁর পুরপ্রবেশে বাধা দেয়, এই মুদ্রা দেখাস্‌।”— বলিয়া আপন কণ্ঠের রত্নহার হইতে সুবর্ণমুদ্রা খুলিয়া দাসীর হস্তে দিল।

জয়ন্তীর মুখ পাংশু হইয়া গেল, সে ভীতকণ্ঠে বলিল, “কিন্তু অজ্জা, কুমারদেবী জানিতে পারিলে—”

সোমদত্তা কহিল, “ত্যক্ত করিস্‌ না, যা বলিলাম কর্‌।”

জয়ন্তী প্রস্থান করিল, মনে মনে বলিতে বলিতে গেল, “তোমার আর কি! অন্দরে বৌদ্ধ ভিক্ষু ডাকিয়াছি শুনিলে পট্টদেবী আমার মাথাটি খাইবেন।”

ভিক্ষু অকিঞ্চনকে লইয়া যখন জয়ন্তী ফিরিল, তখন সোমদত্তা স্নান করিয়া শুদ্ধশুচি হইয়া বসিয়াছে। ললাটে কুঙ্কুম-তিলক পরিয়াছে, বক্ষে কাঁচুলি বাঁধিয়া উচ্ছল দেহলাবণ্য সংযত করিয়াছে। ভিক্ষু কক্ষে প্রবেশ করিয়া সোমদত্তাকে আশীর্বাদ করিলেন এবং আসন পরিগ্রহ করিয়া জিজ্ঞাসু নেত্রে তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিলেন। সংঘস্থবিরের বয়স হইয়াছে, মস্তক ও মুখ মুণ্ডিত, পরিধানে পীতবস্ত্র, শান্ত সৌম্য মূর্তি। কৃচ্ছ্রসাধনের ফলে কিছু কৃশ, কিন্তু মুখমণ্ডলে ব্রহ্মচর্যের নির্মল দীপ্তি জাজ্বল্যমান।

সোমদত্তা জয়ন্তীকে চলিয়া যাইতে ইঙ্গিত করিল। জয়ন্তী প্রস্থান করিলে সে ভিক্ষুকে প্রণিপাত করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিল, “অর্হৎ, আত্ম-পরিচয় গোপন করিয়া সংঘারামে গিয়াছিলাম— ক্ষমা করুন!”

অকিঞ্চন কহিলেন, “আত্মগোপন করিয়া যে আর্তের সেবা করে, সিদ্ধার্থ তাহাকে অধিক কৃপা করেন।”

সোমদত্তা কহিল, “আজ রাত্রে বোধ হয় সংঘারামে যাইবার অবকাশ হইবে না। তাই অজ্জা কুমারদেবীর বৌদ্ধ-বিদ্বেষ জানিয়াও আপনাকে এখানে আহ্বান করিয়াছি। আমার কিছু জিজ্ঞাস্য আছে।”

অকিঞ্চন কহিলেন, “সময় উপস্থিত হইলে ভগবান শাক্যসিংহ কুমারদেবীকে সুমতি দিবেন। … তোমার জিজ্ঞাস্য কি?”

সোমদত্তা কহিল, “শুনিলাম, নগরে খাদ্য আসিয়াছে; এ কথা সত্য?”

“সত্য।”

“কি করিয়া আসিল?”

ভিক্ষু কিছুক্ষণ স্থির থাকিয়া বলিলেন, “তথাগতের কৃপায়।”

সোমদত্তা ঈষৎ অধীর হইয়া বলিলেন, “তাহা জানি। কিন্তু কোথা হইতে কোন্‌ পথে আসিল?”

অকিঞ্চন মৃদুহাস্যে বলিলেন, “সংঘের পথে।”

শিরঃসঞ্চালন করিয়া সোমদত্তা কহিল, “তাহাও জানি; খাদ্য সংঘারামে সঞ্চিত ছিল?”

“না।”

“তবে?”

“এ অতি গূঢ় বৃত্তান্ত। দীপান্বিতে, তুমি কৌতূহল প্রকাশ করিও না, — আমি বলিব না।”

“তবে আমিই বলিতেছি! সংঘমধ্যে কোনও সুড়ঙ্গ আবিষ্কৃত হইয়াছে, সেই পথে দুর্গের বাহির হইতে খাদ্য আসিতেছে— সত্য কি না?”

ইতস্তত করিয়া ভিক্ষু কহিলেন, “সত্য। জান যদি, প্রশ্ন করিতেছ কেন?”

“জানি না, অনুমান করিয়াছি মাত্র। অর্হৎ, কন্যার প্রতি একটি অনুগ্রহ করুন। কি করিয়া কবে এই সুড়ঙ্গ আবিষ্কৃত হইল, আমাকে বলুন।”

কিয়ৎকাল চিন্তা করিয়া সংঘাচার্য বলিলেন, “ভাল, শুন। এই সুড়ঙ্গের সন্ধান একপক্ষ পূর্ব পর্যন্ত আমি অথবা অন্য কেহ জানিত না। আমার পূর্ববর্তী সংঘস্থবির নির্বাণের পূর্বে মোহপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তাই ইহার কথা আমাকে বলিয়া যাইতে পারেন নাই।”

নির্নিমেষ চক্ষুর্দ্বয় ভিক্ষুর মুখের উপর স্থাপন করিয়া সোমদত্তা শুনিতে লাগিল।

অকিঞ্চন বলিতে লাগিলেন, “সংঘের মধ্যে ভূগর্ভস্থ যে প্রকোষ্ঠে বুদ্ধের অস্থি রক্ষিত আছে, তাহার উপরে আর একটি কক্ষ আছে, তুমি দেখিয়া থাকিবে। কক্ষটি সচরাচর ব্যবহৃত হয় না, কদাচ আমি মননাদির জন্য উহা ব্যবহার করিয়া থাকি। গত পূর্ণিমা-তিথিতে আমি সেই কক্ষে প্রবেশ করিয়া দেখি, ঘরটি অত্যন্ত অপরিষ্কার হইয়াছে এবং ছাদের মধ্যস্থলে যে প্রস্তরের ধর্মচক্র ক্ষোদিত আছে, তাহার উপর মধুমক্ষিকা চক্রনির্মাণ করিয়াছে। ঘরটিকে মলনির্মুক্ত করিবার মানসে আমি প্রথমে একটি বংশদণ্ডাগ্রে মশাল যোজিত করিয়া ধূম প্রয়োগ দ্বারা মধুমক্ষিকাগুলিকে বিদূরিত করলাম, তারপর মধুচক্রটি স্থানচ্যুত করিবার অভিপ্রায়ে বংশদণ্ডদ্বারা উহা তাড়িত করিবামাত্র এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটিল। ধর্মচক্রের মধ্যস্থলে যে ক্ষুদ্র ছিদ্র আছে, তাহার মধ্যে বংশের অগ্রভাগ প্রবেশ করিবার সঙ্গে সঙ্গে কক্ষপ্রাচীরের এক স্থানে প্রস্তর সরিয়া গিয়া একটা চতুষ্কোণ গহ্বর দেখা দিল। আমি অতিশয় বিস্মিত হইয়া সেই রন্ধ্রটি পরীক্ষা করিলাম, দেখিলাম, অন্ধকার মধ্যে সোপান নামিয়া গিয়াছে।

“পাছে অন্য কেহ আসিয়া পড়ে, এ জন্য তখন আর কিছু করিলাম না— কক্ষের কবাট বন্ধ করিয়া ফিরিয়া আসিলাম। রাত্রিতে সকলে ঘুমাইলে, প্রদীপ লইয়া কক্ষের ভিতর হইতে অর্গলবদ্ধ করিয়া দিয়া সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রবেশ করিলাম। প্রস্তর ও ইষ্টকনির্মিত সুড়ঙ্গ, অতিশয় সংকীর্ণ ও অনুচ্চ, মস্তক অবনত করিয়া চলিতে হয়। অর্ধ ক্রোশান্তরে বায়ুপ্রবাহের জন্য কূপ আছে— সেই কূপ সকল লঙ্ঘন করিয়া অগ্রসর হইতে হয়। আমি এইভাবে বহুদূর পর্যন্ত গমন করিয়াও সুড়ঙ্গের শেষ পাইলাম না। প্রদীপের তৈল নিঃশেষ হইয়া আসিতেছিল, সে রাত্রিতে ভগ্নোদ্যমে ফিরিয়া আসিলাম। তারপর উপর্যুপরি পঞ্চরাত্র চেষ্টার পর ষষ্ঠরাত্রিতে সুড়ঙ্গের অপর প্রান্তে পৌঁছিলাম। কুক্কুটপাদ বিহারের অঙ্গনে গিয়া সুড়ঙ্গ শেষ হইয়াছে…”

সংহত নিশ্বাসে সোমদত্তা বলিল, “তারপর?”

নিশ্বাস ফেলিয়া অকিঞ্চন কহিলেন, “কুক্কুটপাদ বিহারের পূর্বশ্রী আর নাই, এখন উহা জনহীন ভগ্নপ্রায়, শ্বাপদের বাসভূমি। কিন্তু গোতমের করুণার উৎস এখনো শতমুখে উৎসারিত হইতেছে। তাই ভগবান পথ দেখাইয়া দিলেন। আমি ফিরিয়া আসিয়া সান্ধিবিগ্রহিককে সংবাদ দিলাম, বলিলাম, সংঘের পথেই বুভুক্ষিতের ক্ষুধা নিবারণ হউক।”

ভিক্ষু নীরব হইলেন। সোমদত্তা নতমুখে চিন্তা করিতে লাগিল। কিছুক্ষণ এইভাবে কাটিবার পর ভিক্ষু আসন ত্যাগ করিয়া উঠিবার উপক্রম করিলেন। তখন সোমদত্তা যুক্তপাণি হইয়া বলিল, “শ্রীমন্‌, আর একটি প্রশ্ন আছে। এই রাজপুরী যিনি নির্মাণ করিয়াছিলেন, তিনি কি বৌদ্ধ ছিলেন?”

অকিঞ্চন কহিলেন, “হাঁ, শুনিয়াছি, অশোক প্রিয়দর্শী এই পুরী নির্মাণ করাইয়াছিলেন, সংঘারামও তাঁহারই প্রতিষ্ঠিত।”

সোমদত্তা প্রণাম করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “ভগবন্‌, আশীর্বাদ করুন, যেন পূর্ণমনোরথ হইতে পারি।”

হাস্যমুখে অকিঞ্চন কহিলেন, “সুমঙ্গলে, গোতমের ইচ্ছায় তোমার মনস্কাম সিদ্ধ হইবে— গৌতম অন্তর্যামী।”

সংঘস্থবির বিদায় হইলে সোমদত্তা কক্ষমধ্যে পদচারণ করিতে করিতে ভাবিতে লাগিল। দীর্ঘকাল গভীর চিন্তা করিল। ধর্মচক্র! ধর্মচক্র! কিন্তু পুরীমধ্যে কোথাও তো ধর্মচক্র নাই। বুদ্ধের মূর্তি, ধর্মচক্র প্রভৃতি যাহা ছিল, তাহা অপসারিত করিয়া তৎপরিবর্তে দেবমূর্তি স্থাপিত হইয়াছে।

ভাবিতে ভাবিতে অজ্ঞাতসারে তাহার চক্ষু ঊর্ধ্বে নিপতিত হইল। তখন বিস্ফারিত নেত্রে স্তম্ভিত বক্ষে সোমদত্তা দেখিল, উচ্চ ছাদের মধ্যস্থলে রক্তপ্রস্তরে উৎকীর্ণ ধর্মচক্র— এবং তাহার কেন্দ্রমধ্যে ক্ষুদ্র সুগোল একটি ছিদ্র!

বহুক্ষণ তদাবস্থ থাকিবার পর সোমদত্ত ছুটিয়া গিয়া জয়ন্তীকে ডাকিল। উত্তেজিত কণ্ঠে কহিল, “জয়ন্তী, শীঘ্র যা— অস্ত্রাগার হইতে ধনুর্বাণ লইয়া আয়! জিজ্ঞাসা করিলে বলিস্‌, মহাদেবী সোমদত্তা লক্ষ্যবেধ শিক্ষা করিবেন।”

শব্দতরঙ্গে অন্ধকার পরিপূর্ণ করিয়া বাঁশি বাজিতেছিল। সোমদত্তা প্রদীপের সম্মুখে বসিয়া করতলে চিবুক রাখিয়া এই দূরাগত বংশীধ্বনি শুনিতেছিল। আমি প্রাকার-কুড্য আশ্রয় করিয়া দাঁড়াইয়া ছিলাম।

বাঁশি প্রথমে বসন্ত-রাগ ধরিল; তারপর কিছুক্ষণ গুর্জরী-রাগ লইয়া ক্রীড়া করিয়া আবার বসন্ত-রাগে ফিরিয়া আসিল। শেষে এই দুই রাগ ছাড়িয়া বাঁশি মালকোষ ধরিল। কত নিপুণ সুরের কৌশল, কত মীড়-গমক-ঝংকার, কত তান-লয়ের পরিবর্তন দেখাইল। তারপর সহসা বাঁশি স্তব্ধ হইল।

“বাঁশি কি বলিল?”

সোমদত্তা যেন তন্দ্রার ঘোর হইতে জাগিয়া উঠিল। অতি দীর্ঘ এক নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিল, “তুমি যাহা চাও পাইবে। চন্দ্রবর্মা তোমাকে মগধের ক্ষত্রপ নিযুক্ত করিবেন। আগামী অমাবস্যার রাত্রিতে দ্বিতীয় প্রহর ঘোষিত হইবার পর আমি এই প্রদীপ দ্বারা রাজপুরীতে অগ্নিসংযোগ করিব। অগ্নি যখন ব্যাপ্ত হইয়া আকাশ লেহন করিবে, সেই সময় তুমি গোতম-দ্বারের অর্গল খুলিয়া দিবে। রাজপ্রাসাদে অগ্নিসংযোগই সংকেত; এই সংকেত পাইয়া চন্দ্রবর্মার সেনা দুর্গপ্রবেশের জন্য প্রস্তুত থাকিবে, তুমি দ্বার খুলিয়া দিলেই তাহারা প্রবেশ করিবে। পৌরজন রাজপুরী রক্ষার্থ ব্যস্ত থাকিবে, সেই অবসরে চন্দ্রবর্মা বিনা বাধায় পাটলিপুত্র অধিকার করিবেন।”

আমি উত্তেজিত হইয়া বলিলাম, “অমাবস্যার রাত্রি? তার তো বিলম্ব নাই— আগামী পরশ্ব!”

“হাঁ। অধিক বিলম্বে ভয় আছে, লিচ্ছবিগণ আসিয়া পড়িতে পারে।”

ইহার পর সোমদত্তা আবার মৌন অবলম্বন করিল, করলগ্নকপোলে নিষ্পলক দৃষ্টিতে দীপশিখার দিকে চাহিয়া বসিয়া রহিল। আমিও সহসা কি কথা বলিব ভাবিয়া পাইলাম না, মানসিক উত্তেজনা রসনাকে যেন জড় করিয়া দিল। তথাপি চেষ্টা করিয়া কহিলাম, “বাঁশি তো রাগ-রাগিণীর আলাপ করিল, তুমি এত কথা বুঝিলে কি করিয়া?”

সোমদত্তা অন্যমনে কহিল, “ঐ রাগ-রাগিণীতে সংযুক্ত কথাগুলা আমার জানিত। যিনি বাঁশি বাজাইতেছিলেন, তিনি আমার গীতাচার্য ছিলেন।”

অতঃপর আবার দীর্ঘ নীরবতা বিরাজ করিতে লাগিল। কাহারও মুখে কথা নাই। এই সুকঠিন মৌন আর সহ্য করিতে না পারিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি ভাবিতেছ?”

সোমদত্তা মুখ তুলিয়া বলিল, “ভাবিতেছি, কি অপরিমেয় শক্তি এই ক্ষুদ্র মৃৎপ্রদীপের! এত তুচ্ছ, ভঙ্গুর— মাটিতে পড়িলে ভাঙিয়া শতখণ্ড হইবে; অথচ একটা রাজ্য ধ্বংস করিবার শক্তি ইহার আছে। এমনি কতশত ছার মৃৎপ্রদীপ কেবল রূপশিখার অনলে সংসার ভস্মীভূত করিতেছে!”

আমি তাহার বাক্যের মর্ম বুঝিয়া হস্তধারণপূর্বক বলিলাম, “মৃৎপ্রদীপ নয়, সোমদত্তা, তুমি রত্নপ্রদীপ! তোমার দীপ্তিতে মগধ আলোকিত হইবে।”

সোমদত্তা উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, “আমি শ্মশানের আলো!… এখন চলিলাম, সেই অমাবস্যার রাত্রিতে আবার সাক্ষাৎ হইবে। চন্দ্রবর্মাকে সঙ্গে লইয়া প্রাসাদে যাইও, আমি মন্ত্রগৃহে প্রতীক্ষায় থাকিব।”

আমি তাহাকে সাদরে নিকটে টানিয়া লইয়া বলিলাম, “সেই দিন আমাদের মনোরথ পূর্ণ হইবে!”

ঈষৎ হাসিয়া সোমদত্তা বলিল, “হাঁ, সেই দিন আমার মনোরথ পূর্ণ হইবে।”

মহারাজ চন্দ্রগুপ্ত সোমদত্তার কক্ষে রাত্রিকালে নিদ্রা যাইতেছিলেন। অকস্মাৎ তীব্র শ্বাসরোধকর ধূমের গন্ধে তাঁহার নিদ্রাভঙ্গ হইল। চক্ষু না খুলিয়াই ডাকিলেন, “সোমদত্তা!” উত্তর পাইলেন না। তখন নিদ্রাকষায়নেত্র উন্মীলন করিয়া দেখিলেন, শয্যায় সোমদত্তা নাই। কক্ষের চারিদিকে চাহিলেন, সোমদত্তাকে দেখিতে পাইলেন না।

বাহিরে তখন সমস্ত পুরী জাগিয়া উঠিয়াছে। সদ্যোত্থিত নারীদের ভীত চিৎকার, গৃহপালিত ময়ূর শারিকা প্রভৃতি পক্ষীদের সচকিত আর্তস্বর এবং সর্বোপরি বিস্তারশীল অগ্নির গর্জন নৈশ বায়ুকে বিলোড়িত করিতেছে। দারুপ্রাসাদে আগুন লাগিলে রক্ষা করিবার কোনও উপায় নাই, পলায়ন করিয়া আত্মরক্ষা করাই একমাত্র পথ। পুরীস্থ সকলে মহাকোলাহল করিয়া নিজ নিজ মূল্যবান দ্রব্য যাহা পাইতেছে, লইয়া পলাইতেছে। কে পড়িয়া রহিল, রাজা-রানী কে মরিল কে বাঁচিল, কাহারও দেখিবার অবসর নাই। নিজের প্রাণ বাঁচাইবার জন্য সকলেরই উগ্র বাহ্যজ্ঞানশূন্য ত্বরা।

অগ্নি ক্রমশ আরও ব্যাপ্ত হইতে লাগিল, এক প্রাসাদ ছাড়িয়া সংলগ্ন প্রাসাদসকল আক্রমণ করিল। বায়ুর বেগ বাড়িয়া গেল। অমাবস্যা রাত্রির মসীতুল্য অন্ধকার এই ভীষণ অগ্নিকাণ্ডে যেন বিদীর্ণ শতখণ্ড হইয়া গেল। বহুদূর পর্যন্ত নগর রক্তাভ আলোকে উদ্ভাসিত হইল।

নাগরিকগণ জাগিয়া উঠিয়া কোলাহল করিতে করিতে রাজপুরীর দিকে ছুটিল। উত্তেজিত বিহ্বল নর-নারী স্খলিতবসনে মুক্ত-কেশে বাহ্যজ্ঞানশূন্যভাবে জ্বলন্ত রাজ-প্রাসাদের চতুর্দিকে সমবেত হইতে লাগিল।

সহসা বহুদূরে সম্মিলিত সহস্রকণ্ঠে মহাজয়ধ্বনি শ্রুত হইল। রাজপুরীর চারিপাশে সমবেত নাগরিকগণ ঊর্ধ্বমুখে অনলোল্লাস দেখিতেছিল, তাহার মধ্য হইতে কে একজন চিৎকার করিয়া বলিল, “পালাও! পালাও! নগরে শত্রু প্রবেশ করিয়াছে!”— অমনই বিক্ষুব্ধ জনতা উন্মত্তের ন্যায় চারিদিকে দৌড়িতে আরম্ভ করিল। কেহ ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিতে ছুটিতে পড়িয়া গিয়া জানু ভাঙিল, কেহ জনমর্দের চরণতলে পড়িয়া পিষ্ট হইয়া গেল। ক্রন্দন, হাহাকার এতক্ষণ রাজপুরীর মধ্যে নিবদ্ধ ছিল, এবার নগরময় ছড়াইয়া পড়িল।

সোমদত্তা তখন কোথায়?

সোমদত্তা তখন আলুলায়িত কুন্তলে, লুণ্ঠিত বসনে পট্টমহাদেবীর প্রাসাদে প্রবেশ করিতেছে। কুমারদেবীর ভবনে তখনও ভালো করিয়া আগুন লাগে নাই, কিন্তু দাসী, কিঙ্করী, প্রহারিণী— যে যেখানে ছিল সকলে পলাইয়াছে। কুমারদেবীর অরক্ষিত শয়নকক্ষে প্রবেশ করিয়া সোমদত্তা দেখিল, বিস্তৃত শয্যার উপর পুত্রকে বুকের কাছে লইয়া তিনি তখনও নিদ্রিতা।

সোমদত্তা সবলে তাঁহার অঙ্গে নাড়া দিয়া বলিল, “দেবী, উঠুন, উঠুন— প্রাসাদে আগুন লাগিয়াছে!”

কুমারদেবী চুক্ষ মুছিয়া শয্যায় উঠিয়া বলিলেন, “কে?”

“আমি, সোমদত্তা। আর বিলম্ব করিবেন না, শীঘ্র শয্যাত্যাগ করুন”— বলিয়া ঘুমন্ত সমুদ্রগুপ্তকে ক্রোড়ে তুলিয়া লইতে গেল।

কুমারদেবীর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ও কঠিন হইয়া উঠিল। তিনি বলিলেন, “আমার পুত্রকে স্পর্শ করিও না। দাসীরা কোথায়?”

“কেহ নাই, সকলে প্রাণভয়ে পলাইয়াছে।”

“মহলে কি করিয়া আগুন লাগিল?”

আর গোপন করিবার প্রয়োজন ছিল না। সোমদত্তা স্থিরদৃষ্টিতে কুমারদেবীর মুখের পানে চাহিয়া বলিল, “আমি মহলে আগুন দিয়াছি।”

কুমারদেবী চিৎকার করিয়া কহিলেন, “স্বৈরিণী! তাহা জানি। যখন বৌদ্ধ ভিক্ষুকে ঘরে আনিয়াছিস্‌ তখনি তোর অভিসন্ধি বুঝিয়াছি।”

সোমদত্তা কহিল, “অজ্জা, ক্রোধে অন্ধ হইয়া নির্দোষের প্রতি দোষারোপ করিবেন না। সেই বৌদ্ধ ভিক্ষুর প্রসাদেই আজ আপনাদের প্রাণরক্ষা করিতে পারিব। এখন আসুন, পুরী এতক্ষণে ভস্মসাৎ হইল। আর বিলম্ব করিলে বুঝি আপনাদের বাঁচাইতে পারিব না।”

“তুই বাঁচাইবি? কেন, আমি কি আত্মরক্ষা করিতে জানি না?”

“না অজ্জা, আজ আমি ভিন্ন আর কেহ আপনাদের বাঁচাইতে পরিবে না।”

“তার অর্থ?”

“তার অর্থ চন্দ্রবর্মার সেনা দুর্গে প্রবেশ করিয়াছে, এতক্ষণে বোধ করি রাজপুরী ঘিরিল।”

কুমারদেবীর চক্ষু দিয়া অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বাহির হইতে লাগিল, “ডাকিনী! এ তোর কার্য; তুই মগধরাজ্য ছারখারে দিলি!”

সোমদত্তা স্থিরভাবে বলিল, “স্বীকার করিলাম। কিন্তু আর বিলম্ব করিলে কুমারকে বাঁচাইতে পারিব না। ঐ দেখুন, অগ্নি প্রাসাদ বেষ্টন করিয়াছে।”

এই সময় অর্ধচন্দ্রাকৃতি বাতায়নপথে অগ্নির আরক্ত লোলরসনা ও কুণ্ডলিত ধূমোদাগার কক্ষে প্রবেশ করিল।

সোমদত্তা সমুদ্রগুপ্তকে ক্রোড়ে তুলিয়া লইয়া বলিল, “আজ আমার স্বামীর বংশধরকে বাঁচাইব বলিয়া আসিয়াছি, নহিলে আসিতাম না। আপনি থাকিতে হয় থাকুন, আমি চলিলাম”— বলিয়া দ্বারের দিকে অগ্রসর হইল।

কুমারদেবী ছুটিয়া আসিয়া তাহার বাহু ধরিলেন, বলিলেন, “রাক্ষসী, ছাড়িয়া দে, আমার পুত্রকে ছাড়িয়া দে!”

সোমদত্তা প্রজ্বলিত নয়নে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “দুর্ভাগিনী, নিজের ইষ্ট বুঝিতে পার না? আমার স্বামীর পুত্র কি আমার পুত্র নয়? এ রাজ্যে আগুন আমি জ্বালি নাই, জ্বালিয়াছে তোমার দুরন্ত অন্ধ অভিমান। সেই আগুনে তুমি পুড়িয়া মর!”

কুমারদেবীর হাত ছাড়াইয়া পুত্র বুকে লইয়া সোমদত্তা ধূম্রান্ধকার অলিন্দের ভিতর দিয়া ছুটিয়া চলিল। কাঁদিতে কাঁদিতে উন্মাদিনীর ন্যায় কুমারদেবী তাহার পশ্চাত চলিলেন।

নিজ শয়নকক্ষে ফিরিয়া আসিয়া সোমদত্তা দেখিল, রাজা অভিভূতের ন্যায় শয্যাপার্শ্বে বসিয়া আছেন— চতুর্দিকে কি ঘটিতেছে, তাঁহার যেন কোনও ধারণা নাই। ঘর ধূমাচ্ছন্ন— ঘরের চারিকোণে চারিটি সুবর্ণ-প্রদীপ তখনও ক্ষীণ আলোক বিস্তার করিয়া জ্বলিতেছে।

হাঁপাইতে হাঁপাইতে পুত্রকে স্বামীর ক্রোড়ে ফেলিয়া দিয়া সোমদত্তা ছুটিয়া গিয়া ধনুর্বাণ লইয়া আসিল। ভালো দেখা যায় না, দুই চক্ষু বহিয়া অশ্রুধারা ঝরিতেছে, সোমদত্তা ধর্মচক্রের মধ্যস্থল লক্ষ্য করিয়া শরসন্ধান করিল। লক্ষ্যভ্রষ্ট শর পাথরে লাগিয়া ফিরিয়া আসিল। আবার শরনিক্ষেপ করিল, ব্যর্থ শর আবার প্রতিহত হইয়া ভূমিতে পড়িল। অদম্য ক্রন্দনের আবেগে সোমদত্তার বক্ষ ফাটিয়া যাইবার উপক্রম হইল। তবে কি গুপ্তদ্বার খুলিবে না?

এদিকে ঘরের মধ্যে অগ্নির অসহ্য উত্তাপ উত্তরোত্তর বাড়িতেছে। রাজা এবং কুমারদেবী নির্বাক্‌ নিষ্পলক হইয়া সোমদত্তার এই উন্মত্তবৎ কার্য দেখিতে লাগিলেন। সোমদত্তা অসীম বলে আপনাকে সংযত করিয়া পুনশ্চ ধনুর্বাণ তুলিয়া লইল। লক্ষ্যবস্তু নিকটেই কিন্তু ভালো করিয়া দেখা যায় না, হাত কাঁপে, চক্ষু কূলে কূলে ভরিয়া উঠে। বহুক্ষণ ধরিয়া, অনেকবার চক্ষু মুছিয়া, অতি সাবধানে লক্ষ্য স্থির করিয়া সোমদত্তা তীর ছুঁড়িল। এবার আর তীর ফিরিয়া আসিল না— ধর্মচক্রের মধ্যস্থলে বিঁধিয়া রহিল। সোমদত্তা ধনু ফেলিয়া দিয়া একবার ক্ষণকালের জন্য মাটিতে লুটাইয়া পড়িল।

কিন্তু পরক্ষণেই চক্ষু মুছিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। কুমারদেবীর নিকটে গিয়া বলিল, “অজ্জা, এইবার স্বামিপুত্র লইয়া এই সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রবেশ করুন। সুড়ঙ্গ নগর বাহিরে কুক্কুটপাদ বিহারে গিয়া শেষ হইয়াছে। সেখানে শত্রু নাই, সেখান হইতে সহজেই নিরাপদ স্থানে যাইতে পারিবেন।”

চন্দ্রগুপ্ত সুড়ঙ্গমুখের দিকে চাহিয়া বসিয়া ছিলেন, এতক্ষণে প্রথম কথা কহিলেন, “নগরের বাহিরে যাইবার প্রয়োজন কি?”

সোমদত্তা কহিলে, “প্রয়োজন আছে। শত্রু নগর অধিকার করিয়াছে।”

তখন পুত্র লইয়া দুইজনে সুড়ঙ্গে প্রবেশ করিলেন। সোমদত্তা চন্দ্রগুপ্তের চরণে মস্তক রাখিয়া প্রণাম করিয়া কহিল, “প্রিয়তম! এইবার বিদায় দাও।”

সহসা চন্দ্রগুপ্ত যেন তাঁহার সমস্ত চেতনা ফিরিয়া পাইলেন; ভীষণ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সোমদত্তা, তুমি আসিবে না?”

সোমদত্তা দুই হাতে মুখ ঢাকিল; বলিল, “না প্রিয়তম, আমি আর তোমার সঙ্গে যাইবার যোগ্য নহি। কেন নহি, তাহা দেবীর মুখে শুনিও। চন্দ্রবর্মা আমার পিতা— এই কথা মনে করিয়া যদি পারো, আমাকে ক্ষমা করিও। তোমরা যাও— আমি ভিন্ন পথে যাইব।”

হৃদয়-বিদারক স্বরে চন্দ্রগুপ্ত ডাকিলেন, “সোমদত্তা!” দুই হস্তে কর্ণ আবরণ করিয়া সোমদত্তা কাঁদিয়া উঠিল, “না, না, ডাকিও না— আমি যাইতে পারিব না। আমায় মরিতে হইবে। প্রাণাধিক, আবার জন্মান্তরে দেখা হইবে, তখন তোমার সোমদত্তাকে সঙ্গে লইও।”

এই বলিয়া সবলে টানিয়া সুড়ঙ্গের পাষাণ-দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। চন্দ্রগুপ্তের মুখনিঃসৃত অর্ধোচ্চারিত বাণী পাষাণ-প্রাচীরে লাগিয়া স্তব্ধ হইয়া গেল!

তখন সেই উত্তপ্ত হর্ম্যতলে পড়িয়া, বসুধা আলিঙ্গন করিয়া, কেশ বিকীর্ণ করিয়া, ভূতলে ললাট প্রহত করিয়া সোমদত্তা কাঁদিল।

কিন্তু তবু অগ্নি নিবিল না।

এক হস্তে মুক্ত তরবারি, অন্য হস্তে প্রজ্বলিত উল্কা লইয়া দুর্গাবরোধকারী সেনা গোতম-দ্বার দিয়া প্রবেশ করিল। তাহাদের পুরোভাগে লৌহবর্মাবৃত ধাতুনির্মিত শিরস্ত্রাণধারী ভীষণাকৃতি স্বয়ং চন্দ্রবর্মা। দ্বারের প্রহরীদিগকে পূর্বেই সরাইয়া দিয়াছিলাম, সুতরাং একবিন্দুও রক্তপাত হইল না।

চন্দ্রবর্মা আমাকে দেখিয়া পরুষকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমিই বিশ্বাসঘাতক দ্বারপাল?”

কথার ভাবটা ভালো লাগিল না। যাহার জন্য বিশ্বাসঘাতকতা করিলাম, সে-ই বিশ্বাসঘাতক বলে! যাহা হউক, বিনীত কণ্ঠে বলিলাম, “হাঁ আমিই। সম্রাটের জয় হউক।”

চন্দ্রবর্মা নিষ্করুণ আরক্ত দুই চক্ষু আমার মুখের উপর স্থাপন করিয়া মনে মনে কি যেন গবেষণা করিলেন, তারপর বলিলেন, “ভালো, সর্বাগ্রে পথ দেখাইয়া রাজপ্রাসাদে লইয়া চল।”

পথ দেখাইয়া লইয়া যাইবার কোনও প্রয়োজন ছিল না। বিরাট অনলস্তম্ভের মতো প্রাসাদ তখন জ্বলিতেছে— সমস্ত নগর আলোকিত করিয়াছে। আপনার প্রভায় রাজপুরী স্বয়ংপ্রকাশ।

সেনাদলের অগ্রে অগ্রে আমি চলিলাম। পথে কেহ গতিরোধ করিবার চেষ্টা করিল না, যে সম্মুখে পড়িল চৈত্রের বায়ুতাড়িত শুষ্কপত্রের মতো নিমেষমধ্যে বিপরীত মুখে অন্তর্হিত হইল।

প্রাসাদের শূন্য তোরণ পার হইয়া সদলবলে সম্মুখস্থ মন্ত্রগৃহে প্রবেশ করিলাম। অগ্নি তখনও মন্ত্রগৃহ পর্যন্ত সংক্রামিত হয় নাই, তবে দীর্ঘ জিহ্বা বিস্তার করিয়া অগ্রসর হইতেছে— অচিরাৎ গ্রাস করিবে।

বিশাল বহুস্তম্ভযুক্ত মন্ত্রগৃহ প্রায়ান্ধকার, জনশূন্য। কেবল তাহার মধ্যস্থলে সিংহাসনের বেদীর সম্মুখে সোমদত্তা দাঁড়াইয়া আছে। অশনিপূর্ণ বৈশাখী মেঘের ন্যায় তাহার মূর্তি; বক্ষে পৃষ্ঠে মুক্ত কৃষ্ণ কেশজাল, ললাটে রক্তরেখা, নয়নের কৃষ্ণতারকায় জ্বালাময় বিদ্যুৎ।

বহু মশালের দীপ্তিতে মন্ত্রগৃহ আলোকিত হইল। তখন সোমদত্তা চন্দ্রবর্মাকে দেখিতে পাইয়া দ্রুতপদে আসিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিল।

“বৎসে! কল্যাণী!”— বলিয়া চন্দ্রবর্মা সোমদত্তাকে পদপ্রান্ত হইতে তুলিলেন। ক্ষণকালের জন্য এই ভীষণ দুর্ধর্ষ যোদ্ধার কণ্ঠস্বরা যেন প্রসাদগুণ প্রাপ্ত হইল।

সোমদত্তা অবরুদ্ধ কণ্ঠে কহিল, “পিতা, আপনার কার্য সিদ্ধ হইয়াছে।”

চন্দ্রবর্মা বলিলেন, “পুত্রী, সে তোমারই জন্য! তোমার যোগ্য পুরস্কার আমি সযত্নে সঞ্চিত করিয়া রাখিয়ছি। এখন এই রত্নহার গ্রহণ কর।”— বলিয়া নিজ বক্ষ হইতে অমূল্য রশ্মিকলাপ মণিহার খুলিয়া সোমদত্তার হস্তে দিলেন।

সোমদত্তা হার দুই হন্তে ছিঁড়িয়া দূরে ফেলিয়া দিল; বলিল, “আর আমার পুরস্কারের প্রয়োজন নাই। আমার জীবনের সমস্ত প্রয়োজন শেষ হইয়াছে।”

চন্দ্রবর্মা বলিলেন, “সে কি! চন্দ্রগুপ্ত কোথায়?”

সোমদত্তা কহিল, “তা নয়, আমি বিধবা হই নাই। কিন্তু আমার স্বামীকে আর আপনি খুঁজিয়া পাইবেন না। তিনি পুরী ত্যাগ করিয়াছেন।”

“পুরী ত্যাগ করিয়াছেন! কোথায় গেল?”

“তাঁহাকে গুপ্তপথে দুর্গের বাহিরে পাঠাইয়াছি।”

“কন্যা, এ কার্য কেন করিলে?”

“দেব, এ ভিন্ন আমার আর অন্য পথ ছিল না। তিনি থাকিলে সকল কথা জানিতে পারিতেন, তাহা হইলে মরিয়াও আমার এ নরক-যন্ত্রণা শেষ হইত না। পিতা, আমার কিছুই নাই— সব গিয়াছে। নারীর যাহা কিছু মূল্যবান, যাহা কিছু প্রেয়, এক নরকের পশু তাহা হরণ করিয়াছে।”

অঙ্গারের মতো দুই চক্ষু সোমদত্তা আমার দিকে ফিরাইল। তর্জনী প্রসারিত করিয়া বিকৃতমুখে চিৎকার করিয়া কহিল, “এই নরকের পশু আমার সর্বস্ব হরণ করিয়াছে!”

অল্পকালের জন্য সমস্ত পৃথিবী যেন নীরব হইয়া গেল। আমি আমার হৃৎপিণ্ডের মধ্যে রক্তপ্রবাহের শব্দ শুনিতে পাইলাম। তারপর ব্যাঘ্রের মতো গর্জন করিয়া চন্দ্রবর্মা আসিয়া আমার কেশমুষ্টি ধারণ করিলেন। অন্য হস্তের অঙ্গুলিগুলা আমার চক্ষু উৎপাটিত করিবার জন্য অগ্রসর হইতেছিল, ক্রূর হাসি হাসিয়া সোমদত্তা কহিল, “পিতা, ক্ষণকাল অপেক্ষা করুন, আমি পুরস্কার লইব। এই পিশাচকে এখনি মারিবেন না, ইহাকে তিলে তিলে দগ্ধ করিয়া মারিবেন। দীর্ঘকাল ধরিয়া বিষকন্টকপূর্ণ অন্ধকূপে যেন এই নরাধম পচিয়া পচিয়া মরে, গলিত ক্রিমিপূর্ণ শূকরমাংস ভিন্ন যেন অন্য খাদ্য না পায়; মরিবার পূর্বে যেন ইহার প্রত্যেক অঙ্গ গলিয়া খসিয়া পড়ে। আমার আত্মা পরলোক হইতে দেখিয়া সুখী হইবে।”

চন্দ্রবর্মা আমার কেশ ছাড়িয়া দিয়া বলিলেন, “তাহাই করিব!…ইহাকে বাঁধিয়া রাখ।”

দশ জন মিলিয়া আমাকে বাঁধিয়া মাটিতে ফেলিল। তখন সোমদত্তা আমার নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল। আমার প্রতি অগ্নিপূর্ণ দুই চক্ষু মেলিয়া চাহিয়া থাকিয়া সে আমার মুখে একবার পদাঘাত করিল। তারপর চন্দ্রবর্মার নিকট ফিরিয়া গিয়া স্থির শান্ত স্বরে কহিল, “পিতা, এইবার পিতার কার্য করুন।”

চন্দ্রবর্মার বজ্রের মতো কণ্ঠস্বর কাঁপিয়া উঠিল, “কি কার্য বৎসে?”

সোমদত্তা বলিল, “এ দেহ আপনিই দিয়াছিলেন, আপনিই ইহার নাশ করুন।”

পাষাণ-স্তম্ভের মতো চন্দ্রবর্মা দাঁড়াইয়া রহিলেন।

সোমদত্তা পুনরায় কহিল, “আমার মন নিষ্কলুষ, এই দূষিত দেহ হইতে তাহাকে মুক্ত করিয়া পিতার কর্তব্য করুন।”

বহুক্ষণ পরে অস্ফুট কণ্ঠে চন্দ্রবর্মা বলিলেন, “সেই ভালো, সেই ভালো।”

সোমদত্তা তখন দুই হস্তে বক্ষের কঞ্চুলী ছিঁড়িয়া ফেলিয়া পিতার সম্মুখে নতজানু হইয়া বসিল।

চন্দ্রবর্মা দক্ষিণহস্তে সুতীক্ষ্ণ ভল্ল তুলিয়া লইয়া চতুর্দিকে চাহিয়া কর্কশভয়ানক কণ্ঠে কহিলেন, “সকলে শুন, আমার কন্যার দেহ অশুচি হইয়াছিল, আমি তাহা ধ্বংস করিলাম।”— বলিয়া দুই পদ পিছু হটিয়া গিয়া ভল্ল ঊর্ধ্বে তুলিলেন। সোমদত্তা উন্মুক্ত বক্ষে নির্ভীক নিষ্পলক দৃষ্টিতে পিতার মুখের প্রতি চাহিয়া রহিল।

আমি সভয়ে চক্ষু মুদিলাম।

পুনরায় যখন চক্ষু উন্মীলিত করিলাম, তখন দেখিলাম, রক্তচন্দন-চর্চিত শৈবালবেষ্টিত শ্বেত কমলিনীর মতো সোমদত্তার বিগতপ্রাণ দেহ মাটিতে পড়িয়া আছে।

১ বৈশাখ, ১৩৩৮